সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৪

মা - পাঠভাগ-২

৩০

‘আজাদ, কই যাস ?’ মা জিজ্ঞেস করেন ৷

‘এই তো, ইস্কাটনে’-আজাদ শার্টটা প্যান্টের ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে ৷

‘ইস্কাটনে ? ইস্কাটনে কার বাসায় ?’

‘আবুল খায়েরের বাসায় ৷ ক্রিকেট খেলতে ৷’

মা আশ্বস্ত হন ৷ দেশের অবস্থা খুবই খারাপ ৷ ইয়াহিয়া খান যে কী করছে, সে-ই জানে ৷ শেখ মুজিব ভোটে জিতেছে, তাকে তুমি গদি ছেড়ে দাও ৷ সে দেশ চালাক ৷ তা না ৷ ইয়াহিয়া চলছে ভুট্টোর কথামতো ৷ শেখ সাহেব কি সেটা মেনে নেবার মতো মানুষ! নাকি বাঙালিরা তাকে তা মানতে দেবে ৷ অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন শেখ সাহেব ৷ সবকিছু তার কথামতো চলছে ৷ যদি মুজিবর বলে, বিকালবেলা অফিস বসবে, তো বিকালবেলাই বসছে ৷ হরতাল হচ্ছে ৷ কিন্তু ইয়াহিয়া কারফিউ দিলে সেটা কেউ মানছে না ৷ রাতের বেলা মিছিল বের হচ্ছে ৷ মিছিলে গুলি চলছে ৷ কতজন যে গুলিতে মারা গেল, ইয়ত্তা নাই ৷ মায়ের বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে ৷ কত মা আজ ছেলে ছেলে বলে কাঁদছে ৷ মা বেঁচে থাকতে ছেলের মৃত্যু, এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কী আছে মায়ের কাছে ? আহা, আমার ছেলেটাকে সহিসালামতে রেখো মাবুদ ৷ অজানা আশঙ্কায় তাঁর বুকের ভেতরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে ৷

আজাদ বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে নিউ ইস্কাটন রোডে আবুল খায়েরের বাসার উদ্দেশে ৷ আবুল খায়ের দারুণ ক্রিকেটার ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের হয়ে ফার্স্ট ডিভিশনে খেলে নিয়মিত ৷ তাদের বাসার ছাদটাও যেন একটা ছোটখাটো ক্রিকেট মাঠ ৷ ওখানে বেশ ক্রিকেট প্রাকটিস করা চলে ৷ ক্রিকেটের পাশাপাশি চলে আড্ডা ৷ এ ছাড়া আর তাদের কী-ইবা করার আছে ৷ কলেজ, ইউনিভার্সিটি বন্ধ ৷ অফিস-আদালত বন্ধ ৷ রাস্তায় যানবাহন নাই ৷ শুধু আছে মিছিল আর মিটিং ৷ কত সভাই না হচ্ছে ৷ আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের, ন্যাপের, ছাত্র ইউনিয়নের দু গ্রুপের, কমিউনিস্টদের, লেখক-শিল্পীদের, মিটিংয়ের কোনো শুমার নাই ৷ ধারাবাহিক মিটিং প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে ৷ প্রত্যেকটাতে লোকসমাগম হচ্ছে প্রচুর ৷ ইতিমধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার নকশা করা হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে ছাত্রনেতারা সে পতাকা উত্তোলন করেছে আনুষ্ঠানিকভাবে, পতাকা ওড়ানো হচ্ছে চারদিকে, বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি-কে বেছে নেওয়া হয়েছে ৷ বামদলগুলো আহ্বান জানাচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে ৷ তারা জনযুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছড়াচ্ছে ৷ ছাত্ররাও শেখ মুজিবকে চাপ দিচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্যে ৷

সব ঠিক আছে ৷ কিন্তু আজাদরা কী করবে! তারা তো আর কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয় ৷ কোনো মিটিং মিছিল তাদের জন্যে বসে নাই ৷ তারা তাই ক্রিকেট খেলে আর আড্ডা দেয় ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসা থেকে নিউ ইস্কাটন, সামান্যই পথ ৷ হেঁটে যাওয়া চলে ৷ রাস্তাঘাট ফাঁকা ৷ শুধু বস্তির পিচ্চিদের একটা মিছিল দেখা যাচ্ছে ৷ তাদের স্লোগানও খুব মজার ৷ ‘ইয়াহিয়ার দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ ৷ দুই হাতে ছেঁড়া জুতা পরে নিয়ে তারা ডাম্বেলের মতো বাজাতে বাজাতে যাচ্ছে ৷

আবুল খায়েরদের বাসার ছাদে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই এসেছে ৷ ইব্রাহিম সাবের খোঁড়াচ্ছে ৷ খেলতে গিয়ে সে চোট পেয়েছে ৷ জুয়েল পরে এসেছে একটা নীল রঙের টিশার্ট ৷ চোখে একটা সানগ্লাস ৷ তাকে দেখাচ্ছে একেবারে ইংরেজি ছবির নায়কের মতো ৷ সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসাও কাছেই ৷ সেও এসে গেছে ৷ আশরাফুলও দারুণ ক্রিকেট খেলে ৷ হাবিবুল আলম আসে খানিকক্ষণ পরে ৷ তার বাসা দিলু রোডে ৷ সবাই কাছাকাছিই থাকে ৷ শুধু জুয়েলের বাসা হাটখোলা ৷

আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘জুয়েল, কেমন করে আসলি ?’

জুয়েল বলে, ‘কেমন কইরা আসলাম মানে!’

আজাদ বলে, ‘হরতাল না! গাড়িঘোড়া কিছু আছে নাকি!’

‘পালকি চইড়া আসলাম ৷ ইয়াহিয়া খানের মাইয়ার লগে আমার বিয়ার কথা চলতেছে না ৷ পালকি কইরা নিয়া আইল ৷’

আজাদ বলে, ‘আরে আমি জিগাই হেঁটে আসলি নাকি!’

জুয়েল বলে, ‘না, ক্রলিং কইরা আসলাম ৷ যুদ্ধ শুরু হইলে ক্রলিং করতে হইব তো ৷ তাই হাটখোলা থাইকা চার মাইল রাস্তা ক্রলিং কইরা আসলাম ৷’

আজাদ বলে, ‘আরে জুয়েল খালি পেঁচায় ৷’

কাজী কামাল আসে ৷ লম্বা একটা ছেলে ৷ বাস্কেটবল খেলোয়াড়দের লম্বা হতে হয় ৷ আজাদ ভাবে-অথচ ছোটবেলায় কামাল আর আমি একই সমান ছিলাম ৷

আবুল খায়ের বলে, ‘জুয়েল তো জোকসের হাঁড়ি ৷ উইকেটকিপিং করতে করতে জুয়েল এমন সব জোক্স বলে, ব্যাটসম্যান হাসতে হাসতে আউট হইয়া যায় ৷’

কামাল বলে, ‘একটা জোক ছাড় না জুয়েল ৷’

আবুল খায়ের বলে, ‘সুপারিরটা ক, জুয়েল সুপারিরটা ক ৷’

জুয়েল গা মোচড়ায়-’আরে এক জোক কয়বার কমু ৷ ইয়াহিয়া, আইয়ুব, ভুট্টো-তিনজন গেছে পরকালে ৷ ওইখানে প্রত্যেকরে কওয়া হইছে একটা কইরা ফল আনতে ৷ আইয়ুব খান নিয়া গেছে একটা সুপারি ৷ তার পিছন দিয়া সুপারি দিছে ঢুকাইয়া ৷ তারপর আসছে ইয়াহিয়া ৷ সে নিয়া গেছে কদবেল ৷ তখন হেরা কয় বলে এত বড় ফল আনছ ৷ সর্বনাশ করছ ৷ এইটা তোমার পিছন দিয়া ঢুকাইতে হইব ৷ শুইনা ইয়াহিয়া হাসে ৷ আরে ব্যাক্কল, হাসিস কেন ? ইয়াহিয়া কয়, আমি তো কদবেল আনছি ৷ এরপর ভুট্টো আসতেছে ৷ সে আনছে নারকেল ৷’

জুয়েলের কৌতুক শুনে সবাই হাসে ৷ নির্দোষ হাসি, তা বলা যাবে না ৷ ইয়াহিয়া আর ভুট্টোর শরীরের সঙ্গে বাংলার বাঁশগুলোর কোনো একটা সম্পর্ক স্থাপন করার বাসনায় প্রত্যেকের মন দোষযুক্ত হয়ে আছে ৷

আশরাফুল ব্যাট নিয়ে নেমে গেছে ছাদের ওপরেই ৷ খায়ের বল করছে ৷ খায়ের আশরাফুলকে সাবধান করে দেয়, ‘বল ছাদ থেকে পড়ে গেলে কিন্তু আউট ৷ খালি আউট না, ৬ রান মাইনাস ৷ আর রেলিংয়ে লাগলে ৪ ৷’

কিছুক্ষণ ক্রিকেট খেলা চলে ৷ তারপর আবার সবাই বসে রেলিংয়ের ওপরে ৷ আবার জমে ওঠে আড্ডা ৷ দেশের কী হবে ? ইয়াহিয়া আসলে কী চায় ? ইন্টার কন্টিনেন্টালে আলোচনার নামে কী হচ্ছে! শেখ মুজিব কি ভুল করছেন! ছাত্রনেতারা, চার খলিফা কেন তাহলে চাপ দিয়ে স্বাধীনতা ডিক্লেয়ার করাচ্ছেন না ৷

রুমী আসে ৷ এলিফ্যান্ট রোড থেকে হেঁটে আসায় তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে ৷ তার গাল দুটো মেয়েদের মতো দেখাচ্ছে ৷ আসলে সে হলো সর্বকনিষ্ঠ ৷ কিন্তু তার কথাবার্তায় একটা বুদ্ধিজীবী-বুদ্ধিজীবী ভাব আছে ৷ সে বলে, ‘এভাবে হবে না ৷ লড়াই করে স্বাধীনতা আনতে হবে ৷ একদিকে আলোচনার নামে প্রহসন চলছে, আরেকদিকে প্লেনে করে মিলিটারি আনছে ৷ আমার কিছু ভালো লাগছে না ৷ ঘটনা খুব খারাপ দিকে মোড় নিচ্ছে ৷ মাও সে তুংয়ের লাইন নিতে হবে ৷ গণযুদ্ধের রণনীতি বইয়ে আছে না…

জুয়েল তার কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আইসা পড়ছে আমাদের তাত্তি্বক ৷ শোনো, এক মাইয়া ৷ আমগো গাঁয়ের মাইয়া ৷ তার সাথে বিয়া হইছে এক প্রফেসরের ৷ মহাপণ্ডিত ৷ বাসর রাতে প্রফেসর সাব খালি লেকচার দেয় ৷ কয়, ফ্রয়েড বলেছেন… এইভাবে এক রাত যায়, দুই রাত যায়, ফ্রয়েড আর শেষ হয় না ৷ মাইয়া কয়, আপনের যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে তো… তাইলে লেকচার দেন ক্যান ?

প্রফেসর কয়, অহনও পূর্বরাগ চ্যাপ্টারই শেষ হয় নাই ৷ তারপর আইব ফোরপ্লে… তারপর… আস্তেধীরে আরো ২০০ পৃষ্ঠা পরে না অ্যাকশন… তা প্রফেসর সাহেব যখন ২০০ পৃষ্ঠা পড়ানো শেষ করলেন, মাইয়া তখন ৮ মাসের প্রেগন্যান্ট… প্রফেসর সাব কয় কেমনে হইল… আমি তো তোমারে টাচই করলাম না, মাইয়া কয় আপনে যে পড়াইছেন, এতেই হইয়া গেছে… প্রফেসর কয় হইতে পারে আমারই উচিত ছিল প্রিকশন লওয়া… ফ্যামিলি প্লানিং চ্যাপ্টার আগে না পড়ানোয় এই ভুলটা হইয়া গেছে… কী বুঝলা, থিয়োরি কপচাইবা না…’

রুমী বলে, ‘আমিও তো তাই বলি ৷ এখন আলোচনার সময় না, এখন চাই ডাইরেক্ট অ্যাকশন…’

এর মধ্যে এসে পড়েছে ফারুক ৷ সে বলে, ‘তোমরা লেফটিস্টরা যখন নানা রকমের থিয়োরি দিচ্ছ, বাংলার মানুষ কিন্তু তখন মুক্তির লাইনে অনেক দূর এগিয়ে গেছে, কম তো শুনলাম না, ভোটের আগে ভাত চাই, এখন শুনছি, এই লড়াই হলো দুই কুকুরের লড়াই, আসল কাজ হলো শ্রেণীশত্রু খতম করা, মানুষ এসবকে পাত্তা দেয় নাই, ছয় দফার পেছনে বঙ্গবন্ধুর পেছনে একযোগে দাঁড়িয়ে পড়েছে, এখন সামনে আর কোনো উপায় নাই, দেশ স্বাধীন হবেই, চারদিকে তো শুধু স্বাধীন বাংলার পতাকা…’

একজন বলে, ‘আরে ভোটের আগে ভাত চাই-এটা ভাসানী বলেছেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করেই, যাতে বাঙালি ভোট ভাগ না হয় সেজন্য তিনি সরে গেছেন, আসলে বঙ্গবন্ধু আর ভাসানীর সম্পর্ক তো গুরুশিষ্য, না হলে ধরো পিতাপুত্রের…

‘আচ্ছা, এত যে যুদ্ধ যুদ্ধ করতেছ, যুদ্ধ আরম্ভ হইলে কে কে যুদ্ধে যাবা ?’ একজন প্রশ্ন তোলে ৷

হাবিবুল আলম বলে, ‘আমি যাব ৷’

কাজী কামাল বলে, ‘আমিও যাব ৷’

জুয়েল বলে, ‘আমি সবার আগে থাকব ৷’

রুমী বলে, ‘আমাকে তো যেতেই হবে ৷ উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই…’

‘আজাদ, তুই কী করবি ?’

আজাদ বলে, ‘আমি মাকে গিয়ে বলব, মা, আমি যুদ্ধে যাব ৷ তুমি ‘না’ কোরো না ৷ মা যদি অনুমতি দেন, অবশ্যই যাব ৷ না দিলে কী করব, সেটা বলতে পারি না ৷ তোরা তো জানিসই, আমার মা বেঁচে আছে শুধু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে…’

আজাদ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পুরোটা আড্ডা নীরব হয়ে যায়, কারণ সবাই জানে আজাদের ব্যাপারটা, সবাই জানে এই ইস্কাটনের কোন বড়লোক বাড়ির ছেলে আজাদ, শুধু মায়ের সম্মান রক্ষার জন্যে মায়ের সঙ্গে মগবাজারের বাসায় একা পড়ে আছে ৷

সেই নীরবতা ভঙ্গ করে দূর থেকে মিছিলের স্লোগানের ধ্বনি ভেসে আসে, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো…’

৩১

আজাদ নিজেকে সব সময়ই ননপলিটিক্যাল বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করত ৷ তবে ২৫শে মার্চ রাতে সে মগবাজারে পিকেটিং করছিল, ব্যারিকেড দিচ্ছিল রাস্তায়, এ কথা কাজী কামালের মনে আছে ৷ স্পষ্ট সাক্ষ্য পাওয়া যায় জায়েদেরও ৷ জায়েদ বলে, ২৫শে মার্চ রাতে মগবাজারে আজাদের সঙ্গে আশরাফুলসহ মগবাজার ইস্কাটন এলাকার বন্ধুরাও ছিল ৷ হাবিবুল আলমের মনে আছে, সেও ছিল মগবাজারের মোড়েই ৷ তার সঙ্গে ছিল শেখ কামাল ৷ মেলা রাত পর্যন্ত ৷ আর ছিল জনতা ৷ ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ৷ সবার হাতে বাঁশের লাঠি ৷ রড ৷ পৌনে ১২টার দিকে শেখ কামাল চলে যায় ৷

আজাদের এ রাতে পিকেটিং করতে যাওয়ার পেছনে অন্যান্য কারণের সঙ্গে একটা প্রত্যক্ষ ব্যক্তিগত ক্ষোভও আছে ৷ আজাদ আর জায়েদ সম্প্রতি দিনের বেলা গিয়েছিল ফরাশগঞ্জে ৷ ওখানে আজাদের বাবার এক কর্মচারীর কাছ থেকে আজাদ মাসোহারার টাকা নিয়মিতভাবে তুলে থাকে ৷ অসহযোগের ভেতরে তার ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ যাওয়ায় একদিন হরতালের বিরতিতে আজাদ জায়েদকে নিয়ে গিয়েছিল ফরাশগঞ্জে, মাসোহারার টাকা তুলতে ৷ কর্মচারীটি টাকা দিতে আপত্তি জানিয়েছিল ৷ ওজর দেখিয়েছিল, ব্যাঙ্ক বন্ধ, হাতে টাকা নাই ৷ জায়েদ ‘হারামজাদা’ বলে চেয়ার তুলে ছুড়ে মেরেছিল কর্মচারীটার মাথা বরাবর ৷ তাতে কাজ হয়েছিল ৷ কর্মচারী বাপ বাপ বলে টাকা তুলে দিয়েছিল আজাদের হাতে ৷ দুজন টাকা নিয়ে বেবিট্যাক্সিতে ফিরছিল ৷ পথে একটা জায়গায় ব্যারিকেড ৷ তারা ব্যারিকেডের ওখানে নেমে রাস্তা পার হবে হেঁটে, ঠিক করেছিল ৷ ঠিক এই সময় কতগুলো পাঞ্জাবি সৈন্য তাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে এসেছিল ৷ বলেছিল, ব্যারিকেড নিকাল দো ৷ তারা তাদের রাইফেলের বাঁট দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে বাধ্য করেছিল রাস্তার ব্যারিকেড অপসারণের কাজ করতে ৷ কাজটা করতে আজাদের মোটেও ভালো লাগছিল না ৷ আর হারামজাদা ধরনের গালি, সঙ্গে রাইফেলের বাঁটের মৃদু প্রহার মোটেও সম্মানজনক বলে তার কাছে মনে হচ্ছিল না ৷ সে দাঁতে দাঁত ঘষে পণ করেছিল, সুযোগ পেলেই এ বেটা পাঞ্জাবিদের ছ্যাঁচা দিতে হবে ৷

আসলে আজাদ, আশরাফুল, কাজী কামাল, হাবিবুল আলম, জুয়েল-এরা সবাই বা এদের মতো ঢাকার আরো অসংখ্য তরুণ, প্রায় সব তরুণ-যুবক অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিল, তার পেছনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্য নয়, বরং কাজ করেছিল স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা, স্বতঃস্ফূর্ত দায়িত্ববোধ, যৌবনের স্বাভাবিক অপরাজেয় অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদী চেতনা ও স্বভাবধর্ম ৷ হেলাল হাফিজের ওই সময়ে রচিত ওই কবিতাটাতেই এই ব্যাপারটা অভ্রান্তভাবে ধরা পড়েছে :

এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়

২৫শে মার্চ ১৯৭১-এও যৌবনের স্বভাবধর্ম মিছিলে ব্যারিকেডে টেনে নিয়ে এসেছিল আজাদকে, জায়েদকে, টগরকে, কাজী কামালকে, হাবিবুল আলমকে, সৈয়দ আশরাফুল হককে, লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসীকে ৷ ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে পাকিস্তানি নেতাদের আলোচনা ভেঙে গেছে, ২৩শে মার্চ দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়ে গেছে, বঙ্গবন্ধু নিজে তার বাসভবনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেছেন ৷ ২৪শে মার্চ দিনটা ছিল থমথমে ৷ মানুষ রাস্তা পাহারা দিচ্ছে, আর স্থানে স্থানে গুলি হচ্ছে, সারা বাংলায় জনা পঞ্চাশেক মানুষ মারা গেছে সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে ৷ এদিকে আওয়ামী লীগ ২৬ তারিখ থেকে সর্বাত্মক হরতাল ডেকেছে, ২৫শে মার্চ রাতে তারই সমর্থনে ছাত্রজনতা রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে ৷

আজাদের মা বসে আছেন ভাত নিয়ে ৷ এশার নামাজ পড়া হয়ে গেছে ৷ তিনি তেলাওয়াত করেন প্রতিটা ওয়াক্তের নামাজের শেষে, জায়নামাজে বসে, আজ তাও সমাপ্ত ৷ রাত বাড়ছে ৷ আজাদ কেন এখনও ফেরে না ৷ জায়েদ ফিরে এসেছে ৷ সে উত্তেজিত-’আম্মা, একটা পানির ট্যাঙ্ক দিয়া ব্যারিকেড দিছে ৷ মগবাজারের মোড়ে ৷ হেভি হইছে ৷ অহন ইটা ফেলতাছে ৷ দাদারা স’মিল থাইকা গাছের গুঁড়ি আনতে গেছে ৷ গাছের গুঁড়ি ফেললে ব্যারিকেডটা সলিড হইব ৷’

মায়ের কেমন যেন ভয় ভয় লাগে ৷ কখন কী হয় ? যদি মিলিটারি গুলি করে!

রাত বাড়তে থাকলে রাস্তায় ভারি যানবাহন চলাচলের শব্দ শোনা যায় ৷ জায়েদ বাইরে থেকে খোঁজ নিয়ে এসে বলে, ‘ট্যাংক নামায়া দিছে ৷ বুলডোজার নামাইছে ৷’

গুলির শব্দ ৷ গোলার শব্দ ৷ জানালায় দাঁড়ালে আকাশে দেখা যাচ্ছে, আলো- বোমা ছোড়া হচ্ছে আকাশে ৷ সমস্ত আকাশ হঠাৎ হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে ৷ আর শোনা যাচ্ছে সম্মিলিত মানুষের হৈ-হল্লা ৷ এত জোরে জোরে আওয়াজ হচ্ছে, যেন আজই কেয়ামত হয়ে যাবে ৷ মা বাসার সবাইকে খাটের নিচে শুইয়ে দেন ৷ কিন্তু নিজে বারবার ছুটে যান গেটের দিকে ৷ আজাদ কেন ফেরে না ৷ আজাদ কোথায় গেল ? তার কিছু হয় নি তো!

দরজায় ধাক্কার শব্দ ৷ মা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলেন ৷ আজাদ নয়, বাশার ৷ মা বলেন, ‘এসেছ বাবা ৷’

বাশার বলে, ‘বাইরের অবস্থা খারাপ ৷’

‘আজাদকে দেখেছ ?’

বাশার উদ্বিগ্ন-‘আজাদ আসেনি ? ঠিক আছে, আমি দেখি, ও কোথায় ?’

মা বলেন, ‘না বাবা, তুমি যেও না ৷ কোথায় খুঁজতে যাবে ?’

এই সময় আজাদ ফেরে ৷ বলে, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ৷ আর্মি নেমেছে ৷ মাইকে এনাউন্স করছে, যেখানেই ব্যারিকেড দেখবে, সেইখানেই গুলি চলবে ৷ আশপাশের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে ৷’

‘আরে, তোকে এত কিছু দেখতে শুনতে কে বলেছে! তুই মাটিতে শুয়ে পড়’-মা তাকে ধরে মেঝেতে শুইয়ে দেন ৷

বাড়ির সবাই মেঝেতে শুয়ে আছে ৷ বোমার আওয়াজ, মেশিনগানের আওয়াজ, রাইফেলের গুলির আওয়াজ, মানুষের আর্তনাদ, ভেসে ভেসে আসছে ৷ মনে হচ্ছে আকাশের সমস্ত মেঘ বিদ্যুৎ আর বজ্রসমেত ভেঙে পড়ছে পৃথিবীর ওপর ৷

আজাদ ওঠে ৷ জানালার ধারে যায় ৷ বাইরের আকাশে ট্রেসার হাউই উড়ছে মাঝে মধ্যে, আকাশ আলোকিত করে, আর চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা ৷ মা বকতে থাকেন, ‘আজাদ, জানালার ধারে যাস কেন, এদিকে আয় ৷ এদিকে আয় ৷ লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা পড় ৷ হে আল্লাহ, জালিমের জুলুম থেকে তুমি আমাদের রক্ষা করো ৷’

৩২

১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে, এই ঢাকা শহরে পাকিস্তানি জান্তা তার সামরিক বাহিনীকে ট্যাঙ্ক, কামান, মর্টারসহ নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে গণহত্যা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটাও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ আছে ৷ শুধু ২৫শে মার্চ রাতের ধ্বংসযজ্ঞ, নৃশংসতা, চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, কামান দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া ছাত্রাবাস, ছাত্রাবাস থেকে বের করে এনে কাতারবন্দি করে দাঁড় করিয়ে ছাত্রদের ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা, যেন তারা পিঁপড়ার সারি, আর তুমি অ্যারোসল স্প্রে করে মারলে শত শত পিঁপড়াকে, গণকবর খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া সেইসব লাশ, এখনও মারা না যাওয়া কোনো গুলিবিদ্ধ ছাত্রের মাটিচাপা পড়ে তলিয়ে যাওয়ার আগে মা বলে কেঁদে ওঠা শেষ চিৎকার, শিক্ষক-আবাসে ঢুকে নাম ধরে ডেকে ডেকে হত্যা করা শিক্ষকদের, তার শিশুসন্তানের সামনে, তার স্ত্রীর সামনে, কামানের তোপ দাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া পুড়িয়ে ভস্মীভূত করা সংবাদপত্র অফিস আর খুন করে ফেলা সাংবাদিকদের, আর আগুন লাগিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া জনবসতি, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে মা আর তার স্তনবৃন্তে মুখ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়া শিশু, ভেতরে পুড়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ, তার মুখ থেকে এখনও শেষ হয়নি বিপদতাড়ানিয়া আজানের আল্লাহু আকবার ধ্বনি, মাংস পোড়া গন্ধে ভারি হয়ে উঠছে বাতাস, আর সে-মাংস মানুষের, আর ভীতসন্ত্রস্ত পলায়নপর মানুষদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা, পুলিশ ব্যারাকে আগুন লাগিয়ে জীবন্ত দগ্ধ করে মারা বাঙালি পুলিশদের, ইপিআর ব্যারাকে হামলা চালিয়ে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গুলি করে মারা বাঙালি ইপিআর সদস্যদের, সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘেরাও করে ভেতরে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের নির্বিচারে পাখি মারার মতো করে হত্যা করা, লাশে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, যেন হঠাৎ মাছের মড়ক লাগায় নদীতল ছেয়ে গেছে মরা মাছে, না, কোথাও পানি দেখা যাচ্ছে না, লাশ আর লাশ, আর সেসব মাছ নয়, মানুষ, ঢাকার সবগুলো পুলিশ স্টেশনে টেবিলের ওপরে উপুড় হয়ে আছে বাঙালি ডিউটি অফিসারের গুলি খাওয়া মৃতদেহ, দমকল বাহিনীর অফিসে ইউনিফরর্ম পরা দমকলকর্মীরা শুয়ে আছে, বসে আছে, গুলিবিদ্ধ হয়ে দেয়ালে আটকে আছে লাশ হয়ে, ঢাকার সবগুলো বাজারে আগুন দেওয়া-পাতার পর পাতা শুধু এই পৈশাচিকতার, এই আগুনের, লাশের, হত্যার, আর্তনাদের আর মানুষ মারার আনন্দে উল্লাসে ফেটে পড়া সৈনিকের অট্টহাসির, আর মদের গেলাস নিয়ে মাতাল কন্ঠে সাবাস সাবাস আরো খুন আরো আগুন আরো রেইপ বলে জেনারেলদের চিৎকারে ফেটে পড়ার বর্ণনা লেখা যাবে, শত পৃষ্ঠা, সহস্র পৃষ্ঠা, নিযুত পৃষ্ঠা, তবু বর্ণনা শেষ হবে না, তবু ওই বাস্তবতার প্রকৃত চিত্র আর ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে না ৷ কেই-বা সব দেখেছে একবারে, যে দেখেছে রাজারবাগে হামলা, তার কাছে ওই তো নরক, যে দেখেছে ইপিআরে হামলা, এক জীবনে সে আর কোনো দিনও স্বাভাবিক হতে পারবে না, যে অধ্যাপক ভিডিও করেছেন জগন্নাথ হলের মাঠে সারিবদ্ধ ছাত্রদের গুলি করে মেরে ফেলার দৃশ্য, তিনিও তো ঘটনার সামান্য অংশই চিত্রায়িত করতে পেরেছেন মাত্র, যে সায়মন ড্রিঙ্ক বিদেশী সাংবাদিকদের বহিষ্কার এড়িয়ে ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলের রান্নাঘর দিয়ে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ পাঠিয়েছিলেন ‘জেনোসাইড ইন বাংলাদেশ, সাম উইটনেস অ্যাকাউন্টস, হাউ ড্যাক্কা পেইড ফর ইউনাইটেড পাকিস্তান’, তিনি নরকের বর্ণনার সামান্যই দিতে পেরেছিলেন ৷

৩৩

২৫শে মার্চ রাতে সারাটা শহরে পাকিস্তান আর্মি কোন জাহান্নাম প্রতিষ্ঠা করেছে, তার বর্ণনা আস্তে আস্তে ঢাকাবাসী জানতে, বুঝতে, উপলব্ধি করতে শুরু করে ৷ ২৭শে মার্চ কারফিউ উঠিয়ে নেওয়ার পরে যারা রাস্তায় বেরোয়, তারা দেখতে পায় শুধু লাশ আর লাশ ৷ রাজারবাগের আশেপাশে যাদের বাসা ছিল, তারা ওই রাতে প্রত্যক্ষ করেছে, সারা রাত গুলির মধ্যে কোনো রকমে মাথা বাঁচিয়ে উপলব্ধি করেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতা ৷ কামান মর্টার দিয়ে গোলা তো ছোড়া হয়েইছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, চারদিক থেকে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের ক্যাম্পে ৷ পানির ট্যাঙ্কে যে বাঙালি পুলিশ পজিশন নিয়েছিল, তারা মারা গেছে ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ হয়ে ৷ আলতাফ মাহমুদের বাসা ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুব কাছে ৷ তাঁরা দেখতে পেয়েছিলেন সেই দোজখের খানিকটা ৷ ভোর হতে না হতে প্রতিরোধকারী বাঙালি পুলিশরা আর টিকতে না পেরে একজন-দুজন করে পালিয়ে যাচ্ছিল এদিক-ওদিক ৷ তাদেরই দুজন আসে আলতাফ মাহমুদের বাসায় ৷ তারা তাদের পোশাক খুলে সাধারণ লুঙ্গি-শার্ট ধার নিয়ে পরে অস্ত্র রেখে পালিয়ে যায় ৷ এ রকম পলায়নপর বাঙালি পুলিশদের আশ্রয় দিয়েছিল, পোশাক দিয়েছিল আশপাশের অনেক বাঙালি পরিবার ৷ নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর মনে আছে, ২৫শে মার্চ রাতে রাস্তায় গাছ কেটে, সুয়ারেজ পাইপ ফেলে তারা ব্যারিকেড দিচ্ছিল ৷ ১১টা সাড়ে ১১টার দিকে ট্যাঙ্ক, আরমার্ড কার নিয়ে আর্মি রাস্তায় নেমে আসে গুলি করতে করতে ৷ রাতের বেলা জোনাকি সিনেমা হলের কাছে হাসানের বাসায় আশ্রয় নেয় সে, সারা রাত রাজারবাগে পুলিশের সঙ্গে পাকিস্তানি আর্মির যুদ্ধ হয়, ভোরবেলা বাচ্চু বেবির বাসা হয়ে পল্টন লাইনের নিজের বাসায় ফিরছে গলিপথে, দেখতে পায় বাঙালি পুলিশরা পালিয়ে যাচ্ছে ৷ বাচ্চুদের কাছেও তারা অস্ত্র রেখে যায় ৷ তখনও ধোঁয়া উড়ছে শান্তিনগরে, রাজারবাগে, জোনাকির সামনে রাস্তায় লাশ পড়ে আছে ৷

২৬শে মার্চ ১৯৭১ ৷ বাইরে কারফিউ ৷ আজাদ আর বাশার বাসায় বসে আছে ৷ কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না ৷ মায়ের কঠোর নিষেধ, বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা যাবে না ৷ জায়েদ উসখুস করছে, তার মতলব একবার গলির মুখে গিয়ে দেখে ঘটনা কী ? মাঝে মধ্যে ট্যা-ট্যা করে গুলির শব্দ ভেসে আসছে ৷ ছাদে গিয়ে তাকালে এদিকে-ওদিকে ধোঁয়া দেখতে পাওয়া যায় ৷ আবার গোলাগুলির শব্দ ৷ খুব কাছে থেকে আসছে শব্দ ৷ মনে হয় শেল এসে পড়ছে এই বাসারই ওপরে ৷ আজাদের মা দৌড়ে আসেন ৷ ‘আজাদ কোথায় ? আয় ৷ আয় ৷ শুয়ে পড় ৷ জায়েদ কোথায় ? এই তুই আবার উঠে পড়ছিস কেন ? শো বলছি ৷’

একটু পরে আবার শব্দ থেমে যায় ৷ আজাদ রেডিও অন করে ৷ রেডিও পাকিস্তান থেকে একটা অপরিচিত কন্ঠ ভেসে আসছে ৷ কোনো অবাঙালি হবে হয়তো ৷ না ইংরেজি, না উর্দু, না বাংলা, এক অদ্ভুত ভাষায় সে ঘোষণা পাঠ করে চলেছে ৷ সবই সামরিক বিধি ৷ টিক্কা খানের সামরিক বিধি বমন করে চলেছে রেডিওটা ৷ কী করা যাবে, কী করা যাবে না, অ্যালার্ন হচ্ছে ৷ আর বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন ৷ আজাদ রেডিওর নব ঘোরাতে থাকে ৷ আকাশবাণী শোনা যায় ৷ এদের খবরটা শুনলে হয় ৷ আকাশবাণীর ইংরোজি খবরে বলা হয় : ওয়েস্ট পাকিস্তান হ্যাজ অ্যাটাক্ড ইস্ট পাকিস্তান ৷

আবার গুলির শব্দ ৷ সবাই চুপ করে আছে ৷

কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ তাদের বাসার দরজায় কে যেন ধাক্কা দেয় ৷ কে ? এই ঘোর দুর্যোগের মধ্যে কে ?

বাসার সবার নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাবে, এমন নিস্তব্ধতা ৷

আবার কড়া নাড়ার শব্দ ৷

আজাদ বলে, ‘কে ?’ কিন্তু তার গলা থেকে শব্দ ঠিকমতো বেরুচ্ছে না ৷ সে কেশে গলা পরিষ্কার করে নেয় ৷ কে ? সে এবার স্পষ্ট গলায় বলে ৷

মা ছুটে আসেন ৷ ফিসফিস করে বলেন, ‘আজাদ, তুই ওই ঘরে যা ৷ আমি দেখছি ৷’ মা জানালার বদ্ধ কপাটের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেন কে ৷ বুঝতে পারেন না ৷

তারপর জানালাটা খুলে বারান্দায় তাকান ৷ না কেউ না ৷

২৭শে মার্চ ৷ আজ সকালে কারফিউ নাই ৷ দুপুর থেকে আবার শুরু হবে ৷ আজাদ আর বাশার বের হয় ৷ রেললাইনের পথ ধরে ছুটে চলেছে হাজার হাজার মানুষ ৷ নারী-পুরুষ, শিশু, আবালবৃদ্ধবনিতা ৷ প্রত্যেকের হাতে সাধ্যমতো ব্যাগ, সুটকেস, পোটলা ৷ কারো কোলে বাচ্চা ৷ সবার চোখেমুখে ভয় ৷ সবাই যেন এই মৃত্যুপুরী ছেড়ে পালিয়ে কোনো রকমে পেতে চাইছে একটুখানি জীবনের শরণ ৷ একটা ছোট্ট ছেলে মাথায় একটা বড় ট্রাঙ্ক নিয়ে চলেছে ৷ আজাদ আর বাশার কেউ কোনো কথা বলে না ৷ তারা আরেকটু এগিয়ে যায় ৷ আউটার সার্কুলার রোডে হোটেল দ্য প্যালেসের সামনে দেখতে পায় পড়ে আছে একটা লাশ ৷ আজাদ চমকে ওঠে ৷ কিন্তু এটা কিছুই নয় ৷ আরো অনেক লাশ তাদের দেখতে হবে ৷ তারা রাজারবাগের দিকে এগোয় ৷ পথে পথে ছড়িয়ে আছে লাশ ৷ গুলিবিদ্ধ শরীর থেকে বেরুনো রক্ত শুকিয়ে পড়ে আছে রাস্তায় ৷ পুলিশ ব্যারাক থেকে এখনও ধোঁয়া উঠছে ৷ কুকুরে টানাটানি করছে লাশ নিয়ে ৷ কত যে লাশ পড়ে আছে ইতস্তত, ইয়ত্তা নাই ৷

আজাদ আর বাশার এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি ৷

হঠাৎ বাশার রাস্তার ধারে বসে পড়ে ৷

আজাদ জিজ্ঞেস করে, ‘কী হলো ?’

বাশার একবার ‘ওয়াক’ করে ওঠে ৷

‘খারাপ লাগছে ?’

‘হুঁ ৷’

আজাদ দেখতে পায়, বাশারের পুরোটা কপাল ঘামছে ৷ বোধহয় তার পেটের ভেতরটা গুলিয়ে উঠছে ৷ বমি করবে নাকি সে ? কিন্তু সকালে তারা নাশতা করে বের হয়নি ৷ দুজনেরই পেট খালি ৷ বমি হবে না ৷ শুধু পিত্ত উগড়ে উঠবে ৷ কষ্ট হবে ৷

আজাদ একটা কাগজ কুড়িয়ে এনে বাশারের মাথায় বাতাস করে ৷ সঙ্গীর বিবমিষা দেখে তারও বমি পাচ্ছে ৷

বাশারের চোখেমুখে একটু পানি ছিটাতে পারলে হয়তো ওর ভালো লাগত ৷ ওই যে দূরে রাস্তার ধারে একটা পানির কল দেখা যাচ্ছে ৷ আজাদ বলে, ‘দাঁড়াও, তোমার জন্যে একটু পানি নিয়ে আসি ৷ চোখেমুখে দেবে ৷’

পানির কলের কাছে সে যায় বটে, কিন্তু পানি সে নেবে কী করে ? আঁজলা ভরে পানি নিলেও বাশারের কাছে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে না ৷ সে পকেট থেকে রুমাল বের করে ৷ ভিজিয়ে নেয় রুমালটা ৷ তারপর বাশারের কাছে এসে ভেজা রুমাল দিয়ে বাশারের চোখ-মুখ-কান-ঘাড় মুছে দেয় ৷ বাশারের খানিকটা আরাম লাগে ৷ সে বলে, ‘এখন ঠিক আছি ৷ চলো বাসায় ফিরে যাই ৷’

তারা বাসায় ফিরে আসে ৷ মা চিল্লাচিলি্ল শুরু করে দিয়েছেন, ‘এই, তোরা কই গিয়েছিলি ? বলে যাবি না ? নাশতা না করে কেউ বাইরে যায়!’

দুপুরের আগে হঠাৎ তাদের বারান্দায় বুটের শব্দ ৷ দরজায় নক ৷ জায়েদ এগিয়ে গিয়েছিল ৷ জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে : সর্বনাশ ৷ দুইজন সৈন্য ৷ মিলিটারি সদস্য ৷ তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ৷ সে প্রমাদ গোনে ৷

জায়েদ দৌড়ে ভেতরে আসে ৷ আজাদ আর বাশার তখন রেডিওর নব ঘোরাচ্ছে ৷ কোন রেডিও কী বলে, শোনা দরকার ৷ আকাশবাণী, বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ঢাকা-সবই সে একের পর এক শুনছে ৷ জায়েদ গিয়ে হাজির সেখানে-’দাদা দাদা ৷’ জায়েদের কন্ঠে ফিসফিসানি ৷

‘কী হয়েছে ?’

‘দাদা’, জায়েদ কথা থামিয়ে প্রথমে একটা শ্বাস নেয়, তারপর বলে, ‘বাসাত মিলিটারি আইছে ৷’

‘মিলিটারি ?’ আজাদ আর বাশার একই সঙ্গে বলে ওঠে ৷ তাদের হতবিহ্বল দেখায় ৷ তারা এখন কী করবে ?

দরজা থেকে তখন শোনা যায়, ‘আজাদ, আজাদ আছ নাকি ?’

বাঙালির গলা ৷ আজাদ এগিয়ে যায় বারান্দার দরজায় ৷ ‘কে ?’ সে কন্ঠ উঁচিয়ে বলে ৷

‘আমি সালেক ৷ তোমার সেন্ট গ্রেগরির ফ্রেন্ড ৷’

আজাদ তাড়াতাড়ি দরজা খোলে ৷ সালেক চৌধুরী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ৷ এ বাসাতেও সে একবার এসেছে ৷ আর্মিতে আছে ৷ ‘আসো, আসো ৷’

সালেক ভেতরে ঢোকে ৷ সেনাবাহিনীর পোশাকে তাকে একটু অন্যরকম যে লাগছে না, তা নয় ৷ তার সঙ্গে তার এক সহকর্মী হবে ৷

সালেক ঢুকেই বলে, ‘দরজা বন্ধ করে দাও ৷ ও আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন মাহমুদ ৷ মাহমুদ, এই হলো আজাদ ৷ তোমাকে তো এর কথা বলেইছি ৷ আজাদ, শোনো ৷ ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা খারাপ ৷ আমরা পালিয়ে এসেছি ৷ পালিয়ে চলে যাব ৷ তুমি এক কাজ করো, আমাদের দুজনকে তোমার দু সেট কাপড় দাও ৷ কারফিউ আরম্ভ হওয়ার আগেই ঢাকা ছাড়তে হবে ৷’

আজাদ বলে, ‘বসো ৷ দিচ্ছি ৷’

মা এগিয়ে আসেন ৷ সব শোনেন ৷ তার চোখেমুখে উদ্বেগ ৷ তিনি বলেন, ‘বাবারা, তোমরা কিছু খেয়েছ ?’

সালেক বলে, ‘খালাম্মা, খেতে হবে না ৷ আগে ঢাকার বাইরে যেয়ে নিই ৷’

মা বলেন, ‘বাবা, আমি ভাত তুলে দিয়েছি ৷ ভাত খেয়ে তারপর যেও ৷’

সালেক বলে, ‘সময় হবে না খালাম্মা ৷’

জায়েদ তখন পাশের ঘরের দরজার সামনে দিয়ে বারবার হাঁটাচলা করছে, আর বোঝার চেষ্টা করছে, কারা এল ৷ পরে যখন বোঝে, এ তো সালেক ভাই, তখন সে ঢোকে এ ঘরে ৷ টেবিলের ওপরে দুটো অস্ত্র রাখা ৷ সেসবের দিকে তার অভিনিবেশ ৷

আজাদ তাদের দুজনকে প্যান্ট-শার্ট আর স্যান্ডেল দেয় ৷ তারা কাপড় পাল্টে নেয় ৷ অস্ত্র দুটো তারা নেয় একটা চটের বস্তায় ৷ তারপর সালেক বলে, ‘আজাদ উঠি রে ৷’

আজাদ বলে, ‘কোন দিকে যাবা ?’

সালেক বলে, ‘জানি না ৷ আল্লাহ ভরসা ৷’

মা আসেন ৷ ‘বাবা, আর পাঁচটা মিনিট বসো ৷ ভাত হয়ে এসেছে ৷’

সালেক আর মাহমুদ ঘড়ি দেখে ৷ ‘না খালাম্মা ৷ হাতে সময় আছে আর আধঘন্টা ৷ এর মধ্যে সদরঘাট দিয়ে নদী পার হয়ে যেতে চাই ৷’

‘তাহলে বাবা একটু চিঁড়া ভিজিয়ে দিই ৷ গুড় দিয়ে মেখে দিই ৷ খেয়ে যাও ৷’

মা দৌড়ে চিঁড়া ভেজাতে যান ৷ সালেক বলে, ‘খালাম্মা ৷ নাহ্ ৷ থাকুক, দেরি হয়ে যাবে ৷ আমরা যাই ৷’

চিঁড়া ভেজানোই থাকে ৷ সালেক আর মাহমুদ সিভিল ড্রেসে বেরিয়ে যায় ৷ ঘরে পড়ে থাকে তাদের সামরিক পোশাক, বেল্ট, জুতা, টুপি ৷

মা সেগুলো একটা বস্তায় ভরে রান্নাঘরের পেছনে কাঠের স্তূপের আড়ালে রেখে আসেন ৷

জায়েদের চোখ পড়েছে বেল্ট দুটোর দিকে ৷ এক ফাঁকে সে বেল্ট দুটো সরিয়ে নেবে, মনে মনে পরিকল্পনা আঁটে ৷

তবে এ পরিকল্পনা সে বাস্তবায়িত করতে পারে না ৷ দুদিন পরই কারফিউয়ের বিরতিতে আম্মার নির্দেশে পুরোটা বস্তা মাথায় করে নিয়ে সে ফেলে দিয়ে আসে এফডিসির পুকুরে ৷

২৭শে মার্চ দুপুরের দিকে, কয়েক ঘন্টার জন্যে কারফিউ তুলে নেওয়ার অবকাশে, জুয়েল এসে হাজির সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসায় ৷ ডোরবেল টেপে ৷ বাসার লোকজন উঁকি দিয়ে দেখে, কে এল ৷ জুয়েলকে দেখে দারোয়ান বলে, ‘কে ?’

জুয়েল বলে, ‘আমি জুয়েল ৷ বাবু আছে ?’

সৈয়দ আশরাফুল এসে গেট খোলে ৷

‘কী ব্যাপার ?’

‘শোনো নাই, মুশতাক ভাইরে মাইরা ফেলছে!’

‘কোন মুশতাক ?’

‘তোমগো আজাদ বয়েজ ক্লাবের মুশতাক ভাই ৷’

‘কও কী ?’

আশরাফুলের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ক্রীড়ানুরাগী মুশতাক ভাইকে মেরে ফেলেছে ? সে ভয়ার্ত গলায় বলে, ‘কেমনে ?’

‘ডিডিএসএর সামনে হের গুলি খাওয়া লাশ পইড়া আছে ৷ হাত দুইটা নাকি উপরে ধরা ৷ মনে হয় উর্দুতে কিছু একটা বুঝাইতে চাইছিল, পারে নাই ৷ অনেকে দেখতে যাইতেছে ৷ যাবা ?’

‘চলো ৷’

তারা দুজন বেরিয়ে পড়ে ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশন কার্যালয়ের উদ্দেশে ৷

আশরাফুলের সামনে লাশের বর্ণনা দেবার সময়ও জুয়েল বুঝতে পারেনি আসলে গুলি খেয়ে মৃত্যু ব্যাপারটা কী! কিন্তু ডিডিএসএ কার্যালয়ে গিয়ে যখন মুশতাক ভাইয়ের চিৎ হওয়া উন্মুক্ত শরীরটা গুলিবিদ্ধ আর রক্তাক্ত অবস্থায় সে দেখে, তখন একটা মানুষের এ রকম অন্যায় প্রতিকারহীন মৃত্যু যেন সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না ৷ লোকটার সঙ্গে তিন দিন আগেও তাদের দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে ৷ এখন কীভাবে শুয়ে আছে দুদিনের বাসি লাশটা ৷

ঢাকার অনেক ক্রিকেটারকেই ক্রিকেট খেলতে উদ্বুদ্ধ করা, ক্রিকেটের বিষয়ে একাগ্র ও পরিশ্রমী হতে বলার কাজটা মুশতাক ভাই করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে ৷

সেই মুশতাক ভাইকে এভাবে মেরে ফেলা হবে ? জুয়েলের চোয়ালটা শক্ত হয়ে ওঠে ৷ সে কামড়ে ধরে নিচের ঠোঁট ৷

আর ভয়ে আশরাফুলের শরীর ওঠে গুলিয়ে ৷

হঠাৎ শোনা যায়, কে যেন ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল ৷

জুয়েল আর আশরাফুল লোকটার দিকে তাকায় ৷ আজাদ বয়েজ ক্লাবের পিয়ন খয়বার ৷ ওদিকে দেখা যাচ্ছে ক্রিকেটার রকিবুল হাসানও এসে গেছেন ৷

৩৪

আজাদ ধীরে ধীরে জানতে পারে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সারি বেঁধে হত্যা করা হয়েছে ছাত্রদের, বাসায় গিয়ে গুলি করে খুন করা হয়েছে শিক্ষকদের, ছাত্রীহলে গিয়ে নারকীয় নির্যাতন করা হয়েছে মেয়েদের ৷ তার হাতের মুঠো শক্ত হয়ে আসে ৷ ক্রোধের আগুনে শরীর হয়ে ওঠে তপ্ত ৷ তবে রাজনীতির সঙ্গে তার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকায় ঠিক কী করা উচিত সে বুঝে উঠতে পারে না ৷ কিন্তু সে-সময়ই তার বন্ধুরা, পরবর্তীকালে যারা তার সহযোদ্ধা হবে, তাদের অনেকেই যুদ্ধের ময়দানের সন্ধানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় ৷ শহীদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ, বদিউল আলম, মাসুদ ওমর-ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের চার ছাত্র বেরিয়ে পড়ে যুদ্ধের সন্ধানে, তারা শুনতে পায় গাজিপুরে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈন্যরা লড়াই করছে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে, সেখান থেকে তারা পিছু হটে ময়মনসিংহে যাবে, এটাই স্বাভাবিক, সুতরাং বাদল, আশফি, ওমর, বদি চার তরুণ কারফিউ তুলে নেওয়ার কয়েক ঘন্টার বিরতির মধ্যেই ঢাকা ছেড়ে ময়মনসিংহের পথে পা বাড়ায় ৷ বাচ্চু, আসাদ এবং লক্ষাধিক ঢাকাবাসী ২৭শে মার্চে কারফিউ তুলে নেওয়ার ফাঁকে তাদের সংগৃহীত অস্ত্রশস্ত্রসহ বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে আশ্রয় নেয় জিঞ্জিরায় ৷ সেখানেই তারা প্রথম শুনতে পায় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ঘোষণা, এম এ হান্নান, মেজর জিয়া, শমসের মবিন ও ক্যাপ্টেন ভুঁইয়ার কন্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই এখনও মনে করতে পারে, মেজর জিয়ার কন্ঠস্বর তাদের অনুপ্রাণিত করেছিল খুবই, কারণ তারা আর্মি খুঁজছিল, বাঙালি আর্মি বিদ্রোহ করেছে শুনে তারা বুঝতে পেরেছিল যুদ্ধ সত্যই শুরু হয়ে গেছে ৷ রেডিওর এ ঘোষণা ত্রিমোহনীতে শুনতে পায় শাহাদত চৌধুরী আর ফতেহ, যারা সেখানে গিয়েছিল যুদ্ধক্ষেত্রের খোঁজে, রেডিওতে কান পেতে এ ঘোষণা শুনে যেন জেগে ওঠে ত্রিমোহনী, উৎসব শুরু হয় সেখানে ৷ ত্রিমোহনীতে তারা দেখা পায় রাজারবাগে যুদ্ধ করা চারজন পুলিশের ৷ তাদের সমস্ত অস্তিত্ব তখন প্রতিরোধ আর প্রতিশোধের জন্যে উন্মুখ ৷ তারাও খুঁজছে যুদ্ধক্ষেত্র ৷ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই ট্রাক সৈন্য তারাবো পর্যন্ত এসে পড়লে সে খবর নিয়ে আসে ফতেহ চৌধুরী ৷

তবে যুদ্ধ ২৫শে মার্চ রাতেই শুরু হয়ে গিয়েছিল, রাজারবাগে পুলিশের প্রতিরোধে, পিলখানায় ইপিআরের নাছোড় সাহসিকতায়, নয়াবাজারের নাদির গুণ্ডার এলএমজির গুলিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া আর পিছু হটে যাওয়ার মধ্য দিয়ে, সারা দেশে বাঙালি সৈন্যদের বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ আর প্রতিরোধে ৷ গাজীপুরে ২য় বেঙ্গল, চট্টগ্রামে ৮ম বেঙ্গল, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪র্থ বেঙ্গল বিদ্রোহ করে ৷ লড়তে থাকে বীরের মতো ৷ পাবনার ডিসি, মেহেরপুর কুষ্টিয়ার এসডিও, এসপি-এমনি করে অনেক জায়গায় বেসামরিক প্রশাসন আর জনগণ মিলেমিশে নিজ নিজ এলাকাকে দখল করে রেখে গড়ে তোলে প্রতিরোধ ৷ রংপুর দিনাজপুরের মাটিও দখল করে রাখে সাধারণ মানুষ, বাঙালি সাঁওতাল, ওরাঁও আদিবাসী মিলেমিশে ৷

২৫শে মার্চ রাতে শুধু ঢাকায় নয়, সারাদেশে পাকিস্তানি মিলিটারি ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে তোপের মুখে চিরকালের জন্যে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ৷ শুধু ২৫শে মার্চ রাতে নয়, ২রা এপ্রিল জিঞ্জিরায় যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল, তাকে এখনও বাচ্চু, আসাদ বা যে-কানো প্রত্যক্ষদর্শীর দোজখ দেখার দুঃসহ স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না ৷ প্রাণভয়ে ভীত আশ্রয়সন্ধানী প্রায় লাখখানেক ঢাকাবাসী আশ্রয় নিয়েছে বুড়িগঙ্গার ওপারে ৷ তাদের কারো কারো কাছে দেশি অস্ত্র ৷ একটা-দুটো বন্দুক ৷ পুলিশ কিংবা ইপিআরের ফেলে যাওয়া থ্রি নট থ্রি ৷ ভোরবেলা হঠাৎ পাকিস্তানি আর্মি লঞ্চ আর স্টিমারযোগে চলে আসে নদীর এপারে, অতর্কিতে, বাচ্চুরা টের পেয়ে পেছাতে পেছাতে সৈয়দপুরে সরে আসে, আর পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায় আকাশে হেলিকপ্টার জেট উড়ছে, হাজার হাজার মানুষ পালাচ্ছে দিগ্বিদিক, আর আর্মিরা কী একটা পাউডার নাকি পাইপ দিয়ে ফুয়েল ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, মানুষ পুড়ে যাচ্ছে আর ছুটে যাচ্ছে, ছুটন্ত মানুষ পুড়ছে, পুড়ন্ত মানুষ ছুটছে, ছুটন্ত মানুষ ফুটন্ত, জ্বলন্ত, হাজার হাজার ছুটন্ত অগি্নকুণ্ড, আর চিৎকার, পুরোটা জনপদ পুড়ছে, আর গুলি, রিকোয়েললেস রাইফেল থেকে, আর হেলিকপটার জেট থেকে, ছুটন্ত মানুষ পড়ে যাচ্ছে, ধরাশায়ী হচ্ছে, হাজার হাজার মানুষ পড়ে গেল, মরে গেল, মরে গেল তো বেঁচে গেল, অন্তত ১০ হাজার মানুষ সেদিন মারা পড়েছে জিঞ্জিরায়-এই বিবরণ আজাদ জানতে পারবে, আর তার মনে হবে ট্রুম্যানের কথা, হ্যারি এস ট্রুম্যানের আত্মজীবনীর একটা বই তাকে পড়তে হয়েছে এমএ ক্লাসের জন্য, আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক ক্লাসে, ইয়ার অব ডিসিশনস, হিরোশিমায় যখন অ্যাটম বোমা ফেলা হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তখন বাইরে লাঞ্চ করছিলেন, বোমা ফেলার পরে তাকে জানানো হয় নিউক্লিয়ার টেস্টের চেয়েও এবার ধ্বংস হয়েছে অনেক বেশি, ট্রুম্যান বলেছিলেন, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জিনিস হলো এটা ৷ চলো, বাড়ি যাই ৷ এই বোমা ২০ হাজার টন টিএনটির সমান শক্তিশালী ৷ I was greatly moved… I said to the sailors around me, this is the greatest thing in the history it’s time for us to go home (আজাদের নিজের হাতের ৩.৪.৭০ তারিখে স্বাক্ষর করা এই বইটা রয়ে গেছে জায়েদের সংগ্রহে) ৷ জিঞ্জিরার দিকে পালাতে গিয়েই সঙ্গীতজ্ঞ বারীণ মজুমদার আর ইলা মজুমদারের আঙুল থেকে এক সময় খুলে যায় তাদের বছর সাতেক বয়সী মেয়ে মধুমিতার হাতের মুঠো, তারা তাকে ডাকতেন মিতু বলে, তারপর মিতু মিতু বলে ইলা মজুমদার কত ডাকলেন, বারীণ মজুমদার কত ডাকলেন, তাদের ছোট ছেলে পার্থ কত ডাকল, মিতু আর ফিরে এল না ৷ যে যায় সে আর ফিরে আসে না, কিন্তু মায়েরা প্রতীক্ষায় থাকে, তাদের প্রতীক্ষা দেশ স্বাধীন হওয়ার ১৪ বছর পরেও ফুরায় না ৷

৩৫

যুদ্ধের খোঁজে ঢাকার ছাত্ররা বেরিয়ে পড়ে অনেকেই, যেমন বাচ্চু পায়ে হেঁটে চলে যায় দাউদকান্দি হয়ে কুমিল্লা, সেখান থেকে শুনতে পায় যুদ্ধ হচ্ছে মিরেরসরাইয়ে, তারপর পায়ে হেঁটে চলে যায় চট্টগ্রাম, সেখান থেকে ফিরে আসে ঢাকায়, তারপর পেয়ে যায় ২ নম্বর সেক্টর থেকে পাঠানো বার্তা, খালেদ মোশাররফ গেরিলা অপারেশনের জন্যে ঢাকার ছাত্রদের চান, গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে সীমান্তের ওপারে মেলাঘর যেতে থাকে ছাত্ররা ৷ জুনের প্রথম সপ্তাহে মেজর খালেদ মতিনগর থেকে মাইল দশেক দূরে মেলাঘরে একটু ঘন জঙ্গলের মধ্যে স্থাপন করেন এই নতুন ক্যাম্প ৷ তারও আগে অবশ্য ক্যাম্প হয়েছিল বঙ্নগর ৷ সেখান থেকে মতিনগর ৷ সেখানে যোগ দেয় মানিক, ওমর, মাহবুব, আসাদ ৷ বাস্কেটবল খেলোয়াড় কাজী কামাল মতলবে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বাড়ি হয়ে পৌঁছে যায় মতিনগর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে, ছয়-সাত জনের একটা দলের সদস্য হিসেবে ৷ শহীদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ, মাসুদ ওমর এর আগেই পৌঁছে গেছে ৷ পৌঁছে যায় শাহাদত চৌধুরী, যুদ্ধদিনে যাকে ডাকা হবে শাচৌ বলে ৷ শাচৌ মেজর খালেদ মোশাররফের প্রিয় তরুণে পরিণত হবেন, আর শহীদুল্লাহ খান বাদল কাজ করে যাবে সেক্টর টু-র হেডকোয়ার্টার মতিনগরের গুরুত্বপূর্ণ এক স্টাফ হিসেবে, যতক্ষণ না তাকে যুদ্ধের শেষের দিকে এসে বাম সন্দেহে সরিয়ে নেওয়া হবে কলকাতায় ৷

প্রতিটা তরুণের নিজের ঘরদোর মা-বাবা ছেড়ে যুদ্ধে যাওয়ার আছে একেকটা স্মরণীয় গল্প ৷

বদিউল আলম ঢাকায় এক সময় বিখ্যাত বা কুখ্যাত ছিল এনএসএফ-এর নেতা হিসাবে ৷ কিশোরগঞ্জের ছেলে বদি ছাত্র হিসাবে ছিল দারুণ মেধাবী ৷ লম্বা, একটু ময়লাটে গায়ের রঙ ৷ ‘৭১ সালে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র ৷ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে সে ১৯৬৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগে মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিল ৷ এই উজ্জ্বল পটভূমি নিয়েও বদি যে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সমর্থক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এনএসএফে যোগ দিয়েছিল, তার কারণ খুব একটা রাজনৈতিক নয় ৷ এদের যোগ দেওয়ার কথা ছিল ছাত্র ইউনিয়নেই, কিন্তু কী একটা কথা কাটাকাটি থেকে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের কয়েক বন্ধু এনএসএফে ঢুকে পড়ে ৷ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা থাকায় ক্যাম্পাসে তারা চলাফেরা করত দাপটের সঙ্গে ৷ এই সময় জিন্নাহ হলের এনএসএফ নেতা বদি-সালেকের নাম উচ্চারিত হতো একই নিঃশ্বাসে, মধ্যখানে একটা ঊহ্য হাইফেনসমেত এবং ভয়ের সঙ্গেই ৷ সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে পড়ে, ক্রিকেটার হিসেবে আশরাফুলকে বদি একটু প্রশ্রয়ের চোখে দেখত, ক্যাম্পাসে দেখা হলে জিজ্ঞেস করত, ‘কী আশরাফুল, কেমন আছ’, এতেই আশরাফুল শ্লাঘা অনুভব করত, ‘দেখছস, কত বড় গুণ্ডা আমার খোঁজখবর নিতাছে ৷’

অন্যদিকে শহীদুল্লাহ খান বাদল ছিল এসএসসি আর এইচএসসি দু পরীক্ষাতেই প্রথম স্থান অধিকারকারী এক অবিশ্বাস্য তরুণ ৷ সে যুক্ত ছিল বামপন্থী চিন্তা আর আদর্শের সঙ্গে ৷ বদির সঙ্গে তার গোলযোগ ছিল প্রকাশ্য ৷ অর্থনীতি বিভাগের নির্বাচনের সময় ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে এনএসএফের গণ্ডগোল বাধলে বাদল আর বদির দূরত্বও প্রায় শত্রুতায় পরিণত হয় ৷ এর পরে ছাত্র ইউনিয়নের ছেলেরাও শরীরচর্চা ইত্যাদির দিকে মন দেয় ৷ একদিন জিমন্যাসিয়ামে বাদলরা ব্যায়াম করছে, তারা পড়ে যায় বদি ও তার দলের সামনে, বদিরা ধাওয়া দেয় বাদলদের ৷

‘৬৯-এর গণআন্দোলনের সময় থেকে বদিউল আলমরা এনএসএফে নিষ্ক্রিয় হতে থাকে ৷ ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী এনএসএফের পক্ষ থেকে নির্বাচিত হওয়া সত্ত্বেও গণআন্দোলন সমর্থন করেন এবং এরপর থেকে ছাত্রসমাজের স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে থাকেন ৷ বদিউল আলমরাও মনেপ্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক হয়ে ওঠে ৷

২৫শে মার্চের গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর পর ২৭শে মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে বদি তার বন্ধু তৌহিদ সামাদকে নিয়ে হাজির হয় ধানমন্ডি ৫ নম্বরে শহীদুল্লাহ খান বাদলের ডেরায় ৷ তৌহিদ সামাদের বাসা ছিল ৪ নম্বরে ৷ বদিকে দেখে শহীদুল্লাহ খান বাদলের মনে নীরব প্রশ্ন জাগে : এই এনএসএফের গুণ্ডাটাকে কেন নিয়ে এসেছে তৌহিদ ?

বদিউল বলে বাদলকে, ‘লিসেন ৷ ইউ কমিউনিস্ট ৷ হয়্যার আর দি আর্মস ৷ লেট্স গো অ্যান্ড ফাইট ৷ নিশ্চয় যুদ্ধ হচ্ছে, নিশ্চয় আর্মস পাওয়া যাবে ৷ চলো ৷ যুদ্ধ করব ৷’

কিন্তু শহীদুল্লাহ খান বাদলের চোখমুখ থেকে বদিউল আলমের ব্যাপারে সন্দেহ দূরীভূত হয় না ৷ বদিকে এড়িয়ে যায় বাদল ৷ সে যায় মাসুদ ওমরের বাসায়, সঙ্গে আশফাকুস সামাদ, কী করা যায় এই নিয়ে আলোচনা করে তারা ৷ সেখানে আবার এসে হাজির হয় বদি ৷ অবাক হওয়া বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে বদি সন্দেহরেখা পড়ে ফেলে অন্তর্যামীর মতো ৷ তারপর সে তার পকেটে হাত দেয় ৷ বের করে একটা ব্লেড ৷ একটানে বদি নিজের হাত কেটে ফেলে খানিকটা ৷ ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় তার হাত থেকে ৷ তারপর সে বাদলের হাত টেনে নিয়ে সামান্য কাটে ৷ বাদলের কাটা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে এলে বদি নিজের রক্ত মিশিয়ে দেয় বাদলের রক্তের সঙ্গে ৷ বলে, ‘ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদারস ৷’

শহীদুল্লাহ খান বাদল, মুক্তিযুদ্ধের ১৪ বছর পরেও, আজাদের মাকে দাফন করে ফিরে আসবার পরের দিনগুলোয়, সেইসব কথা মনে করে স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন ৷ তাঁর মনে পড়ে, এর পরে তার এতদিনকার প্রতিপক্ষ বদিউল আলমের সঙ্গে একই মোটরসাইকেলে চড়ে তারা ওই ২৭শে মার্চেই পুরোটা শহর প্রথমে চক্কর মারে ৷ প্রত্যক্ষ করে শহরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আগুন, ধোঁয়া, রক্ত, লাশের স্তূপ-পাকিস্তানিদের ভয়াবহ নৃশংসতার সাক্ষ্যগুলো ৷ তারা যুদ্ধের সন্ধানে যায় মেজর খালেদ মোশাররফের শ্বশুরবাড়িতে, বাদলদের আত্মীয় হন এই মেজর ৷ দূর থেকেই দেখতে পায় ইতিমধ্যে এ বাড়িতে হামলা চালিয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৷ সেখানে উপায়ান্তর করতে না পেরে বদি প্রস্তাব দেয় কিশোরগঞ্জের দিকে যাত্রার ৷ একটা অনুমান হলো, ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী বাঙালি সৈন্যদের পাওয়া যেতে পারে কিশোরগঞ্জে ৷ বাদলের একটা আশা ছিল, কমিউনিস্টদের কতগুলো মুক্তাঞ্চল থাকে, সিলেটে এ রকম একটা মুক্তাঞ্চল আছে সুনীলদার ৷ ওখানে পৌঁছা গেলে একটা উপায় হবেই ৷

বন্ধু তৌহিদ সামাদের কাছ থেকে টাকা ধার নেয় তারা, ৩০০ বা ৪০০ টাকা, তারপর কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ে তারা চারজন-বদি, বাদল, আশফাকুস সামাদ আশফি আর মাসুদ ওমর ৷

যুদ্ধে কাজী কামালের যাওয়ার কথা ফতেহ চৌধুরীর সঙ্গে ৷ নির্দিষ্ট দিন নির্দিষ্ট সময়ে একটু দেরি করে ফতেহ চৌধুরীর বাসায় পৌঁছায় কাজী কামাল ৷ ফতেহ নয়, দেখা পায় তার ভাই শাহাদত চৌধুরীর ৷ শাহাদত বলে, ‘তুমি দেরি করে ফেলেছ ৷ ওরা তো তোমার জন্যে ওয়েট করতে করতে শেষে চলে গেল ৷ এখনও সদরঘাট যাও ৷ দেখা পেতেও পারো ৷ মতলবের লঞ্চে খোঁজো ৷’

কাজী কামাল বেরিয়ে যায় ঝড়ের বেগে ৷ সদরঘাটে গিয়ে ঠিকই ধরা পায় সে ফতেহদের ৷ ফতেহ তাকে বলে, ‘আসছ, ভালো করছ ৷ কিন্তু প্রত্যেকের ১৭০ টাকা লাগবে পথের খরচ আর হাতখরচ হিসাবে ৷ তোমার টাকা আনছ!’ কাজী কামালের মুখ শুকিয়ে যায় ৷ সে তো টাকা আনেনি ৷ যুদ্ধে যেতে যে টাকা লাগে, তা সে জানবে কী করে! ‘আমি আইতাছি’ বলে সে লঞ্চ থেকে নেমে যায় ৷

ফতেহ চিন্তায় পড়ে যায় ৷ কাজী কি আবার টাকা জোগাড় করতে বাসায় ফিরে গেল নাকি ? লঞ্চ যদি ছেড়ে দেয় ? তাহলে তো তাদের কাজীকে ছেড়েই চলে যেতে হবে ৷

কাজী কামাল কিন্তু লঞ্চে ফিরে আসে মিনিট দশেকের মধ্যেই ৷ তার হাতে তখন টাকা ৷ সে টাকাটা ফতেহর হাতে তুলে দেয় ৷ ফতে বিস্মিত ৷ ‘টাকা পেলে কই ?’ কাজী কামাল তার বাঁ হাতের কব্জি দেখায় ৷ সেখানে ঘড়ির বেল্ট পরার শাদা দাগটা রয়ে গেছে, কিন্তু ঘড়িটা নাই ৷ ‘বুঝলা না, ফুটপাতে নাইমা ঘড়িটা বেইচা দিয়া আইলাম ৷’ তার মুখে বিজয়ীর হাসি ৷

রুমী তার মা জাহানারা ইমামকে বলে, ‘মা, আমি যুদ্ধে যাব ৷’ জাহানারা ইমাম মুশকিলে পড়েন ৷ তার ছেলের কী-বা এমন বয়স ৷ কেবল আইএসসি পাস করে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে ৷ আবার আমেরিকার ইলিনয় ইনস্টিটিটিউট অফ টেকনোলজিতেও সে ভর্তি হয়ে গেছে ৷ ৫ মাস পরে ওখানে তার ক্লাস শুরু হবে ৷ কদিন পরই তার আমেরিকার উদ্দেশে ফ্লাই করার কথা, সে কিনা বলছে যুদ্ধে যাবে ৷ জাহানারা ইমামের মাতৃহৃদয় বলে, না, রুমী যুদ্ধে যাবে না ৷ সে আমেরিকা যাবে পড়তে, নিরাপদে থাকতে, দেশে ফিরে এসে স্বাধীন দেশের সেবা করবে ৷ অন্যদিকে তাঁর সচেতন দেশপ্রেমিক স্বার্থত্যাগী হৃদয় বলছে, এ শুধুই স্বার্থপরের মতো কথা ৷ দেশের জন্যে দেশের ছেলে তো যুদ্ধে যাবেই ৷ তুমি কেন তাকে আটকে রাখতে চাও ৷ মা বলে ? আর ছেলেরা মায়ের ছেলে নয়! তখন, জাহানারা ইমামের মনে হয়, অন্য ছেলেদের মতো যদি রুমী বিছানায় কোলবালিশ শুইয়ে রেখে চুপিসারে চলে যেত, তাঁকে আর এই যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না ৷ কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তিনি ছেলেকে শিখিয়েছেন, মাকে লুকিয়ে কোনো কিছু করতে যেও না ৷ যা করতে চাও, মাকে জানিয়ে কোরো ৷ এখন ? রুমী বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন, সে যুদ্ধে যাওয়ার সপক্ষে যুক্তি দেয়, সে যুক্তির তোড়ে হেরে যান মা, শেষে বলেন, ‘যা, তোকে দেশের জন্যে কুরবানি করে দিলাম ৷ যা তুই যুদ্ধে যা ৷’

মুক্তিযোদ্ধারা জানে, পরে বহুদিন রুমীর মা জাহানারা ইমাম তার এই উক্তির জন্য আফসোস করেছেন, অবোধ মাতৃহৃদয় বারবার দগ্ধ হয়েছে অনুশোচনায়, কেন তিনি কুরবানি কথাটা বলতে গেলেন, আল্লাহ বুঝি তার কুরবানি কথাটাই কবুল করে নিয়েছিলেন ৷

আর হাবিবুল আলমের মনে পড়ে যায় যে পাশবালিশ বিছানায় শুইয়ে রেখে এক ভোরে তিনিও পালিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অজানা প্রান্তর আর অনিশ্চিত জীবনের উদ্দেশে ৷

এপ্রিলের ৭ বা ৮ তারিখ ৷ আহমেদ জিয়া, আলমদেরই এক বন্ধু, আলমদের ইস্কাটনের বাসায় আসে ৷ বলে, ‘দোস্ত, একটু রাজশাহী হাউসে আসতে পারবি ?’

‘ক্যান রে ?’

‘আছে, ঘটনা আছে ৷’ জিয়া কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলে, ‘মেজর খালেদ মোশাররফ ডাকছে ৷’

‘কই ?’

‘ফ্রন্টে ৷ উনি তো ওনার ফোর বেঙ্গল নিয়া ২৭শে মার্চেই রিভোল্ট করছে ৷ মুক্তিবাহিনীতে উনি ঢাকার ছাত্র চান ৷ তুই যাবি কি যাবি না, এটা আলোচনা করব ৷ আরো দুই-একজন আসবে ৷ তুই আয় ৷ তুই তো স্কাউট ৷’

হাবিবুল আলম বলে, ‘মেজর খালেদ মোশাররফের নাম তো শুনি নাই ৷ মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটা শুনছি রেডিওতে ৷ ওনার ঘোষণা শুনেই বুঝছি বাঙালি সৈন্যরা যুদ্ধ করতেছে ৷ আমাদেরকেও যেতে হবে ৷’

‘আয় বিকালে রাজশাহী হাউসে ৷ চিনেছিস তো, রমনা থানার কাছে ৷’

‘চিনি ৷ লিচ্যাংয়ের বাসা তো ?’

বিকালবেলা রাজশাহী হাউসে মিটিং ৷ হাবিবুল আলমের অস্থির লাগে ৷ সে কল্পনায় নিজেকে দেখতে পায় যুদ্ধের ময়দানে ৷ কিন্তু কে এই মেজর খালেদ মোশাররফ ? তাকে সে চেনে না ৷ তার নাম শোনেনি ৷ কিন্তু মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটা তার কানে বাজছে ৷

বিকালবেলা হাবিব হাজির হয় রাজশাহী হাউসে ৷ তারা ছাদে ওঠে ৷ কাইয়ুম, জিয়া, লিচ্যাং আর হাবিব ৷ লিচ্যাং-ও তাদের কমন বন্ধু ৷ তার ভালো নাম ইরতিজা রেজা চৌধুরী ৷ সে একটু শারীরিকভাবে আনফিট ৷ সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ৷ বয়স কুড়ির কোঠায় ৷ কেউ হয়তো ২১, কেউ ২২ ৷ চৈত্র মাস শেষ হয়ে আসছে ৷ আজকের বিকালটা বেশ গুমোট ৷ সবাই ঘামছে ৷ তবে হঠাৎ করেই হাওয়া বইতে শুরু করে ৷ বসন্তের বিখ্যাত বাতাস ৷ কপালের ঘামে বুলিয়ে দেয় শীতল পরশ ৷ তাদের আরাম লাগে ৷

জিয়া মুখ খোলে-’আমি মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর টু থেকে আসতেছি ৷ ওখানে আমি ট্রেনিং নিচ্ছি ৷ আমাকে পাঠাইছেন ক্যাপ্টেন হায়দার ৷ আমার সাথে আসছে আশফি ৷ আশফাকুস সামাদ ৷ খালেদ ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে রেগুলার আর্মি গঠন করছেন ৷ তার সাথে যোগ দিছেন বর্ডারের ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল্স ৷ ঢাকা থাকবে খালেদ মোশাররফের আওতায় ৷ এখন ঢাকার ছেলে দরকার ৷ মেজর খালেদ মোশাররফ ক্যাপ্টেন হায়দারকে বলছেন, ঢাকায় ছাত্র পাঠাও ৷ ঢাকা থেকে আরো আরো ছাত্রকে নিয়া আসো ৷ আসলে ওনারা চাইছেন ঢাকায় গেরিলা অপারেশন শুরু করতে ৷ যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ৷ এ জন্য ঢাকার ছাত্র দরকার ৷ ক্যাপ্টেন হায়দারকে একবার দেখলেই তোদের পছন্দ হবে ৷ যুদ্ধের শুরুতেই সিলেটে ক্যাপ্টেন হায়দারের হাতে গুলি লাগে ৷ তার বাম হাতে প্লাস্টার আছে ৷ সেই জন্য উনি ফ্রন্টে যেতে পারতেছেন না ৷ হেডকোয়ার্টারে থেকে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতেছেন ৷ এখন বল তোরা, যাবি কি-না ৷’

অবশ্যই যেতে হবে ৷ আলম ভাবে ৷ না যাওয়ার প্রশ্নই আসে না ৷ এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময় ৷ লিচ্যাং বলে, ‘আমার কী হবে ? আমিও তো যেতে চাই ৷’

হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে ওই আড্ডায় ৷ লিচ্যাং যেতে চায় ৷ কিন্তু ও তো খানিকটা শারীরিক প্রতিবন্ধী ৷ ওকে নেওয়া তো ঠিক হবে না ৷

জিয়াই নীরবতা ভঙ্গ করে ৷ বলে, ‘লিচ্যাং তুই ঢাকাতেই থাক ৷ এখন যুদ্ধ মানে তো শুধু বন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়া নয় ৷ আরো নানাভাবে যুদ্ধ করা যায় ৷ ঢাকায় যখন ফ্রিডম ফাইটাররা ঢুকবে, তুই তাদেরকে আশ্রয় দিবি ৷ খবর দিবি ৷ এই যে তোর বাসায় আজকে মিটিং হচ্ছে, এটাও তো মুক্তিযুদ্ধেই অংশ নেওয়া ৷’

পরদিন হাবিবুল আলমের বাসায় মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ জিয়া আসে ৷ কীভাবে তারা পাড়ি দেবে সীমান্ত, এ বিষয়ে শলা করতে ৷ সঙ্গে আসে যমজ ভাই মুনির ও মিজান ৷ ঠিক হয়, আলম খবর দেবে কাইয়ুমকে, কাইয়ুম শ্যামলকে, জিয়া নিজেই খবর দেবে মুনীর চৌধুরীর ছেলে ভাষণকে, আর তারা যাত্রা শুরু করবে পরদিন সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির কাছের পেট্রলপাম্প থেকে ৷

আগামীকাল যাত্রা ৷ হাবিব আলম রাত্রিবেলা দু চোখের পাতাই এক করতে পারে না ৷ তার বাসা থেকে সে বিদায় নেবে কী করে ? আব্বা-আম্মাকে বলে বিদায় নেওয়ার প্রশ্নই আসে না ৷ সে হলো বাড়ির একমাত্র ছেলে ৷ আর তার বোন আছে চারটা ৷ বড়বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, তিনি থাকেন তিন সন্তানসহ খুলনায়, স্বামী পাকিস্তান নেভির অফিসার ৷ এ বাসায় থাকে তিন বোন ৷ তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাসা থেকে বের হওয়াও মুশকিল ৷ তার ওপর হাবিবুল আলম থাকে বাসার দোতলায় ৷ কাঠের খাড়া সিঁড়ি দোতলা থেকে সোজা নেমে গেছে নিচতলার যে জায়গাটায়, সেখানে সারাক্ষণই কেউ না কেউ বসে থাকে, আসা-যাওয়া করে, কাজ করে ৷

হাবিব একটা ছোট্ট পিআইএ মার্কা ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে ৷ এটা সে ব্যবহার করেছিল স্কাউটের প্রতিনিধি হিসাবে গত ডিসেম্বরে তার অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় ৷

ভোরের আজান হচ্ছে ৷ হাবিবুল আলম বিছানা ছাড়ে ৷ মশারি টানানোই থাকুক ৷ সে পাশবালিশটাকে শুইয়ে দেয় বিছানায় ৷ ঢেকে দেয় একটা চাদর দিয়ে ৷ তারপর একটা চিঠি লেখে বাসার সবার উদ্দেশে ৷ ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে যাচ্ছি ৷ আমার জন্যে চিন্তা কোরো না ৷ দোয়া কোরো ৷’ চিঠিটা পড়ার টেবিলে রেখে একটা বই দিয়ে চাপা দেয় সে ৷ তারপর কাঁধে ব্যাগটা ফেলে আস্তে করে দরজাটা বন্ধ করে বাইরে বারান্দায় আসে ৷ একটা টিনের চালা পার হতে হবে ৷ তারপর কাঠের ফ্রেম ৷ সেখান থেকে একটা লাফ দিয়ে নিচতলায় নামা যাবে ৷ তাহলেই কেবল সিঁড়িটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ৷ একটা একটা করে পা বিড়ালের মতো সতর্কতায় ফেলে সে কার্নিশে চলে আসে ৷ তারপর দোতলার মেঝেসমান উচ্চতা থেকে একটা লাফ দিয়ে এসে পড়ে দিলু রোডের সরু-গলিতে ৷ মাটিতে পড়ে যায় সে, ওঠে, তারপর হাত ঝেড়ে রওনা হয় অজানার উদ্দেশে ৷

সীমান্ত পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছায় মতিনগরে ৷ সেক্টর টুর হেডকোয়ার্টারে ৷ সেখান থেকে তাদের পাঠানো হয় কাঁঠালিয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে ৷ তারা যোগ দেয় ২ নম্বর প্লাটুনে ৷ তার মানে এরই মধ্যে ১ নম্বর প্লাটুন গড়ে উঠেছে, যারা আগে এসেছে তারা তাতে যোগ দিয়েছে ৷ ১ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার হলেন আজিজ ৷ ছাত্রলীগের ঢাকা কলেজের ভিপি ৷ ২ নম্বর প্লাটুনের কমান্ডার হয় জিয়া ৷

জিয়াসহ হাবিব আলমেরা সেকেন্ড প্লাটুনের সবুজ রঙের তাঁবুতে ঢোকে ৷ দেখতে পায় আরো ৭/৮ জন সেখানে আছে ৷ অর্থাৎ সব মিলে দাঁড়াল ১২/১৩ জন ৷ তাঁবুর এক পাশের ঢাকনা খুলে রাখা হয়েছে ৷ তবু তাঁবুর ভেতরটা গরম ৷

একদিন পরে, ২ নম্বর প্লাটুনের ছাত্রযোদ্ধাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন তখনকার কিংবদন্তি সেক্টর টু-র প্রধান মেজর খালেদ মোশাররফ ৷ সঙ্গে আসেন ক্যাপ্টেন হায়দার, শহীদুল্লাহ খান বাদল প্রমুখ ৷ খালেদ মোশাররফ লম্বা, ফরসা, তার পরনে নীল রঙের ট্রাউজার, গায়ে হলদে রঙের ফুলহাতা শার্ট, কোমরে পিস্তল ৷ ছাত্রযোদ্ধাদের সামনে তিনি দেন এক সম্মোহনী ভাষণ ৷ তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার শাসকদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করব তিনভাবে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক ক্ষেত্রে ৷ এ লড়াইয়ে ছাত্রদের ভূমিকা হবে খুবই গুরুত্বপর্ণ ৷ তোমাদের দিয়েই চলবে আমাদের গেরিলা ওয়ারফেয়ার অব সেক্টর টু ৷ তোমরা যারা এসেছ, তারা মনে রেখো, একবার শুরু করলে ফিরে যাওয়ার কোনো পথ নেই, এখনও চলে যেতে পারো, পরে আর পারবে না, হয় জিততে হবে, নয়তো মরতে হবে ৷ তবে মনে রেখো, স্বাধীন দেশের সরকার জীবিত গেরিলাদের চায় না, নো গভর্নমেনট ওয়ান্টস অ্যান অ্যালাইভ গেরিলা, নিতে পারে না, দেশ স্বাধীন হলে তোমাদের কী হবে আমি বলতে পারব না, তবে যদি তোমরা আত্মত্যাগ করো, যদি শহীদ হও, তাহলে সেটা হবে তোমাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ ব্যবহার, এই মৃত্যু হবে বীরের মৃত্যু, দেশের জন্য মৃত্যু, মাতৃভূমির জন্যে মৃত্যু, মায়ের জন্যে মৃত্যু ৷’

শাহাদত চৌধুরী ওরফে শাচৌকে যে মেজর খালেদ তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন, তার একটা কারণ ছিল ৷ সেটা হলো শাচৌয়ের সঙ্গে ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলের স্বাভাবিক যোগাযোগ ৷ শাচৌ, দেখা যাচ্ছে, ঢাকা গেলে সঙ্গে করে আনেন আলতাফ মাহমুদের সুর করা নতুন গান, আরো পরমাশ্চর্য, তিনি একবার সঙ্গে করে আনলেন দুটি কবিতা ৷ সেই কবির নাম বলা বারণ, কিন্তু খালেদ মোশাররফকে বলতে তো মানা নাই ৷ শামসুর রাহমান ৷ শামসুর রাহমান রয়ে গেছেন অবরুদ্ধ বাংলাদেশে, কিন্তু গোপনে লিখে শাচৌয়ের হাতে পাঠিয়েছেন একজোড়া আশ্চর্য কবিতা ৷ গোপনে সেই কবিতা বয়ে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেলাঘরের ক্যাম্পে খালেদের হাতে পৌঁছে দিলেন শাচৌ ৷ সুলতানা কামাল পড়ে শোনাল কবিতা দুটো, খালেদসহ মুক্তিযোদ্ধাদের ৷

স্বাধীনতা তুমি

রবিঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান

স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো

মহান পুরুষ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-

আর

তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা

তোমাকে পাওয়ার জন্যে

আর কতকাল ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায় ?

আর কতকাল দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?

তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা

সকিনা বিবির কপাল ভাঙল

সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর ৷

কবিতা দুটো শুনে পুরো ক্যাম্প উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল ৷ এর পরে শাচৌ আর আলম অবসর পেলে যেতেন কবি শামসুর রাহমানের বাড়ি ৷ কবিও খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করতেন গেরিলাদের ৷ এই গেরিলাদের দেখেই শামসুর রাহমান লেখেন তাঁর আরেকটা অসাধারণ কবিতা-গেরিলা ৷ ওই কবিতাটা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলেন শাচৌ, যখন পড়ে শোনানো হলো, আবেগে চোখ ভিজে এসেছিল অনেকেরই ৷

দেখতে কেমন তুমি ? কী রকম পোশাক আশাক

পরে করো চলাফেরা ? মাথায় আছে কি জটাজাল ?

পেছনে দেখতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন ?

টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবরজং ঢোলা

পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও

পাখির মতন কিংবা চাখানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন ৷

দেখতে কেমন তুমি ?-অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে

কুলুজি তোমার আঁতিপাঁতি ৷ তোমার সন্ধানে ঘোরে

ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য, পাড়ায় পাড়ায় ৷ তন্ন তন্ন

করে খোঁজে প্রতিঘর ৷ পারলে নীলিমা চিরে বের

করত তোমাকে ওরা, দিত ডুব গহন পাতালে ৷

তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছ হাত ধরে পরস্পর ৷

সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ-তাড়ানিয়া;

তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন, সন্তান আমার ৷

শাহাদত চৌধুরী আজ যুদ্ধের ১৪ বছর পরেও স্মরণ করতে পারেন, ভাই আর সন্তান বলে সম্বোধন করার এই শেষ পঙ্ক্তিটা তাদের শরীরে কী রকম বিদ্যুৎ খেলিয়ে দিয়েছিল ৷

ট্রেনিং শেষে হাবিবুল আলমের প্রথম ঢাকা আগমন আর ঢাকায় প্রথম অপারেশন ছিল মেজর নূরুল ইসলাম শিশুর স্ত্রী আর দু কন্যাকে ঢাকা থেকে মতিনগর নিয়ে যাওয়া ৷ এ জন্যে নুরুল ইসলাম পুরস্কার হিসেবে হাবিবুল আলমকে দিতে চেয়েছেন একটা চায়নিজ এসএমজি আর কাজী কামালকে একটা চায়নিজ পিস্তল ৷ এর আগে কাজী কামাল কাইয়ুমকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় এসে মেজর শাফায়াত জামিলের স্ত্রী ও দু পুত্রকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সাফল্য দেখিয়েছে ৷ এবার মেজর নুরুল ইসলাম শিশুর পরিবারকে নিতে কাজী কামালের ডাক পড়লে হাবিবও তার সঙ্গে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করে, কারণ হাবিব শিশুর বাসাটা আগে থেকেই চেনে ৷ আর কাজী কামালকে হাবিবুল আলম আগে থেকেই চেনে বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসাবে, তাকে ডাকে কাজী ভাই বলে, হাবিবুল আলম নিজেও ফার্স্ট ডিভিশন লিগে হকি খেলে থাকে ৷

এই পিস্তলটা কাজী জিতে নিতে সক্ষম হয়, হাবিবও জিতে নেয় এসএমজিটা, মেজর নুরুল ইসলামের পরিবারকে তারা সীমান্তের ওপারে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে পারে সাফল্যের সঙ্গে ৷ এই পিস্তলটার কথা ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষভাবে মনে পড়ে যায় এ জন্য যে, জুয়েলের খুব লোভ ছিল পিস্তলটার ওপর ৷ আজাদদের বাসা থেকে ধরা পড়ার দিনও জুয়েল তার পাশে এই পিস্তলটা রেখেছিল ৷ ওখান থেকেই কাজী কামাল পিস্তলটাকে হারায় আর হারায় আজাদকে, জুয়েলকে, বাশারকে ৷

৩৬

আজাদ যুদ্ধে যাওয়ার পরে, তার মাকে একাধিকবার বলেছিল, এটা তার খালাতো ভাইবোনদের মনে আছে এখনও যে আজাদ বলছে, ‘মা, আমি কিন্তু রাজনীতি করি না, পলিটিঙ্ করতে আমি যুদ্ধে যাই নাই, আমি যুদ্ধে গেছি বাঙালির উপরে পাকিস্তানিদের অত্যাচার মানতে পারছি না বলে, রাজারবাগের পুলিশ ব্যারাকে ওরা যা করছে… ৷

২৫শে মার্চ রাতে রাজারবাগে কী ঘটেছিল, সেটা আজাদ আর বাশার কিছুটা নিজের চোখে দেখেছিল ৷ আর এপ্রিল মে মাসে কী ঘটছে সেখানে, তার বিবরণ তারা পেয়েছিল এক পুলিশ সুবেদারের কাছ থেকে ৷ এই পুলিশ সুবেদারের বাড়ি ছিল মাওয়ায় ৷ আজাদরা তাকে ডাকত খলিল মামা বলে ৷

মা তাঁর কথা মাঝে মধ্যেই স্মরণ করতেন, ‘খলিলটা যে আর আসে না ৷ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কে জানে ? আজাদ, একটু খোঁজ নিস তো ৷ খলিল বেঁচে আছে নাকি ?’

এপ্রিলের মাঝামাঝি পুলিশের সুবেদার খলিল একদিন আসেন আজাদদের বাসায় ৷

মা বলেন, ‘আল্লাহ মালিক ৷ তুমি বেঁচে আছ খলিল ৷’

‘জি বুবু ৷ হায়াত আছে ৷ আপনাদের দোয়ায় বাঁইচা আছি ৷’

আজাদের সঙ্গেও তাঁর দেখা হয় ৷ মা তাঁর জন্যে চাল চড়িয়ে দেন চুলায় ৷

মা বলেন, ‘তোমার কোনো খবর পাই না ৷ বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছিল ৷ চারদিক থেকে কত দুঃসংবাদ আসছে ৷’

খলিল বলেন, “বুবু, কী দেখলাম এই জীবনে ৷ দোজখ দেখা হইয়া গেছে ৷ মার্চ মাসের ২৯ তারিখে কোতোয়ালি থানায় পোস্টিং হইল ৷ আমরা আটজন ৷ থানায় গিয়া দেখি, কী কবো বুবু, দেওয়ালে, মেঝেতে চাপ চাপ রক্ত, থানার দেওয়াল মনে করেন গুলির আঘাতে ঝাঁজরা হইয়া আছে ৷ বুড়িগঙ্গার পাড়ে গিয়া খাড়াইলাম ৷ খালি লাশ আর লাশ ৷ নদীর পানি দেখা যায় না ৷ মনে করেন পুকুরে বিষ দিলে যেমন মাছে পানি ঢাইকা থাকে, বুড়িগঙ্গায় খালি মরা মানুষ ভাসতেছে ৷ একটা পুলিশের লাশ দেইখা আগায়া গেছি ৷ দেখি, আমাদের পিআরএফের কনস্টেবল আবু তাহের ৷ আমি চোখের পানি আটকাইতে পারি না ৷ আরো বহু সিপাহির ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভাসতেছে ৷ আমি তাহেরের বডি ধরতে গেছি, বেহুঁশের মতো, পেছন থাইকা এক পাঞ্জাবি সোলজার চিল্লায়া উঠল, ‘শুয়র কা বাচ্চা, তুমকো ভি পাকড়াতা হায়, কুত্তা কা বাচ্চা, তুমকো ভি সাথ মে গুলি করেগা ৷’ আমি মনে মনে কই, আমি সাব ইন্সপেক্টর আর তুমি একজন সোলজার, আমার সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করতেছ, করো ৷ আল্লাহ বিচার করবে ৷”

মা বলেন, ‘মহুয়া, দ্যাখো তো, চুলায় ভাতের কী অবস্থা ৷ আঁচটা একটু কমিয়ে দিও মা ৷ হ্যাঁ ভাই, বলো ৷’

খলিল বলে চলেন, ‘কোতোয়ালি থানার বরাবর সোজাসুজি গিয়া বুড়ীগঙ্গার লঞ্চঘাটটা আছে না, সেই পারে খাড়াইলাম ৷ দেখলাম বুড়িগঙ্গার পাড়ে লাশ, খালি লাশ, পইচা-গইলা যাইতেছে, বেশুমার মানুষের লাশ ভাসতেছে ৷ দেখলাম কত মানুষ মইরা ভাইসা আছে ৷ বাচ্চা, বুড়া, ছেলে, মেয়ে ৷ যতদূর চোখ যায়, দেখলাম বাদামতলি ঘাট থাইকা শ্যামবাজার ঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে অগণিত মানুষের পচা-গলা লাশ ৷ বুবু, ভাইগ্না এখানে আছে, কওয়া যায় না আবার না কইয়াও পারি না, অনেক উলঙ্গ মহিলার লাশ দেখলাম, পাকিস্তানিরা অত্যাচার কইরা মারছে, দেইখাই বোঝা যাইতেছে ৷ ছোট ছোট মাসুম বাচ্চাদের মনে হইল আছাড় মাইরা খুন করছে ৷ সদরঘাট টার্মিনালের শেডের মধ্যে ঢুইকা খালি রক্ত আর রক্ত দেখলাম…দেখলাম মানুষের তাজা রক্ত এই বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে ৷ বহু মানুষরে ধইরা আইনা টার্মিনালে জবাই করছে ৷ বেটন আর বেয়নেট দিয়া খোঁচায়া মাইরা টাইনা হেঁচড়ায়া পানিতে ফেইলা দিছে ৷ শেডের বাইরের খোলা জায়গাটায় গিয়া দেখি, কাক আর শকুনে ছা্ইয়া গেছে ৷ সদরঘাট টার্মিনাল থাইকা পূর্ব দিকে পাক মিলিটারির সদর আউটপোস্টটা আছে না, সেই দিকে তাকাইলে দেখবেন নদীর পাড়ের সমস্ত বাড়িঘর ছাই কইরা ফেলছে ৷ দেখলাম রাস্তার পাশে ঢাকা মিউনিসিপালিটির কয়েকটা ময়লা পরিষ্কার করার ট্রাক খাড়ায়া আছে, সুইপাররা হাত-পা ধইরা টাইনা হেঁচড়ায়া ট্রাকে লাশ উঠাইতেছে ৷ কাপড়ের বাজারের চারদিকে রূপমহল সিনেমা হলের সামনে খালি লাশ ৷ খ্রিষ্টান মিশনারি অফিসের সামনে, সদরঘাট বাসস্টপেজের চারদিকে, কলেজিয়েট হাইস্কুল, জগন্নাথ কলেজ, পগোজ হাইস্কুল, ঢাকা জজকোর্ট, পুরাতন স্টেট ব্যাংক বিল্ডিং, তারপরে ধরেন সদরঘাট গির্জা, নওয়াবপুর রোডের চারদিকে, ক্যাথলিক মিশনের বাইরে ভিতরে, আদালতের সামনে বহু মানুষের ডেড বডি পইড়া আছে ৷’

আজাদ মাথা নিচু করে সব শুনছে ৷ মায়ের চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়ছে ৷

মা ভাত বাড়েন ৷ আজাদ আর খলিল একসঙ্গে ভাত খেতে বসে ৷ খলিল এমনভাবে গোগ্রাসে খেতে থাকেন যে কতদিন তিনি খান না ৷ আজাদ ভাতের থালায় ভাত নাড়েচাড়ে. কিন্তু ভাত তুলে মুখে দিতে পারে না ৷ তার নাকে এসে লাগে লাশের গন্ধ ৷

আজাদের এই খলিল মামা পরে আবার আসেন তাদের বাসায় ৷ বাশার ছিল সেদিন ৷ আজাদ তাঁকে তাদের ঘরে নিয়ে আসে ৷ বলে, ‘খলিল মামা, কী অবস্থা বলেন তো ৷’

তিনি বলেন, ‘বাশার সাহেব তো আবার সাংবাদিক, সাংবাদিক মানে হইল সাংঘাতিক ৷ আমি তার সামনে কিছু বলব না ৷’

বাশার বলে, ‘মামা, আমি এসব লিখব না ৷ শুধু শুনে রাখি, দেশ যদি কোনো দিন স্বাধীন হয়, তখন লিখব ৷’

খলিল মামা বলেন, ‘বাবা রে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আছি ৷ যা দেখতেছি, তা আল্লাহ কেমনে সহ্য করতেছে, বুঝতেছি না ৷ পাঞ্জাবি সৈন্যরা ট্রাকে কইরা, জিপে কইরা ডেলি স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রীদের ধইরা আনে ৷ ঢাকার নানান জায়গা থাইকা বাচ্চামেয়ে ইয়ং মেয়ে সুন্দরী মহিলাদের ধইরা আনে ৷ হাতে বইখাতা দেইখাই বোঝা যায় স্টুডেন্ট ৷ মিলিটারি জিপে ট্রাকে যখন মেয়েদের পুলিশ লাইনে আনা হয়, তখন পুলিশ লাইনে হৈচৈ পইড়া যায় ৷ পাকিস্তানি পুলিশ জিভ চাটতে চাটতে ট্রাকের সামনে আইসা মেয়েদের টাইনা হেঁচড়ায়া নামায়া কাপড়-চোপড় ছিঁইড়া-খুঁইড়া উলঙ্গ কইরা আমাদের চোখের সামনেই মাটিতে ফেইলা কুত্তার মতো অত্যাচার করে ৷ সারা দিন নির্বিচারে রেইপ করার পর বৈকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার বিল্ডিংয়ের উপর চুলের সাথে লম্বা লোহার রড বাইন্ধা রাখে ৷ আবার রাতের বেলায় শুরু হয় অত্যাচার ৷ গভীর রাতে আমাদের কোয়ার্টারে মেয়েদের কান্না শুইনা সবাই ঘুম থাইকা জাইগা জাইগা উঠি ৷’ খলিল সাহেব কাঁদতে থাকেন ৷

আজাদ আর বাশার নীরব ৷

তারা বুঝতে পারে না, খলিল মামাকে তারা কীভাবে সান্ত্বনা দেবে ? তাদেরকেই বা সান্ত্বনা দেয় কে ? আজাদ ভেতরে ভেতের ফুঁসতে থাকে ৷ এই অত্যাচার মুখ বুজে যে সহ্য করে, সে কি মানুষ ?

৩৭

আজাদকে যুদ্ধে এনেছিল কাজী কামাল উদ্দিন ৷ তার বন্ধুরা, ক্রিকেট খেলার সঙ্গীরা যে অনেকেই আগরতলা গিয়ে ট্রেনিং নিয়ে এসেছে, আজাদ জানত না ৷

বর্ষা এবার প্রলম্বিত হচ্ছে ৷ একেক দিন বৃষ্টি শুরু হলে আর থামতেই চায় না ৷ আর বৃষ্টি না হলে পড়ে গরম ৷ সেটা আরো অসহ্য ৷ আজাদদের মগবাজারের বাসার দু বাসা পরের বাসাটার সামনের বাগানে বেলিফুলের ঝাড়ে ফুল ফুটে থাকে ৷ একেকটা রাতে তার ঘ্রাণ এসে নাকে লাগে আজাদের ৷ আজাদের কেমন ঘোর ঘোর লাগে ৷ বেলির গন্ধের সঙ্গে রাজারবাগে দেখা লাশের গন্ধ যেন মিশে যায় ৷

এক দুপুরে কাজী কামালের সঙ্গে দেখা আজাদের ৷ ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সামনে একটা সিগারেটের দোকানে ৷ এটা আজাদের প্রিয় একটা সিগারেটের দোকান ৷ ৩ টাকার সিগারেট কেনার জন্য আজাদ এখানে আসে ৩ টাকা বেবিট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে হলেও ৷

কাজী কামালকে দেখেই আজাদ উল্লসিত, ‘আরে কাজী, তুমি কই হারিয়ে গেলে ৷ দেখা পাই না ৷’

কাজী কামাল সন্ত্রস্ত ৷ পাগল কী বলে! এইভাবে প্রকাশ্য রাজপথে এই ধরনের কথা বলার মানে ধরা পড়ে যাওয়া ৷ কাজী কামাল কথা ঘোরানোর জন্য বলে, ‘এরামে চলো ৷ তোমারে সব কইতেছি ৷’

এরাম রেস্তোরাঁ এবং বার ৷ দিনের বেলাতেও খোলা থাকে ৷ আজাদ আর কাজী কামাল সেখানে যায় ৷ বারটা এখন ফাঁকা ৷ একটা কোনায় তারা দুজন বসে পড়ে ৷

কাজী কামাল বলে, ‘আজাদ ৷ তোমার একটু হেল্প দরকার ৷ আমি তো ট্রেনিং নিয়া আসছি ৷ গেরিলা ট্রেনিং ৷’

আজাদ বলে, ‘এটা তুমি কী করলা ? আমাকে ফেলে রেখে একা একা চলে গেলা ৷ তুমি ওঠো ৷ যাও ৷ তোমাকে আমি কিছুই খাওয়াব না ৷’

কাজী কামাল বলে, ‘আরে পাগলামো কইরো না ৷ তুমি এখানে থাইকাই যুদ্ধ করতে পার ৷ হেল্প আস ৷’

আজাদ বলে, ‘কী ধরনের হেল্প ?’

‘এবার আমরা অনেক অস্ত্রশস্ত্র আনছি ৷ রাখার জায়গা নাই ৷ আবার আমাদেরও থাকার জায়গা লাগে ৷ হাইড আউট ৷ তোমার বাসায় আমাদের জায়গা দিতে পার ৷’

‘অফ কোর্স ৷’

‘বুইঝা বলো ৷ এখনই বলার দরকার নাই ৷ তোমার মায়ের পারমিশন নাও ৷ বাসায় বাইরের ছেলেরা থাকবে ৷ অস্ত্রপাতি থাকবে ৷ খালাম্মাকে না জানায়া এসব করা উচিত হবে না ৷’

‘মা কিছু বলবে না ৷ রাজি হয়েই আছে ৷’

‘তবুও তুমি মারে জিগাও ৷ রান্নাবান্না কইরা খাওয়াইতে তো হবে ৷’

‘মা তো খাওয়ানোর লোক পেলে খুশি হয় ৷’

‘আরে তুমি জিগাও তো ৷ আমি তোমার বাসায় কালকা আসতেছি ৷ জুয়েলকেও নিয়া আসব ৷ সকাল ১০টায় বাসায় থাইকো ৷’

‘জুয়েলও গিয়েছিল নাকি ?’

‘হ ৷ আরো কে কে আছে আমগো লগে, দেখলে বেহুঁশ হইয়া যাবা ৷ হা-হা-হা ৷’

দুজন খদ্দের এসে তাদের পাশের টেবিলে বসে ৷ তারা আর আলাপ করতে পারে না ৷ গেলাস শেষ করে উঠে পড়ে ৷ আজাদ বিল মিটিয়ে দেয় ৷

আজাদ বাসায় যায় ৷ মাকে বলে, ‘মা শোনো, তোমার সাথে কথা আছে ৷’

মা রান্নাঘরে ছিলেন ৷ তার কপালে ঘাম ৷ তিনি আঁচল দিয়ে ঘাম মোছেন ৷ হাতের হলুদ তার মুখে লেগে যায় ৷ ‘বল, কী বলবি, চুলায় রান্না ৷’

‘বসো ৷ বসে মন দিয়া শোনো ৷’

‘বলে ফেল ৷’

‘আগে বলো, না করবা না ৷’

‘আরে তুই আগে বলে ফেল না ৷’

‘মা, আমার কয়জন বন্ধুবান্ধব আমাদের বাড়িতে এসে থাকবে ৷’

‘থাকবে থাকুক ৷ এটা আবার জিজ্ঞেস করার কথা ৷ বন্ধুগুলো কারা ?’

‘এই ধরো কাজী কামাল, জুয়েল ৷’

‘কাজী, জুয়েল এরা অনেক দিন আমাদের বাসায় আসে না ৷ আসতে বল ৷ ওদের বাড়িতে কি অসুবিধা হয়েছে কোনো ?’

আজাদ কন্ঠস্বর নামিয়ে বলে, ‘ওরা তো যুদ্ধ করছে ৷ শুনছ না, ঢাকায় গেরিলা অপারেশন হচ্ছে ৷ ওরাই করছে ৷ তাই নিজের বাসায় থাকা নিরাপদ না ৷ সাথে কিছু অস্ত্রশস্ত্রও থাকে তো ৷’ আজাদ শেষের কথাটা বলে রাখে ইচ্ছা করেই ৷ অস্ত্র রাখার অনুমতিটাও এই সুযোগে নিয়ে রাখা দরকার ৷

মা স্থির হয়ে যান খানিকক্ষণের জন্যে ৷ তাঁর কপালে ঘামের বিন্দুগুলো শিশিরের মতো জমতে থাকে ৷ এবার তিনি কী বলবেন ?

একটামাত্র ছেলে তাঁর ৷ এই ছেলেকে মানুষ করার জন্যেই যেন তিনি বেঁচে আছেন ৷ ছেলে তাঁর এমএ পাস করেছে ৷ এখন তার জীবন, তার নিজের জীবন ৷ সত্য বটে, ছেলে তাঁর এখন আয়-রোজগার করবে, এখন মায়ের কষ্ট করে জমি আবাদ করার দিন শেষ, বীজ বোনা, নিড়ানি দেওয়া সব সমাপ্ত, এখন তাঁর ফসল ঘরে তোলার দিন ৷ এখন সংসারে তাঁর লাগার কথা নবান্নের আনন্দের ঢেউ, নতুন ভাতের গন্ধের মতোই আনন্দের হিল্লোলে তাঁর ঘরে মৌ-মৌ করার কথা ৷

ইতিমধ্যেই তিনি ছেলের জন্যে একটা বউ দেখে রেখেছেন ৷ আলাপ-আলোচনা কেবল শুরু হয়েছে ৷ আজাদকে নিয়ে তিনি একদিন যাবেন মেয়ের বাসায়, বেড়াতে যাওয়ার ছলে দেখে আসবেন মেয়েকে ৷

এর মধ্যে এ কোন প্রস্তাব!

কিন্তু তিনি নাই-বা করেন কোন মুখে! জুয়েলের মাও তো ছেড়েছে জুয়েলকে, কাজী কামালের মা কাজী কামালকে! আর তা ছাড়া ২৫শে মার্চের পরে ঢাকা শহরের ওপরে পাকিস্তানি মিলিটারি কী অত্যাচার নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে, সে খবর কি তিনি পাচ্ছেন না! বিনা দোষে মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ ৷ রোজ মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, অত্যাচার করছে মেয়েদের ওপর ৷ তার জুরাইনের পীরসাহেব বলেন, ‘মেয়েদের ওপরে অত্যাচার যখন শুরু হয়েছে, পাকিস্তান আর্মি তখন পারবে না ৷ আল্লাহতালা এই অত্যাচার সহ্য করবেন না ৷’

না ৷ এই অত্যাচার চলতে দেওয়া যায় না ৷ এটা অধর্ম ৷ তাঁর অবশ্যই উচিত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা ৷ রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটা গান শোনা যায় : মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি… হ্যাঁ, একটা ফুলকে, একটা দেশকে, দেশের মানুষকে তো বাঁচাতে হবে, আর বাঁচাতে হলে যুদ্ধ তো করতেই হবে ৷ আজাদের বন্ধুরা যুদ্ধ করছে, সারা বাংলার কত কত তরুণ-যুবক, কত কত মায়ের সন্তান যুদ্ধে গেছে, আর তার ছেলে যোদ্ধাদের সাহায্য করবে না ?

তিনি কপালের ঘাম মুছে বলেন, ‘নিয়ে আসিস তোর বন্ধুদের ৷’

আজাদ খুশি হয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে ৷ বলে, ‘মা, তোমার কপালে হলুদ লেগেছে, সুন্দর দেখাচ্ছে ৷’

কাজী কামাল আসে পরদিন সকাল ১০টায় ৷ মা তার সামনে আসেন ৷ বলেন, ‘কেমন আছ বাবা ৷ কী খাবে ? আজাদ আমাকে বলে কামাল, জুয়েল এরা এসে বাসায় থাকবে ৷ এ জন্য কি পারমিশন নিতে হয় নাকি! তোমরা আমার ছেলের মতো না ? আসবে ৷ যখন সুবিধা মনে করবে আসবে ৷’

জায়েদের মনে পড়ে, আজাদদের মগবাজারের বাসাটা ছিল একটা ছোটখাটো ক্যান্টনমেন্ট ৷ প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ আসত এ বাসায় ৷ আবার এখান থেকে বিভিন্ন বাসায় সেসব চালান হয়েও যেত ৷ সে নিজেও বস্তায় ভরে অস্ত্র নিয়ে গেছে আশপাশের বাসায় ৷ দিলু রোডের হাবিবুল আলমের বাসায় যেমন ৷

তার এই বীরত্ব নিয়ে কৌতুক করত মর্নিং নিউজের সাংবাদিক আবুল বাশার ৷ বলত, কিরে, ভয় পেয়েছিস নাকি! আয় তো, এদিকে আয় ৷ জায়েদের প্যান্ট একটানে খুলে বলত, দেখি, প্যান্টের মধ্যে হেগে ফেলেছিস নাকি!’

জায়েদ খুবই বিরক্ত হতো ৷ সে কত কষ্ট করে পিঠে বয়ে রেললাইন ধরে এগিয়ে গিয়ে দিলু রোডের পেছন দিয়ে ঢুকে অস্ত্র রেখে এল ৷ আর তার সঙ্গে কিনা এই ইয়ারকি ৷ বাশারের লুঙ্গিটা ধরে একটা টান দেবে নাকি সে!

দাদার বন্ধু ৷ সে কিছু বলতেও সাহস পায় না ৷

আজাদের আরেক খালাতো ছোট ভাই টিসুর মনে পড়ে, একবার আজাদ ধরে নিয়ে এল এক পুরনো খবরের কাগজের ফেরিঅলাকে ৷ তাকে নিয়ে গেল ঘরের মধ্যে ৷ টিসুর ছিল কতগুলো পুরোনো বইখাতা, সেসব বিক্রি করার উদ্দেশ্যে সে ওই ঘরে গিয়ে দেখে ফেরিআলার ডালায় কাগজপত্রের নিচে সব আগ্নেয়াস্ত্র ৷ ফেরিঅলাটাও আসলে এক মুক্তিযোদ্ধা ৷ টিসুর আর বইখাতা বিক্রি করা হয় না ৷

আর সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে পড়ে, যুদ্ধের সময় তাদের ইস্কাটনের বাড়িতে বদিউল আলম আর স্বপন ছিল দুই মাসের মতো ৷ আশরাফুলের বাবা নান্না মিয়া কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা ছিলেন বলে ধরেই নেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সন্দেহের তালিকায় এই বাসা থাকবে না ৷ এটা হতে পারে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ৷ যুদ্ধের মধ্যে একদিন কাজী কামাল উদ্দিন, জুয়েল, বদি তাদের বাসায় আসে ৷ সঙ্গে আজাদও ছিল ৷

জুয়েল বলে, ‘আমরা তো সব যুদ্ধে ইনভল্ভ্ড হয়ে গেছি ৷ তুমি কী করবা ?’

সৈয়দ আশরাফুল একই সঙ্গে ভয়ে কাঁপে, আবার বিস্ময়ে চোখের পাতা পিটপিট করতে থাকে, কারা কারা জড়িয়ে পড়ছে যুদ্ধের সঙ্গে, সব খেলোয়াড়, সব ভালো ছেলে, সে লক্ষ করে, এই গেরিলারা নিজেদের মধ্যে সব সময় কথা বলে ইংরেজিতে… আর বদিকে দেখে তার বিস্ময় আরো ব্যাপক, বদি ভাই! এনএসএফের গুণ্ডা বদি ভাই, তিনিও ট্রেনিং নিয়ে এসেছেন!

সৈয়দ আশরাফুল জবাব দেয়, ‘আপনাদের যা যা সাহায্য করন লাগে, করুম ৷ বাট আই উইল নট গো টু ইন্ডিয়া…’

বদিউল আলম আর স্বপন-এই দুই যোদ্ধা আশরাফুল হকের বাড়িতে যখন ছিল, তখন বদির এক অসাধারণ গুণ পর্যবেক্ষণ করে আশরাফুল ৷ আশরাফুলের এক বোন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, তাঁর সংগ্রহে ছিল প্রচুর বই, দেশী-বিদেশী বই, বদি দুই মাসে পুরো লাইব্রেরির অর্ধেকটা পড়ে সাবাড় করে ফেলে ৷ একটা বই হাতে নিয়ে সে ঘন্টা তিন-চারেক একেবারে দুনিয়াদারির বাইরে চলে যেত, পড়া শেষ করে তারপর যেন ফিরে আসত মর্ত্যে ৷

সৈয়দ আশরাফুল হকের এও মনে পড়ে, একাত্তরে আজাদ ভাইদের বাসাটা ছিল একটা মুক্তিযোদ্ধা মেসের মতো ৷ প্রায়ই বিনা নোটিসে আজাদের মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা চলে আসত বাসায় ৷ থাকার দরকার হলে থাকত, খাওয়ার দরকার না হলেও খেতে বাধ্য হতো ৷ কারণ আজাদের মা না খাইয়ে ছাড়তেন না তাদের ৷

জুয়েল আর কাজী কামাল মাঝে মধ্যেই আজাদদের বাসায় আসে ৷ রাতে থাকে ৷ কোনো অপারেশন না থাকলে তাস খেলে ৷ টিভি দেখে ৷ আর আজাদের সঙ্গে গল্প করে ৷

জুয়েল বলে, ‘দোস্তো, যখন তুই আর্মস হাতে নিবি, ফায়ার করবি, তখন কিন্তু ইরেকশন হয় ৷ ঠিক কি না কাজী ভাই ?’

কাজী কামাল স্বীকার করে, ‘হয় ৷’

জুয়েল বলে, ‘আজাদ, তুমি তো দোস্তো বুঝবা না ৷ তুমি তো আর্মস নাড়ো নাই ৷’

আজাদ হাসে ৷ ‘কী কয় ৷ আমাদের আর্মসের দোকান ছিল না ? আমার টার্গেট তোদের চাইতে ভালো ৷ আরে আমি যতগুলান পাখি শিকার করছি, আর কেউ করতে পারছে ?’

জুয়েল হাসে ৷ ‘পাখি শিকার করা আর পাক আর্মি মারা আলাদা ব্যাপার ৷ পাঞ্জাবি হইলেও তো মানুষ ৷’

আজাদ বলে, ‘দ্যাখো ৷ পাখি মারতে মায়া লাগে ৷ পাঞ্জাবি মারতে আবার মায়া কী রে! ওরা কেমন করে মারছে!’

আজ মনে হয় তাদের গল্পে পেয়েছে ৷ জুয়েল আর কাজী কামাল আজাদকে শোনাচ্ছে তাদের অপারেশনের কথা ৷

জুয়েল শোনায় তাদের ফার্মগেট অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ ৷

ধানমন্ডি ২৮-এর হাইড আউটে মিটিং ৷ আলম, বদি, স্বপন, চুল্লু ভাই ছাড়াও মিটিংয়ে ছিলেন শাহাদত চৌধুরী ৷ ঠিক হলো ফার্মগেটের আর্মি চেকপোস্ট অ্যাটাক করা হবে ৷ সবচেয়ে বেশি উৎসাহ বদির ৷ এক সপ্তাহ ধরে রেকি করা হলো ৷ তারপর আবার মিটিং ৷ সে মিটিংয়ে ঠিক হলো ফার্মগেটের সঙ্গে সঙ্গে দারুল কাবাবেও আক্রমণ চালানো হবে ৷ ওটাও একই ময়মনসিংহ রোডে ৷ দুটো গ্রুপ গঠন করা হলো ৷ ফার্মগেট অপারেশনে থাকবে বদি, আলম, জুয়েল, পুলু আর সামাদ ভাই ৷ আহমেদ জিয়ার নেতৃত্বে চুল্লু ভাই, গাজি থাকবে দারুল কাবাব ঘর অপারেশনে ৷ ফার্মগেট অপারেশন শেষ হলে গ্রেনেড চার্জ করা হবে, এটাই হবে দারুল কাবাবে হামলা করার সংকেত ৷

সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে ফার্মগেটে মিলিটারি ক্যাম্পে হামলা করার সময় ঠিক হলো ৷ ওই দিন বিকালে সবাই মিলিত হলো সামাদ ভাইয়ের মগবাজারের বাসায় ৷ আলমের হাতে মেজর নুরুল ইসলাম শিশুর দেওয়া এসএমজি ৷ অন্য সবার হাতে থাকে স্টেনগান ৷ অপারেশন করতে দু-তিন মিনিট লাগার কথা ৷ এর মধ্যে আলম একটা ঝামেলা করে ফেলে ৷ তার সাব মেশিনগান পরিষ্কার করতে গিয়ে পরিষ্কার করার নিজস্ব উদ্ভাবিত পুল নলের ভেতরে আটকে যায় ৷ সময় পেরিয়ে যাচ্ছে ৷ সাড়ে ৬টা বাজে ৷ সবাই উৎকন্ঠিত ৷ এসএমজি চালু না হলে আজকের অপারেশনই হবে না ৷ শেষে কেরোসিন ঢেলে ভেতরে আটকে যাওয়া দড়ির গিঁটে আগুন লাগিয়ে ওটাকে জঞ্জালমুক্ত করা যায় ৷

নিয়ন সাইনের মালিক সামাদ ভাই গাড়ি চালাবেন ৷ বদি আর আলম থাকবে সামনের সিটে ৷ জানালার ধারে থাকবে আলম ৷ পেছনের সিটে স্বপন, জুয়েল আর পুলু ৷ এর আগে আলম, বদি, সামাদ ভাই ফার্মগেট এলাকা অনেকবার রেকি করেছে ৷ এমনকি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ওখানে পাকিস্তানি সৈন্যরা কে কী করে, তাও তারা জানে ৷

এখনও কিছু সময় বাকি আছে ৷ জুয়েল স্বভাবমতো চুটকি বলতে শুরু করে ৷ সামাদ ভাই মেটালিক সবুজ টয়োটা সেডান গাড়িটা শেষবারের মতো চেক করে নেন ৷ ৭টা ১৫ মিনিট ৷ সবাই তাদের পোশাক-আশাক পরিপাটি করে নেয় ৷ কেশবিন্যাস করে ৷ এর কারণ এলোমেলো পোশাকে গাড়িতে গেলে তাদের সন্দেহ করা হতে পারে ৷ ঢাকার গেরিলারা সব সময় ভালো শার্ট, ভালো প্যান্ট পরে ৷ ঠিক সাড়ে ৭টায় তারা গাড়িতে উঠে বসে ৷ আলমের হাতে এসএমজি, অন্যদের হাতে স্টেন, এ ছাড়া জুয়েল আর পুলুর হাতে ফসফরাস গ্রেনেড ৷ আরেকটা ইন্ডিয়ান পাইনঅ্যাপেল গ্রেনেড ৷ দেখতে আনারসের মতো বলে এই নাম ৷ ওপেনিং কম্যান্ড দেবে বদি ৷ ফেরার কম্যান্ড দেবে স্বপন ৷

গাড়ি চলতে শুরু করেছে ৷ মগবাজার থেকে ধীরে ধীরে এসে পড়ছে ময়মনসিংহ রোডে ৷ রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি চলাচল করছে ৷ শত্রুর গাড়ির কাছে আসতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত আপনা-আপনিই অস্ত্রের গায়ে চলে যাচ্ছে ৷ তারা ধীরে ধীরে দারুল কাবাব পেরিয়ে ফার্মগেট মোড়ে যায় ৷ ডান দিকেই তাদের লক্ষ্যবস্তু ৷ আর্মি চেকপোস্ট ৷ দুটো তাঁবু ৷ দুজন সৈন্য নিজেদের মধ্যে গল্প করছে ৷ আরেকজন সৈন্য একটা বেবিট্যাক্সি থামিয়ে এক যাত্রীকে তল্লাশি করছে ৷ বাকি সৈন্যরা হয়তো তাঁবুতে রাতের খাবার খাচ্ছে, বা বিশ্রাম নিচ্ছে ৷ তাদের গাড়ি ডানে ঘুরে তেজগাঁও সড়কে পড়ে ৷ কিছুদূর গিয়ে সামাদ ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেন ৷ তারপর গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির নিজস্ব গতিজড়তায় গাড়িটাকে এনে দাঁড় করান হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে ৷ পানের দোকানে বিকিকিনি চলছে যথারীতি ৷ সামাদ ভাই বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা ৷’ পাঁচজন নেমে পড়ে ৷ এক মিনিটের মধ্যে সবাই যার যার পজিশন নিয়ে ফেলে ৷ দুজন সৈন্য এখনও গল্প করছে ৷ তৃতীয় সৈন্যটিও তাদের কাছে এসে গল্প জুড়ে দেয় ৷ গেরিলাদের বুক কাঁপছে ৷ বদি নির্দেশ দেয় : ‘ফায়ার ৷’ আলম গুলি চালায় তিন সেন্ট্রিকে লক্ষ্য করে ৷ সেন্ট্রিরা সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে ৷ আর বাকি চারজন গেরিলা একযোগে ব্রাশফায়ার করতে থাকে দুই তাঁবু লক্ষ্য করে ৷ তিনজন প্রহরারত সৈন্যকে ধরাশায়ী করে আলমও তাক করে তাঁবু দুটো ৷ রচিত হয় গুলির মালা ৷ স্বপন নির্দেশ দেয় : ‘রিট্রিট’ ৷ জুয়েল আর পুলু বোমা চার্জ করে ৷ সবাই দৌড়ে এসে উঠে পড়ে গাড়ি ৷ সামাদ ভাই গাড়িতে টান দেন ৷ ময়মনসিংহ সড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলে ৷ তখন সবার খেয়াল হয় গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি ৷ দারুল কাবাব ঘরের অপারেশন তাই হতে পারে না ৷

জুয়েল তাদের এই অপারেশনের বিবরণ পেশ করে বিশদভাবে, রসিয়ে রসিয়ে ৷

আজাদ বলে, ‘কয়জন মিলিটারি মারা গেল, বুঝলি কেমনে!’

জুয়েল বলে, ‘১২ জন সোলজার মারা গেছে ৷ আমরা পরদিন গেলাম আশরাফুলের বাড়ি ৷ ওইখানে আমগো বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও সব কইল ৷ অর বোন হলিক্রসের টিচার না ? উনিই সব দেখছে ৷ সারা রাত আর্মিরা লাশ লইতে আসতেও সাহস পায় নাই ৷ ভোরবেলা আসছে ৷ হিউবার্টের বোন ১২ বার বুকে কপালে ক্রস করছে ৷ মানে ১২টা লাশ লইয়া গেছে ৷ চিন্তা কর ৷ এরা নাকি দুনিয়ার সবচাইতে সাহসী সোলজার ৷ সারা রাত সৈন্যরা পইড়া থাকল, কেউ তো উন্ডেডও থাকতে পারে, আইসা দ্যাখ, হসপিটালে লইয়া যা, ঢাকা শহরের মধ্যে এই সাহসটা পাইল না ৷ আরে নিউজ শুইনা নাকি ক্যান্টনমেন্টে সব সোলজারগো পিশাব পাইছে, একলগে এতজন বাথরুমে যাইব কেমনে, সব কাপড় নষ্ট কইরা ফেলাইছে, মুতের গন্ধে ক্যান্টনমেন্ট যাওয়া যাইতেছে না…’

শুনে আজাদ উত্তেজিত-’জুয়েল, যুদ্ধ যখন শেষ হবে, তোদেরকে অনেক অ্যাওয়ার্ড দেবে রে ৷ শোন, আমিও যাব নেঙ্ট অপারেশনে ৷ আমাকে তোরা অবশ্যই নিবি ৷’

‘যেতে চাইলে যাবি ৷ কিন্তু আম্মার পারমিশন লাগবে ৷ আম্মার পারমিশন ছাড়া তরে নেওন যাইব না’-জুয়েল বলে ৷ জুয়েল আজাদের মাকে আম্মা বলে, কারণ তার চাচাতো ভাই টগর আম্মা বলে ডাকে তাঁকে ৷

‘মা ঠিক পারমিশন দিবে ৷ ঘরে অস্ত্রশস্ত্র রাখতেছি ৷ তাতে যখন আপত্তি করে নাই, তখন…’

সেই রাতেই ভাত খেতে খেতে আজাদ মাকে বলে, ‘মা, এরা এরপর যেই অপারেশনে যাবে, আমি সেটাতে যেতে চাই ৷ এত বড় জোয়ান ছেলে, ঘরে বসে থাকে, আর দেশের মানুষ মার খায়, এটা হতে পারে না ৷’

মা কথার জবাব দেন না ৷

‘এই দ্যাখ মার অ্যাপ্রুভাল আছে ৷ মা আপত্তি করল না’-আজাদ কায়দা করে ৷

মা বলেন, ‘আমি কালকে তোকে ফাইনাল কথাটা বলব ৷ আজকের রাতটা সবুর কর ৷’

‘ঠিক আছে ৷ কিন্তু দ্যাখো মা, না কোরো না ৷’

মা সারা রাত বিছানায় ছটফট করেন ৷ কী বলবেন তিনি ছেলেকে ৷ যুদ্ধে যাও! পরে যদি ছেলের কিছু হয় ৷ এই ছেলে তাঁর বহু সাধনার ধন ৷ তাঁর প্রথম সন্তানটা একটা মেয়ে ৷ কানপুরেই জন্ম হয়েছিল মেয়েটার ৷ চৌধুরী সাহেব মেয়ের নাম রেখেছিল বিন্দু ৷ সেই মেয়ে এক বছর বয়সে মারা যায় ৷ প্রথম সন্তান বিয়োগের কষ্ট যে কী কষ্ট! বহু রাত সাফিয়া বেগম কেঁদেছেন ৷ মেয়েটা তাঁর কথা শিখেছিল ৷ ‘মা মা, দাদা দাদা’ বলতে পারত ৷ সুন্দর করে হাসত ৷ চৌধুরী সাহেব বলতেন, ফেরেশতারা হাসাচ্ছে ৷ বিন্দু তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে ছিল ৷ সেই মেয়ে বসন্ত হয়ে মারা গেল ৷ সাফিয়া বেগমের মনে হলো সমস্ত জগৎই শূন্য ৷ জীবনের কোনো মানে নাই ৷ বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া সমান কথা ৷ বিন্দু মারা যাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর পেটে সন্তান এসে গেল ৷ নতুন করে তিনি মাতৃত্বের স্বপ্ন বুনতে লাগলেন ৷ জন্ম নিল আজাদ ৷ তখন আজাদির স্বপ্নে পুরো ভারতই উত্তাল ৷ তাই ছেলের নাম, চৌধুরী রাখলেন আজাদ ৷ আজাদকে তিনি যত্ন করেছেন অনেকটা আদেখলার মতো করে ৷ সারাক্ষণ কপালে টিপ পরিয়ে রেখেছেন, যেন কারো নজর না লাগে ৷ মাজারে গিয়ে মানত করেছেন তার সুস্থতার জন্যে ৷ আজাদের কোনো অসুখ-বিসুখ হলে তিনি পাগলের মতো করতেন ৷ তাঁরা পাকিস্তানে চলে আসার পরে তাঁর শাশুড়ি এসবকে বাড়াবাড়ি বলে সমালোচনা করতেন ৷ কিন্তু তাঁর কীই-বা করার ছিল ৷ ছেলের অমঙ্গল-আশঙ্কায় সর্বদা তাঁর মন কুপিত হয়ে থাকত ৷ আজাদের পরেও তাঁর কোলে একটা বাচ্চা এসেছিল ৷ সেও তো বাঁচেনি ৷ আজাদ তাঁর সর্বস্ব ৷ তাকে বুকের মধ্যে আগলে না রেখে তিনি পারেন ?

সেই ছেলে আজ কেমন ডাগরটি হয়েছে ৷ মাশাল্লা স্বাস্থ্য-টাস্থ্য সুন্দর ৷ ছেলের জন্য তিনি মেয়ে দেখে রেখেছেন ৷ ছেলের বিয়ে দিতে পারলে তাঁর দায়িত্ব পালন সম্পূর্ণ হয় ৷ পুত্রপালনের দায়িত্ব তিনি স্বেচ্ছায় একা কাঁধে তুলে নিয়েছেন ৷ এই দায়িত্ব কঠিন ৷ আজকে একটা কঠিন সিদ্ধান্ত তাঁকে নিতে হবে ৷ এই সিদ্ধান্ত তিনি কী করে একা নেবেন ? ছেলের বাবার সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো ৷ তা তিনি জীবন থাকতেও করবেন না ৷ যে বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও স্থূল বাসনা থেকে নিজেকে নিরত রাখতে পারে না, সে আবার বাবা কিসের ? সাফিয়া বেগম আজ সত্যি অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি ৷

কিন্তু দেশ যখন তাঁর ছেলেকে চাইছে, তখন মা হয়ে কি তিনি ছেলেকে আটকে রাখতে পারেন ? বলতে পারেন, আমার একটামাত্র ছেলে, আর কেউ নাই ত্রিজগতে, আমার ছেলেকে ছাড় দাও ৷ এই কথা বলার জন্যে কি তিনি ইস্কাটনের বাসা ছেড়েছিলেন ? এই সুবিধা নেওয়ার জন্যে ? না ৷ ওটা ছিল তাঁর নিজস্ব সংগ্রাম ৷ আজকে দেশ অন্যায় শাসনে জর্জরিত ৷ সাফিয়া বেগম যতটুকু বোঝেন, রেডিও শুনে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনে, ছেলেদের আলোচনা শুনে, বাসায় আগত লোকদের কথাবার্তা যতটুকু তার কানে আসে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে, আর পুলিশ সুবেদার খলিলের বয়ান শুনে, তাতে পাঞ্জাবিদের এই জুলুম মেনে নেওয়া যায় না, মেনে নেওয়া উচিত না ৷ তিনি ছেলেকে মানুষ করেছেন কি নিজে ছেলের আয়-রোজগার আরাম করে ভোগ করবেন বলে! কক্ষনো নয় ৷ এটা তিনি ছেলেকে চিঠিতেও লিখে জানিয়েছেন, ছেলেকে তিনি মানুষ করেছেন মানুষের যা কিছু কর্তব্য তাই করবে বলে ৷ দেশ আর দশের কাজে লাগবে বলে ৷

অমঙ্গল-আশঙ্কায় আবার তাঁর বুক কেঁপে ওঠে, সমস্ত অন্তরাত্মা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে যায় ৷ যদি ছেলের কিছু হয়! তিনি কল্পনা করার চেষ্টা করেন, কেউ এসে তাঁকে খবর দিচ্ছে যে তার ছেলের গায়ে গুলি লেগেছে, না, তিনি কল্পনা করতে পারেন না, অশ্রুর প্লাবন এসে তাঁর দু চোখ আর সমস্ত ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে যায় ৷

একজন কারো সঙ্গে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো ৷ কিন্তু কার সঙ্গে! হঠাৎই মায়ের মনে পড়ে যায় জুরাইনের পীরসাহেবের কথা ৷ বড় হুজুর আর তাঁর স্ত্রী দুজনই বড় ভালো মানুষ ৷ তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করলেই তো চলে ৷

মা সকালবেলা রওনা দেন জুরাইন মাজার শরিফ অভিমুখে ৷ পীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন ৷ তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, ছেলে যুদ্ধে যেতে চায়, তিনি কি অনুমতি দেবেন ?

পীরসাহেব বলেন, ‘ছেলেকে যেতে দাও ৷ পাকিস্তানিরা বড় অন্যায় করতেছে ৷ জুলুম করতেছে ৷ আর তা ছাড়া, ছেলে বড় হলে তাকে আটকায়া রাখার চেষ্টা করে ফল নাই ৷ তুমি না করলেও সে যুদ্ধে যাবেই ৷’

মায়ের মন থেকে সব দ্বিধা দূর হয়ে যায় ৷ ফিরে এসে তিনি আজাদকে ডাকেন ৷ বলেন, ‘ঠিক আছে, তুই যুদ্ধে যেতে পারিস ৷ আমার দোয়া থাকল ৷’

ছেলে মায়ের মুখের দিকে ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ৷ বোঝার চেষ্টা করে, মা কি অনুমতিটা রেগে দিচ্ছেন, নাকি আসলেই দিচ্ছেন ৷

‘মা, তুমি কি অন্তর থেকে পারমিশন দিচ্ছ, নাকি রাগের মাথায় ?’

‘আরে রাগ করব ক্যান ৷ দেশ স্বাধীন করতে হবে না ?’

‘থ্যাঙ্ক ইউ মা ৷ আমি জানি তোমার মতো মা আর হয় না ৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে একটা গান হয় না, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী, ওগো মা… তুমি হলে সেই মা ৷’

৩৮

আজাদের সঙ্গে রুমীর দেখা হয়ে যায় ধানমন্ডির হাইডআউটেই ৷ এটার কোড-নাম ২৮ নম্বর ৷ এটা একটা ওষুধ কোম্পানির ছেড়ে যাওয়া অফিস ৷ এখানে থাকেন শাচৌ আর আলম ৷ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তখন একত্র হয়েছে ৷ উলফত, হ্যারিস, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, কাজী কামাল, আলম আর রুমী ৷ মেলাঘর থেকে নতুন অস্ত্র আসবে ৷ আসবে আরো আরো বিস্ফোরক ৷ ঢাকায় গেরিলাদের অভিযান এখন একটা নতুন মাত্রা পেয়েছে ৷ ফার্মগেট অপারেশনের পর গেরিলাদের মনোবল এখন তুঙ্গে ৷ তারা এখন বড় অ্যাটাকে যেতে চায় ৷ যদিও শাহাদত চৌধুরী বারবার সাবধান করে জানিয়ে দিচ্ছেন ক্যাপ্টেন হায়দারের উক্তি-গেরিলারা কিন্তু পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ করবে না, তারা হঠাৎ আক্রমণ করবে, লুকিয়ে যাবে জনারণ্যে ৷ স্মরণ করিয়ে দেন মেজর খালেদ মোশাররফের রণকৌশল, আক্রমণ হবে তিন দিক থেকে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক আর সামরিক ৷

কিন্তু গেরিলারা এখন সামরিক আক্রমণের জন্যে অস্থির ৷

আজাদ আসে ৷ শাচৌয়ের কথা শোনে ৷ কে এই ক্যাপ্টেন হায়দার ৷ দেখতে কেমন তিনি ৷ শোনা যায়, দাড়ি ছিল, এখন ক্লিন শেভ্ড ৷ প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে যায় ৷ মেলাঘরে একবার যাওয়া দরকার ৷ আর মেজর খালেদ মোশাররফ ৷ ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান ৷ তাকে তো ছেলেরা একেবারে হিরোর মতো দেখে ৷ কিংবদন্তি যেন তিনি ৷ শাহাদত চৌধুরী তো বলেন, প্রথম দেখার দিনটায় খালেদ মোশাররফকে তাঁর মনে হয়েছিল গ্রিক দেবতার মতো, বিকালবেলা তাঁকে প্রথম দেখেন শাচৌ, জিপ থেকে নামছেন গোমতী নদীর এমবারক্মেন্টে, পেছনে অস্তগামী সূর্যটা লাল আর গোল, সোনালি রঙের গ্রিক দেবতা নেমে এলেন…

শাচৌ অনেক কথা বলেন ৷ বুঝিয়ে বলেন, ঢাকার যুদ্ধটা কনভেনশনাল যুদ্ধ নয় ৷ এটা সাইকোলজিক্যাল যুদ্ধ ৷ এই যুদ্ধে জয় বা মাটি দখল উদ্দেশ্য নয় ৷ উদ্দেশ্য হলো, মানুষের মনোবল অক্ষুণ্ন রাখা ৷

পরিবেশটা গম্ভীর ৷ এখানে জুয়েল থাকলে ভালো হতো ৷ এখনই একটা কৌতুক বলে পরিবেশটা জমিয়ে তুলতে পারত ৷

‘এই আজাদ তুমি ?’

একটা জুনিয়র ছেলে তাকে তুমি করে বলছে ব্যাপার কী! ছেলেটা আবার দেখতে রুমীর মতো ৷ ‘হ্যাঁ ৷ তুমি ?’

‘চিনতে পারছ না ৷ আশ্চর্য তো! আমি রুমী!’

‘রুমী! এই, তোমার কী চেহারা হয়েছে ৷’

‘মেলাঘরে ট্রেনিং নিতে গেছলাম না ৷ বোঝোই তো ৷ আমার শরীরে কি ওই সব সহ্য হয় ৷ এই, খালাম্মা কেমন আছেন ?’

‘আছেন ভালো ৷ তোমার মা ?’

‘আছেন ৷ মার সঙ্গে দেখা করতে বাসায় চলো ৷ কাজী, জুয়েল ওরা থাকে তো মাঝে মধ্যে ৷ আজকে আমার সঙ্গে চলো ৷ তোমাকে একটা জিনিস দেব ৷’

‘কী জিনিস ?’ রুমী জিজ্ঞস করে ৷

‘তুমি না গান ভালোবাসো ৷ রেকর্ড শোনো ৷ আমাদের বাসা থেকেও তো রেকর্ড ধার নিতা!’

‘হ্যাঁ ৷ তো ?’

‘একটা গান দেব তোমাকে ৷’

‘রেকর্ড!’

‘না রেকর্ডটা পাই নাই ৷ গানের লিরিকটা পেয়েছি ৷ আমি কপি করে রেখেছি ৷ তোমাকেও দেব এখন ৷’

‘কোন গান, বলো তো!’

‘জর্জ হ্যারিসনের ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ ৷’

‘ও মাই গড ৷ তুমি ওর রেকর্ড পেয়েছ ?’

‘রেকর্ড পাই নাই ৷ জর্জ হ্যারিসনের গানের কপিটা পেয়েছি ৷ বাংলা দেশ বাংলা দেশ ৷’

‘চলো ৷ এখনই যাই ৷ শাহাদত ভাই, আমি একটু আজাদের বাসায় যেতে পারি ?’

‘কেন ?’

‘আগেই বলব না ৷ আগে আনি, তারপরে আপনাদের সবাইকে দেব ৷’

‘কী জিনিস ?’

‘জর্জ হ্যারিসনের গানের লিরিক ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ ৷’

‘বলো কি!’ শাচৌ উত্তেজিত বোধ করেন ৷

শাচৌও খুব গান শোনেন ৷ তবে গানের ব্যাপারে, সাহিত্যের ব্যাপারে তিনি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না ৷ তিনি মনে করেন, জনপ্রিয়তা আর শিল্পের উৎকর্ষ সমার্থক নয় ৷ তার ঝোঁক ক্লাসিকের দিকে ৷ যুদ্ধ আস্তে আস্তে তার মনোভাব পাল্টে দিচ্ছে, এটা তিনি লক্ষ করছেন ৷ জনরুচির প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর বাড়ছে ৷ হয়তো জনগণের কাছাকাছি থাকতে গিয়ে তাঁর এই পরিবর্তন ৷ কনসার্ট ফর বাংলা দেশ সম্পর্কে তিনি জানেন ৷ পহেলা আগস্ট এই কনসার্ট হয়েছে ৷ আমেরিকায় মেডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ৷ জর্জ হ্যারিসন, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, বব ডিলান, এরিখ ক্লাপটন ৷ একেকজন দিকপাল ৷ এরা সবাই মিলে খোদ আমেরিকায় করেছে এই কনসার্ট ৷ হাজার হাজার তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছে এই কনসার্টে ৷ ভয়েস অব আমেরিকা, বিবিসি, আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র-সর্বত্র ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে এই কনসার্টের খবর ৷

শাচৌ বলেন, ‘এই, একটা কপি করে আমাকেও দিও তো ৷’

রুমী বেরিয়ে পড়ে আজাদের সঙ্গে ৷ রিকশায় সহজেই চলে যাওয়া যায় মগবাজার ৷ রেললাইনের ধারে বাসাটা ৷

মাকে ডাকে আজাদ-’মা দ্যাখো ৷ কাকে এনেছি ৷’

মা মাথায় কাপড় দিতে দিতে এগিয়ে আসেন ৷ ‘কে ?’

রুমী সালাম দেয় ৷ মা সালামের জবাব দেন ৷ আজাদ বলে, ‘রুমী ৷’

মা বিস্মিত! রুমীর চেহারা এতটা রোদে পোড়া হলো কী করে! কুশল বিনিময় শেষ করে মা রুমীর জন্যে নাশতা আনতে যান ৷ রুমী আর আজাদকে তার ব্যক্তিগত বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না ৷ বরং তার উৎসাহ জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটা নিয়ে ৷

আজাদ একটা বইয়ের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে ৷ সেই কাগজে সে কপি করে রেখেছে গানটা ৷ তাকেও সে কাগজ-কলম এগিয়ে দেয় ৷ রুমী কপি করার আগে গানটা একবার পড়ে নেয় ৷

Oh friends came to me

With sadness his eyes

(রুমী ভাবে, আজাদ কপি করতে একটু ভুল করেছে ৷ ফ্রেন্ডস না হয়ে ফ্রেন্ড হলে তো গ্রামারটা ঠিক থাকে ৷)

He told me that he wanted help

Before his country dies

Although I couldn`t feel the pain

I knew I had to try

Now I am asking all of you

To help us save some lives

Bangla Desh, Bangla Desh

Where so many people

Are dying fast.

And it sure looks like a mess

I have never seen such distress.

I want you lend your hand

Try to understand

Relieve the people of Bangla Desh

Bangla Desh Bangla Desh

Such a great disaster

I don`t understand

But it sure looks like mess

I never known such distress

Please don`t turn away

I wanna hear you say

Relieve the people of Bangla Desh…

রুমী পড়ে ৷ তার দু চোখে পানি এসে যায় ৷ বলে, ‘কত দূরে বসে একজন গায়ক বাংলাদেশের মানুষের জন্যে ভাবছে, লিখছে, গান করছে, ফান্ড কালেক্ট করছে, মানুষ যখন মানুষের জন্য করে, তখন কেমন লাগে, না!’ সে কাগজকলম নিয়ে বসে পড়ে অনুলিপি করতে ৷ আজাদও কপি করতে থাকে অন্য সহযোদ্ধাদের জন্যে ৷

মা বলেন, ‘আজাদ, চা হয়েছে ৷’

আজাদ বলে, ‘আসছি ৷’ সেও কপি করতে থাকে ৷ শাচৌকে দিতে হবে ৷ জুয়েল, কাজী কামাল-ওরাও তো চাইবে এর কপি ৷

জাহানারা ইমাম ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছেন ৷ বিকালবেলা ৷ রুমী বলেছে, ‘আম্মা, চলো তোমাকে এক বাসায় নিয়ে যাই ৷ তোমার মন একদম ভালো হয়ে যাবে ৷’

‘কোথায় ?’

‘আগে থেকে বলব না ৷ সারপ্রাইজ ৷’

মগবাজার চৌমাথা থেকে তেজগাঁও ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়ার দিকে একটু এগিয়েই রেললাইন পার হয়ে গাড়ি খানিক সামনে গিয়ে ডানে একটা গলিতে ঢোকে ৷ আরো একটুখানি গিয়ে আবার ডানে ঢুকে থামে একটা একতলা বাড়ির সামনে ৷ ৩৯ বড় মগবাজার ৷ দু ধাপ সিঁড়ি উঠেই ছোট্ট একটা বারান্দা-রেলিংঘেরা ৷ এ কার বাসায় যে রুমী আনল তাকে-জাহানারা ইমাম ভাবেন ৷ তিনি দেখতে পান, বারান্দায় চেয়ারে বসে আছে এক স্বাস্থ্যবান যুবক ৷ উঠে দাঁড়িয়ে আদাব দেয় তাকে ৷ রুমী বলে, ‘মা, এ হলো আজাদ ৷ একে তুমি এর ছোটবেলায় অনেক দেখেছ ৷ আগে আমরা এদের বাসায় আসতাম ৷ দাওয়াত খেতাম ৷’

জাহানারা ইমাম আজাদের মুখের দিকে ভালো করে তাকান ৷ কিন্তু মনে করতে পারেন না ৷ তিনি বারান্দা পেরিয়ে ভেতরে যান ৷ আজাদের মা তার সামনে আসেন ৷ ‘আরে, এ যে সাফিয়া আপা ৷’ জাহানারা ইমাম উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন ৷ আজাদের মাকে জড়িয়ে ধরেন ৷ বলেন, ‘কত দিন পরে আপনার সাথে দেখা হলো বলেন তো দশবারো বছর তো হবেই ৷’

আজাদের মা বলেন, ‘তাই হবে ৷’

জাহানারা ইমামের মনে পড়ে, তিনি শুনেছিলেন বটে যে আজাদের আব্বা আরেকটা বিয়ে করেছে ৷ তাই রাগ করে আজাদের মা ছেলেকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন ৷

আজাদের মা চা করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়েন ৷ জাহানারা ইমাম বলেন, ‘আপনি বসুন, আপনার সাথে গল্প করি ৷’

আজাদের মা হাঁক ছাড়েন, ‘কচি, একটু শুনে যেও ৷ খালাম্মাকে কী খাওয়াবে ৷’ তারপর জাহানারার দিকে চেয়ে বলেন, ‘আমিও আজাদকে নিয়ে আলাদা হয়েছি, আমার বোনটাও মারা গেছে, ওর ছেলেমেয়েদের নিজের কাছে রেখেছি ৷ মাঝখানে কয়েক বছর অনেক কষ্ট করেছি আপা ৷ এখন তো মনে করেন আজাদ এমএ পাস করেছে ৷ দেশের পরিস্থিতি ভালো হলে ব্যবসাপাতি করবে ৷ এখন তো ভালোই আছি ইনশাল্লাহ আপনাদের দোয়ায় ৷’

জাহানারা বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে থাকেন সাফিয়ার দিকে ৷ তাঁকে তাঁর বরাবরই মনে হয়েছে বাইরে নম্র মৃদুভাষিণী, আর ভেতরে ভেতরে দৃঢ়চেতা, কিন্তু তাই বলে এই মহিলা যে এতটা একরোখা, তা তো তিনি আগে বোঝেননি ৷ এখন আজাদের মা অনেক শুকিয়ে গেছেন ৷ আগে তাঁর ছিল স্বাস্থ্য-সুখী কান্তি ৷ এখন পরনে সরুপাড় শাদা শাড়ি, গায়ে কোনো গয়না নাই, আগে ছিল শরীরভরা গয়না, দামি শাড়ি, মুখে পান আর মৃদু হাসি, আঁচলে চাবি ৷ কী কনট্রাস্ট ৷

তবে আজাদ ছেলেটাকে দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায় ৷ সুন্দর হয়েছে ছেলেটা, স্বাস্থ্যবান ৷ মায়ের মতোই মুখে সব সময় হাসি লেগে আছে ৷

রুমী আর আজাদ অন্য ঘরে গল্প করছে ৷ এরই মধ্যে আরেকজন ছেলে আসে ৷ লম্বা ৷ ফরসা ৷ রুমী মাকে ওইঘরে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয় তার সঙ্গে, ‘আম্মা, এনাকে চেন ৷ কাজী কামাল উদ্দিন ৷ উনি প্রভিন্সিয়াল বাস্কটবল টিমের খেলোয়াড় ৷ ন্যাশনাল টিমেও ডাক পেয়েছিলো ৷ কাজী ভাই যান নাই ৷ ওনার সাথে আমার দেখা হয়েছে মেলাঘরে, ট্রেনিং ক্যাম্পে ৷ এখানেও কাজী ভাইয়ের অনেক নাম ৷ হিরোইক ফাইটার ৷’

৩৯

আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে, জায়েদের কাছ থেকে ঠিকানা বুঝে নিয়ে, একদিন জুরাইনে যায় সৈয়দ আশরাফুল হক ৷ গোরস্তানে গিয়ে জিয়ারত করে আসে মায়ের কবরটা ৷ এখনও কবরটা পাকা করা হয়নি ৷ তবে মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা-এই পরিচয়-ফলকটা বাঁশের বেড়ার গায়ে লাগানো আছে ৷ কবরস্তান থেকে বেরিয়ে ভিক্ষুকদের পাল্লায় পড়ে আশরাফুল হক ৷ পকেট থেকে খুচরো টাকা বের করে বিলাতে থাকলে কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ভিক্ষুক-মিছিলের মধ্যখানে পড়ে যায় সে ৷ শেষে অসহায়ের মতো দৌড়ে এসে গাড়িতে ওঠে ৷

গাড়িতে ফিরতে ফিরতে আশরাফুল হকের মনে পড়ে যায় বিগত দিনের নানা স্মৃতি ৷

একেকটা সফল অপারেশন করে ফিরত গেরিলারা, আর সেই বিজয়টাকে উদ্যাপন করত দুদিন ধরে ৷ আশরাফুলদের বাসাতেও হয়েছে এ রকম আড্ডা ৷ সবাই চলে আসত সেই ভোজসভায় ৷ আজাদ আসত ৷ রুমী আসত ৷

রুমীকে প্রথম দিন দেখে তো আশরাফুলের আকাশ থেকে পড়ার যোগাড় ৷ এ তো একদম বাচ্চাছেলে ৷ এ কি যুদ্ধ করবে ? এও ট্রেনিং নিয়ে এসেছে মেলাঘর থেকে ?

বদি আর রুমীর একটা বিষয়ে ছিল খুবই মিল ৷ দুজনই ছিল রোমাঞ্চপ্রিয় ৷ আবার দুজনেই ছিল মেধাবী ৷ বিভিন্ন ঘটনা তারা তাত্তি্বকভাবে বিশ্লেষণ করত ৷ একদিন বদি তাকে বলে তার ভঙ্ ওয়াগনে একটা লিফট্ দিতে ৷ আশরাফুল বের হয় গাড়ি নিয়ে ৷ সে গাড়ি চালাচ্ছে, যাত্রী বদি আর স্বপন ৷ বদির কাছে কেবল একটা পিস্তল ৷ ধানমন্ডি ২৮ নম্বরে রেকিট অ্যান্ড কোলম্যানের অফিসের সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হয় ৷ চুল্লু ভাই দুটো বস্তা আনে ৷ আশরাফুল বলে, ‘এর মধ্যে কী ?’

বদি বলে, ‘ইউ গেজ ৷’

আশরাফুলের সমস্তটা শরীর কাঁপতে থাকে ৷ বদি বলে, ‘লেট্স মুভ ৷’

মিরপুর রোডে উঠতেই দেখা যায় সামনে চেকপোস্ট ৷ আশরাফুলের কপালে ঘাম জমে ৷ সে বোঝে, আজই শেষ ৷ বদি কিন্তু নির্বিকার ৷ সে বলে, ‘ইফ দ্য বাস্টার্ডস স্টপ আস, আই উইল জাস্ট ফায়ার ৷ অ্যান্ড ইউ হ্যাভ টু ডু ইয়োর ওন বিজনেস ৷ তোরা কী করবি, তোরা বুইঝা নিস ৷’

শুনে আশরাফুলের সমস্তটা শরীর দুষ্টু ছেলের হাতে ধরা পড়া চড়ুইপাখির ছানার বুকের মতো কাঁপে ৷

গাড়ি চেকপোস্টের সামনে আসে ৷ সৈন্যরা গাড়ি থামাতে বললে তারা থামায় ৷ উর্দুতে কথাবার্তা হয় ৷ তারা জানতে চায় তারা কী করে, কোথায় যাচ্ছে ৷ সামান্য জিজ্ঞাসাবাদের পর সৈন্যরা গাড়ি চেক করার কষ্ট স্বীকার না করে হাত ইশারায় তাদের চলে যেতে বলে ৷

সেই দুপুরটাই তো আশরাফুলের জীবনের শেষ দুপুর হতে পারত ৷ বদিরও হতে পারত ৷ কিন্তু বদি ছিল নির্বিকার ৷ মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলা খেলতে পছন্দ করত সে ৷ তার ছিল অপরিসীম সাহস ৷

আশরাফুলের অত সাহস ছিল না ৷ সে মনেপ্রাণে ছিল গেরিলাদের সঙ্গেই, কিন্তু যুদ্ধে সরাসরি যাওয়ার বা ট্রেনিং নিতে ভারত যাওয়ার কথা ভাবেনি ৷ তবে তার বাবা যেহেতু কৃষক শ্রমিক পার্টি করতেন, পাকিস্তানিরা তাদের সন্দেহের দৃষ্টির বাইরে রাখত, সে কারণে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অন্যতম আশ্রয়স্থল হিসাবে বেছে নিয়েছিল তাদের বাড়িটাকেও ৷

আর ঢাকার গেরিলারা নিজেদের মধ্যে কথা বলত ইংরেজিতে ৷ তারা ভালো পোশাক পরত, সব সময় থাকত ধোপদুরস্ত, যাতে পথেঘাটে চলাচলের সময় কেউ তাদের গেরিলা বলে সন্দেহ না করে ৷

এই ইংরেজি বলা সচ্ছল তরুণ গেরিলাদের সঙ্গেই যোগ দিয়েছিল কমলাপুর রেলস্টশনের কুলি সর্দার রশিদ ৷ শাহাদত চৌধুরীর মতো অভিজাতপন্থী লোক তার সঙ্গে একই সিগারেট ভাগ করে খায়-এটা শুনে আশরাফুলের বিস্ময় আকাশ স্পর্শ করে ৷

৪০

আজকে আজাদের প্রথম অপারেশনে যাওয়া ৷ দুপুরবেলা বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শেভ করতে করতে আজাদ মাকে বলে, ‘মা, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি ৷ আজকে রাতে ফিরব না ৷’

মা বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস ?’

আজাদ বলে, ‘যাব একদিকে ৷ দোয়া কোরো ৷ ইনশাল্লাহ কালকে ফিরে আসব ৷’

মা বলেন, ‘একা যাবি ?’

আজাদ বলে, ‘না ৷ কাজী, জুয়েল ওরাও যাবে ৷ মা, আর কিছু জিজ্ঞেস কোরো না ৷’

মায়ের বুকটা ধক করে ওঠে ৷ শরীরটা অবশ অবশ লাগে ৷ তিনি বুঝতে পারেন, ছেলে আজকে এমন কোথাও যাবে, যেটা ঠিক সে বলতে চায় না ৷ তিনিও আর বাড়তি কিছু জিজ্ঞেস করেন না ৷

শেভ করা হয়ে গেলে ছেলের মুখের দিকে তিনি তাকান ৷ ছেলের ফরসা গাল ৷ শেভ করার পরে সবুজ হয়ে আছে ৷ তিনি বলেন, ‘ভাত খেয়ে যাবে তো ?’

আজাদ বলে, ‘হুঁ ৷’

মা তাড়াতাড়ি করে ভাত বাড়েন ৷ আজকে তরকারি তেমন ভালো নয় ৷ যুদ্ধের কারণে আজাদের ব্যবসাপাতি বন্ধ ৷ ঘরে টানাটানি চলছে ৷ বাজার তেমন করে আর করা হয় না ৷ ছেলে তাঁর কী খেয়ে যাবে ? তিনি তাড়াতাড়ি একটা ডিম ভাজতে চলে যান ৷ তখন তাঁর মনে হয়, ছেলের পরীক্ষার দিনে তিনি তাকে কিছুতেই ডিম খেতে দিতেন না, দেখতেও দিতেন না ৷ আজ ছেলে তাঁর যে অগি্নপরীক্ষার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে, তাতে তো ডিম খেতে অসুবিধা নাই ৷ নিশ্চয় নাই ৷

আজাদেরও মনের মধ্যে উত্তেজনা ৷ উত্তেজনা বেশি হলে তার বারবার পেশাব পায় ৷ সে এরই মধ্যে দুবার জলবিয়োগ করে এসেছে ৷ সে কোনো দিকে তাকাচ্ছে না ৷ ঘাড় না ঘুরিয়ে সামনে নাকের দিকে তাকিয়ে থাকছে ৷ ব্যাপারটা আর কারো চোখে ধরা পড়ছে না বটে, মায়ের চোখে ঠিকই পড়ছে ৷ মা অবশ্য কিছুই বলছেন না ৷

আজাদের বাঁ চোখের পাতা লাফাতে শুরু করে দেয় ৷ এটা কেন হচ্ছে ? এর মানে কী ?

আজাদ ভাত খেতে বসে ৷ ভাতও সে খাচ্ছে মুখ নিচু করে ৷ মা লক্ষ করেন, আজাদ ভাত মুখে নিয়ে চিবোচ্ছে না, গিলে ফেলছে, বারবার গেলাসে করে পানি খাচ্ছে ৷ মা মুখটা হাসি হাসি করে বলেন, ‘আস্তে আস্তে খাও বাবা, চিবিয়ে চিবিয়ে খাও ৷ পানি পরে খেও ৷’

মা যখন সিরিয়াস হয়ে যান, তখন আজাদকে ‘তুমি’ করে বলেন ৷

ভাত খেয়ে উঠে আজাদ কাপড়-চোপড় গোছাতে থাকে ৷ একটা ছোট্ট হাতব্যাগে দুটো ঘরে-পরার কাপড় নেয় ৷ কাজটা করার সময় সে গুনগুন করে গান গাইতে থাকে, এলভিস প্রিসলির গান ৷

তারপর বোনদের ঘরে উঁকি দেয় ৷ মহুয়ার একটা বাচ্চা হয়েছে ৷ সে ঘরে যাওয়া যাবে কি না, কে জানে ৷ দরজায় দাঁড়িয়ে সে গানের আওয়াজ বাড়িয়ে দিয়ে তারপর গলা খাঁকারি দেয় ৷ তারপর বলে, ‘মহুয়া, শরীর ঠিক আছে ?’

‘জি দাদা ৷’

‘বাবুটা রাতে খুব কেঁদেছে মনে হলো ?’

‘জি দাদা ৷ কী যে হইছিল ৷’

‘কিরে কচি, তোর কী অবস্থা ? রোজ দশটা করে অঙ্ক করতে বলেছিলাম, করেছিস ?’

‘জি দাদা ৷’ কচি ভয়ে ভয়ে জবাব দেয় ৷ দাদা যদি এখন খাতা আনতে বলে তাহলেই সে ধরা পড়ে যাবে ৷

দাদা তেমন কিছুই বলে না ৷ সে বেঁচে যায় ৷

‘জায়েদ কই ?’ আজাদ বলে ৷

মা বলেন, ‘ও তো বাইরে গেছে ৷’

আজাদ বলে, ‘ওকে বেশি বাইরে যেতে মানা কোরো ৷’

মা বলেন, ‘ও তোকে মানে বেশি ৷ তুই একদিন ভালো করে কড়া করে বুঝিয়ে বলিস ৷’

‘আচ্ছা ৷’ আজাদ তার ঘরে আসে আবার ৷ জর্জ হ্যারিসনের গান লেখা কাগজটা সঙ্গে নেয় ৷ সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার ঠিক আছে কিনা পরখ করে ৷ তারপর মায়ের সামনে এসে তাঁর মুখের দিকে তাকায় ৷ এই প্রথম সে গত এক ঘন্টায় মায়ের মুখের দিকে তাকাল ৷ ঠোঁটটা কামড়ে ধরে মুখে একটা ঝাঁকি দিয়ে সে বলে, ‘যাই তাহলে ৷’

মা বলেন, ‘বাবা, যাই না, বলো আসি ৷’

আজাদ বলে, ‘আসি ৷ দোয়া কোরো ৷’

মা বলেন, ‘সাবধানে থেকো ৷ সাবধানে চোলো ৷ বিসমিল্লাহ করে বের হয়ো ৷ বিপদে লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সোবহানাকা পোড়ো ৷ মাথা ঠাণ্ডা রেখো ৷’

আজাদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বলে, ‘ওকে ওকে ৷’

সে আর পেছনে তাকায় না ৷ সোজা বের হয়ে বেবিট্যাক্সি স্টান্ডের দিকে যায় ৷

মা তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷ ছেলে অদৃশ্য হয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকেন তার চলে যাওয়ার দিকে ৷

কাজী কামালের নেতৃত্বে জনা-দশেক মুক্তিযোদ্ধা যাচ্ছে সিদ্ধিরগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন কীভাবে উড়িয়ে দেওয়া যায়, সেটা সার্ভে করতে ৷ মেজর খালেদ মোশাররফ কাজী কামালকে মেলাঘর থেকে অস্ত্রশস্ত্র আর লোকজন দিয়ে পাঠিয়েছেনই সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ৷ এটা করতে পারলে ঢাকা শহরের বেশির ভাগটা অন্ধকার হয়ে পড়বে ৷ এর আগে দুবার যোদ্ধারা চেষ্টা করেছিল এটা উড়িয়ে দিতে, পারেনি ৷ এবার কাজী কামালের দল বেশ ভারী ৷ ১০ জনের গ্রুপ নিয়ে সে ঢুকেছে ঢাকায় ৷ একটা সাড়ে তিন ইঞ্চি রকেট লাঞ্চারও আনা হয়েছে ৷ ৮ টা রকেট শেল ৷ ভীষণ ভারী ৷ রকেট লাঞ্চার চালানোর জন্যে আর্টিলারির গানার দেওয়া হয়েছে ৷ তার নাম ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম ৷ আর আছে কানা ইব্রাহিম ৷ এক চোখ কানা তার ৷ কোনোভাবে যদি পাওয়ার স্টেশনের ভেতরে ঢোকা না যায়, বাজার থেকে শেল মারলে কী হয়! এই হলো মেলাঘরের পরামর্শ ৷ অস্ত্রের মধ্যে আরো আছে দুটো এসএলআর, সঙ্গে আন্যার্গা লাঞ্চার ৷ প্রত্যেকের জন্যে একটা করে স্টেনগান, চারটা ম্যাগাজিন, দুটো গ্রেনেড আর অসংখ্য বুলেট ৷

ভাদ্র মাস ৷ আকাশে মেঘ ৷ তাই একটা গুমোট ভাব ৷ সন্ধ্যার পরে বাড্ডার ওপারের পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউট থেকে দুটো নৌকাযোগে গেরিলারা রওনা হয় সিদ্ধিরগঞ্জের দিকে ৷ বেরুনোর আগে আজাদ বুকপকেট থেকে বের করে একবার দেখে নেয় জর্জ হ্যারিসনের গানের কপিটা ৷ তারপর আবার সেটা রাখে যথাস্থানে ৷ তারা দুটো নৌকায় ওঠে ৷ একটা নৌকায় বদি, কাজী, জুয়েল, আরো দুজন ৷ আরেকটা নৌকায় আজাদ, জিয়া, ইব্রাহিম, রুমী ৷ নৌকা চলতে শুরু করলে বাতাস এসে গায়ে স্পর্শ রাখে, একটুখানি শীতল হয় শরীর ৷ এখনও অন্ধকার তেমন ঘন হয়ে নামেনি ৷ আজাদ উত্তেজিত ৷ তার হাতে একটা স্টেনগান ৷ বলা যায় না, হয়তো আজই তার শত্রুর দিকে গুলি ছোড়ার উদ্বোধন হতে পারে ৷ উত্তেজনা গোপন করতে সে গান ধরেছে, তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে, আমরা কজন নায়ের মাঝি, হাল ধরেছি, শক্ত করে রে ৷ সামনের নৌকা থেকে তার গান শুনে জুয়েল বলে, ‘ঢেউয়ের সাগর নারে, এইটা আসলে ডোবা ৷ গানটা হইব : ব্যাঙ-ডাকা এই রামপুরা বিল পাড়ি দিমু রে, আমরা কয়জন কাউবয়…’

সামনে কাজী কামালদের নৌকা ৷ সবাই যার যার স্টেনগান নৌকার পাটাতনে নামিয়ে রেখেছে ৷ কারণ কেউ অস্ত্র দেখে ফেললে তাদের আসার উদ্দেশ্যই মাটি হয়ে যাবে ৷ কিন্তু বদি কিছুতেই তার স্টেনগান নামিয়ে রাখবে না ৷ সে রেখেছে তার কোলের ওপরে ৷

কাজী কামাল এই অপারশেনের কমান্ডার ৷ সে বলে, ‘বদি, স্টেনটা নামায়া রাখো ৷’

বদি গম্ভীর গলায় বলে, ‘আপনেরা নামায়া রাখছেন রাখেন ৷ আমারে কন ক্যান ৷ আর্মি আসলে কি বুড়া আঙুল টাইনা ইনডেঙ্ দিয়া গুলি করব ? নেভার ৷ আই অ্যাম আ ফাইটার অ্যান্ড আই অ্যাম অলওয়েজ রেডি টু শুট…’

আজাদ বদির কথা শুনে অবাক ৷ কাজী না এই অপারেশনের কমান্ডার ৷ তার আদেশ কি বদির মেনে নেওয়া উচিত ছিল না ৷

দুই নৌকা ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে পাওয়ার স্টেশনের কাছাকাছি ৷ সব নিস্তব্ধ ৷ কেবল নৌকার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না ৷ অন্ধকার ধীরে ধীরে বাড়ছে ৷ আকাশে মেঘ থাকায় তারা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না ৷ তবে এখানে-ওখানে বিলের মধ্যে ঝোপের ওপরে জোনাকি দেখা যাচ্ছে ৷ আর একটা কিটিকিটি শব্দও যেন আছে ৷ ঝোপেঝাড়ে কি ঝিঁঝিও ডাকছে নাকি ? এর মধ্যে আবার শেয়ালের ডাকও কানে আসে ৷ সামনের নৌকায় কাজী সিগারেট ধরায় ৷ লাইটারের আলোয় হঠাৎ চমকে ওঠে আজাদ ৷ কাজীর মুখে লাইটারের আলো পড়ায় ওর মুখটা কিছুক্ষণের জন্যে ভেসে ওঠে আজাদের চোখে ৷ বন্ধুর মুখ দেখে সে খানিকটা স্বস্তি বোধ করে ৷

আজাদ বলে, ‘আমি কি একটা সিগারেট ধরাতে পারি ?’

‘ও শিয়োর’-জিয়া জবাব দেয় ৷

আজাদ একটা সিগারেট ধরায় ৷ তার কাছে ব্যাপারটাকে বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে ৷ নাজ বা গুলিস্তান সিনেমা হলে সে কত কত যুদ্ধ-চলচ্চিত্র দেখেছে ৷ আজকে সে নিজেই এক যুদ্ধ-অভিযানের কুশীলব ৷

তাদের নৌকা দুটো এগিয়েই চলেছে ৷ সবাই একদম চুপ ৷ কারণ তারা প্রায় সিদ্ধিরগঞ্জের কাছাকাছি এসে পড়েছে ৷ দূরে পাওয়ার স্টেশনের আলো দেখা যাচ্ছে ৷ ওখানে আছে পাকিস্তানি সৈন্যদের সতর্ক প্রহরা ৷ তাদের জন্যে এটা খুবই স্পর্শকাতর ও সংরক্ষিত এলাকা, সন্দেহ নাই ৷

ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ৷ এতক্ষণে অন্ধকারের সঙ্গে চোখ খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে ৷ অন্ধকারের মধ্যেও নিজেদের কে কোথায় বসে আছে, দেখা যাচ্ছে ৷

আজাদ একটা শ্বাস নেয় জোরে ৷ সেই শ্বাস নেওয়ার শব্দটাও তার কানে প্রবলভাবে বাজে ৷ সে কি ভয় পাচ্ছে ?

হঠাৎই সামনে একটা নৌকার মতো নড়তে দেখা যায় ৷ কী নৌকা, কাদের নৌকা, অন্ধকারে কিছু বোঝা যায় না ৷ তবে তাদের মাঝি বাঙালি ৷ সে হাঁক ছাড়ে, ‘কে যায়!’ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই হাঁক প্রলম্বিত হয়ে বিলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে যেন আছড়ে পড়ে ৷

আজাদ ভাবে, হয়তো কোনো সাধারণ নৌকা ৷ বাঙালি কেউ যাচ্ছে ৷ কাজী জবাব দেয়, ‘সামনে যাই ৷’

কাজীর গলার স্বরটাকে যেন খানিকটা, মাঝির স্বরের তুলনায়ও এই পরিবেশে, আগন্তুকের মতো শোনায় ৷

ওই নৌকাটা কাছে আসতেই দেখা যায় : সর্বনাশ ৷ ওই নৌকায় পাকিস্তানি মিলিটারি ৷ একটা মুহূর্ত সময় শুধু ৷ আজাদ এখন কী করবে ? তার সামনে কাজীদের নৌকা ৷ সে ফায়ার ওপেন করলে তো কাজীরা মারা পড়বে ৷ তার নিজেকে দিশেহারা লাগে ৷ বদি কারো নির্দেশের অপেক্ষা না করে স্টেন তুলে ব্রাশফায়ার করে ৷ পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দেয় ৷ এই শান্ত নিরিবিলি অন্ধকারে অসাড় হয়ে শুয়ে থাকা বিলটার ওপরে আর মেঘভারে নিথর আকাশটার নিচের সমস্ত স্তব্ধতা তখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায় ৷ প্রতিপক্ষ নৌকা থেকেও গুলি বর্ষিত হয় ৷ অন্ধকারে ফুটে ওঠে আগুনের ফুলকি ৷ বারুদের গন্ধ বাতাসের ভেজা গন্ধে এসে মেশে ৷

আজাদ ঠকঠক করে কাঁপে ৷ সামনে শোনা যায় নৌকার ডুবে যাওয়ার শব্দ আর মানুষের আর্তনাদ ৷ মানুষ সাঁতার কাটার চেষ্টা করছে, তাই জলে উঠছে আলোড়ন ৷

আজাদ এরই মধ্যে নৌকার পাটাতনে রাখা অস্ত্র তুলে নিয়েছে ৷ ফায়ার করার জন্যে সে প্রস্তুত ৷ কিন্তু কমান্ডারের অর্ডার ছাড়া ফায়ার করাটা উচিত হবে না ৷ সে চিৎকার করে অর্ডার চায়, ‘কাজী, কাজী…’

কাজী তাড়াতাড়ি বলে, ‘ডোন্ট ফায়ার, ডোন্ট ফায়ার ৷’

আজাদ বলে, ‘ওকে ৷ ওকে ৷’

কাজী বলে, ‘এই, ওই নৌকা এদিকে আনো ৷ এইটা ফুটা হইয়া গেছে ৷ পানি উঠতেছে ৷ কাম শার্প ৷’

আজাদদের নৌকা তাড়াতাড়ি সামনে যায় ৷ এদিকে অন্ধকারে বদির গলা, ‘হেল্প মি, আই অ্যাম গোয়িং টু বি ড্রাউন্ড ৷’ টর্চের আলোয় দেখা যায় বদি পানিতে ভাসছে ৷ ও বোধহয় পড়ে গিয়েছিল ৷ ভাসমান বদিকে নৌকায় তোলা হয় ৷ কাজীরাও নৌকা বদল করে উঠে পড়ে আজাদদেরটায় ৷ ওরা এসে আজাদদের নৌকায় উঠতে না উঠতেই প্রথম নৌকাটা ডুবে যায় ৷

কাজী বলে, ‘দেয়ার বোট হ্যাজ বিন টোটালি ডেস্ট্রয়েড ৷ লেট্স রিট্রিট ৷ স্পিডবোট নিয়া আবার অ্যাটাক করতে আইতে পারে ৷’

পাকিস্তানি সৈন্যদের নৌকাটা ডুবে গেছে ৷ সৈন্যরা হয় গুলিবিদ্ধ অথবা নিমজ্জিত ৷

চারদিক অন্ধকার ৷

একমাত্র নৌকাটি দ্রুত বাইতে বাইতে তারা ফিরে আসছে ৷ দুই নৌকার মাঝি একই নৌকায় ৷ তারা জোরে জোরে দাঁড় বাইছে ৷

জুয়েল বলে, ‘আমার আঙুলে কী যেন হইছে রে ৷’

পেন্সিল টর্চ জ্বালিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখা যায়, ডান হাতের তিনটা আঙুল গুলিতে জখম ৷ রক্তে জায়গাটা একাকার ৷ মনে হয় গুলি আঙুল ভেদ করে বেরিয়ে গেছে ৷

আজাদের শরীর কাঁপছে ৷ উত্তেজনায় ৷ জুয়েলের হাতে রক্ত দেখে সে বুঝতে পারে, তারা মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরছে ৷

দুই মাঝি নৌকা বাইছে ৷ মনে হচ্ছে, তবুও নৌকার গতি বড় শ্লথ ৷ আজাদ আর জিয়া পানি সেচা থালা হাতে নিয়ে বৈঠা বাওয়ার কাজ করছে ৷

কাজী কামাল হ্যা-হ্যা করে হাসে ৷ ‘আজাদ, আওয়ার এলভিস প্রিসলি, ইজ রোয়িং দ্য বোট ৷ দিস ইজ ফানি ৷’

আজাদ বলে, ‘আরে আমি বিক্রমপুরের পোলা না ? গ্রামে গিয়ে কত নৌকা বেয়েছি ৷’ এবার নৌকা সত্যি দ্রুত এগোচ্ছে ৷ অবশেষে বিলের শেষে ডাঙা দেখা যায় ৷ আকাশে মেঘের ফাঁকে একটা চাঁদ দেখা যাচ্ছে ৷ শাদা পেয়ালায় পানি নিয়ে রংমাখা তুলি ছেড়ে দিলে যেমন রঙগুলো ছড়াতে থাকে, চাঁদের ওপরে মেঘগুলোকে দেখা যাচ্ছে তেমনি ৷ শেয়ালের ডাক কানে আসছে, কুকুরদের সম্মিলিত প্রতিবাদধ্বনিও ৷ জোনাকি এখন অনেক ৷

ডাঙা এসে গেছে ৷ নৌকা ঘাটে ভিড়লে সবাই নৌকা থেকে অবতীর্ণ হয় ৷

রাতটা পিরুলিয়া গ্রামের হাইড আউটেই কাটায় তারা ৷ এটাও আজাদের জন্যে এক নতুন অভিজ্ঞতা ৷ কাঁচা ঘর ৷ প্রাকৃতিক শৌচাগার ৷

জুয়েলের দিকে তাকিয়ে আজাদের মায়া লাগতে শুরু করে ৷ তার হাতের রক্তপাত বন্ধ হচ্ছে না ৷ আহা বেচারা এর পরে ব্যাট করতে পারবে তো ৷

হারিকেনের আলোয় জুয়েলের রক্তকে মনে হচ্ছে খয়েরি ৷

এই হারিকেনের আলোতেই বদি একটা চটিবই মনোযোগ দিয়ে পড়ছে ৷ কী বই ? আজাদ এগিয়ে যায় ৷ দেখে আলবেয়ার কামুর দি আউট সাইডার ৷ বদির বই পড়ার বাতিকটা গেল না!

কাজী কামাল বেরিয়ে যায় ফার্স্ট এইডের জন্যে সরঞ্জাম জোগাড় করতে ৷ আজাদ বলে, ‘জুয়েল, ব্যথা করছে ?’

জুয়েল বলে, ‘হেভি আরাম লাগতেছে ৷ দেশের জন্যে রক্ত দেওয়াও হইল, আবার জানটাও রাখা হইল ৷ কইয়া বেড়াইতে পারুম, দেশের জন্যে যুদ্ধ কইরা আঙুল শহীদ হইছিল ৷ হা-হা-হা ৷’

আজাদ জুয়েলের কথায় হাসতে পারে না ৷ বোঝাই যাচ্ছে তার খুবই ব্যথা লাগছে ৷ সে ব্যথা ভোলার জন্যে রসিকতা করার চেষ্টা করছে ৷

কাজী কামাল তুলা আর ডেটল জোগাড় করে আনে ৷ জুয়েলের হাতে ফার্স্ট এইড দেওয়া হয় ৷

৪১

পরদিন সন্ধ্যাবেলা কাজী আর বদি জুয়েলকে নিয়ে আসে ডা. রশিদ উদ্দিনের চেম্বারে ৷ কাজীর বন্ধু কুটু, ভালো নাম সাজ্জাদুল আলম, সে মেডিক্যাল কলেজে পড়ে, তার বাবা ডাক্তার, তিনি আবার ডা. রশিদের বন্ধু ৷ সেই সূত্রে তাদের আগমন রশিদ উদ্দিনের চেম্বারে ৷

কুটু বলে, ‘আংকেল ৷ ওর হাতটা একটু দেখতেন যদি…’

‘কী হয়েছে ?’

ডাক্তারকে কি মিথ্যা বলা যায় ? কাজী বলে, ‘গুলি লাগছে ৷’

রশিদ উদ্দিন বলেন, ‘এহ্ ৷ একেবারে থেঁতলে গেছে ৷ হাড় ভেঙেছে কি না কে জানে! গুলি লাগল কী করে!’

‘এই কেমন কইরা জানি লাগল আর-কি!’ জুয়েল বলে ৷

ডা. রশিদ বলেন, ‘আমার এখানে তো ও.টি. নাই ৷ তোমরা এক কাজ করো ৷ রাজারবাগে ডা. মতিনের ক্লিনিকে নিয়ে যাও ৷ আমি আসছি ৷’

‘রাজারবাগ!’ কাজী কামাল ঢোক গেলে ৷ ‘ও তো বিপজ্জনক জায়গা!’

ডা. রশিদ উদ্দিন বুঝে ফেলেন ৷ বলেন, ‘ঠিক আছে ৷ আমি আমার গাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছি ৷’

ডা. রশিদ তাঁর রেডক্রস চিহ্ন আঁকা গাড়িতে করে জুয়েলকে নিয়ে যান রাজারবাগে ডা. মতিনের ক্লিনিকে ৷ ওখানে অপারেশন থিয়েটারে জুয়েলের হাতে তিনি ব্যান্ডেজ করে দেন ৷ সেখান থেকে জুয়েলকে নিয়ে যাওয়া হয় দিলু রোডে হাবিবুল আলমের বাসায় ৷ হাবিবুল আলমের তিন বোন জুয়েলের যত্নের ভার নেয় ৷ বড় বোন আসমা তাকে ড্রেসিং করে দেয় নিয়মিত ৷

তবে ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসক ছিলেন ডা. আজিজুর রহমান ৷ জুয়েলের হাতে আঙুলের অবস্থা খারাপ দেখে তাকে ডা. আজিজের এলিফ্যান্ট রোডের পলি ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়া হয় ৷

ডা. আজিজ আর তাঁর স্ত্রী ডা. সুলতানা জুয়েলের হাতের ব্যান্ডেজ খোলেন ৷ আঙুলের অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন ৷ আজিজ বলেন, ‘তিনটা আঙুল একসাথে ব্যান্ডেজ করেছে কেন! আর ব্যান্ডেজ এত বড়ই বা কেন ৷’ তিনি তিনটা আঙুল আলাদা আলাদা করে ব্যান্ডেজ করে দেন ৷’

জুয়েল বলে, ‘স্যার, দেশ স্বাধীন হলে আমি হব ন্যাশনাল ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন ৷ আঙুল তিনটা রাইখেন ৷’

মিটিং বসেছে ২৮ নম্বরের হাইড আউটে ৷ শাচৌ, বদি, আলম, কাজী উপস্থিত সেখানে ৷ সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কি ওড়ানো যাবে না ? মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হায়দার-এরা খুবই চান যে ওটা উড়ে যাক ৷ কিন্তু কীভাবে!

আলম বলে, ‘ওখানে আর্মিরা যেভাবে বাঙ্কার করে পজিশন নিয়ে সব সময় অ্যালার্ট থাকে, অ্যাটাক করে ওদেরকে সরানো যাবে না ৷ তার চেয়ে গেরিলা ওয়ারফেয়ার করব গেরিলা কায়দায় ৷ আমরা ওখানকার স্টাফদের সঙ্গে যোগাযোগ করি ৷ দুইজন কর্মচারীর সঙ্গে তো আমাদের যোগাযোগ আছেই ৷ ওদেরকে ট্রেনিং দিয়ে ওদের হাতে এক্সপ্লোসিভ পাঠিয়ে দিয়ে ওদের দ্বারাই ওগুলো ব্লাস্ট করানো হবে ৷’

আলম এক্সপ্লোসিভের ব্যাপারটা খুব ভালো বোঝে ৷ সে বলে যায়, ‘এখন ৮০/৯০ পাউন্ড পি.কে. (প্লাস্টিক এঙ্প্লোসিভ) লাগবে ৷ এতটা পি.কে. ভেতরে নিয়ে যাওয়া যাবে কী করে ?’

অনেক আলোচনার পর ঠিক হয়, পাওয়ার স্টেশনের ইঞ্জিনিয়ারের জিপের দরজার ভেতরের দিকের হার্ডবোর্ড কভার খুলে পি.কে. নিয়ে যাওয়া হবে ৷ একবারে ৮/১০ পাউন্ড পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে ৷

যাক, সিদ্ধিরগঞ্জ বিষয়ে তবু একটা ফয়সালা হলো ৷ কিন্তু বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে এসে গেরিলারা কি শুধু বসে থাকবে ? ‘তা হবে না ৷ চলো, একটা কিছু করি’-বদির উত্তেজনা সবচেয়ে বেশি ৷

কাজী কামাল বলে, ‘খালি প্যাচাল না পাইড়া কিছু একটা অ্যাকশন করি ৷ হাতে-পায়ে জং ধইরা যাইতেছে তো ৷’

ঠিক হয়, তারা আবার বেরিয়ে পড়বে ৷ একসঙ্গে একই সময় দুটো গ্রুপে ৷ একটা আলমের নেতৃত্বে ৷ আরেকটা জিয়ার নেতৃত্বে ৷ আলমের গ্রুপে থাকবে আলম, বদি, কাজী কামাল, রুমী আর স্বপন ৷ দ্বিতীয় গ্রুপে হ্যারিস, মুখতার, জিয়া, আনু, চুল্লু ভাই আর আজাদ ৷

বদি আর আলম মিলে ধানমন্ডি থেকে হাইজ্যাক করে একটা মাজদা গাড়ি ৷ গাড়িটার কাগজপত্রে দেখা যায় গাড়ির মালিক মাহবুব আনাম ৷ অন্যদিকে হ্যারিস আর মুখতার হাইজ্যাক করে ফিয়াট ৬০০ গাড়ি ৷

আজাদরা অপেক্ষা করছে ধানমন্ডির হাইড আউটে ৷ বদি আর আলম গেছে এক গ্রুপের জন্যে গাড়ি হাইজ্যাক করতে ৷ হ্যারিস আর মুখতার গেছে তাদের গ্রুপের জন্যে গাড়ি হাইজ্যাক করতে ৷ বদি আর আলম চলে আসে আগে ৷ তারা হাইজ্যাক করেছে একটা শাদা মাজদা ৷ তাতে উঠে কাজী কামাল, রুমী, স্বপন বিদায় নেয় ৷ আজাদ, আনু, চুল্লু ভাই অপেক্ষা করছে হ্যারিস আর মুখতারের জন্যে ৷ হ্যারিস আর মুখতার আসে ফিয়াট ৬০০ গাড়ি নিয়ে ৷ তাতে উঠে পড়ে আজাদরা ৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ৷ রাস্তার লাইটগুলো জ্বলছে ৷ হ্যারিসদের কাজ হলো রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে থাকা ৷ আর আলমরা ধানমন্ডি এলাকায় চীনা কূটনীতিকের বাসার সামনে প্রহরারত সৈন্যদের ওপর হামলা করে ওদিকেই ১৮ নম্বর রোডে আরেকটা বাসায় শেখ মুজিব পরিবারকে নজরবন্দি রাখা প্রহরারত পুলিশ আর সৈন্যদের ওপর চড়াও হবে ৷ তারপর এসে জিয়াদের সঙ্গে যোগ দেবে ৷ তখন দুটো গ্রুপ একসঙ্গে আরো কিছু অভিযান পরিচালনা করবে ৷ বেরুনোর আগে শাচৌ যখন জানতে চেয়েছেন এই অপারেশনের নাম কী, তখন আলম বলেছে, এর নাম অপারেশন আননোন ডেসটিনেশন ৷

আজাদদের গাড়ি চালাচ্ছে হ্যারিস ৷ সে গাড়ি নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সামনে একটা চক্কর দেয় ৷

হ্যারিস বলে, ‘কী করব ৷ ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে ৷ রেডিয়েটরে মনে হয় পানি নাই ৷ মিটারে হট দেখাচ্ছে ৷’

জিয়া বলে, ‘কোথাও থেকে পানি নিলে হবে ?’

হ্যারিস বলে, ‘হবে ৷’

মুখতার বলে, ‘শাহজাহানপুরে চলেন ৷ আমার চেনা পানের দোকান আছে ৷ ওখান থাইকা পানি নেওন যাইব ৷’

হ্যারিস গাড়ি থামায় শাহজাহানপুরে, মুখতারের দেখিয়ে দেওয়া পানের দোকানের সামনে ৷ স্টেন হাতে সবাই নামে ৷ এলাকায় চাঞ্চল্য দেখা যায় ৷

আজাদ একটা পান কেনে ৷ দোকানদার কিছুতেই দাম নেবে না ৷ বলে, ‘স্যার মুক্তি গো কাছ থাইকা দাম লই না ৷’ ইঞ্জিনে পানি ভরে নিয়ে ওরা আবার আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের গেটে ৷ দুটো চক্কর দেয় ৷ ‘আরে, আলমদের কী হলো! ওরা আসে না কেন!’

জিয়া বলে, ‘চল, আমরা নিজেরাই একটা অ্যাকশন করি ৷ দারুল কাবাবের দিকে যাই ৷’

কাকরাইলের মোড়ে আসতেই কয়েকজন বাঙালি পুলিশ বলে ওঠে, ‘হল্ট ৷’ ওরা গাড়ি থামায় ৷ জিয়া ঘাড় বাড়িয়ে বলে, ‘সরেন তো ৷ আমরা বাঙালি পুলিশ মারি না ৷’

পুলিশও উঁকি দিয়ে দেখে, এদের হাতে যে অস্ত্র, তাতে বাড়াবাড়ি করা মানেই মৃত্যু ৷ বলে, ‘ওরে বাবা, মুক্তিবাহিনী ৷’ তারা সরে এসে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে ৷ যেন তারা কিছুই দেখেনি ৷

আজাদরা ময়মনসিংহ রোডে এসে পড়ে ৷ চলে যায় দারুল কাবাবের দিকে ৷ দারুল কাবাবের সামনে একটা আর্মির জিপ দাঁড় করানো ৷ এটাকে আক্রমণ করা যায় ৷ আজাদের হাত স্টেনগানে চলে যায় ৷ জিয়া বলে, ‘গাড়িটা ইউ টার্ন করে ঘুরিয়ে আন ৷ তাহলে মগবাজার দিয়ে পালিয়ে যেতে সুবিধা হবে ৷’ হ্যারিস গাড়িটাকে ইউ টার্ন করে ঘুরিয়ে আনে খানিকটা দূরে গিয়ে ৷ ফিরে এসে দেখা যায়, আর্মির জিপটা চলে গেছে ৷

তারা সোজা চলে আসে পিজি হাসপাতালের মোড়ে ৷ সেখান থেকে এলিফ্যান্ট রোড হয়ে মিরপুর রোডে পড়তে যাবে ৷ সামনে দেখা যায়, একটা আর্মির জিপ ৷ হ্যারিস বলে, ‘লেট্স অ্যাটাক দি জিপ ৷’ জিয়া বলে, ‘দাঁড়াও ৷ পেছনে আলো নেভানো কতগুলো আর্মির ট্রাক আছে ৷ মিরপুর রোডেও গাড়ি দাঁড় করিয়ে চেক হচ্ছে ৷ হ্যারিস, গাড়ি ২ নন্বর দিয়ে সাতমসজিদ রোডে নাও ৷’

আজকের অপারেশনেও কোনো গুলি করতে না পেরে আজাদ হতাশ ৷ ২৮ নম্বরে তারা তাদের হাইড আউটে যায় ৷

২৮ নম্বরে পরে যখন সবাই মিলিত হয়, তখন জিয়ারা আলমদেরকে বকাবকি করে তাদের সঙ্গে তারা কেন রাজারবাগে যোগ দেয়নি!

আলমরা তাদের অপারেশনের যে গল্প করে, তা শুনে আজাদের রোম খাড়া হয়ে যায় ৷ এ যে সিনেমাকেও হার মানায়!

আলম বলে, “আমি মাজদার ড্রাইভিং সিটে বসলাম ৷ আমার এসএমজিটা দিলাম বদিকে ৷ বদি আমার বাঁ পাশে ফ্রন্ট সিটে বসল ৷ পেছনে বাঁয়ে কাজী, মধ্যখানে রুমী আর ডান দিকে স্বপন ৷ ২৮ নম্বর থেকে বেরিয়ে মাঠের কাছে চায়নিজ ডিপ্লোম্যাটের বাসার সামনে গেলাম ৷ গিয়ে দেখি কোনো সেন্ট্রি নাই ৷ ধানমণ্ডি ১৮ নম্বর রোডে পাকিস্তানি আর্মির হোমরা-চোমরার বাড়ির সামনে গিয়ে দেখি সাত-আট জন সেন্ট্রি রাইফেল কাঁধে, তাদের জনা-দুয়েক দাঁড়িয়ে, বাকিরা বসে, সবাই গল্পগুজব হাসিঠাট্টায় মশগুল ৷ আমি বললাম, ‘ওকে ফ্রেন্ডস, জন্তুরা আমাদের হাতের নাগালে, আর ঠিক তিন মিনিট সময় আমাদের হাতে ৷’

সাতমসজিদ রোডে গিয়ে আমি গাড়ি ঘুরিয়ে নিলাম ৷ এতে সুবিধাও হলো ৷ আমাদের শত্রুরা আমাদের বাঁয়ে পড়ল ৷ বদি আর কাজী তাদের বাঁয়ের জানালা ব্যবহার করতে পারবে ৷ আমি স্বপন আর রুমীকে বললাম, ‘তোমরা রাস্তা দ্যাখো ৷ রুমী পেছনটা ৷ স্বপন সামনেরটা ৷’

সেন্ট্রিদের খুব কাছে চলে আসলাম ৷ মাজদার সুবিধা হলো শব্দ করে না ৷ গাড়ি স্লো করে বললাম, ফায়ার ৷ বদি পেট বরাবর, কাজী বুক বরাবর গুলির মালা রচনা করল তাদের স্টেনগান আর মেশিনগান দিয়ে ৷ সৈন্যরা মুহূর্তে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে ৷ কোনো প্রতিরোধ করার ফুরসত পেল না ৷ রুমী বলল, ‘লেট্স কালেক্ট দ্য উইপন ৷’ আমি বললাম, ‘মাথা খারাপ নাকি ৷ প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান ৷’ সেখান থেকে গাড়ি টান দিয়ে চীনা ডিপ্লোম্যাটের বাসভবনে আবার গিয়ে দাঁড়ালাম কিন্তু কোনো শিকার পেলাম না ৷ স্বপন আর রুমী বলল, ‘এটা কি, আমাদের তো শুটিং প্রাকটিসই হলো না ৷’ আমি আবার মিরপুর রোডে উঠলাম ৷ যাচ্ছি নিউমার্কেটের দিকে ৷ ৫ নম্বরের কাছে এসে দেখি, আর্মি চেকপোস্ট বসিয়েছে ৷ দুটো ট্রাক আর একটা জিপ আমাদের দিকেই মুখ করে দাঁড়ানো ৷ রাস্তায় দুজন সৈন্য শুয়ে পড়ে লাইট মেশিনগান নিয়ে পজিশন নিয়েছে ৷ চার-পাঁচটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে আর্মি চেক করছে ৷ ভয়ে আমার কলজে শুকিয়ে এল ৷ এখন আর থামিয়ে গাড়ি ঘোরানোরও সময় নাই ৷ একমাত্র উপায় ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাওয়া ৷ আমি বললাম, ‘বাঁচার একমাত্র উপায় হলো আমরা গাড়ি না থামিয়ে বাঁয়ে চলে যাব ৷ স্বপন, এলএমজিম্যানকে সাবাড় করবা ৷ বদি, কাজী, রাস্তার বায়ে দাঁড়ানো সৈন্যদের টার্গেট করবা ৷ আমি গাড়ি বাঁয়ে ঘোরানোর সাথে সাথে ফায়ার করবা ৷ আমি শুধু একবারই বলব, ফায়ার ৷’

আমি গাড়ি স্লো করে দাঁড়ানো গাড়িগুলো কাটিয়ে সামনে চলে গেলাম ৷ তিনজন সেন্ট্রি হাত উঁচিয়ে বলল, ‘হল্ট ৷’ আমি হেডলাইট বন্ধ করে ডান দিকে যাওয়ার ইনডিকেটর জ্বালালাম ৷ ডানে ঘোরানোর একটু ভানও করলাম ৷ সেন্ট্রি চিৎকার করে বলল, ‘হারামজাদা, কিধার যাতা হ্যায়, রোকো,’ আমি এক্সসেলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি বাঁয়ে ৫ নম্বরের দিকে নিতে নিতে বললাম, ‘ফায়ার, ফায়ার ৷’

স্বপনের গুলি এলএমজিম্যানকে শেষ করে দিল নিশ্চয় ৷ নইলে কোনো পাল্টা গুলি তো হলো না ৷ একই সাথে বদি আর কাজীর গুলি শেষ করে দিল বাঁয়ের সৈন্যদের ৷ আমার ঘাড়ের মধ্যে স্বপনের ছোড়া গুলির খালি কাতর্ুজ এসে পড়ল ৷ গরমে ঘাড়ে ফোস্কা পড়ে গেল ৷ আমি গাড়ি নিয়ে গ্রীন রোডে পড়লাম ৷ ইনডিকেটরে বাঁ দিক দেখিয়ে গাড়ি ঘোরালাম ডান দিকে ৷ মিরপুর রোডের দিকেই ৷ হেডলাইট নেভানো ৷ হঠাৎই রুমী বলল, ‘লুক লুক, দেয়ার ইজ আ জিপ, দি বাস্টার্ডস আর ট্রায়িং টু ফলোয়িং আস ৷’

রুমীকে কোনো নির্দেশ দিতে হলো না ৷ সে নিজেই স্টেনের বাঁট দিয়ে গাড়ির পেছনের কাচ ভেঙে ফেলল ৷ তারপর স্টেন বাড়িয়ে টার্গেট করল জিপের ড্রাইভারকে ৷ তার টার্গেট, উরেব্বাস ৷ জিপটা গিয়ে একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে ধাক্কা খেল ৷ পেছনে তাকিয়ে রুমীরা দেখল আরো একটা জিপ আর দুটো ট্রাক গ্রীন রোড ধরে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছে ৷ আমরা মিরপুর রোড ধরে এলিফ্যান্ট রোডের দিকে চলে এলাম ৷”

আলমের বর্ণনা শেষ হলো ৷

আজাদ আলমের মুখে সব শুনে তার বন্ধুদের সাফল্যে আর সাহসিকতায় মুগ্ধ ৷ বলে, ‘ইস্, আমি যে কবে নিজ হাতে পাক আর্মি মারতে পারব ৷ তোরা ভাই হেভি দেখাচ্ছিস ৷’

৪২

হাবিবুল আলমদের দিলু রোডের বাসাতেই জুয়েল আহত হওয়ার পরের কটা দিন ছিল ৷ ভালোই ছিল ৷ হাবিবুল আলমের বাবা হাফিজুল আলম ইঞ্জিনিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যেন মিলেমিশে গেছেন ৷ তিনি নিজেও তাঁর হেরাল্ড ট্রাম্প গাড়িতে করে মুক্তিযোদ্ধাদের আনা-নেওয়া করেছেন ৷ বাড়ির মেয়েরা-আসমা, রেশমা, শাহনাজ-এরাও একেকজন অস্ত্র-এঙ্পার্টে পরিণত হয়েছে ৷ রেশমা আর শাহনাজ অস্ত্রের ব্যারেল পরিষ্কার করা, ম্যাগাজিনে গুলি ভরার কাজ এমনভাবে করে যে মনে হয় এটাই তাদের প্রধান কাজ ৷ শাহনাজ আবার শুধু ডান হাত দিয়েই অস্ত্র পরিষ্কার করার কাজটা করে ৷ শাচৌ ব্যাপারটা লক্ষ করেন ৷ আসলে শাহনাজ যখন ছোট, তখন কেমন করে যেন ওর বাঁ হাতে চোট লাগে ৷ ডাক্তাররা ঠিকভাবে হাতটা জোড়া লাগাতে পারেননি বলে ওর বাঁ হাতের সব কটা আঙুল কাজ করে না ৷ জুয়েল যখন তার জখম হওয়া ডান হাত নিয়ে ওই বাসায় যায়, তখন শাহনাজ বলে, ‘জুয়েল ভাই, কী আর হবে, সবচেয়ে খারাপ হবে যদি আপনি আমার মতো একহাতি হয়ে যান ৷ কিন্তু আমার দিকে দেখেন, আমি তো সব কাজই ঠিকমতো করছি ৷’ তবে আসমা এ কথা শুনে একটু মন খারাপ করেছিল ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আসমা ৷ আলমের বন্ধুরা, ছোট-বড় সবাই, তাকে ডাকে মেজপা বলে ৷ কারণ সে আলমের মেজপা ৷ সেপ্টেম্বরে যখন আসমা সীমান্ত অতিক্রম করে চলে গিয়ে সেক্টর-টুর ফিল্ড হাসপাতালে যোগ দেবে, তখনও বড়-ছোট সব সৈনিক ও যোদ্ধারা তাকে ডাকবে মেজপা বলে ৷ সে-ই জুয়েলের হাত নিয়মিত ড্রেসিং করে দেয় ৷

জুয়েলের ভালো নাম আবদুল হালিম চৌধুরী ৷ তার বাবা আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী অ্যাকাউনটেন্ট পদে চাকরি করেন একটা বেসরকারি প্রাইভেট ফার্মে ৷ জুয়েলরা চার বোন আর তিন ভাই ৷ এর মধ্যে বড় ভাই মারা গেছে ছোটবেলাতেই ৷ জুয়েলই এখন বড় ৷ ‘৬৯ সালে সে জগন্নাথ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেছে ৷ এখন চাকরি করে সাত্তার গ্লাস ওয়ার্কে এনালিস্ট কেমিস্ট হিসেবে ৷ ইচ্ছা আছে, দেশ স্বাধীন হলে সে এই বিষয়ে ট্রেনিং নিতে বিদেশে যাবে ৷ তবে তার আসল পরিচয় সে ক্রিকেটার ৷ আজাদ বয়েজে খেলেছে ৷ মোহামেডানে খেলেছে ৷ আজাদ বয়েজ থেকে মোহামেডানে যাওয়ার পেছনেও কারণ ছিল ৷ ১৯৬৭ সালে লন্ডন থেকে এমসিসি দল ঢাকায় খেলতে এলে যে টিম তাদের সঙ্গে খেলতে নেমেছিল, তাতে জুয়েলকে নেওয়া হয়নি ৷ নির্বাচকমণ্ডলীর এই সিদ্ধান্তের পেছনে আজাদ বয়েজের কর্মকর্তাদের হাত আছে ভেবে রাগ করে জুয়েল মোহামেডানে যায় ৷

নিউজিল্যান্ড টিমের বিরুদ্ধে খেলার জন্যে অল পাকিস্তান দলের ক্যাম্পেও সে ডাক পেয়েছিল ৷ চূড়ান্ত টিমে অবশ্য তার জায়গা হয় নাই ৷ সে ট্রেনিং নিতে আগরতলা বর্ডার অতিক্রম করতে বাসা ছাড়ে ৩১শে মে ৷ বাসার কাউকে কিছু বলে যায়নি ৷

জুয়েলের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল শহীদ ক্রিকেটার মুশতাকের লাশ দর্শন ৷

২৭শে মার্চ সৈয়দ আশরাফুল হক আর জুয়েল গিয়েছিল ঢাকা ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের সামনে মুশতাকের মরদেহ দেখতে ৷ মুশতাকের মরামুখটা জুয়েলের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল ৷ একটা মানুষ একটু আগেও ছিল মানুষ, তার কত আশা, কত স্বপ্ন, কত সার্থকতা, এই মুখটাই তো ক্রিকেট খেলত, জয়-পরাজয় নিয়ে কত হিসাব-নিকাশ, কত অধ্যবসায়, আর দ্যাখো এখন সে শুয়ে আছে সবকিছুর অন্য পারে ৷ জুয়েল নীরবে শুধু মাথা নাড়ছিল, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল নিচের ঠোঁট ৷ তখনই সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, একটা কিছু করতে হবে, শুধু শুধু বিনা প্রতিরোধে লাশের কাফেলায় শুয়ে পড়ার কোনো মানে হয় না ৷

ফার্মগেট অপারেশনের পরে বাসার চার বোনের জন্যে জুয়েলের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দেয় ৷ এ কারণে তাদেরকে সে পাঠিয়ে দিয়েছে গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে ৷ এখন অবশ্য সে ঝাড়া হাত-পা ৷ মাঝখানে ঝামেলা হলো নিজের ডান হাতের আঙুল জখম হওয়ায় ৷ তার প্রধান চিন্তা, সে কি আর ক্রিকেট খেলতে পারবে ? তবে মুখে সে এই কথা কাউকে বলে না ৷ নিজেও হাসিমুখ করে থাকে ৷ সঙ্গীদেরও হাসায় ৷

ড্রেসিং করার সময় জুয়েল যেন ব্যথা টের না পায়, সেজন্য আসমা জুয়েলের সঙ্গে নানা গল্প করে ৷ এর মধ্যে একটা হলো ক্রিকেট ৷ জুয়েল ঢাকা শহরের ব্যাটিংয়ে তুফান বলে খ্যাত ৷ সে ব্যাট করে ঝড়ের গতিতে ৷ যতক্ষণ সে উইকেটে থাকে, ততক্ষণ রানের চাকা ঘোরে ৷ শুধু ঘোরে না, বনবন করে ঘোরে ৷

আসমা জিজ্ঞেস করে, ‘জুয়েল, রকিবুল হাসান তো অল পাকিস্তান টিমে চান্স পেয়েছে ৷ তুমি পাবে না ?’

জুয়েল কিন্তু স্বভাবে জন্মরসিক ৷ ‘আরে, আমারে এইবার নিউজিল্যান্ডের এগেইনস্টে নিল না বইলাই তো আমি অল পাকিস্তানই ভাইঙ্গা দিতেছি ৷ দেশটা স্বাধীন হইলে আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম বানাব ৷ এইটাতে আমি ঠিকই চান্স পাব, দেইখেন মেজপা ৷’

আসমা বলে, ‘তা তো পাবেই ৷ পাকিস্তান টিমেও চান্স পেতে ৷’

জুয়েল বলে, ‘আরে আবার পাকিস্তান ৷ পাকিস্তানকে বোল্ড কইরা দিতেছি ৷ মিডল স্টাম্প আউট ৷ উফ্ ৷ ব্যথা লাগে তো ৷’

আসমা পুরনো তুলাটা সরিয়ে একটা পরিষ্কার তুলা নেয় ৷ জুয়েলের ক্ষতস্থান মুছে দেয় ডেটল-ভেজা তুলা দিয়ে ৷ জুয়েলকে বলে, ‘তোমার বাসা না টিকাটুলিতে ৷ বেঙ্গল স্টুডিওর পাশে ৷ নায়িকাদের দেখ না!’

জুয়েল বলে, ‘গেটের সামনে পাবলিকে ভিড় কইরা থাকে ৷ একদিন দেখি আজিম-সুজাতা ঢুকতেছে ৷’

জুয়েল আজিম-সুজাতার ঢোকার দৃশ্যটা মনে করতে না করতেই আসমার ব্যান্ডেজ বাঁধা শেষ হয়ে আসে ৷

তো জুয়েল দিলু রোডে ভালোই ছিল ৷ কিন্তু ওখানে একা একা আটকে থাকাটা কতক্ষণ সম্ভব ? একটু সিগারেট খাওয়া, একটু কার্ড খেলা-এসব করতে ইচ্ছা করে কিনা! আজাদদের বাসা এদিক থেকে উত্তম ৷

২৯শে আগস্ট ১৯৭১ ৷

দুপুরবেলা ইব্রাহিম সাবের আসে আজাদদের বাসায় ৷ আজাদের মায়ের রান্না দুপুরে খাওয়াটা তার কাছে একটা দারুণ আনন্দের ব্যাপার বলে মনে হয় ৷

আজাদদের বাসায় যাতায়াতের রাস্তায় একটা দোকান ৷ তাতে তিনজন যুবক বসে ৷ তারা মাথা বের করে দেখছে কে যায় আজাদদের বাসায় ৷ মনে হয় যেন ফলো করছে ৷ সাবেরকে শুনিয়ে শুনিয়ে তাদের একজন বলে, ‘ভৈরব ব্রিজটা পাহারা দিতেছে পাকিস্তানি আর্মিরা, ওই আর্মিগো অ্যাটাক করতে হইলে আমি সাহায্য করতে পারি ৷’ শুনে ইব্রাহিম সাবেরের সন্দেহ হয়, এরা আর্মির ইনফরমার নয় তো ৷ আজাদদের বাসায় ঢুকে সাবের প্রথমেই আজাদকে বলে, ‘দোস্তো, আজকের রাতটা তোরা এখানে থাকিস না ৷’

আজাদ বলে, ‘কেন ?’

‘দোকানে দেখলাম…’

‘আরে না ৷ চোরের মন তো, তাই সবাইকে পুলিশ পুলিশ লাগে ৷’ আজাদ হেসেই উড়িয়ে দেয় কথাটা ৷ দুপুরের খাওয়াটা ভালোই হয় সাবেরের ৷ খেয়েদেয়ে সে বেলাবেলি ফিরে যায় নিজের বাসায় ৷

জুয়েলের সঙ্গে আর দেখা হয় না সাবেরের ৷ জুয়েল আবার আজকের দুপুরবেলাটা কাটাচ্ছে সৈয়দ আশরাফুল হকের বাসায় ৷

বিকালবেলা আজাদদের বাসায় কাজী কামাল, বাকি, হ্যারিস, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই একসঙ্গে এসেছে ৷ বাকি অনেকক্ষণ ছিল, রাত ৮টার দিকে চলে গেছে ৷ হ্যারিস অবশ্য চলে গেছে খানিকক্ষণ পরই ৷ রোজারিও ইদানীং প্রায়ই রাতে থাকে আজাদদের বাসায় ৷ কিন্তু আজকে রাতে সে থাকবে না ৷ তার মাকে দেখতে নাকি যেতেই হবে ৷ সেও রওনা হয়ে গেছে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ৷ বিকালেই জায়েদ একবার ঢোকে আজাদের ঘরে, আড্ডার মধ্যে রসভঙ্গ করে বলে, ‘দাদা, কামরুজ্জামানরে চিনো না ৷ ওই বেটা তো আর্মির দালাল ৷ আজকা কিন্তু খানিক আগে ওই বেটা আইসা বাসার সামনে থাইকা ঘুইরা গেছে ৷ আমার কেমুন সন্দেহ হয় ৷ আইজকা রাইতে এই বাসায় থাকাটা নিরাপদ না ৷’

‘আরে রাখ তো ৷ কামরুজ্জামান ৷ কামরুজ্জামানরে কামান বানায়া দেব ৷ কত কামরুজ্জামান আসল গেল ৷ ওই এমনি ঘোরে ৷ ইস্কাটনের বাসায় তো কাজ করে ৷’ আজাদ পাত্তাই দেয় না জায়েদের কথায় ৷

‘আরে না ৷ ওই বেটা আর্মির ইনফরমার ৷ সবাই জানে’-জায়েদ ঘাড় গোজ করে বলে ৷

‘তরে কইছে সবাই জানে ৷ আজাইরা কথা বলিস না তো ভাগ ৷’ আজাদ তাকে হাত নেড়ে কেটে পড়ার সংকেত দেয় ৷ জায়েদ বেরিয়ে যায় ৷

জুয়েল চলে আসে আশরাফুল হকদের বাসা থেকে ৷ আশরাফুল তাকে নিষেধ করে, ‘যাস না ৷ থাইকা যা ৷’

জুয়েল বলে, ‘আজাদগো বাসায় রাইতে কার্ড খেলা যাইব ৷ আর তা ছাড়া আম্মা আমারে না দেখলে চিন্তা করব ৷’

জুয়েল আর টগর আবার চাচাতো ভাই ৷ টগররা যেহেতু সাফিয়া বেগমকে আম্মা বলে ডাকে, জুয়েলও তাই ডাকে তাঁকে ৷

জুয়েল গায়ে শার্ট চাপাতে চাপাতে বলে, ‘বদি থাকলে থাকন যাইত এইহানেই ৷’

আশরাফুল বলে, ‘হ, বদি ভাইয়ের ব্যাপারটা বুঝলাম না ৷ দুই দিন ধইরা গায়েব ৷ কই না কই আছে ৷’

‘যাই রে ৷’ জুয়েল বেরিয়ে যায় ৷

আশরাফুলদের ইস্কাটনের বাসা থেকে আজাদদের মগবাজারের বাসা খুবই কাছে ৷ গলি দিয়ে গলি দিয়েই সহজে জুয়েল পৌঁছে যায় সেখানে ৷

ওই সময় আড্ডা জমে ওঠে খুব আজাদদের বাসায় ৷

আজাদ বলে, ‘কাজী, শাহাদত ভাই মেলাঘরে গেছে না ?’

কাজী কামাল বলে, ‘গেছে ৷ আলমও সাথে গেছে ৷’

‘মেজর খালেদ মোশাররফ আর ক্যাপ্টেন হায়দার যখন জিজ্ঞেস করবে, সিদ্ধিরগঞ্জে কী করলা, কী জবাব দেবে!’ আজাদ ফোঁড়ন কাটে ৷

‘আছে, জবাব আছে ৷ সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ব্যাপারে একটা প্লান করা হইছে ৷ ওই স্টেশনের দুই কর্মচারী ইব্রাহিম আর শামসুল হককে ট্রেনিং দেওয়া হইতেছে ৷ ট্রেনিং চলতেছে ধানমন্ডি ২ নম্বরের একটা আর্ট গ্যালারিতে ৷ চিনছ তো বাসাটা ৷ ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদ যেইখানে বসে ৷ ট্রেনিং চলতেছে ৷ এই ধরো টাইম পেন্সিল ব্যবহার করা ৷ পি.কে. ফিট করা ৷ এইসব ৷ ওই গ্যালারিতে তো এখন কেউ যায় না ৷ কেউ বুঝব না’-কাজী কামাল জবাব দেয় ৷

জুয়েল বলে, ‘ওই দুইজনকে তো তোরা খরচের খাতায় ধইরা রাখছস ৷ যদি পাওয়ার স্টেশন উড়ে তাইলেও অগো পাকিস্তানি আর্মি ছাড়ব না ৷’

কাজী কামাল বলে, ‘অরাও জাইনা-শুইনাই আইছে ৷ সাহস আছে ৷ তবে অগো ঢাকার কোনো হাইডআউট, কোনো গেরিলার নাম-ঠিকানা জানানো হয় নাই ৷ খালি আলম, শাচৌ এই রকম একজন-দুইজনের নাম জানে ৷ কওয়া যায় না, সাবধানের মাইর নাই ৷’

আজাদ বলে, ‘তাইলে তো তোর মুখরক্ষা ৷’

কাজী কামাল বলে, ‘ক্যান ৷ ঢাকা শহরটা যে কাঁপায়া দিলাম, মাউড়াগুলানের যে হাঁটুকাঁপা রোগ শুরু হইছে, তার কী হইব ৷ এইটার একটা এপ্রিসিয়েশন দিব না!’

তা অবশ্য দেওয়াই উচিত ৷ ঢাকার চারটা পাওয়ার স্টেশনের দুটো উড়ে গেছে ৷ আলমের দল পিজির পাশে এলিফ্যান্ট রোডের স্টেশন ওড়াতে গিয়ে কাউন্টার অ্যাটাকে পড়ে গিয়ে লড়াই করে বেরিয়ে এসেছে ৷ পাওয়ার স্টেশন ওড়ানোর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও খালেদ মোশাররফ সবচেয়ে খুশি হন এটার জন্যেই ৷ কারণ পৃথিবীর বহু কাগজে বাংলাদেশ খবর হয়ে আসে : ঢাকায় গেরিলারা স্ট্রিট ফাইটে নেমে পড়েছে ৷ এ ছাড়া স্ট্রিট ফাইট হয়েছে গ্রিন রোডে, উড়ে গেছে ফার্মগেটের আর্মিক্যাম্প ৷ আজিজের দল গ্রিন রোডে উড়িয়ে দিয়েছে আর্মিবহর ৷ ঢাকার ছেলেরা এখন তুচ্ছ মনে করছে সবকিছুকে ৷ ঢাকাবাসীর মনোবল ফিরে এসেছে ৷ ভয়টা এখন পাকিস্তানি আর্মির ৷ এসব খবর তো খালেদ মোশাররফের অজানা নয় ৷

এখন রাত ৮টার পরে জমে উঠেছে তাস খেলা ৷ আজাদ, জুয়েল, কাজী কামাল আর সেকেন্দার ৷ জয়েন সেক্রেটারির ছেলে সেকেন্দার এসেছিল টিভি দেখতে ৷ তাসের টানে সে বসে পড়েছে ৷

মর্নিং নিউজের রিপোর্টার বাশার আসে রাত ৯টার পরে ৷ এসেই এই ঘরে উঁকি দেয় ৷ ‘কী ভাই, কেমন চলছে ৷’

জুয়েল বলে, ‘বাশার, তোমাদের মর্নিং নিউজ ফিউজ হইয়া গেছে ৷ বাল্বটা বদলাও ৷’

বাশার শার্ট খুলতে খুলতে বলে, ‘বুঝলাম না ৷’

জুয়েল বলে, ‘তোমরা তো রাজাকারেরও অধম হইয়া গেছ ৷ এত মিথ্যা কথা লেখো কেমনে!’

বাশার বলে, ‘পিছন দিয়া বন্দুকের নলা ঢুকায়া দিলে মুখ দিয়া আপনি যা চাইবেন তা-ই বাইর করতে পারবেন ৷’

জুয়েল বলে, ‘মর্নিং নিউজরে একটু নাইট নিউজ বানাইয়া দিতে হইব ৷ দুইটা পাইন অ্যাপেল গড়ায়া দিলেই তো বোঝা যাইব পেন ইজ মাইটার দ্যান সোর্ড, উইকার দ্যান গান ৷’

‘পাইন অ্যাপেল মানে কী ? বাশার কও তো!’ আজাদ বলে ৷

‘আনারস যে না এটা বুঝি’-বাশার উত্তর দেয় ৷

‘হ্যান্ড গ্রেনেডের নিকনেম-আজাদ জানিয়ে দেয় ৷’

কাজী কামাল কোনো কথা বলছে না ৷ সে একমনে তার হাতে পাওয়া তাসগুলো পর্যবেক্ষণ করে ক্রমানুসারে সাজিয়ে নিচ্ছে ৷

জুয়েলের ডান হাতে ব্যান্ডেজ ৷ অন্য হাত দিয়েই সে চমৎকার তাস বাটতে পারে, ধরতে পারে ৷

আজাদ বলে, ‘তুই তো জুয়েল একটা জিনিয়াস ৷ ওয়ান্ডারফুল বয় ৷ এক হাতে কেমন করে শাফল করছিস!’

জুয়েল বলে, ‘আরে আমি তো ভাবতেছি এক হাতে ব্যাট চালাব ৷’

তখন ঘরে নীরবতা নেমে আসে ৷ এত ভালো একটা ক্রিকেটারের তিনটা আঙুল মোটামুটি থেঁতলে গেছে ৷ সে কি আর এ জীবনে ক্রিকেট খেলতে পারবে!

জায়েদ আসে ঘরে ৷ সিগারেটের ধোঁয়ায় ঘরে ঢোকা মুশকিল ৷ বলে, ‘দাদা, ওঠেন ৷ খেলায় বিরতি দ্যান ৷ আম্মা ভাত নিয়া বইসা আছে ৷’

আজাদ বলে, ‘আরেক দান ৷ এই, তোরা খেয়েছিস ?’

জায়েদ বলে, ‘খাইছি ৷’

আজাদ বলে, ‘টগর, চঞ্চল, কচি, মহুয়া, টিসু-সবাই খেয়েছে ?’

‘হ ৷’

‘মনোয়ার দুলাভাই খেয়েছে ?’

‘জি খাইছে ৷’

তারা আরেক দানের নাম করে তিন-দান খেলে ফেলে ৷ তখন ও-র থেকে মায়ের গলা ভেসে আসে, ‘আজাদ, খাবি না তোরা ?’

আজাদ বলে, ‘মা ডাকছে ৷ এইবার উঠতেই হয় ৷ এই ওঠো ৷’

খাবার টেবিলটা ছোট ৷ একসঙ্গে ছয়জনের বেশি বসা যায় না ৷ বড় টেবিল যে ফেলা হবে, তার জায়গাই বা কোথায়! বাসাটাই তো ছোট ৷ আগে, ইস্কাটনের বাসায় তাদের ডাইনিং টেবিলে একসঙ্গে ১০ জন বসতে পারত ৷ সেসব দিনের জন্যে সাফিয়া বেগমের মনে কি একটা ছোট্ট গোপন আফসোস রয়ে গেছে ? সাফিয়া বেগম তা স্বীকার করবেন না ৷ যুদ্ধ বেধে যাওয়ার পর আজাদও আর টাকা-পয়সা দিতে পারছে না ৷ গয়না বিক্রি করতে হচ্ছে ৷ এখন ঘরের আত্মীয়স্বজন বাদ দিয়েও বাসায় রোজই আজাদের বন্ধুবান্ধব ভিড় করে থাকে ৷ তারা খায়দায় ৷ গাদাগাদি করে এখানেই শোয় ৷ আজাদের মায়ের এটাই ভালো লাগে ৷ লোকজন খাওয়ানোটা তাঁর প্রিয় একটা শখ ৷ আর নিজের ছেলের বন্ধুবান্ধবদের তদারকি করতে পারা, আদর-যত্ন করতে পারাটায় এক ধরনের তৃপ্তি পাওয়া যায় ৷ কলজের মধ্যে এক ধরনের আরাম লাগে ৷

গতকাল যেমন তিনি মালিবাগ থেকে দাওয়াত করে এনেছেন তার বোন মাবিয়ার মেয়ে দুলু, মেয়ের জামাই মনোয়ার হোসেনকে ৷ তাদের ছোট্ট মেয়ে লীনাটা কেমন ঘুরছে সবার কোলে কোলে ৷ এত রাত হলো, মেয়েটার চোখে ঘুম নাই ৷ রাতের বেলা জন্মালে বাচ্চারা রাতে জেগে থাকে ৷ দুলুর বোন ফুলুও এসেছে বেড়াতে, তারও সঙ্গে আছে তার ছোট্ট মেয়ে বিভা ৷

টেবিলে প্লেট বিছিয়ে ভাত-তরকারি বেড়ে আজাদের মা অপেক্ষা করছেন ৷ জুয়েল, আজাদ, কাজী কামাল, সেকেন্দার আসে ৷ বেসিনের কলটা নষ্ট ৷ তিনি একটা গামলা দিয়েছেন টেবিলে ৷ বলেন, ‘সবাই গামলায় হাত ধুয়ে নাও ৷’ তিনি পানি এগিয়ে দেন ৷ গামলাটা একজনের সামনে থেকে নিয়ে ধরেন আরেকজনের সামনে ৷ শুধু জুয়েলের হাত ধোয়ার দরকার পড়ে না ৷ তার ডান হাতের তিন আঙুলে ব্যান্ডেজ ৷ সে বাকি দু আঙুলে চামচ দিয়ে তুলে খাবে ৷ মা বলেন, ‘বাশার কই বাশার ? তুমিও আসো ৷ খেয়ে নাও ৷ ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না ৷’ বাশার আসে ৷

‘কী হয় ? টিভিতে শাহনাজ বেগমের গান হয় নাকি!’ আজাদ বাশারকে খেপানোর চেষ্টা করে ৷

রান্না হয়েছে গরুর মাংস, আলুভর্তা, পটলভাজা, লাউশাক আর ডাল ৷

এত অল্প তরকারি দিয়ে ভাত দিতেও সাফিয়ার লজ্জা লজ্জা লাগে ৷ কিন্তু কিছুই করার নাই ৷ একে তো আয় বুঝে ব্যয় করতে হয়, তার ওপর মাছ খাওয়া বন্ধ ৷ দেশের সব নদীতে এখন শুধু মানুষের লাশ ভাসে ৷ মানুষের লাশ ঠুকরে খেয়ে খেয়ে মাছগুলো হচ্ছেও বেশ নধরকান্তি ৷ মাছ খেলে কলেরা না হয়েই যায় না ৷ তাই মাছ খাওয়া সবাই বন্ধ করে দিয়েছে ৷ তার ওপর গতকাল মনোয়ার জামাইয়ের আগমন উপলক্ষে ভালো খাবারের আয়োজন ছিল ৷

সবাই খেতে বসেছে ৷ জুয়েল ছেলেটা সব সময় রসিকতা করতে পছন্দ করে ৷ সে বলে, ‘আম্মা, আপনি নিজে রানছেন!’

‘হ্যাঁ বাবা ৷’

‘আর কত দিন কষ্ট করবেন আম্মা ৷ আজাদরে একটা বিয়াশাদি দ্যান ৷ বউয়ের হাতের সেবাযত্ন খান ৷’

‘দ্যাখো, তোমরা পাত্রী দ্যাখো ৷ বিয়ে তো দিতেই হবে ৷’ মা যে একটা মেয়ে ঠিক করে রেখেছেন, এটা আর বলেন না ৷

‘তা আম্মা যৌতুক হিসাবে কী নিবেন ? ডিম্যান্ড কী ?’

‘না না ৷ ছেলে বিক্রি করতে পারব না ৷’

‘না ৷ এই যুদ্ধের বাজারে এই কথা কইবেনই না ৷ আপনার ডিম্যান্ড না থাকতে পারে ৷ আমাদের আছে ৷ ছেলেকে একটা অন্তত এলএমজি আর চারটা ম্যাগাজিন আর ২ হাজার রাউন্ড গুলি দিতে হইব ৷’

বাশার বলে, ‘একেবারে ট্যাঙ্ক ডিম্যান্ড করো ৷ ট্যাঙ্ক চাইলে পিস্তল পেতেও পারো ৷’

খাওয়া-দাওয়া শেষ করে সবাই ওঠে ৷ মা গামছা পর্যন্ত এগিয়ে দেন ৷

তারা সবাই আবার আজাদের ঘরে গিয়ে ঢোকে ৷ মা বলেন, ‘পানের অভ্যাস থাকলে বলো ৷ পান দিতে পারি ৷’

বাশার বলে, ‘দ্যান ৷ যার লাগে সে খাবে ৷’

তারা ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে আবার আজাদের ঘরে আসে ৷

বাশার বলে, ‘ঘরে সিগারেট আছে ? রাতে লাগবে না ? আজাদ চলো, সিগারেট আনি!’

আজাদ বলে, ‘জায়েদরে দিয়া আনাই ৷’

বাশার বলে, ‘আরে চলো না ৷ তোমার সাথে কথা আছে ৷’

আজাদ আর বাশার ঘর থেকে বের হয় ৷ এরই মধ্যে রাস্তাঘাট সব ফাঁকা হয়ে পড়েছে ৷ হওয়ারই কথা ৷ গেরিলারা প্রায় প্রতিদিনই ঢাকার নানা জায়গায় নানা অপারেশন চালাচ্ছে ৷ গাড়ির চাকার নিচে ছোট ছোট মাইন পুঁতে গাড়ির চাকা সশব্দে ব্লাস্ট করা থেকে শুরু করে একেবারে সুসজ্জিত আর্মি শিবিরে হামলা করা পর্যন্ত ৷ আর মিলিটারিও হয়ে পড়েছে পাগলা কুকুরের মতো ৷ কখন যে কাকে ধরে নিয়ে যাবে, তার ঠিক নাই ৷ তার ওপর কারফিউ ৷

বাশার বলে, ‘শোনো, মিলি নাকি দেশে ফিরেছে ৷’

মিলির কথায় আজাদের বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে ৷ হাত-পা অবশ হয়ে যায় ৷ সে অতি কষ্টে স্বাভাবিক থাকার ভঙ্গি করে বলে, ‘তাতে আমার কী!’

‘আছে ৷ তোমারও কিছু আছে ৷ মিলির আসলে বিয়ে হয়নি ৷ তোমার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য মিথ্যা কথা বলেছিল ৷’

‘বলো কি!’

‘দেশে এসেছে’-বাশার একটু ভাবগম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করে ৷

‘তুমি কেমন করে জানলা!’

‘জানলাম ৷ খবরের কাগজে চাকরি করি ৷ সব খবরই রাখতে হয় ৷ তবে আরেকটা অসমর্থিত সূত্রের খবর, মিলির ডিভোর্স হয়ে গেছে ৷’

‘তার মানে বিয়া হইছিল ৷’

‘হ্যাঁ ৷ তার ইচ্ছার এগেইনস্টে ৷’

‘তুমি এটা কী শোনাচ্ছ ৷ আমার তো হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতেছে ৷ বাট আই জাস্ট ক্যাননট বিলিভ দিস নিউজ অ্যটঅল ৷’

‘ওকে ৷ উই ক্যান চেক ইট ৷’

‘পুরানা পল্টনে বাসা ৷ চেক তো করাই যায় ৷ তুমি যাবা ৷ তোমার সাথে তো আর কোনো সমস্যা নাই ৷’

‘ঠিক আছে যাব ৷’

‘তুমি আমারটা খোঁজখবর করো ৷ আমি তোমারটা দেখছি ৷ তোমাকে আর কষ্ট করে পাত্রী খুঁজতে হবে না ৷ পাত্রী আমাদের বাসা থেকেই বের করে ফেলব ৷’

বাশার লজ্জা পায় ৷ গলির ভেতরে একটা হোটেলের মধ্যে একটামাত্র দোকান আছে ৷ দোকানটা বাইরে থেকে বন্ধই থাকে ৷ তবে টুক টুক করে টোকা দিলে একটা ছোট্ট জানালা খুলে যায় ৷ টাকা দিলে সিগারেট বেরোয় ৷ এখানেই কেবল রাত্রিবেলা সিগারেট পাওয়া যায় ৷ বেনসন অ্যান্ড হেজেস-এর প্যাকেট কেনে আজাদ ৷

সিগারেট জ্বালিয়ে টানতে টানতে ফিরে আসে ৷ রাস্তায় শুধু কুকুর ৷ গলির মুখটা অন্ধকার ৷ আকাশে পোয়াখানেক চাঁদও দেখা যাচ্ছে ৷ নিজেকে কেমন তুচ্ছ, সামান্য লাগে আজাদের ৷ সে আরো জোরে সিগারেটে টান দেয় ৷ মনে হচ্ছে সিগারেটের মুখের আগুনটুকুকে সে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিতে চায় ৷ অন্ধকারে প্রতিটা টানে তার মুখে লাল আভা পড়ে ৷

মহুয়া, কচি, দুলু, ফুলু, আজাদের খালাতো বোনেরা, আর আজাদের মা এক ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিল ৷ মহুয়ার কোলের কাছে তার অল্পদিন আগে জন্ম নেওয়া মেয়ে ৷ দুলু, ফুলুর সঙ্গেও তাদের ছোট বাচ্চারা ৷ এর মধ্যে বালিকা কচির ঘুম ভেঙে যায় কিসের যেন শব্দে ৷ সে দেখতে পায়, ঘরে আলো ৷ আর আলোর মধ্যে সে দেখতে পায়, চোখে সুরমা, ফরসা, যেন চাঁদের আলো দিয়ে তার দেহ গড়া, লম্বা, স্বাস্থ্যবান এক যুবক, যেন রাজপুত্র, বিছানার ধারে দাঁড়িয়ে আছে ৷ সে মহুয়াকে ধাক্কা দেয়, বলে, ‘বুজি দ্যাখো, কী সুন্দর’ সে বুঝতে পারে না সে স্বপ্ন দেখছে নাকি এই দৃশ্য বাস্তবে ঘটছে ৷ মহুয়ার ঘুম ভেঙে যায়, সে ঘরের মধ্যে মিলিটারি দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যায় আর কচির মুখ চেপে ধরে ৷

তারও আগে নিঃশব্দ আততায়ীর মতো পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে ৩৯ মগবাজারের বাসাটা, হাজি মনিরুদ্দিন ভিলা, ঘিরে ফেলে ৷ তারা দরজায় সজোরে ধাক্কা দিতে থাকে ৷ তখন আজাদের ঘরে জুয়েল বিছানায় শোয়া ৷ কাজী কামালের পিস্তলটা, যেটা মেজর নুরুল ইসলাম শিশু তাকে দিয়েছিল, জুয়েলের কাছে ৷ এটার প্রতি তার লোভ ছিল ৷ বিকালেই কাজী কামাল বলেছে, ‘থাকুক, পিস্তলটা তোর কাছেই থাকুক ৷’ সেটাকে সে বিছানার ওপরেই রেখে শুয়েছিল ৷ নিচে পাটিতে বসে তাস খেলছে কাজী কামাল, আজাদ, সেকেন্দার আর বাশার ৷ ভাদ্রের মাসের রাত, ভাপসা গরম ৷ কাজী কামালের পরনে একটা লুঙ্গি মাত্র, শরীরে আর কিছু নাই ৷ মাথার ওপরে ফ্যান ঘুরছে ৷ আজাদের খালাতো ভাইরা, জায়েদ, টগর, চঞ্চল, টিসু আর খালাতো দুলাভাই মনোয়ার হোসেন শুয়েছে আরেক ঘরে ৷ দরজায় আঘাতটা বেড়েই চলেছে ৷ আজাদরা তখন হকচকিত ৷ জায়েদের ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে ভাবে, শব্দ হয় কেন ? মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে দাদাদের রুমে এখনও আলো জ্বলছে ৷ দরজায় আবার প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা ৷ জায়েদ বিছানা ছাড়ে ৷ দাদারা জেগে আছে, দরজা খোলে না কেন ? উঠে জানালার পর্দাটা ফাঁক করে জায়েদ, তখন তার বয়স সতেরোর মতো, বাইরে তাকায়, দেখতে পায়, সাক্ষাৎ সর্বনাশ বাইরে দাঁড়িয়ে ৷ জায়েদ কী করবে বুঝতে পারে না ৷ পাশের ঘরে যায়, দেখে আম্মা সবাইকে নিয়ে কই লুকাবেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না ৷ আর জুয়েলের পিস্তলটা আলুর বস্তার পেছনে ফেলা হচ্ছে ৷ জায়েদের একটা গোপন দরজা আছে, মেথরদের আসার চোরা রাস্তা ৷ ওই রাস্তা দিয়ে সে অনেকবার অস্ত্র নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে আলমদের দিলু রোডের বাড়িতে ৷ ওই দরজা খুলে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে সে পালানোর চেষ্টা করে ৷ কিন্তু সামনে যমদূতের মতো খাড়া হয়ে আছে পাকিস্তানি আর্মি ৷ হ্যান্ডস আপ ৷ জায়েদ হাত উঁচু করে ৷ দরজা খোলা পেয়ে জায়েদকে বন্দুকের মুখে ঠেলে ভেতরে নিয়ে আসে সৈন্যরা ৷ এসে সামনের দরজা খুলে দেয় ৷ একে একে ঢুকে যায় বেশ কজন ৷ একজন কমান্ডো ধরনের ৷ তার বুকে লেখা : মেজর সরফরাজ ৷ একজনের বুকে লেখা : ক্যাপ্টেন বুখারি ৷ ক্যাপ্টেন বুখারির হাতে স্টেনগান ৷

সৈন্যরা এসেই বলে, ‘আজাদ কোন হ্যায় ৷’

কেউ স্বীকার করে না ৷

আজাদকে ওরা জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমারা নাম কিয়া ?’

আজাদ বলে, ‘মাগফার আহমেদ চৌধুরী হ্যায় ৷’

কম্যান্ডো ধরনের লোকটা বলে, ‘তুম আজাদ হ্যায় ৷’

‘মে আজাদ নেহি হ্যায় ৷’

‘শালা মাদারচোত, তুম নাম কিউ নিদানা হ্যায় ৷’ সে আজাদের ঘাড়ে প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুসি মারে ৷

ইতিমধ্যে অন্য ঘর থেকে টগর, চঞ্চল, মনোয়ারকেও এনে একপাশে লাইনে দাঁড় করানো হয়েছে ৷ মোট আটজন বাঙালি বিভিন্ন বয়সের পুরুষ এখানে বলির পাঁঠার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কাজী কামাল খেয়াল করে ৷ আজাদ, জুয়েল, বাশার, সেকেন্দার, মনোয়ার হোসেন, জায়েদ, টগর, চঞ্চল ৷ কাজী কামালের মনে হয়, তাকে ল্যান্স নায়েক নুরুল ইসলাম সব সময় বলেছে, ‘স্যার, দুইজন সেন্ট্রি দাঁড় করায়া রাখেন ৷ এইভাবে সেন্ট্রি ছাড়া আপনারা থাকেন ৷ কোন দিন জানি বিপদে পড়েন ৷’ ইস্, দুইজন গার্ড যদি বাইরে দাঁড় করানো থাকত, পজিশন নেওয়ার সময় পেলে ওদের গুলি করেই উড়িয়ে দেওয়া যেত ৷ এভাবে বিনা চ্যালেঞ্জে মরতে হতো না ৷

‘আর্মস কিধার হ্যায় ?’ বুখারি নির্দেশ দিচ্ছে ৷ স্টিলের একটা আলমারি আছে ঘরে ৷ আজাদের মা আঁচল থেকে চাবি খুলে দিলে একজন সৈন্য আলমারি খোলে ৷ সবাই আগ্রহভরে অস্ত্র খুঁজছে ৷

হঠাৎই ক্যাপ্টেন বুখারি লক্ষ করে, একটা ছেলের হাতের আঙুলে ব্যান্ডেজ দেখা যায় ৷ সে জুয়েলের জখমি জায়গাটা চেপে ধর বলে, ‘বাস্টার্ড, হয়ার আর দি আর্মস ?’

ব্যথায় জুয়েল ‘ও মাগো’ বলে কুঁকিয়ে ওঠে ৷ কাজী কামালের মাথায় রক্ত উঠে যায় ৷ সে নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, আয়ুরেখা বড় আর স্পষ্ট ৷ তার মানে এখানে তার মরণ নাই ৷ সে হঠাৎই মেজরের হাতের স্টেনগানটার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে দু হাতে স্টেন ধরে ফেলে ৷ মুহূর্তের মধ্যে এ কাণ্ড ঘটে যায় ৷ স্টেনের দখল কে নেবে এই নিয়ে টানাটানি হতে থাকে ৷ ট্রিগারে কাজীর হাত ৷ গুলি বেরুতে থাকে ৷ রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় গুলির শব্দে ৷ কাজীর পরনের একমাত্র বস্ত্র লুঙ্গিটা ধস্তাধস্তিতে যায় খুলে ৷ ক্যাপ্টেন আর কাজী দুজনেই খাটে পড়ে গেলে খাট ভেঙে পড়ে যায় মেঝেতে ৷ ক্যাপ্টেন আহত হয়ে মেঝেতে গড়ায় ৷ স্টিলের আলমারির সামনের সৈন্যটা গুলিবিদ্ধ হয় আর পড়ে যায় ৷ ওপাশে মেজর সরফরাজ ফায়ার ওপেন করলে জায়েদ আর টগর গুলিবিদ্ধ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে ৷ কাজী জানে এখানে ধরা পড়ার মানে হলো মৃত্যু ৷ সে সোজা খোলা দরজা দিয়ে বাইরে আসে ৷ সম্পূর্ণ উলঙ্গ কাজী গেট দিয়ে বাইরে যায় ৷ বাইরে বাউন্ডারি দেয়ালের কাছে দুপাশে দুজন সৈন্য দাঁড়িয়ে ৷ চাঁদের আলোয় এক নগ্ন লম্বা ফরসা যুবককে দেখে তারা মুহূর্তের জন্য বিভ্রান্ত হয় হয়তো ৷ নইলে কেন তারা তাকে চার্জ করেনি, ১৪ বছর পরও কাজী সেটা অনুমান করতে পারে না ৷ কাজী একদৌড়ে বেরিয়ে রেললাইন ধরে সোজা দিলু রোডে চলে যায় ৷

রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে ৷ জায়েদ আর টগর বুঝি মারাই গেছে ৷ তিনজন মিলিটারিও রক্তাক্ত ৷ আরো মিলিটারি প্রবেশ করে ঘরে ৷ তারা আজাদ, জুয়েল, বাশার, মনোয়ার, সেকেন্দার আর চঞ্চলকে ধরে নিয়ে প্রচণ্ড মার দিতে দিতে গাড়ির দিকে চলে যায় ৷ আজাদের মুখ দিয়ে রক্ত ঝরতে তাকে, বাশারের হাত ভেঙে যায়, জুয়েলেরও নাকমুখ দিয়ে রক্ত ঝরে ৷

আজাদের মা দেখেন তাঁর চোখের সামনে থেকে তাঁর ছেলে চলে যাচ্ছে ৷ তিনি কেঁদে ফেলেন ৷ আর্তনাদের সুরে বলেন, ‘আজাদ, তুই চলে গেলে আমি কাকে নিয়ে থাকব ৷’

আজাদ বলে, ‘আল্লাহ আল্লাহ করো মা ৷’ আরেক দফা মার তার ঘাড়ে এসে পড়লে সে সেটা সহ্য করে শেষবারের মতো তার মায়ের দিকে তাকায় ৷

চঞ্চল তখন খুবই ছোট ৷ নিতান্তই বালক ৷ তাকে কেন আর্মি ধরে নিয়ে গাড়িতে তুলছে ৷ সে তো যুদ্ধ করেনি ৷ কোনো পক্ষ-বিপক্ষ বোঝেও না ৷ সৈন্যরা তার পেটে ঘুসি মারছে আর বলছে, ‘বাতাও, হাতিয়ার কিধার হ্যায়’, সে চিৎকার করে বলছে, ‘হাম বেকসুর হ্যায়, হাম বেগুনা (নিষ্পাপ) হ্যায় ৷’ আজাদের মা দৌড়ে যান গাড়ির কাছে, ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আসেন চঞ্চলকে ৷

গুলিবিদ্ধ, আহত অথবা নিহত তিন পাকিস্তানি সৈন্যকে ওরা একটা গাড়িতে তোলে ৷ বন্দি সবাইকে গাড়িতে তুলে নিয়ে পাকসেনারা বিদায় হলে হঠাৎ করেই পুরো পাড়া নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে ৷

টগরের আজও মনে পড়ে, ঘটনার ১৪ বছর পরও, যখন গুলি এসে লাগল তার পেটে, তার মনে হচ্ছিল, যেন লক্ষ লক্ষ ব্লেড ঢুকে যাচ্ছে পেটের ভেতরে, এত যন্ত্রণা, আর মনে হচ্ছে, তার বুকের ভেতরটা মরুভূমি হয়ে গেছে, তার পানি চাই, এত তৃষ্ণা যেন কলসের পরে কলস পানি খেলেও তার পিপাসা মিটবে না, সে চিৎকার করছে, ‘আম্মা পানি, আম্মা পানি…’ তখন লক্ষ লক্ষ পাখি ছেয়ে ফেলে তার আকাশটা, তারা একযোগে মুখর হয়ে ওঠে পানি পানি বলে, আর আজাদের মা এসে ঢোকেন ঘরে ৷

তিনি আজাদের ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখেন শুধু রক্ত আর রক্ত ৷ যেন রক্তের পুকুরে ভেসে আছে জায়েদ আর টগর ৷ তারই মধ্যে রক্তের মধ্যে বসে আপন মনে খেলছে মনোয়ার হোসেন ও দুলুর ছোট্ট মেয়ে লীনা, যে কিনা কেবল হামাগুড়ি দিতে শিখেছে ৷ কে কার দিকে খেয়াল করে, এ এমন এক দুর্যোগময় মুহূর্ত ৷ আজাদের মা দৌড়ে জগ নিয়ে আসেন ৷ পানি ঢালেন টগরের মুখে ৷ টগর পানি খেয়ে বলে, ‘পানি, আম্মা পানি…’ আর পাখিরা ডেকে ওঠে আম্মা পানি, আম্মা পানি, বলে…

জায়েদ বেঁচে আছে, নাকি মারা গেছে কে জানে! টগরের লক্ষণও তো সুবিধার মনে হচ্ছে না, এও বুঝি মারা যাবে ৷ আজাদের মা ধপাস করে পড়ে যান, জ্ঞান হারান ৷ তাঁর ভাগি্নরা তাঁর মাথায় পানি ঢেলে তাঁকে সুস্থ করে তুললে তিনি উঠে কর্তব্য স্থির করেন ৷

টগর আর জায়েদকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে ৷ তিনি পাশের বাসায় গিয়ে হাজির হন, যেখানে টেলিফোন আছে ৷ পাশের বাসায় থাকতেন একজন মাড়োয়ারি মহিলা ৷ মা মাড়োয়ারির বাসার দরজায় ধাক্কা দেন ৷ কিন্তু মহিলা দরজা খোলে না ৷ মা জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন মহিলা কোরআন শরিফ নিয়ে বসেছে ৷ তিনি আরেকবার ধাক্কা দেন ৷ মহিলা কোরান শরিফ থেকে মুখ তোলে না ৷ মা জানালার ধারে দাঁড়িয়েই থাকেন ৷ মহিলা কোরআন শরিফ পড়েই চলেন ৷ মহূর্ত মুহূর্ত করে ঘন্টা চলে যায় ৷ মহিলা কোরআন শরিফ থেকে চোখ সরায় না ৷ আজাদের মাও জানালা থেকে সরেন না ৷ ফজরের আজানের ধ্বনি শোনা যায় ৷ মহিলা মুখ তোলে ৷ আজাদের মা বলেন, ‘বুবু দরজা খোলেন ৷ একটা ফোন করব ৷’

তখন একা বাসায় তিনটা মেয়ে, তার মধ্যে কচি ভাবে, তার স্বপ্নের রাজপুত্ররা ঘরে ঢুকে এ কোন রক্তের খেলা খেলে গেল ৷ তাহলে ওরা কি রাজপুত্র ছিল না, ছিল রাজপুত্রের ছদ্মবেশে দুষ্ট রাক্ষস!

৪৩

কাজী কামাল দৌড়াচ্ছে ৷ রেললাইন ধরে ৷ বড় রাস্তা পেরিয়ে সে ঢুকে পড়ে দিলু রোডের দিকে ৷ সোজা চলে যায় হাবিবুল আলমদের বাসায় ৷ আলমদের নিচতলার জানালার কাচে টুক টুক করে শব্দ করে ৷ ঘুম ভেঙে যায় আসমার ৷ সে জানালার কাছে এসে জানতে চায়, ‘কে ?’ কাজী কামাল, সম্পূর্ণ জন্মদিনের পোশাকপরা, বলে, ‘একটা লুঙ্গি দ্যান আগে ৷ অবস্থা খারাপ ৷ আজাদের বাসা আর্মি রেইড করছে ৷ আমি স্টেন কাইড়া নিয়া গুলি কইরা পালায়া আসছি ৷’ আসমা তাকে একটা পেটিকোট জানালা দিয়ে ছুড়ে দেয় ৷ তারপর তারা দরজা খোলে ৷ কাজী বলে রেশমাকে, ‘একটা হাতিয়ার দাও ৷ আর তোমরা সবাই পালাও ৷ এই বাড়িতেও আর্মি শিয়োর আসবে ৷’

হাফিজুল আলম, আলমের বাবা, বলেন, ‘কাজী, তুমি পালাও ৷ এখন আর অস্ত্র নেওয়ার দরকার নাই ৷ আর আমরা দেখি নিজেরা কী করতে পারি ৷’ কাজীকে ওরা ধাক্কা দিয়ে পেছনের দেয়াল পার করিয়ে দেন ৷ হাফিজুল আলমকেও তাঁর মেয়েরা পাশের বাড়ির দেয়ালের ওপারে ঠেলে পাঠায় ৷ কাজী ইস্কাটনের রাস্তায় আসতেই দেখে দুটো ট্রাক আর একটা জিপ দিলু রোডে আলমের বাড়ির দিকেই যাচ্ছে ৷ কাজী পাশের ড্রেনের মধ্যে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ৷ জায়গাটা অন্ধকার ৷ তাকে হয়তো দেখা যাবে না ৷ কনভয় পাশ দিয়ে পার হয়ে যায় ৷ গাড়ির শব্দের চেয়ে কাজীর বুকের শব্দ যেন আরো জোরে জোরে বাজে ৷ সেখান থেকে সে যায় সৈয়দ আশরাফুল হকের বাড়িতে ৷ দরজায় নক করে ৷ আশরাফুলের ঘুম ভেঙে যায় ৷ সে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলে, ‘কে ?’

‘বাবু, শেষ শেষ, সব শেষ…’ কাজী কামালের গলা ৷ আশরাফুল দেখতে পায় গেটের লাইটের আলোয় খালিগা, পেটিকোট পরা কাজীকে ৷

সে দরজা খোলে ৷ ‘কী হইছে ?’

‘আজাদগো বাড়ি রেইড দিছে ৷ আলমগো বাড়িও ঘেরাও দেওয়া শেষ ৷ সব শেষ ৷ সব শেষ…’ কাজী কাঁপছে ৷

আশরাফুল তাকে নিয়ে লুকিয়ে রাখে গ্যারাজের ওপরে ড্রাইভারদের থাকবার জায়গায়, বলে, ‘এইখানে বইসা থাকো ৷ খাড়াও, তোমারে শার্ট-প্যান্ট আইনা দেই ৷’

পরে সেই জায়গাটাও নিরাপদ মনে না হওয়ায় কাজী বেরিয়ে পড়ে-এখন যেখানে সোহাগ কমিউনিটি সেন্টার সেখানে-আশরাফুলের বড় ভাইয়ের বাসার উদ্দেশে ৷ তখন ভোর ৫টা ৷ আশরাফুল তার এই চলে যাওয়ার দৃশ্যটা আর কোনো দিন ভুলতে পারবে না ৷ আশরাফুলের দেওয়া শার্ট-প্যান্ট পরে কাজী কামাল দরজা খুলে বেরিয়ে যায়, পেছনে তাকিয়ে হ্যা-হ্যা করে হাসে আর হাত নাড়ে, ‘টাটা টাটা, যাইগা…টাটা…’

সৈন্যরা আলমদের বাসায় ঢুকে প্রথমেই জানতে চায় রান্নাঘর কোথায়, রান্নাঘরের মেঝের নিচে গোপন কুঠুরিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ লুকানো ছিল ৷ শাবল দিয়ে মেঝে ভেঙে তারা এইসব অস্ত্র উদ্ধার করে ৷ আর বাসায় বেড়াতে আসা আলমের চাচা আর চাচাতো ভাইকে ধরে নিয়ে যায় ৷

২৯শে আগস্টের সকাল ১১টার দিকে বদি ধরা পড়ে ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপ্যাল জালাল উদ্দিনের বাসা থেকে ৷ প্রিন্সিপ্যালের ছেলে ফরিদ ছিল বদির বন্ধু ৷ প্রচণ্ড মারের মুখে বদি বলে দেয় সামাদ ভাই আর চুল্লু ভাইয়ের নাম ৷ বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ধরা পড়েন সামাদ ভাই ৷ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন আর জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন সামাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদের বাসা চিনিয়ে দিতে সৈন্যরা তাকেই বাধ্য করে সহ্যাতীত নির্যাতনের মুখে ৷

৩০শে আগস্টের ভোর ৷ রাজারবাগের বাসায় শিমুল বিল্লাহর মা তখনও ফজরের নামাজ শেষে জায়নামাজে বসে তসবিহ গুনছেন ৷ শিমুল বিল্লাহ, তখন কিশোরী, সকালের রেওয়াজ করছে ৷ শিমুল দেখতে পায়, তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৷ সে দৌড়ে তার মায়ের কাছে যায়, মা মোনাজাত করছেন ৷ পাকসেনারা নেটের দরজা ভেঙে ফেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে ৷ তাদের একজন শিমুলের বুক বরাবর অস্ত্র উঁচিয়ে ধরলে শিমুল তারস্বরে চিৎকার করে ওঠে, আর বাড়ির চারদিকে এক দল কাক কা কা রবে ডেকে উঠে পাখার ঝাপ্টায় আকাশ মাতায় ৷ সৈন্যরা ধাতবস্বরে বলে ওঠে, ‘মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায় ? কিধার হ্যায় ?’ তখন, চাল ধোয়া পানির মতো ভোরের পবিত্র আলো সত্তায় মেখে দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসেন আলতাফ মাহমুদ : ‘আমি ৷’

‘হয়্যার আর দি আর্মস অ্যান্ড এমুনিশেনস ? হাতিয়ার কিধার হ্যায় ?’

আলতাফ মাহমুদ বুঝতে পারেন, তারা সবকিছু জেনেই এসেছে ৷ তিনি বুঝতে পারেন, এ বাড়ির আর সবাইকে বাঁচাতে হলে সবকিছুর দায়দায়িত্ব তাঁকেই নিতে হবে, যা কিছু তিনি একজীবনে আর একাত্তরের মার্চের পরে করেছেন ৷ তিনি সুর দিয়েছেন আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি গানে, যুক্ত ছিলেন বাম রাজনীতির সঙ্গে, তিনি ২৫ মার্চের রাতে প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা পুলিশ ব্যারাকে হামলা চালিয়েছে, আগুন লাগিয়েছে, বাঙালি পুলিশ কীভাবে পাক-আক্রমণ প্রতিরোধ করতে চেয়েছে শুধু রাইফেল দিয়ে, বাঙালি পুলিশেরা পজিশন নিয়েছিল তাদের আর পড়শিদের বাসার ছাদেও, ভোরে টিকতে না পেরে চলে গেছে অস্ত্র আর ইউনফির্ম ফেলে, সেই অস্ত্র আলতাফ মাহমুদ তুলে দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ৷ শাহাদত চৌধুরী মেলাঘর থেকে জুলাইয়ে এসেছে তাঁর কাছে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য গান রেকর্ড করে তার টেপ নিয়ে যাওয়ার জন্যে, তাঁর কাছে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা গাজী দস্তগীর, ঢাকায় মেলাঘর থেকে খালেদ মোশাররফ আর হায়দার যে ১৭ জনকে পাঠিয়েছিলেন হাবিবুল আলমের নেতৃত্বে , তাদেরই একজন এই দস্তগীর ৷ সামাদ ভাই অনেকবার এসেছে তাঁর কাছে ৷ শাচৌ পূর্বপরিচিত আলতাফ মাহমুদের, যুদ্ধের মধ্যে একদিন রাস্তা থেকে আলতাফ মাহমুদ ধরে আনেন শাচৌ আর আলমকে ৷ তিনি নিজেই যুক্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ৷ তাঁর বাড়ি হয়ে ওঠে ঢাকার যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটা দুর্গ ৷ ফতেহ আর বাকেরও এসেছে ৷ অস্ত্র রাখতে হবে, এ প্রস্তাব শুনে আলতাফ মাহমুদ নিজে গাড়ি চালিয়ে গাড়ির বুটে করে নিয়ে এসেছেন দু ট্রাঙ্ক অস্ত্র, সেগুলো পুঁতে রাখা হয়েছে তাঁদের পড়শির বাসার পেছনের লেবুগাছটার নিচে আঙিনায়, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখলেই তিনি খুশি হতেন, বলতেন, ‘আমার যা সাহায্য লাগবে তোমরা আমাকে বলবে, আমি অবশ্যই করব ৷’

তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের বলেন, ‘তোমরা কেন এসেছ, আমি বুঝতে পারছি ৷ আমি ছাড়া আর কেউ জানে না ৷ এসো ৷ এই গাছের নিচে আছে দুটো ট্রাঙ্ক ৷’

সৈন্যরা তাঁর হাতেই তুলে দেয় কোদাল, একা আলতাফ মাহমুদ খুঁড়তে থাকেন মাটি, কিন্তু তিনি ক্লান্তি বা অনিচ্ছা বোধ করছিলেন, একজন সৈন্য রাইফেলের বাঁট দিয়ে তার মুখে আঘাত করে, তার একটা দাঁত ভেঙে মাটিতে পড়ে যায়, তিনি আবার খুঁড়ে চলেন উঠোন, একজন পাকিস্তানি সৈন্য বেয়নেট চার্জ করলে আলতাফ মাহমুদের কপালের চামড়া কেটে গিয়ে তার চোখের ওপরে ঝুলতে থাকে ৷

দুই ট্রাঙ্ক অস্ত্র উদ্ধার করে আলতাফ মাহমুদ, তাঁর শ্যালক নুহেল, খনু, লিনু, দিনু বিল্লাহ আর আগের রাতে বেড়াতে এসে কারফিউয়ের ফাঁদে আটকে পড়া মুক্তিযোদ্ধা-শিল্পী আবুল বারক আলভীকে, আর যন্ত্রশিল্পী হাফিজকে, আরো দুজন পড়শিকে ধরে নিয়ে গাড়িতে তোলে মিলিটারিরা, তখন প্রতিবাদে ভীষণ কান্না জুড়ে দেয় আলতাফ মাহমুদের চার বছরের কন্যা শাওন ৷ বাড়ির চারপাশের গাছাছালির ডাল থেকে কাকগুলো আকাশে চক্কর দিতে থাকে আর কা কা রবে পুনর্বার ডেকে ওঠে তারস্বরে ৷

একই রাতে, ২১টা বাসায় হানা দেয় পাকিস্তানি মিলিটারি ৷ বদি আর সামাদ ভাইয়ের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে ২৯শে আগস্ট বিকালেই মুক্তিযোদ্ধা উলফত চক্কর মেরে ঘুরতে থাকে বিভিন্ন হাইড আউটে, সে বেবিট্যাক্সিতে চড়ে যায় শাহাদত চৌধুরীদের ৩০ হাটখোলার বাসায়, শাচৌ বাড়ি নাই, গতকালই চলে গেছেন মেলাঘর, তাঁর ভাই মুক্তিযোদ্ধা ফতেহকে উলফত পেয়ে যায় গেটের কাছেই, দ্রুত তাকে জানিয়ে দেয় দুঃসংবাদ, রেইড আসন্ন ৷ এই বাড়িটা মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অন্যতম আশ্রয়স্থল, একটা দুর্গ, শাচৌ ফতেহর তিন বোন মারিয়াম, ঝিমলি আর ডানা আর তাঁদের বাবা-মা অস্ত্রশস্ত্র রাখা, মুক্তিযোদ্ধাদের দেখভাল করার কাজটা এমনভাবে করতেন যে তাঁরা নিজেরাই হয়ে উঠেছিলেন একেকজন নীরব মুক্তিযোদ্ধা ৷ উলফতের কাছে খবর পেয়ে তার আনা বেবিট্যাক্সিতে চড়েই ফতেহ আর তিন বোন চলে যায় তাদের আরেক বোনের বাসায় ৷ শাহাদত আর ফতেহ চৌধুরীর বাবা অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ আব্দুল হক চৌধুরীর অভ্যাস ছিল রাত ১২টা পর্যন্ত কোরআন শরিফ পাঠ, সেদিন তিনি আর জায়নামাজ থেকে ওঠেন না ৷ পাকিস্তানি আর্মি তাঁর বাসায় হানা দেয় রাত ২টায় ৷ তারা তাঁর কাছে তাঁর পরিচয় জানতে চায় ৷ চৌধুরী সাহেব জানান, তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ ৷ তখন আর্মি অফিসার তাঁকে স্যালুট করে ৷ জিজ্ঞেস করে, ‘আপনার ছেলেরা কোথায় ?’

তিনি বলেন, ‘জানি না ৷’

‘তারা কি ভারতে গেছে ?’

‘যেতেও পারে ৷’

‘যুদ্ধে গেছে ?’

‘আমার জানামতে গ্রামে গেছে থাকতে ৷ তবে যুদ্ধে গেলে যেতেও পারে ৷ আমি তাদের সিকিউরিটি দিতে পারব না, তাই তাদের আটকে রাখতেও পারি না ৷’

অফিসারটি বিস্মিত হয়ে চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, ‘আপনার কথা আমি আমার ওপরের অফিসারকে জানাব ৷’

আর রাত ২টায় বাসা ঘেরাও করে কাউকে না পেয়ে বাড়ির জামাতা করাচি থেকে বেড়াতে আসা বেলায়েত হোসেন চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায় পাকবাহিনী ৷

ধানমন্ডি ২৮-এর আশ্রয়স্থলটাও তল্লাশির আওতায় পড়ে, কাউকে না পেয়ে মালি জামানকে প্রচণ্ড মারধর করে আর্মিরা ৷ রাত ২টায় হানা দেয় চুল্লু ভাইয়ের ভাই এএসএইচকে সাদেকের বাসায়, ধরে নিয়ে যায় চুল্লু ভাইকে, কিন্তু ওয়ারড্রবের ভেতরে কাপড়ের আড়ালে রাখা অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে পারে না ৷ ফতেহ আলী চৌধুরী বোনদের বড় বোনের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে চলে যায় এলিফ্যান্ট রোডে জাহানারা ইমামের বাসার খোঁজে, কিন্তু সে বাসাটা চিনত না বলে খুঁজে না পেয়ে ফিরে যায়, আর রাত ২টায় চারদিক থেকে কণিকা নামের বাসাটা ঘিরে ফেলে আর্মিরা, ধরে নিয়ে যায় রুমী, জামী, তাদের বাবা শরীফ ইমাম, কাজিন মাসুম, বন্ধু হাফিজকে ৷ স্বপনের বাড়ি ঘেরাও হওয়ার সময় টের পেয়ে স্বপন বাড়ির পেছনের গোয়ালে ঢুকে পড়ে গরুর পেছনে আশ্রয় নিলে কোনোমতে বেঁচে যায় ৷ মেলাঘরের আরেক গেরিলা উলফতকে না পেয়ে তার বাড়ি থেকে পাকসেনারা ধরে নিয়ে যায় তার বাবা আজিজুস সামাদকে ৷

এইসব খবর নিয়ে ফতেহ, তার ভাই ডাক্তারির ছাত্র মোরশেদ আর তার ইডেন কলেজের অধ্যাপিকা সহমুক্তিযোদ্ধা জাকিয়া চলে যায় সীমান্ত পেরিয়ে মেলাঘরে ৷

সেখানে আলম আর শাচৌ ইতিমধ্যে পদোন্নতি পাওয়া লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ আর মেজর হায়দারকে শোনাচ্ছে ঢাকায় সেক্টর টু-র গেরিলা ওয়ারফেয়ারের সাফল্যের একেকটা অভিযানকাহিনী, তাঁদের দুজনই দারুণ খুশি এই সাফল্যে, এবং তাঁরা রাজি ঢাকার গেরিলাদের হাতে আরো ভারী অস্ত্র আর গোলাবারুদ দিতে, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শহীদুল্লাহ খান বাদল, পরিকল্পনা হচ্ছে আর কী কী করা যায় ঢাকায় ৷

একটা সিগারেট ধরাবেন বলে শাচৌ বেরিয়ে আসেন তাঁবু থেকে, তার মাথায় চিন্তা, ৬ই সেপ্টেম্বরের আগেই ঢাকায় পৌঁছতে হবে ৷ সিগারেট ধরিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছাড়তেই তিনি ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর দিয়ে সামনে দেখতে পান, পাহাড় থেকে নেমে আসছে ফতেহ ৷ আরে, ফতেহ এখানে কেন ? ওর তো ঢাকার অ্যাকশনে থাকার কথা ৷

ফতেহ বলে, ‘সব শেষ হয়ে গেছে ৷’

এই বিয়োগান্ত খবর শুনে খালেদ মোশাররফ আর হায়দার থমকে থাকেন, তারপর খালেদ মোশাররফের চাউনির বাইরে চলে যান হায়দার, ঢুকে পড়েন নিজের তাঁবুতে, দাঁড়িয়ে থাকে বিপন্ন বাদল, আর যে-মেজর হায়দারকে কেউ কোনো দিনও এক ফোঁটা জল ফেলতে দেখেনি, সেই শক্ত যোদ্ধাটি সোজা বিছানায় চলে যান, বালিশ চাপা দেন মুখে, তারপর হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন : মাই বয়েজ, মাই বয়েজ…,

পুরো মেলাঘরে নেমে আসে শোকের ছায়া ৷

৪৪

আজাদের মা টেলিফোন করেন অ্যাম্বুলেন্সের জন্য ৷ কিন্তু কোনো অ্যাম্বুলেন্স আসে না ৷ রক্তাক্ত দেহ নিয়ে পড়ে আছে দুটো ছোট মানুষ : জায়েদ আর টগর ৷ তিনি একা একা রিকশা নিয়ে যান হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের সামনে ৷ ভাড়া করে আনেন ট্যাক্সি ট্যাক্সিঅলাকে বলেন, ‘বাবা, দুইটা ছোট ছোট ছেলের গুলি লাগছে ৷ একটু ধরতে হইব ৷’ ট্যাক্সিচালক, আজাদের মা, মহুয়া-অতিকষ্টে ধরে জায়েদ আর টগরকে গাড়িতে তোলে ৷ মা বলেন, ‘ঢাকা মেডিকালে চলো ৷’ ট্যাক্সিঅলা বলে, ‘ঢাকা মেডিক্যালে আর্মি গিজগিজ করে, ওইখানে গুলি খাওয়া রোগী নিয়া গেলে ওরা গায়েব কইরা ফেলব ৷ এর চায়া হলি ফ্যামিলিতে লন ৷’

‘তাই চলো ৷’

টগর আর জায়েদকে হলি ফ্যামিলিতে ভর্তি করানো হয় ৷ তারা অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে থাকে হাসপাতালের বিছানায় ৷ আজাদের মায়ের দিনগুলো যে তখন কী করে কাটছে! দুটো ভাগ্নে, তারা তার ছেলের মতোই, হাসপাতালে, বাঁচে কি মরে ঠিক নাই ৷ তাদের জন্য ওষুধপাতি, রক্ত জোগাড় করা, হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করা-এসব তাঁকে করতে হচ্ছে ৷ ওদিকে তাঁর নিজের ছেলে ধরা পড়েছে আর্মিদের হাতে ৷ একই সঙ্গে ধরা পড়েছে ভাগি্নজামাই, আর তাঁর ছেলের তিনজন বন্ধু ৷ একা একটা মানুষ তিনি কী করবেন, কোথায় যাবেন ৷ এক ফাঁকে প্রথম সুযোগে তিনি তাঁর বাসায় গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখা অস্ত্রশস্ত্রগুলো সরিয়ে ফেলেন হাঁড়ির মধ্যে ভরে, ভাগ্নে টিসুর মাথায় চাপিয়ে দিয়ে ৷ আর তখনই মেডিক্যাল ছাত্র সাজ্জাদুল আলম কুটু স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে আসে জুয়েলের হাতের ক্ষত ড্রেসিং করে দেবে বলে, সাফিয়া বেগম মুহূর্তে কর্তব্য স্থির করেন ৷ চারদিকে গোয়েন্দা আর পাকিস্তানিদের চর গিজগিজ করছে ৷ এই নির্দোষ ছেলেটা না আবার ধরা পড়ে ৷ তিনি তাকে ডেকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যান, আর বলেন, ‘বাবা, আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না বলেই তোমাকে খবর দিয়ে আনিয়েছি, আমার ব্লাড প্রেসারটা মেপে দ্যাখো তো…’ গোয়েন্দারা তাকিয়ে দেখে কুটু সাফিয়া বেগমের ব্লাড প্রেসার মাপছে, আর হাতে ব্লাড প্রেসার মাপক যন্ত্রের কাপড় পেঁচানো অবস্থায় আজাদের মা বিড়বিড় করে বলে চলেন, ‘বাবা, তুমি তাড়াতাড়ি সটকে পড়ো, জানো না, রাতে ওদের সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে আর্মিরা…’

৪৫

আজাদদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও বিমানবন্দরের উল্টোদিকে ড্রাম ফ্যাক্টরির কাছে এমপি হোস্টেলে ৷ রুমী, জামী, তাদের বাবা শরীফ ইমাম, বন্ধু হাফিজ প্রমুখকে ধরে বাইরে রাস্তায় জিপের সামনে এনে হেডলাইট জ্বালানো হয়, তখন কেউ একজন রুমীকে শনাক্ত করে ৷ হতে পারে সেই কেউ একজনটা বদি, হতে পারে সামাদ ভাই, হতে পারে অন্য কোনো ইনফরমার ৷ রুমীকে শনাক্ত করার পর তাকে আলাদা করে জিপে তোলা হয় ৷ চুল্লুকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ কিন্তু স্বপনের বাড়ির সামনে গিয়ে আর্মিরা যে ‘স্বপন ভাগ গিয়া’ বলেছিল, এটা চুল্লু শুনতে পায় ৷

এখন রাত কত হবে, আজাদ জানে না ৷ সময়ের হিসাব এখন তাদের কাছে গৌণ হয়ে গেছে ৷ তাকে একটা ঘরে আলাদা করে নেওয়া হয়েছে ৷ ধরা পড়ার পর থেকেই তার ওপরে মারটা বেশি পড়ছে ৷ তাদের বাড়িতে পাকিস্তান আর্মির যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তারই রেশ ধরে তার ওপর দিয়েই ঝড়টা যাচ্ছে বেশি ৷ পিটিয়ে তার মুখ ক্ষতবিক্ষত করে ফেলা হয়েছে ৷ সমস্ত শরীরে ব্যথা ৷ ওই ঘরে যখন সবাই মিলে এক জায়গায় ছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছে মারধর ৷ বুকে পেটে মুখে লাথি ৷ ঘুসি ৷ বেত, চাবুক, লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটুনি ৷ বিশেষ করে গিঁটে গিঁটে, কনুইয়ে, হাঁটুতে, কব্জিতে মার ৷ চারদিকে বাঙালির আর্তনাদ, চিৎকার ৷ গোঙানি ৷

এরপর আজাদকে একটা ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় ৷ এঘরে একজন বসে আছে ৷ অফিসার ৷ নেমপ্লেটে লেখা নাম : ক্যাপ্টেন হেজাজি ৷

‘তুম আজাদ হ্যায় ৷’

আজাদ বলে, ‘নেহি, হাম মাগফার হ্যায় ৷’

সঙ্গে সঙ্গে হান্টারের বাড়ি এসে পড়ে গায়ে, পিঠে, ঘাড়ে, মাথায় ৷

‘ফের ঝুট বলতা হ্যায়!’

এরপর একজনকে আনা হয় ৷ তার মুখ কাপড়ে ঢাকা ৷ তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, ‘এ আজাদ ?’

মুখ-ঢাকা মাথা নেড়ে বোঝায়, হ্যাঁ ৷ এ-ই আজাদ ৷

আবার শুরু হয় জেরা ৷

‘তুমি ইন্ডিয়া কবে গেছ ?’

‘যাই নাই ৷’

‘কোন জায়গায় ট্রেনিং নিয়েছ ?’

‘নেই নাই ৷’

আবার মার ৷ মারতে মারতে মেঝেতে ফেলে দেওয়া হয় আজাদকে ৷ তারপর জেরাকারী বুটসহ উঠে পড়ে তার গায়ে পায়ে মাথায়! প্রথম প্রথম এই মার অসহ্য লাগে ৷ তারপর একটা সময় আর কোনো বোধশক্তি থাকে না ৷ ব্যথাও লাগে না ৷ আজাদ পড়েই থাকে মেঝেতে ৷ খানিকক্ষণ বিরতি দেয় জওয়ানটা ৷

আজাদের চোখ বন্ধ ৷ সে প্রায় সংজ্ঞাহীন ৷ পানি এনে ছিটানো হয় তার চোখেমুখে ৷ আবার চোখ মেলতেই আজাদকে বসানো হয় মেঝেতে ৷

‘কোন কোন অপারেশনে গিয়েছিলে ?’

‘যাই নাই ৷’

‘আর কে কে মুক্তিযোদ্ধা আছে তোমার সাথে ?’

‘জানি না ৷’

আবার মার ৷ প্রচণ্ড ৷ কিন্তু আশ্চর্য, কিছুই টের পাচ্ছে না আজাদ ৷

‘শোনো ৷ সব স্বীকার করো ৷ বন্ধুদের নাম বলে দাও ৷ অস্ত্র কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, বলে দাও ৷ তাহলে কথা দিচ্ছি, তোমাকে ছেড়ে দেব ৷’

‘আমি কিছু জানি না ৷ আমি নির্দোষ ৷’

‘জানো না ? তোমার বন্ধুরাই তোমার কথা বলেছে ৷ তোমার বাসা দেখিয়ে দিয়েছে ৷ তোমাকে চিনিয়ে দিয়েছে ৷ যে সব স্বীকার করছে, তাকে আমরা ছেড়ে দেব ৷ তাহলে তুমি কেন বোকার মতো মরবে ৷ স্বীকার করো ৷’

‘আমি কিছু জানি না ৷ তোমরা ভুল করছ!’

আবার প্রচণ্ড জোরে মার ৷ দড়ির মতো করে পাকানো তার দিয়ে ৷ হাত চলে যায় অজান্তেই, পিঠে ৷ হাতের আঙুলে গিয়ে পড়ে চাবুক ৷ আঙুল থেঁতলে যায় ৷ নখগুলো মনে হয় খুলে খুলে পড়বে ৷

আজাদ ‘ওরে বাবা রে ওরে মা রে’ বলে কেঁদে ওঠে ৷ তখন তার নিজেরই বিস্ময় লাগে ৷ যে বাবাকে সে দুই চোখে দেখতে পারে না, যে বাবাকে সে স্বেচ্ছায় ছেড়ে এসেছে, যার ওপরে তার অনেক রাগ, তাকে কেন তার মহান মায়ের সঙ্গে এক করে ডাকল ৷

তার ওপর দিয়ে মারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে ৷ যাক ৷ আজাদ এসব কথা মনে করবে না ৷ সে অন্য কিছু ভাববে ৷ সে তার মাকে ভাববে ৷ তার মায়ের মুখ মনে করবে ৷ তার মা দেখতে খুব সুন্দর ৷ তার সব সময়ই মায়ের মুখটা মিষ্টি লেগেছে ৷ তার মায়ের মুখে সব সময় হাসি লেগেই থাকে ৷ এটাই সে সুখে-দুখে দেখে এসেছে ৷ সে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে ৷ সে শুধু তার মায়ের মুখটা মানসচোখে ফুটিয়ে তুলতে চায় ৷ এই তো তার মা ৷ সেই ঠোঁট, সেই মুখ ৷ সেই পান-খাওয়া লাল ঠোঁট ৷ মা তার মিটিমিটি হাসছে ৷ সেদিন কেন সে জানে না, হঠাৎ করেই দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে বলেছে, ‘মা, তুমি কিন্তু আমাকে কোনো দিনও মারো নাই, আশ্চর্য, না! এমন মা বাংলাদেশে আছে, যে মা তার সন্তানকে কোনো দিনও মারে নাই! আমার মা আছেন ৷ তিনি তাঁর সন্তানকে কোনো দিনও মারেন নাই ৷ কিন্তু বিনিময়ে মাকে সে কী দিয়েছে! শুধুই অবাধ্যতা! মাকে জড়িয়ে ধরে সে কোনো দিনও বলেনি, মা, আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ অনেক ছেলের সঙ্গেই মায়ের এ রকম সম্পর্ক আছে ৷ তার মায়ের সঙ্গে তার নাই ৷ কিন্তু মা কি তার বোঝে না, এই জগতে মা ছাড়া তার আর কেউ নাই ৷ সে তো ইচ্ছা করলে বাবার কাছে চলে যেতে পারত ৷ তার ছোটমা তাকে নানাভাবে আদর করতে চেয়েছেন ৷ কিন্তু সে তো সেই আদর, সেই প্রাচুর্য ভোগ করবে বলে মাকে ফেলে চলে যায়নি ৷ বা, ফেলেই বা চলে যেতে হবে কেন, সে তো মাকেও বলতে পারত, মা পাগলামো করে না, কতজনই তো দ্বিতীয় বিয়ে করে, তাদের সবার প্রথম স্ত্রী কি সংসার ছেড়ে চলে গেছে! করাচিতে তার হোস্টেলের তিন রুমমেটের বাবাই তো দ্বিতীয়বার সৎকার্য করেছিল, সে চিঠি লিখে সেটা জানিয়েওছিল ৷ সে তো বলতে পারত, চলো মা, বাবার সঙ্গে একটা আপসরফা করে নিই ৷ কোনো দিন বলেনি তো! বলবার কথাও ভাবেনি ৷ বাবার সঙ্গে তার তো কোনো গোলযোগ হয়নি ৷ বাবা তাকে আদরই করতেন ৷ কিন্তু সে বাবাকে ছেড়েছে শুধু তার মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে ৷ বাবাকে ছাড়া মানে তো শুধু বাবাকে ছাড়া নয়, আরাম-আয়েশ অর্থ-প্রতিপত্তি গাড়ি-বাড়ি, সম্পত্তির উত্তরাধিকারের মোহ-সব ছাড়া ৷ সে ছেড়েছে তো সব ৷ প্রথম প্রথম অসুবিধা হয়েছে ৷ কিন্তু মেনে কি সে নেয়নি ? ‘মা, এর মধ্য দিয়েই আমার বলা হয়ে গেছে যে আমি তোমাকে ভালোবাসি ৷ মা, তুমি কি তা বুঝেছ ৷ মা, যদি আমি আর ছাড়া না পাই, তাহলে তোমার আর কী থাকবে মা ? আমি জানি, তুমি শুধু আমাকেই মানুষ করতে চেয়েছ ৷ আর তার বিনিময়ে আমার কাছ থেকে কিছুই প্রত্যাশা তুমি করো না ৷ এটা তুমি চিঠিতেও লিখেছিলে ৷ কিন্তু আমি তো তোমার পাশে থাকতে চাই ৷ না, তোমার ভালোবাসার প্রতিদান দেওয়ার জন্যে নয়, তোমাকে খুব ভালোবাসি বলে ৷’

প্রথম রাতের নির্যাতনে আজাদের মুখ থেকে কোনো কথাই আদায় করা যায় না ৷

সময় কীভাবে, কোথা দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, আজাদ টের পায় না ৷ এক সময় দেখতে পায়-বদি, রুমী, চুল্লু ভাই, সামাদ ভাই, আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারক আলভী, বাশার, জুয়েল, সেকেন্দার, মনোয়ার দুলাভাই, আলতাফ মাহমুদের শ্যালকেরা, রুমীর বাবা, ভাই, আরো অনেকের সঙ্গে সেও একই ঘরে ৷ তার কী রকম একটা অভয় অভয় লাগে ৷ একই সঙ্গে এতগুলো পরিচিত, অভিন্ন-লক্ষ্য মানুষ, সতীর্থ মানুষ ৷

আলতাফ মাহমুদ শিখিয়ে দেন তাঁর শ্যালকদের, আলভীকে, একই সঙ্গে ধরা পড়া তাঁর দুই পড়শিকে, ‘তোমরা বলবে তোমরা কিছু জানো না ৷ যা জানার আমিই জানি ৷’

রুমী শিখিয়ে দেয় তার বাবাকে, ভাইকে, বন্ধুকে, ‘তোমরা কিছু জানো না ৷ বলবে, ছেলে কোথায় কী করে বেড়ায় আমরা জানি না ৷ ব্যস ৷’

গাদাগাদি করে বসে আছে সবাই ৷ পানির পিপাসায় সবার অবস্থা খারাপ ৷ পানি পানি করে চিৎকার করে ওঠে একজন ৷ তখন সবার মনে পড়ে, সবাই বড় তৃষ্ণার্ত ৷ একজন সেন্ট্রি দরজার ওপারে ৷ কিন্তু তার কানে এই আবেদন পৌঁছুচ্ছে বলে মনে হয় না ৷ ঘরের ভেতরেই একটা পানির কল আছে ৷ কেউ দেখেনি ৷ একজনের চোখে পড়ে ৷ তখন সবাই এক এক করে উপুড় হয়ে আঁজলা ভরে পানি খায় ৷ প্রত্যেকের চেহারা বিধ্বস্ত ৷ আলতাফ মাহমুদের গেঞ্জিভরা রক্তের দাগ ৷ আবুল বারক আলভীর নখ মারের চোটে খুলে খুলে যাচ্ছে ৷ যারা আগে মার খেয়েছে, তাদের গা ফেটে বেরুনো রক্ত শুকিয়ে আরো বীভৎস দেখাচ্ছে ৷ বাশারের হাত ভাঙা ৷ বোঝাই যাচ্ছে যে ওটা ভেঙে গেছে মাঝ বরাবর ৷ বাশারের মুখে আঁজলা ভরে পানি দেয় আজাদ ৷

আজাদকে ধরা হয়েছে গতকাল রাত ১২টার পরে ৷ এখন সন্ধ্যা ৷ প্রায় ১৮ ঘন্টা হয়ে গেছে তাদেরকে কিছুই খেতে দেওয়া হয়নি ৷

জাহানারা ইমাম সারা দিন চেষ্টা করেছেন ফোনে, আর্মি এঙ্চেঞ্জে ৷ তিনি ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে চাইছেন ৷ কিন্তু ক্যাপ্টেন কাইয়ুমকে কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না ৷ এই ক্যাপ্টেন গত রাতে তাদের বাসায় রেইডের নেতৃত্বে ছিলেন ৷ আর এ বাসায় এসেছিল সুবেদার সফিন গুল ৷ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে জাহানারা ইমাম সুবেদার সফিন গুলকে পেয়ে যান ৷ এই সুবেদার বলে গিয়েছিল, ‘এক ঘন্টা পরে ইন্টারোগেশন শেষে সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হবে ৷’

জাহানারা বলেন, ‘কী এত ইন্টারোগেশন ৷ ওদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না কেন ? ওরা কেমন আছে ? আমি কি ওদের কারো সাথে কথা বলতে পারি ?’

সফিন গুল জামীকে ডেকে দেন ৷

জামী সংক্ষেপে সারে ৷ ‘হ্যালো, ভালো আছি ৷ আমাদের ছেড়ে দেবে ৷’

‘তোরা খেয়েছিস কিছু ?’

‘না ৷’

‘দে তো, সুবেদার সাহেবকে ফোনটা দে ৷’

জাহানারা মিনতি করে আল্লার দোহাই পেড়ে সুবেদারকে অনুরোধ করেন ওদের কিছু খেতে দিতে৷

এই সুবেদার, নাকি অন্য কেউ, আবুল বারক আলভী বহুদিন তার কথা ভুলতে পারবে না যে, তাদের মেস থেকে হাতে বেলা রুটি আর চিনি এনে দিয়েছিল খেতে৷ তাকে আলভীর মনে হয়েছিল সাক্ষাৎ দেবদূত৷ তবে প্রত্যেকের মুখে প্রহারের ক্ষত থাকায় কেউই কিছু খেতে পারেনি৷

ওরা যখন এক ঘরে, কখনও খানসেনারা আসে, দলে দলে বা জোড়ায় জোড়ায়, ইচ্ছামতো পেটাতে থাকে ওদের, যেন ওরা খেলার সামগ্রী, বা ব্যাটিং প্রাকটিস করার বস্তা৷

রাত ১১টার পরে রুমীকে বাদ দিয়ে সবাইকে রমনা থানায় আনা হয়৷

রমনা থানায় দুটো সেল৷ দুটো লাইন করা হয়েছে৷

আবুল বারক আলভী, তখন সবে আর্ট কলেজ থেকে পাস করে বেরিয়েছে, তাকে দেখতে বালকের মতো দেখায়, মেলাঘর থেকে এসেছে, ভাবে, ‘আমাকে আলতাফ মাহমুদের ফ্যামিলির সঙ্গে দাঁড়াতে হবে৷’ সে নিজে থেকে গিয়ে আলতাফ মাহমুদের পরিবারের লাইনে ভিড়ে যায়৷ আর মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, তার নাম সে বলবে সৈয়দ আবুল বারক৷ আলতাফ মাহমুদের বাসায় এসেছে নিতান্তই আত্মীয় হিসাবে, বেড়াতে, সে তার শ্বশুরপক্ষের আত্মীয়৷

সৈন্যরা এক এক করে ডেকে ডেকে নাম এন্ট্রি করছে, আলভী তার নামের প্রথম অংশ বলে, বাকিটা আর বলে না৷ সবাইকে সেলে ঢোকানো সাঙ্গ করে সৈন্যরা চলে যায়৷ সঙ্গে সঙ্গে এতক্ষণ সেলে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকা আগে থেকে ঢোকানো আসামীরা জেগে ওঠে৷ তাদের কেউ হয়তো চোর, কেউবা পকেটমার৷ তারা জানে রোজ রাতে মুক্তিরা আসে, তারা দিনের বেলা তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে নোভালজিন ট্যাবলেট, আয়োডেঙ্ এসব নিয়ে রেখে দিয়েছে৷ তারা সবাই মুক্তিদের সেবায় লেগে যায়৷ আজাদের সারা গায়ে আয়োডেঙ্ লাগায় একজন৷ বলে, ‘ভাইজান, আমি পকেট মারার কেসে ধরা পড়ছি, অনেক মাইর খাইছি, হাটুরা মাইর, আপনাগো মতো মাইর খাই নাই৷’

বাশারের হাতে রুমাল বেঁধে দেয় একজন৷

নিজের গামছা খুলে পুরোটা মেঝে মুছে দেয় কেউ৷ তারা শিখিয়ে দেয় মার থেকে বাঁচার উপায়, বলে, ‘প্রথমে দু-এক ঘা মাইর খাওনের সাথে সাথে অজ্ঞান হওনের ভান কইরা পইড়া যাইবেন, চোখ উল্টায়া রাখবেন, দেখবেন তাইলে মাইর থামায়া চোখেমুখে পানি ছিটাইব৷’

ভাত আর তরকারি আসে কিছু৷ দু চামচ করে ভাত, একটু করে নিরামিষ তরকারি৷ বন্দিরা খায়৷ তারপর হাজতিরা পুলিশকে টাকা-পয়সা দিয়ে এদের জন্যে পান আর সিগারেট জোগাড় করে৷

অল্প ভাত৷ সবাই ভাগাভাগি করে খায়৷ আজাদ গিয়েছিল হাতমুখ ধুতে৷ এসে দেখে ভাত ফুরিয়ে গেছে৷ তার রেজেকে ভাত নাই! কী আর করা! সে পান মুখে দেয়৷ তার মা খুব পান পছন্দ করে৷ কী জানি, মা এখন কী করছে!

৪৬

আজাদের মায়ের সময়গুলো যে কীভাবে কেটে যাচ্ছে, আল্লাহ জানে৷ জায়েদ আর টগরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে৷ হাসপাতালে ভর্তি করলেই তো আর ঝামেলা শেষ হয়ে যায় না৷ কাগজে ছাপা হয়েছে সংবাদ, ঢাকায় পুলিশ আর সেনাবাহিনীর অভিযান, দুষ্কৃতকারী গ্রেফতার, প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার, দেশপ্রেমিক নাগরিকদের কাছ থেকে গোপন খবর পেয়ে সেনাবাহিনী এই মহান সাফল্য দেখিয়েছে৷ গুলিবিদ্ধ দুজন দুষ্কৃতকারী হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে অচেতন হয়ে আছে৷ এই খবর কাগজে প্রকাশিত হওয়ার পর মিলিটারি চলে আসে হলি ফ্যামিলিতে৷ এদের মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন ইমতি৷ তারা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলে, এই রোগী দুজনকে তাদের চাই৷ হলি ফ্যামিলি কর্তৃপক্ষ বলে, এটা রেডক্রসের হাসপাতাল৷ এখান থেকে কোনো রোগীকে কখনও ছাড়া হবে না৷ কাপ্টেন রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের খুঁজতে থাকে৷ আজাদের মাকে পাওয়া যায়৷ ক্যাপ্টেন তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ঘটনা কী ? এরা গুলিবিদ্ধ হয়েছে কীভাবে৷ আজাদের মা ঘটনাটা যতটুকু বলা নিরাপদ মনে করেন, বিবৃত করেন৷ তাঁর ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে জানতে পেয়ে ক্যাপ্টেন জানতে চায়, ছেলের নাম কী৷ মা ছেলের ভালো নাম বলেন৷ ক্যাপ্টেন চমকে ওঠে৷ জানতে চায়, ডাকনাম কী৷ মা বলেন৷ ক্যাপ্টেন বলে, আজাদের কোনো তসবির তাঁদের সঙ্গে আছে কি না৷ আজাদের মা তাঁর সঙ্গে সারাক্ষণ রাখা আজাদের একটা পাসপোর্ট সাইজ ছবি বের করে দিলে ক্যাপ্টেন সেটা হাতে নেয়৷ ভালো করে দেখে৷ তাকিয়ে থাকতে থাকতে ক্যাপ্টেনের দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি ঝরতে থাকে৷ ছবিটা ফেরত দিয়ে ক্যাপ্টেন কিছু না বলে চলে যায়৷ আজাদের মা ঘটনার কোনো কারণ বের করতে পারেন না, তবে ঘটনা শুনে অন্যরা এই অনুমান ব্যক্ত করে যে সম্ভবত এই ক্যাপ্টেনটা করাচি ইউনিভার্সিটিতে আজাদের সহপাঠী ছিল৷

রক্ত জোগাড় করা দরকার৷ জায়েদ-টগরকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে রক্ত আর স্যালাইন দিয়ে৷ টাকা সংগ্রহ করতে হবে৷ হাতে কোনো নগদ টাকা নাই৷ এর মধ্যে আবার চেষ্টাচরিত করতে হবে আজাদ, মনোয়ার, বাশারকে ছাড়িয়ে আনার৷ তিনি কার কাছে যাবেন ? টাকা জোগাড়ের সহজ পথ সোনার গয়না বিক্রি করা৷ ওটা করা যাবে৷ রক্তও যে কার কাছে পাওয়া যাবে, খোদা জানেন৷ তিনি নিজেই দিতে পারেন, কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর রক্ত নিতে চায় না৷ কেন যে নিতে চায় না কে জানে৷

ডাক্তাররা তাঁর কাছে একটা ফরম নিয়ে আসে-’জায়েদের পা কেটে ফেলতে হবে৷ আপনি গার্জিয়ান হিসাবে পারমিশন দেন৷ এখানে আপনার সাইন লাগবে৷ সাইন করেন৷’

পা কেটে ফেলতে হবে ? আজাদের মা চিন্তায় পড়েন৷ ছেলে তাঁর নয়৷ ছেলের মা বেঁচে থাকলে সে-ই সিদ্ধান্ত দিতে পারত৷ ছেলের বাবা তো থেকেও নাই৷ এখন এই সিদ্ধান্ত তিনি কীভাবে দেবেন৷ তখন তাঁর মনে পড়ে যায় জুরাইনের মাজার শরিফের বড় হুজুরের কথা৷ আজাদকে যুদ্ধে যেতে দেবেন কি দেবেন না, এই দোটানায় যখন তিনি ভুগছিলেন, তখন তিনি হুজুরের কাছে গিয়েছিলেন৷ হুজুর তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘আজাদকে যুদ্ধে পাঠাও৷’ এখন তার এই দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় হুজুরের কাছে বুদ্ধি নেওয়া যেতে পারে৷

আমি একটু বুদ্ধিপরামর্শ নিয়ে আসি৷

তিনি জুরাইনে চলে যান৷ বড় হুজুরের সঙ্গে দেখা করেন৷ হুজুরপাকের স্ত্রীর সঙ্গেও তাঁর সুসম্পর্ক৷ তাঁর সঙ্গেও দেখা করেন৷ তাঁদের খুলে বলেন তাঁর বিপদের কথা৷ ছেলেকে, ছেলের বন্ধুকে, ভাগি্নজামাইকে ধরে নিয়ে গেছে আর্মিরা৷ আর্মির গুলিতে দুই ভাগ্নে মরণাপন্ন৷ ছেলে কি তাঁর ফিরে আসবে না ? আর জায়েদের পা কাটার অনুমতি তিনি দেবেন কি দেবেন না!

হুজুর বলেন, ‘উসকো পাও মাত কাটো৷’

ব্যস৷ মা তাঁর সিদ্ধান্ত পেয়ে যান৷ ‘আর আমার ছেলে আজাদের কী হবে হুজুর!’

‘ও আপাস আয়েগা৷ আসবে৷ ফিরে আসবে৷ সহিসালামতেই ফিরে আসবে৷’

আজাদের মা কিছুটা আশ্বস্ত হন৷ হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ফিরে আসেন৷ ডাক্তারদের বলেন, ‘না, জায়েদের পা কাটতে পারবেন না৷ আমার অনুমতি নাই৷’ শুনে ডাক্তাররা বিরক্ত হয়৷ পায়ে গুলি লেগেছে৷ পা না কাটলে এ ছেলেকে তো বাঁচানোই যাবে না৷

জায়েদ এ কথা চিরদিনের মতো স্মরণ করে রাখবে যে, জুরাইনের হুজুরের জন্যে তার পা-টা আজও আছে৷ নইলে তো কবেই সেটা কেটে ফেলে দিতেন হলি ফ্যামিলির ডাক্তাররা৷

আজাদের মা বাসায় ফেরেন৷ ঘরের মধ্যে এখনও পড়ে আছে ভাঙা খাট৷ ইস্পাতের আলমারি এখনও গুলিতে ছঁ্যাদা হয়ে আছে৷ মেঝেতে রক্ত জমে কালো হয়ে গেছে, কে মুছবে আর এসব!

হঠাৎ করে কামরুজ্জামান আসে আজাদের মায়ের কাছে, তাকে জায়েদ সব সময়ই সন্দেহ করে এসেছে আর্মির ইনফরমার বলে, তার সঙ্গে আরেকজন ছেলে, সেই ছেলে বলে, ‘নানি, অস্ত্রগুলা দ্যান৷’

আজাদের মা বলেন, ‘তুমি কে ?’

‘আমি বদির মামা৷ আজাদের বন্ধু৷ আজাদদের সাথে ছিলাম৷’

আজাদের মায়ের মাথায় মুহূর্তে এ প্রশ্ন উদিত হয় যে, আজাদের কোনো বন্ধু তো তাকে নানি বলে না৷ এ কে ? কেন এসেছে ? তিনি বলেন, ‘বাবা, এ বাসায় তো কোনো অস্ত্র নাই৷ তুমি ভুল শুনেছ!’ কামরুজ্জামান আগন্তুককে নিয়ে চলে যায়৷ আজাদের মা ভাবেন, ভাগ্যিস অস্ত্রগুলো তিনি আগেই সরিয়ে ফেলেছিলেন৷

মা সারাক্ষণ ব্যস্ততার মধ্যে থাকেন৷ এর মধ্যে যতটুকু সময় পান তিনি নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন, আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন৷

৪৭

৩১শে আগস্ট ১৯৭১ সকাল ৭টা৷ রমনা থানা৷ বন্দিরা হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ পায়৷ পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে পড়ে৷ বন্দিদের আবার তোলা হয় একটা জানালা-বন্ধ বাসে৷ তাদের নিয়ে আসা হয় আবার এমপি হোস্টেলে৷ একটা কক্ষে সবাইকে কিছুক্ষণ রাখার পর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পেছনের আরেকটা বিল্ডিংয়ে৷ আজাদ শুনতে পায়, এখানে সবার স্টেটমেন্ট নেওয়া হবে৷ স্টেটমেন্ট মানে একজন আর্মি অফিসার বন্দিদের একে একে প্রশ্ন করবে৷ জবাব শুনে সেগুলো কাগজে লিখে নেবে৷ এই স্টেটমেন্ট নেওয়ার সময় যে টর্চার করা হয়, তা আগের দুদিনের অত্যাচারের চেয়েও ভয়াবহ৷

আজাদের পালা আসে৷ একজন অফিসার নাম ধরে ডাকে৷ ‘আজাদ৷’ আজাদ ওঠে না৷ ‘আজাদ আলিয়াস মাগফার৷’ আজাদ ওঠে৷

আজাদকে একটা কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এখানে তিনজন অফিসার একসঙ্গে ঘিরে ধরে আজাদকে৷

‘আজাদ৷’

আজাদ কোনো কথা বলে না৷

‘তোমাকে তোমার বন্ধুরা দেখিয়ে দিয়েছে তুমি আজাদ, তুমি সেটাই স্বীকার করছ না৷ এটা ঠিক না৷ আমাদের কাছে সবকিছুর রেকর্ড আছে৷ তুমি সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে গিয়েছিলে৷ ২৫ তারিখে তুমি রাজারবাগ অপারেশনে ছিলে৷ প্রথমটার কম্যান্ডার ছিল কাজী কামাল৷ পরেরটার আহমেদ জিয়া৷’

‘এসব ঠিক নয়৷ আমার নাম মাগফার৷ ওরা আমার বাসায় এসেছিল তাস খেলতে৷ ওরা তাসটা ভালো খেলে৷ এছাড়া আমি ওরা কোথায় কী করে না করে কিচ্ছু জানি না৷’

‘হারামজাদা৷’ সিপাইদের ডেকে তার হাওলায় সমর্পণ করা হয় আজাদকে, ‘আচ্ছা করকে বানাও৷’ দুজন সিপাই এসে আজাদের পায়ে দড়ি বাঁধে৷ তারপর তাকে ঝোলায় সিলিং ফ্যানের সঙ্গে উল্টো করে৷ ফ্যান ছেড়ে দেয়৷ আজাদ উল্টো হয়ে ঝুলছে, ঘুরতে থাকে ফ্যানের সঙ্গে সঙ্গে৷ আর চলতে থাকে চড়-কিল-ঘুসি৷ আজাদ ‘মা মা’ বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে৷

তাকে নামিয়ে তার চোখেমুখে পানি দেওয়া হয়৷ জ্ঞান ফিরে পেলে সে প্রথম যা বলে, তা হলো, ‘মা৷’ যেন সে মায়ের কোলে শুয়ে আছে৷

অফিসাররা আজাদের ফাইলটা আবার দেখে৷ মায়ের সঙ্গে বাবার সম্পর্ক নাই৷ মায়ের একমাত্র ছেলে৷ মায়ের সঙ্গে একা থাকে৷

অফিসার বলেন, ‘তুমি মাকে দেখতে চাও ?’

‘হুঁ৷’

‘মায়ের কাছে যেতে চাও ?’

‘হুঁ৷’

‘তাহলে তুমি বলো, অস্ত্র কোথায় রেখেছ ?’

আজাদ বলে, ‘জানি না৷’

আবার একপ্রস্থ প্রহার চলে৷

আজাদ আবার তার মায়ের মুখ মনে করে নির্যাতন ভোলার চেষ্টা করে৷

‘ওকে৷ তোমার মা বললে তুমি সব বলবে ?’

‘বলব৷’

‘ঠিক আছে৷ তোমার মাকে আনা হবে৷’

অফিসার ইনটেলিজেন্সের এক লোককে ডেকে বলেন, ‘এর মাকে আনো৷’

আবুল বারক আলভী দেখে একে একে আলতাফ মাহমুদের বাসার সবাইকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে, তাকে তো ডাকে না৷ সে নিজেই উঠে যায়, বলে, ‘আমাকে যে ডাকলেন না! আমি তো ওই বাসায় গেস্ট হিসাবে ছিলাম৷’

তাকে ডাকা হয়৷ অফিসার বলেন, ‘তোমার নাম কী!’

সে বলে, ‘সৈয়দ আবুল বারক৷’

অফিসার তালিকায় তার নাম পান না৷ ‘তোমাকে কেন ধরেছে ?’

‘জানি না৷ আমি মিউজিক ডিরেক্টর সাহেবের বউয়ের পক্ষের আত্মীয়৷ কালকে বেড়াতে এসেছিলাম এ বাসায়৷ আমাকে ভুল করে ধরে এনেছে৷’

আবুল বারক আলভীর চেহারা প্রতারণাময়, বয়স বোঝা যায় না, তার ওপর আগের দিনের মারে সমস্ত শরীরে কাটা কাটা দাগ, রক্ত শুকিয়ে ভয়াবহ দেখাচ্ছে, চোখমুখ ফোলা, ঠোঁট কাটা, হাতের আঙুল থেকে নখ বের হয়ে আসছে…

কর্নেলকে অনেক সহানুভূতিসম্পন্ন মনে হচ্ছে; এমন সময় আগের দিন ও রাতে যে সিপাইটা প্রচণ্ড মেরেছিল, তাকে দেখা যায় এদিকে আসছে, আবুল বারক প্রমাদ গোনে, কারণ ওই সিপাইটা সব জানে, সে জানে যে তার নামই আসলে আলভী, আর একজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে আলভী বলে শনাক্ত করে গেছে৷

আরো খানিকক্ষণ চলে জিজ্ঞাসাবাদ, আবুল বারক জানায় তার চাকুরিস্থলের কথা, সে রোজ অফিসে যায়, ‘এই যে ফোন নম্বর, ফোন করেন,’ এটা সে বলে আত্মবিশ্বাস থেকে যে তার অফিসে কেউ খোঁজ করলে তার সহকর্মী বা বড় কর্তা তাকে বিপদে ফেলবে না…

কর্নেল তাকে চলে যাওয়ার অনুমতি দেন৷

আবুল বারক বেরিয়ে আসে৷ সে হাঁটতে পারছে না৷ তার ওপর ওই দূরে সেই ভয়ঙ্কর সিপাইটাকে দেখা যাচ্ছে৷ সে ভালো মানুষ সুবেদারটাকে পেয়ে যায়৷ এই সুবেদারটাকে পরশু থেকেই তার ফেরেশতা বলে মনে হচ্ছে৷ প্রথম দিন যখন ওই কসাই টাইপের সিপাইটা প্রচণ্ড মার মারছিল, তখন এক সময় এই সুবেদার সিপাইটাকে বলেছিল, ‘ইতনা মার মাত মারো৷’ আজ সুবেদার সাহেবকে সামনে পেয়ে আবুল বারক বলে, ‘আমি তো দাঁড়াতেই পারছি না৷ আমাকে কি তুমি রোড পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারো!’

শুনে সুবেদার বলে, ‘আমি দোয়া করি তুমি একাই হেঁটে যেতে পারবে৷’

‘পারতেছি না চাচাজি৷’

সুবেদার আরেকজন সিপাইকে বলে, ‘ওকে পার করে দিয়ে আসো৷’

আবুল বারক হেঁটে হেঁেট সিপাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় আসে৷ দূর থেকে সেই ভয়ঙ্কর সিপাইটা তাকিয়ে দেখে তাকে৷ আবুল বারক আলভীর রক্ত হিম হয়ে আসে৷

আবুল বারক এখনও নিশ্চিত নয়, তাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, নাকি ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ এই সৈন্যটা তাকে রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘বাসায় গিয়ে একজন ভালো ডাক্তার দেখাবে৷’ আবুল বারকের মনে হয় সে নবজীবন লাভ করল৷ এয়ারপোর্ট রোডে আসে সে৷ দেখে একটা গাড়ি যাচ্ছে৷ সে হাত তোলে৷ গাড়িটা তাকে অতিক্রম করে চলে যায়৷ তারপর ব্রেক কষে৷ আবার ফেরে৷ আলভী ভয় পায়৷ গাড়ি থেকে বলা হয় : ‘গাড়িতে ওঠো৷’

আবুল বারক আলভী দেখতে পায়, গাড়ির চালক তার বন্ধু রানা ও নিমা রহমানের বাবা লুৎফর রহমান৷ আলতাফ মাহমুদের বাসার পাশে থাকেন৷ বড় পাট ব্যবসায়ী৷ আলভী তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে আলতাফ মাহমুদের বাসায় আসে৷ মহিলা-মহলে সাড়া পড়ে যায়৷ নিমার মা এসে সব মহিলার সামনে আবুল বারক আলভীকে খালিগা করে শুশ্রূষা করতে থাকেন৷ আলভী লজ্জা পায়, আবার মহিলাদের এই আদর সে উপভোগও করে৷

ঘরে ফিরে আসে জামী, রুমীর বাবা শরীফ ইমাম৷ রুমী আসে না৷

এইভাবে কেউ ছাড়া পায়, কেউ পায় না৷

আজাদের মা মগবাজারের বাসায় পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই মহুয়া বলে, ‘আম্মা, আপনে কই আছিলেন৷ কামরুজ্জামানে এক লোকরে আনছিল৷ কয় বলে, আজাদের মা কই৷ জরুরি দরকার আছে৷ আজাদরে ছাড়নের ব্যাপারে কথা আছে৷’

মায়ের বুকের ভেতরটা যেন লাফিয়ে ওঠে৷ আজাদকে ছাড়িয়ে আনা যাবে! ফিরে আসবে তাঁর আজাদ৷ আশার সঞ্চার হয় খানিক৷ পরক্ষণেই কামরুজ্জামানের নাম শুনে তিনি খানিকটা হতাশ হন৷ মিলিটারির দালাল লোকটা৷ ইউনুস চৌধুরীর বাসাতেও ঘুরঘুর করে৷ সে কী মতলবে এসেছিল, আল্লাইই জানে! মহুয়া বলে, ‘আপনেরে থাকতে কইছে৷ আজকা বিকালে ফির আইব৷’

বিকালের জন্যে অপেক্ষা করেন মা৷ তাঁর বুক দুরুদুরু করে কাঁপছে৷ কিছুই ভালো লাগছে না৷ মহুয়ার কোলে ছোট মেয়েটা কাঁদে, মহুয়া তাকে স্তন্য পান করায়, মেয়েটা তখন চুপ করে, এই দৃশ্যের দিকে আজাদের মা তাকিয়ে থাকেন৷ তাঁর বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে ওঠে৷ কোথায় তাঁর আজাদ!

বিকালবেলা কামরুজ্জামান আসে৷ দরজায় আওয়াজ শুনে মা দৌড়ে দরজা খোলেন৷ কামরুজ্জামানের সঙ্গে আরো একটা লোক৷ কামরুজ্জামান বলে, ‘চাচি৷ আল্লাহর কাছে শুকর করেন৷ আমি রইছি বইলা না সুযোগ আইছে৷ আজাদরে ছাইড়া দেওনের একটা ভাও করছি৷ ওনারে ক্যাপ্টেন স্যারে পাঠাইছে৷ কী কয়, মন দিয়া শুনেন৷’

আজাদের মা তাদেরকে ঘরের ভেতরে আনেন৷ বসতে দেন৷ কামরুজ্জামানের সঙ্গের লোকটার মুখের দিকে তাকান৷ কালো প্যান্ট, শাদা শার্ট পরা৷ চুল ছোট৷ ছোট করে ছাঁটা গোঁফ৷ চেহারাটা পেটানো৷

লোকটা বলে, ‘আজাদের সঙ্গে দেখা করতে চান ?’

‘জি৷’ মায়ের বুক এমনভাবে কাঁপছে, যেন তা তাঁর শরীরের অংশে আর নাই৷

‘ছেলেকে ছাড়ায়া আনতে চান ?’

‘জি৷’

‘আজকা রাতে আজাদ রমনা থানায় আসবে৷ আপনারে আমি দেখা করায়া দেব৷ বুঝলেন ?’

‘জি৷’

‘তার সঙ্গে দেখা করবেন৷ দেখা করে কী বলবেন ?’

‘জি!’

‘দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়!’

‘জি ?’

‘শোনেন, ছেলেকে যদি ফিরে পেতে চান, তাকে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়৷ বুঝেছেন ?’

‘হুঁ৷’

‘অস্ত্র কোথায় রেখেছে, সে যেন বলে দেয়৷ বুঝেছেন ?’

‘হুঁ৷’

‘সে যদি সব স্বীকার করে, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে৷ বুঝেছেন ?’

আজাদের মা তার মুখের দিকে তাকায়৷ শূন্য তাঁর দৃষ্টি৷

কামরুজ্জামান বলে, ‘রাজসাক্ষী মানে হে সবাইরে ধরায়া দিব৷ যারা যারা আসল ক্রিমিনাল তাগো বিরুদ্ধে সাক্ষী দিব৷ পুরস্কার হিসাবে হেরে ক্ষমা কইরা দিব৷ আপনের ছেলেরে ছাইড়া দিব৷ আমি কইছি, আজাদ ভালো ছেলে৷ হে ইন্ডিয়া যায় নাই৷ আরে বন্ধুবান্ধবগো পাল্লায় পইড়া…’

আজাদের মা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন৷

লোকটা বলে, ‘আপনি বললে আপনার ছেলে আপনার কথা শুনবে৷ আমাদের কথা শুতেছে না৷ বাজে ছেলেদের সাথে মিশে ও কিছু ভুল করেছে৷ সব স্বীকার করলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে৷ এরপর ছেলেকে দেখে রাখবেন৷ আর যেন খারাপ ছেলেদের সাথে না মেশে৷’

যাওয়ার আগে কামরুজ্জামান বলে যায়, ‘রাতের বেলা রমনা থানায় যাইয়েন৷ আজাদ থাকব৷ যা যা কইছে, ঠিকমতন কইরেন৷ বুঝছেন৷’

তারা চলে যায়৷ কচি এসে বলে, ‘কী কইল আম্মা, আজাদ দাদাকে ছেড়ে দিবে ? ও আম্মা৷’

মা কিছুই বলেন না৷ একদিকে তাকিয়ে থাকেন৷ মহুয়ার মেয়েটা আবার কাঁদছে৷ কেন, কাঁদছে কেন৷ মহুয়া কি কাছে নাই ? সে তাকে দুধ দিচ্ছে না কেন!

রাত্রিবেলা৷ গরাদের এপারে আজাদ৷ ওপারে তার মা৷ ছেলেকে দেখে মায়ের সর্বান্তকরণ কেঁপে ওঠে৷ কেঁদে ওঠে৷ কিন্তু তিনি ছেলেকে কিছু বুঝতে দিতে চান না৷ আজাদের চোখমুখ ফোলা৷ ঠোঁট কেটে গেছে৷ চোখের ওপরে ভুরুর কাছটা কাটা৷ সমস্ত শরীরে মারের দাগ৷ মেরে মেরে ফুলিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কাটা জায়গাগুলোয় রক্ত শুকিয়ে দেখাচ্ছে ভয়াবহ৷

এখন আজাদকে তিনি কী বলবেন ? বলবেন, রাজসাক্ষী হও৷ সব স্বীকার করো৷ এটা তিনি তো বলতেই পারেন৷ ওর বাবা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী এই শহরে এখনও সবচেয়ে ক্ষমতাবান লোকদের একজন৷ গভর্নরের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব৷ আর্মির অফিসাররা তার ইয়ার-বান্ধব৷ আজাদের ছোটমা, তিনি শুনতে পান, কর্নেল রিজভী নামের একজনকে ভাই ডেকেছে৷ কর্নেলের ছোট বোনের নামের সঙ্গে নাকি তার নাম মিলে গেছে৷ সাফিয়া বেগম যদি ইঙ্গিতেও চৌধুরীর কাছে ছেলের জন্যে তদবির করেন, তাহলেও তো ছেলে তাঁর মুক্তি পাবে৷ আবার চৌধুরীর নিজের ভাই আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক৷ ওই দিক থেকেও তাঁদের কোনো সমস্যা নাই৷ আজাদের ছোটমা নাকি আজাদের চাচাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে গাড়িতে করে নদীতীরে পৌঁছে দিয়েছেন৷

কিন্তু তাঁর ছেলেকে তিনি রাজসাক্ষী হতে বলবেন ? অন্যের ছেলেদের ফাঁসানোর জন্য ? মুক্তিযোদ্ধাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে ? মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যে ?

ছেলে তাঁর যুদ্ধে যাওয়ার পরে একদিন বলে, ‘মা, তুমি কিন্তু আমাকে কোনো দিনও মারো নাই৷’ হ্যাঁ, তাঁর ছেলেকে তিনি কোনো দিনও ফুলের টোকাও দেননি৷ সেই ছেলেকে ওরা কী মারটাই না মেরেছে! আর ছেলে তাঁর করাচি থেকে চিঠি লিখেছিল, ‘মা, ওরা আর আমরা আলাদা জাতি৷ অনেক ব্যবধান৷’

না৷ তিনি আর যা-ই হন না কেন, বেইমান হতে পারবেন না৷ ছেলেকে যুদ্ধে যেতে তিনিই অনুমতি দিয়েছেন৷

আজাদ বলে, ‘মা, কী করব ? এরা তো খুব মারে৷ স্বীকার করতে বলে৷ সবার নাম বলতে বলে৷’

‘বাবা, তুমি কারো নাম বলোনি তো!’

‘না মা, বলি নাই৷ কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরো মারে, যদি বলে ফেলি৷’

‘বাবা রে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো৷ সহ্য কোরো৷ কারো নাম যেন বলে দিও না৷’

‘আচ্ছা৷ মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে৷ দুই দিন ভাত খাই না৷ কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগ পাই নাই৷’

‘আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্যে ভাত নিয়ে আসব৷’

সেন্ট্রি এসে যায়৷ বলে, ‘সময় শেষ৷ যানগা৷’

মা হাঁটতে হাঁটতে কান্না চেপে ঘরে ফিরে আসেন৷ পাশেই হলি ফ্যামিলি, জায়েদ আর টগর সেখানে চিকিৎসাধীন আছে, কিন্তু সেখানে যেতে তাঁর ইচ্ছা করছে না৷

সকালবেলা, যথারীতি গাড়ি এসে বন্দিদের নিয়ে যায় এমপি হোস্টেলের ইন্টারোগেশন সেন্টারে৷

বদির ওপরে চলছে অকথ্য নির্যাতন, সে আর সহ্য করতে পারছে না, এক সময় সে দৌড়ে ঘরের ভেতরে ইলেকট্রিক লাইনের ভেতরে হাত ঢোকানোর চেষ্টা করে, চেষ্টা করে সকেটের দুই ফুটোর মধ্যে দু আঙুল ঢোকানোর, ব্যর্থ হয়ে সকেট ভেঙে ফেলতে আরম্ভ করে, শব্দ পেয়ে সেন্ট্রিরা এসে তার দু হাত পেছন দিক থেকে বেঁধে ফেলে৷ তখন সে ভাবে, পালানোর চেষ্টা করলে নিশ্চয় গুলি করবে৷ তাকে যখন এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন সে অকস্মাৎ দৌড়ে গেটের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে, এ আশায় যে তাকে গুলি করা হবে, কিন্তু সৈন্যরা অতটা উদারতার পরিচয় দেয় না, তাকে ধরে নিয়ে এসে উল্টো রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড জোরে মারতে থাকে৷

আজাদকে আবার নিয়ে যাওয়া হয় কর্নেলের সামনে৷ কর্নেল কাগজ দেখেন৷ আজাদকে তার মায়ের সঙ্গে দেখা করানো হয়ে গেছে৷ ইন্টেলিজেন্সের রিপোর্ট৷ এখন নিশ্চয় সে স্বীকার করবে সবকিছু৷ জানিয়ে দেবে অস্ত্রের ঠিকুজি৷

‘আজাদ, বলো, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনে আর কে কে ছিল ?’

আজাদ বলে, ‘জানি না৷’

‘বলো, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশনের পরে রকেট লাঞ্চারটা কোথায় রাখা হয়েছে ?’

‘জানি না৷’

কর্নেল ইঙ্গিত দেন৷ আজরাইলের মতো দেখতে একজন সৈনিক এগিয়ে আসে৷ আজাদের ঘাড়ে এমনভাবে হাত লাগায় যে মনে হয় ঘাড় মটকে যাবে৷ তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসানো হয়৷ তাকে বাঁধা হয় চেয়ারের সঙ্গে৷ বিদ্যুতের তার খোলামেলাভাবে আজাদের চোখের সামনে খুলে বাঁধা হচ্ছে চেয়ারের সঙ্গে, তার পায়ের সঙ্গে৷ তাকে এখন শক দেওয়া হবে৷ আজাদের একবার মনে হয় ফারুক ইকবালের কথা, ৩রা মার্চ রামপুরা থেকে পুরানা পল্টনের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিটিংয়ে আসার জন্যে মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছিল সে, টেলিভিশন ভবনের সামনে আর্মি গুলি চালায়, গুলিবিদ্ধ হয়ে রাজপথে লুটিয়ে পড়ে ফারুক ইকবালের শরীর, তখন সারাটা শহরে জনরব ছড়িয়ে পড়ে যে ফারুক ইকবাল নিজের বুকের রক্ত দিয়ে রাস্তায় মৃত্যুর আগে লিখেছিল ‘জয় বাংলা’, তখন খবরটা বিশ্বাস হয়নি আজাদের, এখন ঠিক অবিশ্বাস হচ্ছে না৷ তার মনে পড়ে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের মৃত্যুর বর্ণনা, যা সারাটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে কিংবদন্তির মতো, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দু নম্বর আসামি লে. কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের বাসায় ২৫ মার্চ রাত ১১টার দিকে আর্মি ঢুকে পড়ে, তাঁকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমহারা নাম কিয়া’, তিনি বলেন ‘কম্যান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন’, তারা বলে, ‘বলো পাকিস্তান জিন্দাবাদ’, তিনি বলেন, ‘এক দফা জিন্দাবাদ’, পুরোটা মার্চে যখন নানা রকমের আলোচনা চলছিল, তখন মোয়াজ্জেম হোসেন এই এক দফার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছিলেন, ‘এক দাবি এক দফা বাংলার স্বাধীনতা…’ সৈন্যরা গুলি করল, লুটিয়ে পড়ল তাঁর দেহ…

প্রচণ্ড অত্যাচার চলছে আজাদের ওপর দিয়ে, কিন্তু আজাদ নির্বিকার, সে শুধু মনে করে আছে তার মায়ের মুখ, মা বলেছেন, ‘বাবা, শক্ত হয়ে থেকো… কারো নাম বোলো না…’

এক সময় কর্নেল তাঁর হাতের কাগজ রাগে ছুড়ে ফেলেন, তারপর নির্দেশ দেন চূড়ান্ত শাস্তির… আজাদের ঠোঁট তখন নড়ে ওঠে, কারণ সে জানে চূড়ান্ত শাস্তি মানে এই শারীরিক যন্ত্রণার চির উপশম, আজাদের মন এই টর্চারের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনায় আশ্বস্ত হয়ে ওঠে৷

পরদিন, কখন রাত হবে, কখন তিনি ভাত নিয়ে যাবেন রমনা থানায়, সারা দিন অস্থির থাকেন মা৷ দুপুরে তিনি আর ভাত মুখে দিতে পারেন না৷ তার ছেলে ভাত খেতে পায় না৷ তিনি বাসায় বসে আরাম করে ভাত খাবেন! তা কি হয়!

সন্ধ্যা হতে না হতেই তিনি চাল ধুতে লেগে পড়েন৷ দিনের বেলায়ই ঠিক করে জোগাড়যন্ত্র করে রেখেছেন কী রাঁধবেন! মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা, বেগুনভাজি৷ একটা টিফিন-ক্যারিয়ারে নেবেন৷ নাকি দুটোয়! তার কেমন যেন লাগে৷

রাত নেমে আসে৷ সারাটা শহর নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে৷ কারফিউ দেওয়ার আগেই ভাত নিয়ে তিনি হলি ফ্যামিলিতে আশ্রয় নেন৷ রাত আরেকটু বেড়ে গেলে দুটো টিফিন-ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে তিনি যান রমনা থানায়৷

দাঁড়িয়ে থাকেন, কখন আসবে গাড়ি৷ কখন এমপি হোস্টেল থেকে নিয়ে আসা হবে আজাদদের৷ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর গাড়ি আসে৷ একজন একজন করে নামে বন্দিরা৷ কই, এর মধ্যে তো তার আজাদ নাই৷ আর্মিরা চলে গেলে তিনি পুলিশের কাছে যান৷ ‘আমার আজাদ কই ?’

পুলিশকর্তা নামের তালিকা দেখেন৷ বলেন, ‘না, আজাদ তো আজকে আসে নাই৷’

‘মাগফার চৌধুরী ?’

‘না৷ এ নামেও কেউ নাই৷’

‘আর কি আসতে পারে ?’

‘আজ রাতে ? নাহ্৷’

‘কালকে ?’

‘বলতে পারি না৷’

টিফিন-ক্যারিয়ারে ভাত নিয়ে আজাদের মা কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দঁাঁড়িয়ে থাকেন৷ সারা রাত৷ থানার চত্বরে৷ বাইরে বাঙ্কারে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এলএমজির পেছনে ঢুলুঢুলু হয়ে আসে, ভেতরে পুলিশের প্রহরী মশা মারে গায়ে চাপড় দিতে দিতে, বিচারপতির বাসভবনের উল্টোদিকের গির্জায় ঘন্টা বাজে, মা দাঁড়িয়ে থাকেন টিফিন-ক্যারিয়ার হাতে, তাঁর কেবলই মনে হতে থাকে সেই দিনগুলোর কথা, বিন্দু মারা যাওয়ার পরে যখন তাঁর পেটে আবার সন্তান এল, প্রতিটা মুহূর্ত তিনি কী রকম যত্ন আর উৎকন্ঠা নিয়ে ভেতরের জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, আর সন্তানের জন্ম দেওয়ার পরে কানপুরের ক্লিনিকেই চৌধুরী সাহেব আজান দিয়েছিলেন, আর ভারতবর্ষের আজাদির স্বপ্নে ছেলের নাম রেখেছিলেন আজাদ, তাঁর পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করছে, যেন তিনি আজাদকে আবার এই পৃথিবীর সমস্ত বিপদ-আপদ-শঙ্কার প্রকোপ থেকে বাঁচাতে তাঁর মাতৃগর্ভে নিয়ে নেবেন, যদি তিনি পাখি হতেন, এখনই তাঁর পাখা দুটো প্রসারিত করে আজাদকে তার বুকের নিচে টেনে নিতেন৷ আস্সালাতু খায়রুম মিনান্নাউম, ভোরের আজান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দৌড় ধরেন তেজগাঁও থানার দিকে৷ ওখানে যদি তাঁর আজাদ থাকে! ঝিরঝির করে বৃষ্টি ঝরে, ছোট ছোট ছাঁদে, তিনি কিছুই টের পান না, তেজগাঁও থানার চত্বরে হাজির হন৷ তখনও তাঁর হাতে দুটো টিফিন-ক্যারিয়ার৷

পুলিশকে দুটো টাকা চা খাওয়ার জন্যে উপহার দিয়ে তিনি আজকের হাজতিদের পুরো তালিকা দেখেন৷ গরাদের এ পাশে দাঁড়িয়ে হাজতিদের প্রত্যেকের মুখ আলাদা আলাদা করে নিরীক্ষণ করেন৷ না, আজাদ নাই৷

এখান থেকে এমপি হোস্টেল বেশি দূরে নয়৷ তিনি এমপি হোস্টেলের দিকে দৌড় ধরেন৷ একজন সুবেদারের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর৷ সুবেদারকে বলেন, ‘আজাদ কোথায় ? আমি আজাদের মা৷’

সুবেদার বলে, ‘মাইজি, উনি তো এখানে নাই৷ ক্যান্টনমেন্টে আছেন৷ আপনি বাড়ি চলে যান৷’

মা কী করবেন, বুঝে উঠতে পারেন না৷ তাঁর হাতের ভাত ততক্ষণে পচে উঠে গন্ধ ছড়াচ্ছে৷ তাঁর নিজের পরিপাকতন্ত্রের ভেতরে থাকা পরশুদিনের ভাতও যেন পচে উঠছে…

‘মাইজি, আপনি বাড়ি চলে যান৷’

মা এক সময় বাসায় চলে আসেন৷ তাঁকে পাথরের মতো দেখায়৷ তিনি মহুয়াকে, কচিকে সংসারের স্বাভাবিক কাজকর্ম দেখিয়ে দেন, কিন্তু তবু মনে হয় সমস্তটা পৃথিবী গুমোট হয়ে আছে, কী অসহ্য ভাপসা গরম, বৃষ্টি হলে কি জগৎটা একটু স্বাভাবিক হতো! তিনি হাসপাতালে যান, দেখতে পান, জায়েদের জ্ঞান ফিরে এসেছে, টগরের অবস্থাও উন্নতির দিকে, তিনি জুরাইনের বড় হুজুরের কাছে, বেগম সাহেবার কাছে যান, তাঁরা তাঁকে আশ্বাস দেন যে আজাদ বেঁচে আছে, আজাদ ফিরে আসবে৷ ‘ঘাবড়াও মাত৷ ও আপসা আয়ে গা৷’

মহুয়া বলে, ‘আম্মা কিছু খান, না খেয়ে খেয়ে কি আপনি মারা যাবেন, আজাদ দাদা ফিরা আসবে তো!’

মা কিছুই খান না৷ একদিন, দুদিন৷

মহুয়া বলে, ‘আম্মা, আপনি কি আত্মহত্যা করতে চান ? আত্মহত্যা মহাপাপ৷ আপনি মারা গেলে আমরা কার কাছে থাকব আম্মা৷’

মায়ের হুঁশ হয়৷ তিনি তাঁর চোখের সামনে দেখতে থাকেন তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্ন চঞ্চল, কচি, টিসুর অপ্রাপ্তবয়স্ক মুখ, জায়েদ, টগরের শয্যাশায়ী শরীর, তিনি মরে গেলে এরা কোথায় যাবে, কার কাছে থাকবে ?

মহুয়া একটা থালায় ভাত বেড়ে টেবিলে রাখে৷ তাঁকে ধরে জোর করে এনে খাবার টেবিলে বসায়৷ মা খাবেন বলেই আসেন৷ দুদিন খান না৷ পেটে খিদেও আছে৷ তাঁর সামনে থালায় ভাত৷ মহুয়া আনতে গেছে তরকারি৷ ভাত৷ ভাতের দিকে তাকিয়ে মায়ের পুরো হৃৎদপিণ্ডখানি যেন গলা দিয়ে দুঃখ হয়ে, শোক হয়ে, শোচনা হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে৷ তিনি ভাতগুলো নাড়েন-চাড়েন৷ তাঁর মনে পড়ে যায়, রমনা থানার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে আজাদ কেমন করে বলেছিল, ‘মা, ভাত খেতে ইচ্ছা করে৷ দুই দিন ছেলে আমার ভাত খায় না৷ তারপরেও তো কেটে যাচ্ছে দিনের পর দিন৷ তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে৷ এই প্রথম, আজাদ নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে, তিনি কাঁদেন৷

তাঁকে কাঁদতে দেখে বাড়ির ছেলেমেয়েরাও বিনবিনিয়ে কাঁদতে থাকে৷ আজাদের মায়ের আর ভাত খাওয়া হয়ে ওঠে না৷ তখন সারাটা দুনিয়ায় যেন আর কোনো শব্দ নাই৷ কেবল কয়েকজন বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষের কান্নার শব্দ শোনা যায়৷ তারা আপ্রাণ চেষ্টা করছে চোখের জল সামলাতে, বুকের ভেতর থেকে উঠে আসা রোদনধ্বনি দমন করতে, তারা পারে না৷

রাত্রিবেলা সবাই ভাত খাচ্ছে৷ মহুয়া মায়ের কাছে যায়৷ ‘আম্মা, দুইটা রুটি সেঁকে দেই৷ খাবেন ?’

মা মাথা নাড়েন৷ খাবেন৷

তাঁকে রুটি গড়িয়ে দেওয়া হয়৷ একটুখানি নিরামিষ তরকারি দিয়ে তিনি রুটি গলায় চালান করেন৷

খাওয়ার পরে, শোয়ার সময় তিনি আর খাটে শোন না; মহুয়া, কচি, টিসু অবাক হয়ে দেখছে গত দু রাত ধরে আম্মা মেঝেতে পাটি বিছিয়ে শুইছেন৷ তারা বিস্মিত হয়, বলে, ‘আম্মা, এইটা কী করেন, আপনে মাটিতে শুইলে আমরা বিছানায় শুই কেমনে’, কিন্তু আম্মা কোনো জবাব না দিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়েন৷ মাথায় বালিশের বদলে দেন একটা পিঁড়ি৷

তখন কচি, ১১ বছর বয়স, মহুয়াকে বোঝায়, ‘আম্মা যে দেখছে রমনা থানায় দাদা মেঝেতে শুইয়া আছে, এই কারণে উনি আর বিছানায় শোয় না, না বুজি!’

এর পরে আজাদের মা বেঁচে থাকেন আরো ১৪ বছর, ১৯৮৫ সালের ৩০শে আগস্ট পর্যন্ত, এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন মুখে ভাত দেননি৷ একবেলা রুটি খেয়েছেন, কখনও কখনও পাউরুটি খেয়েছেন পানি দিয়ে ভিজিয়ে৷ মাঝে মধ্যে আটার মধ্যে পেঁয়াজ-মরিচ মিশিয়ে বিশেষ ধরনের রুটি বানিয়েও হয়তো খেয়েছেন৷ কিন্তু ভাত নয়৷ এই ১৪ বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি৷

তিনি আবার যান জুরাইনের মাজার শরিফের হুজুরের কাছে, হুজুরাইনের কাছে৷ হুজুর তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন, ‘ইনশাল্লাহ, আজাদ ফিরে আসবে৷ শিগগিরই আসবে৷’

একদিন জাহানারা ইমাম আসেন আজাদের মায়ের কাছে৷ তাঁরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন৷ অনেকক্ষণ কেউ কথা বলতে পারেন না৷ তারপর আজাদের মা মুখ খোলেন, ‘বোন, কী সর্বনাশ হয়ে গেল৷ আপনার রুমীকেও নাকি ধরে নিয়ে গেছে!’

আজাদের মার মুখে আজাদকে কীভাবে ধরা হলো, তার বৃত্তান্ত শোনেন জাহানারা ইমাম৷ তারপর আজাদের মা তাঁকে দেখান সেই ঘরটা, স্টিলের আলমারিতে এখনও রয়ে গেছে গুলির দাগ৷ মেঝেতে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে৷ দেয়ালে গুলি আর রক্তের চিহ্ন৷

‘বোন রে, বড় মেরেছে আমার আজাদকে৷ চোখমুখ ফুলে গেছে৷ সারা গায়ে মেরে ফাটিয়ে দিয়েছে৷ গায়ে রক্তের দাগ৷ মারের দাগ৷’ আজাদের মা বলেন৷

‘আপনি দেখেছেন আজাদকে ?’

‘হ্যাঁ৷ রমনা থানায়৷’

‘দেখা করতে দিল আপনাকে!’

‘হ্যাঁ৷’

‘কী বলল সে আপনাকে ?’

‘বলল, মা, খুব মারে৷ ভয় লাগে, যদি মারের চোটে বলে দেই সবকিছু৷

‘আপনি কী বললেন ?’

‘বললাম, বাবা, কারো নাম বলোনি তো৷ বোলো না৷ যখন মারবে, শক্ত হয়ে থেকে সহ্য কোরো৷’

জাহানারা ইমাম ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে যান৷ কী শুনছেন তিনি এই মহিলার কাছে ? তাঁকে তিনি শক্তই ভেবেছিলেন, কিন্তু এত শক্ত! গভীর আবেগে জাহানারা ইমামের দু চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে৷ তিনি আবারও সাফিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরেন৷

জুয়েলের মা ফিরোজা বেগম আসেন আজাদদের বাসায়৷ টগরের চাচি হিসেবে তিনি সাফিয়া বেগমের পূর্ব পরিচিত৷ এখন পরিস্থিতি তাদের আরেক অভিন্ন তলে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে৷ তাদের দুজনের ছেলেই ধরা পড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে৷

দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন নীরবে৷ কী করা যায়, এই বিষয়ে তারা মৃদুকন্ঠে শলাপরামর্শ করেন৷

তারা একদিন দুজনে মিলে যান সৈয়দ আশরাফুল হকদের বাসায়৷ আশারফুলের মাকে বলেন, বাবু (আশরাফুলের ডাকনাম) যেন বাসায় না থাকে৷ পারলে যেন ইন্ডিয়া চলে যায়…

আশরাফুল অবশ্য তার আগেই তার বাসা থেকে চলে গেছে অন্য গোপন আশ্রয়ে৷

৪৮

হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে আছে টগর আর জায়েদ৷

লক্ষ লক্ষ পাখি স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে কানের কাছে কলকলিয়ে উঠতে শুরু করে৷ টগর বুঝতে পারে, তার জ্ঞান ফিরে আসছে৷

খানিকটা ধাতস্থ হলে তার মনে পড়ে, পাশের বিছানায় জায়েদেরও শুয়ে থাকবার কথা৷ সে ঘাড় ঘোরায়৷ ওই তো জায়েদ৷

সে বলে, ‘জায়েদ, পা তো নাড়াইতে পারি না৷ তুই পারিস ?’

টগরের বাবা আলাউদ্দিন চৌধুরী আসেন কার্গো-ভরা সুপারি নিয়ে, পটুয়াখালী থেকে সদরঘাটে৷ ঢাকায় পা রেখেই শুনতে পান দুঃসংবাদটা৷ ছেলে তার গুলিবিদ্ধ৷ তিনি দৌড়ে যান হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে৷

ধীরে ধীরে জায়েদ আর টগর অনেকটা সেরে ওঠে৷ তাদের এই হাসপাতাল থেকে যত তাড়াতাড়ি সরিয়ে নেওয়া যায় ততই মঙ্গল৷ ডিসচার্জ করার কাগজপত্র সব তৈরি করাচ্ছেন টগরের বাবা আলাউদ্দিন চৌধুরী৷ হলি ফ্যামিলির ডাক্তাররা আর ফাদাররা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন এবং করছেন৷ তারা বিল কয়েক হাজার টাকা কমিয়ে দিয়েছেন৷

এই সময় টগর হাসপাতালের বিছানায় উঠে বসে৷ নিজের পেটের কাছে ক্ষতস্থানে হাত বুলোতে বুলোতে হঠাৎই দেখে, শক্তমতোন কী যেন দেখা যায়৷ ব্যাপার কী ?

সে বলে, ‘বাবা বাবা, আমার পেটে এটা কী দেখেন তো ? শক্ত৷’

বাবা আসেন৷ দেখেন৷ বুঝতে পারেন না ছেলের পেটে জিনিসটা কী আসলে৷ তিনি ডাক্তার ধরে আনেন একজন৷ ডাক্তার সাহেব টগরের পেটে হাত দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন, ‘ওটা কিছু না৷ বুলেট৷’

‘বুলেট ? বলেন কী ?’ টগরের বাবা আঁতকে ওঠেন৷

ডাক্তার ভাবলেশহীন মুখে বলেন, ‘ওতে কোনো ক্ষতি হবে না৷ থাকুক৷’

‘পরে যদি অসুবিধা হয় ?’ আলাউদ্দিন চৌধুরীর কন্ঠে উদ্বেগ৷

‘পরেও হওয়ার কথা নয়৷ হলে আমরা তো আছিই৷’

‘না না৷ পরে আর আসা যাবে না৷ আপনারা এখনই এটা বের করার ব্যবস্থা নিন৷’

ডাক্তার হেসে বলেন, ‘কী টগর৷ তুমি কী বলো ? বুলেটটা পেটে রাখবে, না বের করবে ?’

টগরও ঘাড় শক্ত করে বলে, ‘বার করব৷’

‘আচ্ছা তাহলে তুমি বসো৷ আমি ব্যবস্থা করছি৷’ ডাক্তার সাহেব বাইরে যান৷

কী বলেন ডাক্তার সাহেব৷ এখনই করবে নাকি ? টগর বিস্মিত৷

ডাক্তার এসে বলেন, ‘এখানে তো এঙ্-রে মেশিন নষ্ট৷ আপনি বাইরে থেকে এঙ্-রে করিয়ে আনেন৷’

টগরের বাবা টগরকে নিয়ে গিয়ে এঙ্-রে করিয়ে আনান৷ ডাক্তার সাহেব রিপোর্ট দেখে বলেন, ‘আরেকটা অপারেশন করতে হবে৷ তবে এটা ছোট অপারেশন৷ পেটের বাইরের দিকে আছে বুলেটটা৷

লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে ডাক্তাররা টগরের পেটে অস্ত্রোপচার করেন৷ টগর সব বুঝতে পারে৷ বুলেটটা বের করে ডাক্তার সাহেব টগরের হাতে দিয়ে বলেন, ‘ধরে থাকো৷’

টগর ওটা ধরেই থাকে৷ সেই বিকালেই টগরকে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে টগরের বাবা নিয়ে যান আজাদদের মগবাজারের বাসায়৷ টগরের হাতে তখনও ধরা আছে বুলেটটা৷ আজাদদের বাসার কাছেই শিল্পী আবদুল জব্বারের বাসা৷ তার সামনে একটা সজনে গাছ৷ সেই গাছের কাছে এসে কী মনে করে টগর বুলেটটা ফেলে দেয় গাছের গোড়াটা লক্ষ্য করে৷

এর পরে টগরকে তার বাবা নিয়ে যায় বরিশালে৷

ইতিমধ্যে জায়েদকেও হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে এনেছেন সাফিয়া বেগম৷

৪৯

জাহানারা ইমাম রুমীর একটা ফটো দোকানে দিয়েছিলেন এনলার্জ করতে৷ ৮ বাই ১০ ইঞ্চি ছবিটা তিনি আজকেই নিয়ে এসেছেন দোকান থেকে৷ সঙ্গে এনেছেন ফটোস্ট্যান্ড৷ ফটোটা স্ট্যান্ডে লাগিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন সেটার দিকে৷ কত দিন এই মুখ তিনি দেখেন না!

দিন কেটে যাচ্ছে৷ একটা একটা করে দিন কেটে যায়৷ আজ ৫০ দিন হলো রুমীকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে৷ ‘রুমী, আজ ৫০টা দিন হলো তোমাকে আমি দেখি না, ভাবা যায়!’ জাহানারা ইমাম দীর্ঘশ্বাস ফেলেন৷ তাদের পরিবারে সবারই মনের অবস্থা খারাপ৷ দুঃখ, হতাশা, নিষ্ফল ক্রোধ, ভয়, ভীতি-সব মিলে তাদেরকে কি পাগল বানিয়ে ছাড়বে ? তাঁর স্বামী শরীফ ইমামের শরীর দ্রুত ওজন হারাচ্ছে৷ তিনিও শুকিয়ে যাচ্ছেন৷ তবে সবাই বলে, রুমীর মাকে নিয়ে ভয় নাই, কারণ তিনি কাঁদেন, হাহুতাশ করেন, মনের বাষ্প বের করে দেন৷ কিন্তু রুমীর বাবা শরীফ কথা বলেন কম, কাঁদেন না, হা-হুতাশ করেন না৷ দৈনন্দিন সব কাজ তিনি করে চলেছেন নিখুঁতভাবে, সকালে উঠে শেভ, গোসল, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা, অফিস, বিকালে টেনিস, সন্ধ্যায় আবার স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান শোনা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা-সবই তিনি এমনভাবে করছেন, যেন তাঁর মনে কোনো দুঃখ নাই, যেন তাঁর ছেলেকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়নি৷

কিন্তু জাহানারা ইমাম এতটা শান্ত ভাব বজায় রাখতে পারেন না৷ ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি বিড়বিড় করতে থাকেন : ‘এই কি ছিল বিধিলিপি, রুমী ? তুমি কি কেবল ছবি হয়েই থাকবে আমাদের জীবনে ?’

রুমীর ধরা পড়ার রাতেই, জাহানারা ইমাম যখন রুমীর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিলেন, হঠাৎ রেডিওতে গান বেজে উঠল, খুদিরামের সেই বিখ্যাত ফাঁসির গান, একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি, হাসি হাসি পরব ফাঁসি, দেখবে জগৎবাসী…

তবে কি রুমী চলেই গেল ? ফিরে আসবে মাসীর ঘরে, গলায় ফাঁসির দাগ দেখে তাকে চিনে নিতে হবে ?

তা কি হয় ? রুমী কি চলে যেতে পারে ? এই অল্প বয়সে ? কেবল আইএসসি পাস একটা ছেলে ? কেবল ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে যে ভর্তি হয়েছে!

রুমী আবৃত্তি করত খুব ভালো৷ জীবনানন্দ দাশের এই কবিতাটাও তার গলায় দারুণ ফুটে উঠত

আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়

হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল মানুষের বেশে

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন এ কাঁঠাল ছায়ায়…

জাহানারা ইমামের দু চোখ জলে ভিজে আসছে৷ তিনি বিড়বিড় করেন, রুমী, তোমাকে ফিরে আসতেই হবে, আসতেই হবে৷

চোখ মুছে ছবিটার নিচে এক টুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে তিনি লেখেন : আবার আসিব ফিরে-এই বাংলায়৷ ফটোটা তিনি রাখেন নিচতলায় বসবার ঘরে, কোনার টেবিলে৷ আগামীকাল ২০ নভেম্বর, ঈদ৷ অনেক মানুষ আসবে এই বাসায়৷ সবাই দেখুক, কোমরে হাত দিয়ে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ানো রুমী কীভাবে সদর্পে ঘোষণা করছে-আবার আসিব ফিরে-এই বাংলায়৷

৫০

সাফিয়া বেগম সারা রাত ঘুমান না৷ রোজ রাতের বেলা মেঝেতে শাড়ি বিছিয়ে শোন বটে, কিন্তু দু চোখে তাঁর ঘুম আসে না৷ তাঁর মনে হয়, যদি আজাদ ফিরে আসে, এসে যদি দেখে দরজা বন্ধ, চারদিকে শত্রু, কারফিউ-কন্টকিত একেকটা রাত, এর মধ্যে ও তো চিৎকার করে মা মা বলে ডাকতে পারবে না, আহা রে, ছেলেটা সারা রাত কি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে! তিনি চোখের পাতা এক করতে পারেন না৷ কোথায় নিতে পারে ওরা তার ছেলেকে ? কোনো জেলখানায় ? ঢাকা জেলখানায় তিনি গিয়েছিলেন নিজে, জেলারের সঙ্গে দেখা করেছেন, ওখানে আজাদ নাই৷ অবশ্য অন্য কোনো জেলখানায় থাকতে পারে৷ এমনও হতে পারে, ওরা ওকে নিয়ে যেতে পারে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো জেলখানায়৷ বিচার না করে তো আর ফাঁসি দেবে না ? নাকি দেবে ?

জুরাইনের বড় হুজুর বলেছেন, আজাদ জিন্দা আছে৷ সহি-সালামতে আছে৷ তিনি দিব্যচোখে না দেখতে পেলে কেন বলবেন ? তাঁর মিথ্যা কথা বলার কী আছে ? জুয়েলের মাও আসে এই বাসায়৷ রুমীর মা আসে৷ সেকেন্দারের মা আসে৷ সেকেন্দারের বাবা তো জয়েন সেক্রেটারি৷ সবাই তো চেষ্টা কম করছেন না৷ এত তদবির উপেক্ষা করে কি ছেলেগুলোর অনিষ্ট করা সম্ভব ?

আর তাঁর বুকটা কেঁপে ওঠে অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে৷ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি শুনতে পান ছক্কু মিয়ার বিচ্চুগুলার নানা কাণ্ডকীর্তির কথা৷ মুক্তিযোদ্ধারা চারদিক থেকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে পাকিস্তানি সৈন্যদের৷ ওদের দিন আসছে ফুরিয়ে৷ দেশ স্বাধীন হবেই৷ জুরাইনের বড় হুজুরও তা-ই বলেন৷ ওরা নাকি মসজিদে পর্যন্ত গুলি করেছে৷ মেয়েদের ওপর অত্যাচার করছে৷ এই অত্যাচার আল্লাহ কেন সহ্য করবেন৷

মহুয়া কচি এরা কিছু বোঝে না৷ তারা তাঁকে বলে ভাত খেতে৷ আবার কচি বলে, ‘আম্মা, তুমি কি আর কোনো দিনও ভাত খাইবা না ?’ আরে খাব না কেন ? নিশ্চয় খাব৷ আজাদ ফিরে আসবে৷ ও খুবই ভাতের পাগল৷ এসেই তো ভাত খেতে চাইবে৷ এখন কি কাওরানবাজারে পাবদা মাছ পাওয়া যাবে ? জায়েদ অসুস্থ হওয়ায় হয়েছে অসুবিধা৷ ওকে আর আগের মতো কথায় কথায় বাজারে পাঠানো যাচ্ছে না৷ আজাদ ফিরে এলে পাঠাতে হবে৷ পাবদা মাছের পাতলা ঝোল করতে হবে৷ বাজারে টমেটো উঠেছে৷ টমেটো ধনেপাতা দিয়ে সুন্দর করে রাঁধতে হবে৷ আজাদ ভাত খাবে৷ আ দেখব৷ তারপর আজাদ নিজেই আমার মুখে এক গ্রাস ভাত তুলে দেবে৷ ও যা পাগল৷ ও সব পারে৷

দেশ যখন স্বাধীন হবে, তখন কি আর ওরা ওকে আটকে রাখতে পারবে ? পারবে না৷ আল্লাহ মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে তুমি থেকো আল্লাহ৷ এরা ন্যায়ের পক্ষ৷ এদের ট্রেনিং কম, অস্ত্র কম, সব ছাত্রমানুষ, কিষান-মজুর-এরা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা! এদের পাশে থাকতে হবে, হে আল্লাহ, তোমাকে৷ তাই তো তুমি আছ৷ তাই তো শুধু খবর আসছে এখানে ওখানে প্রচণ্ড যুদ্ধের আর মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের৷

আজাদের মায়ের চোখ দুটো একটু ধরে আসে৷ দূরে কোথায় যেন গোলাগুলির শব্দ হয়৷ তাঁর ঘুম আবার যায় ভেঙে৷

৫১

আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, তবু দিন গড়িয়ে যায়, সূর্য ওঠে, সূর্য অস্ত যায়, মেলাঘরের মুক্তিযোদ্ধারা নতুন করে পরিকল্পনা আঁটতে থাকে, নতুন নতুন গেরিলারা প্রশিক্ষণ শিবির থেকে বেরিয়ে ঢুকে যেতে থাকে বাংলায়, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গেরিলাদের আক্রমণে সারাটা টাঙ্গাইলে ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বাহিনী মার খেতে থাকে, হেমায়েতের নেতৃত্বে দক্ষিণ বাংলায় চলে দুর্ধর্ষ গেরিলা অভিযান, মাহবুব আলমেরা ঢুকে পড়ে তেঁতুলিয়া দিয়ে, সারা বাংলাদেশের প্রতিটা সীমান্তে সেক্টর কম্যান্ডারদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী, সেনাসদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, আর লক্ষাধিক মুক্তিবাহিনী জলে-ডাঙায় শানাতে থাকে আক্রমণ, বাংলার নদ-নদী বৃষ্টি বর্ষা ধানক্ষেত কাদামাটি ফাঁদ পেতে রাখে হানাদারদের জন্যে, বাংলার ফুল-ফল পাখি-পতঙ্গ আশ্রয় দেয় মুক্তিদের, বাংলার প্রতিটা ঘর দুর্গ হয়ে ওঠে, বাংলার প্রতিটা মানুষ হয়ে ওঠে মুক্তিযোদ্ধা, আর যুদ্ধাহত হন খালেদ মোশাররফ, তবুও সেক্টর টু-র গেরিলা ওয়ারফেয়ার আরো গতি পেতে থাকে, আরবান গেরিলারা ঘিরে ফেলে ঢাকার চারপাশ, ওই তো গান গাইতে গাইতে এগিয়ে আসছেন শিল্পী আজম খান, ওই তো রক্তে আগুনে ক্যানভাস রাঙাবেন বলে ক্রলিং করে অ্যাম্বুশ পাতছেন চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন, কবির কলম ফেলে রাইফেলের ট্রিগারের সঙ্গে মিতালী গড়েছেন হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদ, আবু কায়সার, মাহবুব সাদিক৷

সারা বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে৷ শাহাদত চৌধুরীর মাকে তাঁর এক গণিতজ্ঞ ভাই কিছুদিন আগে বলেছিলেন, ‘আমাকে অঙ্কের হিসাবে বলো, এক পরিবারের কয়জন গেছে মুক্তিযুদ্ধে, ঢাকার রাস্তায় কয়টা পটকা ফোটালেই একটা প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীকে হারানো যায় না, ধরো তোমার ছয় ছেলে, কয়জন যুদ্ধে গেছে, আমার চার ছেলে, তারা তো বাসাতেই বসে আছে, আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার মায়ের মুখ থেকে শুনতে চাই, আমার ছেলে যুদ্ধে গেছে৷’ তাঁকে মা তখন কিছু বলেননি; ৩০শে আগস্ট ৭১ তাঁর বাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যরা হানা দিয়ে তাঁর জামাতা বেলায়েতকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি আশ্রয় নেন তাঁর এই গণিতজ্ঞ ভাইয়ের বাড়িতেই৷ এবার তিনি ভাইয়ের পুরনো প্রশ্নের জবাব বুঝিয়ে দেন, ‘আপনি মুক্তিযোদ্ধার মাকে দেখতে চেয়েছিলেন, আমাকে দেখেন, আমার ছয় ছেলের তিনজনই গেছে মুক্তিযুদ্ধে, আমি অঙ্কের হিসাবে দেখি দু কোটি যুবকের এক কোটিই যোদ্ধা, বলেন, দেশ স্বাধীন হবে কি না ?’

আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, ঢাকায় এক রাতে ধরা পড়ে অনেক গেরিলা, অনেক অস্ত্রশস্ত্র, কিন্তু আবারও ঢাকায় ঢুকে পড়ে গেরিলারা, রাইসুল ইসলাম আসাদের নেতৃত্বে ওই তো এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা বায়তুল মোকাররমে, সেনাবাহিনীর দুটো লরির মধ্যে হাইজ্যাক করা গাড়িতে বোমা পেতে রেখে একই সঙ্গে উড়িয়ে দিচ্ছে দুটো লরিই, বোমা বিস্ফোরিত হয় টিভি ভবনের ছয় তলায়, ঢাকার উত্তরে মানিক বাহিনীর তৎপরতা, আর দক্ষিণে ক্রাক প্লাটুন, ভায়াডুবি ব্রিজ ওড়াতে গিয়ে শত্রু বাহিনীর গুলি ভেদ করে মানিকের শরীর, পানি থেকে তার রক্তাক্ত গরম শরীরটাকে তোলে সহযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, মৃত্যুর আগে ঠোঁট নেড়ে কী যেন বলতে চায় মানিক, কিন্তু কথা শেষ হওয়ার আগেই ঠোঁটের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, বাচ্চুর বিশ্বাস হয় না মানিক নাই, কিন্তু মানিক ততক্ষণে শহীদ, মানিক নাই, মানিকেরা থাকে না, কিন্তু যুদ্ধ এগোতে থাকে, তখন সেকেন্ড ইন কম্যান্ড বাচ্চু গ্রহণ করে নেতৃত্ব; পানির নিচে নেমে যাচ্ছে নৌ কম্যান্ডোরা, একই সময়ে চট্টগ্রাম, খুলনা, চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, ঢাকায় ডুবিয়ে দেওয়া হবে জাহাজ, তিনশ নৌ কম্যান্ডো অপেক্ষা করছে কখন আকাশবাণীতে বাজবে আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম আমার যত গান, নেমে গেল যোদ্ধারা জলে, আবার অপেক্ষা পরের গানের জন্যে, আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি, জিরো আওয়ার, আঘাত করো, একসঙ্গে হঠাৎই ডুবে গেল ১০টা জাহাজ : অপারেশন জ্যাকপট, সেপ্টেম্বরে আবার পরিচালিত হয় অপারেশন জ্যাকপট-২, ধীরে ধীরে ঘেরাও হতে থাকে ঢাকা, চারদিকে ১৬ হাজার গেরিলা… সাভারের উপকন্ঠে অ্যাম্বুশ করে আছেন বাচ্চুরা, ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ, ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ফিরে আসছে আহত ব্যাঘ্রের ক্ষোভ আর ক্রোধ নিয়ে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ থেকে, তাদের আক্রমণ করতে, বাচ্চুদের সঙ্গে আজ আছে একটা কিশোর ছেলে টিটো, ও ঠিক যোদ্ধা নয়, অপারেশনে অতটুকুন ছেলের আসার কথা নয়, সে ক্যাম্পে থাকে, নানা কাজকর্মে সাহায্য করে, এ-ই তো যথেষ্ট এক কিশোরের জন্যে, ও কেন এসেছে, শুরু হয় ঘোরতর যুদ্ধ, মাথার ওপর দিয়ে শিস দিয়ে যাচ্ছে শত্রুর ছোড়া গোলাগুলি, একটা খবর জানানো দরকার মুক্তিযোদ্ধাদের একটা রিজার্ভড অংশকে, টিটোকে সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়, কিন্তু ও তো ছোট, ও তো যুদ্ধের নিয়মকানুন জানে না, হায় আল্লাহ, ওকে বাঁচিয়ে রাখো, ওই তো বাচ্চুর চোখের সামনে হাত তিরিশেক দূরে লুটিয়ে পড়ল টিটোর শরীর, ততক্ষণে টিটো অবশ্য তার ওপরে অর্পিত কাজটা সম্পন্ন করেছে, সঙ্গীদের জানিয়ে দিয়েছে তখনকার কর্তব্যনির্দেশ, শত্রুরা পিছিয়ে যায়, ছন্নছাড়া হয়, টিটোর রক্তাক্ত ছোট্ট শরীরটা আনা হয় ক্যাম্পে, টিটো বাঁচতে চায়, সে দেখতে চায় স্বাধীনতা, ‘আমাকে বাঁচান, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই’, কিন্তু টিটো মরে যায়, সাভারের মাটিতে তাকে সমাহিত করে রাখে সহযোদ্ধারা, তারপর এগোতে থাকে ঢাকার দিকে, এগিয়ে আসে মিত্রবাহিনী-মুক্তিবাহিনী…

সম্মুখসমরে ২৭ জন পাকিস্তানি সৈন্য খতম করে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আর ফতেহ চৌধুরীরা খানিক পিছিয়ে আসে বালু নদী থেকে৷ মধ্য ডিসেম্বরের এই সময়টায় বেশ কুয়াশা পড়ছে৷ ভোরের আলো ফোটবার সঙ্গে সঙ্গে তারা দেখতে পায় মেজর হায়দারকে৷ তাঁর পরনে পুরো কম্যান্ডো পোশাক৷ মেজর হায়দার বলেন: ‘এবার ফাইনাল আঘাত৷ ঢাকা দখল৷ সবাই প্রস্তুত৷’

আজাদের মাকে শুভার্থীরা পরামর্শ দেন মগবাজারের বাসা ছেড়ে দিতে, কেননা ওখানে থাকা নিরাপদ নয়, তিনি বাসাটা ভাড়া নেওয়া ছাড়েন না, নিয়মিত ভাড়া দেন, যদি আজাদ ছাড়া পায়, যদি এসে দেখে বাসায় কেউ নাই, কিন্তু তাঁরা চলে যান মালিবাগে, যাওয়ার আগে পড়শিদের ভালো করে বুঝিয়ে বলে যান, আজাদ এলে যেন তাকে তারা বলে যে মালিবাগের আগের বাসায় গেলেই হবে, ‘৭২ সাল পর্যন্ত মগবাজারের বাসার ভাড়া গুনেছেন তিনি, অবশেষে ছেড়ে দেন, এদিকে চৌধুরী সাহেবের পক্ষ থেকে কামরুজ্জামান আসতে থাকে আজাদের মায়ের কাছে, এখনও চলেন চৌধুরীর কাছে, আজাদের বাবাও তাঁর প্রথম ছেলেকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন, তিনি নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও ছেলের খোঁজ বের করতে পারেন না, আজাদের বাবার পানাসক্তি বেড়ে যায়, একেকটা রাতে তিনি ‘আজাদ আজাদ’ বলে নিজের চুল ছেঁড়েন, আজাদের ছোটমাকে অভিযুক্ত করেন নানা অভিযোগে, লোক পাঠিয়ে দেন সাফিয়া বেগমের কাছে, নানাভাবে মিনতি করেন যেন সাফিয়া বেগম তাঁর বাড়িতে ফিরে যান, কিন্তু আজাদের মা অনড়, প্রশ্নই আসে না চৌধুরীর কাছে ফিরে যাওয়ার, এ তাঁর নিজের যুদ্ধ, এ যুদ্ধে তিনি হেরে যেতে পারেন না৷

আজাদের মা ভাত খান না, বিছানায় শোন না, অপেক্ষায় থাকেন ছেলে আসবে বলে, আর খোঁজ বের করার চেষ্টা করেন ছেলের, রমনা থানায় যান, তেজগাঁও থানায় যান, এমপি হোস্টেলে যান, ছেলের খবর পাওয়া যায় না, অথচ বড় হুজুর আশ্বাস দিয়েছেন আজাদ বেঁচে আছে, সে ফিরে আসবেই৷

এই আশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকেন, দিন গুজরান করেন মহিলা৷

রুমীর কোনো খবর নাই, প্রতিদিন মগবাজারের পাগলাবাবার দরবারে যান জাহানারা ইমাম৷ সেখানে গিয়ে দেখতে পান আলতাফ মাহমুদের আত্মীয়স্বজনদের, ঝিনু মাহমুদ, মোশফেকা মাহমুদ, দেখতে পান চট্টগ্রাম দুর্নীতি দমন বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর নাজমুল হকের স্ত্রীকে, বরিশালের এডিসি আজিজুল ইসলামের স্ত্রীকে, কুমিল্লার ডিসি শামসুল হক খানের স্ত্রীকে, রাজশাহীর রেডিও ইঞ্জিনিয়ার মহসীন আলীর স্ত্রীকে, চট্টগ্রামের চিফ প্লানিং রেলওয়ে অফিসার শফি আহমেদের স্ত্রীকে, কুমিল্লার লে. ক. জাহাঙ্গীরের স্ত্রীকে, কুমিল্লার মেজর আনোয়ারুল ইসলামের স্ত্রীকে এবং এ রকম বহু৷ এদের সবারই স্বামী নিখোঁজ৷ তাঁরা পরস্পরের দুঃখের কাহিনী শোনেন৷ এদের মধ্যে থেকে জাহানারা ইমাম তাঁর নিজের ছেলেকে হারানোর শোক অনেকটা ভুলে থাকতে পারেন৷ পিএসপি আওয়াল সাহেবের স্ত্রী আসেন ছোট ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে, জাহানারা জানেন তাঁর তিন ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে, কিন্তু ভুলেও সে কথা তারা আলোচনা করেন না, উলফতের বাবা আজিজুস সামাদ ছাড়া পাওয়ার পরে তাঁর স্ত্রী তাঁকে আনেন পাগলাবাবার কাছে, কিন্তু ভুলেও জাহানারা তাঁকে শুধান না উলফত বা আশফাকুস সামাদের কথা৷

এরই মধ্যে একদিন খবর আসে, ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাতে, ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগের রাতে, ঢাকায় শখানেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে৷ জাহানারা ইমাম ছুটে যান আজাদের মায়ের কাছে, আজাদের মা আজাদের কোনো খবর আর পাননি৷ জাহানারা ইমামের মনে এই আশঙ্কা জাগে যে, কেউ নাই, রুমী নাই, বদি নাই, বাকের নাই, জুয়েল নাই, আজাদ নাই, বাশার নাই, আলতাফ মাহমুদ নাই…

রুমীর মা অপেক্ষায় থাকেন যে রুমী ফিরে আসবে, আজাদের মা ভাত বেড়ে নিয়ে বসে থাকেন যে তাঁর ছেলে এসেই ভাত খেতে চাইবে, রুমী আসে না, আজাদ আসে না, জুয়েলের মা দিন গোনেন কবে ফিরে আসবে তার ছেলে, জুয়েল ফেরে না, বদির মা জানে না ছেলে তার কোন জেলখানায়, তার দিন যেন কাটতে চায় না, বাশারের মা ছেলেকে স্বপ্নে দেখে কেঁদে ওঠেন ঘুমের ভেতরে, জয়েন সেক্রেটারি এ আর খানের ছেলে সেকেন্দার হায়াত খান ফেরে না আর বাড়ি, তার মাও অপেক্ষা করেন, স্বামীকে মিনতি করেন আরেকটু সচেষ্ট হতে, ছেলেকে উদ্ধার করতে, তিনি এসে দেখা করেন আজাদের মায়ের সঙ্গে, মনোয়ার হোসেনের স্ত্রী দুলু রাতের বেলা বিনবিনিয়ে কাঁদে, লীনার বয়স বাড়ে একটু একটু করে মুক্তিযুদ্ধের বয়সের মতোই, আর স্বাধীনতা নিকটবর্তী হতে থাকে, ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে, মুক্তিবাহিনী আর মিত্র বাহিনী দ্রুত এগিয়ে আসতে থাকে ঢাকার দিকে, গভর্নর হাউসে মিটিং চলাকালে আকাশ থেকে এসে পড়ে ভারতীয় বিমানের বোমা৷

৫২

আজাদের মায়ের অনুরোধে পুলিশ সুবেদার খলিল একবার যান নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারে৷ তখন ঢাকার আকাশ দিয়ে চক্কর দিচ্ছে ভারতীয় বিমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তখন ঘন্টার হিসাবে গণনা করার বিষয় মাত্র৷ জেলখানার এক বাঙালি কর্তার সঙ্গে দেখা করেন তিনি৷

বলেন, ‘আমার এক আত্মীয় অ্যারেস্ট হইছিল৷ খোঁজ পাওয়া যাইতেছে না৷ দেখেন তো আছে নাকি ?’

‘নাম বলেন৷ পিতার নামসহ…’

‘মাগফার উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী আজাদ, পিতা ইউনুস আহমেদ চৌধুরী ?’

অফিসারটি বন্দিদের নামের তালিকা উল্টেপাল্টে দেখেন৷ ‘না, নাই তো ?’

‘আবুল বাশার চৌধুরী ?’ খলিল সাহেব আজাদের মায়ের নিজের হাতে লেখা তালিকাটা পকেট থেকে বের করে পড়েন৷

‘না নাই৷’

‘বদিউল আলম ?’

‘নাই৷’

‘আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ?’

‘নাই৷’

‘চুল্লু ?

‘আছেন’-কর্তাটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷

‘সামাদ ?’

‘আছেন’-কর্তাটির মুখ হাসি হাসি৷ ‘মুক্তিযোদ্ধা আরো আছেন৷ বরিশালের কাজী ইকবাল…’

খলিল সাহেব শঙ্কিত বোধ করেন৷ তিনি তো বলেননি যে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে এসেছেন…

কর্তাটি তাঁর মুখের ভাষা পড়তে পারেন৷ বলেন, ‘আর বেশি দেরি নাই৷ দেশ স্বাধীন হতে চলেছে…’

খলিল সাহেব বলেন, ‘আর সবাই কোথায় ?’

‘অন্য জেলে থাকতে পারে৷’

‘তা পারে৷’ খলিল সাহেব মাথা নাড়েন৷

এই একটা সান্ত্বনা হয়তো তিনি সাফিয়া বেগমকে দিতে পারবেন৷ ঢাকা জেলে আজাদ নাই৷ অন্য কোনো জেলে থাকতে পারে৷ তিনি ধীরে ধীরে কারাগার চত্বর ত্যাগ করেন৷

মালিবাগে যান আজাদের মায়ের কাছে৷

সাফিয়া বেগম দরজা খুলে তাঁর দিকে তাকান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে৷ তিনি বোঝার চেষ্টা করেন, কী নিয়ে এসেছে খলিল৷ সুসংবাদ, নাকি দুঃসংবাদ৷

‘কী খবর খলিল, কোনো খোঁজ পেলে ?’ তিনি কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করেন৷

‘না৷ এই জেলখানায় নাই৷’

‘তাহলে অন্য কোনো জেলখানায় রেখেছে!’ সাফিয়া বেগম অকম্পিত স্বরে বলেন৷

খলিল জোরে বলে ওঠেন, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ বুবু৷ অরা তা-ই কইল৷ বরিশালের মুক্তিযোদ্ধারে আইনা রাখছে ঢাকায়, ঢাকার ছেলেদের ঢাকার বাইরে পাঠায়া দিছে৷’

‘তুমি বসো৷ তোমাকে চা দেই৷’ সাফিয়া বেগম রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে খলিল একটা বড় শ্বাস ফেলে যেন মুক্তির আস্বাদ পান৷

এই মুহূর্তটা বড় কঠিন হবে বলে তিনি ভেবেছিলেন৷ কী করে তিনি আজাদের মাকে বলবেন যে আজাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, এই নিয়ে তিনি সারাটা পথ ভেবে ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছিলেন৷

কী রকম শক্ত একজন মহিলা হতে পারেন, খলিল ভাবেন৷

৫৩

আবাবিল পাখির ছোড়া ঢিলের মতো আকাশ থেকে নেমে আসছে পত্রাঘাত, পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আত্মসমর্পণের আহ্বান সংবলিত লিফলেট, যত তাড়াতাড়ি পারো সারেন্ডার করো, তোমাদের জেনেভা কনভেনশন অনুসারে মর্যাদা আর নিরাপত্তা দেওয়া হবে, রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হতে থাকে আত্মসমর্পণের আহ্বান, মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ঢাকায় ঢুকে পড়ে গেরিলারা, ট্রাকে ট্রাকে মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনী, জনতা তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে, কারফিউ ভেঙে রাস্তা দখল করে নিচ্ছে উল্লসিত জনতা, মেজর হায়দার ওই তো লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছেন রেসকোর্স ময়দানের দিকে, যাচ্ছেন কাদের সিদ্দিকী, ৯০ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে জেনারেল অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করছে জেনারেল নিয়াজি, মাথা হেঁট, অস্ত্র ফেলে দিতে হচ্ছে মাটিতে…

৫৪

আজাদের মা থাকেন মালিবাগের একটা বেড়ার বাসায়৷ ১৬ ডিসেম্বরের সকাল থেকেই তিনি শুনতে পাচ্ছেন, দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে, পাকিস্তানি আর্মি সারেন্ডার করতে যাচ্ছে, তাঁর বুকের ভেতরটা আশায় আনন্দে কেমন যে করে, তিনি মহুয়াকে বলেন, ‘দেশ স্বাধীন হলে জেলখানা থেকে সব মুক্তিফৌজ তো ছাড়া পাবে, কী বলিস তোরা!’ সকাল গড়িয়ে বিকাল হয়, তিনি একবার ঘরে যান, আবার বেরিয়ে আসেন, ডিসেম্বরের বিকালের হলদেটে আলো এসে পড়ে দাওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা আজাদের মায়ের মুখে৷ ডালু এসে বলে, ‘আম্মা, মুক্তিবাহিনী আর মিত্রবাহিনী ঢুইকা পড়ছে, আর চিন্তা নাই, দেশ স্বাধীন’, মা বলেন, ‘তাহলে চল, যাই, মগবাজারের বাসায় যাই, আজাদ যদি ছাড়া পেয়ে চলে আসে!’

‘এখন যাইবা৷ চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজ, এর মাঝে ?’

‘হ্যাঁ৷’

‘কাইলকা যাই চলো৷’

‘না৷ আজকেই যাব৷’

ডালু জানে তার খালার জেদ, তার খালার তেজ, সে আর ‘না’ করে না৷ সাফিয়া বেগম একটা থলেতে করে মগবাজারে বাসায় যাওয়ার জন্যে জিনিসপত্র গোছগাছ করেন৷ রিকশা জোগাড় করে সাফিয়া বেগমকে নিয়ে ডালু রওনা হয় মগবাজারের বাসার দিকে৷ একটা দোকানের সামনে এসে সাফিয়া বেগম বলেন, ‘এই রিকশা, একটু দাঁড়ান না৷’

ডালু বলে, ‘কেন ?’

সাফিয়া বেগম তার হাতে ১০টা টাকা দিয়ে বলে, ‘দু সের ভালো চাল কেনো তো বাবা৷ আলু পেঁয়াজ মরিচ তেল সাথেই আছে৷’

ডালু কোনো কথা না বলে চাল কিনে আনে৷

ততক্ষণে সন্ধ্যা ঝুপ করে নেমে এসেছে এই ঢাকায়৷ শীতও পড়েছে প্রচণ্ড৷ চারদিকে জনতার কন্ঠে জয় বাংলা ধ্বনি৷ মাঝে মধ্যে গুলির শব্দে প্রকাশ পাচ্ছে জয়োল্লাস৷

মগবাজারের বাসায় আসতে আসতে অন্ধকার ঘন হয়ে নামে৷ বারান্দাটা অন্ধকার, অন্ধকারেই তালা খুলতে গিয়ে আজাদের মা বোঝেন তালার ওপরে ধুলার আস্তর পড়ে গেছে৷ তালা খুলে ভেতরে ঢুকে লাইটের সুইচ অন করলে বোঝা যায় বিদ্যুৎ নাই৷ ডালু দোকানে গিয়ে মোমবাতি কিনে আনে৷ দিয়াশলাইয়ের কাঠি দিয়ে মোমবাতি জ্বালানো হয়৷ ঘরদোরেও ধুলার প্রলেপ পড়ে গেছে৷ মা ঘরদোর সাফসুতরো করে ফেলেন দ্রুত৷ ছেলে ফিরে এসে দেখুক ঘর অপরিষ্কার, এটা হতে দেওয়া যায় না৷ মোমবাতি হাতে নিয়ে মা রান্নাঘরে যান৷ হাঁড়ি-পাতিল এখানে যে কটা ছিল সেসব মাকড়সার জালে ছেয়ে গেছে৷ তিনি একটা হাঁড়ি পেড়ে নিয়ে লেগে পড়েন চাল ধুতে৷

ডালু জিজ্ঞেস করে, ‘আম্মা, কী করো ?’

‘একটু ভাত রাঁধি৷’

ডালু আর কথা বাড়ায় না৷ খালা তার কার জন্যে ভাত রাঁধছে, এ সে ভালো করেই জানে৷ সে চোখের জল গোপন করে৷ বাইরে তখনও হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার ভেসে আসছে : জয় বাংলা৷

ভাতের চাল সেদ্ধ হচ্ছে৷ বলক উঠেছে৷ ভাতের মাড়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে রান্নাঘরের বাতাসে৷ মা অনেক যত্ন করে রাঁধছেন এই ভাতটুকু৷ ভাত হয়ে গেলে তিনি হাঁড়িটা মুছে আবার চুলার ওপরই রেখে দেন৷ কিছুক্ষণ গরম থাকবে৷ আজাদ কখন আসবে, বলা তো যায় না৷

চুলার আগুন এক সময় নিভে আসে৷ ডিসেম্বরের শীতের স্পর্শে ভাত ঠাণ্ডা হয়ে আসে হাঁড়িতেই৷ সারা রাত কেটে যায় আশায় আশায়৷ মোমবাতি ক্ষয় হতে হতে এক সময় শেষ হয়ে যায়, আলো যায় নিভে৷ মেঝেতে একটা পাটি আর পাটির ওপরে একটা চাদরে বিছিয়ে শুয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম৷ দু চোখের পাতা তাঁর কখনও এক হয় না৷ মাঝে মধ্যে উঠে বসেন৷ রাত ভোর হয়, ফজরের আজান ভেসে আসে মগবাজারের মসজিদ থেকে৷ আজাদ ফেরে না৷

সকালবেলা রোদ উঠলে সাফিয়ার বোনের ছেলেমেয়েরাও চলে আসে এই বাসায়৷ চঞ্চল বলে, ‘আম্মা, মগবাজারের মোড়ে পাড়ার পোলাপান আজাদ ভাইয়ের নামে ব্যানার টাঙাইছে৷’

‘কেন ? চল তো দেখে আসি৷’

‘চলো৷’

চঞ্চলের সঙ্গে মা হাঁটতে থাকেন৷

মগবাজারের চৌরাস্তায় এসে দেখেন, পাড়ার ছেলেরা ব্যানার তুলেছে, ‘শহীদ আজাদ, অমর হোক’৷ তিনি বলেন, ‘এইসব কী তুলেছ, এইসব নামাও, আজাদ তো বেঁচে আছে, ও তো ফিরবে!’

৫৫

১৭ই ডিসেম্বরেই দুপুরবেলা বোন শাহনাজ আর মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ আলী চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে হাবিবুল আলম একটা জিপ চালিয়ে যায় নাজিমুদ্দিন রোডের জেলখানায়৷ তারা জানতে পেরেছে, চুল্লু ভাই আর সামাদ ভাই আছেন এখানে৷ তাদের মনে আশা, হয়তো আছে জুয়েল, রুমী, বারেক, আজাদ৷ তারা তাদের জন্যে ফুল নিয়ে যায়৷ আলম জেলারকে বলে, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ছেড়ে দিতে হবে৷’ জেলার যথাযথ কতৃপক্ষের লিখিত হুকুম ছাড়া মুক্তি দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানান৷ তখন হাবিবুল আলম নিজে সেক্টর টু আর প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাসহ সব যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশপত্র লিখে স্বাক্ষর করে দেয়৷ জেলার তার ঊর্ধতন কর্তার সঙ্গে ফোনে কথা বলে মুক্তিযোদ্ধাসহ যুদ্ধবন্দিদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন৷

মুক্তিযোদ্ধারা বেরিয়ে আসে৷ কাজী ইকবাল, মাহবুবুল্লাহসহ অনেককেই দেখা যায় সেই দলে৷ তারা হাবিবুল আলম আর ফতেহর সঙ্গে মোলাকাত করে৷ শাহনাজ তাদের হাতে ফুল তুলে দেয়৷ মুক্তিপ্রাপ্ত অন্য মুক্তিযোদ্ধা আর যুদ্ধবন্দিরাও তাদের ঘিরে ধরে৷ তারা চিৎকার করে ওঠে : জয় বাংলা৷ তাদেরকেও ফুল দিয়ে বরণ করে শাহনাজ৷ তাদের অনেকেরই চোখে জল৷ তারা কেউ কেউ জেলখানা চত্বরে হাঁটু গেড়ে বসে মাথাটা ঠেকায় মাটিতে, মাটিকে চুমু দেয়, মুক্ত ভূমিকে, দু হাত মাটিতে বুলিয়ে নিয়ে সেই হাত বোলায় চোখে মুখে মাথায়…

শাহনাজ, হাবিবুল আলম আর ফতেহ তাদের জিপে ফিরে আসে৷ সঙ্গে নিয়ে আসে চুল্লু ভাই আর সামাদ ভাইকে৷ গত কয়েক মাসে শাহনাজসহ হাবিবুল আলমের বোনেরা তাদের দিলু রোডের বাসায় এত অস্ত্র নেড়েছে, পরিষ্কার করেছে যে, একেকজন পরিণত হয়েছে একেকটা অস্ত্র-বিশেষজ্ঞে৷ আবার মুক্তিযোদ্ধারা তাদের বাসায় আসত, বিশেষ করে আহত হওয়ার পরে কয়েক দিন জুয়েল ছিল তাদের বাসায়, সেই সূত্রে জুয়েল, বদি, রুমী, আজাদদের জন্যে তাদের এক ধরনের মায়া জমে গেছে৷ শাহনাজ আগে থেকেই জানত, ঢাকা কারাগারে চুল্লু ভাই আর সামাদ ভাই ছাড়া ঢাকার গেরিলাদের আর কেউ নাই৷ তবু তার একটা ক্ষীণ আশা ছিল, হয়তো জুয়েল ভাইকে পাওয়া যাবে, রুমী-বদি-আজাদদের দেখা মিলবে৷ কিন্তু যখন বাস্তবতা এসে তার সেই ক্ষীণ আশাটুকুকে উড়িয়ে নিয়ে গেল, শাহনাজ কিন্তু ভেতরে ভেতরে মন খারাপ করে৷ জিপে উঠে সে আলমের হাত থেকে স্টেনগান তুলে নিজের হাতে নেয়৷ তারপর যে হাতে এত দিন সে শুধু অস্ত্র পরিষ্কারই করেছে, আজ মুক্ত বাংলাদেশের আকাশ লক্ষ্য করে সেই হাত দিয়ে সে গুলি ছুড়তে থাকে৷ তাকে গুলি করতে দেখে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দিরা আবার চিৎকার করে ওঠে : জয় বাংলা৷ সবাই ধরেই নেয় শাহনাজের মতো মেয়ে গুলি ছুড়ছে আনন্দে৷ কিন্তু শাহনাজ জানে না, গুলি কেন সে ছুড়ছে ? বিজয়ের আনন্দে, ভাইকে ফিরে পাওয়ার প্রশান্তিতে, নাকি অন্য সব গেরিলাকে খুঁজে না পাওয়ার ক্ষোভে! গুলির আওয়াজে জেলখানার সানশেডে বাসা বানানো পায়রাগুলো উড়ে উঠে ছেয়ে ফেলে নাজিমুদ্দিন রোডের আকাশ-বাতাস৷

জিপ স্টার্ট নেয়৷ একটু একটু করে তারা ছেড়ে আসছে জেলখানা চত্বর৷ ১৭ই ডিসেম্বরের এই দুপুর রোদে এমনভাবে ঝলকাচ্ছে, যেন বিজয়ের জমক এসে লেগেছে আকাশে-বাতাসে৷ মুক্ত পায়রাগুলো যেন ছড়াচ্ছে শান্তির আশ্বাস৷ শাহনাজ স্টেনগানটা হাতে নিয়েই বারবার পেছনে তাকায়, কারাগারের দরজার দিকে তার চোখ যেন আরো কাউকে কাউকে খোঁজে৷

এক সময় কারাগারের দেয়াল তার দৃষ্টিসীমা থেকে অদৃষ্ট হয়ে যায়৷

৫৬

১৭ই ডিসেম্বর, কাল শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ, আত্মসমর্পণ করেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা, রুমীর মা জাহানারা ইমাম বিজয়ের আনন্দে হাসবেন, নাকি কাঁদবেন বুঝছেন না, সকালে সবাই মিলে বাসার ছাদে তুলেছেন স্বাধীন বাংলার পতাকা, কিন্তু দুদিন আগে মারা গেছেন তাঁর স্বামী শরীফ ইমাম সাহেব, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, আসলে আর্মির নির্যাতনের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায়৷ আর তা ছাড়া রক্তহিম করা সব খবর আসছে, মুনীর চৌধুরী নাই, শহীদুল্লা কায়সার নাই, ডা. রাবি্ব, ডা. আলীম চৌধুরী, তাঁদের কারা যেন দুদিন আগে চোখ বেঁধে জিপে করে তুলে নিয়ে গেছে, বিকাল নাগাদ খবর আসে, রায়েরবাজারের জলা ডোবাটা একটা বধ্যভূমি, পড়ে আছে সবার লাশ… আরো পরে জানা যাবে, কারা করেছে এই অপকীর্তি, পাকিস্তানি জেনারেল আর সৈন্যদের পুরো ৯ মাসই সহযোগিতা করেছে এ দেশের কিছুসংখ্যক মানুষ, জামায়াতে ইসলামী আর মুসলিম লিগের অনেকেই, গঠন করেছে রাজাকার, আল বদর, আল শামস, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের, তাদের শিবিরে তাদের লালসার কাছে জোর করে ঠেলে পাঠিয়েছে বাঙালি তরুণী কিশোরী নারীদের, আর যুদ্ধের শেষ দিকে এসে জামায়াতি ও তাদের ছাত্র উইংয়ের দ্বারা গঠিত আল বদররা তালিকা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের, বাছাই করে বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে চোখ বেঁধে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে তারা নিয়ে গেছে এ দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, লেখক, সাংবাদিকদের, তাঁরা সবাই পড়ে আছে লাশ হয়ে রায়েরবাজারে, মিরপুরে…

সন্ধ্যার পরে বিদ্যুৎ নাই বলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে আছেন জাহানারা ইমাম, তাঁর দু বাহুর ভেতরে জামী, বাইরে গাড়ির শব্দ, তারপর দরজায় করাঘাত, কাঁধে স্টেন ঝুলিয়ে কয়েকটা তরুণ দাঁড়িয়ে, তিনি বলেন, ‘এসো বাবারা এসো৷’

‘আমি মেজর হায়দার, এ শাহাদত, এ আলম, এ আনু, ফতেহ, জিয়া আর এই যে চুল্লু৷’

বড় গোঁফ, জুলফি নেমে এসেছে দাড়ির ধরনে, মিলে গেছে গোঁফের সঙ্গে, আলম বলে, ‘চুল্লু জেলে ছিল ৷ আমি নিজেই এদের রিলিজ অর্ডারে সাইন করে এদের ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম৷’

আলমের চাইনিজ স্টেনগানটা জাহানারা ইমাম নিজের হাতে তুলে নেন৷ তারপর তুলে দেন জামীর হাতে৷

৫৭

ইস্কাটন গার্ডেনে লেডিস ক্লাবে মেজর হায়দারের ক্যাম্প৷ সেখানে নিখোঁজ মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে আসতে থাকে তাদের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা৷ জুয়েলের ভাইয়েরা আসে মেজর হায়দারের ক্যাম্পে, আলতাফ মাহমুদের খোঁজে আসে লিনু বিল্লাহরা৷ ডালু আসে, জায়েদ আসে, জায়েদ কথা বলে কাজী কামালের সঙ্গে, কিন্তু আজাদদের সন্ধান মেলে না৷ জাহানারা ইমাম বিভিন্নভাবে তালাশ চালান তার ছেলের আর ছেলের সহযোদ্ধা বন্ধুদের কোনো খোঁজখবর বের করতে, কিন্তু তাদের উদ্ধার তো করা যায়ই না, কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না৷

৫৮

প্রতিবেশীদের অনেকেই, এবং তাদের সূত্র ধরে ঢাকা নগরবাসীর অনেকেই জেনে যায় যে, পুরানা পল্টনের এক বাড়িতে মিলি নামের একটা মেয়ে সারাক্ষণ শুধু নীরবে চোখের পানি ফেলছে৷ সে কিছুই বলে না৷ তার কোনো অভিযোগ নাই৷ সে শুধু পথের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর নীরবে অশ্রুবর্ষণ করে৷

তার দুঃখের কারণ কেউ সঠিকভাবে বলতে পারে না৷ তবে নাগরিকেরা অনুমান করে, যুদ্ধের পরে সব মুক্তিযোদ্ধাই তো একে একে ফিরে আসছে, ফিরে এসেছে, হয়তো এই মেয়েটি যাঁর জন্যে অপেক্ষা করছিল, সে ফেরেনি৷

কার জন্যে অপেক্ষা করছিল মেয়েটা ?

নগরবাসী সেটা আর অনুমান করতে পারে না৷ কারণ যারা মিলিকে চেনে, তারা আজাদকে চেনে না৷ আর যারা আজাদের কথা জানে, তারা মিলির কথা জানে না৷

আর মিলিই তো একমাত্র মেয়ে নয় এই নগরে, যে পথের দিকে তাকিয়ে থেকে অশ্রু বিসর্জন করছে ? আর আজাদই তো একমাত্র ছেলে নয় যে যুদ্ধের পরে দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে কিন্তু ফিরে আসছে না৷

নগরবাসী একদিন মিলির কথা ভুলেই যায়৷

১৪ বছর পর, আজাদের মায়ের মৃত্যু মুক্তিযোদ্ধাদের আবার একত্র আর আজাদের বিষয়েই স্মৃতিদষ্ট করে তোলার পরে, কারো কারো মনে হতে থাকে, তাই তো, এ রকম একটা মেয়ে তো ছিল, কী যেন নাম, যে শুধু কাঁদত৷

মিলি হয়তো নীরবে অশ্রুবর্ষণ করেছে, মুখে শব্দ করেনি, কিন্তু এমন মেয়েও তো কিছু থেকে থাকবে, যারা প্রকাশ্যে অশ্রুও বর্ষণ করেনি, দীর্ঘশ্বাসটুকুও চেষ্টা করেছে গোপন করতে, অশ্রুটুকু বিসর্জন দিয়েছে গোপনভাবে, নিভৃতে, কাউকে জানতে না দিয়ে…

বাশারের জন্যে কি কেউ কাঁদেনি, জুয়েলের জন্যে, রুমীর জন্যে, বদির জন্যে, কী সুন্দর থোকা থোকা গুচ্ছ গুচ্ছ নাম, নক্ষত্রপুঞ্জের মতো, অসংখ্য নাম, নিযুত শহীদের নাম, এদের প্রত্যেকের জন্যে, অনেকের জন্যে…নিশ্চয় কেঁদেছে, সম্মিলিত, একাকী, প্রকাশ্য, সংগোপন কত কান্না কত অশ্রু ভাপ হয়ে মিশে গেছে আকাশে বাতাসে, কে তার হিসাব রেখেছে ?

তরুণীদের কান্নার হিসাব কেউ রাখেনি, কিন্তু শহীদদের মায়েদের প্রকাশ্য কান্না, অশ্রুপাত, ব্যক্তিগত প্রতীক্ষা আর দীর্ঘশ্বাসের চিহ্নগুলোই বা কাল কোথায় ধরে রেখেছে ?

৫৯

আজাদের মা কিছুদিন থাকেন মগবাজারের বাসায়, এই সময় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে কাজী কামাল উদ্দিন, হাবিবুল আলম আসে, সাফিয়া বেগম তাদের যত্নআত্তি করেন, তাদের ভাত না খাইয়ে ছাড়তে চান না, ছেলেরাও কথা না বাড়িয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসে যায়, কাজী কামাল ভাত খায়, সাফিয়া বেগম তার পাতে ভাত তুলে দেন, কাজী কামাল ভাত চিবোয়, আজাদের মা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে চোয়ালের ওঠানামা দেখেন, হাবিবুল আলম তার বড় জুলফিওয়ালা গাল নেড়ে ভাত খেতে খেতে গল্প করে, সেন্ট্রাল জেল থেকে সে বের করেছে চুল্লু ভাইকে, সামাদ ভাইকে, আজাদের মা বলে, ‘আমার আজাদও বেঁচে আছে, কালকে বড় হুজুর স্বপ্ন দেখে আমাকে বলেছেন…’

জাহানারা ইমাম আসেন আজাদের মায়ের মালিবাগের ডেরায়৷ জাহানারা ইমাম খোঁজখবর নেন অন্য মায়েদের, জুয়েলের মা কোথায়, বদির মা কোথায়, বাকেরের মা কোথায়, এইসব৷ আজাদের মা সবাইকে বলেন, আজাদ অবশ্যই বেঁচে আছে৷ সে ফিরে আসবেই৷ এই বিশ্বাস তিনি পান জুরাইনের বড় হুজুরের কাছ থেকে, আর তখন নানা জনরব শোনা যেতে থাকে, একজন এসে বলে সে আজাদকে দেখেছে লন্ডনে, টিউব রেলে, তার পাশের আসনেই বসা; আজমির শরিফ থেকে একজন আত্মীয় ফিরে এসে বলেন, ওখানকার খাদেম বলেছে, আজাদ বেঁচে আছে, ফিরে আসবে… একজন পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী, পেশোয়ারে আজাদকে দেখা গেছে…

৬০

আজাদের মায়ের মৃত্যুর পরে, মালিবাগের শ্বশুরবাড়িতে বসে কচির মনে পড়ে, ‘৭২ সালে মাঝে মধ্যে আম্মাকে সে গান গেয়ে শোনাত৷ এই সময় আম্মার প্রিয় গান ছিল, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…

কচি গলা ছেড়ে গাইত৷ মা, ঘরে কুপি জ্বলছে, আলো নড়ছে, মায়ের মুখে আলো পড়ছে আর নড়ছে, চুপচাপ পাটিতে বসে গান শুনছেন :

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!

ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।

ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাতে তোর শঙ্কাহরণ,

দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরন৷

ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।

তোমার মুক্তকেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,

তোমার আঁচল ঝলে আকাশ তলে রৌদ্রবসনী!

ওগো মা তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।

যখন অনাদরে চাইনি মুখে ভেবেছিলাম দুঃখিনী মা

আছে ভাঙা ঘরে একলা পড়ে দুঃখের বুঝি নাইকো সীমা৷

কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি-

আকাশে আজ ছড়িয়ে গেল ওই চরণের দীপ্তিরাশি!

ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।

আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও ধরণী-

তোমার অভয় বাজে হৃদয়মাঝে হৃদয়হরণী!

ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।।

কচি গান গায় আর তার ভারি কান্না পায়৷ গানের কথাগুলো কি রবীন্দ্রনাথ আম্মাকে নিয়েই লিখে রেখেছিলেন ? এই মা কি আম্মা, নাকি দেশ ? আমার সোনার বাংলা, যাকে আমরা খুব ভালোবাসি, যাকেও আমরা মা বলে ডাকি ? বলি, মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি… কী জানি, কচির ছোট মাথায় হিসাব মেলে না৷ কিন্তু দ্যাখো, রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, আজি দুখের রাতে সুখের স্রোতে ভাসাও তরণী, এ তো তাদের আম্মারই রূপ৷ কোথা সে তোর দরিদ্র বেশ, কোথা সে তোর মলিন হাসি, এও তো তাদের আম্মাকেই কেবল বলা যায়৷

কুপির সলতে জ্বলে, কুপির শিখাটা এমন যে শিখার ছায়া পড়েছে মেঝেতে, আশ্চর্য না, আলোর নিজের ছায়া পড়ে! আর আম্মাকে দেখা যাচ্ছে কী! মনে হচ্ছে, পিতলের তৈরি এক মাতৃমূর্তি৷ সত্যি তিনি আজ দুখের রাতে সুখের স্রোতে ধরণী ভাসিয়ে দিচ্ছেন, আম্মা বলেন, ‘আজাদ বেঁচে আছে, দেখিস, ও আসবে, আর দ্যাখ, দেশটা তো স্বাধীন হয়েছে, জুলুম অত্যাচার তো বন্ধ হয়েছে, এখন তো আর সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয় না, আজাদ যেদিন আসবে, কত খুশি হবে সে…’

১৯৮৫ সালে, স্বামিগৃহে বসে, স্মৃতিতাড়িত কচি তার নিজের ছোট ছোট মেয়েদের ডেকে বলে, ‘আম্মা আর আমি আর কী করতাম জানিস ?’

তারা আধো আধো স্বরে বলে, ‘কী করতা ?’

‘আম্মা যখন আমার ওপরে রাগ করতেন, আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না, আমি তার দরজায় দাঁড়িয়ে গান গাইতে আরম্ভ করে দিতাম :

বড় আশা করে এসেছি গো, কাছে টেনে লও,

ফিরায়ো না জননী

দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো৷

আর আমি যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব৷

আর আমি যে কিছু চাহি নে, জননী বলে শুধু ডাকিব৷’

কচি গুনগুন করে গান গেয়ে চলে, মাকে গান গাইতে দেখে তার দুই মেয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কচি বলে, ‘আম্মা চুপ করে এই গান শুনত, গান শেষ হলে দেখতাম তার রাগ আর নাই৷’

কচির চোখ জলে টলমটল করে৷

তার ছোট ছোট মেয়েরা অবাক হয়ে দেখে তাদের মা কাঁদছে৷

৬১

আজাদের মা থাকেন মালিবাগের বাসায়, আর ভাড়া পরিশোধ করেন মগবাজারের বাসারও৷ এইভাবে যায় কিছুদিন৷ তারপর এক সময় মগবাজারের বাসার ভাড়া দেওয়ার সঙ্গতি চলে যায় তাঁর৷ মালিবাগের বাসাও তাঁরা ছেড়ে দেন, বাসা ছেড়ে দিয়ে ওঠেন বিক্রমপুরে আরেক বোনের ছেলের বাড়িতে, কিছুদিন চলে যায়, সেখান থেকে এসে ভাড়া নেন খিলগাঁওয়ের এক বাসা, যাকে ঠিক হয়তো বাসা বলা যাবে না, বলতে হবে বস্তিঘর, অন্তত যে রাজপ্রাসাদে তিনি একদা থাকতেন, তার তুলনায় এ তো বস্তিই, নর্দমার গন্ধ ঘরের মধ্যে, কাঁচা বাঁশের বেড়া, চারদিকে গরিব মানুষের কোলাহল-খিস্তিখেউড়, জায়েদ কাজ নেয় গাড়ির ওয়ার্কশপে, সারা দিন কাটে তার কালিঝুলি মেখে গাড়ির নিচে৷ এই সময় আজাদের মায়ের কাছে আসতেন খোঁজখবর করতেন তাঁর খালাতো বোনের ছেলে শুভ, খুদু, খোঁজ নিতেন তাঁর খালাতো দুলাভাই আবদুস সালাম৷

জাহানারা ইমাম এ বাসায় আসেন, আজাদের মায়ের অবস্থা দেখে তাঁর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে, এতটা খারাপ অবস্থা কারো হতে পারে এ তাঁর কল্পনারও অতীত, দারিদ্র্যের কশাঘাতের চিহ্ন ঘরজুড়ে, আজাদের মায়ের চেহারাও খুবই খারাপ হয়ে গেছে, শুকিয়ে তিনি অর্ধেক হয়ে গেছেন, অথচ এই মহিলা একদিন এই শহরে রাজরানী ছিলেন৷ তার মনে পড়ে, ইস্কাটনের প্রাসাদোপম বাড়িতে বা ফরাশগঞ্জের বাড়িতে সাফিয়া বেগমের সুখী পরিতৃপ্ত সেই বেশটা, গা ভরা গয়না, আঁচলে চাবি, মুখে হাসি… তিনি দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন৷

জাহানারা ইমাম তাঁর ব্যাগ থেকে একটা খাম বের করে দেন সাফিয়া বেগমের হাতে, বলেন, ‘আপা, কিছু মনে করবেন না, এটা রাখেন৷’

সাফিয়া বেগম শান্তস্বরে বলেন, ‘এটা কী ?’

‘কিছু টাকা আছে৷’

‘আপা, আপনি কিছু মনে করবেন না, এটা আমি নিতে পারব না৷’ এমন স্পষ্ট উচ্চারণে সাফিয়া কথা বলেন যে জাহানারা ইমাম খামটা ফেরত নিয়ে ব্যাগে রাখেন৷

আজাদের মায়ের দু-একজন আত্মীয়স্বজন এসে তাঁকে বলেন, ‘আপনার নামে না অনেক অনেক সম্পত্তি, ইস্কাটনের বাড়ি, ফরাশগঞ্জের বাড়ি, এসব বিক্রি করলেও তো টাকা আসে, বিক্রি করে দেন, দখল নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের৷’

আজাদের মা বলেন, ‘দ্যাখো বাপু, ওসব সম্পত্তি আমার নামে বটে, কিন্তু ওসব তো আসলে চৌধুরীর, আমার নামে থাকলেই ওগুলো আমার হয়ে যায় না৷ ও চৌধুরীরই৷ উনি যা করার করবেন, আমি ওসবে লোভ করি না৷ তোমরাও এ নিয়ে কোনো কিছু বলতে এসো না৷’

সৈয়দ আশরাফুল হক আসে এই বাসায়, ভুরু কুচকে চারদিকে তাকিয়ে বলে, ‘মা, তোমার এ কি অবস্থা, তুমি এইটা কোন জায়গায় উঠছ ?’

‘কোন জায়গায় উঠেছি ?’

‘এই যে, এইটা তো বস্তি৷ ঢোকা যায় না, এইখানে তুমি থাকো কেমন কইরা ?’

‘আমার তো অসুবিধা হয় না৷’

‘তোমার আত্মীয়স্বজন কই ?’

‘আত্মীয়স্বজন দিয়ে কী হবে ?’

‘তোমাকে কেউ সাহায্য করব না ? তুমি যে এদের জন্যে এত কিছু করলা ?’

‘আমি কারো সাহায্য নিলে তো বাবু৷’

‘আচ্ছা কাউরে লাগব না৷ তুমি আমার সাথে চলো আমার লগে থাকবা৷’

মা হাসেন৷ কিছু বলেন না৷

‘কি চলো ?’

‘যাও, পাগলামি কোরো না৷ আমি কারো সাহায্য চেয়েছি কখনও ? কেন নেব ?’

‘তাহলে তোমাকে এর চেয়ে ভালো জায়গায় থাকতে হবে৷’

মা এ কথার জবাবেও শুধু হাসেন৷ সৈয়দ আশরাফুল হক তাকে কিছু টাকা দিলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন৷ তারপর বলেন, ‘শোনো, আজাদের খবর পেয়েছি৷ ওই খায়রুল আছে না বিক্রমপুরের, তার ভায়রার বড় ছেলে, ও লন্ডনে দেখে এসেছে, টিউবে ওর পাশে বসেছিল, হুবহু এক চেহারা, আরেকটু নাকি ফরসা হয়েছে…’

আশরাফুলের মনে হয় মাকে বলে, মা, আজাদ ভাই বেঁচে থাকলে তো তোমাকে চিঠি লিখতে পারত, তোমাকে ছাড়া আজাদ ভাই একদণ্ড থাকার ছেলে নাকি, কিন্তু সে কিছু বলে না৷ মহিলা একটা বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন, থাকুন…

মাঝে মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল আসে, সে তো আবার আজাদের সহপাঠী, তাকে তো আর তিনি ‘না’ করতে পারেন না, কাজী কামাল স্মৃতিতর্পণ করে, ‘মাঝে মধ্যে জুয়া খেইলা হয়তো পাইলাম ৫০০ টাকা, তারে দিয়া আসলাম, জুয়ার টাকা সেইটা অবশ্য কই নাই…’

আজাদের আরেক বন্ধু হিউবার্ট রোজারিও এসে তাঁকে মা বলে ডাকে, সাফিয়া বেগম তার মাথায় হাত বোলান, সে তখন জোর করে তাঁর হাতে কিছু টাকা গছিয়ে দেয়, তিনি সেটাও গ্রহণ করেন৷ না, ভাত তিনি আর কোনোদিনই খান না, দুটো পাতলা রুটি, একটু সব্জি হলেই তাঁর দিন চলে যায়, কি শীত কি গ্রীষ্ম, তার বিছানা মেঝেতে, পাটি বিছিয়ে, খুব শীতের রাতে গায়ের ওপরে দুটো শাড়ি ভাঁজ করে ঢেকে দেওয়া থাকে৷

জাহানারা ইমাম আবার আসেন তাঁর বাসায়, বলেন, ‘আপনার এই কাহিনী আমি লিখতে চাই, আপনি আজাদের ফটো দেন, আপনার ফটো দেন’, তিনি বলেন, ‘না, আমি ইতিহাস হতে চাই না৷ কোনো কিছু লিখবেন না৷’

কী জানি, হয়তো তিনি চৌধুরীর কাছে নিজেকে ছোট করতে চাননি৷

‘আপনি শহীদের মা৷ আপনার কথা সবাইকে জানাতে হবে৷ এটা আপনার জন্যে নয়, সারা দেশের মানুষের ভালোর জন্যে জানাতে হবে’-জাহানারা ইমাম যুক্তি দেখান৷

সাফিয়া বেগম হেসে বলেন, ‘কিন্তু আপা, আমার আজাদ তো শহীদ হয়নি৷ ও তো বেঁচে আছে৷ ও ফিরে আসবে৷’

জাহানারা ইমাম চোখ মুছে সেই বস্তিঘর ত্যাগ করেন৷

জাহানারা ইমামের কাছে তাঁর সম্পর্কে লেখার প্রস্তাবটা শুনে সাফিয়া বেগম এক রাতে তাঁর ছেলের চিঠিগুলো বের করেন৷ সেখান থেকে আলাদা করেন আজাদের একটা বিশেষ চিঠি৷

মা,

কেমন আছ ? আমি ভালোভাবেই পৌঁছেছি৷ এবং এখন ভালোই আছি৷ হরতাল বন্ধ হয়ে গেছে৷ রীতিমতো ক্লাস হচ্ছে৷ পরীক্ষা শীঘ্রই শুরু হবে৷ দোয়া কোরো৷ তোমার দোয়া ছাড়া কোন উপায় নাই৷ আমি নিজে কী ধরনের মানুষ আমি নিজেই বুঝতে পারি না৷ আচ্ছা তুমি বল ত সব দিক দিয়ে আমি কী ধরনের মানুষ৷ আমি তোমাকে আঘাত না দেওয়ার অনেক চেষ্টা করি৷ তুমি আমার মা দেখে বলছি না; তোমার মতো মা পাওয়া দুর্লভ৷ এই বিংশ শতাব্দীতে তোমার মতো মা যে আছে কেউই বিশ্বাস করবে না৷ আমি এগুলি নিজ হৃদয় থেকে বলছি, তোমার কাছে ভালো ছেলে সাজবার জন্য নয়৷ যদি আমি পৃথিবীতে তোমার দোয়ায় বড় বা নামকরা হতে পারি, তবে পৃথিবীর সবাইকে জানাব তোমার জীবনী, তোমার কথা৷

আমি ভালো পড়াশুনা করার চেষ্টা করছি৷

এবং অনেক দোয়া দিয়ে চিঠির উত্তর দিও৷

ইতি তোমার

অবাধ্য ছেলে

আজাদ

আজাদ লিখেছিল, সে যদি নামকরা হয় কোনো দিন, সে লিখবে তার মায়ের জীবনী৷ পৃথিবীকে জানাবে তার মায়ের কথা৷ আজাদ যদি বেঁচে থাকে, যদি ফিরে আসে, অবশ্যই সে বেঁচে আছে, অবশ্যই সে ফিরে আসবে, নিশ্চয় এই কাজ সে-ই করবে৷ তিনি তো এই কাজ অন্য কাউকে করতে দিতে পারেন না৷

৬২

জাহানারা ইমাম একা খোঁজখবর করেন আর সব শহীদের মায়ের, সময়ের চাকা ঘুরছে, পৃথিবী ঘুরছে, জীবনের চক্রে পড়ে কোথায় ছিটিয়ে পড়ছেন শহীদ জুয়েলের মা, শহীদ বদির মা, শহীদ বাকেরের মা, কত কত শহীদ এই দেশে, তাদের কতজনের মা, অভিযোগহীন, দুঃখ সয়ে পাথর হয়ে যাওয়া কখনো উচ্চবাচ্য না করা একেকজন মা!

চৌধুরী আবার প্রস্তাব পাঠান সাফিয়া বেগমকে বাসায় নিয়ে যেতে, কাকুতি-মিনতি করেন, তাঁর নিজেরও শরীর ভেঙে আসছে, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন নিজের অতীত আনন্দময় সুখের জীবনের কথা ভেবে ভেবে, কিন্তু সাফিয়া বেগম রাজি হন না, রাজি হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ ইতিমধ্যে আরো বিয়ে করেছেন চৌধুরী, চট্টগ্রামে পেতেছেন আরেক সংসার, তার কাছে যাওয়ার চিন্তাও তো অবান্তর৷ এখনও ইস্কাটনের বাসা সাফিয়া বেগমেরই নামে, ফরাশগঞ্জের বাসা, এবং ঢাকায় আরো অনেক জমাজমি…

জুরাইনের এক ঘোরতর বস্তিঘরে গিয়ে ওঠেন মা৷ সেখানে একদিন গিয়ে হাজির হয় সৈয়দ আশরাফুল হক৷

‘মা, তুমি এইসব জায়গা খুঁইজা বাইর করো কেমনে ? এইসব জায়গায় আসা যায় ?’

‘এসো না৷’

‘না, আসুম না তো৷ তুমি এমন জায়গায় থাকবা যাতে আসা না যায়, আসুম ক্যান ? চলো আইজকাই তোমারে নিয়া যামু৷ কাম অন৷ স্টে উইথ মি৷’

‘তোমাকে আসতেও হবে না, নিয়ে যেতেও হবে না৷ এখন তো তুমি এভাবেই কথা বলবে৷ অন্য সবাই যেভাবে কথা বলে, তুমিও যদি সে রকমই বলো… এসো না…’

সাফিয়া বেগম মৃদু হেসে তাকিয়ে থাকেন সৈয়দ আশরাফুলের চোখের দিকে৷ এরপর আর তাঁকে কিছু বলা যায় ?

৬৩

১৯৮৫ সাল৷ আগস্ট মাস৷ আগস্ট মাস এলেই ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের মাথার ভেতরটা কেমন করতে থাকে৷ জায়েদের হাত-পা ঘামতে থাকে দরদর৷ সারা শরীরের জ্বলুনিটা বেড়ে যায়৷ ২৯শে আগস্ট দিবাগত রাতে আজাদ চলে গিয়েছিল৷ ১৪ বছর আগে৷

সেই রাতটা কাছে আসছে৷ এদিকে শাহজাহানপুরের এক দীনহীন বাসায় থাকা আজাদের মার শরীরটা খুবই খারাপ হচ্ছে৷ হাঁপানির টান যখন ওঠে, তখন তিনি এত কষ্ট পান যে মনে হয় এর চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়৷ এর মধ্যে একটা দিনের জন্যেও, সেই ১৯৬১ থেকে, তিনি স্বামীর মুখ দেখেননি৷ নিজের মুখও তাকে দেখতে দেননি৷ আজাদের মা জায়েদকে ডেকে বলেন, ‘আমার আর সময় নাই৷’

জায়েদ বলে, ‘আম্মা, ডাক্তার ডাকি৷’

মা বলেন, ‘ডাকো৷ এত দিন ধরে আমাদের দেখছেন, বিদায় নিই৷’

তাঁকে যে ডাক্তার দেখতেন, টাঙ্গাইলের লোক, ডাক্তার এস. খান, তাঁকে ডাকা হয়৷ ডাক্তার এসে দেখেন, আজাদের মা শুয়ে আছেন স্যাঁতসেঁতে মেঝের ওপরে বিছানো একটা পাটিতে৷ তিনি বিস্মিত হন না৷ কারণ তিনি জানেন, কেন এই ভদ্রমহিলা মেঝেতে শোন৷ তবে ঘরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তাঁকে চিন্তিত করে৷ গলিটা ময়লা, একধারে নর্দমা উপচে উঠেছে, দুর্গন্ধ ঘরের ভেতরে পর্যন্ত এসে ঢুকছে৷ ঘরটাতেও আলো তেমন নাই৷

তবে সাফিয়া বেগমের মুখখানা তিনি প্রশান্তই দেখতে পান৷ তিনি তাঁর নাড়ি পরীক্ষা করেন, স্টেথোস্কোপ কানে দিয়ে তাঁর বুকের ভেতরের হাপরের শব্দের মর্ম অনুধাবন করেন৷ রোগীর অবস্থা বেশি ভালো নয়৷ এখনই ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে একটা শেষ চেষ্টা করা যায়৷

ডাক্তার বলেন, ‘বোন, কী করবা!’

মা বলেন, ‘আপনাকে দেখলাম৷ দেখতে ইচ্ছা করছিল৷ তাই ডেকেছি৷ আপনার আর কী করার আছে! আমার সময় হয়ে এসেছে৷ আমাকে বিদায় দিন৷ ভুলত্রুটি যা করেছি, মাফ করে দেবেন৷’

‘হসপিটালে যাওয়া দরকার৷’

‘না৷ দরকার নাই৷’

‘আল্লাহ!’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে বিদায় হন৷

মা বলেন, ‘উকিল ডাকো৷ গেন্ডারিয়ার জমিগুলো আমি লেখাপড়া করে দেব৷’

উকিল ডাকা হয়৷

তিনি গেন্ডারিয়ার জমি তাঁর ভাগ্নে-ভাগি্নদের নামে আর জুরাইনের মাজারের নামে দলিল করে দেন৷

২৯শে আগস্ট পেরিয়ে যায়৷ আসে ৩০শে আগস্ট৷ আজাদের ধরা পড়ার ১৪ বছর পূর্ণ হওয়ার দিন৷ তিনি ভাগ্নে-ভাগি্নদের ডাকেন৷ জায়েদকে বলেন, ‘শোনো, আমার মৃত্যুর পরে কবরে আর কোনো পরিচয় লিখবে না, শুধু লিখবে-শহীদ আজাদের মা৷ বুঝলে!’

‘জি৷’ জায়েদরা কাঁদতে শুরু করে৷

তিনি বলেন, ‘শোনো, আসলে আজাদ যুদ্ধের সময়ই শহীদ হয়েছে৷ ওর বউয়ের জন্যে আমি কিছু গয়না রেখেছিলাম৷ এগুলো রেখে আর কোনো লাভ নাই৷ আজাদ তো আসলে যুদ্ধের সময়ই শহীদ হয়েছে৷ এগুলো তোমাদের দিয়ে গেলাম৷ তোমরা বড় হুজুরের সাথে আলাপ করে সৎকাজে এগুলো ব্যয় কোরো৷ আমার যাওয়ার সময় হয়েছে, আমি যাই বাবারা, মায়েরা…’

জায়েদ, টিসু, টগর, তাদের বউ-বাচ্চা, যারা তাঁর পাশে ছিল, তারা কাঁদতে থাকে৷

তিনি ইশারা করে বলেন, ‘কেঁদো না৷’ তিনি একটা ট্রাঙ্কের চাবি জায়েদের হাতে তুলে দেন৷ পরে, জায়েদ সেই ট্রাঙ্ক খুলে প্রায় একশ ভরি সোনার গয়না দেখতে পায়! আশ্চর্য তো মহিলা, এতটা কষ্ট করলেন, কিন্তু ছেলের বউয়ের জন্য রাখা গয়নায় এই ১৪টা বছর হাত দিলেন না!

১৩ই জিলহজ্ব, ৩০শে আগস্ট ১৯৮৫ বিকাল পোনে ৫টায় আজাদের মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷

জায়েদ অন্যান্য কৃত্যের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল বীরবিক্রমকে খবরটা দেওয়ার কর্তব্যটাও পালন করে৷ সেখান থেকে খবরটা পান জাহানারা ইমাম৷ তিনি আবার একে একে খবর দেন ঢাকার আরবান গেরিলাদের৷ হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, হ্যারিস, বাচ্চু, ফতেহ, উলফত, শাহাদত চৌধুরী, চুল্লু, আলভী, আসাদ, শহীদুল্লাহ খান বাদল, হিউবার্ট রোজারিও…

পরদিন সকালে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় জুরাইন গোরস্তানে৷ জাহানারা ইমাম রয়ে যান গাড়ির ভেতরে, গোরস্তানের গেটের বাইরে৷

জনা-তিরিশেক মুক্তিযোদ্ধা আর কিছু নিকটাত্মীয়ের শবযাত্রীদলটি কফিন বয়ে নিয়ে চলেন৷

লাশ গোরে নামানোর পরে হঠাৎই রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশ থেকে বৃষ্টি নামতে থাকে৷ একটা অচেনা মিষ্টি গন্ধে পুরো গোরস্তানের বাতাস আচ্ছন্ন হয়ে থাকে৷ অনেক মুক্তিযোদ্ধারই মনে হয়, তাদের সহযোদ্ধা শহীদেরা আজ অনেকেই একত্র হয়েছে এই সমাধিক্ষেত্রে, যেন তারা পুষ্পবৃষ্টি বর্ষণ করছে বেহেশত থেকে, যেন তারা মাটি দিচ্ছে কবরে৷ শহীদ জুয়েল, শহীদ বদি, শহীদ বাকের, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ রুমী, শহীদ বাশার প্রমুখ আর শহীদ আজাদ এখানে উপস্থিত৷

সহযোদ্ধা শহীদের মাকে সমাহিত করতে এসে ঢাকার আরবান গেরিলা দলের সদস্যরা আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, ঘোরগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তাড়িত বোধ করেন; স্মৃতি তাদের দখল করে নেয়, স্বপ্ন আর দুঃস্বপ্ন তাদের জাগিয়ে তোলে, নিশি-পাওয়া মানুষের মতো তারা হাঁটাহাঁটি করেন, ত্রিকালদর্শী বৃদ্ধের মতো তারা একবার কাঁদেন, একবার হাসেন৷ তারা স্মৃতিতর্পণ করেন৷ আজাদের মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে যাবার পরের কটা দিন তারা একা একা, জোড়ায় জোড়ায়, কিংবা ছোট ছোট গ্রুপে বসে এই কাহিনী স্মরণ করেন৷ বলাবলি করেন৷ ঘাঁটাঘাঁটি করেন৷

বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদত চৌধুরীর চশমার পুরু লেন্স ঝাপসা হয়ে আসে বাষ্পে, তিনি কান্না লুকাতে পারেন না, আরেকটু সাবধান বোধহয় হওয়া উচিত ছিল, এই নির্দেশ হয়তো তাঁরই দেওয়া উচিত ছিল, আর আমরা কী রকম বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম, ভেবে দ্যাখো, একদিন প্রকাশ্য দিবালোকে আমরা গাড়িতে যাচ্ছি আর ছেলেমানুষের মতো বাজি ধরছি, চল, এসএমজি পাশে রেখে নিয়ে যাই তো, দেখি না কী হয়, আর সত্যি আমরা এসএমজি পাশে রেখে ট্রিগারে আঙুল ধরে যাচ্ছি, সামাদ ভাই নির্বিকার গাড়ি চালাচ্ছেন, এটা তো ছিল শুধুই অ্যাডভেঞ্চার, খালেদ মোশাররফ বলতেন, কাউবয় অ্যাডভেঞ্চার৷ কাজী কামালের মনে হয়, অবশ্যই প্রত্যেকটা হাইড আউটে সেন্ট্রি রাখা উচিত ছিল, আর ওই রাতে এলএমজির দখলটা পুরোপুরি নিয়ে নিতে পারলে… জুয়েল, আজাদ, বাশার সবাইকে নিয়েই তো বেরিয়ে আসা যেত, হয়তো… সৈয়দ আশরাফুল হকের মনে হয়, কেন তিনি ছাড়তে গেলেন জুয়েলকে, ওই রাতে, আর কেনই বা বদি শেষের দুই রাত তাদের বাসায় না থেকে অন্য জায়গায় থাকতে গেল ? জায়েদ হাহাকার করে ওঠে : ‘দাদা ক্যান আমার কথা বিশ্বাস করল না, কামরুজ্জামানরে দেইখাই তো আমি বুইঝা ফেলছিলাম, ওই বেটা ক্যান ঘুরঘুর করে আমগো বাড়ির চারদিকে৷’ ইব্রাহিম সাবেরের মনে পড়ে, ওইদিন দুপুরবেলা দোকানে তিন যুবকের চোখমুখ দেখেই তিনি বুঝেছিলেন এরা ইনফরমার হতে পারে, তিনি সতর্ক করে দিয়েছিলেন আজাদকে, আজাদ শোনেনি… শহীদুল্লাহ খান বাদল হিসাব মেলাতে পারেন না, ২৭শে মার্চ তারা রওনা দিলেন চার জন, যুদ্ধশেষে ফিরে এলেন দুজন, ‘বদি যে আমাদের দুজনের হাত কেটে রক্তের সঙ্গে রক্ত মিশিয়ে বলে গেল আজ থেকে আমরা রক্তের ভাই, সে কেন আর আসে না, আশফাকুস সামাদ আশফি ভুরুঙ্গামারীর যুদ্ধে শহীদ হয়েছে, সে তো আর আসবে না… যেন এখনও বাদল শুনতে পান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত আশফির শহীদ হওয়ার সংবাদটা, সেক্টর টু’তে বসে তারা খবরটা শোনেন, তোপধ্বনি করা হয় এই বীরের সম্মানে, স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলেন হায়দার, তাঁর নিজের হাতে গড়া ছেলে!

নিদ্রাহীনতায় জেগে ওঠেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, যখন তিনি তাকান বিগত ১৪টা বছরের দিকে, খেই খুঁজে পান না, খালেদ মোশাররফ বলতেন, স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলার চেয়ে পছন্দ করে শহীদ যোদ্ধাদের, কোথায় গেল সেই যুদ্ধ, কোথায় সেই আগুনের পরশমণি ছোঁয়ানো দিনগুলো, যুদ্ধের পরে শুধু ধ্বংসের শব্দ, শুধু অবক্ষয়ের চিত্র, একে একে মরে যাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধারা, রক্ষীবাহিনীর হাতে মরল মুখতার, এখানে ওখানে কতজন মরল, কয়েকজন অধঃপাতে গেল, চোখের সামনে একে একে কেবল মুক্তিযোদ্ধাদেরই চলে যাওয়ার ছবি, সার সার৷

টগরের মাথার ওপর দিয়ে সব পাখি একে একে বিদায় নেয়, যাওয়ার আগে যেন শেষতম পাখিটা বলে যায় বঙ্গবন্ধু নাই, তাজউদ্দীন আহমদসহ চার নেতা নাই, খালেদ মোশাররফ নাই, হায়দার নাই, জিয়াউর রহমান নাই, কে আছে আর মুক্তিযোদ্ধাদের…

নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু ঘুমুতে পারেন না, বহু মুক্তিযোদ্ধা বিহ্বলের মতো আচরণ করে, চারপাশের মানুষগুলো তাদের বুঝতে পারে না…তারাও বুঝে উঠতে পারে না চারপাশের জগতকে৷

ঘোর লাগা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু যান শাহাদত চৌধুরীর বাসায়৷ ‘বাচ্চু আসো, বসো’-শাচৌ বলেন৷

বাচ্চু বলেন, ‘শাহাদত ভাই, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলাম৷’

‘বসো৷ বসে বলো, কী তোমার কথা ?’ শাচৌ বলেন৷

বাচ্চু বলেন, ‘শাহাদত ভাই, আচ্ছা বলেন তো এই দেশে আম্মা, মানে জাহানারা ইমামের মতো মা আছেন ?’

‘হ্যাঁ৷ বলো৷’

‘আজাদের মায়ের মতো মা ছিলেন ?’

শাচৌ চুপ করে তাকিয়ে থাকেন বাচ্চুর মুখের দিকে৷

‘তাঁরা তাদের ছেলেদের হাসিমুখে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন, দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে, আমাদের সবার ভালো থাকার জন্যে…’ বাচ্চু বলে চলেন৷

শাচৌ মাথা নাড়েন৷ ‘হ্যাঁ…’

‘তাহলে বীরের এ রক্তস্রোত, মায়ের এ অশ্রুধারা, এসব কি ধরার ধুলায় হারা হয়ে যাবে ? শাহাদত ভাই, ইতিহাসে এটা কি হতে দেখেছেন… এত এত লোক আত্মত্যাগ করল, নিজের জীবনের চেয়ে বড় আর কী হতে পারে, সেই জীবন দিয়ে দিল, আর মায়ের কাছে ছেলের চেয়ে বড় ধন আর কী, মায়েরা হাসিমুখে ছেলেদের তুলে দিলেন মৃত্যুর হাতে, সব বৃথা যাবে ?’

পুরোটা ঘরে তখন অসহ্য নীরবতা৷

বাচ্চু বলেন, ‘শাহাদত ভাই, আবুল হাসানের একটা কবিতা আছে না, তোমরা আমার না পাওয়াগুলো জোড়া দাও, আমি তোমাদের ভালো থাকা হবো, আছে না ? আছে৷ তাহলে আজাদের মায়ের না পাওয়াগুলো জোড়া দিলে আমাদের সবার ভালো থাকার দিন আসে না ? এই দেশটার ভালো হবে না ? শাহাদত ভাই বলেন৷’

শাহাদত চৌধুরী মাথা নিচু করে থাকেন৷ বাচ্চুর এই প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়ই ‘হ্যাঁ’৷ এই দেশটার একদিন ভালো হবে, এই দেশের মানুষের সবার ভালো হবে, আমাদের সন্তানেরা সবাই দুধভাতে থাকবে, এত এত মানুষের এত এত আত্মত্যাগ বৃথা যেতে পারে না৷ কিন্তু কই, সেই সুসময় তো আসে না…

নীরবতা, পাথরের মতো নীরবতা নেমে আসে ওই ঘরটায়, তাদের বুকের ওপর, সমস্তটা দেশের ওপর৷ শাহাদত চৌধুরীর মনে পড়ে, আলমও প্রায়ই বলে, ‘আমরা তো যুদ্ধ শেষেই পাস্ট টেন্স হয়ে গেছি৷ এখন আমার পরিচয় কী ? হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন৷ ১৭ ডিসেম্বর থেকেই আমাদের অতীত ইতিহাস করে দেওয়া হয়েছে৷’ শাহাদত চৌধুরীরও মনে হয়, মুক্তিযুদ্ধকে জাতির সত্তায় বপন করতে দেওয়া হয়নি৷ খালেদ মোশাররফ তো বলতেনই, স্বাধীন দেশ জীবিত গেরিলা চাইবে না, তার চাই শহীদ…

খানিকক্ষণ নীরব থেকে শাচৌ বলেন, ‘বাচ্চু, তুমি বসো৷ তোমার মনের কথাগুলো লিখে ফেলো৷ সামনে আমার বিজয় দিবস সংখ্যা, ওতে আমি তোমার এই কথাগুলো ছাপব৷’

তাকে টেবিলে বসিয়ে কাগজ কলম ধরিয়ে দেন তিনি৷

সারা রাত জেগে বাচ্চু লিখে ফেলেন তাঁর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আবেগময় স্মৃতিগাথা : ঘুম নেই৷

৬৪

আজাদের মাকে দাফন করে এসে জাহানারা ইমাম কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসেন৷ কারণ তিনি মা৷ একটা লোক যখন মরে যায়, ভাইয়ের কাছে সেটা চলে যাওয়া, বোনের কাছে সেটা শূন্যতা, বাবার কাছে তার নিজেরই ধারবাহিকতার ছেদ, বন্ধুর কাছে সেটা অতীত স্মৃতি আর বিস্মৃতির দোলাচল, পড়শির কাছে তা দীর্ঘশ্বাস, দেশের কাছে কালের কাছে হয়তো তা প্রিয়তম পাতার ঝরে যাওয়া, কিন্তু মায়ের কাছে ? মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যু হলো সমস্ত সত্তাটাই মৃতের দ্বারা দখল হয়ে যাওয়া, মায়ের স্মৃতি, মায়ের অস্তিত্ব, তাঁর নিদ্রা, তাঁর জেগে থাকা, তাঁর স্বপ্ন, সবটা জুড়েই পুনর্বার জন্ম নিয়ে বিপুলভাবে বেড়ে উঠতে থাকে তাঁর গতায়ু সন্তানটিই৷ তাঁর পরিপাশর্্ব, তাঁর চারপাশের জগৎ একজন সন্তানহারা মায়ের এই গোপন বিপুল রক্তক্ষয়ী নিজস্ব সংগ্রামটাকে বুঝতে পারে না, আমলে আনে না৷

সন্তান নাই এই সত্যটা মেনে নিতে না পেরে মা করে চলেন তাঁর নিজস্ব সংগ্রাম, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম; বিলাপ করে, সন্তানের স্মৃতি বয়ান করে, তার ছবি বুকের মধ্যে, ঘরের মধ্যে, ট্রাঙ্কের মধ্যে সংরক্ষণ করে, তার নামে কুরবানি দিয়ে, তার নামে গাছ লাগিয়ে, ফল ফলিয়ে তিনি চালিয়ে যান এই তাঁর এই একাকী নিজস্ব ব্যক্তিগত সংগ্রাম৷ তা-ই করতে বসেন জাহানারা ইমাম, লিখে চলেন একাত্তরের ডায়েরি, বুকে পাথর বেঁধে, দিনের পর দিন, পৃষ্ঠার পরে পৃষ্ঠা৷ নিশ্চয় শহীদ জুয়েলের মা, শহীদ বদিউল আলমের মা, শহীদ বাশারের মা, শহীদ বাকেরের মা, বাংলাদেশের আর লাখো শহীদের মা, নিজ নিজ ধরনে বিস্মৃতির সুষুপ্তির বিরুদ্ধে একা জেগে থাকেন৷ আর তাঁদের সেই একাকী স্মরণসংগ্রামের প্রতীক হয়ে শহীদ মিনারের মধ্য মিনারটা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে, মায়ের দুপাশে চারটা সন্তানসমেত, দিন নাই, রাত্রি নাই, কি রোদে, কি বৃষ্টিতে!

উপসংহার

আজাদ ধরা পড়ার পর ৩১ বছর পরে, আজাদের মাকে দাফন করার ১৭ বছর পরে একজন ক্ষুদ্র-সামর্থ্য লেখক, আরেক ৩০ আগস্টে আরম্ভ করে আজাদের অপূর্ণ একটা ইচ্ছা পূর্ণ করার অসম্ভব কাজটি : আজাদের মায়ের কথা সবাইকে জানানো, আজাদের মায়ের জীবনী রচনা করা৷ আজাদ মাকে লিখেছিল সে যদি নামকরা হয়, বড় হয়, তাহলে সে সবাইকে জানাবে তার মায়ের কথা৷ রচনা করবে তাঁর জীবনী! আজাদ অনেক বড় হয়েছে, এত বড় যে তার সমান আর কেই-বা হতে পারে, নামকরা হয়েছে, এর চেয়ে বেশি নামকরা আর কীভাবে হওয়া যাবে ? এখন আজাদের বাবা বেঁচে নাই, ইস্কাটনের বাসাটাও বিক্রি ও ভাঙা হয়ে গেছে, ওখানে উঠছে বড় অ্যাপার্টমেন্ট, ৩৯ মগবাজারের বাসাটা একই রকম আছে, কামরুজ্জামান মারা গেছে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে ভুগে ভুগে৷ শহীদ ক্রিকেটার জুয়েলের নামে প্রতি বছর গঠন করা হয় শহীদ জুয়েল স্মৃতি একাদশ আর শহীদ মুশতাকের নামে গড়া হয় শহীদ মুশতাক একাদশ, দুদলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় স্বাধীনতা দিবস ক্রিকেট টুর্নামেন্ট৷

জাহানারা ইমাম আর বেঁচে নাই, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর একাত্তরের দিনগুলি, মুক্তিযোদ্ধারা অনেকেই আছেন, কেউ কেউ নাই, বাংলাদেশ আছে, স্বাধীনতা আছে, কী জানি, এই বাংলাদেশ তাঁদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের সঙ্গে মেলে কি না, টগর চাকরি করে ব্যাঙ্কে, তাদের দুলাভাই শহীদ মনোয়ার হোসেনের নামে একটা স্টেডিয়ামের নামকরণ হয়েছিল খিলগাঁও মসজিদের পশ্চিম দিকে মুক্তিযুদ্ধের পরপর, সেটা আর নাই, তাঁর মেয়ে লীনার বয়স এখন ৩১ কি ৩২, জায়েদ ও চঞ্চল দাঁড়িয়ে গেছে নিজের পায়ে, তাদের আম্মার দোয়ায় তারা এখন সচ্ছল, আর তারা তাদের আম্মার কবরটা পাকা করে টাইলস্-শোভিত করে রেখেছে আম্মারই রেখে যাওয়া টাকা দিয়ে; আজও যদি কেউ যায় জুরাইন গোরস্তানে, দেখতে পাবে কবরটা, আর দেখতে পাবে প্রস্তরফলকে উৎকীর্ণ মায়ের পরিচয় : মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা৷

—————————————–

গ্রন্থপঞ্জী ও তথ্যসূত্র

১. ‘আগরতলা মামলা’, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ : ফয়েজ আহ্মদ, প্রকাশক : সাহিত্য প্রকাশ৷

২. আমাদের সংগ্রাম চলবেই, প্রকাশক : অপরাজেয় সংঘ৷

৩. একাত্তরের দিনগুলি : জাহানারা ইমাম, প্রকাশক : সন্ধানী প্রকাশনী৷

৪. ঘুম নেই, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, প্রকাশক : চেতনা প্রকাশন৷

৫. টিটোর স্বাধীনতা, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু : চেতনা প্রকাশন৷

৬. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র : সম্পাদনা-হাসান হাফিজুর রহমান, প্রকাশক : তথ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সরকার৷

৭. বাঙালির ইতিহাস, ড. মোহাম্মদ হাননান, প্রকাশক : অনুপম প্রকাশনী৷

৮. ভুলি নাই, ভুলি নাই : গোলাম মোর্তোজা সম্পাদিত, প্রকাশক : সময় প্রকাশন৷

৯. মুক্তিযুদ্ধ, সিদ্দিকুর রহমান, প্রকাশক : ঢাকা প্রকাশনী৷

১০. মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক-এর লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রকাশিতব্য স্মৃতিচারণ গ্রন্থের ইংরেজি পাণ্ডুলিপি৷

১১. শাশ্বত : তাহমীদা সাঈদা, প্রকাশক : সন্ধানী প্রকাশনী৷

১২. সাধু গ্রেগরির দিনগুলি : শাহরিয়ার কবির, প্রকাশক : দিব্যপ্রকাশ৷

১৩. সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকায় প্রকাশিত হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক লিখিত ঢাকার বিভিন্ন অপারেশনের স্মৃতিচারণ৷

১৪. স্বাধীনতা সংগ্রাম, ঢাকায় গেরিলা অপারেশন : হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ, প্রকাশক : সময় প্রকাশন৷

১৫. হাসান হাফিজুর রহমান, বিমুখ প্রান্তরে অনির্বাণ বাতিঘর : মিনার মনসুর, প্রকাশক : বাংলা একাডেমী৷

লেখকের নেওয়া নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার

(আগস্ট ২০০২ থেকে মার্চ ২০০৩)

১. আজাদের ছোটমা

২. আবুল বারক আলভী, মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী

৩. ইব্রাহিম সাবের, সাবেক বাস্কেটবল খেলোয়াড়, শহীদ আজাদের বন্ধু

৪. গাজী আমিন আহমেদ, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ আজাদের দূর-সম্পর্কিত ভাই প্রাক্তন বামপন্থী রাজনীতিক

৫. গাজী আলী হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ আজাদের দূর-সম্পর্কিত চাচা,

৬. ফেরদৌস আহমেদ জায়েদ, শহীদ আজাদের খালাতো ভাই, ৩০শে আগস্ট ১৯৭১ গুলিবিদ্ধ

৭. মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামাল উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম

৮. মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু

৯. মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বীরপ্রতীক

১০. মুসলেহ উদ্দিন চৌধুরী টগর, শহীদ আজাদের খালাতো ভাই, ৩০শে আগস্ট ১৯৭১ গুলিবদ্ধ

১১. শহীদুল্লাহ খান বাদল, মুক্তিযোদ্ধা

১২. শাহাদত চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা, সম্পাদক সাপ্তাহিক ২০০০

১৩. শিমুল ইউসুফ; অভিনেত্রী

১৪. সৈয়দ আশরাফুল হক, সাবেক ক্রিকেটার, শহীদ আজাদের বয়ঃকনিষ্ঠ বন্ধু

১৫. আরো একাধিক ব্যক্তি (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক)

এবং

মাকে লেখা আজাদের চিঠি, ফেরদৌস আহমেদ জায়েদের সূত্রে প্রাপ্ত৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন