সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৪

তিতাস একটি নদীর নাম

অদ্বৈত মল্লবর্মণ

অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১লা জানুয়ারি, ১৯১৪- ১৬ই এপ্রিল, ১৯৫১) বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। তৎকালীন কুমিল্লা জেলার অধীনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার গোকর্ণঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামের একটিমাত্র উপন্যাস লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যের চিরস্মরণীয় ও অমর প্রতিভা হিসেবে সবিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেন। এই উপন্যাসটি সর্বপ্রথম মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (উইকি)
- See more at: http://ebanglalibrary.com/category/%e0%a6%85%e0%a6%a6%e0%a7%8d%e0%a6%ac%e0%a7%88%e0%a6%a4-%e0%a6%ae%e0%a6%b2%e0%a7%8d%e0%a6%b2%e0%a6%ac%e0%a6%b0%e0%a7%8d%e0%a6%ae%e0%a6%a3#sthash.u4eBoKu5.dpuf

অদ্বৈত মল্লবর্মণ (১লা জানুয়ারি, ১৯১৪- ১৬ই এপ্রিল, ১৯৫১) বাঙালি ঔপন্যাসিক ও সাংবাদিক। তৎকালীন কুমিল্লা জেলার অধীনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার গোকর্ণঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামের একটিমাত্র উপন্যাস লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যের চিরস্মরণীয় ও অমর প্রতিভা হিসেবে সবিশেষ স্বীকৃতি লাভ করেন। এই উপন্যাসটি সর্বপ্রথম মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (উইকি)


১.১ তিতাস একটি নদীর নাম

তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস।

স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়।

ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙ্গে, দিনের সূর্য তাকে তাতায় ; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।
মেঘনা পদ্মার বিরাট বিভিষিকা তার মধ্যে নাই। আবার রমু মোড়লের মরাই, যদু পণ্ডিতের পাঠশালার পাশ দিয়া বহিয়া যাওয়া শীর্ণা পল্লীতটিনীর চোরা কাঙ্গালপনাও তার নাই। তিতাস মাঝারি নদী। দুষ্ট পল্লীবালক তাকে সাঁতরাইয়া পার হতে পারে না। আবার ছোট নৌকায় ছোট বৌ নিয়া মাঝি কোনদিন ওপারে যাইতে ভয় পায় না।

তিতাস শাহী মেজাজে চলে। তার সাপের মতো বক্রতা নাই, কৃপণের মতো কুটিলতা নাই। কৃষ্ণপক্ষের ভাঁটায় তার বুকের খানিকটা শুষিয়া নেয়, কিন্তু কাঙ্গাল করে না। শুক্লপক্ষের জোয়ারের উদ্দীপনা তাকে ফোলায়, কিন্তু উদ্বেল করে না।

কত নদীর তীরে একদা নীল-ব্যাপারিদের কুঠি-কেল্লা গড়িয়া উঠিয়াছিল। তাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও খুঁজিয়া পাওয়া যায়। কত নদীর তীরে মোঘল-পাঠানের তাঁবু পড়িয়াছে, মগদের ছিপনৌকা রক্ত-লড়াইয়ে মাতিয়াছে–উহাদের তীরে তীরে কত যুদ্ধ হইয়াছে। মানুষের তক্তের হাতিঘোড়ার রক্তে সে-সব নদীর জল কত লাল হইয়াছে। আজ হয়ত তারা শুখাইয়া গিয়াছে, কিন্তু পুঁথির পাতায় রেখ্‌ কাটিয়া রাখিয়াছে। তিতাসের বুকে তেমন কোন ইতিহাস নাই। সে শুধু একটি নদী।

তার তীরে বড় বড় নগরী বসানো নাই। সওদাগরের নৌকারা পাল তুলিয়া তার বুকে বিচরণ করিতে আসে না। ভূগোলের পাতায় তার নাম নাই।
ঝরণা থেকে জল টানিয়া, পাহাড়ি ফুলেদের ছুঁইয়া ছুঁইয়া উপল ভাঙিয়া নামিয়া আসার আনন্দ কোনোকালে সে পায় নাই। অসীম সাগরের বিরাট চুম্বনে আত্মবিলয়ের আনন্দও কোনোকালে তার ঘটিবে না। দুরন্ত মেঘনা নাচিতে নাচিতে কোন্‌কালে কোন্‌ অসতর্ক মুহূর্তে পা ফসকাইয়াছিল; বাঁ তীরটা একটু মচ্‌কাইয়া গিয়া ভাঙিয়া যায়। স্রোত আর ঢেউ সেখানে প্রবাহের সৃষ্টি করে। ধারা সেখানে নরম মাটি খুঁজিয়া, কাটিয়া, ভাঙিয়া, দুমড়াইয়া পথ সৃষ্টি করিতে থাকে। এক পাকে শতশত পল্লী দুই পাশে রাখিয়া অনেক জঙ্গল অনেক মাঠ-ময়দানের ছোঁয়া লইয়া ঘুরিয়া আসে–মেঘনার গৌরব আবার মেঘনার কোলেই বিলীন হইয়া যায়। এই তার ইতিহাস। কিন্তু সে কি আজকের কথা? কেউ মনেও করে না কিসে তার উৎপত্তি হইল। শুধু জানে সে একটি নদী। অনেক দূর-পাল্লার পথ বাহিয়া ইহার দুই মুখ মেঘনায় মিশিয়াছে। পল্লীরমনীর কাঁকনের দুই মুখের মধ্যে যেমন একটু ফাঁক থাকে, তিতাসের দুই মুখের মধ্যে রহিয়াছে তেমনি একটুখানি ফাঁক–কিন্তু কাঁকনের মতই তার বলয়াকৃতি।



অনেক নদী আছে বর্ষার অকুণ্ঠ প্লাবনে ডুবিয়া তারা নিশ্চিহ্ন হইয়া যায়। পারের কোনো হদিস থাকে না, সবদিক একাকার । কেউ তখন বলিতে পারে না এখানে একটা নদী ছিল । সুদিনে আবার তাদের উপর বাঁশের সাঁকোর বাঁধ পড়ে । ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়িরা পর্যন্ত একখানা বাঁশে হাত রাখিয়া আর একখানা বাঁশে পা টিপিয়া টিপিয়া পার হইয়া যায় । ছেলে-কোলে নারীরাও যাইতে পারে । নৌকাগুলি অচল হয় । মাঝিরা কোমরে দড়ি বাঁধিয়া সেগুলিকে টানিয়া নেয় । এপারে ওপারে ক্ষেত । চাষীরা দিনের রোদে তাতিয়া কাজ করে । এপারের চাষী ওপারের জনকে ডাকিয়া ঘরের খবর জিজ্ঞাসা করে । এপারের চাষী ঘাম মুছিয়া জবাব দেয় । গরুগুলি নামিয়া স্নান করিতে চেষ্টা করে । অবগাহন স্নান । কিন্তু গা ডোবে না । কাক- স্নান করা মাত্র সম্ভব হয় কোন রকমে । নারীরা কোমরজলে গা ডুবাইবার চেষ্টায় উবু হয় । দুই হাতে ঢেউ তুলিয়া নীচু–করা ঘাড়ে-পিঠে জল দিয়া স্নানের কাজ শেষ করে । শিশুদের ডুবিবার ভয় নাই বলিয়া মায়েরা তাদের জলে ছাড়িয়া দিয়াও নিরুদ্বেগে বাসন মাজে, কাপড় কাচে, আর এক পয়সা দামের কার্বলিক সাবানে পা ঘসে । অল্প দূরে ঘর । পুরুষমানুষে ডাক দিলে এখান হইতে শোনা যাইবে; তাই ব্যাস্ততা নাই ।

কিন্তু সত্যি কি ব্যাস্ততা নাই ? যে-মানুষটা এক-গা ঘাম লইয়া ক্ষেতে কাজ করিয়া বাড়ি গেল, তার ভাত বাড়িয়া দিবার লোকের মনে ব্যাস্ততা থাকিবেইত । দুপুরে নারীরা ঘাটে বেশি দেরি করে না । কিন্তু সকালে সন্ধ্যায় দেরি করে । পুরুষেরা এজন্য কিছু বলে না । তারা জানে এ নদী দিয়া কোনো সদাগরের নৌকা আসা- যাওয়া নাই ।

শীতে বড় কষ্ট । গম্ গম্ করিয়া জলে নামিতে পারে না । জল খুব কম । সারা গা তো ডোবেই না; কোমর অবধিও ডোবে না । শীতের কন্ কনে ঠাণ্ডা জলে হুম্ করিয়া ডুবিয়া ভাসিয়া উঠিবার উপায় নাই; একটু একটু করিয়া শরীর ভিজে । মনে হয় একটু একটু করিয়া শরীরের মাংসের ভিতর ছুরি চালাইতেছে কেউ । চৈত্রের শেষে খরায় খাঁ খাঁ করে । এতদিন যে জলটুক্ অবশিষ্ট ছিল, তাও একটু একটু করিয়া শুষিতে শুষিতে একদিন নিঃশেষ হইয়া যায় । ঘামের গা ধুইবার আর উপায় থাকে না । গরুরা জল খাইতে ভুল করিয়া আসিয়া ভাবনায় কাতর হয় । মাঘের মাঝামাঝি সরষে ফুলে আর কড়াই-মটরের সবুজিমায় দুই পারে নকসা করা ছিল । নদীতেও ছিল একটু জল । জেলেরা তিন-কোণা ঠেলা-জাল ঠেলিয়া চাঁদা পুঁটি টেংরা কিছু-কিছু পাইত । কিন্তু চৈত্রের খরায় এ সবের কিছুই থাকে না । মনে হয় মাঘমাসটা ছিল একটা স্বপ্ন । চারিদিক ধু-ধু করা রুক্ষতায় কাতরায় । লোকে বিচলিত হয় না । জানে তারা , এ সময় এমন হয় ।



তিতাসের তেরো মাইল দূরে এমনি একটা নদী আছে । নাম বিজয় নদী । তিতাসের পারের জেলেদের অনেক কুটুম বিজয় নদীর পারের পাড়াগুলিতে আছে । তিতাসের পারের ওরা ওই নদীর পারের কুটুম-বাড়িতে অনেকবার বেড়াইতে গিয়াছে । বিয়ের কনের খোঁজে গিয়াছে । সে-সব গাঁয়ে তারা দেখিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় । একদিক দিয়া জল শুকায় আর একদিক দিয়া মাছেরা দমবন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় নাক জাগাইয়া হাঁপায় । মাছেদের মত জেলেদেরও তখন দম বন্ধ হইতে থাকে । সামনে মহাকালের শুষ্ক এক কঙ্কালের ছায়া দেখিয়া তারা একসময় হতাশ হইয়া পড়ে । যারা বর্ষার সময় চাঁদপুরের বড় গাঙ্ এ নৌকা লইয়া প্রবাস বাহিতে গিয়াছিল, তারা সেখানে নিকারীর জিম্মায় নাও জাল রাখিয়া রেলে চড়িয়া আসিয়া পড়ে । তাদের কোন চিন্তা থাকে না । হাতের টাকা ভাঙিয়া এই দুর্দিন পার করে । কিন্তু যারা বর্ষায় ঘরের মায়া ছাড়িয়া বাহির হয় নাই তারাই পড়ে বিপদে । নদী ঠন্ ঠনে । জাল ফেলিবে কোথায় । তিন-কোণা ঠেলা-জাল কাঁধে ফেলিয়া আর-এক কাঁধে গলা-চিপা ডোলা বাঁধিয়া এ-পাড়া সে-পাড়ায় টই-টই করিয়া ঘুরিতে থাকে, কোথায় পানা পুকুর আছে মালিক হীন ছাড়া বাড়িতে । চার পারে বন বাদাড়ের ঝুপড়ি । তারই ঝরাপাতা পড়িয়া, পচিয়া, ভারি হইয়া তলায় শায়িত আছে । তারই উপর দিয়া ভাসিয়া উঠিয়া ছোট মাছেরা ফুট দেয় । গলা-জল শুকাইয়া কোমর-জল,  কোমর-জল শুকাইয়া হাঁটু-জল হইয়াছে । মাছেদের ভাবনার অন্ত নাই । কিন্তু অধিক ভাবিতে হয় না । গোপালকাছা-দেওয়া দীর্ঘাকার মালো কাঁধের জল নামাইয়া শুন্য-দৃষ্টিতে তাকাইতে তাকাইতে এক সময় খেউ দিয়া তুলিয়া ফেলে । মাছেদের ভাবনা এখানেই শেষ হয়, কিন্তু মাছ যারা ধরিল তাদের ভাবনার আর শেষ হয় না । তাদের ভাবনা আরও সুদূর-প্রসারী । সামনের বর্ষাকাল পর্যন্ত ।



বর্ষাকালের আর খুব বেশি দেরি নাই । সঙ্কট অবসানের সম্ভাবনায় অনেক মালো উদ্বেগের পাহাড় ঠেলিয়া চলিয়াছে, হাতে ঠেলা-জাল লইয়া চুনো-পুঁটি যা পায় ধরিয়া পোয়া দেড়-পোয়া চাউলের যোগাড় করিতেছে । কিন্তু গৌরাঙ্গ মালোর দিন আর চলিতে চায় না । একদিন অনেক খানাডোবায় খেউ দিয়া কিছুই পাইল না, নামিলে টগবগ করিয়া পচা জলের ভুরভুরি উঠে, আর খেউ দিলে তিনচারিটা ব্যাঙ্ জাল হইতে লাফাইয়া এদিকে ওদিকে পড়িয়া যায় ।

উঠানের একদিকে একটা ডালিম গাছ । পাতা শুকাইয়া গিয়াছে । গৌরাঙ্গসুন্দরের বউ লাগাইয়াছিল । বউ যৌবন থাকিতেই শুখাইয়া গিয়াছিল । গাল বসিয়া, বুক দড়ির মত সরু হইয়া গিয়াছিল । বুকের স্তনদুটি বুকেই বসিয়া গিয়াছিল তার । তারপর একদিন সে মরিয়া গিয়াছিল । সে মরিয়া গিয়া গৌরাঙ্গকে বাঁচাইয়াছে । তার কথা  গৌরাঙ্গসুন্দরের আর মনে পড়ে না । তারই মত শুকাইয়া-যাওয়া তারই হাতের ডালিম গাছটা চোখে পড়িতে আজ মনে পড়িয়া গেল । উঃ, বউটা মরিয়া কি ভালই না করিয়াছে ! থাকিলে, আজ তার অবস্থা হইত ঠিক নিত্যানন্দদাদার মত ।

নিত্যানন্দ থাকে উত্তরের ঘরে । তার বউ আছে । আর আছে একটি ছেলে, একটি মেয়ে । নিত্যানন্দ-পরিবারের দিকে চাহিয়া গৌরাঙ্গ শিহরিয়া উঠে ! একপেটের ভাবনা নিয়াই বাঁচি না, দাদা চারিটা পেটের ভাবনা মাথায় করিয়া কেমন তামাক খাইতেছে । তার যেন কোন ভাবনাই নাই ।

সত্যি নিত্যানন্দের আর কোন ভাবনা নাই । যতই ভাবিয়াছে, দেখিয়াছে কোন কূল-কিনারা পাওয়া যায় না । বৌ ঝিমাইতেছে । ছেলেমেয়ে দুইটা নেতাইয়া পড়িয়া কিসের নির্ভরতায় অক্ষম নিত্যানন্দের মুখের দিকে চাহিয়া আছে । আর নিত্যানন্দ কোন উপায় না দেখিয়া কেবল তামাক টানিতেছে ।

পশ্চিমের ভিটায় গৌরাঙ্গসুন্দরের ঘর । ডালিম গাছে কাঁধের জাল ঠেকাইয়া দিয়া ডোলাটা ছুঁড়িয়া ফেলিল দাওয়ার একদিকে । দক্ষিণ ও পূর্বদিকের ভিটা খালি । তাদের দুই কাকা থাকিত । এক কাকা মরিয়া গিয়াছে এবং তার ঘর বেচিয়া তার শ্রাদ্ধ করিতে হইয়াছে । আরেক কাকা ঘর ভাঙিয়া লইয়া আরেক গাঁয়ে ছাড়িয়া গিয়াছে ।

গৌরাঙ্গ অকারণে খেঁকাইয়া উঠিল, ‘খালি তামুক খাইলে পেত ভরব ?’

‘কি খামু তবে ?’

না, লোকটার কেবল পেটই শুকায় নাই । মাথাও শুকাইয়া গিয়াছে ।

‘চল যাই বুধাইর বাড়ি ।’

নয়ানপুরে বোধাই মালো টাকায় সব মালোদের চেয়ে বড় । বাড়িতে চার পাঁচটা ঢেউটিনের ঘর । দুই ছেলে রোজগারী লোক । বোধাই হাতীর মত মোটা ও কাল । শরীরেও হাতীর মত জোর । তার কারবার অন্য ধরণের । বড় বড় দীঘি ইজারা নিয়া মাছের পোনা ফেলে । মাছ বাড়িতে থাকে, আর তারা তিন বাপ বেটায় লোকজন লইয়া জাল ফেলে, মাছ তোলে, মাছ চালান দেয় । এ কাজে বোধাই অনেক লোকজন খাটায় । নদীতে জল না থাকিলে, মালোরা যখন দুই চোখে অন্ধকার দেখে তখন তারা যায় বোধাইর বাড়িতে ।



কিন্তু তিতাসে কত জল ! কত স্রোত ! কত নৌকা ! সব দিক দিয়াই সে অকৃপণ ।

আর বিজয়-নদীর তীরে-তীরে যে-মালোরা ঘর বাঁধিয়া আছে, তাদের কত কষ্ট । নদী শুকাইয়া গেলে তাদের নৌকা-গুলি অচল হইয়া থাকে আর কাঠ-ফাটা রোদে কেবল ফাটে ।

তিতাস-তীরের মালোরা যারা সেখানে বেড়াইতে গিয়াছে, চৈত্রের খরায় নদী কত নিষ্করুণ হয় দেখিয়া আসিয়াছে । রিক্ত মাঠের বুকে ঘূর্ণির বুভুক্ষা দেখিতে দেখিতে ফিরতি-পথে তারা অনেকবার ভাবিয়াছে, তিতাস যদি কোনোদিন এই রকম করিয়া শুকাইয়া যায় ! ভাবিয়াছে এর আগেই হয়ত তাদের বুক শুকাইয়া যাইবে , ভাবিতে ভাবিতে হঠাৎ পাশের জনকে নিতান্ত খাপছাড়াভাবে বলিয়াছেঃ ‘বিজ্ নার পারের মালোগুষ্টি বড় অভাগা রে ভাই, বড় অভাগা !’

যারা বিজয় নদীর দশা দেখে নাই, বছরের পর বছর কেবল তিতাসের তীরেই বাস করিয়াছে, তারা এমন করিয়া ভাবে না । তারা ভাবে তিন-কোণা ঠেলা-জাল আবার একটা জাল ! তারে হাঁটু-জলে ঠেলিতে হয়, উঠে চিংড়ির বাচ্ছা । হাত তিনেক তো মোটে লম্বা । বিজয়ের বুকে তা-ই ডোবে না । তিতাসের জলে কত বড় বড় জাল ফেলিয়া তারা কত রকমের মাছ ধরে । এখানে যদি তিতাস নদী না থাকিত, বিজয় নদী থাকিত, তবে নাকের চারিদিক থেকে বায়ুটুকু সরাইয়া রাখিলে যা অবস্থা হয়, তাদের ঠিক সেই রকম অবস্থা হইত । ওদের মতো থেলা-জাল ঘাড়ে করিয়া গ্রামগ্রামান্তরের খানা-ডোবা খুঁজিয়া মরিতে হইত দুই আনা এর দশ পয়সার মোরলা ধরিবার জন্য ।

জেলেদের বউ-ঝিরা ভাবে অন্যরকম কথা – বড় নদীর কথা যারা শুনিয়াছে । যে-সব নদীর নাম মেঘনা এর পদ্মা । কি ভীষণ ! পাড় ভাঙ্গে । নৌকা ডোবায় । কি ঢেউ । কি গহীন জল । চোখে না দেখিয়াই বুক কাঁপে ! কত কুমীর আছে সে-সব নদীতে । তাদের পুরুষদের মাছ ধরার জীবন । রাতে-বেরাতে তারা জলের উপরে থাকে । এতবড় নদীতে তারা বাহির হইত কি করিয়া ! তাদের নদীতে পাঠাইয়া মেয়েরা ঘরে থাকিতই বা কেমন করিয়া ! তিতাস কত শান্ত । তিতাসের বুকে ঝড়-তুফানের রাতেও স্বামীপুত্রদের পাঠাইয়া ভয় করে না । বৌরা মনে করে স্বামীরা তাদের বাহুর বাঁধনেই আছে, মায়েরা ভাবে ছেলেরা ঠিক মায়েরই বুকে মাথা এলাইয়া দিয়া শান্ত-মনে মাছ-ভরা জাল গুটাইতেছে ।



বাংলার বুকে জটার মতো নদীর প্যাঁচ । শাদা, ঢেউ-তোলা জটা । কোন্ মহাস্থবিরের চুম্বন-রস-সিক্ত বাংলা । তার জটাগুলি তার বুকের তারুণ্যের উপর দিয়া সাপ-খেলানো জটিলতা জাগাইয়া নিম্নাঙ্গের দিকে সরিয়া পড়িয়াছে । এ সবই নদী ।

সবগুলি নদীর রূপ এক নয় । উহাদের ব্যবহার এবং উহাদের সহিত ব্যবহার তাও বিভিন্ন রকমের । সবগুলি নদীই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কাজে আসে । কিন্তু এ কাজে আসার নানা ব্যতিক্রম আছে । বড় নদীতে সওদাগরের নৌকা আসে পাল উড়াইয়া । উহার বিশাল বুকে জেলেরা সারাদিন নৌকা লইয়া ভাসিয়া থাকে । নৌকায় রাঁধে, খায়, ঘুমাইয়া থাকে । মাছ ধরে । সব বিষয়ে একটা কোঠর রূপ এখানে প্রকটিত । তীরে তীরে বালুচর, তাল নারিকেল সুপারির বাগ । স্রোতের খরায় তীরের মাটি কাটে, ধ্বসে । ঢেউয়ের আঘাতে তীরগুলি ভাঙিয়া খসিয়া পড়ে । গৃহস্থালি ভাঙ্গে । ক্ষেত খামার ভাঙ্গে, তাল-নারিকেল, সুপারির গাছগুলি সারি বাঁধিয়া ভাঙিয়া পড়ে । ক্ষমা নাই । ভাঙ্গাগড়ার এক রুদ্র দোলার দোলনায় করাল এক চিত্তচঞ্চল ক্ষিপ্ত আনন্দ । সে-ই এক ধরণের শিল্প ।

শিল্পের আরেকটা দিক আছে । সৌম্য শান্ত করুণ স্নিগ্ধ প্রসাদগুণের মাধুর্যে রঞ্জিত এ শিল্প । এ শিল্পের শিল্পী মহাকালের তাণ্ডবনৃত্য আঁকিতে পারে না । পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না । এ শিল্পের শিল্পী মেঘনা, পদ্মা, ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করিয়াছে ।

এ-শিল্পী যে-ছবি আঁকে তা বড় মনোরম । তীর-ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট শিল্পী । তারপর জমি । তাতে অঘ্রাণ মাসে পাকা ধানের মৌসুম । মাঘ মাসে সর্ষেফুলের অজস্র হাসি । তারপর পল্লী । ঘাটের পর ঘাট । সে ঘাটে জীবন্ত ছবি । মা তার নাদুস-নুদুস ছেলেকে ডুবাইয়া চুবাইয়া তোলে । বৌ-ঝিরা সব কলসী লইয়া ডুব দেয় । পরক্ষণে ভাসিয়া উঠে । অল্প দূর দিয়া নৌকা যায়, একের পর এক । কোনটাতে ছই থাকে, কোনটাতে থাকে না । কোনো কোনো সময় ছইয়ের ভিতর নয়া বউ থাকে । বাপের বাড়ি থেকে স্বামী তার বাড়িতে লইয়া যায়; তখন ছইয়ের এ-পারে ও-পারে থাকে বউয়ের শাড়ি-কাপড়ের বেড়া । স্বামীর বাড়ি থেকে যখন বাপের বাড়িতে যায়, তখন কিন্তু কাপড়ের বেড়া থাকে না । থাকে না তার মাথায় ঘোমটা । ছইয়ের বাহিরে বসিয়া ঘাটগুলির দিকে চাহিয়া থাকে সে । স্বামীর বাড়ির ঘাট অদৃশ্য না হইলে কিন্তু সে ছইয়ের বাহিরে আসে না ।

তারা স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি আর বাপের বাড়ি থেকে স্বামীর বাড়ি যায় অনেক হাসি-কান্নার ঢেউ বুকে লইয়া । যে বৌ স্বামীর বাড়ি যায়, তার এক চোখে প্রজাপতি নাচে, আরেক চোখে থাকে জল । এরা সব ভিন্ জাতের বৌ । বামুন, কায়েত, নানা জাতের । জেলেদের বৌরা জেলে-নৌকাতেই যায় । তারা অত সুন্দরীও নয় । অত তাদের আবরুরও দরকার হয় না । কিন্তু ওরা খুব সুন্দরী । জেলের ছেলেরা কপালের দোষ দেয় । অমন সুন্দর বৌ তাদের জীবনে কোনদিন আসিবে না । ভালো করিয়া চায় তারা । ভালো করিয়া চাহিতে পারিলে প্রায়ই ছইয়ের ফাঁক দিয়া, বাতাসে শাড়িটা একটু সরিয়া গেলে, চকিতে তারই ফাঁক দিয়া, টুকটুকে একখানা মুখ আর এক জোড়া চোখ চোখে পড়িবে । বৌয়ের অভিভাবক ছইয়ের দুই মুখে গুঁজিয়া দিয়াছে শাড়ির বেড়া; তাতে বৌকে সকলে দেখিতে পারে না, কিন্তু বৌ সকলকে দেখিতে পায় । তিতাসের জলে অনেক মাছ । মালোর ছেলের স্ফূর্তি রসাইয়া উঠে । জালের দিকে চোখ রাখিয়াই গাহিয়া উঠে, ‘আগে ছিলাম ব্রাহ্মণের মাইয়া করতাম শিবের পূজা, জালুয়ার সনে কইরা প্রেম কাটি শণের সুতা রে, নছিবে এই ছিল ।’ বৌ ঠিক শুনিতে পাইবে ।

গ্রামের পর গ্রাম । নৌকাখানা সেখানে ঢুকিয়া পড়ে । সাপের জিহবার মত চকিতে সে-খাল গ্রামখানাকে ঘুরিয়া কোথায় পলাইয়া গিয়াছে । হয়ত আরো দূরে গিয়াছে । আরো কয়েকখানি গ্রামের পাশ দিয়া জের টানিতে টানিতে গিয়া, তারই কোনটাতে বৌকে লইয়া যাইবে । খালের পাড়েই বাড়ি । ছোট্ট ছেলে-পিলেরা তৈরি হইয়া আছে, বৌকে কি করিয়া চমকাইয়া দিবে । তৈরি হইয়া আছে হয়ত আরও কেউ । খালটা এইখানে শুকাইয়া গিয়াছে । এইখানে নৌকা হইতে উঠিয়া বৌকে খানিকটা হাটিয়া যাইতে হইবে । শিল্পী শান্ত সবুজ সুন্দর রঙে ক্ষেতগুলির বুকে-বুকে যে নক্সা আঁকিয়া রাখিয়াছে তাহারই আল দিয়া বৌকে হাটিতে হইবে । তিতাসের তীরে না থাকার কি কষ্ট । যে-বউয়ের যাওয়ার বাড়ি একেবারে তিতাসের তীরে, কর্ম-চঞ্চল ঘাটখানাতে তার নৌকা লাগে । দশ-জোড়া নারীর চোখের দবদে স্নান করিয়া সে বৌ নৌকা থেকে নামে । তারপর বাপের বাড়ি হইলে এক দৌড়ে ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট ভাইবোনদের বুকে চাপিয়া ধরে । আর স্বামীর বাড়ি হইলে পিঠের কাপড় সুদ্ধ টানিয়া তুলিয়া ঘোমটা বড় করে, তারপর আগে-পিছে দুই-চারিজন নারীর মাঝখানে থাকিয়া ধীরে ধীরে জড়িত পায়ে ঘাটের পথটুকু অতিক্রম করে ।



পথটুকু অতিক্রম করিয়া জমিলা বাহির-বাড়ির মসজিদ-লগ্ন মক্তবের কোণে পা দিয়া একবার পিছন ফিরিয়া চাহিল । তার স্বামী মাঝির সঙ্গে তখনও কেরায়া নিয়া দরদস্তর করিতেছে । দুই-এক আনা ফেলিয়া দিলেই মাঝি খুশি হইয়া চলিয়া যায় । বুড়া মাঝি । যা খাটিয়াছে ! সঙ্গে মাত্র দুই ননদ । তাও ননদের ছোট সংস্করণ ! সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিয়াছে । ভয় করে না বুঝি ! লোকটা যেন কি ! তাদের আসিতে বলিয়া নিজে আসিতেছে না । বাড়ির পথে বড় বড় ঘাস । সাপ বাহির হইয়াছে হইত । ব্যাঙ্ মনে করিয়া এখনই জমিলার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলে যদি ছোবল দেয় !

ছমির মিয়া হিসাবী লোক । কাউকে এক পয়সা ঠকায় না । বেহুদা কাউকে এক পয়সা বেশিও দেয় না । সব কাজ ওজন করিয়া করে । মাঝি হাত মানিয়া নৌকায় গিয়া উঠিলে, ছমিরের মনে অনাহূত এক ছোপ প্রসন্নতা রঙ গুলাইয়া দিল । আজ তার কিসের রাত ! এ রাতে কেউ কোন দিন মাঝিকে ঠকায় ! কেউ যেন না ঠকায় !

মাঝি দশ মিনিট ঝগড়া করিয়া যাহা পায় নাই, এক মিনিট চুপ করিয়া তাহার চারিগুণ পাইল ! চক্ চকে সিকিটা শাদা নদীর খোলসা অল্প আলোকে ভালো করিয়া দেখিয়া লইয়া লগিতে ঠেলা দিল ।

ছমির কাছে আসিলে জমিলার মনে হইল – এতক্ষণ এতগুলি সাপ তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটিকে ঘিরিয়া কিল্ বিল্ করিতেছিল, এখন সব কয়টা সরিয়া পড়িয়াছে । কি ভাল তার মানুষটি !

কিন্তু তার চাইতেও ভাল একজনকে দেখিয়া আসিয়াছে সেই মালোপাড়ার ঘাটে । বড় ভাল লাগিয়াছে তার মানুষটাকে । প্রথম দৃষ্টিতেই সে তাকে ভালবাসিয়া ফেলিয়াছে, সেও কি তেমনি ভালবাসে নাই ? কেমন অনুরাগের ভরে চাহিয়াছিল । আর কেমন মানুষ গো ! একবার দেখিয়াই মনে হইল যেন কতবার দেখিয়াছি । বেলা ফুরাইতেছে । একটু একটু বাতাস বহিতেছে । আর সেই বাতাসে আমার শাড়ির বেড়া খুলিয়া গেল, আর তখনই তাকে আমি দেখিতে পাইলাম । যদি না খুলিত, তবে ত দেখিতেই পাইতাম না । এমনই কত লোককে যে আমরা দেখিতে পাই না । অথচ দেখিতে পাইলে এমনি করিয়া আপন হইয়া যাইত । আমরা কি আর দেখি ? যে দেখাইবার, সে-ই দেখায় ! তা না হইলে সে যখন জলে ঢেউ খেলাইয়া কলসী ডুবাইল, ঠিক সেই সময়ে আমার শাড়ির বাঁধন খুলিল কেন ? বর্ষায় আমার বাপ ওদের গাঁয়ে ভিজা নালিতার আঁটি-বোজাই নৌকা লইয়া যায়, পাট ছাড়াইবার জন্য । আবার যখন বাপের বাড়ি যাইব, বাপকে বলিয়া রাখিব, এই রকম এই রকম মেয়েটি, দেখিতে ঠিক আমার মত । তার বাপকে বলিয়া দেখিও, আমার মেয়ে তোমার মেয়ের সঙ্গে সই পাতিতে চায়, তুমি রাজি আছ কিনা।


১.২ তিতাস একটি নদীর নাম

আগে যা বলিতেছিলাম ।

–         এ শিল্পী মহাকালের তাণ্ডব- নৃত্য আঁকিতে পারে না । পিঙ্গল জটার বাঁধন খসিয়া পড়ার প্রচণ্ডতা এ- শিল্পীর তুলিকায় ধরা দিবে না । এ শিল্পী মেঘনা-পদ্মা-ধলেশ্বরীর তীর ছাড়িয়া তিতাসের তীরে আঙিনা রচনা করে ।

এ শিল্পী যে ছবি আঁকে তা বড় মনোরম । তীর ঘেঁসিয়া সব ছোট ছোট গ্রাম । গ্রামের পর জমি । অগ্রহায়ণে পাকা ধানের মরসুম । আর মাঘে সর্ষেফুলের হাসি । তারপর আবার গ্রাম । লতাপাতা গাছগাছালির ছায়ায় ঢাকা সবুজ গ্রাম । ঘাটের পর ঘাট । সে ঘাটে সব জীবন্ত ছবি । মা তার নাদুস-নুদুস শিশু ছেলেমেয়েকে চুবাইয়া তোলে । অল্প একটু দূর দিয়া নৌকা যায় একের পর এক …।।



তিতাস একটি নদীর নাম । এ নামের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ তার তীরের লোকেরা জানে না । জানিবার চেষ্টা কোনদিন করে নাই, প্রয়োজন বোধও করে নাই । নদীর কত ভাল নাম থাকে – মধুমতী। ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, সরস্বতী, যমুনা । আর এর নাম তিতাস । সে কথার মানে কোনোদিন অভিধানে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না । কিন্তু নদী এ-নামে যত প্রিয়, ভালো একটা নাম থাকিলে তত প্রিয় হইতই যে, তার প্রমাণ কোথায় !

ভালো নাম আসলে কি ? কয়েকটা আখরের সমষ্টি বৈত নয় । কাজললতা মেয়েটিকে বৈদূর্যমালিনী নাম দিলে, আর যাই হোক, এর খেলার সাথীরা খুশি হইবে না । তিতাসের সঙ্গে নিত্য যাদের দেখাশুনা, কোনো রাজার বিধান যদি এর নাম চম্পকবতী কি অলকনন্দা রাখিয়া দিয়া যায়, তারা ঘরোয়া আলাপে তাকে সেই নামে ডাকিবে না, ডাকিবে তিতাস নামে ।

নামটি তাদের কাছে বড় মিঠা । তাকে তারা প্রাণ দিয়া ভালবাসে, তাই এর নামের মালা তাদের গলায় ঝুলানো ।

শুরুতে কে এই নাম রাখিয়াছিল, তারা তা জানে না । তার নাম কেউ কোনোদিন রাখিয়াছে, এও তারা ভাবে না । ভাবিতে বা জানিতেও চায় না । এ কোনোদিন ছিল না, এও তারা কল্পনা করিতে পারে না । কবে কোন্ , দূরতম অতীতে এর পারে তাদের বাপ পিতামহেরা ঘর বাঁধিয়াছিল একথা ভাবা যায় না । এ যেন চির সত্য, চির অস্তিত্ব নিয়া এখানে বহিয়া চলিয়াছে । এ সঙ্গী তাদের চিরকালের । এ না হইলে তাদের চলে না । এ যদি না হইত, তাদের চলিতও না । এ না থাকিলে তাদের চলিতে পারে না । জীবনের প্রতি কাজে এ আসিয়া উঁকি মারে । নিত্যদিনের ঝামেলার সহিত এর চিরমিশ্রণ ।



নদীর একটা দার্শনিক রূপ আছে । নদী বহিয়া চলে । কালও বহিয়া চলে । কালের বহার শেষ নাই । নদীরও বহার শেষ নাই । কতকাল ধরিয়া কাল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বহিয়াছে ! তার বুকে কত ঘটনা ঘটিয়াছে । কত মানুষ মরিয়াছে । কত মানুষ বিশ্রী-ভাবে মরিয়াছে – কত মানুষ না খাইয়া মরিয়াছে – কত মানুষ ইচ্ছা করিয়া মরিয়াছে – আর কত মানুষ মানুষের দুষ্কার্যের দরুণ মরিতে বাধ্য হইয়াছে । আবার শত মরণকে উপেক্ষা করিয়া কত মানুষ জন্মিয়াছে । তিতাসও কতকাল ধরিয়া বহিয়া চলিয়াছে । তার চলার মধ্যে তার তীরে তীরে কত মরণের কত কান্নার রোল উঠিয়াছে । কত অশ্রু আসিয়া তার জলের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে । কত বুকের কত আগুন, কত চাপা বাতাস তার জলে নিবিয়াছে । কতকাল ধরিয়া এ-সব সে নীরবে দেখিয়াছে, দেখিয়াছে আর বহিয়াছে । আবার সে দেখিয়াছে কত শিশুর জন্ম, দেখিয়াছে আর ভাবিয়াছে । ভাবী নিগ্রহের নিগড়ে আবদ্ধ এই অজ্ঞ শিশুগুলি জানে না, হাসির নামে কত বিষাদ, সুখের নামে কত ব্যথা, মধুর নামে কত বিশ তাদের জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে ।

ওরা কারা ? ওরা মালোদের ছেলেরা । আর মালোদের মেয়েরা । ওরা তারা নয় যাদের দেয়াল-ঘেরা বাড়ি, সামনে আছে পুষ্করিণী , পাশে আছে কুয়া, যাদের আঙ্গিনার পাড় থেকেই শুরু হইয়াছে পথ – সে পথ গিয়াছে শহরের দিকে, পাশের গাঁগুলিতে এক একটা শাখাপথ ঢুকাইয়া দিয়া । সে পথে ঘোড়ার গাড়ি চলে ।

আর মালোদের ঘরের আঙ্গিনা থেকে শুরু হইয়াছে যত পথ সে-সবই গিয়া মিশিয়াছে তিতাসের জলে । সে-সব পথ ছোট ছোট । পথের এধার থেকে বুকের শিশু কাঁদিয়া উঠিলে ওধার থেকে মা টের পায় । এধারের তরুণীর বুকের ধুক্ ধুকানি ওপারের নৌকার মাচানে বসিয়া মালোদের তরুণরা শুনিতে পায় । এপথ অতি খর্ব । দীর্ঘপথ গিয়াছে মাঝ-তিতাসের বুক চিরিয়া । সেপথে চলে কেবল নৌকা ।



তিতাস সাধারণ একটা নদী মাত্র । কোনো ইতিহাসের কেতাবে, কোনো রাষ্ট্রবিপ্লবের ধারাবাহিক বিবরণীতে এ নদীর নাম কেউ খুঁজিয়া পাইবে না । কেননা, তার বুকে যুযুধান দুই দলের বুকের শোণিত মিশিয়া ইহাকে কলঙ্কিত করে নাই । কিন্তু তাই বলিয়া তার কি সত্যি কোনো ইতিহাস নাই ?

পুঁথির পাতা পড়িয়া গর্বে ফুলিবার উপাদান এর ইতিহাসে নাই সত্য, কিন্তু মায়ের স্নেহ, ভাইয়ের প্রেম, বৌ-ঝিয়েদের দরদের অনেক ইতিহাস এর তীরে তীরে আঁকা রহিয়াছে । সেই ইতিহাস হয়ত কেউ জানে, হয়ত কেউ জানে না । তবু সে ইতিহাস সত্য । এর পারে পারে খাঁটি রক্তমাংসের মানুষের মানবিকতা আর অমানুষিকতার অনেক চিত্র আঁকা হইয়াছে । হয়ত সেগুলি মুছিয়া গিয়াছে । হয়ত তিতাসই সেগুলি মুছিয়া নিয়াছে ! কিন্তু মুছিয়া নিয়া সবই নিজের বুকের ভিতর লুকাইয়া রাখিয়াছে । হয়ত কোনোদিন কাহাকেও সেগুলি দেখাইবে না, জানাইবে না কারো সেগুলি জানিবার প্রয়োজনও হইবে না । তবু সেগুলি আছে । যে-আখর কলার পাতায় বা কাগজের পিঠে লিখিয়া অভ্যাস করা যায় না, সে-আখরে সে-সব কথা লেখা হইয়া আছে । সেগুলি অঙ্গদের মতো অমর । কিন্তু সত্যের মতো গোপন হইয়াও বাতাসের মতো স্পর্শপ্রবণ । কে বলে তিতাসের তীরে ইতিহাস নাই !

আর সত্য তিতাস-তীরের লোকেরা ! তারা শীতের রাতে কতক কতক কাঁথার তলাতে ঘুমায় । কতক জলের উপর কাঠের নৌকায় ভাসে ।। মায়েরা, বোনেরা আর ভাই-বৌয়েরা তাদের কাঁথার তলা থেকে জাগাইয়া দেয় । তারা এক ছুটে আসে তিতাসের তীরে । দেখে, ফরসা হইয়াছে; তবে রোদ আসিতে আরও দেরি আছে । নিস্তরঙ্গ স্বচ্ছ জলের উপর মাঘের মৃদু বাতাস ঢেউ তুলিতে পারে না । জলের উপরিভাগে বাষ্প ভাসে – দেখা যায়, বুঝি অনেক ধোঁয়া । তারা সে ধোঁয়ার নিচে হাত ডোবায়, পা ডোবায় । অত শীতেও তার জল একটু উষ্ণ মনে হয় । কাঁথার নিচের মায়ের বুকের উষ্ণতার দোসর এই মৃদু উষ্ণতাটুকু না পাইলে তারা যে কি করিত ।



শরতে আকাশের মেঘগুলিতে জল থাকে না । কিন্তু তিতাসের বুকে থাকে ভরা-জল । তার তীরের ডুবো মাঠময়দানে সাপলা সালুকের ফুল নিয়া, লম্বা লতানে ঘাস নিয়া, আর বাড়ন্ত বর্ষাল ধান নিয়া থাকে অনেক জল । ধানগাছ আর সাপলা সালুকের লতাগুলির অনেক রহস্য নিবিড় করিয়া রাখিয়া এ জল আরও কিছুকাল স্তব্ধ হইয়া থাকে । তারপর শরৎ শেষ হইয়া আসে । কে বুঝি বৃহৎ চুমুকে জল শুষিতে থাকে । বাড়তি জল শুকাইয়া গিয়া তিতাস নিচে থাকিয়া মাখনের মত নরম হইয়া গিয়াছিল, সে মাটি আবার কঠিন হয় । আসে হেমন্ত ।

হেমন্তের মুমূর্ষু অবস্থায় কখন ধানকাটার মরসুম শুরু হইয়া গিয়াছিল । পারে সব খানেই গ্রাম নাই । এক গ্রাম ছাড়াইয়া আরেক গ্রামে যাইতে মাঝে পড়ে অনেক ধানজমি । জমির চাষীরা ধানকাতা শেষ করিয়া ভারে ভারে ধান এদিক ওদিকের গ্রামগুলিতে বহিয়া নিয়া চলে । তারা তিতাসের ঠিক পাড়ে থাকে না । থাকে একটু দূরে । একটু ভিতরের দিকে । সেখান হইতে মাঘের গোড়ায় আবার তারা তীরে তীরে সর্ষে বেগুনের চারা লাগায় । তীরের যেখানে যেখানে বালিমাটির চর, সেখানে তারা আলুর চাষ করে । এ মাটিতে সকরকন্দ আলু ফলায় অজস্র ।



জোবেদ আলীর জোয়ান ছেলেরা ওপারে আলু লাগাইয়া তিন ভাইয়ে এক-সমানে আলী আলী আলী বলিয়া তাদের লম্বা ডিঙ্গিখানা ভাসাইয়া তাতে উঠিয়া পড়িল । বেলা পড়িয়া আসিয়াছে । হালের চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড় পার করাইতে হইবে । সে কাজ করিবে তাদের মুনীস-দুইজন । সাঁরা বছর তারা জোবেদ আলীর বাড়িতে জন খাটে । খায় দায়, মাহিনা পায় । সারাদিন – ভোর হইতে রাত-অবধি খাটে, রাতের খানিকটা সময় নিয়া নিজেদের বাড়িতে পরিবারের সান্নিধ্য লাভ করিয়া আসে । দিনমানে আর দেখা হয় না । পরিবারেরাও এর বাড়ি ওর বাড়ি ধান ভানিয়া পাট গুটাইয়া কিছু-কিঞ্চিৎ উপায় করে । এইভাবে দিন গুজরায় তারা । কাজেই জোবেদ আলীর ছেলেরা যখন আলী আলী আলী বলিয়া নৌকায় নদী পার হইতে থাকে, মুনীস-দুইজন তখন চারিজোড়া বলদ ও দুইজোড়া ষাঁড়ের অনিচ্ছুক দেহমন শীতের জলে নামাইয়া মাথায় পাগড়ি বাঁধিয়া গরুদের ল্যাজে ধরিয়া আল্লা আল্লা মোমিন বলিয়া সাঁতার দেয় । সকালে এপার হইতে ওপার যাইবার বেলা লাঙ্গল কাঁধে করিয়া সর্ষে ক্ষেত-গুলির আলের উপর দিয়া গিয়াছে । তীর-অবধি সর্ষেফুলের হলদে জৌলুষে হাসিয়া উঠিয়াছিল । মনে হইয়াছিল কে বুঝি তিতাসের কাঁধে নক্সা-করা উড়ানি পরাইয়া রাখিয়াছে । অর্বাচীন গরুগুলি পাছে তাতে মুখ দেয়, তার জন্য কত না ছিল সতর্কতা । এখন এ-পারে উঠিয়া গায়ের জল মুছিতে মুছিতে চারিদিক আঁধার হইয়া আসে । আঁধারে সব একাকার, গরু কোথায় মুখ দিবে ! দিনের শ্রমে শ্রান্ত গরু । আর শ্রান্ত আ দুইজন মানুষ সারাদিন অসুরের বল নিয়া ক্ষেতে খাটিয়াছে । এবার বাড়িতে যাইবে । তাই এত ব্যস্ততা । কিন্তু কার বাড়িতে যাইবে ! তাদের প্রভু জোবেদ আলীর বাড়িতে । নিজের বাড়িতে নয় । পাখিরাও এ সময় নিজের বাসায় যায় । তারা যাইবে মুনিবের বাড়িতে । গিয়া গোয়ালে গরু বাঁধিবে । ঘাস কাটিবে । মাড় দিবে, খইল ভুষি দিবে । জোতদার চাষীর বাড়িতে কত কাজ । এটা সেটা টুকিটাকি কাজ করিতে করিতে হাজারগণ্ডা কাজ হইয়া যায় । প্রকাণ্ড চওড়া উঠান । চার ভিটায় বড় বড় চারিটা ঘর । বাহিরের দিকে গোয়ালসুদ্ধ আরো তিন-চারিটা ঘর । দড়ি পাকানো হইতে বেড়াবাঁধা পর্যন্ত এই এতবড় বাড়িতে কত কাজ যে এই দুইজনের জন্য অপেক্ষা করিয়া থাকে । কাজ করিতে করিতে রাত বাড়িয়া চলে । এক দময় ডাক আসে – ‘অ করমালী অ বন্দালী খাইয়া যাও !’

খাওয়ার পর কাঁধের গামছায় মুখ মুছিতে মুছিতে পথে নামিয়া বন্দেআলী বলে, ‘ভাই করমালী নিজে ত খাইলাম্ ঝাগুর মাছের ঝোল । আমার ঘরের মানুষের একমুঠ শাক-ভাত আজ জুটল নি, কি জানি ?’

করমালী বলে, ‘বন্দালী ভাই, কইছ কথা মিছা না । তোমার আমার ঘরের মানুষ! তোমার আমার ঘরই নাই, তার আবার মানুষ। দয়া কইরা রাইতে থাকতে দেয়-থাকি; ফজরে উইঠ্যা মুনিবের বাড়ি গিয়া ঘুমের আলস ভাঙ্গি । ঘরের সাথে এইত সমন্দ। – কি খায়, কি পিন্ধে কোনোদিন নি খোঁজ রাখতে পারছি? তা যখন পারছি না তখন তোমার আমার কিসের ঘর আর কিসের মানুষ।’

বন্দেআলী খানিক ভাবিয়া নিয়া বলে, ‘বেবাকই বুঝি করমালী ভাই। তবু মুনিবের ঘরে পঞ্চ সামিগ্রী দিয়া খাইবার সময় ঘরের কথা মনে হয়; গলায় ভাত আইটকা যায় আর খাইতে পারি না।’

শুনিয়া করমালী বলে, ‘আমার কিন্তু তাও মনে পড়ে না। হ, আগে মাঝে মাঝে পড়ত। এখন দেখি, পড়ে না যে, ইটাই ভাল।’

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বন্দেআলী বলে, ‘সারাদিনের মেহ্ নতে নাস্তানাবুদ হইয়া ঘরে যাই, গিয়া দেখি ছিঁড়া চাটাইয়ে শুইয়া আছে। ঝুপ কইরা তার পাশে শুইয়া পড়ি; জাগাই না। – একদিন তার একখানা হাত আইয়া আমার বুকের উপর পইড়া যায়। হাতখানা হাতে লইয়া দেখি, কি শক্ত! কড়া পড়ছে পরের বাড়ির ধান ভানতে ভানতে।’

করমালীর বউ ধান ভানে না। লোকের বাড়ি-বাড়ি কাঁথা সেলাই করিয়া দেয়। কাঁথা সেলাইয়ের ধুম পড়িয়াছে। তার মোটে অবসর নাই। ডান হাতের সূঁচের ফোঁড় বাঁ হাতের আঙ্গুলের ডগায় তুলিতে তুলিতে আঙ্গুলে হাজার কাটাকাটি দাগ পড়িয়াছে। করমালী প্রায়ই ঘরে গিয়া দেখে বিছানা খালি।

একটু বিমর্ষ হাসি হাসিয়া করমালী বলিল, ‘বন্দালী ভাই, তুমি ত গিয়া দেখ, বউ ঘুমাইয়া রইছে। আমি ছিঁড়া খাঁথায় গাও এলাইয়া দিয়া পথের পানে চাইয়া থাকি। সে তখন পরের বাড়ির খাঁথা সিলাই করে, আর সে সুঁইচের ফোঁড় আমার বুকে আইয়া বিন্ধে। তার আইতে আইতে রাইত গহীন হয় – আগ-আন্ধাইরা রাইত – দেখি আন্ধাইর গিয়া চাঁদ উঠছে- ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে দিয়া রোশনি ঢুকে, কেডায় যেমুন ফক ফক কইরা হাসে!’

কথা শেষ হইলেও করমালীর মুখের ম্লান হাসিটুকু মিলাইয়া যায় না । বন্ধেআলীর বুক ছাপাইয়া আর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস বাহির হয়। কোনোরকমে সেটা চাপা দিতে দিতে বলে, ‘করমালী ভাই, আছ ভাল। কামে-কাজে থাক, খাও দাও। তার কথা মনে পড়ে না। মনে পড়ে খালি শুইবার সময়। আমার হইছে বিষম জ্বালা! উঠতে বইতে খালি মনে হয় তারে আমি দুখ দিতাছি। একটু সুখ না, শান্তি না- আমরা কি অভাইগ্যা ভাই করমালী?’

করমালী প্রায় দার্শনিক নির্লিপ্ততার সঙ্গে বলিল, ‘আমার ভাই অত কথায় কথায় শ্বাস পড়ে না! তুমি আমি বড় মুনিবের কাম করি, ভাল খাই! বউরা ছোট মুনিবের কাম করে, ভাল খাইতে পারে না। – আমরার জমি নাই, জিরাত নাই, পরের জমি চইয়া জান কাবার করি। যদি জমি থাকত তা’ অইলে বৌরা নিজেরার ঘরে খাটত, তোমারে আমারে মুনিবের মতো দেখত।’

বন্দেআলীর মন এই ধরণের চিন্তায় সায় দেয় না! সে ভাবে, করমালীর প্রেমিক মন বড় নিষ্ঠাহীন। তার মোটে স্ত্রীর প্রতি প্রেম ভালবাসা এসবের বুঝি কোনো দাম নাই। হাঁ দাম নাই-ই তো। তার মতো ভূমিহীন চাষীর কাছে এসবের কোনো দাম নাই। জীবনে যদি বসন্ত আসে তবেই এসবের দাম চোখে ধরা পড়ে। তাদের জীবনে বসন্ত আসে কই!



আসে বসন্ত। টি সময় মাঠের উপর রঙ্ থাকে না। তিতাসের তীর ছুঁইয়া যাদের বাড়িঘর তারা জেলে। তিতাসে মাছ ধরিয়া তারা বেচে, খায়। তাদের বাড়িপিছু একটা করিয়া নৌকা ঘাটে বাঁধা থাকে। বসন্ত তাদের মনে রঙের মাতন জাগায়।

বসন্ত এমনি ঋতু- এই সময় বুঝি সকলের মনেই প্রেম জাগে। জাগে রঙের নেশা। জেলেরা নিজে রঙ্ মাখিয়া সাজে – তাতেই তৃপ্তি পায় না। যাদের তারা প্রিয় বলিয়া মনে করে, তাদেরও সাজাইতে চায়। তাতেও তৃপ্তি নাই। যাদের প্রিয় বলিয়া মনে করে তারাও তাদের এমনি করিয়া রঙ্ মাখাইয়া সাজাক তাই তারা চায়। তখন আকাশে রঙ, ফুলে ফুলে রঙ্, পাতায় পাতায় রঙ্ । রঙ্ মানুষের মনে মনে। তারা তাদের নৌকাগুলিকেও সাজায়। বৌ-ঝিরা ছোট থালিতে আবির নেয়, আর নেয় ধানদূর্বা। জলে পায়ের পাতা ডুবাইয়া থালিখানা আগাইয়া দেয়। নৌকাতে যে পুরুষ থাকে সে থালির আবির নৌকার মাঝের গুরায় আর গলুইয়ে নিষ্ঠার সহিত মাখিয়া দেয়। ধানদূর্বাগুলি দুই অঙ্গুলি তুলিয়া ভক্তিভরে আবির-মাখানো জায়গাটুকুর উপর রাখে। এই সময়ে বৌ জোকার দেয়। সে-আবিরের রাগে তিতাসের বুকেও রঙের খেলা জাগে। তখন সন্ধ্যা হইবার বেশি বাকি নাই। তখনো আকাশ বড় রঙিন। – তিতাসের বুকের আরসিতে যে-আকাশ নিজের মুখ দেখে, সেই আকাশ।

চৈত্রের খরার বুকে বৈশাখের বাউল বাতাস বহে। সেই বাতাসে বৃষ্টি ডাকিয়া আনে। আকাশে কালো মেঘ গর্জায়। লাঙ্গল চাষা মাঠ-ময়দানে যে ঢল হয়, ক্ষেত উপচাইয়া তার জল ধারা-স্রোতে বহিয়া তিতাসের উপর আসিয়া পড়ে। মাঠের মাটি মিশিয়া সে-জলের রঙ্ হয় গেরুয়া। সেই জল তিতাসের জলকে দুইএক দিনের মধ্যেই গৈরিক করিয়া দেয়। সেই কাদামাখা ঠাণ্ডা জল দেখিয়া মালোদের কত আনন্দ। মালোদের ছোট ছোট ছেলেদেরও কত আনন্দ। মাছগুলি অন্ধ হইয়া জালে সহজে আসিয়া ধরা দেয়। ছেলেরা মায়ের শাসন না মানিয়া কাদাজলে দাপাদাপি করে। এই শাসন-না-মানা দাপাদাপিতে কত সুখ! খরার পর শীতলের মাঝে গা ডুবাইতে কত আরাম।



২.০১ প্রবাস খণ্ড

তিতাস নদীর তীরে মালোদের বাস। ঘাটে-বাঁধা নৌকা,মাটিতে ছড়ানো জাল, উঠানের কোণে গাবের মটকি, ঘরে ঘরে চরকি, তেক,তকলি – সুতা কাটার, জাল বোনার সরঞ্জাম। এই সব নিয়াই মালোদের সংসার।

নদীটা যেখানে ধনুকের মত বাঁকিয়াছে, সেইখান হইতে গ্রামটার শুরু। মস্ত বড় গ্রামটা, – তার দিনের কলরব রাতের নিশুতিতেও ঢাকা পড়ে না। দক্ষিণ পাড়াটাই গ্রামের মালোদের।

মাঘ মাসের শেষ তারিখে সেই মালোপাড়াতে একটা উৎসবের ধুম পড়িল। এটা কেবল কুমারীদের উতসব। নাম মাঘমণ্ডলের ব্রত।

এ-পাড়ার কুমারীরা কোনোকালে, অরক্ষণীয়া হয় না। তাদের বুকের উপর ঢেউ জাগিবার আগে, মন যখন থাকে খেলার খেয়ালে রঙিন, তখনই একদিন ঢোল সানাই বাজাইয়া তাদের বিবাহ হইয়া যায়। তবু বিবাহের জন্যে তারা দলে-দলে মাঘমণ্ডলের পূজা করে।

মাঘ মাসের ত্রিশদিন তিতাসের ঘাটে প্রাতঃস্নান করিয়াছে; প্রতিদিন স্নানের শেষে বাড়িতে আসিয়া ভাঁটফুল আর দূর্বাদলে বাঁধা ঝুটার জল দিয়া সিঁড়ি পূজিয়াছে, মন্ত্রপাঠ করিয়াচেঃ ‘লও লও সুরুজ ঠাকুর লও ঝুটার জল, মাপিয়া জুখিয়া দিব সপ্ত আঁজল।’ আজ তাদের শেষ ব্রত।

তরুণ কলাগাছের এক হাত পরিমাণ লম্বা করিয়া কাটা ফালি, বাঁশের সরু শলাতে বিঁধিয়া ভিত করা হয়। সেই ভিতের উপর গড়িয়া তোলা হয় রঙিন কাগজের চৌয়ারি-ঘর। আজিকার ব্রত শেষে ব্রতিনীরা সেই চৌয়ারি মাথায় করিয়া তিতাসের জলে ভাসাইবে, সঙ্গে সঙ্গে ঢোল-কাঁসি বাজিবে, নারীরা গীত গাহিবে।



দীননাথ মালোর মেয়ে বাসন্তী পড়িল বিষম চিন্তায়। সব বালিকারই কারো দাদা, কারো বাপ চৌয়ারি বানাইতেছে, – ফুলকাটা, ঝালরওয়ালা, নিশানা-উড়ানো কত সুন্দর চৌয়ারি, সংসারে তার একটি ভাইও নাই যে কোনরকমে একটা চৌয়ারি খাড়া করিয়া তার মাঘব্রতের শেষ-দিনের অনুষ্ঠানটুকু সফল করিয়া তুলিবে। বাপের কাছে বলিতে গিয়াছিল, কিন্তু বাপ গম্ভীর মুখে আগুন-ভরা মালসা, টিকা-তামাক-ভরা বাঁশের চোঙা, আর দড়িবাঁধা-কলকে-ওয়ালা হুকা লইয়া নৌকায় চলিয়া গিয়াছে। ‘কাঠায়’ লাগিয়া কাল তার জাল ছিঁড়িয়াছে, আজ সারা দুপুর বসিয়া গড়িতে হইবে।

মেয়ের এই মর্মবেদনায় মার মন দয়ার্দ্র হইল। তার মনে পড়িয়া গেল কিশোর আর সুবলের কথা। দুইটি ছেলেতে গলায় গলায় ভাব। এইটুকু বয়সেই ডানপিটে বলিয়া পাড়াতে নামও করিয়াছে। বাসন্তীর মার ভালই লাগে এই ডানপিটে ছেলেদের। ভয় ডর নাই, কোনো কাজের জন্য ডাকিলে উড়িয়া আসে, মা বাপ মানা করিলেও শোনে না। বিশেষতঃ কিশোর ছেলেটি অত্যন্ত ভাল, যেমন ডানপিটে তেমনি বিবেচক।

বাসন্তীর মার আহবানে কিশোর আর সুবল বাসন্তীর দাওয়ায় বসিয়া এমন সুন্দর চৌয়ারি বানাইয়া দিল যে, যারা দেখিল তারাই মুগ্ধ হইয়া বলিল, – বাসন্তীর চৌয়ারি যেন রূপে ঝলমল করিতেছে। নিশানে ঝালরে ফুলে উজ্জ্বল চৌয়ারিখানার দিকে গর্বভরে চাহিতে চাহিতে বাসন্তী উঠান-নিকানো শেষ করিলে, তার মা বলিল, ‘উঠান-জোড়া আলিপনা আকুম; অ বাবা কিশোর, বাবা সুবল, তোমরা একটা হাতী, একটা ঘোড়া, আর কয়টা পক্ষী আইক্যা দেও।’

বাল্যশিক্ষা বই খুলিয়া তাহারা যখন উঠানের মাটিতে হাতী ঘোড়া আঁকিতে বসিল, বাসন্তীর তখন আনন্দ ধরে না। সারা মালোপাড়ার কারো উঠানে হাতীঘোড়া নাই, কেবল তারই উঠানে থাকিবে। শিল্পীদের অপটু হস্তচালনার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া বাসন্তী এক সময় খুশিতে হাসিয়া উঠিল।

আলিপনার মাঝখানে বাসন্তী ছাতা মাথায় দিয়া একখানি চৌকিতে বসিল। ছাতাখানা সে আস্তে আস্তে ঘুরাইতে লাগিল এবং তার মা ছাতার উপর খই আর নাড়ু ঢালিয়া দিতে লাগিল; হরির লুটের মত ছেলেরা কাড়াকাড়ি করিয়া সে-নাড়ু ধরিতে লাগিল। সবচেয়ে বেশি ধরিল কিশোর আর সুবল।

নারীরা গীত গাহিতেছেঃ ‘সখি ঐ ত ফুলের পালঙ রইলো, কই কালাচাঁদ আইলো।’ বহুদিনের পুরানো গীত। সাত বছর আগে বাসন্তী যখন পেটে আসে, তখনও তারা এই গানই গাহিত উৎসবের এই দিনটিতে। আজও উহাই গাহিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে দুখাই বাদ্যকর ঢোল ও তার ছেলে কাঁসি বাজাইতেছে। প্রতি বছর একই রকম তালে তারা ঢোল আর কাঁসি বাজায়। আজও সেই রকমই বাজাইতেছে। সবই একই রকম আছে, পরিবর্তনের মাঝে কেবল দুখাইর ঢোলটা আরো পুরানো হইয়াছে, তার ছেলেটা আরো বড় হইয়াছে।



বাসন্তীর মাথায় জবজবে তেল, পরনে মোটা শাড়ি। এই কালকের থেকেই যেন আজ তাকে অনেকখানি বড় দেখাইতেছে । এই ভাবেই বাসন্তী আরো বাড়িয়া উঠিবে, এই ভাবেই কিশোরও বড় হইয়া উঠিবে, সুবলও বড় হইয়া উঠিবে। তবে কিশোর ছেলেটি অনেক ভাল, বাসন্তীকে তার পাশেই ঠিক মানাইবে । – বাসন্তীর মার চিন্তায় বাধা পড়িল মেয়ের ডাকেঃ ‘মা, ওমা, দেখ সুবলদাদা কিশোরদাদার কাণ্ড। আমি চৌয়ারি জলে ছাড়তে-না-ছাড়তে তারা দুইজনে ধরতে গিয়া কি কাইজ্যা। এ কয় আমি নিমু, হে কয় আমি নিমু। ডরে আর কেউ কাছেঅ গেল না। শেষে কি মারামারি! আমি কইলাম, দুইজনে মিল্যা বানাইছ, দুইজনেই নিয়া রাইখ্যা দেও। মারামারি কর কেনে? শুইন্ন্যা কিশোর দাদা ভালামানুষের মত ছাইড়া দিল । আর সুবলদাদা করল কি – মাগ্ গো মা, দুই হাতে মাথাত তুইল্যা দৌড়!’

সেদিন মালোপাড়ার ঘাটে ঘাটে সমারোহ। ঢোল সানাই বাজিতেছে, পুরনারীরা গান গাহিতেছে, দুপুরের রোদে তিতাসের জল চিক্ চিক্ করিতেছে। মালোর কুমারীরা আনকোরা শাড়ি পরিয়া, তেল-জবজবে মাথায় চিত্র-বিচিত্র চৌয়ারি তুলিয়া, জলে ভাসাইয়া দিবার উদ্যোগ করিতেছে। কিন্তু মালোর ছেলেদের তর সহিতেছে না। মেয়েরা অনুনয় করিতেছে, এখনই ধরিও না, জলে আগে ভাসাই, তখন ধরিও।

সব চৌয়ারিই জলে ভাসিল। ছেলেরা দৌরাত্ম করিয়া প্রায় সব কটাকেই ধরিল, কাড়াকাড়ি করিয়া ছিঁড়িল, এবং ভাঙ্গাচোরা অবস্থায় মাথায় করিয়া বাড়িতে ফিরিল। কিন্তু তাহাদের দস্যুতামুক্ত হইয়া কয়েকখানা চৌয়ারি তিতাসের মন্দ স্রোতে আর মৃদু তরঙ্গে অনেক বাহির-জলে চলিয়া গেল। তীর হইতে দেখা গেল যেন জলের উপর এক একটা ময়ূর পেখম ধরিয়াছে। কিন্তু তাদের যারা ভাসাইল, তারা সুখী হইল কি? ছেলেরাই যদি ধরিতে না পারিল, তবে মেয়েদের উহা ভাসাইবার সার্থকতা কই?

কিশোরের জন্য বাসন্তী মনে বড় ব্যথা পাইল! এমন সুন্দর চৌয়ারিটা সে পাইল না, পাইল সুবলে। কিন্তু সে ছাড়িয়া দিল কেন? এমন নির্বিবাদে, ভালোমানুষের মত ছাড়িয়া দিল! কিন্তু মনে যে কষ্ট পাইয়াছে তা ঠিক। মানুষটাই এই ধাচের। বন্ধু যেন আর লোকের থাকে না! মানি, বন্ধু নিতে চাহিলে কোনো জিনিস নিজে আঁকড়াইয়া থাকে না। কিন্তু বন্ধুর জন্য চোখ বুজিয়া ভাল জিনিস এমন ছাড়িয়াও কেউ দেয় না!



সুবলের বাপ গগন মালোর কোনোকালে নাও-জাল ছিল না। সে সারাজীবন কাটাইয়াছে পরের নৌকার জাল বাহিয়া। যৌবনে সুবলের মা ভৎসনা করিত, ‘এমন টুলাইন্যা গিরস্তি কত দিন চালাইবা! নাও করবা, জাল করবা, সাউকারি কইরা সংসার চালাইবা! এই কথা আমার বাপের কাছে তিন সত্য কইরা তবে ত আমারে বিয়া করতে পারছ। স্মরণ হয় না কেনে?’

কিন্তু নিশ্চেষ্ট লোককে ভৎসনা করিয়া ফল পাওয়া যায় না।

‘খাইবা বুড়াকালে পরের লাথি উষ্ঠা; যেমন মানুষ তুমি।’ গগন এসব কথায়ও কর্ণপাত করে নাই।

বুড়া কাল যখন সত্যই আসিল, তখন বলিত, ‘অখন বুঝ নি?’ ইহার উত্তরে গগনচন্দ্র বলিত, ‘আমার সুবল আছে। আমি ত করতাম পারলাম না, নাও-জাল আমার সুবলে করব। অত ভেন্ ভেন্ করিস্ না।’

কাজেই সুবলের বাপ যখন মারা যায়, সুবলকে নৌকা গড়াইয়া দিয়া যাইতে পাড়ে নাই। সুবল ‘মাথা-তোলা’ হইয়া কিশোরের নৌকায় গিয়া উঠিল। এবং তার সঙ্গেই জাল বাহিয়া চলিল। নিজের নাও-জাল করার কথা আর তার মনেই আসিল না। কিশোর বয়সে তার মাত্র তিন বছরের বড়। আশৈশব বন্ধু তারা। তাদের মধ্যে ভাব ছিল গলায় গলায়। শৈশবে দুইজনে বর্ষাকালে সাপেভরা বটের ঝুড়িতে বসিয়া খোপের মধ্য দিয়া বঁড়শি ফেলিত। শিং মাছের জাল বুনিয়া আঁধার রাতে বুকজলভরা পাটক্ষেতের আল ধরিয়া অনেক দূরে গিয়া পাতিয়া আসিত। রাত থাকিতে উঠিয়া শিংমাছ-কৈমাছ-গাঁথা জাল তুলিয়া আনিত। এসব জালে অনেক সময় সাপ গাঁথা পড়ে। কিন্তু মালোর ছেলেরা তাতে ভয় পায় না। অনেক মালোর ছেলে এভাবে মারা পড়ে দেখিয়াও ভয় পায় না। কেননা অনেক মরিয়া গিয়াও তারা অনেক বাঁচিয়া থাকে।

একদিন দুইজনেরই বাপ তাদের পাঠশালায় পাঠাইল। প্রথম দিন তারা চুপচাপ কাটাইল। পরের দিন ভিন্নপাড়ার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করিয়া শিক্ষকের মার খাইল। তার পরের দিন নিজেদের মধ্যে মারামারি করিয়া শিক্ষকের হাতে যে মার খাইল, তাহার মাত্রা সহনাতীত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া দুইজনেই এক সঙ্গে বাহির হইয়া পড়িল। পাঠশালায় আর গেল না। গুরুজনের মার খাইল, তবু গেল না, বরং সেদিন কিশোর কলাগাছের খোল কাটিয়া চটি জুতার মতো পরিল, সাথীকে ধমকাইয়া বলিল, ‘হেই সুবলা, দেখ্, আমি বৈকণ্ঠ চক্রপত্তি, তুই আমারে ভক্তি দে।’

শিক্ষকের কাকা বৈকণ্ঠ চক্রবর্তী চটিপায়ে উঠানে রোদে বসিয়া তামাক টানিত আর পালেরা বণিকেরা পথ চলিতে তাঁহাকে পা ধরিয়া প্রণাম করিয়া যাইত। কিশোর ইহা লক্ষ্য করিয়াছিল।

তারপর একদিন দুইজনেরই উপর তাগিদ আসিল- সুতা পাকাও, জাল বোনো ।

তিতাস নদীর প্রশস্ত তীর। সেখানে এক দৌড়ের পথ লম্বা করিয়া সুতা মেলিত। বাঁশের চরখিতে কাঠি লাগাইয়া দুইজনে এক দুই তিন বলিয়া এমন জোরে পাক লাগাইত যে, কাঠি ভাঙ্গিয়া চরখি কাত হইয়া মাটিতে পড়িয়া যাইত। বর্ষায় যে বটের ঝুরিতে বঁড়শি  ফেলিত, সুদিনে তারই তলা ছিল গরমের দুপুর কাটাইবার উত্তম স্থান। জাল লইয়া দুইজনে সেখানে গিয়া বসিত। জাল পায়ের বুড়া আঙ্গুলে ঠেকাইয়া দুইজনেই সমান গতিতে তকলি চালাইত। তাতে জালে অনেক বাজে গিট পড়িত সত্য কিন্তু বোনা খুব আগাইত।

তারপর এক সময়ে কিছুদিন আগেপিছে দুইজনেরই নাও-জালে হাতেখড়ি হইল। অল্প দিনের মধ্যেই পাকা জেলে বলিয়া পাড়ার মধ্যে নাম হইয়া গেল।



মাছের জো ফুরাইয়া গিয়াছে। মালোদের অফুরন্ত চাহিদা মিটাইতে গিয়া, দিতে দিতে তিতাস ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে।

দুপুর পর্যন্ত জাল-ফেলা জাল-তোলা চলিল, কিন্তু একটি মাছও নৌকায় ফেলিতে পারিল না। জালের হাতায় হ্যাঁচকা একটা টান মারিয়া কিশোর বলিল, ‘জগৎপুরের ডহরে যা সুবনা, ইখানে ত জালে-মাছে এক করা গেল না।’

কিন্তু ডহরের অতলস্পর্শী জল জালের খুঁটিতে দীর্ণ-বিদীর্ণ করিয়াও মাছের হদিস মিলিল না। কিশোর পায়ের তলা হইতে বাঁশের গুড়ি ছাড়িয়া দিয়া একটানে বাঁধ খুলিয়া ফেলিল। আচমকা আঘাতে ডহরের নিস্তরঙ্গ জল কাঁপিয়া উঠিল। তারই দিকে চাহিয়া কিশোর বলিল, ‘জান্ বাঁচাইতে চাস্ ত, উত্তরে চল্ সুবলা।’



একদিন কয়েকখানা নৌকা সাজিল। উত্তরে যাইবে। প্রবাসে। তাদের সঙ্গে কিশোরের নৌকাও সাজিল।

তারা পুরাণো ছই নূতন করিল, নৌকা ডাঙ্গায় তুলিয়া গাবকালি মাখাইল। জালগুলিকে কড়া গাব খাওাইয়া তিনদিন বিশ্রাম দিল। অতিরিক্ত কিছু বাঁশ আর দড়াদড়িও যোগাড় করিল।

কিশোরের বাপ সঙ্গে গেলে বাড়িতে থাকিবার কেউ থাকে না। বুড়া মানুষ বাড়িতে থাকিয়া সকাল সন্ধ্যা ঘাটে কিনিয়া-বেচিয়া যা পাইবে, সংসার চালাইবে। আরেকজন ভাগীদার দেখা দরকার।

কিশোরের বাপ ভাবিয়া দেখিল, দুইজনই বালক, কোনোদিন বড় নদী দিয়া বিদেশ যায় নাই। সেখানে গিয়া অনেক কথা বলিতে হইবে। বুদ্ধি বিবেচনা খরচ করিতে হইবে। ডাকাতে ধরিয়া জাল ছিনাইয়া নিতে চাহিলে, সামান্য জাল নিয়া কেবল গরীবকেই মারা হইবে, আর কোনো লাভ হইবে না বলিয়া ডাকাতের মন ভিজাইতে হইবে। একজন বয়স্ক লোকের দরকার। জলের উপর ছয় মাস চরিয়া বেড়াইতে হইবে। তিলকচাঁদ প্রবীণ জেলে। একটু বেশী বুড়া। তা হোক। সঙ্গে দুইজন জোয়ান মানুষ ত রহিলই।

রাব-তামাক মাখিয়া গুল করিতে করিতে কিশোরের বাপ বলিল, ‘তিলকচাঁদ জানেশুনে। তারে নে। গাঁওএর নাম শুকদেবপুর। খলার নাম উজানিনগরের খলা। মোড়লের নাম বাশিঁরাম মোড়ল।’

একদিন ঊষাকালে তিনজন নৌকায় উঠিল।

বিদায় দিবার জন্য নদীর পারে যারা গেল, তাদের সংখা সামান্য। একজন আধবুড়ি – কিশোরের মা। আর একজন বাসন্তীর মা, আর তার মেয়ে বাসন্তী – এগারো বছরের কুমারী কন্যা।

বুড়ি বলিল, ‘অ মাইয়ার মা, জোকার দেও না।’

বুড়ির ঠোঁটে জোকার বাজে না। বাসন্তীর ও তার মা জোকার দিল। দেড়জনের উলুধ্বনি বলিয়া তাহা ঊষার বাতাসকে কাঁপাইল মাত্র। কলরব তুলিল না। কিশোরের বাপ নদীতীরে যায় নাই। ঘরে বসিয়া ঘনঘন কেবল তামাক টানিতেছিল। ছেলেকে বিদায় দিয়া ঘরে আসিয়া বুড়ি কাঁদিয়া উঠিল।

পাঁচপীর বদরের ধ্বনি দিয়া প্রথম লগি-ঠেলা দিল তিলক। সুবল হালের বৈঠা ধরিল। তার জোর টানে নৌকা সাপের মতো হিস্ হিস্ করিয়া ঢেউ তুলিয়া ঢেউ ভাঙ্গিয়া চলিল। তিলকচাঁদ গলুইয়ে গিয়া দাঁড় ফেলিয়াছে। কিন্তু তার দাঁড়ে জোর বাঁধিতেছেনা। শুধু পড়িতেছে আর উঠিতেছে। ছইএর উপর একখানা হাত রাখিয়া কিশোর মাঝ-নৌকায় দাঁড়াইয়া ছিল। দেখিতেছিল তাদের মালোপাড়ার ঘরবাড়ি গাছপালা-গুলি, খুঁটিতে বাধা নৌকাগুলি, অতিক্রান্ত ঊষার স্বচ্ছ আলকেও কেমন অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে। অদৃশ্য হইয়া যাইতেছে সারাটি গ্রাম, আর গোচারণের মাঠ। অদৃশ্য হইতেছে কালীসীমার ময়দান আর গরীবুল্লার বটগাছ দুইটি। জলের উষ্ণতায় শীতের প্রভাতী হাওয়াও কেমন মিষ্টি। গলুইর দিকে আগাইয়া গিয়া কিশোর বলিল, ‘ যাও তিলক, তামুক খাও গিয়া। দাঁড়টা দেও আমার হাতে।’



তিতাস যেখানে মেঘনাতে মিলিয়াছে, সেইখানে গিয়া দুপুর হইল। কিশোর দাঁড় তুলিয়া খানিক চাহিয়া দেখিল। অনুভব করিল মেঘনার বিশালত্বকে, আর তার অতলস্পর্শী কালো জলকে। এপারের শক্ত মাটিতে এক সময়ে ভাঙ্গন হইয়া গিয়াছে। এখন আর ভাঙিতেছে না। কিন্তু ভাঙনের জয়পতাকা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে পর্বতের মতো খাড়া পাড়টা। ছোট ছোট ঢেউয়ে মসৃণ হইয়া রহিয়াছে বড় বড় মাটির ধ্বস্ । ওপারে – অনেক দূরে, যেখানে গড়ার সমারোহ – দেখা যায় সাদা বালির ঢালা রূপালি বিছানা, ভাঙিয়াছে গাছে-ছাওয়া জনপদ, গড়িয়াছে নিষ্ফলা ধু ধু বালুচর।

তিলককে ভাত চাপাইতে বলিয়া কিশোর গলুইয়ে একটু জল দিয়া প্রণাম করিল। তারপর আবার দাঁড় ফেলিল।

সন্ধ্যা হইল ভৈরবের ঘাটে আসিয়া।

এখানে কয়েকঘর মালো থাকে। ঘাটে খুঁটি-বাঁধা কয়েকটি নৌকা, পাড়ে বাঁশের উপর ছড়াইয়া দেওয়া কয়েকটি জাল, পাশে গাবের মটকি গামলা বেতের ঝুড়ি – দেখিতেই চেনা যায় এখানে মালোরা থাকে।

গ্রামের পাশে সূর্য ঢাকা পড়িলেও আকাশে একটু একটু বেলা আছে। নৌকা বাহিলে আরো একটা বাঁক ঘোরা যাইত কিন্তু সম্মুখে রাত কাটাইবার ভাল জায়গা তিলক স্মরণ করিতে না পারায় কিশোর বলিল, ‘এই জাগাতই রাইত থ্যাইক্যা যাই রে সুবলা।’

এখান হইতে বাড়িগুলিও দেখা যায়। গ্রাম আগে বড় ছিল। মালোদের অনেক জায়গা রেলকোম্পানি লইয়া গিয়াছে। বৃহত্তর প্রয়োজনের পায়ে ক্ষুদ্র আয়োজনের প্রয়োজন অগ্রাহ্য হইয়া গিয়াছে। তবু এ গাঁয়ের মালোরা গরীব নয়। বড় নদীতে মাছ ধরে। রেলবাবুদের পাশে থাকে। গাড়িতে করিয়া মাছ চালান দেয়। তারা আছে মন্দ-না।

‘কিশোরদা, ভৈরবের মালোরা কি কাণ্ড করে জান কি? তারা জামা-জুতা ভাড়া কইরা রেলকম্পানির বাবুরার বাসার কাছ দিয়া বেড়ায়, আর বাবুরাও মালোপাড়ায় বইআ তামুক টানে আর কয়, পোলাপান ইস্কুলে দেও, – শিক্ষিৎ হও, শিক্ষিৎ হও।’

তিলক ক্ষেপিয়া উঠিয়া বলিল, ‘হ, শিক্ষিৎ হইলে শাদি-সম্বন্দ করব্ কি না! আরে সুবলা, তুই বুঝবি কি! তারা মুখে মিঠা দেখায়, চোখ রাখে মাইয়া-লোকের উপর।’

ব্যাপারটার মীমাংসা করিয়া দিল কিশোর; হাসিয়া বলিল, ‘না তিলকচাঁদ, না। চোখ রাখে বড় মাছের উপর। যা শোনা যায় তা না। তা হইলে কি জাইন্যাশুইন্যা নগরবাসী এই গাঁওএ সমন্দ ঠিক করত।’

‘কিশোরদাদা, চল মাইয়ারে একবার দেইখ্যা যাই। বাড়ি বাড়ি।’

মেয়েরা দিনের শেষে জল ভরিতে আসিয়াছে। দলে দেখা গেল কয়েকটি কুমারী কন্যাকে।

কিশোর চোখ টিপিয়া বলিল, ‘গিয়া কি করবি? এর মধ্যে থাইক্যা দেইখ্যা রাখ।’



২.০২ প্রবাস খণ্ড

সারারাত সুখে ঘুমাইয়া তারা ঊষার আলোকে নৌকা খুলিয়া দিল।

ভৈরব খুব বড় বন্দর। জাহাজ নোঙর করে। নানা ব্যবসায়ের অসংখ্য নৌকা। কোনো নৌকাই বেকার বসিয়া নাই। সব নৌকার লোক কর্ম-চঞ্চল। নৌকার অন্ত নাই। কারবারেরও অন্ত নাই। লাভের বাণিজ্যে সকলেই তৎপর, আপন কড়াগণ্ডা বুঝিয়া পাইবার জন্য সকলেই ব্যস্ত। যারা পাইয়াছে তারা আর অপেক্ষা করিতেছে না। আগের যারা অবেলায় পাইয়াছে, তারা রাতটুকু কাটাইয়া কিশোরের নৌকা খোলার সময়েই নৌকা খুলিয়াছে। বেশির ভাগ গিয়াছে- যে দিক হইতে আসিয়াছে সেই দিকে; কিশোরেরা যাইতেছে সামনের দিকে। বন্দরের এলাকা পর্যন্তই কর্মচাঞ্চল্য । এর সীমা অতিক্রম করিতেই দেখা গেল সকল প্রাণস্পন্দন থামিয়া গিয়াছে।

বন্দরের কলরব ধীরে ধীরে পশ্চাতে মিলাইয়া গেল। সম্মুখে বিরাট নদী তার বিশালতা লইয়া চুপ করিয়া পড়িয়া আছে। শীতের নদী। উত্তরের হাওয়া সরিয়া গিয়াছে। দক্ষিণের বাতাস এখনো বাহির হয় নাই! নদীতে ঢেউ নাই, স্রোতের বেগও নাই। আছে কেবল শান্ত তৃপ্ত স্বচ্ছ অবাধ জলরাশি। এই অনন্তের ধ্যান ভাঙিয়া, এই প্রশান্তের মৌনতা বিঘ্নিত করিয়া কিশোরের নৌকার দুইখানা দাঁড় কেবল উঠানামা করিতেছে।

এতক্ষণ কূল ঘেঁষিয়া চলিতেছিল। ঢালা বালিরাশির বন্ধ্যা কূল। লোকের বসতি নাই, গাছপালা নাই, ঘাট নাই। কোনোখানে একটি নৌকার খুঁটিও নাই। এমনি নিষ্করুণ নিরালা কূল। রোদ চড়িলে, শীত অন্তর্হিত হইল। সুদূরের ইশারায় এই নির্জনতার মাঝেও কিশোরের মনে যেন আনন্দের ঢেউ উঠিল। নদীর এই অবাধ উদার রূপ দেখিতে দেখিতে অনেক গানের সুর মনে ভাসিয়া উঠিল। অদূরে একটা নৌকা। এদিকে আসিতেছে। কিশোর গলা ছাড়িয়া জুড়িল –

উত্তরের জমিনে রে,               সোনা-বন্ধু হাল চষে,
লাঙ্গলে বাজিয়া উঠে খুয়া।
দক্ষিণা মলয়ার বায়                 চান্দমুখ শুকাইয়া যায়,
কার ঠাঁই পাঠাইব পান গুয়া।

নৌকাটা পাশ কাটাইবার সময় তারা কিশোরের গানের এই পদটি শুনিল –

নদীর কিনার দিয়া                 গেল বাঁশি বাজাইয়া,
পরার পীরিতি মধু লাগে।
কু-খেনে বাড়াইলাম পা’                  খেয়াঘাটে নাইবে না,
খেয়ানীরে খাইল লঙ্কার বাঘে।

একজন মন্তব্য করিল, ‘বুড়ারে দাঁড় টানতে দিয়া জোয়ান বেটা খাড়ইয়া রইছে, আবার রস কেমুন, পরার পীরিতি মধু লাগে।’

কিশোর আঘাত পাইয়া বলিল, ‘যাও তিলকচাঁদ, তুমি গিয়া ঘুমাইয়া থাক।’

তিলক নৌকার মালিকের আদেশ অগৌণে পালন করিল।

আবার নির্জনতা। যত দূর চোখ যায়, শুধু জল।

দাঁড়ের উপর মনের ঢালিয়া কিশোর বলিল, ‘বা’র গাঙ্ দিয়া ধরত দেখি সুবলা। খালি বালু দেখতে এর ভাল লাগেনা। ধর্ কোণাকুনি ধর্। পার বাইবি ত অই পার দিয়া ধর্। এই পারে কিচ্ছু নাই।’

কিন্তু ও-পার তখনো চোখের আড়ালে। যা দৃষ্টির বাহিরে, তারই হাতছানির মায়ায় তারা বিপদে পা দিল। কিশোরের বুক একবার একটু কাঁপিয়াছিল একটা গান মনে পড়িয়া ‘মাঝিভাই তোর পায়ে পড়ি, পার দেখিয়া ধর পাড়ি।’ কিন্তু শেষের কথাগুলি সুন্দর, ‘পিছের মাঝি ডাক দিয়া কয় নৌকা লাগাও প্রেম-তলায়। হরি বল তরী খুল সাধের জোয়ার যায়।’ কিশোর নিজের মনকে প্রবোধ দিল, বৈঠার আওয়াজ বেসুরা হইতেছে দেখিয়া সুবলকেও সাহস দিল, ‘না সুবলা, ডরাইসনা। গাঙের ডর মাইঝ গাঙে না, গাঙের বিপদ পারের কাছে। বা’র গাঙে মা-গঙ্গা থাকে, বিপদে নাইয়ারে রক্ষা করে।’

চিলকচাঁদের ঘুম ভাঙ্গিল। বাহিরে আসিয়া দেখে বেলা নাই। নৌকার লক্ষ্য যে তীরের দিকে, সে-তীরের ভরসা নাই, পশ্চাতে ফেলিয়া আসিয়াছে যে তীর, তারও ভরসা নাই।

শীতের বেলা ফুরাইল ত একেবারেই শেষ হইয়া গেল। নদীর উপর যাও বা একটু আলো ছিল তাও অদৃশ্য হইল। তারপর তারা কুলহারা হইয়া কেবল মেঘনার বুকেই নিরুদ্দেশ হইল না, আঁধারের বুকেও আত্মসমর্পণ করিল।

সুবল বৈঠা রাখিয়া ছইয়ের ভিতর আসিল, টিমটিমে একটা আলো তিলক জ্বালাইয়াছিল, সেটা রাগ করিয়া নিভাইয়া ফেলিল। তিলক তামাক টানিতেছিল, সেটা একটানা টানিয়া চলিল। শুধু কিশোর নিরাশ হইল না। সুবলের পরিত্যক্ত হালখানা হাতে লইয়া জোরে কয়েকটা টান দিল। হঠাৎ নৌকাটা কিসের উপর ঠেকিল, ঠেকিয়া একেবারে নিশ্চল হইয়া গেল। আতঙ্কিত হইয়া তিলক বলিয়া উঠিল, ‘আর আশা নাই সুবলা, কুমীরের দল নাও কান্ধে লইছে।’

‘আমার মাথা হইছে। নাও আটকাইছে চরে। বাইর অইয়া দেখ না।’

বাহির হইয়া দেখিয়া তিলক বলিল, ‘ইখানে পাড়া দে।’

রাত পোহাইলে দেখা গেল এখানে নদীর বুকে একটুখানি চর জাগিয়াছে, তারই উপরে লোকে নানা জাতের ফসল বুনিয়াছে। চারাগুলিতে ফুল ধরিয়াছে। পাখ্ পাখালিরাও খোঁজ পাইয়া সকাল বেলাতেই বসিয়া গিয়াছে। মেলার মতো।



ভোরের রোদে নৌকা খুলিয়া দুপুর নাগাদ অনেক পথ আগাইয়া তারা পূবপার ধরিল। ঘাটে নৌকা বাঁধা, পারে জাল টাঙানো – সেখানেও এক মালো পাড়া।

‘চিন নি চিলক, ইটা কি গাঁও?’

তিলক চিনিতে পারিলনা।

‘ইখানেই নাও, রাখ্ সুবলা। দুপুরের ভাত ইখানেই খাইয়া যাই।’

‘হ, খাওয়াইবার লাইগ্যা তারা তৈয়ার হইয়া রইছে।’

‘ভাত খামু নিজে রাইন্ধা, পরের আশা করি নাকি?’

ঘাটে সারি সারি নৌকা বাঁধা। তারই একটার পাশে সুবলা নৌকা ভিড়াইল।

একজন নৌকায় বসিয়া ছেঁড়া জাল গড়িতেছিল। কৌতূহলী হইয়া আগন্তুক-নৌকার দিকে তাকাইল। মালোদের নৌকা, দেখিলেই চেনা যায়। ভিড়িতেই, কোন্ গ্রামের নৌকা, কথায় যাইবে জিজ্ঞাসা করিল।

তারাও জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, গ্রামের নাম নয়াকান্দা। ত্রিশ-চল্লিশ ঘর মালো থাকে। নয়া বসতি করিয়াছে। আগে ছিল পশ্চিম পারের এক শিক্ষিত লোকের গ্রামে। নদীর পারে যেখানে তারা নৌকা বাঁধিত জাল ছড়াইত, জমিদার সে-জমি তাদের নিকট হইতে জোর করিয়া ছিনাইয়া অন্য জাতের কাছে বন্দোবস্ত দিয়াছে। তাই তারা সেই অবিচারের গ্রাম ছাড়িয়া এখানে আসিয়া নূতন বাড়ি বাঁধিয়াছে। এখানে জমিদার নাই। বেশ শান্তিতে আছে। হাটবাজার দূরে। কিন্তু ঘাটে নৌকা আছে, দেহে ক্ষমতা আছে। তারা দূরকে সহজেই নিকট করিতে পারে।

কিশোর মুগ্ধ হইয়া শুনিতে শুনিতে হাতের হুক্কা তার দিকে বাড়াইয়া দিল।

‘আমার হুক্কাও আইতাছে। দেও আগে তোমারটাই খাঁই।’

এই সময়ে একটি ছোট দিগম্বরী হৃষ্টপুষ্ট মেয়ে আসিতেছে দেখা গেল। বাড়ি থেকে হুক্কা লইয়া আসিয়াছে। শরীরের দুলানির সঙ্গে সঙ্গে হুক্কাটা ডাইনে-বাঁয়ে দুলিতেছে। নৌকার কাছে আসিয়া ডাকিল, ‘বাবু, আমারে তোল্ ।’

মেয়ের হাত হইতে হুক্কা লইয়া কিশোরের দিকে বাড়াইয়া লোকটি বলিল, ‘আমি খাই তোমার হুক্কা, তুমি খাও আমার ঝিয়ের হুক্কা। – আমার ঝি।’

মেয়ের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি গো মা, জামাই দেখছ নি! বিয়া দিয়া দেই?’

‘কার ঠাঁই?’

এই বুড়ার ঠাঁই।’

‘ননা, বুড়ার ঠাঁই না। আমার জামাই হইব যবুনার জামাইর মত সুন্দর। মায় কইছে।’

‘তা অইলে এই জামাইর ঠাঁই দেই?’

কন্যাকর্তা সুবলের দিকে হাতের তকলি বাড়াইল। সুবল কিশোরের দিকে চাহিয়া মুচকিয়া হাসিল।

‘নাও লইয়া আইছ, নিয়া যাইবার বুঝি?’

সুবল বলিল, ‘হ, লইয়া যামু অনেক দূর। এই দেশের কাওয়ার মুখও দেখতে পারবা না।’

মেয়ের চিন্তিত মুখ দেখিয়া বাপের দয়া হইল, ‘না না আমার মায়েরে যাইতে দিমু না। জামাই আমরা ঘর-জামাই রাখুম।’

বাড়ি যাইবার সময় লোকটি কিশোরকে বলিয়া গেল, ‘শোন মালোর পুত, তোমরার পাক আমার বাড়িতে হইব। আমার ঝি তোমরারে নিমন্তন করল। – কি কও?’

‘না না আমরা নাওই রান্ধুম। তুমি খাও গিয়া। রাইতের জালে যাও বুঝি।‘

‘ইখানে রাইতের জাল বাওন লাগে না। বেহানে কটা বিকালে কটা খেউ দিলেই হয়। অদৈন্য মাচ। কত মাছ ধরবায় তুমি।’

লোকটি মেয়েকে স্নান করাইল, নিজে স্নান করিল, গামছা পরিয়া কাপড় নিংড়াইয়া কাঁধের উপর রাখিল। তারপর মেয়েকে কোলে তুলিয়া গ্রামপথে পা বাড়াইল। কিশোরের চোখে ভাসিয়া উঠিল সুন্দর একটি পরিবারের ছবি, যে-পরিবারে একটি নারী আছে একটি নন্দিনী আছে, আর পুরুষকে সারারাত নদীতে পড়িয়া থাকিতে হয় না। তার মনে একটা ঔদাস্তের সুর খেলিয়া গেল। নির্লিপ্তকণ্ঠে বলিল, ‘কইরে সুবলা, কি করবে কর। – নাও ভাসাইয়া দিমু।’



কিছুই করিতে হইল না। গলায় মালা কপালে তিলক একজনকে পল্লীপথে বাহির হইয়া আসিতে দেখা গেল। তার মুখময় হাসি। কোনো ভূমিকা না করিয়াই বলিল, ‘দেখ মালোর পুত। দোহাই তোমার দোহাই তোমার বাপের। আমার ঘাটে যখন নাও লাগাইছ, সেবা না কইরা যাইতে পারবায় না।’

সবল তার কথা বলার ভঙ্গী। প্রত্যেকটি কথা আত্ম-প্রত্যয়ে সুদৃঢ়। কিশোরের মৃদু প্রতিবাদ তৃণের মতো উড়িয়া গেল।

খাইতে বসিলে, সেই নন্দিনী-গর্বিত পাত্রান্বেষী লোকটি বলিল, ‘এ-ই। তখনই আমি মনে করছিলাম, আমার হাতে ছাড়া পাইলেও সাধুর হাতে ছাড়ান নাই। তাই ঘাটে কিছু না কইয়া জানাইয়া দিলাম সাধুরে।’

খাওয়ার পর সাধু ধরিল, আজ রাতটুকু থাকিয়া যাও। একটু আনন্দ করিবার বাসনা হইয়াছে।

তিলক বলিল, ;আমরা ত বাবা গান জানি না।’

‘জান না! কোন্ জায়গাতে বিরাজ কর তোমরা?’

‘গ্রামের নাম গোকনঘাট – ’

‘আমি সেই কথা কই না। আমি কই, তোমরা বিরাজ কর বৃন্দাবনে না কৈলাসে – তোমরা কৃষ্ণমন্ত্রী না শিবমন্ত্রী।’

তিলকের সেই কোন যৌবনকালে গুরুকরণ হইয়াছিল। গুরু তার কানে কৃষ্ণমন্ত্রই দিয়াছে। যদিও সে দীক্ষা অনুযায়ী কোন কাজই আজ পর্যন্ত করিয়া উঠিতে পারিল না, তবু গুরুর তিন আখরের মূলমন্ত্র ভোলে নাই। সাধুর প্রশ্নে সে একটুও ইতস্তত না করিয়াই বলিল, ‘আমরা বাবা কিষ্ণমন্ত্রী ।’

‘এই দেখ, গুরু মিলাইছে। আনন্দ করার গানে ত জানা-অজানার কথা উঠে না বাবা, কেবল নামের রূপ-মাধুরী পান করতে হয়। ষোল নাম বত্রিশ আখরের মাঝে প্রভু আমার বন্ধন-দশায় আছে। শাস্ত্রে কয় বৃন্দাবনে অপ্রাকৃত মদনমোহন। বিবর্তবিলাসের কথা। সে হইল নিত্য-বৃন্দাবনের কথা। তিনি লীলা-বৃন্দাবনে আইসা সুবলাদি সখা আর ললিতাদি সখিসহ আদ্যাশক্তি শ্রীমতী রাধিকারে লইয়া লীলা কইরা গেছে। সেই লীলা-বৃন্দাবনে অখন আর তানরা নাই। আছেন নিত্য-বৃন্দাবনে। সেই নিত্য-বৃন্দাবন আছে এই দেহেরই মধ্যে। তবেই দেখ-তানরা এই দেহের মধ্যেই বিরাজ করে। তারপর নদীয়া নগরের প্রভু গৌরাঙ্গ-অবতারের কথাখান ভান না কেনে। পদকর্তা কইচেঃ আছে মানুষ গ সই, আছে মানুষ গওরচান্দের ঘরে, নিগুঢ় বৃন্দাবনে গ সই, আছে মানুষ।। এক মানুষ বৈকুণ্ঠবাসী, আরেক মানুষ কালোশশী, আরেক মানুষ গ’ সই, দেহের মাইঝে রসের কেলি করে – নিগুঢ় বৃন্দাবনে গ সই আছে মানুষ ।।’

কথাগুলির অর্থ তিলক কিছু কিছু বুঝিল। কিশোর ও সুবল মুগ্ধ আনুগত্যের দৃষ্টি দিয়া। বক্তার কথাগুলি উত্তমরূপে শুনিয়া লইয়া মনে মনে বলিল, এসব তত্ত্বকথা, অত্যন্ত শক্ত জিনিস। যে বুঝে সেই স্বর্গে যায়। আমি তুমি পাপী মানুষ। আমরা কি বুঝিব!

অনেক রাত পর্যন্ত গাল হইল। সাধু নিজে গাহিল। পাড়ার আরো দু’চারজন গাহিল। তিলকও তাহার জানা ‘উঠান-মাটি ঠনঠন পিড়া নিল সোতে, গঙ্গা মইল জল-তিরাসে ব্রহ্মা মইল শীতে’,গানটি গাহিল। সাধুর নির্বন্ধাতিশয্যে কিশোর আর সুবল দুইজনে তাহাদের গাঁয়ের সাধুর বৈঠকে শোনা দুই-তিনটা গান গাহিয়া সাধুর চোখে জল আনিল।

তাদের গান শুনিয়া-সাধু মুগ্ধ হইল। ততোধিক মুগ্ধ হইল তাদের সরল সাহচর্যে । মনে মনে বলিলঃ বৃন্দাবনের চির কিশোর তোমরা, কৃষ্ণে তোমাদের গোলকের আনন্দ দান করুক। আমাকে যেমন তোমরা আনন্দ দিলে তোমরাও তেমনি আনন্দময় হও।

পরদিন তারা এখান হইতে নৌকা খুলিল। ছপ্ ছপ্ ছলাৎ শব্দ করিয়া নৌকা দুই তরুণের দাড়ের টানে ঢেউ ভাঙিয়া আগাইয়া চলিল। তীরে দাঁড়াইয়া সাধু। নৌকা যতই দূরে যাইতেছে, তার দুই চোখ জলে ভরিয়া উঠিতেছে। তার কেউ নাই। সকলের মধ্যে থাকিয়াও সে একা। তারা আনন্দ করিতে জানে না, আনন্দ দিতে জানে না। যারা আনন্দ দিতে পারিল, তাকে একটানা দৈনন্দিনতার মধ্যে ফেলিয়া তারা ঐ দূরে সরিয়া যাইতেছে।

অকূল মেঘনার অবাধ জলরাশির উদার শুভ্র বুকের উপর একটি কালো দাগের মতো ছোট হইতে হইতে তারা এক সময় মিলাইয়া গেল।

সাধুর বুক ছাপাইয়া বাহির হইল একটি দীর্ঘশ্বাস। তারা দিয়া গেল অনেক কিছু, কিন্তু নিয়া গেল তার চাইতেও অধিক।



এইখানে পাড়াটা ধনুকের মত বাঁকিয়া গিয়াছে। বাঁকা অংশ জুড়িয়া স্রোতের আবর্ত এত জোরে পাক খাইয়া চলিতেছে যে, তীরে লাগিয়া অমন শক্ত মাটিকেও যেন করাত-কাটা করিতেছে, ছিন্নমূল তালগাছের মত ভাঙ্গিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে এক একটা অতিকায় মাটির ধস। ভাঙ্গনের এই সমারোহে পড়িয়া পাড়াটা খাড়া উঁচু হইয়া উথিয়াচে। দেখিলে ভয় হয়! ইহার নিকট দিয়া নৌকা চালাইতে বিপদের আশঙ্কা আছে। যদি একটি ধ্বস ভাঙ্গিয়া নৌকার উপরেই পড়ে। যা স্রোত! আগানো বড় কঠিন। তবু আগাইতে হইবে।

সকাল হইতে নৌকা বাহিয়া সুবল দুপুরে খাইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। একটানা রাতের-জালে যাওয়ার এমনি অবভাশ। জালে না গেলেও রাতে চোখে ঘুম আসে না। দুপুরে চোখে ঘুম আসে, ঘুমাইতে হয়। তিলক সে কাজ দুপুরের আগেই সারিয়াছে। হুকা হাতে শুইয়া ছিল। হাতের হুকা হাতেই ছিল। দেখিয়া মনে হইয়াছিল যেন চাহিয়াই আছে। চোখ খলা। অথচ এরই মধ্যে ঘুমাইয়া নিয়াছে। এখন গলুইয়ে বসিয়া ঝপাঝপ দাঁড় ফেলিতে ফেলিতে জলের দিকে চাহিয়া বলিল, ‘এইবার যা মাছ পরব কিশোর! জলের রূপখান চাইয়া দেখ্ ।’

মেঘনার বিশালতা এখানে অনেক কমিয়া গিয়াছে। ভাঁটিতে থাকিতে এপার হইতে ওপার একটা রেখার মতো দেখা যাইত। এখন উজানে আসিয়া, এপারে থাকিয়া ওপারের খড়ের ঘরগুলি পর্যন্ত সুস্পষ্ট দেখা যাইতেছে।

বিকালে ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া সুবল অবাক হইল।

‘তিলক, ইটা কোন্ গাঙ্?’

‘কোন্ গাঙ্ আবার । যে-গাঙ্ দিয়া আসা অইসে।’

‘ইখানে মেঘনা অত ছোট?’

‘যত উজানে যাইবা ততই ছোট।’

‘আরো কত উজানে যাইতে হইব? উজানি-নগরের খলা আর কতদূর? শুকদেবপুরের বাঁশিরাম মোড়লের বাড়ি আর কতদুর?’

‘আবার ঘুমাইয়া থাক। একেবারে তাঁর ঘাটে নাও ভিড়াইয়া ডাক দিমু, হুক্কা হাতে লইয়া।’

‘যাও আর ঠিসারা কইর না।’

দূরে একখানা ছায়াচ্ছন্ন পল্লী। গাছপাতায় সবুজ। তাকে পাশে রাখিয়া যেন অকস্মাৎ নদী টানা ধনুকের মত বাঁকিয়া সোজা পশ্চিমের দিকের অদৃশ্য হইয়াছে। পশ্চিম পারের আড়ালে পড়ায় এখান হইতে তাকে আর দেখা যাইতেছে না। বাঁকানো ঢালা পার। পড়ন্ত রোদে তার বালিরাশি চিকচিক করিতেছে। সেই বালিঢালা পারের উপর একস্থানে দশ-বারখানি বড় বড় খড়ের ঘর। গাছপালা একটিও নাই; কোনোখানে সবুজের চিহ্নমাত্র নাই। কেবল বালি আর কয়েকখানা ঘর-মরুর বালুকায় পান্থ-নিবাসের মত। ব্যতিক্রম কেবল সচল অজগরের মত এলাইয়া পড়া নদীটি।

আরো একটু স্পষ্ট হইয়া উঠিলে তিলক তার বৃদ্ধ চক্ষু দুইটির প্রতি অসীম করুণায় কিঞ্চিৎ আবেগের সঙ্গে বলিল, ‘ঐ দেখা যায় শুকদেবপুর আর ঐ উজানিনগরের খলা।’

কিশোর আর কোন কথা বলিল না। যেখানটার পরে নদী আর দেখা যাইতেছেনা সেই দিকে চাহিয়া রহিল।



বাঁশিরাম মোড়লের ঘাটে যখন নৌকা ভিড়িল, তখন সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে।

মোড়ল খুব প্রতাপশালী লোক। এখানে নদীর পাঁচ মাইল তার শাসনে। এখানে মাছ ধরিতে হইলে তাঁরই সঙ্গে বন্দোবস্ত করিতে হয়।

পরদিন সকালে মোড়লের বাড়ি হইতে নিমন্ত্রণ আসিল, দুপুরে তাঁর বাড়িতে সেবা করিতে হইবে।

দুপুরে স্নান করিয়া তিনজনে সেখানে উপস্থিত হইল।

মোড়লের বাড়িতে চার ভিটাতে চারিটি খড়ের ঘর। সংস্কারাভাবে জীর্ণ। তারই একটার বারান্দায় বসিয়া সে এক বাক্স রূপার টাকা গুনিতেছে। তার শরীর পাথরের মত নিরেট, অসুরের মত শক্ত। রঙ কালো। বয়স পঞ্চাশের উপর। কিন্তু মাংসে চামড়ায় বার্ধক্য ধরে নাই। কণ্ঠার দুইপাশের মোটা হাড়ে অজস্র দৈহিক বলের পরিচয়। কিশোর মনে মনে বলিল, ‘তোমার মত মুনীসের পঁচিশটায় শ’। তোমার চরণে দণ্ডবৎ।’

মোড়ল তার নূতন জেলেদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইল।

‘নাম ত জানলাম কিশোর। পিতার নাম ত জানলাম না।’

‘পিতার নাম রামকেশব।’

‘হ, চিনতে পারছি। তোমরা ক’ ভাই।

‘ছোট এক ভাই আছিল; মারা গেছে। অখন আমি একলা।’

‘পুত্রসন্তান কি?’

‘আমার পুত্রসন্তান আমিই।’

‘হ, বুঝলাম। বিয়া করছ কই?’

কিশোর চুপ করিয়া রহিল। কথা বলিল সুবল। এইবার দেশে গিয়া করিবে। সম্বন্ধ নিজ গ্রামেই ঠিক হইয়া আছে।



রান্না যা কিছু হইয়াছে সবই বড়মাছের। কিশোরেরা ছোট মাছের জেলে। বড়মাছ বড় একটা মুখে পড়ে না, কেন না এ সব মাছ তারা ধরিতে পারে না। কোনোদিন কোনো বড় মাছ পথ ভুলিয়া তাদের জালে আসিয়া পড়িলেও পয়সার জন্য বেচিয়া ফেলিতে হয়।

মোড়ল খায় যেমন বেশি খাওয়ার উপর তার মনোযোগও তেমনি অখণ্ড। খাওয়ার ফাঁকে একবার তার অতিথিদের কথা মনে পড়িল।

‘জাল্লা ভাই, যা খাইবা কেবল হাতের জোরে।’

কিশোর কোন উত্তর দিতে পারিল না। কারণ আয়োজনের এত প্রাচুর্যের মধ্যে পড়িয়া তার খুব লজ্জা করিতে লাগিল। রুইমাছের মাথার খানিকটা চিবাইতে চিবাইতে উত্তর দিল তিলক, ‘কি যে তুমি কও মোড়ল।’

কিশোরেরও একটা কিছু বলা দরকার। নৌকার মহাজন সে। কিন্তু এসব উত্তর চাতুর্যপূর্ণ ভাষায় দিতে হয়। সে-ভাষা কিশোরের জানা নাই। সরল মানুষ সে। তার কথাও সরল; ‘আমার দেশে অত বড় মাছ পাওয়া যায় না। বড়মাছ অত বেশি আমরা খুব কম খাই।’

শুনিয়া মোড়ল গিন্নি আর এক বাটি মাছ আনিল। কিশোর প্রবল আপত্তি জানাইল, ‘না না, না না।’

মোড়ল- বৌ বুদ্ধিমতী। কিশোরের এঁটো পাতে বাটিটা শব্দ করিয়া ঠেকাইল। এবার কিশোরকে মাছগুলি খাইতেই হইবে।

মোড়ল-বৌ লম্বা ঘোমটা টানিয়া পরিবেশন করিয়াছে। মুখ দেখা যায় নাই। মুখ দেখা গেল খাওয়ার পর তারা বারান্দায় বসিলে যখন পান দিয়া গেল, তখন। মোড়ল চৌকির উপর বীরাসনে বসিয়াছে। তাকে ছেলেবেলার গল্পে-শোনা হনুমান ভীমাদি কোন বীরের মত দেখাইতেছে। কিশোর তাকে চোরা দৃষ্টিতে দেখিতেছে আর ভাবিতেছে, রাগ নাই অহংকার নাই, মানুষটার আছে কেবল শক্তি। উহার বুকের কাছটিতে একবার বসিতে পারিলে ঝড়তুফানেও কিছু করিতে পারিবে না।

এমন সময় গিন্নি স্বামীর হুকা দিয়া গেল। একটু পরে পানের বাটা সাজাইয়া আনিয়া চারিজনের মাঝখানে রাখিতেই তার ঘোমটা সরিয়া গেল। কিশোর মুহূর্তের জন্য তার মুখখানা দেখিতে পাইল। শ্যামাঙ্গী ক্ষীণকায় তরুণী। ভৈরবকায় মহাদেবের পাশে বালিকা-বধূ গৌরীকে যেমনটি দেখাইত এ-বৌ তাঁর পাশে বসিলে ঠিক তেমনই দেখাইবে। কিশোর চিন্তিত মনে বসিয়া রহিল।

মোড়ল বলিল, ‘কি ভাবছ, আমার স্তিরাচার।’

কিশোর আঘাত পাইল, ‘আমি বুঝি এই ভাবছি।’

‘আর কি ভাববা । আমার ঘরে এই ছাড়া আর কেউ নাই। আর যে ছিল, মারা গেছে সে। থাকলে তোমারে লইয়া অখন কত ঠার-ঠিসারা করত!’

‘মোড়ল!’

‘কি জাল্লা!’

‘তোমার দিকে চাইয়া আমার শিবঠাকুরের কথা মনে পড়ে। তোমার অত নামডাক, কিন্তু বাড়ি-ঘরের ছিরি নাই। তাজ্জবের কথা।’

মোড়ল তার আয়ত চোখ দুটি মেলিয়া তার স্নিগ্ধ দৃষ্টি কিশোরের চোখ দুটির মধ্যে ডুবাইয়া দিল।

‘আমার মনে পড়ে আরও একজন শিবের কথা। সে-শিব বুড়া। সকলের দরবারে তার নামডাক। কিন্তু ঘরে তার দৈন্যদশা।’

শিশুর মত বাধিত হইয়া মোড়ল বলিল, ‘ তুমি আমারে শিব ঠাকুর বানাইলা। না জাল্লা, তুমি আমারে বুড়া শিব বানাইলা, আমার গৌরী বড় ভাল, তারে আবার নাচাইও না।

আর, আমরা ত শিবমন্ত্রী না, আমরা কিষ্ণমন্ত্রী। তোমরা কোন্ দেশের দেশি।’

জবাব দিল তিলক, ‘বিন্দাবনের।’

‘অ, বুঝলাম, তোমরাও কিষ্ণমন্ত্রী। কিষ্ণে মিলাইছে। রাইতে আনন্দ কড়া চাই, মনে থাকে যেন। অখন একটু গড়াইয়া যাও।’

উত্তম ভোজন পাইলে তিলকের পেট উঁচু হইয়া উঠে, নির্লজ্জভাবে অস্তিত্ব সপ্রমাণ করে। উহার সম্বন্ধে সচেতন হইয়া তিলক বলিল, ‘ঠিক কথাই কইছ মোড়ল। যা খাওয়াইছ, গড়াইয়াই যাইতে লাগবে, খাড়া হইয়া জাওয়ার ভরসা খুব কম।’

রসিকতা। মোড়ল শশব্যস্তে প্রতিবাদ করিল, ‘সে কথা কই না জাল্লা, আমি কই পাটি বিছাইয়া দেউক, একটু গড়াইয়া লও, তারপর যাইও। রাইতে আমার উজাগর করতে লাগব।’

‘অ, একটা শীতলপাটি বিছাইয়া দিলে গড়াইয়া যাইতে পাড়ি।’

‘তুমি জাল্লা বড় ঢঙ্গী। তোমারে আমার বড় ভাল লাগে।’



সেদিন তারা আর নৌকাতে ফিরিল না। শীতলপাটিতে গড়াইয়া বিকালে পাড়া বেড়াইতে বাহির হইল। তিলক বুড়া মানুষ। তার কাপড় হাঁটুর নিচে নামে না। কিন্তু কিশোর সুবল ধুতি পায়ের পাতা অবধি ঢিলা করিয়া কার্তিকের মত কোমরে গেরো দিয়াছে। কাঁধে চড়াইয়াছে এক একখানা গামছা।

সুবলের বয়সের দোষ। সে শুধু দেখিল কার বাড়িতে ডাগর পাত্রী বিবাহের দিন গুনিতেছে। অনেককে দেখিল এবং সকলকেই মনে ধরিল। ইহাদের বাপ-মা সুবলকে লক্ষ্য করিতেছে এবং ওগো ছেলে, যাওয়ার পথে আমার মেয়েকে নিয়া যাইও, বাতাসে ভর করিয়া সুবলের কানে এই কথা পাঠাইতেছে, ইহা কল্পনা করিয়া সুবল মনে মনে পুলকিত হইয়া উঠিল।

কিশোর ভাবিতেছে আর একরকম কথা। এগাঁয়ের লোকগুলি কি স্বাস্থ্যবান! নারী-পুরুষ, ছেলে-বুড়া, সকলের গায়েই জোরের জোয়ার বহিয়া চলিতেছে, আটকায় সাধ্য কার। সকলেরই রঙ্ কালো। তবে হালকা রঙ্ চটা কালো নয়, তেলতেলে পাথরের সুগঠিত মূর্তির মত কালো। কিশোরের গাঁয়ের লোকও বেশির ভাগই কালো। কিন্তু মাঝে মাঝে পরিষ্কার লোকও আছে। নারীরাও অনেকেই কালো আবার অনেকেরই রঙ্ ফরসা। বাসন্তীর রঙ্ তো রীতিমত ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতের মেয়ের মত। কিন্তু এ গাঁয়ের নারী-পুরুষ সকলেই কালো।

আর একটা জিনিস কিশোরের চোখে পড়িয়াছে। এখানে ঘরেঘরে জাল যেমন আছে তেমনি হালও আছে। প্রত্যেক বাড়িতেই একপাশে জালের সরঞ্জাম, আর এক পাশে হালের সরঞ্জাম। একদিকে আছে গাবের মটকি, জালের পুটলি, দড়াদড়ি, ঝুড়ি ডোলা আরেকদিকে লাঙ্গল-জোয়াল, কাঁচি নিড়ানি, মই। অযত্নরক্ষিত ঘর দুখানার একখানাতে যেমন দুই এক পুরুষের পুরানো জালের পুটলি পুরাতন পঞ্জিকার মত জমিয়া উঠিয়াছে, তেমনি অন্যখানাতে বিভিন্ন বয়সের গরুবাছুরের ঘাসে ফেনে গোবরে থমথম করিতেছে। ইহাদের জীবনদেবতা আকাশের আদমসুরতের মত দুই দিকে আঙ্গুল বাড়াইয়া রাখিয়াছে। একদিকে নদী আছে ভরভর আর আরেকদিকে মাঠ ফসলে হাসি-হাসি। কোনোদিন কোন অদৃশ্য শয়তান যদি ইহাদের জালের গিঁটগুলি খুলিয়া দেয়, নৌকার লোহার বাঁধগুলি আলগা করিয়া ফেলে, আর নদীর জল চুমুক দিয়া শুষিয়া নেয়, ইহারা মরিবে না। ক্ষেতে শস্য ফলাইবে। এক হাতে ক্ষেতে শস্য ফলাইবে আরেক হাতে জালগুলি, নৌকাগুলি আগের মত ঠিক করিয়া লইবে। যথাকালে বর্ষার ঢল নামিয়া নদীটাকে আবার যৌবনবতী করিয়া দিবে। ইহারা মরিবে না। কিন্তু আমরাও কি মরিব! আমাদের গাঁয়ের মালোদের কারো খেত খামার নাই। কিন্তু তিতাস নদী আছে। তাকে শোষণ করিবে কে!

‘আরে, ও কিশোর, তামুক পাওয়া যায় কই! এক ছিলুম তামুক।’ তিলক এই বলিয়া কিশোরের ধ্যান ভঙ্গ করিল।



সন্ধ্যার পর গানের আসর বসিল।

প্রথম গান তুলিল তিলক। সুবল গোপীযন্ত্র বাজাইল। কিশোর কেবল হাততালি দিয়া মাথা দুলাইয়া তাল রাখিয়া চলিল।

কৃষ্ণমন্ত্রী শিবমন্ত্রী দুই মতের লোকই আসিয়াছে। প্রথমে আসর-বন্দনা গাওয়ার পর দেখা গেল, আর কোণে কয়েকজন গাঁজার কলকে সাজাইতেছে। তিলক ও-জিনিস কালেভদ্রে গ্রহণ করিয়া থাকে। এবারও এক টান কসিল। নাক দিয়া ধোঁয়া ছাড়িল। তারপর সুবলের দিকে রক্তচক্ষু করিয়া বলিল, ‘বাজাও’।

সুবল গোপীযন্ত্র পেটে ঘসিয়া তাল ঠুকিল।

মোড়ল মাঝ-আসরে বসিয়া ছিল। তার দিকে হাত বাড়াইয়া তিলক গান জুড়িল, ‘কাশীনাথ যোগিয়া – তুমি নাম ধর নিরাঞ্জন, সদাই যোগাও ভূতের মন, ভূত লইয়া কর খেলন, শিঙ্গা ডম্বুর কান্ধে লয়ে নাচিয়া’ –

অপর পক্ষের একজন বলিল, ‘গান বড় বে-ধারায় চলছে মোড়ল। ইখানে এই গানটা মানাইত – এক পয়সার তেল হইলে তিন বাতি জ্বালায়। জ্বেলে বাতি সারা রাতি ব্রজের পথে চলে যায়।’

মোড়ল নিষেধ করিতে জাইতেচিল, ‘বিদেশী মানুষ, ছন্দি ধর কেনে?’ কিন্তু তাহার মুখের কথা মুখেই রহিয়া গেল। অনেক দিনের অনভ্যাসের পর তিলকের মগজে গাঁজার ধোঁয়া গিয়াছে। সামলাইতে পারিল না। অনেক কষ্টে মাথা খাড়া রাখিবার চেষ্টা করিয়া এক সময় মোড়লের কোলের উপর এলাইয়া পড়িল। নেতৃহারা হইয়া কিশোরেরা আর গান গাহিল না। কেবল শুনিয়া চলিল। বিরোধী দল অনেক রকম গান গাহিবার পর যখন রাধাকৃষ্ণের মিলন গাহিয়া আসর শেষ করিল, তখন মোড়লের একটা লোক বাতাসার হাঁড়ি হাতে আগাইয়া আসিয়া কিশোরকে বলিল, ‘লও’। কিশোর স্বপ্নোত্থিতের মত সচেতন হইয়া হাত পাতিল, তারপর তিলককে ডাকিয়া তুলিল। তিলক যখন চোখ মেলিল, আসরে তখন ভাঙ্গন ধরিয়াছে।



নদীর বুকে সকাল বড় সুন্দর। তখনো সূর্য উঠে নাই। আকাশে নীলাভ সচ্ছতার আভাস। চারি দিকে নীলাভ শুভ্রতা। এ শুভ্রতা মাখনের মত স্নিগ্ধ। চারিদিকের অবাধ নির্মুক্তির মাঝে এ-স্নিগ্ধতার আলাপন মনের আনাচে কানাচে সুরধ্বনি জাগায়। নদীর বুকে লক্ষ লক্ষ তরঙ্গ-শিশুর অস্ফুট করতালি জাগায় যে মুক্ত বাতাস, তারই মৃদু স্পর্শ তিলককে বৃদ্ধ সঙ্কুচিত বুকখানাও পূর্ণতায় প্রসারিত করিয়া তুলিল।

পূবদিকে মোড়লদের পল্লী। গাছগাছালিতে ঢাকা উত্তর-দিকে নদীটা বাঁকিয়া বাঁ দিকে অদৃশ্য হইয়াছে। দক্ষিণ দিকে নদী একেবারে তীরের মত সোজা, যতদূর দৃষ্টি চলে কেবল জল আর জল। দুইটি তীরের বাঁধনে পড়িয়া সে-জল দৈর্ঘ্যে অবাধ। তিলকের দৃষ্টি, যেখানে নদীর জলে আর আকাশের কোলে একাকার হইয়া মিশিয়াছে, সেইখানে। তারও অনেক দক্ষিণ হইতে ভাসিয়া আসিতেছে ফাল্গুন মাসের এই মৃদুমন্দ হাওয়া। সেই দিকে চাহিয়া তিলক বুক ভরিয়া নিঃশ্বাস লইল। বড় উদার আর অকৃপণ সে হাওয়া।

নৌকার পিছন দিক খুঁটিতে বাঁধা। গলুই বাতাসের অনুকূলে উত্তর দিকে লম্বমান। মাঝ নৌকায় দাঁড়াইয়া তিলক কথা বলিল, ‘কিশোর, জাল লাগাইবার সময় হইছে।’

অন্ধকার পাতলা হইয়া আসার সঙ্গে সঙ্গে কিশোরের ঘুমও পাতলা হইয়া আসিয়াছে। তিলকের ডাকে তার শেষ সুতাটুকু ছিঁড়িয়া গেল।

কিশোর ক্ষিপ্র হাতে হুক্কা ধরাইয়া সুবলকে ডাকিয়া তুলিল। সুবল ঘুমের গাধা। কিন্তু হুক্কার আওয়াজ পাইয়া তারও ঘুম টুটিয়া গেল।

পাড়াটার আওতা ছাড়াইয়া তারা দক্ষিণে আগাইয়া গেল। পারের খানিকটা ঢালু। একটু উপর দিয়া সোজা একটা পায়ে-চলা পথ। তার ওপারে ধানজমি। যতদূর চোখ যায় কেবল ধানগাছ। ভোরের বাতাসে তাদের শিশুশিরগুলি দুলিতেছ, তাতে একটানা একটা শব্দ হইতেছে। আকাশ বাতাশ ঢেউ সব কিছুর প্রাতঃকালীন কোমলতার সহিত ভাল রাখিয়া এ শব্দের সুরও ক্রমাগত কোমলে বাজিয়া চলিয়াছে। কিশোরের চোখ জুড়াইয়া গেল। মোড়লের গ্রামের লোকেরা এ সকল ধানের জমি লাগাইয়াছে। ধান হইলে ইহারাই সব কাটিয়া নিয়া ঘরে তুলিবে। বাত্যা-বাদলায় নদীতে নামিতে না পারিলেও কিশোরের দেহসের মালোদের মত ইহাদের উপবাস করিতে হইবে না।

‘বাঁশটা আস্তে চালাইও তিলক। ধানগাছ নষ্ট না হয়। কার জানি এই ক্ষেত। মনে কষ্ট পাইব।’

‘তোমার যত কথা। কত রাখালে পাঁজনের বাড়ি দিয়া ক্ষেত নষ্ট করে, কত গাই-গরু চোরা-কামড় দিয়া ধানগাছের মাথা ভাঙ্গে, আমরারে চিলব কোন্ – ’

তিলকের অর্বাচীনতায় কিশোর চটিয়া উঠিল। কিন্তু এই স্নিগ্ধ সকালবেলার সহিত চটিয়া উঠা বড় বেমানান। কিশোরের মনের গোপনতায় যে সূক্ষ্ম শিল্পবোধ সব সময় প্রচ্ছন্ন থাকে, তারই ইঙ্গিত এবার তাকে চটিতে দিল না। সে আগেই তীরে নামিয়াছিল। তিলকের ছুঁড়িয়া-ফেলা বাঁশের আগাটা ক্ষিপ্রগতিতে ধরিয়া তার গতিরোধ করিল এবং তার উদ্যত আঘাত হইতে অবোলা ধানগাছগুলিকে বাঁচাইল।

জাল লাগানো শেষ হইলে কিশোর নৌকায় উঠিয়া বাঁশের গোঁড়ায় পা দিল। সুবল পাছার কোরায় হাত দিলে গলুইয়ে গিয়া তিলক লগি ঠেলিয়া নৌকা ভাসাইল। নৌকা মাঝ নদীতে পুরিয়া কুলি করিয়া জালে ‘বুলানি’ দিল।

কিছুক্ষণ ডুবাইয়া রাখিয়া কিশোর তাহার প্রথম খেউ তুলিল। ইঞ্চিপরিমাণ সরু সরু মাছ – রূপার মত রঙ্, ছোট ছোট ঢেউয়ের মত জীবন্ত। কিশোর ক্ষিপ্রহস্তে টানিয়া এক ঝটকায় ‘ডরা’তে ফেলিল, মাছগুলি অনির্বচনীয় ভঙ্গিতে নাচিতে লাগিল। প্রথম খেউয়ের মাছ দেখিয়া কিশোরের চক্ষু জুড়াইয়া গিয়াছে। মাছগুলি দেখিতে এই সকাল বেলার মতই স্নিগ্ধ।

এক সময়ে ধা করিয়া সূর্য উঠিল। নদীর উপর রোদ বিছাইয়া দিল। তাপের আভাস পাইয়া মাছ একযোগে অথই জলে ডুবিয়া গেল। এখন আর তারা জালে ধরা দিবে না। একবার কিশোর জালতা ধপাস করিয়া ফেলিল। এই রকমে ফেলার অর্থ – আজ এই পর্যন্তই। তিলক কোরা গুটাইয়া আগাইয়া আসিল। তারপর দুইজনে মিলিয়া দড়াদড়ির বাঁধাছাঁদা খুলিয়া ফেলিল।

মোড়ল আগেই ঘতে বসিয়াছিল। প্রথম দিনের মাছ দেখিয়া খুশি হইল। বলি, ‘ছোট জাল্লা, তোমার ত খুব সাইৎ। চল, মাছ ডাঙ্গিতে লইয়া যাই।’



সাঁ সাঁ করিয়া বসন্তের বাতাশ বহিয়া যায়, স্বচ্ছ জলের উপর ঢেউ তুলিয়া। কিশোর ক্ষণে ক্ষণে উন্মনা হইয়া যায়। নদীর তাতা থৈ থৈ নাচনের সঙ্গে তার বুকখানাও নাচিয়া উঠে। আকাশে রোদ বাড়ে। সে রোদ যেন নৌকার উপর, তিলকের সুবলের মাথার উপর, আর কিশোরের বুকের উপর সোনা হইয়া ঝরিয়া পড়ে। কোন্ অদৃশ্য শিল্পী এক না-দেখা মোহের তুলি বুলাইয়া তার মনের মাঝখানে অদৃশ্য আনন্দের এক একটা ছোপ লাগাইয়া যায়; থাকিয়া থাকিয়া তার মনে সম্ভব-অসম্ভব নানা রকম চিন্তার আবির্ভাব হয়। শুকদেবপুর পল্লিতা কখনো সুবলকে লইয়া একপাক ঘুরিয়া আসে। অনেক গাছগাছালি আছে শুকদেবপুরে। তাতে অনেক পাতা ঝরিয়া গিয়াছিল। এখন নূতন পাতা মেলিয়াছে। কি তুলতুলে মসৃণ পাতা। কিশোরের হৃদয়ের পরদার মত মসৃণ। চাহিয়া থাকিতে খুব ভাল লাগে। একটি বাড়িতে তুলসীতলার পাশে বেড়া দিয়া ফুলের গাছ করিয়াচে।অনেক সুন্দর ফুল ধরিয়াছে। পাপড়িগুলিতে কি সুন্দর বর্ণ-সমাবেশ। কি ফুল চিনিতে না পারিয়া কিশোর দাঁড়াইল। সামনা দিয়া এক কুমারী কন্যা যাইতেছে একগোছা সুতা হাতে করিয়া। কিশোর চলমান সুবলকে হাত ধরিয়া থামাইয়া বলিল, ‘দাঁড়া, ফুলেরে আগে দেইখ্যা লই। বন রঙিন ফুল। কিন্তু চিনতে পারলাম না। এই মাইয়ারে জিগা, ইটা কি ফুল কইয়া যাক্।’

অকবি সুবল, মনে রঙ-ধরা কিশোরের সমজদার সাথী হওয়ার অনুপযুক্ত সুবল, নিঃস্পৃহ কণ্ঠে বলিল, ‘তুমি জিগাও না, আমারে লইয়া টানাটানি কর কেনে?’

‘বেশ, আমিই জিগাই।’

বিচারকের সামনে আসামীর মত, এক ফোঁটা মেয়েটার সামনে জোয়ান কিশোর এতটুকু হইয়া গিয়া কোনো রকমে বলিল, ;বিদেশী মানুষ। এ দেশের এই ফুলেরে চিনলাম না। নামখান নি কইয়া যাইতে পার।’

মেয়েটি  লজ্জায় উচ্ছলিত হইয়া বলিল, ‘মুগরাচণ্ডী। এর নাম মুগরাচণ্ডী ফুল।’ বলিয়া, কিশোরের চোখের দিকে চাহিল। কিন্তু চোখ এর নামাইতে পারিল না। সর্পমুগ্ধের মত চাহিয়া থাকিয়াই পরনের বসন-আঁচলে বুকের শিশু স্তনদুটিকে ঢাকিয়া দিল। তারপর ভয়-পাওয়া হরিণীর মত বড় বড় পা ফেলিয়া একটা ঘরের আড়ালে চলিয়া গেল।

সুবল কিছু টের পাইয়া বলি, ‘যা কও দাদা, তোমার বাসন্তীর মত একটা মাইয়াও কিন্তু শুকদেবপুরে দেখলাম না।’

‘আমার বাসন্তী! তুই কি কইলি সুবলা?’

‘তোমার সঙ্গে বিয়া হইব। এই ক্ষেপের টাকা লইয়া দেশে গেলেই তোমার সঙ্গে বিয়া হইব। তোমার বাসন্তী কমু না, তবে কি আমার বাসন্তী কমু?’

কিশোর হাসিলঃ ‘নারে সুবলা,না, ঠিসারার কথা না। বাসন্তীরে আমার, তোর লগেই সাতপাক ঘুরাইয়া দেমু।’

‘মনরে চোখ ঠার’ কেনে কিশোর দাদা? বাসন্তী যে তোমার হাড়িত চাউল দিয়া রাখছে – তুমি ত কম জান না।’

‘নারে সুবলা, আমার মন যেমন কয়, কথাখান ঠিক না। যারে লেংটা থাইক্যা দেখতাছি – ছোটকালে যারে কোলে পিঠে লইছি – হাসাইছি, কাঁদাইছি, ডর দেখাইছি, ভেউরা বানাইয়া দিছি – তারে কি বিয়া করন যায়! বিয়া করন যায় তারে, যার লগে কোনোকালে দেখাসাক্ষাৎ নাই। দেখাসাক্ষাৎ খালি মুখাচণ্ডীর সময় – গীত-জোকারের লগে পিড়ির উপর শাড়ীর ঘোমটা তুইল্যা যখন চোখ মেইল্যা চায়। – সে হয় সত্যের স্তিরি। আর সগল তো ভইন।’

সুবল ভাবে, কিশোরের মাথার ঠিক নাই। কিন্তু যদি সত্যই বাসন্তীর সহিত কিশোরের বিবাহ না হয়, তবে বাসন্তীর বিবাহ হইবে কাহার সহিত। সুবল ভাবে।

মনের ভিতর একটা কিছু হইতেছে টের পাইয়া কিশোর কিছু লজ্জিত হয়। বলে, ‘আর পাড়া বেড়াইবার দরকার নাই সুবলা, চল্ ফিরা যাই।’

সে-অজানা ভাব অধিকক্ষণ থাকে না। থাকিলে কিশোর পাগলা হইয়া যাইত।



সেই স্নিগ্ধ নীলাভ ফাল্গুনী প্রভাত আসে। জাল লাগাইয়া মৃদু নৃত্যপরা তটিনীর বুকের গহনে গুঁজিয়া দেয় সেই জাল। তুলিয়াই দেখে মাছ। রূপার মত শাদা, ছোট ছোট প্রাণচঞ্চল অজস্র মাছ। এক একটা মাছে এক একটা প্রাণ। নৌকার ডরাতে জলের উপর ভাসিতে ভাসিতে কেমন খেলা করে। দুই মিনিটেই যাদের মৃত্যু, তারা মরণকে অবহেলা করিয়া এমন শান্তচিত্তে ভাসে কি করিয়া। কিন্তু বড় ভাল লাগে দেখিতে। দ্রুততালে জাল তোলা-ফেলার মাঝে কিশোর আত্মহারা হইয়া যায়। তার মনের সকল রকম অস্বস্তি কথায় আত্মগোপন করে।



২.০৩ প্রবাস খণ্ড

চৈত্রের মাঝামাঝি । বসন্তের তখন পুরা যৌবন। আসিল দোল পূর্ণিমা । কে কাকে নিয়া কখন দুলিয়াছিল। সেই যে দোলা দিয়াছিল তারা তাদের দোলনায়, স্মৃতির অতলে তারই ঢেউ। অমর হইয়া লাগিয়া গিয়াছে গগনে পবনে বনে বনে, মানুষের মনে মনে। মানুষ নিজেকে নিজে রাঙায়। তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না। প্রিয়জনকে রাঙায়, তাতেও পূর্ণ তৃপ্তি পায় না – তখন তারা আত্মপর বিচার না করিয়া, সকলকেই রাঙাইয়া আপন করিয়া তুলিতে চায়।

তেমনি রাঙাইবার ধুম পড়িয়া গেল শুকদেবপুরের খলাতে

তারা ঘটা করিয়া দোল করিবে, দশজনকে নিয়া আনন্দ করিবে। শুকদেবপুর গ্রামের সকলকেই তারা নিমন্ত্রণ করিল। মোড়লের গাঙের রায়ত হিসাবে কিশোররাও নিমন্ত্রিত হইল। কাল সকাল থেকে রাত অবধি হোলি, গানবাজনা, রঙখেলা, খাওয়া-দাওয়া হইবে।

‘খলাতে দোল-পুন্নিমায় খুব আরব্বা হয়। মাইয়া লোকে করতাল বাজাইয়া যা নাচে! নাচেত না, যেন পরীর মত নিত্য করে। পায়ে ঘুঙরা, হাতে রাম-করতাল। এ নাচ যে না দেখছে, মায়ের গর্ভে রইছে।’

তিলকের এই কথায় সুবলের খুব লোভ হইল। কিন্তু তার মন অপ্রসন্ন। ধুতি গামছা দুইই তার ময়লা।

কিশোর সমাধান বাতলাইয়া দিলঃ নদীর ওপারে হাত বসে। সাবান কিনিয়া আনিলেই হয়।

কিন্তু এক টুকরা সাবানের জন্য এত বড় নদী পাড়ি দেওয়া চলেনা।

শেষে সমাধান আপনা থেকেই হইয়া গেল।

ভাটিতে বেদের বহর নোঙর করিয়াছে। বেদেনীরা আয়না চিরুনী সাবান বঁড়শি, মাথার কাঁটা, কাঁচের চুড়ি, পুঁতির মালা লইয়া নৌকা করিয়া শুকদেবপুরের ঘাটে ঘাটে বেসাত করিয়া যায়। সাপের ঝাঁপিও দুই একটা সঙ্গে থাকে।

কিশোরেরা মাছ ধরায় ব্যস্ত। বেলা বাড়িয়াছে। আর একটু বাড়িলে মাছেরা অতলে ডুব দিবে। এখনি যত ছাঁকিয়া তোলা যায় নদী হইতে। উঠিতেছেও খুব। এমন সময়ে এক বেদেনী ডাক দিল, ‘অ, দাদা, মাছ আছে?’

কিনিতে আসিয়া তারা বড় বিরক্ত করে। তিলক ঝান্নু লোক। বলিল, ‘না মাছ নাই।’

বেদেনীর বিশ্বাস হইল না। বৈঠা বাহিয়া তার বাবুই পাখির মাসার মত নৌকাখানা কিশোরদের নৌকার সঙ্গে মিশাইল। সে তার নৌকার দড়ি হাতে করিয়া লাফ দিয়া কিশোরের নৌকায় উঠিল, ডরার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘কি জাল্লা, মাছ না নাই! চাইর পয়সার মাছ দেও।’

কিশোরের জালে অনেক মাছ উঠিয়াছে। বাঁশের গোঁড়ায় পা দিয়া, জালের হাতায় টান মারিয়া সে বুক চিতাইল; তার পিথ ঠেকিল বেদনীর বুকে।

বেদেনী তরুণী। স্বাস্থ্যবতী। তার স্তনদুইটি দুর্বিনীতভাবে উঁচাইয়া উঠিয়াছে। তার কোমল উন্নত স্পর্শ কিশোরের সর্ব-শরীরে বিদ্যুতের শিহরণ তুলিল। বাঁশের গুড়ি হইতে পড়িয়া গিয়া, হাত পা ভাঙ্গিয়া সে হয়ত একটা কাণ্ড করিয়া বসিত। বেদেনী এক হাত ডান বগলের তলায় ও অন্য  হাত বাম কাঁধের উপরে দিয়া বুক পর্যন্ত বাড়াইয়া কিশোরকে নিজের বুকে চাপিয়া ধরিল। অবলম্বন পাইয়া কিশোর পড়িয়া গেল না। কিন্তু দিশা হারাইল। বেদেনীর বুকটা সাপের মত ঠাণ্ডা। তারই চাপ হইতে ধীরে ধীরে মুক্ত করিয়া দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, পড় কেনে। আমারে ধরবার পার না?’

তিলক গলুই হইতে ডাকিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার নাওয়ে যাও।’

‘তুমি বুড়া মানুষ, তোমার সাথে আমার কি? আমার বেসাতি এই জনার সাথে।’ সে কিশোরের কাঁধের উপর হাত দিয়া আবার তার বুকখানা কিশোরের পিঠে ঠেকাইতে গেল।

‘এ জনা তোমার কোন্ জনমের কুটুম গো?’

‘শকুন্যা বুড়া, উকুইন্যা বুড়া, তুই কথা কইসনা, তুই কেমনে্ জানবি এজনা আমার কি?’

নিজের লোককে গাল দিতেছে। উভয়সঙ্কটে পরিয়া কিশোর বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি অখন তোমার নাওয়ে যাও।’

‘মাছ দিলেই যাই। বাস করতে কি আইচই?’

‘এই নেও চাইর পয়সার মাছ। এইবার যাও।’

‘মাছ পাইলাম, কিন্তু মানুষ ত পাইলাম না। তুমি মনের মানুষ।’

‘নাগরালি রাখ। আমার তিলকের বড় রাগ।’

‘রাগের ধার ধারি না। মনের মানুষ থুইয়া যাই, শেষে বুক থাপড়াইয়া কান্দি। অত ঠকাঠকির বেসাতি আমি করি না।’

কিশোরের হাসি পাইল। বলিল, ‘এক পলকে মনের মানুষ হইয়া গেলাম। তোমার আগের মনের মানুষ কই?’

‘উইড়া গেছে, সময় থাকতে বান্ধি নাই, তোমারে সময় থাকতে বান্ধতে চাই।’

‘কি তোমার আছে গো বাদ্যানী, বান্ধবা কি দিয়া?’

‘সাপ দিয়া। ঝাঁপিতে সাপ আছে –’

বেদেনী ঝাঁপি খুলিয়া দুই হাতে দুইটা সাপ বাহির করিয়া আনিল। আগাইয়া দিল কিশোরের গলার কাছে।

কিশোর ভয় পাইয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তুমি তোমার সাপ সরাও। বড় ডর করে।’

‘সরাইতে পাড়ি, যদি আমার কথা রাখ।’

‘কি কথা, কও না।’

‘আর দুইটা মাছ ফাও দেও – ’

‘এই নেও!’ কিশোর অপ্রসন্ন  মুখে কতকগুলি মাছ তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘এইবার তুমি যাও।’

‘যাই। তুমি বড় ভাল মানুষ। তুমি আমার নাতিন-জামাই।’

কিশোর সর্গের ইন্দ্রসভা হইতে একঠেলায় মাটিতে পরিয়া গেল!

বেদেনী বিজয়িনীর বেশে চলিয়া যাইতেছিল, এমন সময় সুবল ছুটিয়া আসিয়া বলিল, ‘অ বাদ্যানী, তোমার কাছে সাবান আছে? আমারে দুই পয়সার সাবান দিয়া যাও।’



২.০৪ প্রবাস খণ্ড

গান শুরু হওয়ার আগেই তিন জনে সজা-গোজ করিয়া খলায় উপস্থিত হইল। সাজের মধ্যে, ধুতি ঢিলা করিল, গামছা কাঁধ হইতে কায়দা করিয়া বুকে ঝুলাইল। পেশীবহুল বাহু বুক এই সজ্জাতেই শ্রীসম্পন্ন হইয়াছে। গিয়া দেখে অপরূপ কাণ্ড।

মোড়লের বড় বড় চারিটা বিল আছে। বর্ষাকালে চারিদিক জলে একাকার হইয়া যায়। তখন দেশদেশান্তরের মাছ এই সব বিলে আসর জমায়। জল কমিয়া আসিলে মোড়লের লোকেরা বিলগুলিতে বাঁধ দেয়। সব মাছ তখন বন্দী হয়। হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ রুই কাতলা নান্দিল মৃগেল মাছ। দূরদূরান্তরের গ্রাম হইতে মালোদের অনেক নৌকা আসে। একএকটি নৌকাতে থাকে চার পাঁচজন পুরুষ ও পনর কুড়িজন স্ত্রীলোক। এমনিভাবে বারো গাঁয়ের বারো রকম মালোনরনারী এক জায়গায় জড়ো হয়। ছয় মাসের স্থায়িত্ব নিয়া বড় বড় চালাঘর উঠিতে থাকে। একেকটা চালা একদৌড়ের পথ লম্বা।

কারোর সঙ্গে কারোর কোনোকালে দেখাসাক্ষাৎ ছিল না। এখানে আসিয়া সকলে এক সংসারের লোক হইয়া গিয়াছে। এক সঙ্গে খায়, থাকে, কাজ করে। মহোৎসবের রান্নার মত স্তূপাকারে ভাত তরকারি রান্না হয়। ঢালা পংক্তিতে বসিয়া খায়। মুখ ধুইয়া আবার কাজে বসে।

কি অত কাজ? না, মেয়েরা বটি মেলিয়া কাতারে কাতারে বসিয়া যায়। পুরুষেরা মাছের ঝুড়ি ধরাধরি করিয়া আনিয়া তাহাদের পাশে স্তূপ করিতে থাকে। মেয়েদের হাত চলে ঠিক কলের মত। এতবড় মাছটাকে পলকে ঘুরাইয়া পেটে পিঠে গলায় তিন পোচ দিয়া ঘাড়ের উপর দিয়া ছুঁড়িয়া মারে, সে-মাছ যথাস্থানে জড় হয়। আরেক দল পুরুষ সেখান হইতে নিয়া ডাঙ্গিতে তোলে শুকাইবার জন্য। দিনের পর দিন এই ভাবে তিন মাস কাজ চলে। ছয় মাসের প্রবাস সারিয়া তারা যার যার দেশে পাড়ি জমায়। ইহাকে বলে ‘খলা-বাওায়া।’


২.০৫ প্রবাস খণ্ড

তারা ঝুড়িভরা আবির আনিয়াছে। গামলাভরা রঙ্ গুলিয়াছে। চৌকোণা চার-থাকের একটা মাটির সিঁড়ির উপর দুই পাশে পোঁতা দুইখানা বাঁশের সঙ্গে দড়ি বাঁধিয়া একখণ্ড সালু কাপড়ে একটি ছোট গোপাল ঝুলাইয়াছে। নিতান্তই নাড়ুগোপাল। পাশে রাধা নাই। হামা দিয়া হাত বাড়াইয়া লাল কাপড়ের বাঁধনে লটকাইয়া একা একাই ঝুলিতেছে। এক-একজন আসিয়া তার গায়ে মাথায় আবির মাখাইয়া একটা করিয়া দোলা দিয়া যায়। তারই দোলনে সে অনবরত দুলিয়া চলিতেছে।

এ-পক্ষ প্রস্তুত। শুকদেবপুরের দল এখনো আসিয়া পৌঁছায় নাই। আপ্যায়নকারীদের একজন তিলকদিগকে ঠাকুরের কাছে নিয়া ঝুড়ি হইতে কয়েক মুঠা আবির একখানা ছোট পিতলের থালিতে দিয়া বলিল, ‘ঠাকুরের চরণে আবির দেও।’

প্রেমের দেবতা কোথায় কার জন্য ফাঁদ পাতিয়া রাখে কেউ কি বলিতে পারে? উজানীনগরের খলাতে কিশোর এমনি একটা ফাদে পড়িল। কার সঙ্গে কার জোড়বাঁধা হইয়া থাকে তাও কেউ বলিতে পারে না। যাকে জীবনে কখনো দেখি নাই হঠাৎ একদিন তাকে দেখিয়া মনে হয় সে যেন চিরজনমের আপন। প্রেমের দেবতা অলক্ষে কার সঙ্গে কখন কার গাঁটছড়া বাঁধিয়াছেন কেউ জানে না।

তারাত তিন জনে গোপালকে আবিরে রঞ্জিত করিল। তারপর কয়েকজন পুরুষ মানুষ তাহাদের গালে মাথায় আবির দিয়া রাঙাইবার পর তিন চারজন স্ত্রীলোক আবিরের থালা লইয়া আগাইয়া আসিল। কয়েকজন, কিশোরের কাছে মাতৃসমা। তারা কিশোরের কপাল রাঙাইল। আশীর্বাদের মত সে-আবির গ্রহণ করিয়া কিশোর নিজে তাদের পায়ে আবির মাখাইয়া কপালে পায়ের ধূলা ঠেকাইল।

কয়েকজন তরুণী। বোন বৌদিদের বয়সী। তারা আবির লাগাইল গালে আর কপালে। কিশোর নীরবে গ্রহণ করিল। গোলমালে ফেলিল আর একজন।

অবিবাহিতা মেয়ে। দেহে যৌবনের সব চিহ্ন ফুটিয়াছে। সে-সব ছাপাইয়া বহিয়াছে রূপের বান। বসন্তের এই উদাত্ত দিবসে মনে লাগিয়াছে বাসন্তী রঙ্। প্রাণে জাগিয়াছে অজানা উন্মাদনা। পঞ্চদশী। বড়ই সাংঘাতিক বয়স এইটা। মনের চঞ্চলতা শরীরে ফুটিয়া বাহির হয়। হইবেই। মালোর মেয়েরা বিবাহের আগে অত বড় থাকে না। অতখানি বড় হয় বিবাহের দুই তিন বছর পর। কোথা হইতে কেমন করিয়া এই অনিয়ম এখানে আসিয়া পড়িয়াছে।

কিশোরের গালে আবির দিতে মেয়েটার হাত কাঁপিল; বুক দুরু দুরু করিতে লাগিল। তার ছন্দময় হাতখানার কোমল স্পর্শ কিশোরের মনের এক রহস্যলোকের পদ্মরাজের ঘোমটা-ঢাকা দলগুলিকে একটি একটি করিয়া মেলিয়া দিল। সেই অজানা-স্পর্শের শিহরণে কাঁপিয়া উঠিয়া সে তাকাইল মেয়েটির চোখের দিকে। সে-চোখে মিনতি। সে-মিনতি বুঝি কিশোরকে ডাকিয়া বলিতেচেঃ বহুজনমের এই আবিরের থালা সাজাইয়া রাখিয়াছি। তোমারই জন্যে। তুমি লও। আমার আবিরের সঙ্গে তুমি আমাকেও লও।

থালা সুদ্ধ তার অবাদ্ধ হাত দুইটি কাঁপিতেছে। লজ্জায় লাল হইয়া সে চোখ নত করিল। তাকে বাঁচাইল তার মা। মাথার কাপড় একটু টানিয়া সলজ্জভাবে তার মেয়েকে নিজের বুকে আশ্রয় দিল।

কিশোরের ধ্যান ভাঙ্গিল সুবল। হাতে একটা ঝাঁকুনি দিয়া বলিল, ‘অ দাদা, গানের আসরে চল।’



শুকদেবপুরের অর্ধেক পুরুষ মাছধরায় গিয়াছে। মোড়ল গিয়াছে একটা শুকনা বিল লইয়া বাসুদেবপুরের লোকদের সঙ্গে পুরানো একটা বিবাদ মিটাইতে। শুকদেবপুরের নারীরা আসিয়া খলার নারীদের সহিত মিশিল। পুরুষেরাও আসিল ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া।

পুরুষেরা কতক্ষণ রঙ-মাখামাখি করিয়া শ্রান্তদেহে চাটাইয়ের উপর বসিয়াছে। ওদিকে মেয়েদের রঙ-মাখামাখির পালা চলিতেছে, এদিকে পুরুষদের হোলি-গান শুরু হইয়াছে। একজনকে সাজাইয়াছে হোলির রাজা। তার গলায় কলা-গাছের খোলের মালা, মাথায় কলাপাতার টোপর, পরণে ছেঁড়া ধুতি, গায়ে ছেঁড়া ফতুয়া। মাঝে মাঝে উঠিয়া কোমর বাঁকাইয়া নাচে, আবার বসিয়া বিরাম নেয়। বুড়া মানুষ।

বহুদিন পরে আনন্দের আমেজ পাইয়া তিলকের এইরূপ হোলির রাজা হইবার ইচ্ছা করিতেছিল। কিশোরের কানে কানে বলাতে উত্তর পাইল, ‘আমরা বিদেশী মানুষ। সভ্য হইয়া বইসা থাকাই ভাল। নাচানাচি করলে তারা পাগলা মনে করব।’ কিন্তু তিলক দমিবার লোক নয়। সে প্রতীক্ষা করিয়া থাকিল। গানের সম যখন চড়িবে, ঝুমুরের তাল উঠিবে, তখন সে কোনোদিকে না চাহিয়া আসরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া নাচিবে। একবার কোনোরকমে উঠিয়া কয়েক পাক নাচিতে পারিলে, লজ্জা ভাঙ্গিয়া যায়, কোনো অসুবিধা হয় না।

গায়কেরা দুই দলে পৃথক হইয়া গান জুড়িল। রাধার দল আর কৃষ্ণের দল।



রাধার দল ভদ্রভাবে গান তুলিলঃ

সুখ-বসন্তকালে, ডেকোনারে
অরে কোকিল বলি তুমারে।।
বিরহিনীর বিনে কান্ত হৃদাগ্নি হয় জ্বলন্ত,
জলে গেলে দিগুণ জ্বলে হয়নারে শান্ত।
সে-যে ত্যজে’ অলি কুসুম-কলি রইল কি ভুলে।।

কৃষ্ণের দল সুর চড়াইলঃ

বসন্তকালে এলরে মদন-
ঘরে রয় না আমার মন।।
বিদেশে যাহার পতি,
সেই নারীর কিবা গতি,
কতকাল থাকিবে নারী বুকে দিয়া বসন।।

রাধার দল তখনও ধৈর্য ঠিক রাখিয়া গাহিলঃ

বনে বনে পুষ্প ফুটে,
মধুর লোভে অলি জুটে,
কতই কথা মনে মনে উঠে সই –
ব্যথা কার বা কাছে কই।।
দারুণ বসন্তকাল গো,
নানা বৃক্ষে মেলে ডাল গো,
প্রবাস করে চিরকাল সে এল কই।।
বসিয়া তরুর শাখে কুহু কুহু কোকিল দাকে,
অরে সখিরে এ-এ-এ-

কৃষ্ণের দল এবার অসভ্য হইয়া উথিলঃ

আজু শুন্ ব্রজনারী,
রাজোকুমারী, তোমার যৌবনে করব আইন-জারি।
হস্তে ধরে নিয়ে যাব,
হৃদকমলে বসাইব – রঙ্গিনী আয় লো –
হস্তে ধরে নিয়ে যাব, হৃদকমলে বসাইব।
বসন তুলিয়া মারব ঐ লাল-পিচোকারী –



রাধার দল এই গানের কি উত্তর দিবে ভাবিতেছে, এমন সময় মেয়েদের তরফ হইতে আপত্তি আসিল, পুরুষদের গান এখানেই শেষ হোক। দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে। এখন মেয়েদের গান আরম্ভ করিতে হইবে।

রসাল প্রসঙ্গ পাইয়া তিলক মনে মনে উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিল। ভাবিয়াছিল রাধার দল কৃষ্ণপক্ষকে কড়া একটা উত্তর দিয়া আরও চেতাইবে, তারপর কৃষ্ণপক্ষের মুখ দিয়া যাহা বাহির হইবে, তাহার সঙ্গে সঙ্গে সে নাচিতে উঠিবে। তার আশাভঙ্গ হইল।



দোল-মণ্ডলের চারিদিকে খলার ও শুকদেবপুরের মেয়েরা সেদিন একাকার হইয়া গিয়াছে। কারো হাতে একজোড়া রাম-করতাল। কারো বা শুধু-হাত।

একসঙ্গে অনেকগুলি করতাল বাজিয়া উঠিল। ঝা ঝা ঝম্ ঝম্ ঝা ঝা ঝম্ ঝম্ শব্দে আকাশ ফাটাইয়া দিল। তার সঙ্গে অনেকগুলি কাঁকনপরা হাতের মিলিত করতালি। তারপর অনেকগুলি মেয়ের পা একসঙ্গে নাচিয়া উঠিল। অনেকগুলি মেয়ের কণ্ঠ একসুরে গাহিয়া উঠিল। কিশোরের মন এক অজানা আনন্দ-সাগরে ডুবিয়া গেল।

দলের ভিতর সেই মেয়েটিকেও দেখা গেল। মার পায়ের দিকে তাকাইয়া সেও তালে তালে পা ফেলিতেছিল। কিশোরের সহিত চোখাচোখি হইয়া সে তাল-কাটা পড়িল। পা আর উঠিতে চাহিল না। মা সস্নেহে মুখ ঘুরাইয়া চাহিয়া দেখে, মণ্ডলের মধ্যে থাকিয়া মেয়ের পা দুটি স্তব্ধ হইয়া গিয়াছে। আর ঘনঘন লাজে রাঙা হইয়া উঠিতেছে। কারণ কি, না, অদূরে দাঁড়াইয়া কিশোর তাহাকেই দুই চোখের দৃষ্টি দিয়া যেন গ্রাস করিতেছে।

মণ্ডলের তাল্ভঙ্গ হইতেছে দেখিয়া মা তাহাকে ঠেলিয়া বাহির করিয়া দিল। মণ্ডল-ছাড়া হইয়া সে আরও বিপন্ন বোধ করিল। এইবার সে কি করিবে ভাবিতেছে এমন সময় এক ভয়ানক কাণ্ড ঘটিল। দমকা হাওয়ার মত একটা আকস্মিক শব্দে মেয়েদের কণ্ঠপদ স্তব্ধ হইয়া গেল। মৃদু তরঙ্গায়িত তরাগে যেন সহসা জাগিল ঝঞ্ঝার বিক্ষোভ। শুকদেবপুরের পুরুষ যারা উপস্থিত ছিল, চক্ষুর পলকে উঠিয়া মালকোঁচা মারিয়া রুখিয়া দাঁড়াইল। যে-ঘরে লাঠিসোঁটা থাকে সে ঘরে ঢুকিয়া কয়েকজন বিদ্যুতের গতিতে লাঠির তাড়া বাহির করিয়া আনিল। সাজ সাজ রবে খলা তোলপাড় হইয়া উঠিল।

ততক্ষণে বাসুদেবপুরের ওরা ঢুকিয়া পড়িয়াছে।

মেয়েদের মধ্যে হুলস্থূল পড়িয়া গেল। আক্রমণকারীদের কয়েকজন লাঠি হাতে মেয়েদের দলে পড়িয়া লাফালাফি করিতেছে। একজন সেই বিমূঢ়া মেয়েটার দিকে আগাইয়া আসিতেছে যেন। এইবার কিশোরের চৈতন্য হইল। সে লাফাইয়া মেয়েটার সামনে পড়িয়া দুর্বৃত্তের গতিরোধ করিল। তার লাঠি তখন আকাশে আস্ফালন করিয়া কিশোরের মাথায় পড়ে আর কি। ঠিক সেই মুহূর্তে শুকদেবপুরের একজনের বিপুল এক লাঠির ক্ষিপ্ত আঘাত আক্রমণকারীকে ধরাশায়ী করিল। তার হাতের লাঠি লক্ষ্যচ্যুত হইয়া কিশোরের মাথায় না পড়িয়া হাতে পড়িল। মুহূর্ত মধ্যে মুমূর্ষুর হাত হইতে সেই লাঠি ছিনাইয়া লইয়া সে আগাইয়া যাইতেছিল, পিছন হইতে টান পড়ায় ফিরিয়া দেখে তার ধুতির খুঁট দুই হাতে মুঠা করিয়া ধরিয়া মেয়েটা মূর্ছা যাইতেছে।

তারপর শত শত কণ্ঠের সোরগোলের মধ্যে শত শত লাঠির ঠকাঠক্ ঠকাঠক্ শব্দ হইতে লাগিল। কারো হাত ভাঙ্গিল, পা ভাঙ্গিল, কারো মাথা ফাটিল। আক্রমণকারীদের অনেকেই আর ফিরিয়া গেল না। রক্তাক্ত দেহে এখানেই পড়িয়া রহিল। অন্যেরা লাঠি ঘুরাইয়া পিছু হটিতে হটিতে খোলা মাঠে নামিয়া দৌড় দিল।

ইহারই পটভুমিকায় কিশোর মূর্ছিতা মেয়েটাকে পাঁজা-কোলা করিয়া তুলিয়া ঘন ঘন হাঁকিতে লাগিল, ‘এর মা কই, এর মা কই! ডরে অজ্ঞান হইয়া গেছে। জল আন, পাংখা আন।’

মেয়েটার চুলগুলি আলগা হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়াছে। গলা টান হইয়া মাথাটা এলাইয়া পড়িয়াছে। বুকটা চিতাইয়া এতখানি উঁচু হইয়াছে যে, কিশোরের নিঃশ্বাস লাগিয়া বুঝিবা আবরণটুকু খসিয়া যায়।

মা এক জায়গায় দাঁড়াইয়া তখন কাঁপিতেছিল। কিশোরের ডাকে সম্বিৎ পাইয়া ভাঁড়ারঘর হইতে তেলজল পাখা আনিয়া দিল। কিশোর তেলে-জলে এক করিয়া গায়ের জোরে ঘুঁটিয়া দিয়া হাতের তালুতে চাপিয়া চাপিয়া মাথায় দিতে দিতে মেয়েটা চোখ মেলিয়া চাহিল।

‘আপনের মাইয়া আপনে নেন’, বলিয়া কিশোর ত্যাগ দেখাইল।

কথা কয়টি ঠিক জামাইর মুখের কথার মত হইয়া মেয়ের মার কানে গিয়া ঝঙ্কার তুলিল।



২.০৬ প্রবাস খণ্ড

সেইদিন হইতে এক মহাযুদ্ধের সূত্রপাত হইয়া রহিল। বাসুদেবপুরের ওরাও কম নয়। সংখ্যায় তারা বেশি, দাঙ্গাতেও খুব ওস্তাদ। শুকদেবপুরের মালোরাও বিপদ আসিলে পিছ-পা হয় না। বিশেষত,তাহাদের মোড়লকে ইহারা আটকাইয়া রাখিয়াছে। ঝগড়াটা ছিল অনেক দিন আগের। বিনা রক্তপাতে যাহাতে মীমাংসা হয় তারই চেষ্টা করিতে মোড়ল তাহাদের গ্রামে গিয়াছিল। আর ফিরিয়া আসে নাই। কাজেই শুকদেবপুরের মালোরা স্থির থাকিবে কি করিয়া? একটা মহাপ্রলয়ের আভাস লইয়া প্রহরগুলি অতিক্রান্ত হইতে থাকিল। পুরুষদের প্রস্তুতির আড়ম্বর আর নারীদের আতঙ্কের নিঃশ্বাসে শুকদেবপুরের বাতাস ভারী হইয়া উঠিল। প্রতি ঘর হইতে বাহির হইতে লাগিল লাঠির তাড়া, চোখাচোখা মুলিবাঁশের কাঁদি, এককেঠে, কোচ, চল্ প্রভৃতি নানাবিধ সরঞ্জাম। সবকিছু সাজাইয়া গোছাইয়া লইয়া মালোরা একটিমাত্র ইঙ্গিতের অপেক্ষায় প্রস্তুত হইয়া রহিল।



২.০৭ প্রবাস খণ্ড

কিশোরের মনে একটা অস্বাভাবিক আশা জাগিয়াছে। সেই মেয়েটির সঙ্গেই তার বিবাহ হইবে। আশাটা আরও অস্বাভাবিক এইজন্যঃ সে নিজে কাউকে কিছু বলিতে পারিবে না, তাকেই বরং কেউ আসিয়া বলুক। মনে মনে সে কল্পনার রঙ ফলায়ঃ আচ্ছা এমন হয় না, মেয়েপক্ষ কেউ আসিয়া তাকে বলে, ‘অ কিশোর, এই কন্যা তোমারে দিলাম, লইয়া গিয়া বিয়া কর।’



খলার কাছে নদী-স্রোতের একটা আড় পড়িয়াছে। বিকালে সেখানে জাল ফেলিতে যাইয়া কিশোর বলিল, ‘আজ জাল লাগামু গিয়া খলার ঘাটে।’

খলার ঘাটে গিয়া কিশোর বাঁশের আগায় জাল জুড়িতেছে আর তৃষিতের দৃষ্টিতে ঘরগুলির দিকে তাকাইতেছে।

তাহারই সমবয়সের একটি তরুণকে খলার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে দেখা গেল। লোকটা কিশোরের নৌকার দিকেই আসিতেছে। তার এদিকে আসার কি হেতু থাকিতে পারে?

কিশোর ভাবিয়া রোমাঞ্চিত হইলঃ এ বোধ হয় তারই কোনো ভাই হইবে। আসিতেছে সম্বন্ধের কথা চালাইতে। এ না হইয়া যায় না।

সত্যই লোকটা কিশোরের নিকট আসিয়া আত্মীয়তার ভঙ্গিতে কথা বলিল।

‘আপনেরার দেশ নাকি সুদেশ। দেখতে ইচ্ছা করে। কায়স্থ আছে, বরাহ্মন্ আছে, শিক্ষিৎ লোক আছে। বড় ভাল দেশে থাকেন আপনেরা ।’

সময় নাই। এখনই জাল ফেলিতে হইবে। শিক্ষিৎ লোকের দেশে থাকার যে কি কষ্ট, আর এদের মত দেশে থাকার যে কি সুখ, এ কথাগুলি অনেক যুক্তিপ্রমাণ দিয়া বুঝাইয়া দিবার কিশোরের সময় নাই। কিশোর কেবল শুনিয়া গেল।

‘আপনের সাথে একখান্ কুটুম্বিতা করতে চাইল।’

কিশোরের সকল শিরা-উপশিরা একযোগে স্পন্দিত হইতে লাগিল।

বলি, ‘আমরা গরীব মানুষ, আমরার সাথে কি আপনেরার কুটুম্বিতা মানায়?’

‘গরীব ত আমরাও। গরীবে গরীবেই কুটুম্বিতা মানায়। কি কন্ আপনে?’

এই কুটুম্বিতার জন্য কিশোর যে কতখানি ব্যাকুল, এই অনভিজ্ঞ ছেলেটাকে কিশোর সে কথা কি করিয়া বুঝাইবে। না বলিয়া দিলেও সে কি নিজেনিজেই বুঝিয়া লইতে পারে না’

কিশোরের মনের আকাশে রঙ্ ধরিল। জানিয়া শুনিয়াও কেবল পুলকের তাড়নায় জিজ্ঞাসা করিল, ‘কি কুটুম্বিতা করতে চান্।’

‘বন্ধুস্তি, আপনের-আমার মধ্যে বন্ধুস্তি। কত দেশ ঘুরলাম, মনের মত মানুষ পাইলাম না। আপনেরে দেইখ্যা মনে অইল, এতদিনে পাইলাম।’

‘আচ্ছা, বন্ধুস্তি করলাম, বেশ।’

‘মুখে-মুখের বন্ধুস্তি না। বাদ্য-বাজনা বাজাইয়া কাপড় গামছা বদল কইরা –’

বাদ্য-বাজনা বাজাইয়া একটা আড়ম্বর করা যায় কি রকম কাজে – সে কেবল, ঐ মেয়েটাকে লইয়া করা যায়। মিতালি করা মুখের কথাতেই হয়। ওকাজে কি বাদ্য-বাজনা জমে, না, ভাল লাগে? কিশোর খুশির স্বর্গ হইতে মরুর বালিতে পড়িয়া বলিল, ‘আমার সাথে না, সুবলার সাথে গিয়া আপ্‌নে বন্ধুস্তি করেন।’



২.০৮ প্রবাস খণ্ড

একদিন দুপুরের রোদ ঠেলিয়া বিলের পার দিয়া মোড়লকে ফিরিয়া আসিতে দেখা গেল।

মোড়লের মুখের দিকে তাকানো যায় না। পর্বতপ্রমাণ কাঠিন্য আসিয়া আশ্রয় করিয়াছে। ভয়ংকর একটা-কিছু যে ঘটিতে যাইতেছে তাহাতে কাহারো দ্বিমত রহিল না।

এইরূপ সময়ে একদিন মোড়লের বাড়িতে কিশোরের ডাক পড়িল।

কিশোর ছিল অন্যরকম চিন্তায় বিভোর। সে রাতদিন কেবল ভাবিয়া চলিয়াচিলঃ কোনো-একটা অলৌকিক উপায়ে ঐ মেয়েটির সহিত তাহার বিবাহের আয়োজন হইতে পারে কিনা। তাহা না হইলে কিশোরের বাঁচিয়া থাকিয়া লাভ কি? কে তাহার পক্ষ হইতে উহাদের কাছে কথাটা তুলিবে।

মোড়লের কাছে খুলিয়া বলা যাইত। কিন্তু তার মনের যা অবস্থা।

এমন সময় মোড়লের ডাকে কিশোর ভয়ে ভয়ে তাঁহার কাছে গিয়া দাঁড়াইল। মোড়লের কথা বলিবার সময় নাই। হাতে ইসারা করিয়া মুখে শুধু বলিল, ‘আমার স্তিরাচারে ডাকছে।’

এখানে কাজ এত আগাইয়া রহিয়াছে, অথচ কিশোর ইহার কিছুই জানে না। সে মোড়ল-গিন্নির পায়ের ধূলা লইয়া দাঁড়াইতেই, গিন্নি তাহাকে একটা ঘরের ভিতরে লইয়া গেল। সেখানে নূতন একটা শাড়ি পরিয়া, পানের রসে ঠোঁট রাঙা করিয়া, এবং গালে-মুখে তেলের ছোপ লইয়া সেই মেয়েটা বারবার লাজে রাঙা হইয়া উঠিতেছে।

মোড়ল গিন্নির হাতে দুইটি ফুলের মালা। একটি কিশোরের হাতে তুলিয়া দিয়া বলিল, ‘শাস্ত্র মতে বিয়া কইর দেশে গিয়া। অখন মালাবদল কইরা রাখ।’

মালাবদল হইয়া গেল, মোড়ল-গিন্নি হঠাৎ ঘরের বাহির হইয়া শিকল তুলিয়া দিল।

মেয়েটি ভয় পাইয়াছিল। দরজা বন্ধ, অন্ধকার ঘর। কারো মুখ কেউ দেখিতে পায় না। অবশেষে কিশোর তাহার ভয় দূর করিল।

পরে মোড়লগিন্নি শিকল খুলিয়া বন্দীকে মুক্তি দিয়া বাহির করিয়া দিল; আর বন্দিনীকে ভগিনীস্নেহে স্নান করাইয়া দিয়া রান্নাঘরে নিয়া বসাইল। কিশোরকে বলিল দিল, ‘দেখ জাল্লা উতলা হইয়া পাখির মত পাখ বাড়াইও না, রইয়া-সইয়া আগমন কইর।’

পরের দিন মেয়ের মা দেখিতে আসিল। মোড়ল-গিন্নিকে বলিল, ‘মালাবদল হইয়া গেছে ত?’

‘হ, হইয়া গেছে।’

‘আর দেখাসাক্ষাৎ করাইও না মা। অমঙ্গল হয়। দেশে গিয়া আগে শাস্ত্রমতে বিয়া হোক। কপালের কি গরদিস মা। জামাই পাইয়া মাইয়া আমার পর হইয়া গেল। আমার ত তাতে কোন অনাহলাদ নাই। অখন ঘরের মানুষেরে নিয়া কথা। সে-মানুষে না জানি কি করে।’

সকল কথা শুনিয়া সুবল আনন্দে লাফাইয়া উঠিয়া বলে, ‘দাদা, তা অইলে বাসন্তীরে তুমি ইখানেই পাইয়া গেলা। অখন দেশের বাসন্তীরে কার হাতে তুইল্যা দিবা কও।’

‘তোর হাতে দিয়া দিলাম।’

সুবলের মনে একটা আশার রেশ গুন্ গুন্ করিয়া উঠে।


২.০৯ প্রবাস খণ্ড

যে-মেঘ একটু একটু করিয়া আকাশে দানা বাঁধিতে ইল, তাহাই কাল-বৈশাখের ঝড়ের আকারে ফাটিয়া পড়িল।

মোড়লের মোটে সময় নাই। এক ফাঁকে দুই এক কথায় জানাইয়া দিল, খলার পরবাসীদিগকে দুই একদিনের মধ্যেই খলা ভাঙ্গিয়া যার যার দেশের দিকে পাড়ি দিতে হইবে। কিশোরকেও মোড়ল ভুলিল না। মেয়ের বাপের সামনে তাহাকে ডাকাইয়া নিয়া বলিল, কন্যা পাইয়াছ। দেশে নিয়া ধর্মসাক্ষী করিয়া বিবাহ করিও। সে তোমার জীবনের সাথী, ধর্মকর্মের সাথী, ইহকাল পরকালের সাথী। তাকে কোনদিন অযত্ন করিও না। – আর, কাল তোমার শুকনা মাছ বিক্রি হইয়া যাইবে। খলাভাঙ্গার দলের সাথে তুমিও দেশের দিকে নাও ভাসাইও। আমার সঙ্গে আর দেখা হইবে না।

মোড়লের সত্যই সময় নাই। মোড়ল উঠিয়া পড়িল।

মেয়ের বাপ সামনে বসিয়া আছে। রাগী মানুষ। তাহার কাছে কিশোর নিজেকে অপরাধী মনে করিতে লাগিল।

বাপ গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিল, ‘নাম কি আপনের?’

‘শ্রীযুক্ত কিশোরচান মূল্যব্রহ্মণ। পিতা শ্রীযুক্ত রামকেশব মূল্যব্রহ্মণ। নিবাস গোকন্নঘাট, জিলা ত্রিপুরা।’

লোকটা এক টুকরা কাগজে টুকিয়া লইল।

কিশোর নত হইয়া তাহার পায়ের ধূলা লইয়া দাঁড়াইয়া দেখে, লোকটা খলার দিকে চলিয়া যাইতেছে।

খলার ঘাটে সবগুলি নৌকা যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইল। ওপারে বাসুদেবপুরবাসীরা এরই মধ্যে লাঠি কাঁধে ফেলিয়া মালকোঁচা মারিয়া পথে নামিয়া পড়িয়াছে। এপারে খলার ঘাট হইতে তাহাদিগকে স্পষ্ট দেখা যাইতেছে; কিশোরের মনে হইতেচিল, আকাশকোণের কোনো মেঘলোক হইতে একখণ্ড কালো মেঘ যেন ঝটিকার আভাস লইয়া দ্রুত ছুটিয়া আসিতেছে। অতদুর হইতেও ইহাদিগকে কি ভীষণ আর কি কালো দেখাইতেছে। মোড়লকে ফেলিয়া যাইতে হইবে ভাবিয়া কিশোরের মনে বড় কষ্ট হইল। তাহার কেবল মনে হইতে লাগিল, এত লোকজন, এত টাকাপয়সা, কাজ-কারবারের মধ্যে থাকিয়াও লোকটা কত অসহায়। আর মোড়ল-গিন্নি! সে আরও অসহায়। কিন্তু যাইতেই হইবে, মোড়লের কড়া হুকুম – গাঙের বিদেশী রায়তদের সে কিছুতেই বিপদে জড়াইবে না।



২.১০ প্রবাস খণ্ড

আজ বিলের পারে প্রলয় কাণ্ড হইবে। তার আগেই নৌকাবিদায়ের পালা।

নৌকা বিদায় বড় মর্মস্পর্শী। নববধূকে নৌকায় তুলিয়া দিতে আসিয়া মোড়লগিন্নি কাঁদিয়া ফেলিল। তার চোখে জল দেখিয়া কিশোরেরও বুক ফাটিয়া কান্না বাহির হইতে চায়।

বধূ পা ধুইয়া নমস্কার করিয়া নৌকায় উঠিলে, দুইখানা নৌকা একসঙ্গে বাঁধন খুলিয়া দিল। একটি কিশোরের অন্যটি মেয়ের বাপের।

কতক্ষণ তাহারা পাশাপাশি চলিল। তারপর মেঘনার পশ্চিম পারের একটা শাখানদীর মুখ লক্ষ্য করিয়া উহাদের নৌকার মুখ ঘুরাইল। উহাদের নৌকাখানা দূরে সরিয়া যাইতেছে। এখনো অনেক দূরে যায় নাই। এখনো মানুষগুলিকে চেনা যায়। এখনো স্পষ্ট দেখা যাইতেছে ও-নৌকায় একটি যৌবনোতীর্ণ নারী চোখে আঁচল-চাপা দিয়া কাঁদিতেছে। এখন গলা ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছে। আর ওই যে কঠিন-হৃদয় পুরুষ মানুষটি, তারও কাঠিন্য গলিয়া জল হইয়া গিয়াছে। সে কাঁধের গামছা তুলিয়া নিয়া দুই চোখে চাপা দিয়াছে।

তাহাদিগকে আর চেনা যায় না। কিশোরের নৌকার একটি নারী-হৃদয়ের তখন সকল বাঁধ ভাঙ্গিয়া কান্নার প্লাবন ছুটিয়াছে।



সারা বেলা নৌকা বাহিয়া, বিকাল পড়িলে তিলকের মাথায় এক সমস্যা আসিয়া ঢুকিল। খানিক ভাবিয়া নিয়া, নিজেনিজেই সেই সমস্যার সমাধান করিয়া বলিল, ‘ডাকাইতের মুল্লুক দিয়া নাও চালামু, তার মধ্যে আবার মাইয়ালোক। আমি কই, কিশোর, তুমি একখান কাম কর। পাটাতনের তলে বিছনা পাত। কেউ যেমুন না দেখে, না জানে।’

কিশোর নৌকার তলায় কাঁথা বালিশ দিয়া বধুর প্রবাস-জীবনের স্থায়ী শয্যা রচনা করিল।

রাত্রি হইলে এক স্থানে নৌকা বাঁধিয়া রান্না-খাওয়া সারিল, বৌকে তুলিয়া খাইয়াইল, আবার সেইখানেই লুকাইয়া রাখিল।

শুইবার সময় কিশোরের হাবভাব লক্ষ্য করিতে করিতে তিলক এক ধমক দিয়া বলিল, ‘আমি বুড়া-মাইনষে একখান কথা কইয়া থুই কিশোর, নাওয়ের ডরার ভিতরে নজর লাগাইও না কিন্তুক।’

লজ্জা পাইয়া কিশোর সুবলকে লইয়া এক বিছানায় শুইয়া পড়িল।

পরের দিন আবার আঁধার থাকিতে নাও খুলিয়া দিল।

তিলকের এমনই কড়া শাসন যে, তাহাকে স্পর্শ করাত দূরের কথা তাহাকে চোখে দেখার পর্যন্ত উপায় নাই। খাওয়ানো-শোওয়ানোর ভার পড়িয়াছে সুবলের উপর। কিশোর নিজে নৌকার মালিক হইয়াও এ বিষয়ে তিলকের আইন মানিয়া লইতে বাধ্য হইল।

নৌকার পাছায় কোড়া টানিতে টানিতে সুবল জিজ্ঞাসা করিল, ‘অ দাদা, বৌ তুমি মনের মতন পাইছ ত?’

কিশোর সলজ্জভাবে হাসিয়া বলিল, ‘কি কইরা কইরে ভাই। ভাল কইরা দেখলাম না, জানলাম না। কোন্ দিন দেখছিলাম, মনেঅ নাই। বিস্মরণ হইয়া গেছে। অখন আর চেহারা-নবুনা মনেই পড়ে না। কেউ বদলাইয়া দিয়া গেলেও চিনতে পারুম না।’



চৈত্রমাস গিয়াছে। গ্রীষ্মের বৈশাখেই এ নদীতে জল বাড়িতে থাকে আর উজানি স্রোত বহিতে শুরু করে। নদীর তীরে ধান ক্ষেত, পাট ক্ষেত। তার সরু আল অবধি জল লুটাইয়া পরিয়াছে। গুণের কাঠি হাতে লইয়া কিশোর লাফ দিয়া তীরে নামিল।

কিশোর অমানুষিক শক্তিতে গুণ টানে আর নৌকা সাপের মত সাঁতার দিয়া স্রোত ঠেলিয়া চলে। লম্বা গুণ। অনেক দূরে থাকিয়া টানিতেছে। সুবল হাল ঠিক রাখিয়া তাহার দিকে চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছে। তাহাকে ছোট দেখাইতেছে। একটি জায়গা হইতে নদীর পার ডুবিতে আরম্ভ করিয়াছে। পাতা-জল ভাঙ্গিতে ভাঙ্গিতে এক সময়ে হাঁটু-জলে গিয়া পড়িল। হাঁটু-জল ক্রমে কোমড়-জলে গিয়া দাঁড়াইল। কটির কাপড় ভিজাইয়া কিশোর কোমড় জল ভাঙ্গিয়াই গুণ টানিতেছে। সুবল চাহিয়া চাহিয়া দেখিতেছিল। কিন্তু লক্ষ্য ছিল না। যখন লক্ষ্য হইল, সে হা হা করিয়া উঠিল, ‘অ কিশোর দাদা, তুমি করতাছ কি? গুণ মার, গুণ মার। নাইল্যা ক্ষেতে অখন পানক সাপ থাকে। তুমি গুণ মাইরা নাওএ উঠ।’

চৈতন্য পাইয়া কিশোর গুণ মারিয়া নৌকায় উঠিল।

সুবল তিরস্কার করিল, ‘দাদা, তোমারে কি মধ্যে মধ্যে ভূতে আমল করে?’

সে-কথার জবাব না দিয়া কিশোর বলিল, ‘ভাই, আর কদিনের পথ সামনে আছে?’

‘ইখান থাইক্যা আগাননগরের খাড়ি একদিনের পথ। আর একদিন একটানা নাও বাইতে পারলে ভৈরব ছাড়াইয়া নাও রাখুম নিয়া কলাপুড়ার খাড়িতে। সেইখান থাইক্যা তিতাসের মুখ আর এক দুপুরের পথ।’

হিসাব মত আকদিনে আগাননগরের খাড়ি পাওয়া গেল। সেখানে রাত কাটাইয়া নৌকা খোলা হইল। কিন্তু একদিনের স্থলে দুই দিন গত হইয়া যায়, ভৈরব বাজার আর দেখা দেয় না।

সামনা হইতে হু হু করিয়া জোরালো বাতাস আসিতেছে। মেঘনার বুক জুড়িয়া ঢেউয়ের তোলপাড় চলিতেছে। নৌকা এক হাত আগায়, তো আর এক হাত পিছাইয়া যায়। দুইটি প্রাণী গলুইয়ে বসিয়া দাঁড় টানিতেছে। বড় বড় ঢেউয়ের মুখে পড়িয়া নৌকা একবার শুন্যে উঠিতেছে, আবার ধপাস্ ধপাস্ আছড়াইয়া পড়িতেছে। গলুইয়ে দাঁড় হাতে প্রাণী দুইটি এক একবার কোমর অবধি ডুবিয়া যাইতেছে। ঝলকে ঝলকে নৌকায় জল উঠিতেছে। মাঝে মাঝে দাঁড়টানা বন্ধ করিয়া কিশোর সে-জল সেঁউতিতে করিয়া সেচিয়া ফেলিতেছে। নাওয়ের পাছায় সুবল বাতাসের ঝাপটায় আর জলের ছাঁটে ভেজা কাকের মত হইয়া গিয়াছে। তবু এক একবার গায়ের সবটুকু জোর নিংড়াইয়া লইয়া চাপ দিতেছে। দম-দেওয়া কলের মত নৌকাটা সে-চাপে একটু আগাইয়া গিয়াই দমভাঙ্গা হইয়া পিছনে সরিয়া আসিতেছে। তিলকের মুখে কথা নাই। কিশোর স্থলিতস্বরে বলি, ‘ভাইরে সুবল, আর বুঝি দেশে যাওয়া হইল না।’

শুনিয়া, ব্যথিত সুবল আরও জোর খাটাইল; একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িতে চাহিল।

রাঁধা খাওয়ার সময় নাই। বিশ্রামের অবসর নাই। এক ছিলিম তামাক খাওয়ারও অবকাশ নাই। কোথাও নৌকা বাঁধিয়া বিশ্রাম নিবে, তারও উপায় নাই। নদীর দুইদিকে চাহিলে বুক শুখাইয়া যায়। কেবল জল। কথাও এতটুকু তীর নাই। অবলম্বন নাই, অথৈ, অপার জল, নির্ভরসায় বুক শুখাইয়া যায়। একটা খালের মুখও চোখে পড়িতেছে না।

এই দুর্যোগের বিরুদ্ধে ঝাড়া তিনদিন লড়াই চলিল শেষে তারা ঝিমাইয়া পড়ার আগে দুর্যোগ নিজেই ঝিমাইয়া পড়িল। যে বাতাস দৈত্যের নাসিকা গর্জনের মত বহিতেছিল, তাহা এখন প্রজাপতির পাখার হাওয়ার মত কোমল হইয়া গেল। মেঘনার বুকের আলোড়ন থামিয়া একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেল।

এইত ভৈরবের বন্দর। এখানে আসিয়া মনে হইল বাড়ির কাছেই আসিয়াছি। স্রোতের আড় পাইয়া নৌকা অল্প মেহনতেই হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। ভৈরব বন্দরের মালোপাড়া দেখিতে দেখিতে অনেক পিছনে পড়িয়া গেল। তাহাদিগকে সমুখে আগাইবার নেশাতে পাইয়াছে। এই কলাপুড়ার খাড়ি। নৌকা বাঁধিবার চমৎকার জায়গা। কিন্তু আকাশের কোণে আরও একটু বেলা রহিয়াছে। কিশোর বলিল, ‘চলুক নাও। রাখুম গিয়া একেবারে নয়া গাঙের খাড়িতে। যত আগাইতে পার আগাও।’

সূর্য ডুবিবার আগেই নয়া গাঙ দেখা গেল।

এখানে নয়া গাঙের এক দুরন্ত ইতিহাস মনে পড়ে।

মেঘনা সরল হইয়া চলিতে চলিতে এই খানটায় একটু কোমর বাঁকাইয়াছিল। পশ্চিম পারে ছিল একটা খালের মুখ। বর্ষায় জলে ভরিয়া উঠিত আড় সুদিনে শুখাইয়া ঠনঠনে হইয়া যাইত। কখনো কখনো সামান্য একটু জল থাকিলে তাহাতে বৈকুন্ঠপুর আড় তাতারকান্দী গাঁয়ের ছেলেরা গামছায় ছাঁকিয়া পুঁটিমাছ ধরিত। সেই খালেরই মুখ। একদিন সে মুখে ফুলচন্দন পড়িল। কি করিয়া মেঘনার এইখানটাতে একটা স্রোতের বড় আবর্তের সৃষ্টি হইল, আর খালের মুখে ধরিল সর্বনাশা ভাঙ্গন। ভাঙ্গিয়া চুড়িয়া মুচড়াইয়া দুমড়াইয়া মেঘনার অকৃপণ জলরাশি আছড়াইয়া পড়িতে লাগিল খালের দুই দিকের পাড়ে। তাতেও ধরিল ভাঙ্গন। হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিল স্রোত। সাঁই সাঁই করিয়া ফুতিল আবর্ত। হিস্ হিস্ করিয়া জাগিল উচ্ছ্বাস। হুস্ হুস্ করিয়া পড়িতে লাগিল মাটির ধ্বস। মাটি ক্ষেত প্রান্তর ভাঙ্গিয়া, ছোট বড় পল্লী নিশ্চিহ্ন করিয়া, রাশি রাশি গাছপালা ছিন্নবিচ্ছিন্ন করিয়া সে জলধারা দিনের পর দিন উদ্দাম গতিতে ছুটিয়া চলিল। কার সাধ্য তার গতিরোধ করে। দুর্বার, দুর্মদ, প্রলয়ঙ্কর এ গতি। চাষীরা প্রমাদ গণিয়া অকালে ফসল কাটিয়া ঠাঁই করিয়া দিল, পল্লীবাসীরা সন্ত্রাসে বিমূঢ় হইয়া তৈজসপত্র বাঁধিয়া ছাঁদিয়া, গরুবাছুর হাঁকাইয়া লইয়া, অনেক পশ্চিমে গিয়া ডেরা বাঁধিল। কালক্রমে অনেক কিছু হইয়া গেল। যে ছিল একদা একটা খাল, সে এখন স্বয়ং মেঘনা হইতেও অনেক প্রশস্তা, অনেক বেগবতী, সমধিক ভয়ঙ্করী হইয়া উঠিয়াছে। সবিস্তারে এই কাহিনী বর্ণনা করিতে করিতে তিলকের চোখ দুইটি উজ্জ্বল হইয়া উঠিল। কথা কিছু নূতন নয়। তাদের গাঁয়ের মালোরা অনেকেই এখানে মাছ ধরিতে আসে। আর নয়া গাঙের নয়া স্রোতে মাছও ধরা পড়ে অনেক। কিশোর সুবলেরাও নয়া গাঙের এই কালান্তক, দিগন্তবিসারী মোহনাটি কয়েকবার দেখিয়াছে, কাহিনীটিও শুনিয়াছে। তবু তিলক তাহা আবেগপূর্ণ ভাষা দিয়া বিস্তারিত-ভাবে বর্ণনা করিল। ইহাই জেলেদের রোমান্স। নদীর রহস্য তারা শুনিয়াও আনন্স পায়, শুনাইয়াও আনন্দ পায়। আর স্রোতা যদি ইতিপূর্বে না শুনিয়া থাকে, অধিকন্তু শ্রোতা যদি বক্তার কাছে নূতন মানুষ কেউ হয়, তাহা হইলে বক্তার বলার উদ্দীপনা বাঁধ মানে না। পাটাতনের তলের মানুষটির সম্বন্ধে তিলক খুবই সজাগ। নয়া গাঙের এই রহস্যময় কাহিনী সে নিশ্চয়ই কান পাতিয়া শুনিতেছে।

পরিশেষে তিলক বলিল, এত কাণ্ড করিয়াও শেষে নয়া গাঙ কিনা মূল মেঘনাতেই গিয়া পড়িয়াছে!

মোহনাটি সত্যই ভয়ঙ্কর। এপার হইতে ওপারের কূল-কিনারা চোখে ঠাহর করা যায় না। হু হু করিয়া চলিতে চলিতে স্রোত এক একটা আবর্ত সৃষ্টি করিয়াছে। দুই ধারের স্রোত মুখোমুখি হইয়া যে ঝাপটা খাইতেছে, তাহাতে প্রচণ্ড শব্দ করিয়া জল অনেক উপরে উঠিয়া ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে। একটানা একটা সোঁ সোঁ শব্দ দূর হইতেই কানে ভাসিয়া আসিতেছে।

এই ভয়ঙ্করের একপাশে খাড়িটি বড় সুন্দর। বড় নিরাপদ স্থান। খালের মত একটা সরু মুখ দিয়া ঢুকিয়া অল্প একটু গেলেই এক প্রশস্ত জলাশয়ের বুক পাওয়া যায়। শান্ত শিষ্ট জলাশয়। প্রচণ্ড বাতাসেও বড় ঢেউ উঠে না।



তারা ভেতরে ঢুকিয়া দেখে, সেখানে অনেক নৌকার সমারোহ। তার বেশির ভাগ ধান-বেপারী, কাঁঠাল-বেপারী, পাতিল বেপারীর নৌকা। সকলেই এখানে এক রাতের জন্য আশ্রয় নিয়াছে। ভোর হইলে চলিয়া যাইবে।

তারাও শ্রান্ত ক্লান্ত। খাইয়া দাইয়াই শুইবে। কিন্তু বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের এই নদী-বিহারীদের কতকগুলি নিজস্ব সম্পদ আছে। অমনিতেই তারা শুইয়া পড়ে না। সেই সম্পদগুলিকে বুক দিয়া ভোগ করিয়া নিয়া তবে নিদ্রার কোলে আশ্রয় এয়। কোনো নৌকোয় মুর্শিদা বাউল গান হইতেছেঃ-

এলাহির দরিয়ার মাঝে নিরাঞ্জনের খেলা,
শিল পাথর ভাসিয়া গেল শুকনায় ডুবল ভেলা।
জলের আসর জলের বসন দেইখ্যা সারাসারি,
বালুচরে নাও ঠেকাইয়া পলাইল বেপারী।

 কোনো নৌকায় হইতেছে বারোমাসিঃ-

এহী ত আষাঢ় মাসে বরিষাগম্ভীর,
আজ রাত্রি হবে চুরি লীলার মন্দির।

কোনো নৌকায় টিমটিমে কেরোসিনের আলোর কাছে আগাইয়া জরাজীর্ণ একখানা পুঁথি সুর করিয়া পড়িতেছেঃ-

হাম্মাক রাজার দেশেরে –
উত্তরিল শেষে রে।

কোনো নৌকায় কেচ্ছা হইতেছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে গান ভাসিয়া আসিতেছেঃ-

আরদিন উঠেরে চন্দ্র পূবে আর পশ্চিমে।
আজোকা উঠছেরে চন্দ্র শানের বান্ধান ঘাটে।

স্বচ্ছ আকাশের উজ্জ্বল চাঁদ মাথার উপর অবধি পাড়ি দিয়াছে। সাদা ছেঁড়া মেঘ তাহাকে ধরিবার জন্য ছুটাছুটি করিতেছে। কিন্তু নাগাল পাইতেছে না।

দেখিতে দেখিতে কিশোরদের চোখে ঘুম আসিয়া পড়িল।

পা টিপিয়া টিপিয়া চলার শব্দ, আর চাপা গলার ফিসফাস কথা বলার আওয়াজ প্রথমে তিলকের মনোযোগ আকৃষ্ট করিল। নাঃ, কিশোরটা বেহায়ার হদ্দ। তাকে নিয়া আর পারা যাইবে না। বিরক্ত হইয়া তিলক পাশ ফিরিয়া শুইতেছিল। এমন সময় পায়ে জোরে একটা টান পড়ায় তার তন্দ্রা পাতলা হইতে হইতে একেবারে ভাঙ্গিয়া গেল। পুরা সম্বিত পাইয়া দেখে, ছইয়ের ভিতরে শুইয়াছিল, তারা তিন-জনেই এখন ছইয়ের বাইরে। আর তিনজনেরই পা নৌকার গুরার সঙ্গে দড়ি দিয়া বাঁধা। নৌকা আর সেই খাড়ির ভিতরে নাই। হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে নয়া গাঙের সেই সর্বনাশা মোহনার দিকে।

তিলক চীৎকার করিয়া উঠিল, ‘অ কিশোর, আর কত ঘুমাইবা, চাইয়া দেখ, সর্বনাশ হইয়া গেছে।’

এক ঝটকায় পায়ের বাঁধন ছিঁড়িয়া, কিশোর এক নিঃশ্বাসে ছইয়ের ভিতরে গিয়া পাটাতন খুলিল। সে নাই।

‘অ তিলক! সে নাই আমার! হাওরে-ডাকাতি হইয়া গেছে।’

একটা হাত বাক্সে বেসাতের মুনাফা দুইশত টাকা ছিল। তালাস করিতে গিয়া তিলক দেখিতে পাইল না। বাক্স সুদ্ধ তাহাও লইয়া গিয়াছে।’

‘হায়, কি হইল রে’ বলিয়া কিশোর পাগলের মত গলা ফাটাইয়া এক চীৎকার দিল। চারিপাশের জলোচ্ছাসের উপর দিয়া সেই চীৎকার-ধ্বনি ধীরে ধীরে ডুবিয়া গেল। কোনো প্রতিধ্বনিও আসিল না।

এদিকে মাঝ-মোহনার জলের উচ্ছ্বাস-ধ্বনি ক্রমেই নিকটবর্তী হইতেছে। নৌকাটা চুম্বকের মত আকৃষ্ট হইয়া সেদিক লক্ষ্য করিয়া চলিয়াছে। আর আকাশে তখন অজস্র জ্যোৎস্না।

তিলক সচেতন হইয়া বলি, ‘সুবলা, পাছায় গিয়া হালের কোরায় হাত দে।’

প্রবলভাবে আপত্তি জানাইয়া কিশোর বলিল, ‘না না তিলক, নাও আর ফিরাইও না। যার দিকে রোখ করছে তার দিকেই যাউক।’

সুবল ও তিলকের আপ্রাণ চেষ্টায় নৌকাখানা কোনমতে আসন্ন ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা পাইল। রাত্রির বিভ্রান্তিতে কূল-কিনারা দেখা যাইতেছিল না; তাহাও শেষে পাওয়া গেল। রাতটা বিশ্রী রকমের দীর্ঘ। ফুরাইতেছিল না। অবশেষে তাহাও ফুরাইয়া সকাল হইল। কিন্তু রাতের ঝড়ে পাখির সেই যে ডানা ভাঙ্গিল সে-ডানা আর জোড়া লাগিল না।

কিশোর দাঁড়ে গিয়া বসিয়াছিল। বার বার হাত হইতে দাঁড় খসিয়া পড়িতেছে দেখিয়া তিলকের দয়া হইল, ‘যাও কিশোর, দাঁড় তুইল্যা ছইয়ার তলে যাও।’

কিশোর ছইয়ের ভিতরে আসিয়া পাটাতনের উপরে বসিল। পাটাতনের নীচেই সে ছিল। এখন সে কোথায়!

সুবলের হাতে হালের বৈঠাও নিস্তেজ হইয়া আসিল। কেবল তিলকের বৃদ্ধ হাতের দাঁড়টানাকে সম্বল করিয়া নৌকা মন্থরগতিতে আগাইতে লাগিল।



২.১১ প্রবাস খণ্ড

এখানে তিতাসের মোহনা। মেঘনার সঙ্গে সম্পর্ক চুকাইয়া এখন ইহারই মুখ দিয়া প্রবেশ করিতে হইবে। যাইবার সময় মুখটা আরো সংকীর্ণ ছিল। এখন বর্ষার জলে সে-মুখ অনেক বড় হইয়া গিয়াছে।

তিতাসের মুখের ভিতর ঢুকিয়া খানিক আগাইবার পর সুবল দুত্তোরি বলিয়া দাঁড় তুলিয়া ফেলিল। বাঁশের খুঁটিটা একটানে তুলিয়া লইয়া মাটিতে ঠেকাইয়া কয়েকটা পাড় দিল। তারপর তার সঙ্গে নৌকার দড়ি বাঁধিয়া ছইয়ের ভিতরে ঢুকিয়া শুইয়া পড়িল। আরো একটু বেলা ছিল। আরো একটু আগানো যাইত। কিন্তু তিলক মুখ খুলিয়া একথা বলিতে সাহস পাইল না।

আবার রাত আসিল। রাত গভীর হইল। এবং এক সময়ে ফুরাইয়া গেল।

পূবদিকের আকাশ খোলাসা হইয়া আসিতেছে। কিশোর কি ভাবিয়া উঠিল। মাঝ নৌকায় দাঁড়াইয়া সেদিকে কতক্ষণ তাকাইয়া রহিল। তারপর গলুইয়ে গিয়া হাত বাড়াইয়া জল স্পর্শ করিল।

হাত জলে লাগে নাই। কিসে যেন লাগিতেচে। কিন্তু বড় নরম। আর কি ভীষণ ঠাণ্ডা। ঘার বাড়াইয়া চাহিয়া দেখিল, স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। দেখিয়া কিশোর খুব জোরে একটা চিৎকার দিল।

একটা নারীদেহ ভাসিয়া রহিয়াছে। কোমর হইতে পা অবধি একেবারে খাড়া জলের নীচে। বুকটা চিতাইয়া ভাসিয়া উঠিয়াছে। গলা টান হইয়া মাথা পিছন দিকে ঢলিয়া রহিয়াছে। লম্বা চুলগুলিকে লইয়া তিতাসের মৃদু স্রোত টানাটানি করিতেছে।

‘অ তিলক, দেইখ্যা যাও!’

চোখ কচলাইয়া তিলক বলিল, ‘কি কিশোর।’

‘তারে পাওয়া গেছে।’

তিলক উঠিয়া আসিয়া মড়াটাকে দেখিয়া, রাম রাম বলিতে বলিতে সুবলকে ডাকিয়া তুলিল। তারপর কালবিলম্ব না করিয়া নৌকা ছাড়িয়া দিল।

কিশোর ছইয়ের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়াছিল।

দাঁড় টানিতে টানিতে ক্লান্ত হইয়া তিলক ছইয়ের ভিতরে আসিয়া বসিল। আগে লক্ষ্য ক’রে নাই। মালসার আগুনে টিকা ডুবাইয়া তামাকের চোঙ্গাটা কোথায় কিশোরকে জিজ্ঞাসা করিয়া যখন কোন সাড়া পাইল না, তখন লক্ষ্য করিল। কিশোরের চোখ দুইটা অস্বাভাবিক রকমের বড় আর জবাফুলের মত লাল হইয়া গিয়াছে। মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে ভীষণ এক দানবীয় ভাব। মাঝে মাঝে ডাইনে বাঁয়ে নীচে উপরে চোখ ঘুরাইতেছে।

আঁতকাইয়া উঠিয়া তিলক চিৎকার দিল, ‘অ সুবলা দেইখ্যা যা, কিশোর পাগল হইয়া গেছে।’

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন