০১.
বাবুরামবাবুর পরিচয়—মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ও ফার্সী শিক্ষা।
বৈদ্যাবাটীর বাবুরাম বাবু বড়ো বৈষয়িক ছিলেন। তিনি মাল ও ফৌজদারী আদালতে অনেক কর্ম করিয়া বিখ্যাত হন। কর্মকাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া উৎকোচাদি গ্রহণ না করিয়া যথার্থ পথে চলা বড়ো প্রাচীন প্রথা ছিল না – বাবুরাম সেই প্রথানুসারেই চলিতেন। একে কর্মে পটু – তাতে তোষামোদ ও কৃতাঞ্জলি দ্বারা সাহেব-সুবাদিগকে বশীভূত করিয়াছিলেন এজন্য অল্পদিনের মধ্যেই প্রচুর ধন উপার্জন করিলেন। এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে, বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক্ গৌরব হয় না। বাবুরাম বাবুর অবস্থা পূর্বে বড়ো মন্দ ছিল, তৎকালে গ্রামে কেবল দুই এক ব্যক্তি তাঁহার তত্ত্ব করিত। পরে তাঁহার সুদৃশ্য অট্টালিকা, বাগ-বাগিচা, তালুক ও অন্যান্য ঐশ্বর্য-সম্পত্তি হওয়াতে অনুগত ও অমাত্য বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অসংখ্য হইল। অবকাশ কালে বাটিতে আসিলে তাঁহার বৈঠকখানা লোকারণ্য হইত, যেমন মেঠাইওয়ালার দোকানে মিষ্ট থাকিলেই তাহা মক্ষিকায় পরিপূর্ণ হয় তেমন ধনের আমাদানি হইলেই লোকের আমদানি হয়। বাবুরামবাবুর বাটীতে যখন যাও তাঁহার নিকট লোক ছাড়া নাই—কি বড়ো, কি ছোট, সকলেই চারিদিকে বসিয়া তুষ্টিজনক নানা কথা কহিতেছে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ভঙ্গিক্রমে তোষামদ করিত আর এলোমেলো লোকেরা একেবারেই জল উঁচু-নিচু বলিত। এইরূপে কিছু কাল যাপন করিয়া বাবুরাম বাবু পেন্সন লইলেন ও আপন বাটীতে বসিয়া জমিদারী ও সওদাগরী কর্ম করিতে আরম্ভ করিলেন।
লোকের সর্বপ্রকারে সুখ প্রায় হয় না ও সর্ববিষয়ে বুদ্ধিও প্রায় থাকে না। বাবুরাম বাবু কেবল ধন উপার্জনেই মনোযোগ করিতেন। কি প্রকারে বিষয়-বিভব বাড়িবে, কি প্রকারে দশজন লোক জানিবে, কি প্রকারে গ্রামস্থ লোক-সকল করজোড়ে থাকিবে— কি প্রকারে ক্রিয়াকাণ্ড সর্বোত্তম হইবে— এই সকল বিষয় সর্বদা চিন্তা করিতেন। তাঁহার এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। বাবুরামবাবু বলরাম ঠাকুরের সন্তান, এজন্য জাতিরক্ষার্থ কন্যাদ্বয় জন্মিবামাত্র বিস্তর ব্যয় ভূষণ করিয়া তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু জামাতারা কুলীন, অনেক স্থানে দারপরিগ্রহ করিয়াছিল— বিশেষ পারিতোষিক না পাইলে বৈদ্যবাটীর শ্বশুরবাটীতে উঁকিও মারিত না। পুত্র মতিলাল বাল্যাবস্থা অবধি আদর পাইয়া সর্বদা বাইন করিত—কখন বলিত বাবা চাঁদ ধরিব—কখন বলিত বাবা তোপ খাব। যখন চিৎকার করিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিত নিকটস্থ সকল লোক বলিত ঐ বান্কে ছেলেটার জ্বালায় ঘুমানো ভার। বালকটি পিতা-মাতার নিকট আস্কারা পাইয়া পাঠশালায় যাইবার নামও করিত না। যিনি বাটীর সরকার তাঁহার উপর শিক্ষা করাইবার ভার ছিল। প্রথম প্রথম গুরু মহাশয়ের নিকটে গেলে মতিলাল আঁ আঁ করিয়া কান্দিয়া তাঁহাকে আঁচড় ও কামড় দিত—গুরুমহাশয় কর্তার নিকট গিয়া বলিতেন, মহাশয়! আপনার পুত্রকে শিক্ষা করানো আমার কর্ম নয়। কর্তা প্রত্যুত্তর দিতেন—ও আমার সবেধন নীলমণি-ভুলাইয়া-টুলাইয়া গায় হাত বুলাইয়া শেখাও। পরে বিস্তর কৌশলে মতিলাল পাঠশালায় আসিতে আরম্ভ করিল। গুরুমহাশয় পায়ের উপর পা, বেত হাতে দেয়ালে ঠেসান দিয়া ঢুলছেন ও বলছেন “ল্যাখ রে ল্যাখ।” মতিলাল ঐ অবকাশে উঠিয়া তাঁহার মুখের নিকট কলা দেখাচ্ছে আর নাচ্ছে — গুরুমশায় নাক ডাকিতেছেন—শিষ্য কি করিতেছে তাহা কিছুই জানেন না। তাঁহার চক্ষু উন্মীলিত হইলেই মতিলাল আপন পাততাড়ির নিকট বসিয়া কাগের ছা বগের ছা লিখিত। সন্ধ্যাকালে ছাত্রদিগকে ঘোষাইতে আরম্ভ করিলে মতিলাল গোলে হরিবোল দিত—কেবল গণ্ডার এণ্ডা ও বুড়িকা ও পণিকার শেষ অক্ষর বলিয়া ফাঁকি সিদ্ধান্ত করিত,—মধ্যে মধ্যে গুরুমহাশয় নিদ্রিত হইলে তাঁহার নাকে কাটি দিয়া ও কোঁচার উপর জলন্ত অঙ্গার ফেলিয়া তীরের ন্যায় প্রস্থান করিত। আর আহারের সময় চুনের জল ঘোল বলিয়া অন্য লোকের হাত দিয়া পান করাইত। গুরুমহাশয় দেখিলেন বালকটি অতিশয় ত্রিপণ্ড, মা সরস্বতীকে একবারে জলপান করিয়া বসিল, অতএব মনে করিলেন যদি এত বেত্রাঘাতে সুযুত না হইল, কেবল গুরুমারা বিদ্যাই শিক্ষা করিল তবে এমতো শিষ্যের হাত হইতে ত্বরায় মুক্ত হওয়া কর্তব্য, কিন্তু কর্তা ছাড়েন না—অতএব কৌশল করিতে হইল। বোধ হয় গুরুমহাশয়গিরি অপেক্ষা সরকারি ভালো, ইহাতে বেতন দুই টাকা ও খোরাক-পোষাক—উপরি লাভের মধ্যে তালপাত কলাপাত ও কাগজ ধরিবার কালে এক একটা সিধে ও এক এক জোড়া কাপড় মাত্র, কিন্তু বাজার সরকারি কর্মে নিত্য কাঁচা কড়ি। এই বিবেচনা করিয়া কর্তার নিকট গিয়া কহিলেন—মতিবাবুর কলাপাত ও কাগজ লেখা শেষ হইয়াছে এবং এক প্রস্থ জমিদারী কাগজও লেখানো গিয়াছে। বাবুরামবাবু এই সংবাদ পাইয়া আহ্লাদে মগ্ন হইলেন, নিকটস্থ পারিষদেরা বলিল— না হবে কেন! সিংহের সন্তান কি কখন শৃগাল হইতে পারে ?
পরে বাবুরাম বাবু বিবেচনা করিলেন ব্যাকরণাদি ও কিঞ্চিত ফার্সী শিক্ষা করানো আবশ্যক। এই স্থির করিয়া বাটীর পূজারী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—কেমন হে তোমার ব্যাকরণ-ট্যাকরণ পড়াশুনা আছে ? পূজারী ব্রাহ্মণ গণ্ডমুর্খ—মনে করিল যে চাউল-কলা পাই তাতে তো কিছুই আঁটে না—এত দিনের পর বুঝি কিছু প্রাপ্তির পন্থা হইল, এই ভাবিয়া প্রত্যুত্তর করিল— আজ্ঞে হাঁ, আমি কুইনমোড়ার ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তবাগীশের টোলে ব্যাকরণাদি একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন করি, কপাল মন্দ, পড়াশুনার দরুন কিছুই লাভবান হয় না, কেবল আদা জল খাইয়া মহাশয়ের নিকট পড়িয়া আছি। বাবুরাম বাবু বলিলেন—তুমি অদ্যাবধি আমার পুত্রকে ব্যাকারণ শিক্ষা করাও। পূজারী ব্রাহ্মণ আশা বায়ুতে মুগ্ধ হইয়া মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের দুই-এক পাত শিক্ষা করিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। মতিলাল মনে করিলেন গুরু-মহাশয়ের হাত হইতে তো মুক্ত হইয়াছি এখন এ বেটা চাউল-কলাখেকো বামুনকে কেমন করিয়া তাড়াই? আমি বাপ-মার আদরের ছেলে—লিখি বা না লিখি, তাঁহারা আমাকে কিছুই বলিবেন না—লেখাপড়া শেখা কেবল টাকার জন্য—আমার বাপের অতুল বিষয়—আমার লেখাপড়ায় কাজ কি? কেবল নাম সহি করিতে পারিলেই হইল। আর যদি লেখাপড়া শিখিব তবে আমার এয়ারবক্সিদিগের দশা কি হইবে? আমোদ করিবার এই সময়,—এখন কি লেখা-পড়ার যন্ত্রণা ভালো লাগে ?
মতিলাল এই স্থির করিয়া পূজারী ব্রাহ্মণকে বলিল—অরে বামুন, তুই যদি হ, য, ব, র, ল, শিখাইতে আমার নিকট আর আসিস ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া তোর চাউল-কলা পাইবার উপায় সুদ্ধ ঘুচাইয়া দিব কিন্তু বাবার কাছে গিয়া একথা বললে ছাতের উপর হতে তোর মাথায় এমন এক এগারঞ্চি ঝাড়িব যে তোর ব্রাহ্মণীকে কালই হাতের নোয়া খুলিতে হইবে। পূজারী ব্রাহ্মণ হ, য, ব, র, ল প্রসাদ্যৎ ক্ষণেক কাল হ, য, ব, র, ল হইয়া থাকিলেন পরে আপনা আপনি বিচার করিলেন—ছয় মাস প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছি এক পয়সাও হস্তগত হয় নাই, আবার “লাভঃ পরং গোবধঃ” —প্রাণ নিয়া টানাটানি—এক্ষণে ছেড়ে দিলে কেঁদে বাঁচি। পূজারী ব্রাহ্মণ যৎকালে এই সকল পর্যালোচনা করিতেছিলেন মতিলাল তাঁহার মুখাবলোকন করিয়া বলিল—বড়ো যে বসে বসে ভাবছিস্? টাকা চাই? এই নে—কিন্তু বাবার কাছে গিয়া বল্ গে আমি সব শিখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণ কর্তার নিকট গিয়া বলিল—মহাশয় মতিলাল সামান্য বালক নহে—তাহার অসাধারণ মেধা, যাহা একবার শুনে তাহাই মনে করিয়া রখে। বাবুরামবাবুর নিকট একজন আচার্য ছিল—বলিল, মতিলালের পরিচয় দিবার আবশ্যক নাই। উটি ক্ষণজন্মা ছেলে, বেঁচে থাকিলে দিক্পাল হইবে।
অনন্তর পুত্রকে ফার্সী পড়াইবার জন্য বাবুরাম বাবু একজন মুন্শী অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। অনেক অনুসন্ধানের পর আলাদি দরজির নানা হবিবল হোসেন তেল কাঠ ও ১।।০ টাকা মাহিনাতে নিযুক্ত হইল। মুন্শী সাহেবের দন্ত নাই, পাকা দাড়ি, শনের ন্যায় গোঁফ, শিখাইবার সময় চক্ষু রাঙা করেন ও বলেন, ‘আরে বে পড়’ ও কাফ গাফ আয়েন গায়েন উচ্চারণে তাঁহার বদন সর্বদা বিকট হয়। একে বিদ্যা শিক্ষাতে কিছু অনুরাগ নাই তাতে ঐরূপ শিক্ষক অতএব মতিলালের ফার্সী পড়াতে ঐরূপ ফল হইল। এক দিবস মুন্শী সাহেব হেঁট হইয়া কেতাব দেখিতেছেন ও হাত নেড়ে সুর করিয়া মস্নবির বয়েত পড়িতেছেন ইত্যবসরে মতিলাল পিছন দিগ্ দিয়া একখান জ্বলন্ত টিকে দাড়ির উপর ফেলিয়া দিল। তৎক্ষণাৎ দাউদাউ করিয়া দাড়ি জ্বলিয়া উঠিল। মতিলাল বলিল—কেমন রে বেটা নেড়ে আমাকে পড়াবি? মুন্শী সাহেব দাড়ি ঝাড়িতে ঝাড়িতে ও তোবা তোবা বলিতে বলিতে প্রস্থান করিলেন এবং জ্বালার চোটে চিৎকার করিয়া বলিলেন—এস্ মাফিক বেতমিজ আওর বদ্জাৎ লেড়কা কাভি দেখা নেই—এস্ কাম্সে মুল্কমে চাস কর্ণা আচ্ছি হ্যায়। এস্ জেগে আনা ভি হারাম হ্যায়-তোবা-তোবা-তোবা !!!
০২.
মতিলালের ইংরাজী শিখাবার উদ্যোগ গো বাবুরামবাবুর বালীতে গমন।
মুন্শী সাহেবের দুর্গতির কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু বলিলেন-মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয়- সে বেটা জেতে নেড়ে-কত ভালো হবে ? পরে ভাবিলেন যে ফার্সী চলন উঠিয়া যাইতেছে, এখন ইংরেজী পড়ানো ভালো। যেমন ক্ষিপ্তের কখন কখন জ্ঞানোদয় হয় তেমনি অবিজ্ঞ লোকেরও কখন কখন বিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। বাবুরামবাবু ঐ বিষয় স্থির করিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি বারাণসীবাবুর ন্যায় ইংরেজী জানি-‘‘সরকার কম স্পিক ন্যাট’’ -আমার নিকটস্থ লোকেরাও তদ্রূপ বিদ্বান্, অতএব একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ লওয়া কর্তব্য। আপন কুটুম্ব ও আত্মীয়দিগের নাম স্মরণ করাতে মনে হইল বালীর বেণীবাবু বড়ো যোগ্য লোক। বিষয় কর্ম করিলে তৎপরতা জন্মে। এজন্য অবিলম্বে একজন চাকর ও পাইক সঙ্গে লইয়া বৈদ্যবাটীর ঘাটে আসিলেন।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মাঝিরা বৈঁতির জাল ফেলিয়া ইলিশ মাছ ধরে ও দুই প্রহরে সময় মাল্লারা প্রায় আহার করিতে যায় এজন্য বৈদ্যবাটীর ঘাটে খেয়া কিংবা চলতি নৌকা ছিল না। বাবুরামবাবু চৌগোঁপ্পা-নাকে তিলক-কস্তাপেড়ে ধুতি পরা-ফুলপুকুরে জুতা পায়-উদরটি গণেশের মতো-কোঁচনো চাদরখানি কাঁধে-একগাল পান-ইতস্ততঃ বেড়াইয়া চাকরকে বলছেন-ওরে হরে ! শীঘ্র বালী যাইতে হইবে দুই-চার পয়সায় একখানা চলতি পানসি ভাড়া কর তো।
বড়ো মানুষের খানসামারা মধ্যে মধ্যে বেআদব হয়, হরি বলিল-মোশায়ের যেমন কান্ড ! ভাত খেতে বস্তেছিনু-ডাকাডাকিতে ভাত ফেলে রেখে এসেচি-ভেটেল পান্সি হইলে অল্প ভাড়ায় হইত-এখন জোয়ার-দাঁড় টান্তে ও ঝিঁকে মারতে মাঝিদের কাল ঘাম ছুটবে-গহনার নৌকায় গেলে দুই-চার পয়সা হতে পারে-চলতি পান চার পয়সায় ভাড়া করা আমার কর্ম নয়-এ কি থুতকুড়ি দিয়া ছাতু গোলা ?
বাবুরামবাবু দুটা চক্ষু কট্মট্ করিয়া বলিলেন-তোবেটার বড়ো মুখ বেড়েছে-ফের যদি এমন কথা কবি তো ঠাস্ করে চড় মারবো। বাঙালী ছোট জাতিরা একটু ঠোকর খাইলেই ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে, হরি তিরস্কার খাইয়া জড়সড় হইয়া বলিল-এজ্ঞে না, বলি এখন কি নৌকা পাওয়া যায় ? এই বল্তে বল্তে একখানা বোট গুণ টেনে ফিরিয়া যাইতেছিল, মাঝির সহিত অনেক কস্তাকস্তি ধস্তাধস্তি করিয়া ।।০ ভাড়া চুক্তি হইল-বাবুরামবাবু চাকর ও পাইকের সহিত বোটের উপর উঠিলেন। কিঞ্চিৎদূর আসিয়া দুই দিগ্ দেখিতে দেখিতে বলিতেছেন-ওরে হরে ! বোটখানা পাওয়া গিয়াছে ভালো-মাঝি ! ও বাড়িটা কার রে ? ওটা কি চিনির কল ? অহে চকমকি ঝেড়ে এক ছিলিম তামাক সাজো তো ? পরে ভড় ভড় করিয়া হুঁকা টানিতেছেন-শুশুকগুলা এক এক বার ভেসে ভেসে উঠতেছে-বাবু স্বয়ং উঁচু হইয়া দেখ্তেছেন ও গুন গুন করিয়া সখীসংবাদ গাইতেছেন-‘‘দেখে এলাম শ্যাম তোমার বৃন্দাবন ধাম কেবল আছে নাম’’। ভাঁটা হাওয়াতে বোট সাঁ সাঁ করিয়া চলিতে লাগিল-মাঝিরাও অবকাশ পাইল-কেহ বা গলুয়ে বসিল, কেহ বা বোকা ছাগলের দাড়ি বাহির করিয়া চারি দিগে দেখিতে লাগিল ও চাটগেঁয়ে সুরে গান আরম্ভ করিল ‘‘খুলে পড়বে কানের সোনা শুনে বাঁশির সুর’’-
সূর্য অস্ত না হইতে হইতে বোট দেওনাগাজির ঘাটেতে গিয়া লাগিল। বাবুরামবাবুর শরীরটি কেবল মাংসপিন্ড-চারিজন মাঝিতে কুঁতিয়া ধরাধরি করিয়া উপরে তুলিয়া দিল। বেণীবাবু কুটুম্বকে দেখিয়া ‘‘আস্তে আজ্ঞা হউক, বসতে আজ্ঞা হউক’’ প্রভৃতি নানবিধ শিষ্টালাপ করিলেন। বাবুর বাটীর চাকর রাম তৎক্ষণাৎ তামুক সাজিয়া আনিয়া দিল। বাবুরামবাবু ঘোর হুঁকারি, দুই-এক টান টানিয়া বলিলেন-ওহে হুঁকাটা পীসে পীসে বল্ছে, খুড়া খুড়া বল্ছে না কেন ? বুদ্ধিমান লোকের নিকট চাকর থাকিলে সেও বুদ্ধিমান হয়। রাম অমনি হুঁকায় ছিঁচ্কা দিয়া-জল ফিরাইয়া-মিঠেকড়া তামাক সেজে-বড়ো দেকে নল করে হুঁকা আনিয়া দিল। বাবুরামবাবু হুঁকা সম্মুখে পাইয়া একবারে যেন ইজারা করিয়া লইলেন-ভড়র ভড়র টানছেন- ধুঁয়া সৃষ্টি করছেন-ও বিজর বিজর বক্ছেন।
বেণীবাবু। মহাশয় একবার উঠে একটা পান খেলে ভালো হয় না ?
বাবুরামবাবু। সন্ধ্যা হল-আর জল খাওয়া থাকুক-এ আমার ঘর-আমাকে বলতে হবে কেন ?
-দেখো মতিলালের বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো হইয়াছে-ছেলেটিকে দেখে চক্ষু জুড়ায়। সম্প্রতি ইংরেজী পড়াইতে বাঞ্ছা করি-অল্প-স্বল্প মাহিনাতে একজন মাস্টার দিতে পারো ?
বেণীবাবু। মাস্টার অনেক আছে, কিন্তু ২০/২৫ টাকা মাসে দিলে একজন মাঝারি গোছের লোক পাওয়া যায়।
বাবুরামবাবু। কত- ২৫ টাকা !!! অহে ভাই, বাটীতে নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ-প্রতিদিন একশত পাত পড়ে-আবার কিছুকাল পরেই ছেলেটির বিবাহ দিতে হইবে। যদি এত টাকা দিব তবে তোমার নিকট নৌকা ভাড়া করিয়া কেন এলাম ?
এই বলিয়া বেণীবাবুর গায়ে হাত দিয়া হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
বেণীবাবু। তবে কলিকাতার কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়া দিউন। একজন আত্মীয়-কুটুম্বের বাটীতে ছেলেটি থাকিবে, মাসে ৩/৪ টাকার মধ্যে পড়াশুনা হইতে পারিবে।
বাবুরামবাবু। এত ? তুমি বলে-কয়ে কমজম করিয়া দিতে পারো না ? স্কুলে পড়া কি ঘরে পড়ার চেয়ে ভালো ?
বেণীবাবু। যদ্যপি ঘরে একজন বিচক্ষণ শিক্ষক রাখিয়া ছেলেকে পড়ানো যায় তবে বড়ো ভালো হয়, কিন্তু তেমন শিক্ষক অল্প টাকায় পাওয়া যায় না, স্কুলে পড়ার গুণও আছে-দোষও আছে। ছেলেদিগের সঙ্গে একত্র পড়াশুনা করিলে পরস্পরের উৎসাহ জন্মে কিন্তু সঙ্গদোষ হইলে কোনো কোনো ছেলে বিগড়িয়া যাইতে পারে, আর ২৫/৩০ জন বালক এক শ্রেণীতে পড়িলে হট্টগোল হয়, প্রতিদিন সকলের প্রতি সমান তদারকও হয়না, সুতরাং সকলের সমানরূপ শিক্ষাও হয় না।
বাবুরামবাবু। তা যাহা হউক-মতিকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিব, দেখেশুনে যাহাতে সুলভ হয় তাহাই করিয়া দিও। যে সকল সাহেবের কর্মকাজ করিয়াছিলাম এক্ষণে তাহাদের কেহ নাই-থাকিলে ধরে-পড়ে অমনি ভর্তি করিতে পারিতাম। আর আমার ছেলে মোটামুটি শিখিলেই বস্ আছে, বড়ো পড়াশুনা করিলে স্বধর্মে থাকিবে না। ছেলেটি যাহাতে মানুষ হয় তাহাই করিয়া দিও-ভাই সকল ভার তোমার উপর।
বেণীবাবু। ছেলেকে মানুষ করিতে গেলে ঘরে-বাইরে তদারক চাই। বাপকে স্বচক্ষে সব দেখ্তে হয়-ছেলের সঙ্গে ছেলে খাটতে হয়। অনেক কর্ম বরাতে চলে বটে কিন্তু এ কর্মে পরের মুখেঝাল খাওয়া হয় না।
বাবুরামবাবু। সে সব বটে-মতি কি তোমার ছেলে নয় ? আমি এক্ষণে গঙ্গাস্নান করিব-পুরাণ শুনিব-বিষয়-আশয় দেখিব-আমার অবকাশ কই ভাই ? আর আমার ইংরেজী শেখা সেকেলে রকম। মতি তোমার-তোমার-তোমার !!! আমি তাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দিয়া নিশ্চন্ত হইব, তুমি যা জানো তাই করিবে কিন্তু ভাই ! দেখো যেন বড়ো ব্যয় হয় না- আমি কাচ্চাবাচ্চাওয়ালা মানুষ-তুমি সকল তো বুঝতে পারো ?
অনন্তর অনেক শিষ্টালাপের পর বাবুরামবাবু বৈদ্যবাটিতে প্রত্যাগমন করিলেন।
০৩.
মতিলালের বালীতে আগমন ও তথায় লীলাখেলা, পরে ইংরাজী শিক্ষার্থে বহুবাজারে অবস্থিতি।
রবিবারে কুঠিওয়ালারা বড়ো ঢিলে দেন—হচ্ছে হবে—খাচ্ছি খাব—বলিয়া অনেক বেলায় স্নান-আহার করেন—তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন—কেহ বা তাস পেটেন—কেহ বা মাছ ধরেন—কেহ বা তবলায় চাঁটি দেন— কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং করেন— কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভালো বুঝেন—কেহ বা বেড়াতে যান—কেহ বা বহি পড়েন। কিন্তু পড়াশুনা অথবা সৎ কথার আলোচনা অতি অল্প হইয়া থাকে। হয় তো মিথ্যা গালগল্প কিংবা দলাদলির ঘোঁট, কি শম্ভু তিনটা কাঁঠাল খাইয়াছে এই প্রকার কথাতেই কাল ক্ষেপণ হয়। বালীর বেণীবাবুর অন্য প্রকার বিবেচনা ছিল। এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়ার শেষ হইল। কিন্তু এ বড়ো ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কুল পাওয়া যায় না, বিদ্যার চর্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে। বেণীবাবু এ বিষয় ভালো বুঝিতেন এবং তদনুসারে চলিতেন। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া আপনার গৃহকর্ম সকল দেখিয়া পুস্তক লইয়া বিদ্যানুশীলন করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ বৎসরের একটি বালক—গলায় মাদুলি—কানে কামড়ি, হাতে বালা ও বাজু, সম্মুখে আসিয়া টিপ করিয়া একটি গড় করিল। বেণীবাবু এক মনে পুস্তক দেখিতেছিলেন বালকের জুতার শব্দে চম্কিয়া উঠিয়া দেখিয়া বলিলেন, ‘এসো বাবা মতিলাল এসো—বাটীর সব ভালো তো? মতিলাল বসিয়া সকল কুশল সমাচার করিল। বাণীবাবু কহিলেন—অদ্য রাত্রে এখানে থাকো কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব—এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুন ক্লেশ বোধ হয়—এজন্য আস্তে আস্তে উঠিয়া বাটীর চতুর্দিকে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল— কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে—কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপদুপ করিতেছে—কখন বা পথিকদিগকে ইট- পাটকেল মারিয়া পিট্রান দিতেছে; এইরূপে দুপ-দুপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল—কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে—কাহারো গাছের ফল পাড়ে—কাহারো মট্কার উপর উঠিয়া লাফয়—কাহারো জলের কলসী ভাঙিয়া দেয়।
বালীর সকল লোকেই ত্যক্ত হইয়া বলাবলি করিতে লাগিল—এ ছোঁড়া কে রে? যেমন ঘরপোড়া দ্বারা লস্কা ছারখার হইয়াছিল আমাদিগের গ্রামটা সেইরূপ তচ্নচ্ হবে না –কি? কেহ কেহ ঐ বালকের পিতার নাম শুনিয়া বলিল—আহা বাবুরামবাবুর এ পুত্র—না হবে কেন? “পুত্রে যশসি তোয়েচ নরাণাং পুণ্যক্ষণম্।”
সন্ধ্যা হইল—শৃগালদিগের হোয়া হোয়া ও ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দে গ্রাম শব্দায়মান হইতে লাগিল। বলীতে অনেক ভদ্রলোকের বসতি—প্রায় অনেকের বাটীতে শালগ্রাম আছেন এজন্য শঙ্খ-ঘণ্টা ধ্বনির ন্যূনতা ছিল না। বেণীবাবু অধ্যয়নান্তর গামোড়া দিয়া তামাক খাইতেছেন ইত্যবসরে একটা গোল উপস্থিত হইল। পাঁচ-সাতজন লোক নিকটে আসিয়া বলিল—মশাই গো! বৈদ্যবাটীর জমিদারের ছেলে আমাদের উপর ইঁটঁ মারিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঝাঁকা ফেলিয়া দিয়াছে—কেহ বলিল—আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়াছে—কেহ বলিল—আমার মুখে থুতু দিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঘিয়ের হাঁড়ি ভাঙিয়াছে। বাণীবাবু পরদুঃখে কাতর—সকলকে তুষেতেষে ও কিছু কিছু দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন, পরে ভাবিলেন এ ছেলের তো বিদ্যা নগদ হইবে—এক বেলাতেই গ্রাম কাঁপিয়া দিয়াছে—এক্ষণে এখন হইতে প্রস্থান করিলে আমার হাড় জুড়ায়।
গ্রামের প্রাণকৃঞ্চ খুড়ে, ভগবতী ঠাকুরদাদা ও ফচ্কে রাজকৃষ্ণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—বাণীবাবু এ ছেলে কে? —আমরা আহার করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলাম—গোলের দাপটে উঠে পড়েছিলাম—কাঁচা ঘুম ভাঙাতে শরীরটা মাটি মাটি করিতেছে। বেণীবাবু কহিলেন—আর ও কথা কেনে বলো? একটা ভারি কর্মভোগে পড়িয়াছি—আমার একটি জমিদার ষণ্ডা কুটুম্ব আছে—তাহার হ্রস্ব দীর্ঘ কিছুই জ্ঞান নাই—কেবল কতকগুলো টাকা আছে। ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য আমার নিকট পাঠাইয়াছেন—কিন্তু এর মধ্যেই হাড় কালি হইল—এমন ছেলেকে তিনদিন রাখিলেই বাটীতে ঘুঘু চরিবে। এইরূপ কথোপকথন হইতেছে—জন কয়েক চেংড়া পশ্চাতে মতিলাল ‘ভজ নর শম্ভুসুতেরে’ বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে আসিল। বেণীবাবু বলিলেন—ঐ আসছে রে বাবু—চুপ কর—আবার দুই-এক ঘা বসিয়ে দেবে না-কি? পাপকে বিদায় পারিলে বাঁচি। মতিলাল বেণীবাবুকে দেখিয়া দাঁত বাহির করিয়া ঈষদ্ধাস্য করত কিঞ্চিৎ সস্কুচিত হইল। বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—বাবু কোথায় গিয়েছিলে? মতিলাল বলিল—মহাশয়দের গ্রামটা কত বড়ো তাই দেখে এলেম।
পরে বাটীর ভিতর যাইয়া মতিলাল রাম চাকরকে তামাক আনিতে বলিল। অম্বুরি অথবা ভেলসায় সানে না—কড়া তামাকের উপর কড়া তামাক খাইতে লাগিল। রাম তামাক যোগাইয়া উঠিতে পারে না—এই আনে—এই নাই । এইরূপ মুহুর্মুহু তামাক দেওয়াতে রাম অন্য কোনো কর্ম করিতে পারিল না। বাণীবাবু রোয়াকে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন ও এক-এক বার পিছন ফিরিয়া মিট মিট করিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলেন।
আহারের সময় উপস্থিত হইল। বেণীবাবু অন্তঃপুরে মতিলালকে লইয়া উত্তম অন্ন-ব্যঞ্জন ও নানা প্রকার চর্চা-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দ্বারা পরিতোষ করাইয়া তাম্বুলগ্রহণান্তর আপনি শয়ন করিতে গেলেন। মতিলাল শয়নগারে গিয়া পান-তামাক খাইয় বিছেনার ভিতর ঢুকিল। কিছু কাল এপাশ ওপাশ করিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া এক-এক বার পায়চারি করিতে লাগিল ও এক-এক বার নীলু ঠাকুরের সখীসংবাদ অথবা রাম বসুর বিরহ গাইতে লাগিল। গানের চোটে বাটীর সকলের নিদ্রা ছুটে পালাইল।
চণ্ডীমণ্ডপে রাম ও কাশীজোড়া নিবাসী পেলারাম মালী শয়ন করিয়াছিল। দিবসে পরিশ্রম করিলে নিদ্রাটি বড়ো আরামে হয়, কিন্তু ব্যঘাত হইলে অত্যন্ত বিরক্তি জন্মে। গানের চিৎকারে চাকরের ও মালীর নিদ্রা ভাঙিয়া গেল ।
পেলারাম। অহে বাপা রাম ! এ সড়ার চিড়কারে মোর লিদ্রা হতেছে না—উঠে বাগানে বীজ গুঁড়া কি পেড়াইব?
রাম। (গা মোড় দিয়া) আরে রাত ঝিঁ ঝিঁ কচ্চে—এখন কেন উঠ্বি ? বাবু ভালো নালা কেটে জল এনেছে—এ ছোঁড়া কান ঝালা-পালা কল্লে—গেলে বাঁচি।
পরদিন প্রভাতে বেণীবাবু মতিলালকে লইয়া বৌবাজারের বেচারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বেচারামবাবু কেনারামবাবুর পুত্র—বুনিয়াদী বড়ো মানুষ—সন্তানাদি কিছুই নাই—সাদাসিধে লোক কিন্তু জন্মাবধি গঁর্ণখাঁদা—অল্প অল্প পিট্পিটে ও চিড়চিড়ে। বেণীবাবুকে দেখিয়া স্বাভাবিক নাকিস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন—’আরে কও কি মনে করে?’
বাণীবাবু। মতিলাল মহাশয়ের বাটীতে থাকিয়া স্কুলে পড়বে—শনিবার শনিবার ছুটি পাইলে বৈদ্যবাটী যাইবে। বাবুরামবাবুর কলিকাতায় আপনার মতো আত্নীয় আর নাই এজন্য এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি।
বেচারাম। তার আটক কি? —এও ঘর সেও ঘর। আমার ছেলেপুলে নাই— কেবল দুই ভাগিনেয় আছে—মতীলাল স্বচ্ছন্দে থাকুক।
বেচারামবাবুর নাকিস্বরের কথা শুনিয়া মতিলাল খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। অমনি বাণীবাবু উহুঁ উহুঁ করত চোখ টিপ্তে লাগিলেন ও মনে করিলেন এমন ছেলে সঙ্গে থাকিলে কোথাও সুখ নাই। বেচারামবাবু মতিলালের হাসি শুনিয়া বলিলেন—বেণী ভায়া ! ছেলেটি কিছু বেদ্ড়া দেখতে পাই যে? বোধ হয় বালককালাবধি বিশেষ নাই পাইয়া থাকিবে। বাণীবাবু অতি অনুসন্ধনী—পূর্বকথা সকলি জানেন, আপনিও ভুগেছেন—কিন্তু নিজ গুণে সকল ঢেকে ঢুকে লইলেন—গুপ্ত কথা ব্যক্ত করিলে মতিলাল মারা যায়—তাহার কলিকাতায় থাকাও হয় না ও স্কুলে পড়াও হয় না। বেণীবাবু নিতান্ত বাসনা সে কিছু লেখাপড়া শিখিয়া কোনো প্রকার মানুষ হয়।
অনন্তর অন্যান্য প্রকার অনেক আলাপ করিয়া বেচারামবাবুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া বেণীবাবু মতিলালকে সঙ্গে করিয়া শরবোরণ সাহেবের স্কুলে আসিলেন। হিন্দু কলেজ হওয়াতে শরবোরণ সাহেবের স্কুল কিঞ্চিৎ মেড়ে পড়িয়াছিল এজন্য সাহেব দিন রাত্রি উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন—তাঁহার শরীর মোটা—ভুরুতে রোঁ ভরা—গালে সর্বদা পান—বেত হাতে—এক একবার ক্লাসে ক্লাসে বেড়াইতেন ও এক একবার চৌকিতে বসিয়া গুড়গুড়ি টানিতেন। বেণীবাবু তাঁহার স্কুলে মতিলালকে ভর্তি করিয়া দিয়া বলীতে প্রত্যাগমন করিলেন।
০৪.
কলিকাতায় ইংরাজী শিক্ষার বিবরণ, শিশুশিক্ষার প্রকরণ, মতিলালের কুসঙ্গ ও ধৃত হইয়া পুলিশে আনয়ন।
প্রথম যখন ইংরাজেরা কলিকাতায় বাণিজ্য করিতে আইসেন, সে সময়ে সেট বসাখ বাবুরা সওদাগরী করিতেন, কিন্তু কলিকাতার একজনও ইংরাজী ভাষা জানিত না। ইংরাজদিগের সহিত কারবারের কথাবর্তা ইশারা দ্বারা হইত। মানব স্বভাব এই যে, চাড় পড়িলেই ফিকির বেরোয়, ইশারা দ্বারাই ক্রমে ক্রমে কিছু কিছু ইংরজী কথা শিক্ষা হইতে আরম্ভ হইল। পরে সুপরিম কোর্ট স্থাপিত হইলে, আইন-আদালতের ধাক্কায় ইংরাজী চর্চা বাড়িয়া উঠিল। ঐ সময় রামরাম মিশ্রী ও আনন্দিরাম দাস অনেক ইংরাজী কথা শিখিয়াছিলেন। রামরাম মিশ্রীর শিষ্য রামনারায়ণ মিশ্রী উকিলের কেরানিগিরি করিতেন ও অনেক লোকের দরখাস্ত লিখিয়া দিতেন, তাঁহার একটি স্কুল ছিল তথায় ছাত্রদিগকে ১৪।১৬ টাকা করিয়া মাসে মাহিনা দিতে হইত। পরে রামলোচন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু প্রভৃতি অনেকেই স্কুল-মাস্টারগিরি করিয়াছিলেন। ছেলেরা তামস্ডিস্ পড়িত ও কথার মানে মুখস্থ করিত। বিবাহে অথবা ভোজের সভায়, যে ছেলে জাইন ঝাড়িতে পারিতে, সকলে তাহাকে চেয়ে দেখিতেন ও সাবাস বাওহা দিতেন।
ফ্রেন্কো ও আরাতুন পিট্রস প্রভৃতির দেখাদেখি শরবোরণ সাহেব কিছু কাল পরে স্কুল করিয়াছিলেন। ঐ স্কুলে সম্ভ্রান্ত লোকের ছেলেরা পড়িতেন।
যদি ছেলেদিগের আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তবে তাহারা যে স্কুলে পড়ুক আপন আপন পরিশ্রমের জোরে কিছু না কিছু অবশ্যই শিখিতে পারে। সকল স্কুলেরই দোষ গুণ আছে , এবং এমন এমন অনেক ছেলেও আছে যে এ স্কুল ভালো নয়, ও স্কুল ভালো নয় বলিয়া, আজি এখানে কালি ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়—মনে করে, গোলমালে কাল কাটাইয়া দিতে পারিলেই বাপ-মাকে ফাঁকি দিলাম। মতিলাল শরবোরণ সাহেবের স্কুলে দুই-একদিন পড়িয়া, কালুস সাহেবের স্কুলে ভর্তি হইল।
লেখাপড়া শিখিবার তৎপর্য এই যে, সৎ স্বভাব ও সৎ চরিত্র হইবে—সুবিবেচনা জন্মিবে ও যে যে-বিষয়-কর্মে লাগিতে পারে, তাহা ভালো করিয়া শেখা হইবে। এই অভিপ্রায় অনুসারে বালকদিগের শিক্ষা হইলে তাহারা সর্বপ্রকারে ভদ্র হয় ও ঘরে-বাহিরে সকল কর্ম ভালোরূপ বুঝিতেও পরে—করিতেও পারে। কিন্তু এমতো শিক্ষা দিতে হইলে, বাপ-মারও যত্ন চাই—শিক্ষকেরও যত্ন চাই। বাপ যে পথে যাবেন, ছেলেও সেই পথে যাবে। ছেলেকে সৎ করিতে হইলে, আগে বাপের সৎ হওয়া উচিত। বাপ মদে ডুবে থাকিয়া ছেলেকে মদ খেতে মানা করিলে, সে তাহা শুন্বে কেন? বাপ অসৎ কর্মে রত হইয়া নীতি উপদেশ দিলে, ছেলে তাকে বিড়াল তপস্বী জ্ঞান করিয়া উপহাস করিবে। যাহার বাপ ধর্মপথে চলে তাহার পুত্রের উপদেশ বড়ো আবশ্যক করে না—বাপের দেখাদেখি পুত্রের সৎ স্বভাব আপনা আপনি জন্মে ও মাতারও আপন শিশুর প্রতি র্সবদা দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। জননীর মিষ্টবাক্যে, স্নেহে এবং মুখচুম্বনে শিশুর মন যেমন নরম হয়, এমন কিছুতেই হয় না। শিশু যদি নিশ্চয়রূপে জানে যে এমন এমন কর্ম করিলে আমাকে মা কোলে লইয়া আদর করিবে না, তাহা হইলেই তাহার সৎ সংস্কার বদ্ধমূল হয়। শিক্ষকের কর্তব্য যে, শিষ্যকে কতকগুলা বহি পড়াইয়া কেবল তোতা পাখী না করেন। যাহা পড়িবে তাহা মুখস্থ করিলে স্মরণশক্তির বৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু তাহাতে যদ্যপি বুদ্ধির জোর ও কাজের বিদ্যা না হইল, তবে সে লেখাপড়া শেখা কেবল লোক দেখাবার জন্য। শিষ্য বড়ো হউক বা ছোট হউক, তাহাকে এমন করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবেক যে, পড়াশুনাতে তাহার মন লাগে—সেরূপ বুঝানো শিক্ষার সুধারা ও কৌশলের দ্বারা হইতে পারে—কেবল তাঁইস করিলে হয় না।
বৈদ্যবাটীর বাটীতে থাকিয়া মতিলাল কিছুমাত্র সুনীতি শেখে নাই। এক্ষণে বহুবাজারে থাকিতে হিতে বিপরীত হইল। বেচারামবাবুর দুই জন ভাগিনেয় ছিল, তাহাদের নাম হলধর ও গদাধর, তাহারা জন্মাবধি পিতা কেমন দেখে নাই। মাতার ও মাতুলের ভয়ে এক একবার পাঠশালায় গিয়া বসিত, কিন্তু সে নামমাত্র, কেবল পথে ঘাটে—ছাতে মাঠে—ছুটাছুটি হুটোহুটি করিয়া বেড়াইত। কেহ দমন করিলে দমন শুনিত না—মাকে বলিত, তুমি এমন করো তো আমরা বেরিয়ে যাব। একে চায় আরে পায়—তাহারা দেখিল মতিলালও তাহাদেরই একজন। দুই-এক দিনের মধ্যেই হলাহলি গলাগলি ভাব হইল। এক জায়গায় বসে—এক জায়গায় খায়—এক জায়গায় শোয়। পরস্পর এ ওর কাঁধে হাত দেয় ও ঘরে-দ্বারে বাহিরে-ভিতরে হাত ধরাধরি ও গলা জড়াজড়ি করিয়া বেড়ায়। বেচারামবাবুর ব্রাক্ষ্ণণী তাহাদিগকে দেখিয়া এক এবার বলিতেন—আহা এরা যান এক মার পেটের তিনটি ভাই ।
কি শিশু কি যুবা কি বৃদ্ধ ক্রমাগত চুপ করিয়া, অথবা এক প্রকার কর্ম লইয়া থাকিতে পারে না। সমস্ত দিন রাত্রির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন কর্মে সময় কাটাইবার উপায় চাই। শিশুদিগের প্রতি এমন নিয়ম করিতে হইবেক যে তাহারা খেলাও করিবে—পড়াশুনাও করিবে। ক্রমাগত খেলা করা অথবা ক্রমাগত পড়াশুনা করা ভালো নহে। খেলাধুলা করিবার বিশেষ তাৎর্পয এই যে, শরীর তাজা হইয়া উঠিলে তাহাতে পড়াশুনা করিতে অধিক মন যায়। ক্রমাগত পড়াশুনা করিলে মন দুর্বল হইয়া পড়ে—যাহা শেখা যায় তাহা মনে ভেসে ভেসে থাকে— ভালো করিয়া প্রবেশ করে না। কিন্তু খেলারও হিসাব আছে, যে-যে খেলায় শারীরিক পরিশ্রম হয়, সেই খেলাই উপকারক। তাস পাশা প্রভৃতিতে কিছুমাত্র ফল নাই—তাহাতে কেবল অলস্য স্বভাব বাড়ে—সেই আলস্যেতে নানা উৎপাত ঘটে। যেমন ক্রমাগত পড়াশুনা করিলে পড়াশুনা ভালো হয় না, তেমন ক্রমাগত খেলাতেও বুদ্ধি হোঁতকা হয়। কেননা খেলায় কেবল শরীর সবল হইতে থাকে—মনের কিছুমাত্র শাসন হ্য় না, কিন্তু মন একটা না একটা বিষয় লইয়া অবশ্যই নিযুক্ত থকিবে, এমন অবস্থায় তাহা কি কুপথে বই সুপথে যাইতে পারে? অনেক বালক এইরূপেই অধঃপাতে গিয়া থাকে।
হলধর, গদাধর ও মতিলাল গোকুলের ষাঁড়ের ন্যায় বেড়ায়— যাহা মনে যায় তাই করে— কাহারো কথা শুনে না— কাহাকেও মানে না। হয় তাস—নয় পাশা— নয় ঘুড়ি—পায়রা—নয় বুলবুল, একটা না একটা লইয়া সর্বদা আমোদেই আছে।
খাবার অবকাশ নাই—শোবার অবকাশ নাই—বাটীর ভিতর যাইবার জন্য চাকর ডাকিতে আসিলে, অমনি বলে—যা বেটা যা, আমরা যাব না। দাসী আসিয়া বলে অগো মা-ঠাকুরানী যে শুতে পান না। তাহাকেও বলে—দূর হ হারামজাদী ! দাসী মধ্যে মধ্যে বলে, আ মরি, কী মিষ্ট কথাই শিখেছ! ক্রমে ক্রমে পাড়ার যত হতভাগা লক্ষ্ণীছাড়া—উনপাজুরে—বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটিতে আরম্ভ হইল। দিবারাত্রি হট্রগোল—বৈঠকখানায় কান পাতা ভার—কেবল হো হো শব্দ— হাসির গর্রা ও তামাক-চরস গাঁজার ছররা, ধোঁয়াতে অন্ধকার হইতে লাগিল। কার সাধ্য সে দিক দিয়া যায়— কার বাপের সাধ্য যে মানা করে। বেচারামবাবু এক একবার গন্ধ পান—নাক টিপে ধরেন আর বলেন— দূঁর দূঁর।
সঙ্গদোষের ন্যায় আর ভয়ানক নাই। বাপ-মা ও শিক্ষক সর্বদা যত্ন করিলেও সঙ্গদোষে সব যায়, যে স্থলে ঐরূপ যত্ন কিছুমাত্র নাই, সে স্থলে সঙ্গদোষে কত মন্দ হয়, তাহা বলা যায় না।
মতিলাল যে সকল সঙ্গী পাইল, তাহাতে তাহার সুস্বভাব হওয়া দূরে থাকুক, কুস্বভাব ও কুমতি দিন দিন বাড়িতে লাগিল। সপ্তাহে দুই-এক দিন স্কুলে যায় ও অতিকষ্টে সাক্ষিগোপালের ন্যায় বসিয়া থাকে। হয় তো ছেলেদের সঙ্গে ফট্কি নাট্কি করে— নয় তো সিলেট লইয়া ছবি আঁকে— পড়াশুনায় পাঁচ মিনিটও মন দেয় না। সর্বদা মন উড়ু উড়ু, কতক্ষণে সমবয়সীদের সঙ্গে ধুমধাম ও আহলাদ আমোদ করিব! এমন এমন শিক্ষকও আছেন যে, মতিলালের মতো ছেলের মন কৌশলের দ্বারা পড়াশুনায় ভেজাইতে পারেন। তাঁহারা শিক্ষা করাইবার নানা প্রকার ধারা জানেন—যাহার প্রতি যে ধারা খাটে, সেই ধারা অনুসারে শিখা দেন। এক্ষণে সরকারী স্কুলে যেরূপ ভড়ুঙ্গে রকম শিক্ষা হইয়া থাকে, কালুস সাহেবের স্কুলেও সেইরূ্প শিক্ষা হইত। প্রত্যেক ক্লাসের প্রত্যেক বালকের প্রতি সমান তদারক হইত না—ভারি ভারি বহি পড়িবার অগ্রে সহজ সহজ বহি ভালোরূপে বুঝিতে পারে কি-না, তাহার অনুসন্ধান হইত না—অধিক বহি ও অনেক করিয়া পড়া দিলেই স্কুলের গৌরব হইবে এই দৃঢ় সংস্কার ছিল— ছেলেরা মুখস্ত বলে গেলেই হইল, —বুঝুক না বুঝুক জানা অবশ্যক বোধ হইত না এবং কি কি শিক্ষা করাইলে উত্তরকালে কর্মে লাগিতে পারিবে তাহারও বিবেচনা হইত না। এমতো স্কুলে যে ছেলে পড়ে তাহার বিদ্যা শিক্ষা কপালের বড়ো জোর না হইলে হয় না।
মতিলাল যেমন বাপের বেটা—যেমন সহবাস পাইয়াছিল—যেমন স্থানে বাস করিত—যেমন স্কুলে পড়িতে লাগিল তেমনি তাহার বিদ্যাও ভারি হইল। এক প্রকার শিক্ষক প্রায় কোনো স্কুলে থাকে না, কেহ-বা প্রাণান্তিক পরিশ্রম করিয়া মরে—কেহ বা গোঁপে তা দিয়া উপর চাল চলিয়া বেড়ায়। বটতলার বক্রেশ্বরবাবু কালুস সাহেবের সোনার কাটি রুপার কাটি ছিলেন। তিনি যাবতীয় বড়ো মানুষের বাটীতে যাইতেন ও সকলেকেই বলিতেন—আপনার ছেলের আমি সর্বদা তদারক করিয়া থাকি—মহাশয়ের ছেলে না হবে কেন! সে তো ছেলে নয় পরশ পাথর! স্কুলের উপর উপর ক্লাসের ছেলেদিগকে পড়াইবার ভার ছিল, কিন্তু যাহা পড়াইতেন, তাহা নিজে বুঝিতে পারিতেন কি-না সন্দেহ। এ কথা প্রকাশ হইল ঘোর অপমান হইবে, এজন্য চেপে চুপে রাখিতেন। বালকদিগকে কেবল মথন পড়ায়তেন—মানে জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, ডিক্সনেরী দেখ। ছেলেরা যাহা তরজমা করিত, তাহার কিছু না কিছু কাটাকুটি করিতে হয়, সব বজায় রাখিলে মাস্টারগিরি চলে না, কার্য শদ্ব কাটিয়া কর্ম লিখিতেন, অথবা কর্ম শব্দ কাটিয়া কার্য লিখিতেন—ছেলেরা জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, তোমরা বড়ো বে-আদব, আমি যাহা বলিব তাহার উপর আবার কথা কও? মধ্যে মধ্যে বড়োমানুষের ছেলেদের লইয়া বড়ো আদর করিতেন ও জিজ্ঞাসা করিতেন—তোমাদের অমুক জায়গার ভাড়া কত—অমুক তালুকের মুনাফা কত? মতিলাল অল্প দিনের মধ্যে বক্রেশ্বরবাবুর অতি প্রিয়পাত্র হইল। আজ ফুলটি, কাল ফলটি, আজ বইখানি, কাল হাত-রুমালখানি আনিত, বক্রেশ্বরবাবু মনে করিতেন মতিলালের মত ছেলেদিগকে হাতছাড়া করা ভালো নয়—ইহারা বড়ো হইয়া উঠিলে আমার বেগুন ক্ষেত হইবে! স্কুলের তদারকের কথা লইয়া খুঁটিনাটি করিলে আমার কি পরকালে সাক্ষী দিবে?
শারদীয় পূজার সময় উপস্থিত—বাজারে ও স্থানে স্থানে অতিশয় গোল—ঐ গোলে মতিলালের গোলে হরিবোল বাড়িতে লাগিল। স্কুলে থাকিতে গেলে ছটফটানি ধরে—একবার এদিগে দেখে—এবার ওদিগে দেখে—একবার বসে—একবার ডেক্স বাজায়,—এক লহমাও স্থির থাকে না। শনিবারে স্কুলে আসিয়া বক্রেশ্বরবাবুকে বলিয়া কহিয়া হাপ স্কুল করিয়া বাটী যায়। পথে পানের খিলি খরিদ করিয়া, দুই পাশে পায়রাওয়ালা ও ঘুড়িওয়ালা দোকান দেখিয়া যাইতেছে—অম্লান মুখ, কাহারও প্রতি দৃক্পাত নাই, ইতিমধ্যে পুলিশের একজন সারজন ও কয়েকজন পেয়াদা দৌড়িয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল। সারজন কহিল—তোমারা নাম পর পুলিশমে গেরেফ্তারি হুয়া—তোমকো জরির জানে হোগা । মতিলাল হাত বাগড়া বাগড়ি করিতে আরম্ভ করিল। সারজন বলবান—জোরে হিড় হিড় করিয়া টানায়া লইয়া যাইতে লাগিল। মতিলাল ভূমিতে পড়িয়া গেল—সমস্ত শরীরে ছড়াই গিয়া ধুলায় পরিপূর্ণ হইল, তবুও একবার ছিনিয়া পলাইতে চেষ্টা করিতে লাগিল, সারজনও মধ্যে মধ্যে দুই এক কিল ও ঘুষা মারিতে লাগিল। অবশেষে রাস্তায় পড়িয়া বাপকে স্মরণ করিয়া কাঁদিতে লাগিল, এক এক বার তাহার মনে উদয় হইল যে কেন এমন কর্ম করিয়াছিলাম—কুলোকের সঙ্গী হইয়া আমার সর্বনাশ হইল। রাস্তায় অনেক লোক জমিয়া গেল। এ ওকে জিজ্ঞাসা করে—ব্যাপারটা কি? দুই একজন বুড়ী বলাবলি কেইতে লাগিল, আহ, কার বাছাকে এমন করিয়া মারে গা—ছেলেটির মুখ যেন চাঁদের মতো—ওর কথা শুনে আমাদের প্রাণ কেঁদে উঠে।
সূর্য অস্ত না হইতে হইতে মতিলাল পুলিশে আনীত হইল, তথায় দেখিল যে হলধর, গদাধর ও পড়ার রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ প্রভৃতিকেও ধরিয়া আনিয়াছে। তাহারা সকলে অধোমুখে একপাশে দাঁড়াইয়া আছে। বেলাকিয়র সাহেব ম্যাজেস্ট্রেট—তাঁহাকে তজ্বিজ্ করিতে হইবে, কিন্তু তিনি বাটী গিয়াছেন, এজন্য সকল আসামীকে বেনিগারদে থাকিতে হইল।
০৫.
বাবুরামবাবুকে সংবাদ দেওনার্থে প্রেমনারায়ণকে প্রেরণ, বাবুরামের সভাবর্ণন, ঠকচাচার পরিচয়, বাবুরামের স্ত্রীর সহিত কথোপকথন, কলিকাতায় আগমন, প্রভাতকালীন কলিকাতার বর্ণন, বাবুরামের বাঞ্ছারামের বাটীতে গমন, তথায় আত্নীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎ ও মতিলাল সংক্রান্ত কথোপকথন ।
“শ্যামের নাগাল পালাম না গো সই—ওগো মরমেতে মরে রই”—টক্—টক্—পটাস্—পটাস্, মিয়াজান গাড়োয়ান এক একবার গান করিতেছে—টিটকারি দিতেছে ও শালার গোরু চলতে পারে না বলে লেজ মুচড়াইয়া সপাৎ সপাৎ মারিতেছে। একটু একটু মেঘ হইয়াছে—একটু একটু বৃষ্টি পড়িতেছে—গোরু দুটা হন্ হন্ করিয়া চলিয়া একখানা ছকড়া গাড়ীকে পিছে ফেলিয়া গেল। সেই ছকড়ায় প্রেমনারায়ণ মজুমদার যাইতেছিলেন—গাড়ীখানা বাতাসে দোলে—ঘোড়া দুটা বেটো ঘোড়ার বাবা—পক্ষিরাজের বংশ—টংয়স টংয়স ডংয়স ডংয়স করিয়া চলিতেছে—পটাপট্ পটাপট্ চাবুক পড়িতেছে কিন্তু কোনোক্রমেই চাল বেগড়ায় না। প্রেমনারায়ণ দুইটা ভাত মুখে দিয়া সওয়ার হইয়াছেন—গাড়ীর হোঁকোঁচ হোঁকোঁচে প্রাণ ওষ্ঠগত। গোরুর গাড়ী এগিয়ে গেল তাহাতে আরো বিরক্ত হইলেন। এ বিষয়ে প্রেমনারায়ণের দোষ দেওয়া মিছে—অভিমান ছাড়া লোক পাওয়া ভার। প্রায় সকলেই আপনাকে আপনি বড়ো জানে। একটুকু মনের ক্রটি হইলেই কেহ কেহ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে—কেহ কেহ মুখটি গোঁজ করিয়া বসিয়া থাকে। প্রেমনারায়ণ বিরক্ত হইয়া আপন মনের কথা আপনি বলিতে লাগিলেন—চাকরি করা ঝাক্মারি—চাকরে কুকুরে সমান—হুকুম করিলে দৌড়িতে হয়। মতে, হলা, গদার জ্বালায় চিরকালটা জ্বলে মরেছি—আমাকে খেতে দেয় নাই—শুতে দেয় নাই—আমার নামে গান বাঁধিত—সর্বদা ক্ষুদে পিঁপড়ার কামড়ের মতো ঠাট্টা করিত—আমাকে ত্যক্ত করিবার জন্য রাস্তার ছোঁড়াদের টুইয়ে দিত ও মধ্যে মধ্যে আপনারাও আমার পেছনে হাততালি দিয়া হো হো করিত। এ সব সহিয়া কোন্ ভালো মানুষ টিকিতে পারে? ইহাতে সহজ মানুষ পাগল হয়। আমি যে কলিকাতা ছেড়ে পলাই নাই এই আমার বাহাদুরি—আমার বড়ো গুরুবল যে অদ্যাপিও সরকারগিরি কর্মটি বজায় আছে। ছোঁড়াদের যেমন কর্ম তেমনি ফল। এখন জেলে পচে মরুক—আর যেন খালাস হয় না—কিন্তু এ কথা কেবল কথার কথা, আমি নিজেই খালাসের তদ্বিরে যাইতেছি। মানিবওয়ারি কর্ম, চারা কি? মানুষকে পেটের জ্বালায় সব করিতে হয়।
বৈদ্যবাটীর বাবুরামবাবু বাবু হইয়া বলিয়াছেন। হরে পা টিপিতেছেন । এক পাশে দুই—একজন ভট্টাচার্য বসিয়া শাস্ত্রীয় তর্ক করতেছে—আজ লাউ খেতে আছে—কাল বেগুন খেতে নাই—লবণ দিয়ে দুগ্ধ খাইলে সদ্যগোমাংস ভক্ষণ করা হয় ইত্যাদি কথা লইয়া ঢেঁকির কচ্কচি করিতেছেন। এক পাশে কয়েকজন শতরঞ্চ খেলিতেছে । তাহার মধ্যে একজন খেলোয়াড় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে—তাহার সর্বনাশ উপস্থিত উঠসার কিস্তিতেই মাত। এক পাশে দুই-একজন গায়ক যন্ত্র মিলাইতেছে—তানপুরা মেঁও মেঁও করিয়া ডাকিতেছে। এক পাশে মুহুরীরা বসিয়া খাতা লিখিতেছে —সম্মুখে কর্জদার প্রজা ও মহাজন সকলে দাঁড়াইয়া আছে—অনেকের দেনা-পাওনা ডিক্রি ডিস্মিস হইতেছে—বৈঠকখানা লোকে থই থই করিতেছে। মহাজনেরা কেহ কেহ বলিতেছে—মহাশয় কাহারো তিন বৎসর—কাহারো চার বৎসর হইল আমরা জিনিস সরবরাহ করিয়াছি, কিন্তু টাকা না পাওয়াতে বড়ো ক্লেশ হইতেছে—আমরা অনেক হাঁটহাঁটি করিলাম—আমাদের কাজকর্ম সব গেল। খুচরা খুচরা মহাজনেরা যথা—তেলওয়ালা, কাঠওয়ালা, সন্দেশওয়ালা তাহারাও কেঁদে ককিয়ে কহিতেছে—মহাশয় আমরা মারা গেলাম—আমাদের পুঁটিমাছের প্রাণ—এমন করিলে আমরা—কেমন করে বাঁচিতে পারি ? টাকার তাগাদা করিতে করিতে আমাদের পায়ের বাঁধন ছিড়িয়া গেল, —আমাদের দোকান-পাট সব বন্ধ হইল, মাগ ছেলেও শুকিয়ে মরিল। দেওয়ানজী এক একবার উত্তর করিতেছে—তোরা আজ যা, টাকা পাবি বই কি—এত বকিস্ কেন? তাহার উপর যে চোড়ে কথা কহিতেছে অমনি বাবুরামবাবু চোখ-মুখ ঘুরাইয়া তাহাকে গালিগালাজ দিয়া বাহির করিয়া দিতেছেন। বাঙালী বড়োমানুষ বাবুরা দেশসুদ্ধ লোকের জিনিস ধারে লন—টাকা দিতে হইলে গায়ে জ্বর অইসে —বাক্সের ভিতর টাকা থাকে কিন্তু টাল-মাটাল না করিলে বৈঠকখানা লোকে সরগরম ও জমজমা হয় না। গরীব-দুঃখী মহাজন বাঁচিল কি মরিল তাহাতে কিছু এসে যায় না, কিন্তু এরূপ বড়োমানুষি করিলে বাপ পিতামহের নাম বজায় থাকে। অন্য কতকগুলা ফতো বড়োমানুষ আছে—তাহাদের উপরে চাকন চিকণ, ভিতরে খ্যাঁড়। বাহিরে কোঁচার পত্তন ঘরে ছুঁচার কীর্তন, আয় দেখে ব্যয় করিতে হইলেই যমে ধরে—তাহাতে বাগানও হয় না—বাবুগিরিও চলে না। কেবল চটক দেখাইয়া মহাজনের চক্ষে ধূলা দেয় —ধারে টাকা কি জিনিস পাইলে দুআওরি লয়— বড়ো পেড়াপীড়ি হইলে এর নিয়ে ওকে দেয় অবশেষে সমন-ওয়ারিন বাহির হইলে বিষয়-আশয় বেনামী করিয়া গা ঢাকা হয়।
বাবুরামবাবুর টাকাতে অতিশয় মায়া—বড়ো হাত ভারি—বাক্স থেকে টাকা বাহির করিতে হইলে বিষম দায় হয়। মহাজনদিগের সহিত কচ্কচি ঝক্ঝকি করিতেছেন, ইতিমধ্যে প্রেমনারায়ণ মজুমদার আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কলিকাতার সকল সমাচার কানে কানে বলিলেন। বাবুরামবাবু শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া থাকিলেন —বোধ হইল যেন বজ্র ভাঙিয়া তাহার মাথায় পড়িল। ক্ষণেক কাল পরে সুস্থির হইয়া ভাবিয়া মোকাজান মিয়াকে ডাকাইলেন। মোকাজান আদালতের কর্মে বড়ো পটু। অনেক জমিদার নীলকর প্রভৃতি সর্বদা তাহার সহিত পরামর্শ করিত। জাল করিতে —সাক্ষী সাজাইয়া দিতে— দারোগা ও আমলাদিগকে বশ করিতে —গাঁতের মাল লইয়া হজম করিতে —দাঙ্গা-হাঙ্গামের জোটপাট ও হয়কে নয় করিতে নয়কে হয় করিতে তাহার তুল্য আর একজন পাওয়া ভার। তাহাকে আদর করিয়া সকলে ঠকচাচা বলিয়া ডাকিত, তিনিও তাহাতে গলিয়া যাইতেন এবং মনে করিতেন আমার শুভক্ষণে জন্ম হইয়াছে— রমজান ঈদ শবেবরাত আমার করা সার্থক — বোধ হয় পীরের কাছে কষে ফয়তা দিলে আমার কুদ্রত আরও বাড়িয়া উঠিবে। এই ভাবিয়া একটা বদনা লইয়া অজু করিতেছিলেন, বাবুরামবাবুর ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে তাড়াতাড়ি করিয়া আসিয়া নির্জনে সকল সংবাদ শুনিলেন। কিছুকাল ভাবিয়া বলিলেন — ডর কি বাবু ? এমন কত শত মকদ্দমা মুই উড়াইয়া দিয়েছি — এ বা কোন ছার ? মোর কাছে পাকা পাকা লোক আছে — তেনাদের সাথে করে লিয়ে যাব — তেনাদের জবানবন্দিতে মকদ্দমা জিত্ব, কিছু ডর কর না — কেল খুব ফজরে এসবো, এজ্ চললাম।
বাবুরামবাবু সাহস পাইলেন বটে, তথাপি ভাবনায় অস্থির হইতে লাগিলেন। আপনার স্ত্রীকে বড়ো ভালোবাসিতেন, স্ত্রী যাহা বলিতেন সেই কথাই কথা — স্ত্রী যদি বলিতেন এ জল নয় — দুধ, তবে চোখে দেখিলেও বলিতেন এ জল নয় — এ দুধ — না হলে গৃহিণী কেন বলবেন ? অন্যান্য লোকে আপন আপন পত্নীকে ভালবাসে বটে, কিন্তু তাহারা বিবেচনা করিতে পারে যে স্ত্রীর কথা কোন্ বিষয়ে ও কতদূর পর্যন্ত শুনা উচিত। সুপুরুষ আপন পত্নীকে অন্তকরণের সহিত ভালবাসে কিন্তু স্ত্রীর সকল কথা শুনিতে গেলে পুরুষকে শাড়ী পরিয়া বাটীর ভিতর থাকা উচিত। বাবুরামবাবু স্ত্রী উঠ বলিলে উঠিতেন — বস বলিলে বসিতেন। কয়েক মাস হইল গৃহিণীর একটি নবকুমার হইয়াছে — কোলে লইয়া আদর করিতেছেন — দুই দিকে দুই কন্যা বসিয়াছে, ঘরকন্নার ও অন্যান্য কথা হইতেছে, এমতো সময়ে কর্তা বাটীর মধ্যে গিয়ে বিষণ্ণভাবে বসিলেন এবং বলিলেন—গিন্নী ! আমার কপাল বড়ো মন্দ—মনে করিয়াছিলাম মতি মানুষমুনুষ হইলে তাহাকে সকল বিষয়ের ভার দিয়া আমরা কাশীতে গিয়া বাস করিব, কিন্তু সে আশায় বুঝি বিধি নিরাশ করলেন।
গৃহিণী। ওগো—কি—কি—শীঘ্র বলো, কথা শুনে যে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল—আমার মতি তো ভালো আছে ?
কর্তা। হাঁ—ভালো আছে—শুনিলাম পুলিশের লোক আজ তাহাকে ধরে হিঁচুড়ে লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে।
গৃহিণী। কি বল্লে ?—মতিকে হিঁচুড়িয়া লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে? ওগো, কেন কয়েদ করেছে? আহা বাছার গায়ে কতই ছড় গিয়াছে, বুঝি আমার বাছা খেতেও পায় নাই—শুতেও পায় নাই ! ওগো কি হবে? আমার মতিকে এখুনি আনিয়া দাও।
এই বলিয়া গৃহিণী কাঁদিতে লাগিলেন—দুই কন্যা চক্ষের জল মুছাইতে মুছাইতে নানা প্রকার সান্ত্বনা করিতে আরম্ভ করিল। গৃহিণীর রোদন দেখিয়া কোলের শিশুটিও কাঁদিতে লাগিল।
ক্রমে ক্রমে কথাবার্তার ছলে কর্তা অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন মতিলাল মধ্যে মধ্যে বাড়িতে আসিয়া মায়ের নিকট হইতে নানা প্রকার ছল করিয়া টাকা লইয়া যাইত। গৃহিণী এ কথা প্রকাশ করেন নাই—কি জানি কর্তা রাগ করিতে পারেন—অথচ ছেলেটিও আদুরে—গোসা করিলে পাছে প্রমাদ ঘটে। ছেলেপুলের সংক্রান্ত সকল কথা স্ত্রীলোকদিগের স্বামীর নিকট বলা ভালো। রোগ লুকাইয়া রাখিলে কখনই ভালো হয় না। কর্তা গৃহিণীর সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া পরদিন কলিকাতার যে স্থানে যাইবেন তথায় আপনার কয়েকজন আত্মীয়কে উপস্থিত হইবার জন্য রাত্রিতেই চিঠি পাঠাইয়া দিলেন।
সুখের রাত্রি দেখিতে দেখিতে যায়। যখন মন চিন্তার সাগরে ডুবে থাকে তখন রাত্রি অতিশয় বড়ো বোধ হয়। মনে হয় রাত্রি পোহাইল কিন্তু পোহাইতে পোহাইতেও পোহায় না। বাবুরামবাবুর মনে নানা কথা, নানা ভাব, নানা কৌশল, নানা উপায় উদয় হইতে লাগিল। ঘরে আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না, প্রভাত না হইতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া নৌকায় উঠিলেন। নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাঁটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে—কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে—বলদেরা গোরু লইয়া চলিতেছে—ধোবার গাধা থপাস থপাস করিয়া যাইতেছে—মাছের ও তরকারির বাজরা হু-হু করিয়া আসিতেছে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে। কেহ বলিছে, বাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল—কেহ বলে, আমার শাশুড়ী মাগী বড়ো বৌকাঁটকি—কেহ বলে, দিদি, আমার আর বাঁচতে সাধ নাই—বৌছুঁড়ী আমাকে দু’পা দিয়া থেত্লায়, বেটা কিছুই বলে না; ছোঁড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে—কেহ বলে, আহা অমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে,—কেহ বলে, আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল— কবে মরি কবে বাঁচি এই বেলা তার বিয়েটি দিয়ে নি।
এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আকাশে স্থানে স্থানে কানা মেঘ আছে। রাস্তাঘাট সেঁত সেঁত করিতেছে। বাবুরামবাবু এক ছিলিম তামাক খাইয়া একখানা ভাড়া গাড়ী অথবা পাল্কির চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাড়া বনিয়া উঠিল না—অনেক চড়া বোধ হইল। রাস্তায় অনেক ছোঁড়া একত্র জমিল। বাবুরামবাবুর রকম সকম দেখিয়া কেহ কেহ বলিল—ওগো বাবু, ঝাঁকা মুটের উপর বসে যাবে? তাহা হইলে দু-পয়সায় হয়। তোর বাপের ভিটে নাশ করেছে—বলিয়া যেমন বাবুরাম দৌড়িয়া মারিতে যাবেন অমনি দড়াম করিয়া পড়িয়া গেলেন। ছেঁড়াগুলো হো হো করিয়া দূরে থেকে হাততালি দিতে লাগিল। বাবুরামবাবু অধোমুখে শীঘ্র একখানা লকাটে রকম কেরাঞ্চিতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া উঠিলেন এবং খন্ খন্ ঝন্ ঝন্ শব্দে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাঞ্ছারামবাবুর বৈঠকখানায় উকিল বটলর সাহেবের মুৎসুদ্ধি—আইন-আদালত মামলা-মকদ্দমায় বড়ো ধড়িবাজ। মাসের মাহিনা ৫০ টাকা কিন্তু প্রাপ্তির সীমা নাই, বাটীতে নিত্য ক্রিয়াকাণ্ড হয়। তাহার বৈঠকখানায় বালীর বেণীবাবু, বহুবাজারের বেচারামবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া অপেক্ষা করিয়া বসিয়াছিলেন।
বেচারাম। বাবুরাম। ভালো দুধ দিয়া কালসাপ পুষিয়াছিলে। তোমাকে পুনঃপুনঃ বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম আমার কথা গ্রাহ্য করো নাই—ছেলে হতে ইহকালও গেল—পরকালও গেল। মতি দেদার মদ খায়—জোয়া খেলে—অখাদ্য আহার করে। জোয়া খেলিতে খেলিতে ধরা পড়িয়া চৌকিদারকে নির্ঘাত মারিয়াছে। হলা, গদা ও আর-আর ছোঁড়ারা তাহার সঙ্গে ছিল। আমার ছেলেপুলে নাই। মনে করিয়াছিলাম হলা ও গদা এক গণ্ডুষ জল দিবে এখন সে গুড়ে বালি পড়িল। ছোঁড়াদের কথা আর কি বলিব ? দূঁর দূঁর।
বাবুরাম। কে কাহাকে মন্দ করিয়াছে তাহা নিশ্চয় করা বড়ো কঠিন —এক্ষণে তদ্বিরের কথা বলুন।
বেচারাম। বাবুরাম যা ইচ্ছা তাই করো—আমি জ্বালাতন হইয়াছি—রাত্রে ঠাকুরঘরের ভিতর যাইয়া বোতল বোতল মদ খায়—চরস গাঁজার ধোঁয়াতে কড়িকাট কালো করিয়াছে—রূপা-সোনার জিনিস চুরি করিয়া বিক্রি করিয়াছে। আবার বলে একদিন শালগ্রামকে পোড়াইয়া চুন করিয়া পানের সঙ্গে খাইয়া ফেলিব। আমি আবার তাহাদের খালাসের জন্য টাকা দিব ? দূঁর দূঁর।
বক্রেশ্বর। মতিলাল এত মন্দ নহে—আমি স্বচক্ষে স্কুলে দেখিয়াছি তাহার স্বভাব বড়ো ভালো —সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর, তবে এমনটা কেন হইল বলতে পারি না।
ঠকচাচা। মুই বলি এসব ফেল্ত বাতের দরকার কি ? ত্যাল-খেড়ের বাতেতে কি মোদের প্যাট ভরবে? মকদ্দমাটার বনিয়াদটা পেকড়ে সেজিয়া ফেলা যাওক।
বাঞ্ছারাম। (মনে মনে বড়ো আহলাদ—মনে করিতেছেন বুঝি চিড়া-দই পেকে উঠিল) কারবারী লোক না হইলে কারবারের কথা বুঝে না। ঠকচাচা যাহা বলিতেছেন তাহাই কাজের কথা। দুই-একজন পাকা সাক্ষীকে ভালো তালিম করিয়া রাখিতে হইবে—আমাদিগকে বটলর সাহেবকে উকিল ধরিতে হইবে—তাতে যদি মকদ্দমা জিত না হয় তবে বড়ো আদালতে লইয়া যাব—বড়ো আদালতে কিছু না হয়—কৌন্সেল পর্যন্ত যাব,—কৌন্সেলে কিছু না হয় তো বিলাত পর্যন্ত করিতে হইবে। এ কি ছেলের হাতে পিটে ? কিন্তু আমাদিগের বটলর সাহেব না থাকিলে কিছুই হইবে না। সাহেব বড়ো ধমিষ্ঠ—তিনি অনেক মকদ্দমা আকাশে ফাঁদ পাতিয়া নিকাশ করিয়াছেন আর সাক্ষীদিগকে যেন পাখী পড়াইয়া তইয়ার করেন।
বক্রেশ্বর। আপদে পড়িলেই বিদ্যা-বুদ্ধির আবশ্যক হয়। মকদ্দমার তদ্বির অবশ্যই করিতে হইবেক। বেতদ্বিরে দাঁড়াইয়া হারা ও হাততালি খাওয়া কি ভালো ?
বাঞ্ছারাম। বটলর সাহেবের মতো বুদ্ধিমান উকিল আর দেখতে পাই না। তাঁহার বুদ্ধির বলিহারি যাই। এ সকল মকদ্দমা তিনি তিন কথাতে উড়াইয়া দিবেন। এক্ষণে শীঘ্র উঠুন—তাঁহার বাটিতে চলুন।
বেণী। মহাশয় আমাকে ক্ষমা করুন। প্রাণ বিয়োগ হইলেও অধর্ম করিব না। খাতিরে সব কর্ম করতে পারি কিন্তু পরকালটি খোয়াইতে পারি না। বাস্তবিক দোষ থাকলে দোষ স্বীকার করা ভালো—সত্যের মার নাই—বিপদে মিথ্যা পথ আশ্রয় করিলে বিপদ বাড়িয়া উঠে।
ঠকচাচা। হা-হা-হা-হা—মকদ্দমা করা কেতাবী লোকের কাম নয়—তেনারা একটা ধাব্কাতেই পেলিয়ে যায়। এনার বাত মাফিক কাম করলে মোদের মেটির ভিতর জলদি যেতে হবে—কেয়া খুব।
বাঞ্ছারাম। আপনাদের সাজ করিতে দোল ফুরাল। বেণীবাবু স্থিরপ্রজ্ঞ —নীতিশাস্ত্রে জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, তাঁহার সঙ্গে তখন একদিন বালীতে গিয়া তর্ক করা যাইবেক। এক্ষণে আপনারা গাত্রোত্থান করুন।
বেচারাম। বেণীভায়া ! তোমার যে মত আমার সেই মত—আমার তিন কাল গিয়েছে—এককাল ঠেকেছে, আমি প্রাণ গেলেও অধর্ম করিব না—আর কাহার জন্যে বা অধর্ম করিব? ছোঁড়ারা আমার হাড় ভাজা ভাজা করিয়াছে—তাদের জন্যে আমি আবার খরচ করিব—তাদের জন্য মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াইব ? তাহারা জেলে যায় তো এক প্রকার আমি বাঁচি। তাদের জন্যে আমার খেদ কি? তাদের মুখ দেখিলে গা জ্বলে উঠে—দূঁর দূঁর ! ! !
০৬.
মতিলালের মাতার চিন্তা, ভগিনীদ্বয়ের কথোপকথন, বেণী ও বেচারামবাবুর নীতি বিষয়ে কথোপকথন ও বরদাপ্রসাদবাবুর পরিচয়।
বৈদ্যবাটীর বাটিতে স্বস্ত্যয়নের ধুম লেগে গেল। সূর্য উদয় না হইতে হইতে শ্রীধর ভট্টাচার্য, রামগোপাল চূড়ামণি প্রভৃতি জপ করিতে বসিলেন। কেহ তুলসী দেন —কেহ বিল্বপত্র বাছেন —কেহ বববম্ বববম্ করিয়া গালবাদ্য করেন —কেহ বলেন যদি মঙ্গল না হয় তবে আমি বামুন নাহি —কেহ কহেন যদি মন্দ হয় তবে আমি পৈতে ওলাব। বাটীর সকলেই শশব্যস্ত —কাহারো মনে কিছু মাত্র সুখ নাই।
গৃহিণী জানালার নিকট বসিয়া কাতরে আপন ইষ্টদেবতাকে ডাকিতেছেন। কোলের ছেলেটি চুষি লইয়া চুষিতেছে —মধ্যে মধ্যে হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতেছে। শিশুটির প্রতি এক একবার দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহিণী মনে মনে বলিতেছেন —জাদু ! তুমি আবার কেমন হবে বলতে পারি না। ছেলে না হবার এক জ্বালা —হবার শতেক জ্বালা —যদি ছেলের একটু রোগ হল, তো মার প্রাণ অমনি উড়ে গেল। ছেলে কিসে ভালো হবে এজন্য মা শরীর একেবারে ঢেলে দেয় —তখন খাওয়া বলো —শোয়া বলো, সব ঘুরে যায়। দিনকে দিন জ্ঞান হয় না, রাতকে রাত জ্ঞান হয় না। এত দুঃখের ছেলে বড়ো হয়ে যদি সুসন্তান হয় তবেই সব সার্থক —তা না হলে মার জীয়ন্তে মৃত্যু —সংসারে কিছুই ভালো লাগে না —পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না —বড়ো মুখটি ছোট হয়ে যায় আর মনে হয় যে পৃথিবী দোফাঁক হও আমি তোমার ভিতরে সেঁদুই। মতিকে যে করে মানুষ করেছি তা গুরুদেবই জানেন —এখন বাছা উড়তে শিখে আমাকে ভালো সাজাই দিতেছেন। মতির কুকর্মের কথা শুনে অমি ভাজা ভাজা হয়েছি, দুঃখেতে ও ঘৃণাতে মরে রয়েছি। কর্তাকে সকল কথা বলি না, সকল কথা শুনিলে তিনি পাগল হতে পারেন। দূর হউক, আর ভাবতে পারি না। আমি মেয়েমানুষ, ভেবেই বা কি করিব—যা কপালে আছে তাই হবে।
দাসী আসিয়া খোকাকে লইয়া গেল। গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিলেন। মনের ধর্মই এই যখন এক বিষয়ে মগ্ন থাকে তখন সে বিষয়টি হঠাৎ ভুলিয়া আর একটি বিষয়ে প্রায় যায় না। এই কারণে গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিয়াও আহ্নিক করিতে পারিলেন না। এক একবার যত্ন করেন জপে মন দি, কিন্তু মন সেদিকে ধায় না। মতির কথা মনে উদয় হইতে লাগিল —সে যেন প্রবল স্রোত, কার সাধ্যি নিবারণ করে। কখন কখন বোধ হইতে লাগিল তাহার কয়েদ হুকুম হইয়াছে —তাহাকে বাঁধিয়া জেলে লইয়া যাইতেছে, তাহার পিতা নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন, দুঃখেতে ঘার হেঁট করিয়া রোদন করিতেছেন। কখন বা জ্ঞান হইতেছে, পুত্র নিকটে আসিয়া বলিতেছেন, মা আমাকে ক্ষমা করো —আমি যা করিয়াছি তা করিয়াছি আর আমি কখন তোমার মনে বেদনা দিব না, আবার এক একবার বোধ হইতেছে যে মতির ঘোর বিপদ উপস্থিত, তাহাকে জন্মের মতো দেশান্তর যাইতে হইবেক। গৃহিণীর চটক ভাঙিয়া গেলে আপনাআপনি বলিতে লাগিলেন —এ দিনের বেলা আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি? না এ তো স্বপ্ন নয়, তবে কি খেয়াল দেখিলাম? কে জানে আমার মনটা আজ কেন এমন হচ্চে। এই বলিয়া চক্ষের জল ফেলতে ফেলতে ভূমিতে আস্তে আস্তে শয়ন করিলেন। দুই কন্যা মোক্ষদা ও প্রমদা ছাতের উপর বসিয়া মাথা শুকাইতেছিলেন।
মোক্ষদা। ওরে প্রমদা। চুলগুলো ভালো করে এলিয়ে দে না, তোর চুল গুলা যে বড়ো উষ্কখুষ্ক হয়েছে! না হবেই বা কেন? সাত জন্মের তো একটু তেল পড়ে না—মানুষের তেলে-জলেই শরীর, বারো মাস রুক্ষু নেয়ে নেয়ে কি একটা রোগনারা করবি? তুই এত ভাবিস্ কেন ? ভেবে ভেবে যে দড়ি বেটে গেলি।
প্রমদা। দিদি। আমি কি সাধ করে ভাবি? মনে বুঝে না, কি করি ? ছেলেবেলা বাপ একজন কুলীনের ছেলেকে ধরে এনে আমাকে বিবাহ দিয়েছিলেন —এ কথা বড়ো হয়ে শুনেছি। পতি কত শত স্থানে বিয়ে করেছেন, আর তাঁহার যেরূপ চরিত্র তাতে তাঁহার মুখ দেখতে ইচ্ছা হয় না। অমন স্বামী না থাকা ভালো।
মোক্ষদা। হাবি ! অমন কথা বলিস নে —স্বামী মন্দ হউক ছন্দ হউক, মেয়েমানুষের এয়ত্ থাকা ভালো।
প্রমদা। তবে শুনবে? আর বৎসর যখন আমি পালা জ্বরে ভুগতেছিনু —দিবারাত্রি বিছানায় পড়ে থাকতুম —উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি ছিল না, সে সময় স্বামী আসিয়া উপস্থিত হলেন। স্বামী কেমন, জ্ঞান হওয়া অবধি দেখি নাই, মেয়ে মানুষের স্বামীর ন্যায় ধন নাই। মনে করিলাম দুই দণ্ড কাচে বসে কথা কহিলে রোগের যন্ত্রণা কম হবে। দিদি বললে প্রত্যয় যাবে না —তিনি আমার কাছে দাঁড়াইয়াই অমনি বল্লেন —ষোল বৎসর হইল তোমাকে বিবাহ করে গিয়াছি —তুমি আমার এক স্ত্রী —টাকার দরকারে তোমার নিকটে আসিতেছি —শীঘ্র যাব —তোমার বাপকে বললাম। তিনি তো ফাঁকি দিলেন —তোমার হাতের গহনা খুলিয়া দাও। আমি বললাম —মাকে জিজ্ঞাসা করি —মা যা বলবেন তাই করবো। এই কথা শুনিবা মাত্র আমার হাতের বালাগাছটা জোর করে খুলে নিলেন। আমি একটু হাত বাগড়া বাগড়ি করেছিনু, আমাকে একটা লাথি মারিয়া চলিয়া গেলেন —তাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিনু, তারপর মা আসিয়া আমাকে অনেকক্ষণ বাতাস করাতে আমার চেতনা হয়।
মোক্ষদা। প্রমদা। তোর দুঃখের কথা শুনিয়া আমার চক্ষে জল আইসে, দেখ তোর তবু এয়ত্ আছে, আমার তাও নাই।
প্রমদা। দিদি। স্বামীর এই রকম। ভাগ্যে কিছুদিন মামার বাড়ি ছিলাম তাই একটু লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম শিখিয়াছি। সমস্ত দিন কর্ম-কাজ ও মধ্যে মধ্যে লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম করিয়া মনের দুঃখ ঢেকে বেড়াই। একলা বসে যদি একটু ভাবি তো মনটা অমনি জ্বলে উঠে।
মোক্ষদা। কি করবে? আর জন্মে কত পাপ করা গিয়েছিল তাই আমাদের এত ভোগ হইতেছে। খাটা খাটুনি করলে শরীরটা ভালো থাকে মনও ভালো থাকে। চুপ করিয়া বসে থাকিলে দুর্ভাবনা বলো, দুর্মতি বলো, রোগ বলো, সকলি আসিয়া ধরে। আমাকে এ কথা মামা বলে দেন —আমি এই করে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণাকে অনেক খাটো করেছি, আর সর্বদা ভাবি যে সকলই পরমেশ্বরের হাত, তাঁর প্রতি মন থাকাই আসল কর্ম। বোন্ ! ভাবতে গেলে ভাবনার সমুদ্রে পড়তে হয়। তার কূল-কিনারা নাই। ভেবে কি করবি? দশটা ধর্ম -কর্ম কর্ —বাপ -মার সেবা কর —ভাই দুটির প্রতি যত্ন কর, আবার তাদের ছেলেপুলে হলে লালন —পালন করিস্ —তারাই আমাদের ছেলেপুলে।
প্রমদা। দিদি। যা বলতেছ তা সত্য বটে কিন্তু বড়ো ভাইটি তো একেবারে অধঃপাতে গিয়েছে। কেবল কুকথা কুকর্ম ও কুলোক লইয়া আছে। তার যেমন স্বভাব তেমনি বাপ-মার প্রতি ভক্তি —তেমনি আমাদের প্রতিও স্নেহ। বোনের স্নেহ ভায়ের প্রতি যতটা হয় ভায়ের স্নেহ তার শত অংশের এক অংশও হয় না। বোন ভাই-ভাই করে সারা হন কিন্তু ভাই সর্বদা মনে করেন বোন বিদায় হলেই বাঁচি। আমরা বড়ো বোন —মতি যদি কখন কখন কাছে এসে দু-একটা ভালো কথা বলে তাতেও মনটা ঠাণ্ডা হয় কিন্তু তার যেমন ব্যবহার তা তো জানো ?
মোক্ষদা। সকল ভাই এরূপ করে না। এমন ভাইও আছে যে বড়ো বোনকে মার মতো দেখে, ছোট বোনকে মেয়ের মতো দেখে। সত্যি বল্চ এমন ভাই আছে যে ভাইকেও যেমন দেখে বোনকে তেমন দেখে। দু-দণ্ড বোনের সঙ্গে কথাবার্তা না কহিলে তৃপ্তি বোধ করে না ও বোনের আপদ্ পড়িলে প্রাণপণে সাহায্য করে।
প্রমদা। তা বটে কিন্তু আমাদিগের যেমন পোড়া কপাল তেমন ভাই পেয়েছি। হায় ! পৃথিবীতে কোনো প্রকার সুখ হয় না।
দাসী আসিয়া বলিল —মা ঠাকুরুন কাঁদছেন —এই কথা শুনিবামাত্র দুই বোনে তাড়াতাড়ি করিয়া নীচে নামিয়ে গেলেন।
চাঁদনীর রাত্রি। গঙ্গার উপর চন্দ্রের আভা পড়িয়াছে—মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে—বনফুলের সৌগন্ধ মিশ্রিত হইয়া এক একবার যেন আমোদ করিতেছে—ঢেউগুলা নেচে উঠিতেছে। নিকটবর্তী ঝোপের পাখীসকল নানা রবে ডাকিতেছে। বালীর বেণীবাবু দেওনাগাজীর ঘাটে বসিয়া এদিক্ ওদিক্ দেখিতে দেখিতে কেদারা রাগিণীতে “শিখেহো” খেয়াল গাইতেছেন। গানেতে মগ্ন হইয়াছেন, মধ্যে মধ্যে তালও দিতেছেন। ইতিমধ্যে পেছন দিক্ থেকে “বেণী ভায়া, বেণী ভায়া, ও শিখেহো” বলিয়া একটা শব্দ হইতে লাগিল। বেণীবাবু ফিরিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত। অমনি আস্তেব্যস্তে উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে নিকটে আনিয়া বসাইলেন।
বেচারাম। বেণী ভায়া। তুমি আজ বাবুরামকে খুব ওয়াজিব কথা বলিয়াছ। তোমাদের গ্রামে নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলাম —তোমার উপর আমি বড়ো তুষ্ট হইয়াছি —এজন্য ইচ্ছা হইল তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।
বেণী। বেচারাম দাদা। আমরা নিজে দুঃখী প্রাণী লোক, মজুরী করে এনে দিনপাত করি। যেসব স্থানে জ্ঞানের অথবা ধর্মকথার চর্চা হয় সেই সব স্থানে যাই। বড়োমানুষ কুটুম্ব ও আলাপী অনেক আছে বটে কিন্তু তাহাদিগের নিকট চক্ষুলজ্জা অথবা দায়ে পড়ে কিংবা নিজ প্রয়োজনেই কখন কখন যাই, সাধ করে বড়ো যাই না, আর গেলেও মনের প্রীতি হয় না কারণ বড়োমানুষ বড়োমানুষকেই খাতির করে, আমরা গেলে হদ্দ বল্বে—”আজো বড়ো গরমি—কেমন কাজকর্ম ভালো হচ্ছে—অরে এক ছিলিম তামাক দে।” যদি একবার হেসে কথা কহিলেন তবে বাপের সঙ্গে বত্তে গেলাম। এক্ষণে টাকার যত মান তত মান বিদ্যারও নাই ধর্মেরও নাই। আর বড়োমানুষের খোসামোদ করাও বড় দায়। কথাই আছে “বড়োর পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ” কিন্তু লোকে বুঝে না —টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকট গিয়া যে আজ্ঞাও করছে। সে যাহা হউক, বড়োমানুষের সঙ্গে থাকলে পরকাল রাখা ভার, আজকের যে ব্যাপারটি হইয়াছিল তাতে পরকালটি নিয়ে বিলক্ষণ টানাটানি !
বেচারাম। বাবুরামের রকম সকম দেখিয়া বোধ হয় যে তাহার গতিক ভালো নয়। আহা। কি মন্ত্রী পাইয়াছেন। এক বেটা নেড়ে তাহার নাম ঠকচাচা। সে বেটা জোয়াচোরের পাদশা। তার হাড়ে ভেল্কি হয়। বাঞ্ছারাম উকিলের বাটীর লোক ! তিনি বর্ণচোরা আঁব —ভিজে বেড়ালের মতো আস্তে আস্তে সলিয়া কলিয়া লওয়ান্। তাঁহার জাদুতে যিনি পড়েন তাঁহার দফা একেবারে রফা হয়, আর বক্রেশ্বর মাস্টারগিরি করেন —নীতি শিখান অথচ জল উঁচু নীচু বলনের শিরোমণি। দূঁর দূঁর ! যাহা হউক, তোমার এ ধর্মজ্ঞান কি ইংরাজী পড়িয়া হইয়াছে ?
বেণী। আমার এমন কি ধর্মজ্ঞান আছে? এরূপ আমাকে বলা কেবল অনুগ্রহ প্রকাশ করা। যৎকিঞ্চিৎ যাহা হিতাহিত বোধ হইয়াছে তাহা বদরগঞ্জের বরদাবাবুর প্রসাদাৎ। সেই মহাশয়ের সহিত অনেক দিন সহবাস করিয়াছিলাম। তিনি দয়া করিয়া কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়াছেন।
বেচারাম। বরদাবাবু কে ? তাহার বৃত্তান্ত বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি। এমন কথা সকল শুনতে বড়ো ইচ্ছা হয়।
বেণী। বরদাবাবুর বাটী বঙ্গদেশে—পরগনে এটেকাগমারি। পিতার বিয়োগ হইলে কলিকাতায় আইসেন—অন্নবস্ত্রের ক্লেশ আত্যন্তিক ছিল —আজ খান এমতে যোত্র ছিল না। বাল্যাবস্থাবধি পরমার্থ প্রসঙ্গে সর্বদা রত থাকিতেন, এজন্য ক্লেশ পাইলেও ক্লেশ বোধ হইত না। একখানি সামান্য খোলার ঘরে বাস করিতেন—খুড়ার নিকট মাস মাস যে দুটি টাকা পাইতেন তাহাই কেবল ভরসা ছিল। দুই-একজন সৎলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল —তদ্ভিন্ন কাহারও নিকট যাইতেন না, কাহার উপর কিছু ভার দিতেন না। দাসদাসী রাখিবার সঙ্গতি ছিল না—আপনার বাজার আপনি করিতেন—আপনার রান্না আপনি রাঁধিতেন, রাঁধিবার সময় পড়াশুনা অভ্যাস করিতেন, আর কি প্রাতে কি মধ্যাহ্নে কি রাত্রে একচিত্তে পরমেশ্বরকে ধ্যান করিতেন। স্কুলে ছেঁড়া ও মলিন বস্ত্রেই যাইতেন, বড়োমানুষের ছেলেরা পরিহাস ও ব্যঙ্গ করিত। তিনি শুনিতেন না ও সকলকে ভাই দাদা ইত্যাদি মিষ্ট বাক্যের দ্বারা ক্ষান্ত করিতেন। ইংরাজী পড়িলে অনেকের মনে মাৎসর্য হয় —তাহারা পৃথিবীকে সরাখান্ দেখে। বরদাবাবুর মনে মাৎসর্য কোনো প্রকারে করিতে পারিত না। তাঁহার স্বভাব অতি শান্ত ও নম্র ছিল, বিদ্যা শিখিয়া স্কুল ত্যাগ করিলেন। স্কুল ত্যাগ করিবারমাত্র স্কুলে একটি ৩০ টাকার কর্ম হইল। তাহাতে আপনি ও মা ও স্ত্রী ও খুড়ার পুত্রকে বাসায় আনিয়া রাখিলেন এবং তাঁহারা কিরূপে ভালো থাকিবেন তাহাতেই অতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। বাসার নিকট অনেক গরীব-দুঃখী লোক ছিল তাহাদিগেকে সর্বদা তত্ত্ব করিতেন —আপনার সাধ্যক্রমে দান করিতেন ও কাহারো পীড়া হইলে আপনি গিয়া দেখিতেন এবং ঔষধাদি আনিয়া দিতেন। ঐ সকল লোকের ছেলেরা অর্থাভাবে স্কুলে পড়িতে পারিত না এজন্য প্রাতে তিনি আপনি তাহাদিগকে পড়াইতেন। খুড়ার কাল হইলে খুড়াতুতো ভায়ের ঘোরতর ব্যামোহ হয়, তাহার নিকট দিনরাত বসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাতে তিনি আরাম হন। বরদাবাবুর খুড়ীর প্রতি অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাঁহাকে মায়ের মতো দেখিতেন। অনেকের পরমার্থ বিষয়ে শ্মশান বৈরাগ্য দেখা যায়। বন্ধু অথবা পরিবারের মধ্যে কাহারো বিয়োগ হইলে অথবা কেহ কোনো বিপদে পড়িলে জগৎ অসার ও পরমেশ্বরই সারাৎসার এই বোধ হয়। বরদাবাবুর মনে ঐ ভাব নিরন্তর আছে, তাঁহার সহিত আলাপ অথবা তাঁহার কর্ম দ্বারা তাহা জানা যায় কিন্তু তিনি একথা লইয়া অন্যের কাছে কখনই ভড়ং করেন না। তিনি চটুকে মানুষ নহেন —জাঁক ও চটকের জন্য কোনো কর্ম করেন না। সৎকর্ম যাহা করেন তাহা অতি গোপনে করিয়া থাকেন। অনেক লোকের উপকার করেন বটে কিন্তু যাহার উপকার করেন কেবল সেই ব্যক্তিই জানে, অন্য লোকে টের পাইলে অতিশয় কুণ্ঠিত হয়েন। তিনি নানা প্রকার বিদ্যা জানেন কিন্তু তাঁহার অভিমান কিছুমাত্র নাই। লোকে একটু শিখিয়া পুঁটি মাছের মতো ফর্ ফর্ করিয়া বেড়ায় ও মনে করে আমি বড়ো বুঝি —আমি যেমন লিখি এমন লিখিতে কেহ পারে না —আমার বিদ্যা যেমন, এমন বিদ্যা কাহারো নাই —আমি যাহা বলিব সেই কথাই কতা। বরদাবাবু অন্য প্রকার ব্যক্তি, তাঁহার বিদ্যাবুদ্ধি প্রগাঢ় তথাচ সামান্য লোকের কথাও অগ্রাহ্য করেন না এবং মতান্তরের কোন কথা শুনিলে কিছু মাত্র বিরক্তও হয়েন না বরং আহলাদপূর্বক শুনিয়া আপন মতের দোষগুণ পুনর্বার বিবেচনা করেন। ঐ মহাশয়ের নানা গুণ, সকল খুঁটিয়া বর্ণনা করা ভার —মোট এই বলা যাইতে পারে যে তাঁহার মতো নম্র ও ধর্মভীতু লোক কেহ কখন দেখে নাই —প্রাণ বিয়োগ হইলেও কখন অধর্মে তাঁহার মতি হয় না। এমতো লোকের সহবাসে যত সৎ উপদেশ পাওয়া যায় বহি পড়িলে তত হয় না।
বেচারাম। এমতো লোকের কথা শুনে কান জুড়ায়। রাত অনেক হইল, পারাপারের পথ, বাটী যাই। কাল যেন পুলিশে একবার দেখা হয়।
০৭.
কলিকাতার আদিবৃত্তান্ত, জাস্টিস অব পিস নিয়োগ, পুলিশ বর্ণন, মতিলালের পুলিশে বিচার ও খালাস, বাবুরামবাবুর পুত্র লইয়া বৈদ্যবাটী গমন, ঝড়ের উত্থান ও নৌকা জলমগ্ন হওনের আশঙ্কা।
সংসারের গতি অদ্ভুত—মানববুদ্ধির অগম্য। কি কারণে কি হয় তাহা স্থির করা সুকঠিন। কলিকাতার আদি বৃত্তান্ত স্মরণ করিলে সকলেরই আশ্চার্য বোধ হইবে ও সেই কলিকাতা যে এই কলিকাতা হইবে ইহা কাহারো স্বপ্নেও বোধ হয় নাই।
কোম্পানীর কুঠি প্রথমে হুগলীতে ছিল, তাঁহাদিগের গোমস্তা জাব চার্নক সাহেব সেখানকার ফৌজদারের সহিত বিবাদ করেন, তখন কোম্পানীর এত জারিজুরি চলতো না সুতরাং গোমস্তাকে হুড়ো খেয়ে পালিয়ে আসিতে হইয়াছিল। জাব চার্নকের বারাকপুরে এক বাটী ও বাজার ছিল এই কারণে বারাকপুরের নাম অদ্যাবধি চার্নক বলিয়া খ্যাত আছে। জাব চার্নক একজন সতীকে চিতার নিকট হইতে ধরিয়া আনিয়া বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু, ঐ বিবাহ পরস্পরের সুখজনক হইয়াছিল কি-না তাহা প্রকাশ হয় নাই। তিনি নূতন কুঠি করিবার জন্য উলুবেড়িয়ায় গমনাগমন করিয়াছিলেন ও তাঁহার ইচ্ছাও হয়েছিল যে সেখানে কুঠি হয় কিন্তু অনেক অনেক কর্ম হ পর্যন্ত হইয়া ক্ষ বাকি থাকিতেও ফিরিয়া যায়। জাব চার্নক বটুকখানা অঞ্চল দিয়া যাতায়াত করিতেন, তথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ ছিল তাহার তলায় বসিয়া মধ্যে মধ্যে আরাম করিতেন ও তামাকু খাইতেন, সেই স্থানে অনেক ব্যাপারীরাও জড়ো হইত। ঐ গাছের ছায়াতে তাঁহার এমনি মায়া হইল যে সেই স্থানেই কুঠি করিতে স্থির করিলেন। সূতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই তিন গ্রাম একেবারে খরিদ হইয়া আবাদ হইতে আরম্ভ হইল; পরে বাণিজ্য নিমিত্ত নানা জাতীয় লোক আসিয়া বসতি করিল ও কলিকাতা ক্রমে ক্রমে শহর হইয়া গুলজার হইতে লাগিল।
ইংরাজী ১৬৮৯ সালে কলিকাতা শহর হইতে আরম্ভ হয়। তাহার তিন বৎসর পরে জাব চার্নকের মৃত্যু হইল, তৎকালে গড়ের মাঠ ও চৌরঙ্গী জঙ্গল ছিল, এক্ষণে যে স্থানে পারমিট্ আছে পূর্বে তথায় গড় ছিল ও যে স্থানকে এক্ষণে ক্লাইব স্ট্রীট বলিয়া ডাকে সেই স্থানে সওদাগরি কর্ম হইত।
কলিকাতায় পূর্বে অতিশয় মারীভয় ছিল এজন্য যে— যে ইংরাজেরা তাহা হইতে পরিত্রাণ পাইত তাহারা প্রতি বৎসর নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে একত্র হইয়া আপন আপন মঙ্গলবার্তা বলাবলি করিত।
ইংরাজদিগের এক প্রধান গুণ এই যে, যে স্থানে বাস করে তাহা অতি পরিষ্কার রাখে। কলিকাতা ক্রমে ক্রমে সাফসুতরা হওয়াতে পীড়াও ক্রমে ক্রমে কমিয়া গেল কিন্তু বাঙালীরা ইহা বুঝিয়াও বুঝেন না। অদ্যাবধি লক্ষপতির বাটীর নিকটে এমন খানা আছে যে দুর্গন্ধে নিকট যাওয়া ভার।
কলিকাতার মাল, আদালত ও ফৌজদারী এই তিন কর্ম নির্বাহের ভার একজন সাহেবের উপর ছিল। তাঁহার অধীনে একজন বাঙালী কার্মচারী থাকিতেন ঐ সাহেবকে জমিদার বলিয়া ডাকিত। পরে অন্যান্য প্রকার আদালত ও ইংরাজদিগের দৌরাত্ম্য নিবারণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হইল, আর পুলিশের কর্ম স্বতন্ত্র হইয়া সুচারুরূপে চলিতে লাগিল। ইংরাজী ১৭৯৮ সালে স্যার জন রিচার্ডসন প্রভৃতি জাস্টিস অব পিস মোকরর হইলেন। তদনন্তর ১৮০০ সালে ব্লাকিয়র সাহেব প্রভৃতি ঐ কর্মে নিযুক্ত হন।
যাঁহারা জাস্টিস অব পিস হয়েন তাঁহাদিগের হুকুম এদেশের সর্বস্থানে জারি হয়। যাঁহারা কেবল ম্যাজিস্ট্রেট, জাস্টিস অব পিস নহেন, তাঁহদিগের আপন আপন সরহদ্দের বাহিরে হুকুম জারি করিতে গেলে তথাকার আদালতের মদৎ আবশ্যক হইত এজন্যে সম্প্রতি মফস্বলের অনেক ম্যাজিস্ট্রেট জাস্টিস অব পিস হইয়াছেন।
ব্লাকিয়র সাহেবের মৃত্যু প্রায় চারি বৎসর হইয়াছে। লোকে বলে ইংরাজের ঔরসে ও ব্রাহ্মণীর গর্ভে তাঁহার জন্ম হয়। তাঁহার প্রথম শিক্ষা এখানে হয়—পরে বিলাতে যাইয়া ভালো রূপ শিক্ষা করেন। পুলিশের ম্যাজিস্ট্রেসী কর্মপ্রাপ্ত হইলে তাঁহার দবদবায় কলিকাতা শহর কাঁপিয়া গিয়াছিল—সকলেই থরহরি কাঁপিত। কিছুকাল পরে সন্ধান-সুলুক করা ও ধরা-পাকড়ার কর্ম ত্যাগ করিয়া তিনি কেবল বিচার করিতেন। বিচারে সুপারগ ছিলেন, তাহার কারণ এই দেশের ভাষা ও রীতি-ব্যবহার ও ঘাঁত-ঘুঁত সকল ভালো বুঝিতেন—ফৌজদারী আইন তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল ও বহুকাল সুপ্রিম কোর্টের ইন্টারপ্রিটর থাকাতে মকদ্দমা কিরূপে করিতে হয় তদ্বিষয়ে তাঁহার উত্তম জ্ঞান জন্মিয়াছিল।
সময় জলের মতো যায়—দেখতে দেখতে সোমবার হইল—গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দশটা বাজিল। সারজন্, সিপাই, দারোগা. নায়েব, ফাঁড়িদার, চৌকিদার ও নানা প্রকার লোকে পুলিশ পরিপূর্ণ হইল। কোথাও বা কতকগুলা বাড়িওয়ালী ও বেশ্যা বসিয়া পানের ছিবে ফেলছে – কোথাও বা কতকগুলা লোক মারি খেয়ে রক্তের কাপড় সুদ্ধ দাঁড়িয়া আছে—কোথাও বা কতকগুলা চোর অধোমুখে এক পার্শ্বে বসিয়া ভাবছে—কোথাও বা দুই-একজন টয়ে বাঁধা ইংরেজীওয়ালা দরখাস্ত লিখছে—কোথাও বা ফৈরাদিরা নীচে উপরে টংঅস টংঅস করিয়া ফিরিতেছে— কোথাও বা সাক্ষী সকল পরস্পর ফুস ফুস করিতেছে—কোথাও বা পেশাদার জামিনেরা তীর্থের কাকের ন্যায় বসিয়া আছে—কোথাও বা উকিলদিগের দালাল ঘাপ্টি মেরে জাল ফেলিতেছে—কোথাও বা উকিলেরা সাক্ষীদিগের কানে মন্ত্র দিতেছে—কোথাও বা আমলারা চালানি মকদ্দমা টুক্ছে—কোথাও বা সারজনেরা বুকের ছাতি ফুলাইয়া মস্ মস্ করিয়া বেড়াচ্ছে—কোথাও বা সরদার সরদার কেরানীরা বলাবলি করচে—এ সাহেবটা গাধা, ও সাহেব পটু, এ সাহেব নরম, ও সাহেব কড়া— কালকের ও মকদ্দমাটার হুকুম ভালো হয় নাই। পুলিশ গস্ গস্ করিতেছে— সাক্ষাৎ যমালয়—কার কপালে কি হয়— সকলেই সশঙ্ক।
বাবুরামবাবু আপন উকিল, মন্ত্রী ও আত্মীয়গণ সহিত তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠকচাচার মাথায় মেন্তাই পাগড়ি, গায়ে পিরহান, পায়ে নাগোরা জুতা, হাতে ফটিকের মালা—বুজর্গ ও নবীর নাম নিয়া এক একবার দাড়ি নেড়ে তসবি পড়িতেছেন কিন্তু সে কেবল ভেক। ঠকচাচার মতো চালাক লোক পাওয়া ভার। পুলিশে আসিয়া চারিদিকে যেন লাটিমের মতো ঘুরিতে লাগিলেন। একবার এদিগে যান—একবার ওদিকে যান—একবার সাক্ষীদিগের কানে ফুস্ করেন—এক একবার বাবুরামবাবুর হাত ধরিয়া টেনে লইয়া যান—এক একবার বটলর সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেন—এক একবার বাঞ্ছারামবাবুকে বুঝান। পুলিশের যাবতীয় লোক ঠকচাচাকে দেখিতে লাগিল। অনেকের বাপ পিতামহ চোর-ছেঁচড় হইলেও তাহাদিগের সন্তান-সন্ততিরা দুর্বল স্বভাব হেতু বোধ করে যে তাঁহারা অসাধারণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, এজন্য অন্যের নিকট আপন পরিচয় দিতে হইলে একেবারে বলিয়া বসে আমি অমুকের পুত্র অমুকের নাতি। ঠকচাচার নিকট যে আলাপ করিতে আসিতেছে, তাহাকে অমনি বলিতেছেন— মুই আবদুর রহমান গুলমোহাম্মদের লেড়কা ও আমপক্ আমপক্ গোলাম হোসেনের পোতা। একজন ঠোঁটকাটা সরকার উত্তর করিল, আরে তুমি কাজ-কর্ম কি করো তাই বলো— তোমার বাপ-পিতামহের নাম নেড়ে পাড়ার দুই-এক বেটা শোরখেকো জানতে পারে কলিকাতা শহরে কে জানবে? তারা কি সইসগিরি কর্ম করিত? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিলেন— কি বল্ব এ পুলিশ, দুসরা জেগা হলে তোর উপরে লাফিয়ে পড়ে কেমড়ে ধরতুম। এই বলিয়া বাবুরামবাবুর হাত ধরিয়া দাঁড়াইলেন ও সরকারকে পাকতঃ দেখাইলেন যে আমার কত হুরমত—কত ইজ্জত।
ইতিমধ্যে পুলিশের সিঁড়ির নিকট একটা গোল উঠল, একখানা গাড়ী গড় গড় করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল—গাড়ীর দ্বার খুলিবামাত্র একজন জীর্ণশীর্ণ প্রাচীন সাহেব নামিলেন—সারজনেরা অমনি টুপি খুলিয়া কুরনিশ করিতে লাগিল ও সকলেই বলিয়া উঠিল ব্লাকিয়র সাহেব আসছেন। সাহেব বেঞ্চের উপর বসিয়া কয়েকটা মারপিটের মকদ্দমা ফয়সালা করিলেন পরে মতিলালের মকদ্দমা ডাক হইল। একদিকে কালে খাঁ ও ফতে খাঁ ফৈরাদি দাঁড়াইল আর একদিকে বৈদ্যাবাটীর বাবুরামবাবু, বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বৌবাজারের বেচারামবাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও বৈঠকখানার বটলর সাহেব দাঁড়াইলেন। বাবুরামবাবুর গায়ে জোড়া, মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি, নাকে তিলক, তার উপরে হোমের ফোঁটা—দুই হাত জোড়া করিয়া কাঁদো কাঁদো ভাবে সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন—মনে করিতেছেন যে চক্ষের জল দেখিলে অবশ্যই সাহাবের দয়া উদয় হইবে। মতিলাল, হলধর, গদাধর ও অন্যান্য আসামীরা সাহেবের সম্মুখে আনীত হইল। মতিলাল লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল, তাহার অনাহারে শুষ্ক বদন দেখিয়া বাবুরামবাবুর হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল। ফৈরাদিরা এজেহার করিল যে আসামীরা কুস্থানে যাইয়া জুয়া খেলিত, তাহাদিগকে ধরাতে বড়ো মারপিট করিয়া ছিনিয়ে পালায়—মারপিটের দাগ গায়ের কাপড় খুলিয়া দেখাইল। বটলর সাহেব ফৈরাদির ও ফৈরাদির সাক্ষীর উপর অনেক জেরা করিয়া মতিলালের সংক্রান্ত এজেহার কতক কাঁচিয়া ফেলিলেন। এমতো কাঁচানো আশ্চার্য নহে কারণ একে উকিলী ফন্দি, তাতে পূর্বে গড়াপেটা হইয়াছিল— টাকাতে কি-না হতে পারে ? ‘কড়িতে বুড়ার বিয়ে হয়।’ পরে বটলর সাহেব আপন সাক্ষীসকলকে তুলিলেন। তাহারা বলিল, মারপিটের দিনে মতিলাল বৈদ্যবাটীর বাটিতে ছিল কিন্তু ব্লাকিয়র সাহাবের খুঁচনিতে এক এক বার ঘাবড়িয়া যাইতে লাগিল। ঠকচাচা দেখিলেন গতিক বড়ো ভালো নয়—পা পিছলে যাইতে পারে—মকদ্দমা করিতে গেলে প্রায় লোকের দিগ্বিদগ্ জ্ঞান থাকে না— সত্যের সহিত ফারখতাখতি করিয়া আদালতে ঢুকতে হয়— কি প্রকারে জয়ী হইব তাহাতেই কেবল একিদা থাকে, এই কারণে তিনি সম্মুখে আসিয়া স্বয়ং সাক্ষী দিলেন অমুক দিবস অমুক তারিখে অমুক সময়ে তিনি মতিলালকে বৈদ্যবাটীর বাটীতে ফার্সী পড়াইতেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট অনেক সওয়াল করিলেন কিন্তু ঠকচাচা হেল্বার-দোল্বার পাত্র নয়—মামলার বড়ো টঙ্ক, আপনার আসল কথা কোনো রকমেই কমপোক্ত হইল না। অমনি বটলর সাহেব বক্তৃতা করিতে লাগিলেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষণেক কাল ভাবিয়া হুকুম দিলেন মতিলাল খালাস ও অন্যান্য আসামীর এক এক মাস মেয়াদ এবং ত্রিশ ত্রিশ টাকা জরিমানা। হুকুম হইবামাত্র হরিবোলের শব্দ উঠিল ও বাবুরামবাবু চিৎকার করিয়া বলিলেন—ধর্মাবতার ! বিচার সুক্ষ্ণ হইল, আপনি শীঘ্র গবর্ণর হউন।
পুলিশের উঠানে সকলে আসিলে হলধর ও গদাধর প্রেমনারায়ণ মজুমদারকে দেখিয়া তাহার খেপানের গান তাহার কানে কানে গাইতে লাগিল— ‘প্রেমনারায়ণ মজুমদার কলা খাও, কর্ম কাজ নাই কিছু বাড়ি চলে যাও। হেন করি অনুমান তুমি হও হনুমান, সমুদ্রের তীরে গিয়া স্বচ্ছন্দে লাফাও।’ প্রেমনারায়ণ বলিল—বটে রে বিটলেরা—বেহায়ার বালাই দূর—তোরা জেলে যাচ্ছিস্ তবুও দুষ্টুমি করিতে ক্ষান্ত নহিস্—এই বলতে বলতে তাহাদিগকে জেলে লইয়া গেল।
বেণীবাবু ধর্মভীতু লোক—ধর্মের পরাজয় অধর্মের জয় দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন— ঠকচাচা দাড়ি নেড়ে হাসিতে হাসিতে দম্ভ করিয়া বলিলেন—কেমন গো এখন কেতাবীবাবু কি বলেন, এনার মসলতে কাম করলে মোদের দফা রফা হইত। বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বলিলেন—একি ছেলের হাতের পিটে? বক্রেশ্বর বলিলেন—সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর। বেচারামবাবু বলিলেন—দূঁর দূঁর ! এমন অধর্মও করিতে চাই না—মকদ্দমা জিতও চাই না—দূঁর দূঁর ! এই বলিয়া বেণীবাবুর হাত ধরিয়া ঠিকুরে বেরিয়ে গেলেন।
বাবুরামবাবু কালীঘাটে পূজা দিয়া নৌকায় উঠিলেন। বাঙালীরা জাতের গুমর সর্বদা করিয়া থাকেন, কিন্তু কর্ম পড়িলে যবনও বাপের ঠাকুর হইয়া উঠে। বাবুরামবাবু ঠকচাচাকে সাক্ষাৎ ভীষ্মদেব বোধ করিলেন ও তাহার গলায় হাত দিয়া মকদ্দমা জিতের কথাবার্তায় মগ্ন হইলেন—কোথায় বা পান পানির আয়েব— কোথায় বা আহ্নিক— কোথায় বা সন্ধ্যা ? সবই ঘুরে গেল। এক একবার বলা হচ্ছে, বটলর সাহেব ও বাঞ্ছারামবাবুর তুল্য লোক নাই— এক একবার বলা হচ্ছে, বেচারাম ও বেণীর মতো বোকা আর দেখা যায় না। মতিলাল এদিক ওদিক দেখছে— এক একবার গোলুয়ে দাঁড়াচ্ছে—এক একবার দাঁড় ধরে টানছে—এক একবার ছতরির উপর বসছে— এক একবার হাইল ধরে ঝিঁকে মারছে। বাবুরামবাবু মধ্যে মধ্যে বলতেছেন— মতিলাল বাবা ও কি ? স্থির হয়্যে বসো। কাশীজোড়ার শঙ্কুরে মালী তামাক সাজছে— বাবুর আহলাদ দেখে তাহারও মনে স্ফুতি হইয়াছে—জিজ্ঞাসা করছে—বাও মোশাই। এবাড় কি পূজাড় সময় বাকুলে বাওলাচ হবে? এটা কি তুড়ার কড় ? সাড়ারা কত কড় করেছে ?
প্রায় একভাবে কিছুই যায় না—যেমন মনেতে রাগ চাপা থাকিলে একবার না একবার অবশ্যই প্রকাশ পায় তেমনি বড়ো গ্রীষ্ম ও বাতাস বন্ধ হইলে প্রায় ঝড় হইয়া থাকে। সূর্য অস্ত যাইতেছে— সন্ধ্যার আগমন— দেখিতে দেখিতে পশ্চিমে একটা কালো মেঘ উঠিল— দুই-এক লহমার মধ্যেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া আসিল— হু-হু করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল— কোলের মানুষ দেখা যায় না— সামাল সামাল ডাক পড়ে গেল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যু চম্কিতে আরম্ভ হইল ও মুহুর্মু হুঃ মুহুর্মুহুঃ বজ্রের ঝঞ্জন কড়মড় হড়মড় শব্দে সকলের ত্রাস হইতে লাগিল— বৃষ্টির ঝরঝর তড়তড়িতে কার সাধ্য বাহিরে দাঁড়ায়। ঢেউগুলা এক একবার বেগে উচ্চ হইয়া উঠে আবার নৌকার উপর ধপাস্ ধপাস্ করিয়া পড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যে দুই-তিনখানা নৌকা মারা গেল। ইহা দেখিয়া অন্য নৌকার মাঝিরা কিনারায় ভিড়তে চেষ্টা করিল কিন্তু বাতাসের জোরে অন্য দিগে গিয়া পড়িল। ঠকচাচার বকুনি বন্ধ—দেখিয়া শুনিয়া জ্ঞাশূন্য— তখন এক একবার মালা লইয়া তসবি পড়েন— তখন আপনার মহম্মদ, আলী ও সত্যপীরের নাম লইতে লাগিলেন। বাবুরামবাবু অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, দুষ্কর্মের সাজা এইখানেই অরম্ভ হয়! দুষ্কর্ম করিলে কাহার মন সুস্থির থাকে? অন্যের কাছে চাতুরীর দ্বারা দুষ্কর্ম ঢাকা হইতে পারে বটে কিন্তু কোনো কর্মই মনের অগোচর থাকে না। পাপী টের পান যেন তাঁহার মনে কেহ ছুঁচ বিঁধছে— সর্বদাই আতঙ্ক— সর্বদাই ভয়— সর্বদাই অসুখ—মধ্যে মধ্যে যে হাসিটুকু হাসেন সে কেবল দেঁতোর হাসি। বাবুরামবাবু ত্রাসে কাঁদিতে লাগিলেন ও বলিলেন—ঠকচাচা কি হইবে। দেখিতে পাই অপঘাত মৃত্যু হইল— বুঝি আমাদিগের পাপের এই দণ্ড। হায় হায় ছেলেকে খালাস করিয়া আনিলাম, ইহাকে গৃহিণীর নিকট নিয়ে যাইতে পারিলাম না— যদি মরি তো গৃহিণীও শোকে মরিয়া যাইবেন। এখন আমার বেণী ভায়ার কথা স্মরণ হয়— বোধ হয় ধর্মপথে থাকিলে ভালো ছিল। ঠকচাচারও ভয় হইয়াছে কিন্তু তিনি পুরানো পাপী— মুখে বড়ো দড়— বলিলেন— ডর কেন করো বাবু? লা ডুবি হইলে মুই তোমাকে কাঁধে করে সেঁতরে লি্য়ে যাব— আফদ তো মরদের হয়। ঝড় ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া উঠিল— নৌকা, টলমল করিয়া ডুবুডুবু হইল, সকলেই আঁকু পাঁকু ও ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল, ঠকচাচা মনে মনে কহেন “চাচা আপনা বাঁচ”।
০৮.
উকিল বটলর সাহেবের আপিস—বৈদ্যবাটীর বাটীতে কর্তার জন্য ভাবনা, বাঞ্ছারামবাবুর তথায় গমন ও বিষাদ, বাবুরামবাবুর সংবাদ ও আগমন।
বটলর সাহেব আপিসে আসিয়াছেন। বর্তমান মাসে কত কর্ম হইল উল্টে পাল্টে দেখিতেছেন, নিকটে একটা কুকুর শুয়ে আছে, সাহেব এক একবার শিস্ দিতেছেন—এক একবার নাকে নস্য গুঁজে হাতের আঙুল চট্কাইতেছেন—এক একবার কেতাবের উপর নজর করিতেছেন—এক একবার দুই পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াইতেছেন—এক একবার ভাবিতেছেন আদালতের কয়েক আপিসে খরচার দরুন অনেক টাকা দিতে হইবেক—টাকার জোট্পাট্ কিছুই হয় নাই অথচ টারম্ খোলবার আগে টাকা দাখিল না করিলে কর্ম বন্ধ হয়—ইতিমধ্যে হোয়র্ড উকিলের সরকার আসিয়া তাঁহার হাতে দুইখানা কাগজ দিল। কাগজ পাইবামাত্র সাহেবের মুখ আহলাদে চক্চক্ করিতে লাগিল, অমনি বলিতেছেন বেন্শারাম। জলদি হিঁয়া আও। বাঞ্ছারামবাবু চৌকির উপর চাদরখানা ফেলিয়া কানে একটা কলম গুঁজিয়া শীঘ্র উপস্থিত হইলেন।
বটলর। বেন্শারাম। হাম বড়া খোশ হুয়া। বাবুরামকা উপর দো নালিশ হুয়া—এক ইজেক্টমেন্ট আর এক একুটি, হামকো নটিশ ও সুপিনা হৌয়র্ড সাহেব আবি ভেজ দিয়া।
বাঞ্ছারাম শুনিবামাত্র বগল বাজিয়ে উঠিলেন ও বলিলেন— সাহেব দেখো আমি কেমন মুৎসুদ্দি—বাবুরামকে এখানে আনাতে একা দুদে কত ক্ষীর ছেনা ননী হইবেক। ঐ দু’খানা কাগজ আমাকে শীঘ্র দাও আমি স্বয়ং বৈদ্যবাটীতে যাই—অন্য লোকের কর্ম নয়। এক্ষণে অনেক দমবাজি ও ধড়িবাজির আবশ্যক। একবার গাছের উপর উঠাতে পারলেই টাকার বৃষ্টি করিব, আর এখন আমাদের তপ্ত খোলা—বড়ো খাঁই—একটা ছোবল মেরে আলাল হিসাবে কিছু আনিতে হইবে।
বৈদ্যবাটীর বাটীতে বোধন বসিয়াছে— নহবত ধাঁধাঁগুড়গুড় ধাঁধাঁগুড় করিয়া বাজিতেছে। মুর্শুদাবাদি রোশনচৌকি পেওঁ পেওঁ করিয়া ভোরের রাগ আলাপ করিতেছে। দালানে মতিলালের জন্য স্বস্ত্যয়ন আরম্ভ হইয়াছে। একদিগে চণ্ডীপাঠ হইতেছে— একদিগে শিবপূজার নিমিত্তে গঙ্গামৃত্তিকা ছানা হইতেছে। মধ্যস্থলে শালগ্রাম শিলা রাখিয়া তুলসী দেওয়া হইতেছে। ব্রাহ্মণেরা মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে ও পরস্পর বলাবলি করিতেছে আমাদিগের দৈব ব্রাহ্মণ্য তো নগদই প্রকাশ হইল— মতিলালের খালাস হওয়া দূরে থাকুক এক্ষণে কর্তাও তাহার সঙ্গে গেলেন। কল্য যদি নৌকায় উঠিয়া থাকেন, সে নৌকা ঝড়ে অবশ্য মারা পড়িয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই— যা হউক, সংসারটা একেবারে গেল— এখন ছ্যাং চেংড়ার কীর্তন হইবে— ছোটবাবু কি রকম হইয়া উঠেন বলা যায় না— বোধ হয় আমাদের প্রাপ্তির দফা একেবারে উঠে গেল। ঐ ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে একজন আস্তে আস্তে বলতে লাগিলেন— ওহে তোমরা ভাবছো কেন? আমাদের প্রাপ্তি কেহ ছাড়ায় না— আমরা শাঁকের করাত— যেতে কাটি আস্তে কাটি— যদি কর্তার পঞ্চত্ব হইয়া থাকে তবে তো একটা জাঁকাল শ্রাদ্ধ হইবে, কর্তার বয়েস হইয়াছে, মাগী টাকা লয়ে আতু-আতু পুতু-পুতু করিলে দশজনে মুখে কালি চুন দিবে। আর একজন বললেন, বসুধারার মতো ফোঁটা ফোঁটা পড়ে নিত্য পাই, নিত্য খাই—এক বর্ষণে কি চিরকালের তৃষ্ণা যাবে ?
বাবুরামবাবুর স্ত্রী অতি সাধ্বী। স্বামীর গমনাবধি অন্নজল ত্যাগ করিয়া অস্থির হইয়াছিলেন। বাটীর জানালা থেকে গঙ্গা দর্শন হইত— সারারাত্রি জানালায় বসিয়া আছেন। এক একবার যখন প্রচণ্ড বায়ু বেগে বহে, তিনি অমনি আতঙ্কে শুখাইয়া যান। এক একবার তুফানের উপর দৃষ্টিপাত করেন কিন্তু দেখিবামাত্র হৃকম্পন উপস্থিত হয়। এক একবার বজ্রঘাতের শব্দ শুনেন, তাহাতে অস্থির হইয়া কাতরে পরমেশ্বরকে ডাকেন। এই প্রকারে কিছুকাল গেল, গঙ্গার উপর নৌকার গমনাগমন প্রায় বন্ধ। মধ্যে মধ্যে যখন একেকটা শব্দ শুনেন অমনি উঠিয়া দেখেন। এক একবার দূর হইতে এক একটা মিড়মিড়ে আলো দেখতে পান, তাহাতে বোধ করেন ঐ আলোটা কোনো নৌকার আলো হইবে— কিয়ৎক্ষণ পরেই একখানা নৌকা দৃষ্টিগোচর হয়, তাহাতে মনে করেন এ নৌকা বুঝি ঘাটে আসিয়া লাগিবে— যখন নৌকা ভেড়-ভেড় করিয়া ভেড়ে না— বরাবর চলে যায়, তখন নৈরাশ্যের বেদনা শেলস্বরূপ হইয়া হৃদয়ে লাগে। রাত্রি প্রায় শেষ হইল, ঝড় বৃষ্টি ক্রমে ক্রমে থামিয়া গেল। সৃষ্টির অস্থির অবস্থার পর স্থির অবস্থা অধিক শোভাকর হয়। আকাশে নক্ষত্র প্রকাশ হইল—চন্দ্রের আভা গঙ্গার উপর যেন নৃত্য করিতে লাগিল ও পৃথিবী এমতো নিঃশব্দ হইল যে, গাছের পাতাটি নড়িলেও স্পষ্টরূপ শুনা যায়। এইরূপ দর্শনে অনেকেরই মনে নানাভাবের উদয় হয়। গৃহিণী এক একবার চারিদিকে দেখিতেছেন ও অধৈর্য হইয়া আপনা আপনি বলিতেছেন —জগদীশ্বর ! আমি জানত কাহার মন্দ করি নাই— কোনো পাপও করি নাই—এতকালের পর আমাকে কি বৈধব্য-যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে? আমার ধনে কাজ নেই, গহনার কাজ নাই— কাঙালিনী হইয়া থাকি সেও ভালো— সে দুঃখে দুঃখ বোধ হইবে না কিন্তু এই ভিক্ষা দেও যেন পতি-পুত্রের মুখ দেখতে দেখতে মরিতে পারি। এইরূপ ভাবনায় গৃহিণীর মন অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিল। তিনি বড়ো বুদ্ধিমতী ও চাপা মেয়ে ছিলেন, আপনি রোদন করিলে পাছে কন্যারা কাতর হয়, এ কারণে ধৈর্য ধরিয়া রহিলেন। শেষ রাত্রে বাটীতে প্রভাতী নহবত বাজিতে লাগিল। ঐ বাদ্যে সাধারণের মন আকৃষ্ট হয় সত্য কিন্তু তাপিত মনে ঐরূপ বাদ্য দুঃখের মোহনা খুঁলিয়া দেয়, এ কারণ বাদ্য শ্রবণে গৃহিণীর মনের তাপ যেন উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। ইতিমধ্যে একজন জেলিয়া বৈদ্যবাটীর বাটিতে মাছ বেচতে আসিল। তাহার নিকট অনুসন্ধান করাতে সে বলিল ঝড়ের সময় বাঁশবেড়ের চড়ার নিকট একখানা নৌকা ডুবুডুবু হইয়াছিল, বোধ হয় সে নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে— তাতে একজন মোটা বাবু, একজন মুসলমান, একটি ছেলেবাবু ও আর আর অনেক লোক ছিল। এই সংবাদ একেবারে যেন বজ্রাঘাত তুল্য হইল। বাটীতে বাদ্যোদ্যম বন্ধ হইল ও পরিবারেরা চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
অনন্তর সন্ধ্যা হয় এমন সময় বাঞ্ছারামবাবু তড়বড় করিয়া বৈদ্যবাটীর বাটীর বৈঠকখানায় উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞসা করিলেন— কর্তা কোথায়? চাকরের নিকট সংবাদ প্রাপ্ত হওয়াতে একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন এবং বলিলেন— হায় হায় বড় লোকটাই গেল। অনেকক্ষণ খেদ বিষাদ করিয়া চাকরকে বললেন, এক ছিলিম তামাক আন্ তো। একজন তামাক আনিয়া দিলে খাইতে খাইতে ভাবিতেছেন— বাবুরামবাবু তো গেলেন এক্ষণে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যে যাই। বড়ো আশা করিয়া আসিয়াছিলাম কিন্তু আশা আসা মাত্র হইল। বাটীতে পূজা-প্রতিমা ঠন্ঠনাচ্ছে— কোত্থেকে কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। দমসম দিয়া টাকাটা হাত করিতে পারিলে অনেক কর্মে আসিত— কতক সাহেবকে দিতাম— কতক আপনি লইতাম— তারপরে এর মুণ্ডু ওর ঘাড়ে দিয়া হর বর সর করিতাম। কে জানে যে আকাশ ভেঙে একেবারে মাথার উপর পড়বে? বাঞ্ছারামবাবু চাকরদিগকে দেখাইয়া লোক-দেখানো একটু কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন কিন্তু সে কান্না কেবল টাকার দরুন। তাঁহাকে দেখিয়া স্বস্ত্যয়নি ব্রাহ্মণেরা নিকটে আসিয়া বসিলেন। গলায়দড়ে জাত প্রায় বড়ো ধূর্ত—অন্ত পাওয়া ভার। কেহ কেহ বাবুরামবাবুর গুণ বর্ণন করতে লাগিলেন— কেহ কেহ বলিলেন, আমরা পিতৃহীন হইলাম— কেহ কেহ লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, এখন বিলাপের সময় নয় যাতে তাঁর পরকাল ভালো হয় এমনতো চেষ্টা করা কর্তব্য— তিনি তো কম লোক ছিলেন না? বাঞ্ছারামবাবু তামাক খাচ্ছেন ও হাঁ হাঁ বলছেন— ও কথায় বড়ো আদর করেন না— তিনি ভালো জানেন বেল পাকলে কাকের কি? আপিনি এমনি বুকভাঙা হইয়া পড়িয়াছেন যে উঠে যেতে পা এগোয় না— যা শুনেন তাতেই সাটে হেঁ হুঁ করেন— আপনি কি করিবেন— কার মাথা খাবেন— কিছুই মতলব বাহির করিতে পারিতেছেন না। এক একবার ভাবতেছেন তদ্বির না করিলে দুই একখানা ভালো বিষয় যাইতে পারে এ কথা পরিবারদিগকে জানালে এখনি টাকা বেরোয়— আবার এক একবার মনে করতেছেন এমতো টাট্কা শোকের সময় বললে কথা ভেসে যাবে। এইরূপ সাত-পাঁচ ভাবছেন, ইতিমধ্যে দরজায় গোল উঠিল— একজন ঠিকা চাকর আসিয়া একখানা চিঠি দিল— শিরোনামা বাবুরামবাবুর হাতের লেখা কিন্তু সে ব্যক্তি সরেওয়ার কিছুই বলিতে পারিল না, বাটীর ভিতরে চিঠি লইয়া যাওয়াতে গৃহিণী আস্তেব্যস্তে খুলিয়া পড়িলেন। সে চিঠি এই “কাল রাত্রে ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম— নৌকা আঁদিতে এগিয়ে পড়ে, মাঝিরা কিছুই ঠাহর করিতে পারে নাই, এমনি ঝড়ের জোর যে নৌকা একবারে উল্টে যায়। নৌকা ডুবিবার সময় এক একবার বড়ো ত্রাস হয় ও এক একবার তোমাকে স্মরণ করি— তুমি যেন আমার কাছে দাঁড়াইয়া বলিতেছ— বিপদ কালে ভয় করিও না— কায়মনোচিত্তে পরমেশ্বেরকে ডাকো— তিনি দয়াময়, তোমাকে বিপদ থেকে অবশ্যই উদ্ধার করিবেন। আমিও সেইমতো করিয়াছিলাম। যখন নৌকা থেকে জলে পড়িলাম তখন দেখিলাম একটা চড়ার উপর পড়িয়াছি সেখানে হাঁটু জল। নৌকা তুফানের তোড়ে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি চড়ার উপর থাকিয়া প্রাতঃকালে বাঁশবেড়িয়াতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। মতিলাল অনেকক্ষণ জলে থাকাতে পীড়িত হইয়াছিল। তাকুত করাতে আরম হইয়াছে, বোধ করি রাততক বাঠীতে পৌঁছিব।”
চিঠি পড়িবামাত্র যেন অনলে জল পড়িল—গৃহিণী কিছু কাল ভাবিয়া বলিলেন, এ দুঃখিনীর কি এমন কপাল হবে? এই বলিতে বলিতে বাবুরামবাবু আপন পুত্র ও ঠকচাচা সহিত বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চারিদিকে মহাগোল পড়িয়া গেল। পরিবারের মন সন্তাপের মেঘে আচ্ছন্ন ছিল এক্ষণে আহ্লাদের সূর্য উদয় হইল। গৃহিণী দুই কন্যার হাত ধরিয়া স্বামী ও পুত্রের মুখ দেখিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন, মনে করিয়াছিলেন মতিলালকে অনুযোগ করিবেন— এক্ষণে সে সব ভুলিয়া গেলেন। দুইটি কন্যা ভ্রাতার হাত ধরিয়া ও পিতার চরণে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। ছোট পুত্রটি পিতাকে দেখিয়া যেন অমূল্য ধন পাইল— অনেকক্ষণ গলা জড়াইয়া থাকিল— কোল থেকে নামিতে চায় না। আন্যান্য স্ত্রীলোকেরা দাঁড়াগোপান দিয়া মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। বাবুরামবাবু মায়াতে মুগ্ধ হওয়াতে অনেকক্ষণ কথা কহিতে পারিলেন না। মতিলাল মনে মনে কহিতে লাগিল নৌকাডুবি হওয়াতে বাঁচলুম তা না হলে মায়ের কাছে মুখ খেতে খেতে প্রাণ যাইত।
বাহির বাটীতে স্বস্ত্যয়নি ব্রাহ্মণেরা কর্তাকে দেখিয়া আশীর্বাদ করণান্তর বলিলেন, “নচ দৈবাৎ পরং বলং” দৈব বল অপেক্ষা শ্রেষ্ট বল নাই— মহাশয় একে পুণ্যবান তাতে যে দৈব করা গিয়াছে আপনার কি বিপদ হইতে পারে? যদ্যপি তা হইল তবে আমরা অব্রাহ্মণ। এ কথায় ঠকচাচা চিড়চিড়িয়া উঠিয়া বলিলেন— যদি এনাদের কেরদানিতে সব আপদ দফা হল তবে কি মোর মেহনত ফেলতো, মুই তো তসবি পড়েছি ? অমনি ব্রাহ্মণেরা নরম হইয়া সামঞ্জস্য করিয়া বলতে লাগিলেন— ওহে যেমন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি ছিলেন তেমনিতুমি কর্তাবাবুর সারথিই— তোমার বুদ্ধিবলেই তো সব হইয়াছে— তুমি অবতার বিশেষ, যেখানে তুমি আছ— যেখানে আমরা আছি— সেখানে দায়-দফা ছুটে পালায়। বাঞ্ছারামবাবু মণিহারা ফণী হইয়া ছিলেন— বাবুরামকে দেখাইবার জন্য পানসে চক্ষে একটু একটু মায়কান্না কাঁদিতে লাগিলেন। তখন তাঁহার দশ হাত ছাতি হইয়াছে এবং দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে চার ফেললেই, মাছ পড়িবে। তিনি ব্রাহ্মণদিগের কথা শুনিয়া তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বল্তে লাগিলেন— এ কি ছেলের হাতের পিটে ? যদি কর্তার আপদ হবে তবে আমি কলিকাতায় কি ঘাস কাটি?
০৯.
শিশুশিক্ষা ও সুশিক্ষা না হওয়াতে মতিলালের ক্রমে ক্রমে মন্দ হওন ও অনেক সঙ্গী পাইয়া বাবু হইয়া উঠন এবং ভদ্র কন্যার প্রতি অত্যাচার করণ।
ছেলে একবার বিগ্ড়ে উঠলে আর সুযুত হওয়া ভার। শিশুকাল অবধি যাহাতে মনে সদ্ভাব জন্মে এমতো উপায় করা কর্তব্য, তাহা হইলে সেই সকল সদ্ভাব ক্রমে ক্রমে পেকে উঠতে পারে তখন কুকর্মে মন না গিয়া সৎকর্মের প্রতি ইচ্ছা প্রবল হয়, কিন্তু বাল্যকালে কুসঙ্গ অথবা অসদুপদেশ পাইলে বয়সের চঞ্চলতা হেতু সকলই উল্টে যাইবার সম্ভাবনা। অতএব যে পর্যন্ত ছেলেবুদ্ধি থাকিবে সে পর্যন্ত নানা প্রকার সৎ অভ্যাস করানো আবশ্যক। বালকদিগের এইরূপ শিক্ষা পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত হইলে তাহাদিগের মন্দ পথে যাইবার সম্ভাবনা থাকে না। তখন তাহাদিগের মন এমতো পবিত্র হয় যে কুকর্মের উল্লেখমাত্রেই রাগ ও ঘৃণা উপস্থিত হয়।
এতদ্দেশীয় শিশুদিগের এরূপ শিক্ষা হওয়া বড়ো কঠিন, প্রথমতঃ ভালো শিক্ষক নাই—দ্বিতীয়তঃ ভালো বহি নাই—এমতো এমতো বহি চাই যাহা পড়িলে মনে সদ্ভাব ও সুবিবেচনা জন্মিয়া ক্রমে ক্রমে দৃঢ়তর হয়। কিন্তু সাধারণের সংস্কার এই যে কেবল কতকগুলিন শব্দের অর্থ শিক্ষা হইলেই আসল শিক্ষ হইল। তৃতীয়তঃ কি কি উপায় দ্বারা মনের মধ্যে সদ্ভাব জন্মে তাহা অতি অল্প লোকের বোধ আছে। চতুর্থতঃ শিশুদিগের যে প্রকার সহবাস হইয়া থাকে তাহাতে তাহাদিগের সদ্ভাব জন্মানো ভার। হয় তো কাহারো বাপ জুয়াচোর বা মদখোর, নয় তো কাহারো খুড়া বা জেঠা ইন্দ্রিয়দোষে আসক্ত—হয় তো কাহারো মাতা লেখাপড়া কিছুই না জানাতে আপন সন্তানাদির শিক্ষাতে কিছু-মাত্র যত্ন করেন না ও পরিবারের অন্যান্য লোক এবং চাকরদাসীর দ্বারা নানা প্রকার কুশিক্ষা হয়—নয় তো পাড়াতে বা পাঠশালাতে যে সকল বালকের সহিত সহবাস হয়, তাহাদের কুসংসর্গ ও কুকর্ম শিক্ষা হইয়া একেবারে সর্বনাশোৎপত্তি হয়। যে স্থলে উপরোক্ত একটি কারণ থাকে, সে স্থলে শিশুদিগের সদুপদেশের গুরুতর ব্যাঘাত—সকল কারণ একত্র হইলে ভয়ঙ্কর হইয়া উঠে— সে যেমন খড়ে আগুন লাগা— যে দিক জ্বলে উঠে সেই দিকেই যেন কেহ ঘৃত ঢালিয়া দেয় ও অল্প সময়ের মধ্যেই অগ্নি ছড়িয়া পড়িয়া যাহা পায় তাহাই ভস্ম করিয়া ফেলে।
অনেকেরই বোধ হইয়াছিল পুলিশের ব্যাপার নিষ্পন্ন হওয়াতে মতিলাল সুযুত হইয়া আসিবে। কিন্তু যে ছেলের মনে কিছুমাত্র সৎসংস্কার জন্মে নাই ও মান বা অপমানের ভয় নাই তাহার কোন সাজাতেই মনের মধ্যে ঘৃণা হয় না। কুমতি ও সুমতি মন থেকে উৎপন্ন হয় সুতরাং মনের সহিত তাহাদিগের সম্বন্ধ—শারীরিক আঘাত অথবা ক্লেশ হইলেও মনের গতি কিরূপে বদল হইতে পারে? যখন সারজন মতিলালকে রাস্তায় হিঁচুড়িয়া টানিয়া লইয়া গিয়াছিল তখন তাহার একটু ক্লেশ ও অপমান বোধ হইয়াছিল বটে কিন্তু সে ক্ষণিক—বেনিগারদে যাওয়াতে তাহার কিছুমাত্র ভাবনা বা ভয় বা অপমানবোধ হয় নাই। সে সমস্ত রাত্রি ও পরদিবস গান গাইয়া ও শেয়াল-কুকুরের ডাক ডাকিয়া নিকটস্থ লোকদিগকে এমতো জ্বালাতন করিয়াছিল যে, তাহারা কানে হাত দিয়া রাম রাম ডাক ছাড়িয়া বলাবলি করিয়াছিল—কয়েদ হওয়া অপেক্ষা এ ছোঁড়ার কাছে থাকা ঘোর যন্ত্রণা। পরদিবস ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাঁড়াইবার সময় বাপকে দেখাইবার জন্য শিশু পরামানিকের ন্যায় একটুকু অধোবদন হইয়াছিল কিন্তু মনে মনে কিছুতেই দৃকপাত হয় নাই—জেলেই যাউক আর জিঞ্জিরেই যাউক কিছুতেই ভয় নাই।
যে সকল বালকদের ভয় নাই, ডর নাই, লজ্জা নাই কেবল কুকর্মেতেই রত—তাহাদিগের রোগ সামান্য রোগ নহে—সে রোগ মনের রোগ। তাহার উপর প্রকৃত ঔষধ পড়িলেই ক্রমে ক্রমে উপশম হইতে পারে। কিন্তু ঐ বিষয়ে বাবুরামবাবুর কিছুমাত্র বোঁধ-শোধ ছিল না। তঁহার দৃঢ় সংস্কার ছিল মতিলাল বড়ো ভাল ছেলে, তাহার নিন্দা শুনিলে প্রথম প্রথম রাগ করিয়া উঠিতেন—কিন্তু অন্যান্য লোকে বলিতে ছাড়িত না, তিনিও শুনিয়ে শুনিতেন না। পরে দেখিয়া শুনিয়া তাঁহার মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জন্মিল কিন্তু পাছে অন্যের কাছে খাটো হইতে হয় এজন্য মনে মনে গুমরে গুমরে থাকিতেন, কাহারো নিকট কিছুই ব্যক্ত করিতেন না, কেবল বাটীর দরওয়ানকে চুপি চুপি বলিয়া দিলেন মতিলাল যেন দরজার বাহির না হইতে পারে। তখন রোগ প্রবল হইয়াছিল সুতরাং উপযুক্ত ঔষধ হয় নাই, কেবল আটকে রাখতে অথবা নজরবন্দী করায় কি হইতে পারে? মন বিগড়ে গেলে লোহার বাড় দিলেও থামে না বরং তাহাতে ধূর্তমি আরও বেড়ে উঠে।
মতিলাল প্রথম প্রথম প্রাচীর টপকিয়া বাহিরে যাইতে লাগিল। হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ ও মানগোবিন্দ খালাস হইয়া বৈদ্যবাটীতে আসিয়া আড্ডা গাড়িল ও পাড়ার কেবলরাম, বাঞ্ছারাম, ভজকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ এবং অন্যান্য শ্রীদাম, সুবল ক্রমে ক্রমে জুটে গেল। এই সকল বালকের সহিত সহবাস হওয়াতে মতিলাল একেবারে ভয়ভাঙা হইল— বাপকে পুসিদা করা ক্রমে ক্রমে ঘুচিয়া গেল। যে যে বালক বাল্যাবস্থা অবধি নির্দোষ খেলা অথবা সৎআমোদ করিতে না শিখে তাহারা ইতর আমোদেই রত হয়। ইংরাজদিগের ছেলেরা পিতা-মাতার উপদেশে শরীর ও মনকে ভালো রাখিবার জন্য নানা প্রকার নির্দোষ খেলা শিক্ষা করে, কেহ বা তসবির আঁকে— কাহারো বা ফুলের উপর সক হয়— কেহ বা সংগীত শিখে— কেহ বা শিকার করিতে অথবা মর্দানা কস্ত করিতে রত হয়— যাহার যেমন ইচ্ছা, সে সেই মতো এইরূপ নির্দোষ ক্রীড়া করে। এতদ্দেশীয় বালকেরা যেমন দেখে তেমনি করে— তাহাদিগের সর্বদা এই ইচ্ছা যে জরি-জহরত ও মুক্ত-প্রবাল পরিব—মোহসাহেব ও বেশ্যা লইয়া বাগানে যাইব এবং খুব ধুমধামে বাবুগিরি করিব। জাঁকজমক ও ধুমধামে থাকা যুবকালেরই ধর্ম, কিন্তু তাহাতে পূর্বে সাবধান না হইলে এইরূপ ইচ্ছা ক্রমে বেড়ে উঠে ও নানাপ্রকার দোষ উপস্থিত হয়—সেই সকল দোষে শরীর ও মন অবশেষে একেবারে অধঃপাতে যায়।
মতিলাল ক্রমে ক্রমে মেরোয়া হইয়া উঠিল, এমনি ধূর্ত হইল যে পিতার চক্ষে ধূলা দিয়া নানা অভদ্র ও অসৎকর্ম করিতে লাগিল। সর্বদাই সঙ্গীদিগের সহিত বলাবলি করিত বুড়া বেটা একবার চোখ বুজলেই মনের সাধে বাবুয়ানা করি। মতিলাল বাপ-মার নিকট টাকা চাহিলেই টাকা দিতে হইত— বিলম্ব হইলেই তাহাদিগকে বলে বসিত—আমি গলায় দড়ি দিব অথবা বিষ খাইয়া মরিব। বাপ-মা ভয় পাইয়া মনে করিতেন কপালে যাহা আছে তাই হবে এখন ছেলেটি প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলে আমরা বাঁচি ও আমাদিগের শিবরাত্রির সলিতা বেঁচে থাকুক, তবু এক গণ্ডুষ জল পাব। মতিলাল ধুমধামে সর্বদাই ব্যস্ত—বাটীতে তিলার্ধ থাকে না। কখন বনভোজনে মত্ত—কখন যাত্রার দলে আকড়া দিতে আসক্ত—কখন পাঁচালির দল করিতেছে—কখন সকের কবিওয়ালদিগের সঙ্গে দেওরা দেওরা করিয়া চেঁচাইতেছে— কখন বারোয়ারী পূজার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে— কখন খেম্টার নাচ দেখিতে বসিয়া গিয়াছে— কখন অনর্থক মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামে উন্মত্ত আছে। নিকটে সিদ্ধি, চরস, গাঁজাগুলি, মদ অনবরত চলিতেছে—গুড়ুক্ পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। বাবুরা সকলেই সর্বদা ফিটফাট— মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি, সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরা বুটোদার এক্লাই ও গাজের মেরজাই গায়ে, মাথায় জরির তাজ, হাতে আতরে ভুরভুরে রেশমের হাত রুমাল ও এক এক ছড়ি, পায়ে রূপার বগলসওয়ালা ইংরাজী জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা, বর্ফি, নিখুঁতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে।
প্রথম প্রথম কুমতি দমন না হইলে ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠে। পরে একেবারে পশুবৎ হইয়া পড়ে—ভালো-মন্দ কিছুই বোধ থাকে না, আর যেমন আফিম খাইতে আরম্ভ করিলে ক্রমে ক্রমে মাত্রা অবশ্যই অধিক হইয়া উঠে তেমনি কূকর্মে রত হইলে অন্যান্য গুরুতর কূকর্ম করিবার ইচ্ছা আপনা আপনি আসয়া উপস্থিত হয়। মতিলাল ও তাঁহার সঙ্গী বাবুরা যে সকল আমোদে রত হইল ক্রমে তাহা অতি সামান্য আমোদ বোধ হইতে লাগিল— তাহাতে আর বিশেষ সন্তোষ হয় না, অতএব ভারি ভারি আমোদের উপায় দেখিতে লাগিল। সন্ধ্যার পর বাবুরা দঙ্গল বাঁধিয়া বাহির হন—হয় তো কাহারো বাড়িতে পড়িয়া লুটতরাজ করেন নয় তো কাহারো কানাচে আগুন লাগাইয়া দেন— হয় তো কোন বেশ্যার বাটীতে গিয়া শোর সরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বা মশারি পোড়ান কিংবা কাপড় ও গহনা চুরি করিয়া আনেন নয় তো কোনো কুলকামিনীর ধর্ম নষ্ট করিতে চেষ্টা পান। গ্রামস্থ সকল লোক অত্যন্ত ব্যস্ত, আঙুল মটকাইয়া সর্বদা বলে— তোরা ত্বরায় নিপাত হ।
এইরূপ কিছুকাল যায়—দুই-চারি দিবস হইল বাবুরামবাবু কোনো কর্মের অনুরোধে কলিকাতায় গিয়াছেন। একদিন সন্ধ্যার সময় বৈদ্যবাটীর নিকট দিয়া একখানা জানানা সোয়ারি যাইতেছিল। নববাবুরা ঐ সোয়ারি দেখিবামাত্র দৌড়ে গিয়ে চারিদিক ঘেরিয়া ফেলিল ও বেহারাদিগের উপর মারপিট আরম্ভ করিল, তাহাতে বেহারারা পাল্কি ফেলিয়া প্রাণভয়ে অন্তরে গেল। বাবুরা পাল্কি খুলিয়া দেখিল একটি পরমা সুন্দরী কন্যা তাহার ভেতরে অছেন— মতিলাল তেড়ে গিয়া কন্যার হাত ধরিয়া পাল্কি থেকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল। কন্যাটি ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন—চারিদিক শূন্যাকার দেখেন ও রোদন করিতে করিতে মনে মনে পরমেশ্বরকে ডাকেন— প্রভু ! এই অবলা অনাথাকে, রক্ষা করো— আমার প্রাণ যায় সেও ভালো যেন ধর্ম নষ্ট না হয়। সকলে টানাটানি করাতে কন্যাটি ভূমিতে পড়িয়া গেলেন তবুও তাহারা হিঁচুড়ে জোরে বাটীর ভিতর লইয়া গেল। কন্যার ক্রন্দন মতিলালের মাতার কর্ণগোচর হওয়াতে তিনি আস্তে-আস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন, অমনি বাবুরা চারিদিকে পলায়ন করিল। গৃহিণীকে দেখিয়া কন্যা তাঁহার পায়ে পড়িয়া কাতরে বলিলেন—মা গো ! আমার ধর্ম রক্ষা করো—তুমি বড়ো সাধ্বী। সাধ্বী স্ত্রী না হইলে সাধ্বী স্ত্রীর বিপদ অন্যে বুঝিতে পারে না। গৃহিণী কন্যাকে উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাঁহার চক্ষের জল পুঁছিয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন— মা ! কেঁদো না। ভয় নাই। তোমাকে আমি বুকের উপর রাখিব, তুমি আমার পেটের সন্তান— যে স্ত্রী পতিব্রতা তাহার ধর্ম পরমেশ্বর রক্ষা করেন। এই বলিয়া তিনি কন্যাকে অভয় দিয়া সান্তনা করণান্তর আপনি সঙ্গে করিয়া লইয়া তাঁহার পিতৃ আলয়ে রাখিয়া আসিলেন।
১০.
বৈদ্যবাটীর বাজার বর্ণন, বেচারামবাবুর আগমন, বাবুরামবাবুর সভায় মতিলালের বিবাহের ঘোঁট ও বিবাহ করণার্থে মণিরামপুরে যাত্রা এবং তথায় গোলযোগ।
শেওড়াপুলির নিস্তারিণীর আরতি ডেডাং ডেডাং করিয়া হইতেছে। বেচারামবাবু ঐ দেবীর আলয় দেখিয়া পদব্রজে চলিয়াছেন। রাস্তার দোধারি দোকান —কোনোখানে বন্দীপুর ও গোপাল পুরের আলু স্তূপাকার রহিয়াছে—কোনোখানে মুড়ি-মুড়কি ও চালডাল বিক্রয় হইতেছে —কোনোখানে কলু ভায়া ঘানিগাছের কাছে বসিয়া ভাষা রামায়ণ পড়িতেছেন —গোরু ঘুরিয়া যায় অমনি টিটকারি দেন, আবার আলে ফিরিয়া আইলে চিৎকার করিয়া উঠেন “ও রাম আমরা বানর, রাম আমরা বানর” —কোনোখানে জেলের মেয়ে মাছের ভাগা দিয়া নিকটে প্রদীপ রাখিয়া “মাছ নেবে গো, মাছ নেবে গো” বলিতেছে —কোনোখানে কাপুড়ে মহাজন বিরাট পর্ব লইয়া বেদব্যাসের শ্রাদ্ধ করিতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে বেচারামবাবু যাইতেছেন। একাকী বেড়াতে গেলে সর্বদা যে সব কথা তোলাপড়া হয় সেই সকল কথাই মনে উপস্থিত হয়। তৎকালে বেচারামবাবু সদ্য সংকীর্তন লইয়া আমোদ করিতেন। বসতি ছাড়াইয়া নির্জন স্থান দিয়া যাইতে যাইতে মনোহরসাহী একটা তুক্ক তাঁহার স্মরণ হইল। রাত্রি অন্ধকার —পথে প্রায় লোকজনের গমনাগমন নাইে—কেবল দুই-একখানা গোরুর গাড়ী কেঁকোর কেঁকোর করিয়া ফিরিয়া যাইতেছে ও স্থানে স্থানে এক একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করিতেছে। বেচারামবাবু তুক্কর সুর দেদার রকমে ভাঁজিতে লাগিলেন —তাঁহার খোনা আওয়াজ আশপাশের দুই-একজন পাড়াগেঁয়ে মেয়েমানুষ শুনিবামাত্রে আঁও মাঁও করিয়া উঠিল —পল্লীগ্রামের স্ত্রীলোকদিগের আজন্মকালাবধি এই সংস্কার আছে যে খোনা কেবল ভূতেতেই করিয়া থাকে। ঐ গোলযোগ শুনিয়া বেচারামবাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া দ্রুতগতি একেবারে বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন।
বাবুরামবাবু ভারি মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও অন্যান্য অনেকে উপস্থিত। গদির নিকট ঠকচাচা একখানা চৌকির উপর বসিয়া আছেন। অনেকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শাস্ত্রালাপ করিতেছেন। কেহ কেহ ন্যায়শাস্ত্রের ফেঁক্ড়ি ধরিয়াছেন —কেহ কেহ তিথিতত্ত্ব, কেহ বা মলমাসতত্ত্বের কথা লইয়া তর্ক করিতে ব্যস্ত আছেন —কেহ কেহ দশম স্কন্ধের শ্লোক ব্যাখ্যা করিতেছেন —কেহ কেহ বহুব্রীহি ও দ্বন্দ্ব লইয়া মহা দ্বন্দ্ব করিতেছেন। কামাখ্যা-নিবাসী একজন ঢেঁকিয়াল ফুক্কন কর্তার নিকট বসিয়া হুকা টানিতে টানিতে বলিতেছেন —আপনি বড়ো বাগ্যমান পুরুষ —আপনার দুইটি লড়বড়ে ও দুইটি পেঁচা মুড়ি —এ বচ্চর একটু লেড়াং ভেড়াং আছে কিন্তু একটি যাগ করলে সব রাঙা ফুকনের মাচাং যাইতে পারবে ও তাহার বশীবুত অবে —ইতিমধ্যে বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আসিবামাত্র সকলেই উঠে দাড়াইয়া “আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক” বলিতে লাগিল। পুলিশের ব্যাপার অবধি বেচারামবাবু চটিয়া রহিয়াছিলেন কিন্তু শিষ্টাচারে ও মিষ্টকথায় কে না ভোলে ? ঘন ঘন “যে আজ্ঞা মহাশয়ে” তাহার মন একটু নরম হইল এবং তিনি সহাস্য বদনে বেণীবাবুর কাছে ঘেঁষে বসিলেন। বাবুরামবাবু বলিলেন —মহাশয়ের বসাটা ভালো হইল না —গদির উপর আসিয়া বসুন। মিল মাফিক লোক পাইলে মানিকজোড় হয়। বাবুরামবাবু অনেক অনুরোধ করিলেন বটে কিন্তু বেচারামবাবু বেণীবাবুর কাছছাড়া হইলেন না। কিয়ৎক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর বেচারামবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন মতিলালের বিবাহের সম্বন্ধ কোথায় হইল ?
বাবুরাম। সম্বন্ধ অনেক আসিয়াছিল। গুপ্তিপাড়ার হরিদাসবাবু, নাকাসী পাড়ার শ্যামাচরণবাবু, কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু ও অন্যান্য অনেক স্থানের অনেক ব্যক্তি সম্বন্ধের কথা উপস্থিত করিয়াছিল। সে সব ত্যাগ করিয়া এক্ষণে মণিরামপুরের মাধববাবুর কন্যার সহিত বিবাহ ধার্য করা গিয়াছে। মাধববাবু যোত্রাপন্ন লোক আর আমাদিগের দশ টাকা পাওয়া-থোয়া হইতে পারিবে।
বেচারাম। বেণী ভায়া ! এ বিষয়ে তোমার কি মত ? কথাগুলো খুলে বলো দেখি।
বেণী। বেচারাম দাদা। খুলে খেলে কথা বলা বড় দায় — বোবার শত্রু নাই আর কর্ম যখন ধার্য হইয়াছে তখন আন্দোলনে কি ফল ?
বেচারাম। আরে তোমাকে বলতেই হবে —আমি সব বিষয়ের নিগূড় তত্ত্ব জানিতে চাই।
বেণী। তবে শুনুন— মনিরামপুরের মাধববাবু দাঙ্গাবাজ লোক —ভদ্র চালচুলা নাই, কেবল গোরু কেটে জুতাদানি ধার্মিকতা আছে —বিবাহেতে জিনিসপত্র টাকাকড়ি দিতে পারেন কিন্তু বিবাহ দিতে গেলে কেবল কি টাকাকড়ির উপর দৃষ্টি করা কর্তব্য ? অগ্রে ভদ্রঘর খোঁজা উচিত, তারপর ভালো মেয়ে খোঁজা কর্তব্য, তারপর পাওনা-থোওনা হয় বড়ো ভালো — না হয় —নাই। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু অতি সুমানুষ —তিনি পরিশ্রম দ্বারা যাহা উপায় করেন তাহাতেই সানন্দচিত্তে কাল যাপন করেন —পরের বিষয়ের উপর কখন চেয়েও দেখেন না —তাঁহার অবস্থা বড়ো ভালো নয় বটে কিন্তু তিনি আপন সন্তানাদির সদুপদেশে সর্বদা যত্নবান ও পরিবারেরা কি প্রকারে ভালো থাকিবে ও কি প্রকারে তাহাদিগের সুমতি হইবে সর্বদা কেবল এই চিন্তা করিয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা হইলে তো সর্বাংশে সুখজনক হইত।
বেচারাম। বাবুরামবাবু ! তুমি কাহার বুদ্ধিতে এ সম্বন্ধ করিয়াছ ? টাকার লোভেই গেলে যে ! তোমাকে কি বল্ব ? এ আমাদিগের জেতের দোষ। বিবাহের কথা উপস্থিত হইলে লোকে অমনি বলে বসে —কেমন গো রূপোর ঘড়া দেবে তো ? মুক্তোর মালা দেবে তো ? আরে আবাগের বেটা কুটুম্ব ভদ্র কি অভদ্র তা আগে দেখ্—মেয়ে ভালো কি মন্দ তার অন্বেষণ কর্ ? সে সব ছোট কথা —কেবল দশ টাকা লাভ হইলেই সব হইল —দূঁর দূঁর !
বাঞ্ছারাম। কুলও চাই —রূপও চাই —ধনও চাই ! টাকাটা একেবারে অগ্রাহ্য করলে সংসার কিরূপে চলবে ?
বক্রেশ্বর। তা বই কি —ধনের খাতির অবশ্য রাখতে হয়। নির্ধন লোকের সহিত আলাপে ফল কি ? সে আলাপে কি পেট ভরে ?
ঠকচাচা চৌকির উপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বললেন, মোর উপর এতনা টিটকারি দিয়া বাত হচ্ছে কেন ? মুই তো এ শাদি করতে বলি —একটা নামজাদা লোকের বেটি না আন্লে আদমির কাছে বহুত শরমের বাত, মুই রাতদিন ঠেওরে ঠেওরে দেখেছি যে, মণিরামপুরের মাধববাবু আচ্ছা আদমি —তেনার নামে বাগে গোরুতে জল খায় —দাঙ্গা-হাঙ্গামের ওক্তে লেঠেল মেংলে লেঠেল মিল্বে —আদালতের বেলকুল আদমি তেনার দস্তের বিচ —আপদ পড়লে হাজারো সুরতে মদত্ মিলবে। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু সেকস্ত আদ্মি —ঘেসাট-ঘোসাট করে প্যাট-টালে —তেনার সাথে খেসি কামে কি ফায়দা ?
বেচারাম। বাবুরাম! ভালো মন্ত্রী পাইয়াছ ! এমন মন্ত্রীর কথা শুনিলে তোমাকে সশরীর স্বর্গে যাইতে হইবে —আর কিবা ছে্লেই পেয়েছ ! —তাহার আবার বিয়ে ? বেণী ভায়া তোমার মত কি ?
বেণী। আমার মত এই যে —পিতা প্রথমে ছেলেকে ভালো রূপে শিক্ষা দিবেন ও ছেলে যাহাতে সর্বপ্রকারের সৎ হয় এমতো চেষ্টা সম্যক্রূপে পাইবেন —ছেলের যখন বিবাহ করিবার বয়েস হইবে তখন তিনি বিশেষরূপে সাহায্য করিবেন। অসময় বিবাহ দিলে ছেলের নানাপ্রকার হানি করা হয়।
এই সকল কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু ধড়মরিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি বাটীর ভিতর গেলেন। গৃহিণী পাড়ার স্ত্রীলোকদিগের সহিত বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তা কহিতেছিলেন। কর্তা নিকটে গিয়া বাহির বাটীর সকল কথা শুনাইয়া থতমত খাইয়া দাঁড়াইলেন ও বলিলেন —তবে কি মতিলালের বিবাহ কিছু দিন স্থগিত থাকিবে ? গৃহিণী উত্তর করিলেন —তুমি কেমন কথা বলো —শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ষেটের কোলে মতিলালের বয়েস ষোল বৎসর হইল —আর কি বিবাহ না দেওয়া ভালো দেখায়? এ কথা লইয়া এখন গোলমাল করিলে লগ্ন বয়ে যাবে, কি করছো—একজন ভালো মানুষের কি জাত যাবে? —বড় লয়ে শীঘ্র যাও। গৃহিণীর উপদেশে কর্তার মনের চাঞ্চল্য দূর হইল —বাটীর বাহিরে আসিয়া রোশনাই জ্বালিতে হুকুম দিলেন; অমনি ঢোল, রোশনচৌকি, ইংরাজী বাজনা বাজিয়া উঠিল ও বরকে তক্তনামার উপর উঠাইয়া বাবুরামবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া আপন বন্ধু-বান্ধব কুটুম্ব-সজ্জন সঙ্গে লইয়া হেল্তে দুল্তে চলিলেন। ছাতের উপর থেকে গৃহিণী ছেলের মুখখানি দেখিতে লাগিলেন। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা বলিয়া উঠিল —ও মতির মা ! আহা বাছার কী রূপই বেরিয়েছে। বরের সব ইয়ার-বক্সি চলিয়াছে, পেছনে রংমশাল লইয়া কাহারো গা পোড়াইয়া দিতেছে, কাহারো ঘরের নিকট পটকা ছুঁড়িতেছে, কাহারো কাছে তুবরিতে আগুন দিতেছে। গরীব-দুঃখী লোকসকল দেক্সেক হইল কিন্তু কাহারো কিছু বলিতে সাহস হইল না।
কিয়ৎক্ষণ পরে বর মণীরামপুরে গিয়া উত্তীর্ণ হইল —বর দেখতে রাস্তার দোধারি লোক ভেঙে পড়িল —স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগিল —ছেলেটির শ্রী আছে বটে কিন্তু নাকটি একটু টেকালো হলে ভালো হইত —কেহ বলতে লাগিল রংটি কিছু ফিকে একটু মাজা হলে আরও খুলতো। বিবাহ ভারি লগ্নে হবে কিন্তু রাত্রি দশটা না বাজতে বাজতে মাধববাবু দরওয়ান ও লন্ঠন সঙ্গে করিয়া বরযাত্রীদিগের আগ্বাড়ান লইতে আইলেন —রাস্তায় বৈবাহিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে প্রায় অর্ধঘন্টা শিষ্টাচারেতেই গেল —ইনি বলেন মহাশয় আগে চলুন, উনি বলেন মহাশয় আগে চলুন। বালীর বেণীবাবু এগিয়ে আসিয়া বলিলেন —আপনারা দু’জনের মধ্যে যিনি হউন একজন এগিয়ে পড়ুন আর রাস্তায় দাঁড়াইয়া হিম খাইতে পারি না। এইরূপ মীমাংসা হওয়াতে সকলে কন্যাকর্তার বাটীর নিকট আসিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে লাগিলেন ও বর যাইয়া মজলিসে বসিল। ভাট, রেও ও বারওয়ারীওয়ালা চারিদিকে ঘেরিয়া দাঁড়াইল —গ্রামভাটি ও নানা প্রকার ভাবের কথা উপস্থিত হইতে লাগিল —ঠকচাচা দাঁড়াইয়া রফা করিতেছেন —অনেক দম-সম দেন কিন্তু ফলের দফায় নামমাত্র —রেওদিগের মধ্যে একটা ষণ্ডা তেড়ে এসে বলিল, এ নেড়ে বেটা কেরে ? বেরো বেটা এখান থেকে —হিন্দুর কর্মে মুসলমান কেন ? ঠকচাচা অমনি রাগ উপস্থিত হইল। তিনি দাড়ি নেড়ে চোখ রাঙাইয়া গালি দিতে লাগিলেন। হলধর, গদাধর ও অন্যান্য নব বাবুরা একে চায় আরে পায়। তাহারা দেখিল যে প্রকার মেঘ করিয়া আসিতেছে —ঝড় হইতে পারে —অতএব ফরাস ছেড়ে, কেহ সেজ নেবায় —কেহ ঝাড়ে ঝাড়ে টক্কর লাগাইয়া দেয় —কেহ এর ওর মাথার উপর ফেলিয়া দেয়, কন্যাকর্তার তরফের দুইজন লোক এই সকল গোলযোগ দেখিয়া দুই-একটি শক্ত কথা বলাতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল —মতিলাল বিবাদ দেখিয়া মনে মনে ভাবে, বুঝি আমার কপালে বিয়ে নাই —হয় তো সুতা হাতে সার হইয়া বাটী ফিরিয়া যাইতে হবে।
১১.
মতিলালের বিবাহ উপলক্ষে কবিতা ও আগরপাড়ার অধ্যাপকদিগের বাদানুবাদ।
আগরপাড়ার অধ্যাপকেরা বৈকালে গাছের তলায় বিছানা করিয়া বসিয়া আছেন। কেহ কেহ নস্য লইতেছেন —কেহ বা তামাক খাইতেছেন —কেহ বা খক্ খক্ করিয়া কাশিতেছেন —কেহ বা দুই-একটি খোশ-গল্প ও হাসি-মস্করার কথা কহিতেছেন। তাঁহাদিগর মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন —বিদ্যারত্ন কেমন আছেন? ব্রাহ্মণ পেটের জ্বালায় মণিরামপুরে নিমন্ত্রণে গিয়া পা ভাঙিয়া বসিয়াছে —আহা কাল যে করে লাঠি ধরিয়া স্নান করিতে যাইতেছিলেন তাহাকে দেখিয়া আমার দুঃখ হইল।
বিদ্যাভূষণ। বিদ্যারত্ন ভালো আছেন, চুন হলুদ ও সেঁকতাপ দেওয়াতে বেদনা অনেক কমিয়া গিয়াছে। মণিরামপুরের নিমন্ত্রণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণ দাদা যে কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহাতে রং আছে —বলি শুনুন :
ডিমিকি ডিমিকি, তাথিয়ে থিয়ে বোলে নহবত বাজে।
মাধব ভবন। দেবেন্দ্রসদন। জিনি ভুবন বিরাজে।
অদ্ভুত সভা। আলোকের আভা। ঝাড়ের প্রভা মাজে মাজে।
চারিদিকে নানা ফুল। ছড়াছড়ি দুই কুল। বাদ্যের কুল কুল ঝাঁজে।
খোপে খোপে গাঁদা মালা। রাঙা কাপড় রুপার বালা। এতক্ষণে বিয়ের শালা সাজে।
সামেয়ানা ফর্ ফর্। তালি তাতে বহুতর। জল পড়ে ঝর্ ঝর্ হাজে।
লেঠিয়াল মজবুত। দরওয়ান রজপুত। নিনাদ অদ্ভুত গাজে।
লুচি চিনি মনোহরা। ভাঁড়ারেতে খুব ভরা। আল্পনার ডোরা ডোরা সাজে।
ভাট বন্দী কত কত। শ্লোক পড়ে শত শত। ছন্দ নানামতো ভাঁজে।
আগরপাড়া কবিবর। বিরচয়ে ওঁহিপর। ঝুপ করে এল বর সমাজে।
হলধর গদাধর উসু খুসু করে।
ছট্ ফট্ ছট্ ফট্ করে তারা মরে।
ঠকচাচা হন কাঁচা শুনে বাজে কথা।
হলধর গদাধর খাইতেছে মাথা।
পড়াপড়্ পড়াপড়্ ফাঁড়িবার শব্দ।
গুপাগুপ্ গুপাগুপ্ কিলে করে জব্দ।
ঠনাঠন্ ঠনাঠন্ ঝাড়ে ঝাড়ে লাগে।
সট্ সট্ সট্ সট্ করে সবে ভাগে।
মতিলাল দেখে কাল বসে বসে দোলে।
সুতাসার কি আমার আছয়ে কপালে।
বক্রেশ্বর বোকেশ্বর খোশামদে পাক্কা।
চলে যান কিল খান খান গলা ধাক্কা।
বাঞ্ছারাম অবিরাম ফিকিরেতে টন্ক।
চড় খেয়ে আচাড় খেয়ে হইলেন বঙ্ক।
বেচারাম সব বাম দেখে যান টেরে।
দূঁর দূঁর দূঁর দূঁর বলে অনিবারে।
বেণীবাবু খান খাবু নাই গতি গঙ্গা।
হুপ্ হাপ্ গুপ্ গাপ্ বেড়ে উঠে দাঙ্গা।
বাবুরাম ধরে থাম থাম থাম করে।
ঠক ঠক ঠক ঠক কেঁপে মরে ডরে।
ঠকচাচা মোরে বাঁচা বলে তাড়াতাড়ি।
মুসলমান বেঈমান আছে মুড়ি ঝুড়ি।
যায় সরে ধীরে ধীরে মুখে কাপড় মোড়া।
সবে বলে এই বেটা যত কুয়ের গোড়া।
রেওভাট করে সাট ধরে তাকে পড়ে।
চড়্ চড়্ চড়্ চড়্ দাড়ি তার ছেঁড়ে।
সেখের পো ওহো ওহো বলে তোবা তোবা।
জান যায় হায় হায় মাফ করো বাবা।
খুব করি হাত ধরি মোরে দাও ছেড়ে।
ভালা বুরা নেহি জান্তা জেতে মুই নেড়ে।
এ মোকামে কোই কামে আনা ঝকমারি।
হয়রান পেরেসান বেইজ্জতে মরি।
না বুজিয়া না সুজিয়া হেন্দুদের সাতে।
এসেছি বসিয়া আছি সেরফ্ দোস্তিতে।
এ সাদিতে না থাকিতে বার বার নানা।
চাচি মোর ফুপা মোর সবে করে মানা।
না শুনিয়া না রাখিয়া তেনাদের কথা।
জান যায় দাড়ি যায় যায় মোর মাথা।
মহা ঘোর ঝাপে লাঠিয়াল সাজিছে।
কড়্ মড়্ হড়্ মড়্ করে তারা আসিছে।
সপাসপ্ লপালপ্ বেত পিঠে পড়িছে।
গেলুম্রে মলুম্রে বলে সবে ডাকিছে।
বরযাত্রী কন্যাযাত্রী কে কোথা ভাগিছে।
মার মার ধর ধর এই শব্দ বাড়িছে।
বর লয়্যে মাধববাবু অন্তঃপুরে যাইছে।
সভা ভেঙে ছারখার একেবারে হইছে।
সবে বলে ঠক মুখে খুলে কাপড় বেড়।
দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড়।
বাবুরাম নির্ নাম হইয়ে চলিল।
রেসালা দোশালা সব কোথায় রহিল।
কাপড় চোপড় ছিঁড়ে পড়ে খুলে।
বাতাসে অবশে ওড়ে দুলে দুলে।
চাদর ফাদর নাহি কিছু গায়ে।
হোঁচট মোচট খান সুদু পায়ে।
চলিছে ধলিছে বড়ো অধোমুখে।
পড়েছি ডুবেছি আমি ঘোর দুঃখে।
ক্ষুধাতে তৃষ্ণাতে মোর ছাতি ফাটে।
মিঠাই না পাই নাহি মুড়কি জোটে।
রজনী অমনি হইতেছে ঘোর
বাতাস নিশ্বাস মধ্যে হল জোর।
বহে ঝড় হড়্ মড়্ চারিদিগে।
পবন শমন যেন এল বেগে।
কি করি একাকী না লোক না জন।
নিকট বিকট হইবে মরণ।
চলিতে বলিতে মন নাহি লাগে।
বিধাতা শত্রুতা করিলে কি হবে।
না জানি গৃহিণী মোর মৃত্যু শুনে।
দুঃখেতে খেদেতে মরিবেন প্রাণে।
বিবাহ নির্বাহ হল কি না হল।
ঠ্যাঙাতে লাঠিতে কিন্তু প্রাণ গেল।
সম্বন্ধ নির্বন্ধ কেন করিলাম।
মানেতে প্রাণেতে আমি মজিলাম।
আসিতে আসিতে দোকান দেখিল।
অবাধা তাগাদা যাইয়া ঢুকিল।
পার্শ্বেতে দর্মাতে শুয়ে আছে পড়ে।
অস্থির দুস্থির বুরো ঠক নেড়ে।
কেমনে এখানে বাবুরাম বলে।
একালা আমাকে ফেলিয়া আইলে।
এ কর্ম কি কর্ম সখার উচিত।
বিপদে আপদে প্রকাশে পিরিত।
ঠক কয় মহাশয় চুপ করো।
দোকানী না জানি তেনাদের চর।
পেলিয়ে যাইলে সব বাত হবে।
বাঁচিলে জানেতে মহবত রবে।
প্রভাতে দোঁহাতে করিল গমন
রচিয়ে তোটকে শ্রীকবিকঙ্কণ।
তর্কবাগীশ বাবুরামবাবুর বড়ো গোঁড়া কবিতা শুনিবামাত্র জ্বলিয়া উঠে বলিলেন —আ মরি ! কিবা কবিতা —সাক্ষাৎ সরস্বতী মূর্তিমান —কিংবা কালিদাস মরিয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন —কবিকঙ্কণের ভারি বিদ্যা —এমন ছেলে বাঁচা ভার। পয়ারও চমৎকার ! মেজের মাটি —পাথর বাটি —শীতল পাটি —নারকেল কাটি ! ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হইয়া বড়োমানুষের সর্বদা প্রশংসা করিবে গ্লানি করা তো ভদ্র কর্ম নয় —এই বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সে স্থান হইতে উঠিয়া চলিয়া যান। সকলে হাঁ —হাঁ —দাঁড়ান গো বলিয়া তাঁহাকে জোর করিয়া বসাইলেন।
অন্য আর একজন অধ্যাপকও কথা চাপা দিয়া অন্যান্য কথা ফেলিয়া সলিয়ে-কলিয়ে বাবুরামবাবু ও মাধববাবুর তারিফ করিতে আরম্ভ করিলেন। বামুনে বুলি প্রায় বড়ো মোটা —সকল সময় সবকথা তলিয়ে বুঝিতে পারে না —ন্যায়শাস্ত্রে ফেঁকড়ি পড়িয়া কেবল ন্যায়শাস্ত্রীয় বুদ্ধি হয় সাংসারিক বুদ্ধির চালনা হয় না। তর্কবাগীশ অমনি গলিয়া গিয়া উপস্থিত কথায় আমোদ করিতে লাগিলেন।
১২.
বেচারামবাবুর নিকট বেণীবাবুর গমন, মতিলালের ভ্রাতা রামলালের উত্তম চরিত্র হওনের কারণ, বারদাপ্রসাদবাবুর প্রসঙ্গ— মন শোধনের উপায়।
বৌবাজারের বেচারামবাবু বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। নিকটে দুই-একজন লোক কীর্তন-অঙ্গ গাইতেছেন। বাবু গোষ্ঠ, দান, মান, মাথুর খণ্ডিতা, উৎকণ্ঠিতা কলহান্তরিতা ক্রমে ক্রমে ফরমাইশ করিতেছেন। কীর্তনিয়ারা মনোহরসাহী রেনিটি ও নানা প্রকার সুরে কীর্তন করিতেছে, সে সকল শুনিয়া কেহ কেহ দশা পাইয়া একেবারে গড়াগড়ি দিতেছে। বেচারামবাবু চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছেন এমতো সময়ে বালীর বেণীবাবু গিয়া উপস্থিত।
বেচারামবাবু অমনি কীর্তন বন্ধ করাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আরে কত্তা বেণীভায়া। বেঁচে আছো কি? বাবুরাম নেকড়ার আগুন —ছেড়েও ছাড়ে না অথচ আমরা তাঁহার যে কর্মে যাই সেই কর্মে লণ্ডভণ্ড হইয়া আসিতে হয়। মনিরামপুরের ব্যাপারেতে ভালো আক্কেল পাইয়াছি —কথাই আছে, যে হয় ঘরের শত্রু সেই যায় বর যাত্রী।
বেণী। বাবুরামবাবুর কথা আর বলবেন না —দেক্সেক্ হওয়া গিয়াছে —ইচ্ছা হয় বালীর ঘর-দ্বার ছাড়িয়া প্রস্থান করি। “অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি” —আর বা কপালে কি আছে।
বেচারাম। ভালো, বাবুরামের তো এই গতিক —আপনি যেমন —মন্ত্রী যেমন —সঙ্গীরা যেমন —পুত্র যেমন —সকল কর্ম-কারখানা তেমন। তাহার ছোট ছেলেটি ভালো হইতেছে এর কারণ কি ? সে যে গোবর কুঁড়ে পদ্ম ফুল।
বেণী। আপনি এ কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। — এ কথাটি অসম্ভব বটে কিন্তু ইহার বিশেষ কারণ আছে। পূর্বে আমি বরদাপ্রসাদ বিশ্বাসবাবুর পরিচয় দিয়াছি তাহা আপনার স্মরণ থাকিতে পারে। কিয়ৎকালাবধি ঐ মহাশয় বৈদ্যবাটীতে অবস্থিতি করিয়া আছেন। আমি মনের মধ্যে বিবেচনা করিয়া দেখিলাম বাবুরামবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রামলাল যদ্যপি মতিলালের মতো হয় তবে বাবুরামের বংশ ত্বরায় নির্বংশ হইবে কিন্তু ঐ ছেলেটি ভালো হইতে পারে, তাহার উত্তম সুযোগ হইয়াছে। এই সকল বিবেচনা করিয়া রামলালকে সঙ্গে করিয়া উক্ত বিশ্বাসবাবুর নিকট গিয়াছিলাম। ছেলেটির সেই পর্যন্ত বিশ্বাসবাবুর প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে তাঁহার নিকটেই সর্বদা পড়িয়া আছে, আপন বাটীতে বড় থাকে না। তাঁহাকে পিতার তুল্য দেখে।
বেচারাম। পূর্বে ঐ বিশ্বাসবাবুরই গুণ বর্ণনা করিয়াছিলে বটে —যাহা হউক একাধারে এত গুণ কখনও শুনি নাই, এক্ষণে তাঁহার ভালো পদ হইয়াছে —মনে গর্মি না জন্মিয়া এত নম্রতা কি প্রকারে হইল ?
বেণী। যে ব্যক্তি বাল্যকালাবধি সম্পত্তি প্রাপ্ত হয় ও কখন বিপদে না পড়িয়া কেবল সম্পদেই বাড়িতে থাকে তাহার নম্রতা প্রায় হওয়া ভার —সে ব্যক্তি অন্যের মনের গতি বুঝিতে পারে না অর্থাৎ কি বা পরের প্রিয়, কি বা পরের অপ্রিয়, তাহা তাহার কিছুমাত্র বোধ হয় না, কেবল আপন সুখে সর্বদা মত্ত থাকে —আপনাকে বড়ো দেখে ও তাহার আত্মীয়বর্গ প্রায় তাহার সম্পদেরই খাতির করিয়া থাকে। এমতো অবস্থায় মনের গর্মি বড়ো ভয়ানক হইয়া উঠে —এমতো স্থলে নম্রতা ও দয়া কখনই স্থায়ী হইতে পারে না। এই কারণে কলিকাতার বড়োমানুষের ছেলেরা প্রায় ভালো হয় না। একে বাপের বিষয়, তাতে ভারি পদ সুতরাং সকলের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়া বেড়ায়। চোট না খাইলে —বিপদে না পড়িলে মন স্থির হয় না। মনুষ্যের নম্রতা অগ্রেই আবশ্যক। নম্র না হইলে লোকে ধর্মে বাড়িতেও পারে না।
বেচারাম। বরদাবাবু এত ভালো কি প্রকারের হইলেন ?
বেণী। বরদাবাবু বাল্যাবস্থা অবধি ক্লেশে পড়িয়াছিলেন। ক্লেশে পড়িয়া পরমেশ্বরকে অনবরত ধ্যান করিতেন —এইমতো অনবরত ধ্যান করাতে তাঁহার মনে দৃঢ় সংস্কার হইয়াছে যে, যে-কর্ম পরমেশ্বরের প্রিয় তাহাই করা কর্তব্য। যে-যে কর্ম তাঁহার অপ্রিয় তাহা প্রাণ গেলেও করা কর্তব্য নহে। ঐ সংস্কার অনুসারে তিনি চলিয়া থাকেন।
বেচারাম। পরমেশ্বরের প্রিয় অপ্রিয় কর্ম তিনি কি প্রকারে স্থির করিয়াছেন।
বেণী। ঐ বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত হইবার দুই উপায়ে আছে। প্রথমতঃ, মনঃসংযম করিতে হয়। মনের সংযম নিষিদ্ধ স্থির হইয়া ধ্যান ও মনের সম্ভাব বৃদ্ধি করা অবশ্যক। স্থিরতর চিত্তে ধ্যানের দ্বারা মনকে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে হিতাহিত বিবেচনা শক্তি চালনা হইতে থাকে, ঐ শক্তি যেমন প্রবল হইয়া উঠে তেমনি লোকে ঈশ্বরের অপ্রিয় কর্মে বিরত হইয়া প্রিয় কর্মেতে রত হইতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ সাধুলোকে যাহা লিখিয়াছেন তাহা পাঠ ও আন্দোলন করিলে ঐ শক্তি ক্রমশঃ অভ্যাস হয়। বরদাবাবু আপনাকে ভালো করিবার জন্য কোনো অংশ কসুর করেন নাই। অদ্যাবধি তিনি সাধারণ লোকের ন্যায় কেবল হো হো করিয়া বেড়ান না। প্রাতঃকালে উঠিয়া নিয়ত পরমেশ্বরের উপাসনা করিয়া থাকেন —তৎকালীন তাঁহার মনে যে ভাব উদয় হয় তাহা তাঁহার নয়নের জল দ্বারাই প্রকাশ পায়। তাহার পরে তিনি আপনি কি মন্দ ও কি ভালো কর্ম করিয়াছেন তাহা সুস্থির হইয়া উল্টে পাল্টে দেখেন —তিনি আপন গুণ কখনই গ্রহণ করেন না —কোন অংশে কিঞ্চিৎমাত্র দোষ দেখিলেই অতিশয় সন্তাপিত হন কিন্তু অন্যের গুণ শ্রবণে আমোদ করেন, দোষ জানিতে পারিলে ভ্রাতৃভাবে কেবল কিছু দুঃখ প্রকাশ করেন। এইরূপ অভ্যাসের দ্বারা তাঁহার চিত্ত নির্মল ও শান্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি মনকে এরূপ সংযত করে সে যে ধর্মেতে বাড়িবে তাহাতে আশ্চর্য কি ?
বেচারাম। বেণী ভায়া। বরদাবাবুর কথা শুনিয়া কর্ণ জুড়াইল, এমতো লোকের সহিত একবার দেখা করিতে হইবে, দিবসে তিনি কি করিয়া থাকেন ?
বেণীবাবু। তিনি দিবসে বিষয় কর্ম করিয়া থাকেন বটে কিন্তু অন্যান্য লোকের মতো নহে। অনেকেই বিষয় কর্মে প্রবৃত্ত হইয়া কেবল পদ ও অর্থের বিষয় ভাবেন, কিন্তু তিনি তাহা বড় ভাবেন না। তাঁহার ভালো জানা আছে যে পদ ও অর্থ জলবিম্বের ন্যায় দেখিতে ভালো —শুনিতে ভালো —কিন্তু মরিলে সঙ্গে যায় না বরং সাবধানপূর্বক না চলিলে ঐ উভয় দ্বারা কুমতি জন্মিয়া থাকে, তাঁহার বিষয় কর্ম করিবার প্রাধান তাৎপর্য এই যে তদ্দ্বারা আপন ধর্মের চালনা ও পরীক্ষা করিবেন। বিষয়কর্ম করিতে গেলে লোভ, রাগ, হিংসা, অবিচার ইত্যাদি প্রবল হইয়া উঠে ও ঐ সকল রিপুর দাপটে অনেকেই মারা যায়, তাহাতে যে সামলিয়া যায় সে-ই প্রকৃত ধার্মিক। ধর্ম মুখে বলা সহজ কিন্তু কর্মের দ্বারা না দেখাইলে মুখে বলা কেবল ভণ্ডামি; বরদাবাবু সর্বদা বলিয়া থাকেন সংসার পাঠশালার স্বরূপ, বিষয় কর্মের দ্বারা মনের সদভ্যাস হইলে ধর্ম অটুট হয়।
বেচারাম। তবে কি বরদাবাবু অর্থকে অগ্রাহ্য করেন ?
বেণী। না না —অর্থকে হেয় বোধ করেন না —কিন্তু তাঁহার বিবেচনাতে ধর্ম অগ্রে অর্থ তাহার পরে, অর্থাৎ ধর্মকে বজায় রাখিয়া অর্থ উপার্জন করিতে হইবেক।
বেচারাম। বরদাবাবু রাত্রে বাড়িতে কি করেন ?
বেণী। সন্ধ্যার পর পরিবারের সহিত সদালাপ ও পড়াশুনা করিয়া থাকেন। তাঁহার সচ্চরিত্র দেখিয়া পরিবারের সকলে তাঁহার মতো হইতে চেষ্টা করে, পরিবারের প্রতি তাঁহার এমতো স্নেহ যে স্ত্রী মনে করেন এমন স্বামী যেন জন্মে জন্মে পাই, সন্তানেরা তাঁহাকে এক দণ্ড না দেখিলে ছটফট করে। বরদাবাবুর পুত্রগুলি যেমন ভালো, কন্যাগুলিও তেমনি ভালো। অনেকের বাটীতে ভায়ে-বোনে সর্বদা কচ্কচি-কলহ করিয়া থাকে। বারদাবাবুর সন্তানেরা কেহ কাহাকেও উচ্চ কথা কহে না, কি লেখার সময়, কি পড়ার সময়, কি খাবার সময়, সকল সময়ই তাহারা পরস্পর স্নেহ পূর্বক কথাবার্তা কহিয়া থাকে —বাপ-মা ভালো না হইলে সন্তান ভালো হয় না।
বেচারাম। আমি শুনিয়াছি বরদাবাবু সর্বদা পাড়ায় ঘুরিয়া বেড়ান।
বেণী। এ কথা সত্য বটে —তিনি অন্যের ক্লেশ, বিপদ অথবা পীড়া শুনিলে বাটীতে স্থির হইয়া থাকিতে পারেন না। নিকটস্থ অনেক লোকের নানা প্রকারে উপকার করিয়া থাকেন কিন্তু ঐ কথা ঘুণাক্ষরে কাহাকেও বলেন না ও অন্যের উপকার করিলে আপনাকে উপকৃত বোধ করেন।
বেচারাম। বেণী ভায়া। এমন প্রকার লোক চক্ষে দেখা দূরে থাকুক কোনো কালে কখন কানেও শুনি নাই —এমতো লোকের নিকটে বুড়ো থাকিলেও ভালো হয় —ছেলে তো ভালো হবেই। আহা। বাবুরামের ছোট ছেলেটি ভালো হইলেই বড়ো সুখজনক হইবে।
১৩.
বরদাপ্রসাদবাবুর উপদেশ দেওন –তাঁহার বিজ্ঞতা ও ধর্মনিষ্ঠা এবং সুশিক্ষার প্রণালী। তাঁহার নিকট রামলালের উপদেশ, তজ্জন্য তাঁহার পিতার ভাবনা ও ঠকচাচার সহিত পরামর্শ। রামলালের গুণ বিষয়ে মনান্তর ও তাঁহার বড়ো ভগিনীর পীড়া ও বিয়োগ।
বরদাপ্রসাদবাবুর বিদ্যাশিক্ষা বিষয় বিজাতীয় বিচক্ষণতা ছিল। তিনি মানব স্বভাব ভালো জানিতেন। মনের কি কি শক্তি কি কি ভাব এবং কি কি প্রকারে ঐ সকল শক্তি ও ভাবের চালনা হইলে মনুষ্য বুদ্ধিমান ও ধার্মিক হইতে পারে তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ বিজ্ঞতা ছিল। শিক্ষকের কর্মটি বড়ো সহজ নহে। অনেকে যৎকিঞ্চিৎ ফুলতোলা রকম শিখিয়া অন্য কর্ম-কাজ না জুটিলে শিক্ষক হইয়া বলেন –এমতো সকল লোকের দ্বারা ভালো শিক্ষা হইতে পারে না। প্রকৃত শিক্ষক হইতে গেলে মনের গতি ও ভাব সকলকে ভালো রূপে জানিতে হয় এবং কি প্রকারে শিক্ষা দিলে কর্মে আসিতে পারে তাহা সুস্থির হইয়া দেখিতে হয় ও শুনিতে হয় ও শিখিতে হয়। এ সকল না করিয়া তাড়াহুড়া রকমে শিক্ষা দিলে কেবল পাথরে কোপ মারা হয় –একশত বার কোদাল পড়িলেও এক মুঠা মাটি কাটা হয় না, বরদাপ্রসাদ বাবু বহুদর্শী ছিলেন –অনেক কালাবধি শিক্ষার বিষয়ে মনোযোগী থাকাতে শিক্ষা দেওয়ার প্রণালী ভালো জানিতেন, তিনি যে প্রকারে শিক্ষা করাইতেন তাহাতে সার শিক্ষা হইত। এক্ষণে সরকারী বিদ্যালয়ে যে প্রকার শিক্ষা হয় তাহাতে শিক্ষার আসল অভিপ্রায় সিদ্ধ হয় না, কারণ মনের শক্তি ও মনের ভাবাদির সুন্দর রূপ চালনা হয় না, ছাত্রেরা কেবল মুখস্থ করিতে শিখে। তাতে কেবল স্মরণশক্তি জাগরিত –বিবেচনাশক্তি প্রায় নিদ্রিত থাকে, মনের ভাবাদির চলনার তো কথাই নাই। শিক্ষার প্রধান তাৎপর্য এই যে ছাত্রদিগের বয়ঃক্রম অনুসারে মনের শক্তি ও ভাব সকল সমানরূপে চালিত হইবেক। এক শক্তির অধিক চালনা ও অন্য শক্তির অল্প চালনা করা কর্তব্য হয় না। যেমন শরীরের সকল অঙ্গকে মজবুত করিলে শরীরটি নিরেট হয় তেমনি মনের সকল শক্তিকে সমানরূপে চালনা করিলে আসল বুদ্ধি হয়। মনে সদ্ভাবাদিরও চালনা সমানরূপে করা আবশ্যক। একটি সদ্ভাবের চালনা করিলেই সকল সদ্ভাবের চালনা হয় না। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মিলেও দয়ার লেশ না থাকিতে পারে –দয়ার ভাগ অধিক থাকিয়া দেনা-পাওনা বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান না থাকা অসম্ভব নহে –দেনা-পাওনা বিষয়ে খাড়া থাকিয়াও পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্রের উপর অযত্ন ও নিস্নেহ হইবার সম্ভাবনা –পিতা-মাতা-স্ত্রী-পুত্রের প্রতি স্নেহ থাকিতে পারে অথচ সরলতা কিছু মাত্র না থাকা অসম্ভব নহে। ফলেও বরদাপ্রসাদ বাবু ভালো জানিতেন যে মনের ভাবাদির চালনার মূল পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি –ঐ ভক্তির যেমন বৃদ্ধি হইবে তেমনি মনের সকল ভাবের চালনা হইতে থাকিবে, তাহা না হইলে ঐ কর্মটি জলের উপরে আঁক কাটার প্রায় হইয়া পড়ে।
রামলাল ভাগ্যক্রমে বরদাবাবুর শিষ্য হইয়াছিল। রামলালের মনের সকল শক্তি ও ভাবের চালনা সুন্দররূপে হইতে লাগিল। মনের ভাবের চালনা সৎ লোকের সহবাসে যেমন হয়, তেমন শিক্ষা দ্বারা হয় না। যেমন কলমের দ্বারা জাম গাছের ডাল আঁব গাছের ডাল হয়, তেমন সহবাসের দ্বারা এক রকম মন অন্য আর এক রকম হইয়া পড়ে। সৎমনের এমন মহাত্ম্য যে –তাহার ছায়া অধম মনের উপর পড়িলে, অধম রূপ ক্রমে ক্রমে সেই ছায়ার স্বরূপ হইয়া বসে।
বরদাবাবুর সহবাসে রামলালের মনের ঢাঁচা প্রায় তাহার মনের মতো হইয়া উঠিল। রামলাল প্রাতঃকালে উঠিয়া শরীরকে বলিষ্ঠ করিবার জন্য ফর্দা জায়গায় ভ্রমণ ও বায়ু সেবন করেন –তাঁর দৃঢ় সংস্কার হইল যে, শরীরে জোর না হইলে মনের জোর হয় না। তাহার পরে বাটীতে আসিয়া উপাসনা ও আত্মবিচার করেন এবং যে সকল বহি পড়িলে ও যে-যে লোকের সহিত আলাপ করিলে বুদ্ধি ও মনের সদ্ভাব বৃদ্ধি হয় কেবল সেই সকল বহি পড়েন ও সেই সকল লোকের সাহিত আলাপ করেন। সৎ লোকের নাম শুনিলেই তাঁহার নিকট গমনাগমন করেন –তাঁহার জাতি অথবা অবস্থার বিষয় কিছুমাত্র অনুসন্ধান করেন না। রামলালের বোধশোধ এমতো পরিষ্কার হইল যে, যাহার সঙ্গে আলাপ করেন তাহার সহিত কেবল কেজো কথাই কহেন –ফাল্তো কথা কিছুই কহেন না, অন্য লোক ফাল্তো কথা কহিলে আপন বুদ্ধির জোরে কুরুনির ন্যায় সার সার কথা বাহির করিয়া লয়েন। তিনি মনের মধ্যে সর্বদাই ভাবেন পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি, নীতিজ্ঞান ও সদ্বুদ্ধি যাহাতে বাড়ে তাহাই করা কর্তব্য। এই মতে চলাতে তাঁহার স্বভাব-চরিত্র ও কর্মসকল উত্তর উত্তর প্রশাংসনীয় হইতে লাগিল।
সততা কখনই চাপা থাকে না –পাড়ার সকল লোকে বলাবলি করে –রামলাল দৈত্যকূলের প্রহ্লাদ। তাহাদিগের বিপদ-আপদে রামলাল আগে বুক দিয়া পড়ে। কি পরিশ্রম দ্বারা, কি অর্থ দ্বারা, কি বুদ্ধি দ্বারা, যাহার যাতে উপকার হয় তাহাই করে। কি প্রাচীন, কি যুবা, কি শিশু, সকলেই রামলালের অনুগত ও আত্মীয় হইল –রামলালের নিন্দা শুনিলে তাহাদিগের কর্ণে শেল সম লাগিত –প্রশংসা শুনিলে মহা আনন্দ হইত। পাড়ার প্রাচীন স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল –আমাদিগের এমন একটি ছেলে হলে বাছাকে কাছছাড়া হতে দিতুম না –আহা ! ওর মা কত পূণ্য করেছিল যে এমন ছেলে পেয়েছে। যুবতী স্ত্রীলোকেরা রামলালের রূপ গুণ দেখিয়া শুনিয়া মনে মনে কহিত, এমনি পুরুষ যেন স্বামী হয়।
রামলালের সৎ স্বভাব ও সৎ চরিত্র ক্রমে ক্রমে ঘরে-বাহিরে নানা প্রকারে পাইতে লাগিল, তাঁহার পরিবার মধ্যে কাহারও প্রতি কোনো অংশে কর্তব্য কর্মের ত্রুটি হইত না।
রামলালের পিতা তাঁহাকে দেখিয়া এক একবার মনে করিতেন, ছোট পুত্রটি হিন্দুয়ানী বিষয় আল্গা আল্গা রকম –তিলক সেবা করে না –কোশা-কোশী লইয়া পূজা করে না। হরিনামের মালাও জপে না, অথচ আপন মত অনুসারে উপাসনা করে ও কোনো অধর্মে রত নহে –আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা কহি –ছেলেটি সত্য বৈ অন্য কথা জানে না –বাপ-মার প্রতি বিশেষ ভক্তিও আছে, অধিকন্তু আমাদের অনুরোধে কোনো অন্যায় কর্ম করিতে কখনই স্বীকার করে না –আমার বিষয়-আশয়ে অনেক জোর আছে –সত্য মিথ্যা দুই-ই-চাই। অপর বাটীতে দোল দুর্গোৎসব ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ হইয়া থাকে –এ সকল কি প্রকারে রক্ষা হইবে ? মতিলাল মন্দ বটে কিন্তু সে ছেলেটির হিন্দুয়ানী আছে –বোধ হয় দোষে-গুণে বড়ো মন্দ নয় –বয়েসকালে ভারিত্ব হইলে সব সেরে যাবে। রামলালের মাতা ও ভগিনীরা তাঁহার গুণে দিন দিন আর্দ্র হইতে লাগিলেন। ঘোর অন্ধকারের পর আলোক দর্শনে যেমন আহলাদ জন্মে তেমনি তাঁহাদিগের মনে আনন্দ হইল, মতিলালের অসদ্ব্যবহারে তাঁহারা ম্রিয়মাণ ছিলেন, মনে কিছুমাত্র সুখ ছিল না, –লোক গঞ্জনায় অধোমুখ হইয়া থাকিতেন, এক্ষণে রামলালের সদ্গুণে মনে সুখ ও মুখ উজ্জ্বল হইল। দাসদাসীরা পূর্বে মতিলালের নিকট কেবল গালাগালি ও মার খাইয়া পালাই পালাই ডাক ছাড়িত –এক্ষণে রামলালের মিষ্ট বাক্যে ও অনুগ্রহে ভিজিয়া আপন আপন কর্মে অধিক মনোযোগী হইল। মতিলাল, হলধর ও গদাধর রামলালের কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া পরস্পর বলাবলি করিত, ছোঁড়া পাগল হল –বোধ হয় মাথায় দোষ জন্মিয়াছে। কর্তাকে বলিয়া ওকে পাগলা গারদে পাঠান যাউক –একরত্তি ছোঁড়া, দিবারাত্রি ধর্ম ধর্ম বলে –ছেলে মুখে বুড়ো কথা ভালো লাগে না। মানগোবিন্দ, রামগোবিন্দ ও দোলগোবিন্দ মধ্যে মধ্যে বলে –মতিবাবু ! তুমি কপালে পুরুষ –রামলালের গতিক ভালো নয় –ওটা ধর্ম ধর্ম করিয়া নিকেশ হবে, তারপর তুমিই সমস্ত বিষয়টা লইয়া পায়ের উপর পা দিয়া নিছক মজা মারো। আর ওটা যদিও বাঁচে তবু কেবল জড়ভরতের মতো হবে। আ মরি ! যেমন গুরু তেমন চেলা –পৃথিবীতে আর শিক্ষক পাইলেন না ! একটা বাঙালের কাছে গুরুমন্ত্র পাইয়া সকলের নিকট ধর্ম ধর্ম করিয়া বেড়ান। বড়ো বাড়াবাড়ি করলে ওকে আর ওর গুরুকে একেবারে বিসর্জন দিব। আ মরি ! টগরে ছোঁড়া বলে বেড়ায়, দাদা কুসঙ্গ ছাড়লে বড়ো সুখের বিষয় হবে –আবার বলে বরদাবাবুর নিকট গমনাগমন করিলে ভালো হয়। বরদাবাবু বুদ্ধির ঢেঁকি। গুণবানের জেঠা। খবরদার মতিবাবু, তুমি যেন দমে পড়ে সেটার কাছে যেও না। আমরা আবার শিখব কি ? তার ইচ্ছা হয় তো সে আমাদের কাছে এসে শিখে যাউক। আমরা এক্ষণে রং চাই –মজা চাই –আয়েস চাই।
ঠকচাচা সর্বদাই রামলালের গুণাগুণ শুনেন ও বসিয়া বসিয়া ভাবেন। ঠকের আঁচ সময় পাইলেই বাবুরামের বিষয়ের উপর দুই-এক ছোবল মারিবেন। এই পর্যন্ত অনেক মামলা গোলমালে গিয়াছে –ছোবল মারিবার সময় হয় নাই কিন্তু চারের উপর চার দিয়া ছিপ ফেলার কসুর হয় নাই। রামলাল যে প্রকার হইয়া উঠিল তাহাতে যে মাছ পড়ে এমন বোধ হইল না –পেঁচ পড়িলেই সে পেঁচের ভিতর যাইতে বাপকে মানা করিবে। অতএব ঠকচাচা ভারি ব্যাঘাত উপস্থিত দেখিল এবং ভাবিল আশার চাঁদ বুঝি নৈরাশ্যের মেঘে ডুবে গেল, আর প্রকাশ বা না পায়। তিনি মনোমধ্যে অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন বাবুরামকে বলিলেন, বাবু সাহেব। তোমার ছোট লাড়কার ডৌল নেকা করে মোর বড়ো গর্মি হচ্ছে। মোর মালুম হয় ওনা দেওয়ানা হয়েছে –তেনা মোর উপর বড়ো খাপ্পা, দশ আদমির নজদিগে বলে মুই তোমাকে খারাপ করলাম –এ বাতশুনে মোর দেলে বড়ো চোট লেগেছে। বাবু সাহেব ! এ বহুত বুরাবাত –এজ এস মাফিক মোরে বললে –কেল তোমাকেও শক্ত শক্ত বলতে পারে। লেড়কা ভালো হবে –নরম হবে –বেতমিজ ও বজ্জাত হল, এলাজ দেয়া মোনাসেব। আর যে রবক সবক পড়ে তাতে যে জমিদারি থাকে এতনা মোর এক্কেলে মালুম হয় না।
যে ব্যক্তির ঘটে বড়ো বুদ্ধি নাই সে পরের কথায় অস্থির হইয়া পড়ে। যেমন কাঁচা মাঝির হাতে তুফানে নৌকা পড়িলে টল্মল্ করিতে থাকে –কুল-কিনারা পেয়েও পায় না –সেই মতো ঐ ব্যক্তি চারিদিকে অন্ধকার দেখে – ভালো-মন্দ কিছুই স্থির করিতে পারে না। একে বাবুরামবাবুর মাজা বুদ্ধি নহে তাতে ঠকচাচার করা ব্রহ্মজ্ঞান, এই জন্য ভেবাচেকা লেগে তিনি ভদ্রজংলার মতো ফেল্ফেল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন ও ক্ষণেক কাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন –উপায় কি ! ঠকচাচা বলিলেন –মোশার লেড়কা বুরা নহে, বারদাবাবুই সব বদের জড় –ওনাকে তফাত করিলে লেড়কা ভালো হবে –বাবু সাহেব। হেন্দুর লেড়কা হবে হেন্দু মাফিক পাল-পর্বণ করা মোনাসেব, আর দুনিয়াদারি করিতে গেলে ভালা-বুরা দুই-ই চাই –দুনিয়া সাচ্চা নয় –মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করবো ?
যাহার যেরূপ সংস্কার সেইমতো কথা শুনিলে ঐ কথা বড়ো মনের মতো হয়। হিন্দুয়ানী ও বিষয় রক্ষা সংক্রান্ত কথাতেই লক্ষ্য সিদ্ধ হইবে, তাহা ঠকচাচা ভালো জানিতেন ও ঐ কথাতেই কর্ম কেয়াল হইল। বাবুরামবাবু উক্ত পরামর্শ শুনিয়া তা বটে তো তা বটে তো বলিয়া কহিলেন –যদি তোমার এই মত তো শীঘ্র কর্ম নিকেশ করো –টাকাকড়ি যাহা আবশ্যক হবে আমি তাহা দিব কিন্তু কল-কৌশল তোমার।
রামলালের সংক্রান্ত ঘষ্টি ঘর্ষণা এইরূপ হইতে লাগিল। নানা মুনির নানা মত –কেহ বলে ছেলেটি এ অংশে ভালো –কেহ বলে ও অংশে ভালো নহে –কেহ বলে এই মুখ্য গুণটি না থাকাতে এক কলসী দুগ্ধে এক ফোঁটা গোবর পড়িয়াছে –কেহ বলে ছেলেটি সর্ব বিষয়ে গুণান্বিত, এইরূপ কিছুকাল যায় –দৈবাৎ বাবুরামবাবুর বড়ো কন্যার সাংঘাতিক পীড়া উপস্থিত হইল। পিতা-মাতা কন্যাকে ভারি ভারি বৈদ্য আনাইয়া দেখাইতে লাগিলেন। মতিলাল ভগিনীকে একবারও দেখিতে আইল না। –পরম্পরায় বলিয়া বেড়াইতে লাগিল ভদ্র লোকের ঘরে বিধবা হইয়া থাকা অপেক্ষা শীঘ্র মরা ভাল, এবং ঐ সময়ে তাহার আমোদ আহ্লাদ বাড়িয়া উঠিল –কিন্তু রামলাল আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া ভগিনীর সেবা-শুশ্রূষা করিতে লাগলেন ও ভগিনীর আরোগ্যের জন্য অতিশয় চিন্তান্বিত ও যত্নবান হইলেন। ভগিনী পীড়া হইতে রক্ষা পাইলেন না –মৃত্যুকালীন ছোট ভ্রাতার মস্তকে হাত দিয়া বলিলেন –রাম ! যদি মরে আবার মেয়ে জন্ম হয় তবে যেন তোমার মতো ভাই পাই –তুমি আমার যা করেছ তাহা আমি মুখে বলিতে পারিনে –তোমার যেমন মন তেমনি পরমেশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন –এই বলিয়া ভগিনী প্রাণ ত্যাগ করিলেন।
১৪.
মতিলাল ও তাহার দলবল একজন কবিরাজ লইয়া তামাশা-ফষ্টি করণ, রামলালের সহিত বরদাপ্রসাদবাবুর দেশ ভ্রমণের ফলের কথা, হুগলী হইতে গুমখুনির পরওয়ানা ও বরদাবাবু প্রভৃতির তথায় গমন।
বেলেল্লা ছোঁড়াদের আয়েসে আশ মেটে না, প্রতিদিন তাহাদের নূতন নূতন টাটকা টাটকা রং চাই। বাহিরে কোনো রকম আমোদের সূত্র না পাইলে ঘরে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসে। যদি প্রাচীন খুড়া জেঠা থাকে তবেই বাঁচোয়া, কারণ বেসম্পর্ক ঠাট্টা চলে অথবা জো সো করে তাঁহাদিগের গঙ্গাযাত্রার ফিকিরও হইতে পারে, নতুবা বিষম সংকট –একেবারে চারিদিকে সরিষাফুল দেখে।
মতিলাল ও তাহার সঙ্গীরা নানা রঙ্গের রঙ্গী হইয়া অনেক প্রকার লীলা করিতে লাগিল কিন্তু কোন্ লীলা যে শেষ লীলা হইবে, তাহা বলা বড়ো কঠিন। তাহাদিগের আমোদ-প্রমোদের তৃষ্ণা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। এক এক রকমের আমোদ দুই-একদিন ভালো লাগে –তাহার পরেই বাসী হইয়া পড়ে, আবার অন্য কোনো রং না হইলে ছট্ফটানি উপস্থিত হয়। এইরূপে মতিলাল দলবল লইয়া কাল কাটায়। পালাক্রমে এক একজনকে এক একটা নূতন নূতন আমোদের ফোয়ারা খুলিয়া দিতে হইত, এজন্য একদিন হলধর দোলগোবিন্দের গায়ে লেপমুড়ি দিয়া ভাইলেক সকলকে শিখাইয়া পড়াইয়া ব্রজনাথ কবিরাজের বাটীতে গমন করিল। কবিরাজের বাটীতে ঔষধ প্রস্তুতের ধুম লেগে গিয়াছে – কোনোখানে রসাসিন্ধু মাড়া যাইতেছে –কোনোখানে মধ্যম নারায়ণ তৈলের জ্বাল হইতেছে –কোনোখানে সোনা ভস্ম হইতেছে। কবিরাজ মহাশয় এক হাতে ঔষধের ডিপে ও আর এক হাতে এক বোতল গুড়ুচ্যাদি তৈল লইয়া বাহিরে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে হলধর উপস্থিত হইয়া বলিল, রায় মহাশয় ! অনুগ্রহ করিয়া শীঘ্র আসুন –জমিদারবাবুর বাটিতে একটি বালকের ঘোরতর জ্বরবিকার হইয়াছে বোধ হয় রোগীর এখন তখন হইয়াছে তবে তাহার আয়ু ও আপনার হাতযশ –অনুমান হয় মাতব্বর মাতব্বর ঔষধ পড়িলে আরাম হইলেও হইতে পারে। যদি আপনি ভালো করিতে পারেন যথাযোগ্য পুরস্কার পাইবেন। এই কথা শুনিয়া কবিরাজ তাড়াতাড়ি করিয়া রোগীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যতগুলিন নববাবু নিকটে ছিল তাহারা বলিয়া উঠিল –আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক কবিরাজ মহাশয় ! আমাদিগকে বাঁচাউন –দোলগোবিন্দ দশ-পনের দিন পর্যন্ত জ্বরবিকারে বিছানায় পড়িয়া আছে –দাহ পিপাসা অতিশয় –রাত্রে নিদ্রা নাই –কেবল ছট্ফট করিতেছে, –মহাশয় এক ছিলিম তামাক খাইয়া ভালো করিয়া হাত দেখুন। ব্রজনাথ রায় প্রাচীন, পড়াশুনা বড়ো নাই –আপন ব্যবসায়ে ধামাধরা গোছ –দাদা যা বলেন তাইতেই মত –সুতরাং স্বয়ংসিদ্ধ নহেন, আপনি কেটে ছিঁড়ে কিছুই করিতে পারে না। রায় মহাশয়ের শরীর ক্ষীণ, দন্ত নাই, কথা জড়িয়া পড়ে, কিন্তু মুখের মধ্যে যথেষ্ট গোঁপ – গোঁপও পেকে গিয়াছে কিন্তু স্নেহপ্রযুক্ত কখনই ফেলিতেন না। রোগীর হাত দেখিয়া নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিলেন। হলধর জিজ্ঞাসা করিলেন – কবিরাজ মহাশয় যে চুপ করিয়া থাকিলেন? কবিরাজ উত্তর না দিয়া রোগীর প্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেন, রোগীও এক একবার ফেল্ ফেল্ করিয়া চায় – এক একবার জিহ্বা বাহির করে –এক একবার দন্ত কড়মড় করে –এক একবার শ্বাসের টান দেখায় –এক একবার কবিরাজের গোঁপ ধরিয়া টানে। রায় মহাশয় সরে সরে বসেন, রোগী গড়িয়া গড়িয়া গিয়া তাহার তেলের বোতল লইয়া টানাটানি করে। ছোঁড়ারা জিজ্ঞাসা করিল –রায় মহাশয় ! এ কি ? তিনি বলিলেন –এ পীড়াটি ভয়ানক –বোধ হয় জ্বরবিকার ও উল্বণ হইয়াছে। পূর্বে সংবাদ পাইলে আরাম করিতে পারিতাম, এক্ষণে শিবের অসাধ্য। এই বলিতে বলিতে রোগী তেলের বোতল টানিয়া লইয়া এক গণ্ডুষ তৈল মাখিয়া ফেলিল। কবিরাজ দেখিলেন যে ছ-বুড়ির ফলে অমিত্তি হারাইতে হয়, এজন্য তাড়াতাড়ি বোতল লইয়া ভালো করিয়া ছিপি আঁটিয়া দিয়া উঠিলেন। সকলে বলিল –মহাশয় যান কোথায়? কবিরাজ কহিলেন –উল্বণ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি হইতেছে বোধ হয়, এক্ষণে রোগীকে এ স্থানে রাখা আর কর্তব্য নহে –যাহাতে তাহার পরকাল ভালো হয় এমতো চেষ্টা করা উচিত। রোগী এই কথা শুনিয়া ধড়মড়িয়া উঠিল –কবিরাজ এই দেখিয়া চোঁ চোঁ করিয়া পিট্টান দিলেন –বৈদ্যবাটীর অবতারেরা সকলেই পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়ে যাইতে লাগিল –কবিরাজ কিছুদূর যাইয়া হতভোম্বা হইয়া থ্মকিয়া দাঁড়াইলেন –নববাবুরা কবিরাজকে গলাধাক্কা দিয়া ফেলিয়া ঘাড়ে করিয়া লইয়া হরিবোল শব্দ করিতে করিতে গঙ্গাতীরে আনিল। দোলগোবিন্দ নিকটে আসিয়া কহিল –কবিরাজ মামা ! আমাকে গঙ্গায় পাঠাইতে বিধি দিয়াছিলে –এক্ষণে রোজার ঘারে বোঝা –এসো বাবা ! এক্ষণে তোমাকে অন্তর্জলি করিয়া চিতায় ফেলি। খামখেয়ালী লোকের দণ্ডে দণ্ডে মত ফেরে, আবার কিছুকাল পরে বলিল –আর আমাকে গঙ্গায় পাঠাইবে? যাও বাবা ! ঘরের ছেলে ঘরে যাও, কিন্তু তেলের বোতলটা দিয়ে যাও। এই বলিয়া তেলের বোতল লইয়া সকলে রগরগে করিয়া তেল মাখিয়া ঝুপঝাপ করিয়া গঙ্গায় পড়িল। কবিরাজ এই সকল দেখিয়া শুনিয়া হতজ্ঞান হইলেন ! এক্ষণে পালাইতে পারিলেই বাঁচি, এই ভাবিয়া পা বাড়াইতেছেন –ইতিমধ্যে হলধর সাঁতার দিতে দিতে চিৎকার করিয়া বলিল –ওগো কবরেজ মামা ! বড়ো পিত্ত বৃদ্ধি হইয়াছে, পান দুই রসাসিন্ধু দিতে হবে –পালিও না। বাবা ! যদি পালাও তো মামীকে হাতের লোহা খুলিতে হবে। কবিরাজ ঔষধের ডিপেটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া বাপ বাপ করিতে করিতে বাসায় প্রস্থান করিলেন।
ফাল্গুন মাসে গাছপালা গজিয়ে উঠে ও ফুলের সৌগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বরদাবাবুর বাসাবাটী গঙ্গার ধারে –সম্মুখে একখানি আটচালা ও চতুষ্পার্শে বাগান। বরদাবাবু প্রতিদিন বৈকালে ঐ আটচালায় বসিয়া বায়ু সেবন করিতেন এবং নানা বিষয় ভাবিতেন ও আত্মীয় লোক উপস্থিত থাকিলে তাহাদিগের সহিত আলাপ করিতেন। রামলাল সর্বদা নিকটে থাকিত, তাহার সহিত বরদাবাবুর মনের কথা হইত। রামলাল এই প্রকারে অনেক উপদেশ পায় –সুযোগ পাইলেই কি কি উপায়ে পরমার্থ জ্ঞান ও চিত্তশোধন হইতে পারে তদ্বিষয়ে গুরুকে খুঁচিয়া খুঁচিয়া জিজ্ঞাসা করিত। একদিন রামলাল বলিল –মহাশয় ! আমার দেশ ভ্রমণ করিতে বড়ো ইচ্ছা যায় –বাটীতে থাকিয়া দাদার কুকথা ও ঠকচাচার কুমন্ত্রণা শুনিয়া তাক্ত হইয়াছি কিন্তু মা-বাপের ও ভগিনীর স্নেহপ্রযুক্ত বাড়ি ছেড়ে যাইতে পা বাধুবাধু করে কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারি না।
বরদা। দেশ ভ্রমণে অনেক উপকার। দেশ ভ্রমণ না করিলে লোকের বহুদর্শিত্ব জন্মে না, নানা প্রকার দেশ নানা প্রকার লোক দেখিতে দেখিতে মন দরাজ হয়। ভিন্ন ভিন্ন স্থানের লোকদিগের কি প্রকার রীতি-নীতি, কিরূপ ব্যবহার ও কি কারণে তাহাদিগের ভালো অথবা মন্দ অবস্থা হইয়াছে তাহা খুঁটিয়া অনুসন্ধান করিলে অনেক উপদেশ পাওয়া যায়; আর নানা জাতীয় ব্যক্তির সহিত সহবাস হওয়াতে মনের দ্বেষভাব দূরে যাইয়া সদ্ভাব বাড়িতে থাকে। ঘরে বসিয়া পড়াশুনা করিলে কেতাবী বুদ্ধি হয় –পড়াশুনাও চাই –সৎলোকের সহবাসও চাই –বিষয়কর্মও চাই –নানা প্রকার লোকের সহিত আলাপও চাই। এই কয়েকটি কর্মের দ্বারা বুদ্ধি পরিষ্কার এবং সদ্ভাব বৃদ্ধিশীল হয় কিন্তু ভ্রমণ করিতে গিয়া কি কি বিষয়ে ভালো করিয়া অনুসন্ধান করিতে হইবে তাহা অগ্রে জানা আবশ্যক, তাহা না জানিয়া ভ্রমণ করা বলদের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়ানো মাত্র। আমি এমন কথা বলি না যে এরূপ ভ্রমণ করাতে কিছুমাত্র উপকার নাই –আমার সে অভিপ্রায় নহে, ভ্রমণ করিলে কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই আছে কিন্তু যে ব্যক্তি ভ্রমণকালে কি কি অনুসন্ধান করিতে হয় তাহা না জানে ও সেই সকল অনুসন্ধান করিতে না পারে তাহার ভ্রমণের পরিশ্রম সর্বাংশে সফল হয় না। বাঙালীদিগের মধ্যে অনেকে এ দেশ হইতে ও দেশে গিয়া থাকেন কিন্তু ঐ সকল দেশ সংক্রান্ত আসল কথা জিজ্ঞাসা করিলে কয়জন উত্তমরূপে উত্তর করিতে পারে ? এ দোষটি বড়ো তাহাদিগের নহে –এটি তাহাদিগের শিক্ষার দোষ। দেখাশুনা, অন্বেষণ ও বিবেচনা করিতে না শিখিলে একবারে আকাশ থেকে ভালো বুদ্ধি পাওয়া যায় না। শিশুদিগকে এমতো তরিবত দিতে হইবে যে তাহারা প্রথমে নানা বস্তুর নক্সা দেখিতে পায় –সকল তসবির দেখিতে দেখিতে একটার সহিত আর একটার তুলনা করিবে অর্থাৎ এর হাত আছে, ওর পা নাই, এর মুখ এমন, ওর লেজ নাই, এইরূপ তুলনা করিলে দর্শনশক্তি ও বিবেচনাশক্তি দুয়েরই চালনা হইতে থাকিবে। কিছুকাল পরে এইরূপ তুলনা করা আপনা-আপনি সহজ বোধ হইবে তখন নানা বস্তু কি কারণে পরস্পর ভিন্ন হইয়াছে তাহা বিবেচনা করিতে পারিবে, তাহার পরে কোন্ কোন্ শ্রেণীতে আসিতে পারে তাহা অনায়াসে বোধগম্য হইবে। এই প্রকার উপদেশ দিতে দিতে অনুসন্ধান করণের অভ্যাস ও বিবেচনাশক্তির চালনা হয়। কিন্তু এরূপ শিক্ষা এদেশে প্রায় হয় না এজন্য আমাদিগের বুদ্ধি গোলমেলে ও ভাসা ভাসা হইয়া পড়ে –কোনো প্রস্তাব উপস্থিত হইলে কোন্ কথাটা বা সার ও কোন্ কথাটা বা অসার তাহা শীঘ্র বোধগম্য হয় না ও কিরূপ অনুসন্ধান করিলে প্রস্তাবের বিবেচনা হইয়া ভালো মীমাংসা হইতে পারে তাহাও অনেকের বুদ্ধিতে আসে না অতএব অনেকের ভ্রমণ যে মিথ্যা ভ্রমণ হয় এ কথা অলীক নহে কিন্তু তোমার যে প্রকার শিক্ষা হইয়াছে তাহাতে বোধ হয় ভ্রমণ করিলে তোমার অনেক উপকার দর্শিবে।
রামলাল। যদি বিদেশে যাই তবে যে স্থানে বসতি আছে সেই সেই স্থানে কিছুকাল অবস্থিতি করিতে হইবে কিন্তু আমি কোন্ জাতীয় ও কি প্রকার লোকের সহিত অধিক সহবাস করিব ?
বরদা। এ কথাটি বড়ো সহজ নহে –ঠাওরিয়া উত্তর দিতে হবে। সকল জাতিতেই ভালো-মন্দ লোক আছে–ভালো লোক পাইলেই তাহার সহিত সহবাস করিবে। ভালো লোকের লক্ষণ তুমি বেশ জানো, পুনরায় বলা অনাবশ্যক। ইংরেজদিগের নিকটে থাকিলে লোকে সাহসী হয় –তাহারা সাহসকে পূজা করে –যে ইংরাজ অসাহসিক কর্ম করে সে ভদ্রসমাজে যাইতে পারে না কিন্তু সাহসী হইলে যে সর্বপ্রকারে ধার্মিক হয় এমতো নহে –সাহস সকলের বড়ো আবশ্যক বটে কিন্তু যে সাহস ধর্ম জ্ঞান হইতে উৎপন্ন হয় সেই সাহসই সাহস –তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি ও এখনও বলিতেছি সর্বদা পরমার্থ চর্চা করিবে নতুবা যাহা দেখিবে –যাহা শুনিবে –যাহা শিখিবে তাহাতেই অহংকার বৃদ্ধি হইবে। আর মনুষ্য যাহা দেখে তাহাই করিতে ইচ্ছা হয়, বিশেষতঃ বাঙালীরা সাহেবদিগের সহবাসে অনেক ফাল্তো সাহেবানি শিখিয়া অভিমানে ভরে যায় ও যে-কিছু কর্ম করে তাহা অহংকার হইতেই করিয়া থাকে –এ কথাটিও স্মরণ থাকিলে ক্ষতি নাই।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে বাগানের পশ্চিম দিক থেকে জনকয়েক পিয়াদা হন্ হন্ করিয়া আসিয়া বরদাবাবুকে ঘিরিয়া ফেলিল –বরদাবাবু তাহাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন –তোমরা কে? তাহারা উত্তর করিল –আমরা পুলিশের লোক –আপনার নামে গোমখুনির নালিশ হইয়াছে –আপনাকে হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আদালতে যাইয়া জবাব দিতে হইবে আর আমরা এখানে গোমতল্লাশ করিব। এই কথা শুনিবামাত্রে রামলাল দাঁড়াইয়া উঠিল ও পরওয়ানা পড়িয়া মিথ্যা নালিশ জন্য রাগে কাঁপিতে লাগিল। বরদাবাবু তাহার হাতে ধরিয়া বসাইলেন এবং বলিলেন –ব্যস্ত হইও না, বিষয়টা তলিয়ে দেখা যাউক –পৃথিবীতে নানাপ্রকার উৎপাত ঘটিয়া থাকে। আপদ্ উপস্থিত হইলে কোনোমতে অস্থির হওয়া কর্তব্য নহে–বিপদকালে চঞ্চল হওয়া নির্বুদ্ধির কর্ম, আর আমার উপর যে দোষ হইয়াছে তাহা মনে বেশ জানি যে আমি করি নাই –তবে আমার ভয় কি? কিন্তু আদালতের হুকুম অবশ্য মানিতে হইবে এজন্য সেখানে শীঘ্র হাজির হইব। এক্ষণে পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করুক ও দেখুক যে আমি কাহাকেও লুকাইয়ে রাখি নাই। আদেশ পাইয়া পেয়াদারা চারিদিকে তল্লাশ করিল কিন্তু গুমি পাইল না।
অনন্তর বরদাবাবু নৌকা আনাইয়া হুগলী যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন, ইতিমধ্যে বালীর বেণীবাবু দৈবাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে ও রামলালকে সঙ্গে করিয়া বরদাবাবু হুগলীতে গমন করিলেন। বেণীবাবু ও রামলাল কিঞ্চিৎ চিন্তাযুক্ত হইয়া থাকিলেন কিন্তু বরদাবাবু সহাস্যবদনে নানা-প্রকার কথাবার্তায় তাহদিগকে সুস্থির করিতে লাগিলেন।
১৫.
হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বর্ণন, বারদাবাবু, রামলাল ও বেণীবাবুর সহিত ঠকচাচার সাক্ষাৎ, সাহেবের আগমন ও তজবিজ আরম্ভ এবং বরদাবাবুর খালাস।
হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বড়ো সরগরম। আসামী, ফৈরাদি, সাক্ষী, কয়েদী, উকল ও আমলা সকলেই উপস্থিত আছে, সাহেব কখন আসিবে —সাহেব কখন আসিবে বলিয়া অনেকে টো টো করিয়া ফিরিতেছে, কিন্তু সাহেবের দেখা নাই। বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একটি গাছের নীচে কম্বল পাতিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার নিকট দুই একজন আমলা-ফয়লা আসিয়া ঠারে ঠোরে চুক্তির কথা কহিতেছে, কিন্তু বরদাবাবু তাহাতে ঘাড় পাতেন। তাঁহাকে ভয় দেখাইবার জন্য তাহারা বলিতেছে —সাহেবের হুকুম বড়ো কড়া —কর্মকাজ সকলই আমাদিগের হাতের ভিতর —আমরা যা মনে করি তাহাই করিতে পারি —জবানবন্দি করানো আমাদিগের কর্ম —কলমের মারপেঁচে সকলই উলটে দিতে পারি, কিন্তু রুধির চাই —তদ্বির করতে হয় তো এই সময় করা কর্তব্য, একটা হুকুম হইয়া গেলে আমাদিগের ভালো করা অসাধ্য হইবে। এই সকল কথা শুনিয়া রামলালের এক একবার ভয় হইতেছে কিন্তু বরদাবাবু অকুতোভয়ে বলিতেছেন—আপনাদিগের যাহা কর্তব্য তাহাই করিবেন, আমি কখনই ঘুষ দিব না, আমি নির্দোষ —আমার কিছুই ভয় নাই। আমলারা বিরক্ত হইয়া আপন আপন স্থানে চলিয়া গেল। দুই একজন উকিল বরদাবাবুর নিকটে আসিয়া বলিল —দেখিতেছি মহাশয় অতি ভদ্রলোক —অবশ্য কোনো দায়ে পড়িয়াছেন, কিন্তু মকদ্দমাটি যেন বেতদ্বিরে যায় না —যদি সাক্ষীর যোগাড় করিতে চাহেন এখান হইতে করিয়া দিতে পারি, কিঞ্চিৎ ব্যয় করিলেই সকল সুযোগ হইতে পারে। সাহেব এল এল হইয়াছে, যাহা করিতে হয় এই বেলা করুন। বরদাবাবু উত্তর করিলেন —আপনাদিগের বিস্তর অনুগ্রহ কিন্তু আমাকে বেড়ি পরিতে হয় তাহাও পরিব—তাহাতে আমার ক্লেশ হইবে না —অপমান হইবে বটে, সে অপমান স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি —কিন্তু প্রাণ গেলেও মিথ্যা পথে যাইব না। ঈস্ ! মহাশয় যে সত্য যুগের মানুষ —বোধ হয় রাজা যুধিষ্ঠির মরিয়া জন্মিয়াছেন —না ? এইরূপ ব্যঙ্গ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে তাহারা চলিয়া গেল।
এই প্রকারে দুটো বাজিয়া গেল —সাহেবের দেখা নাই, সকলেই তীর্থের কাকের ন্যায় চাহিয়া আছে। কেহ কেহ একজন আচার্য ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিতেছে—অহে ! গণে বলো দেখি সাহেব আসিবেন কি-না ? অমনি আচার্য বলিতেছেন —একটা ফুলের নাম করো দেখি ? কেহ বলে জবা —আচার্য আঙুলে গনিয়া বলিতেছেন —না, আজ সাহেব আসিবেন না —বাটীতে কর্ম আছে। আচার্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া সকলে দপ্তর বাঁধিতে উদ্যত হইল ও বলিয়া উঠিল —রাম বাঁচলুম। বাসায় গিয়া চদ্দপ্যে হওয়া যাউক। ঠকচাচা ভিড়ের ভিতর বসিয়াছিল, জন চারেক লোক সঙ্গে —বগলে একটা কাগজের পোঁটলা —মুখে কাপড়, —চোখ দুটি মিট মিট করিতেছে। দাড়িটি ঝুলিয়া পরিয়াছে, ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়া যাইতেছে। এমতো সময় তাহার উপর রামলালের নজর পড়িল। রামলাল অমনি বরদা ও বেণীবাবুকে বলিল —দেখুন দেখুন ঠকচাচা এখানে আসিয়াছে —বোধ হয় ও এই মকদ্দমার জড় —না হলে আমাকে দেখিয়া মুখ ফেরায় কেন ? বরদাবাবু মুখ তুলিয়া দেখিয়া উত্তর করিলেন —এ কথাটি আমারও মনে লাগে —আমাদিগের দিকে আড়ে আড়ে চায় আবার চোখের উপর চোখ পরিলে ঘাড় ফিরিয়া অন্যের সহিত কথা কয় —বোধ হয় ঠকচাচাই সরষের ভিতর ভূত। বেণীবাবুর সদা হাস্য বদন —রহস্য দ্বারা অনেক অনুসন্ধান করেন। চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন। পাঁচ-সাত ডাক তো ফাওয়ে গেল —ঠকচাচা বগল থেকে কাগজ খুলিয়া দেখিতেছে —বড়ো ব্যস্ত —শুনেও শুনে না —ঘাড়ও তোলে না। বেণীবাবু তাহার নিকটে আসিয়া হাত ঠেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন —ব্যাপারটা কি? তুমি এখানে কেন? ঠকচাচা কথাই কন না, কাগজ উল্টে-পাল্টে দেখিতেছেন —এদিকে যমলজ্জা উপস্থিত —কিন্তু বেণীবাবুকেও টেলে দিতে হইবে, তাঁহার কথায় উত্তর না দিয়ে বলিল —বাবু ! দরিয়ার বড়ো মৌজ হইয়াছে —এজ তোমরা কি সুরতে যাবে? ভালো, তা যা হউক তুমি এখানে কেন? আরে ঐ বাতই মোকে বার বার পুচ করো কেন? মোর বহুত কাম, থোড়া ঘড়ি বাদ মুই তোমার সাতে বাত করব —আমি জেরা ফিরে এসি, এই বলিয়া ঠকচাচা ধাঁ করিয়া সরিয়া গিয়া একজন লোকের সঙ্গে ফাল্ত কথায় ব্যস্ত হইল।
তিনটা বাজিয়া গেল —সকল লোকে ঘুরে-ফিরে ত্যক্ত হইল, মফস্বলে কর্মের নিকাশ নাই —আদালতে হেঁটে হেঁটে লোকের প্রাণ যায়। কাছারি ভাঙো ভাঙো হইয়াছে এমতো সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ীর গড় গড় শব্দ হইতে লাগিল, অমনি সকলে চিৎকার করিয়া উঠিল —সাহেব আস্ছেন আস্ছেন। আচার্যের মুখ শুকাইয়া গেল —দুই-একজন লোক বলিল —মহাশয়ের চমৎকার গণনা —আচার্য কহিলেন, আজ কিঞ্চিৎ রুক্ষ সামগ্রী খাইয়াছিলাম এই জন্য গণনায় ব্যতিক্রম হইয়াছে। আমলা-ফয়লারা স্ব স্ব স্থানে দাঁড়াইল। সাহেব কাছারি প্রবেশ করিবামাত্রেই সকলে জমি পর্যন্ত ঘাড় হেঁট করিয়া সেলাম বাজাইল। সাহেব শিস্ দিতে দিতে বেঞ্চের উপর বসিলেন —হুক্কাবরদার আলবলা আনিয়া দিল —তিনি মেজের উপর দুই পা তুলিয়া চৌকিতে শুইয়া পড়িয়া আলবলা টনিতেছেন ও লেবগুব ওয়াটার মাখানো হাতরুমাল বাহির করিয়া মুখ পুঁচিতেছেন। নাজিরদপ্তর লোকে ভারিয়া গেল —জবানবন্দিনবিস্ হন্ হন্ করিয়া জবানবন্দি লিখিতেছে কিন্তু যাহার কড়ি তাহার জয় —সেরেস্তাদার জোড়া গায়ে, খিরকিদার পাগড়ি মাথায়, রাশি রাশি মিছিল লইয়া সাহেবের নিকট গায়েনের সুরে পড়িতেছে, সাহেব খবরের কাগজ দেখিতেছেন ও আপনার দরকারি চিঠিও লিখিতেছেন, এক একটা মিছিল পড়া হলেই জিজ্ঞাসা করেন —ওয়েল কেয়া হোয়া ? সেরেস্তাদারের যেমন ইচ্ছা তেমনি করিয়া বুঝান ও সেরেস্তাদারের যে রায় সাহেবেরও সেই রায়।
বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। যেরূপ বিচার হইতেছে তাহা দেখিয়া তাঁহার জ্ঞান হত হইল। জবানবন্দিনবিসের নিকট তাঁহার মকদ্দমার যেরূপ জবানবন্দি হইয়াছে তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই —সেরেস্তাদার যে আনুকূল্য করে তাহাও অসম্ভব, এক্ষণে অনাথার দৈব সখা। এই সকল মনোমধ্যে ভাবিতেছেন ইতিমধ্যে তাঁহার মকদ্দমা ডাক হইল। ঠকচাচা অন্তরে বসিয়াছিল, অমনি বুক ফুলাইয়া সাক্ষীদিগকে সঙ্গে করিয়া সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল। মিছিলের কাগজাত পড়া হইলে সেরেস্তাদার বলিল, খোদাওয়ান্দ ! গোমখুনি সাফ সাবুদ হুয়া —ঠকচাচা অমনি গোঁপে চাড়া দিয়া বরদাবাবুর প্রতি কট্মট্ করিয়া দেখিতে লাগিল, মনে করিতেছে এতক্ষণের পর কর্ম কেয়াল হইল। মিছিল পড়া হইলে অন্যান্য মকদ্দমায় আসামীদের কিছুই জিজ্ঞাসা হয় না —তাহাদিগের প্রায় ছাগল বলিদানের ব্যাপারই হইয়া থাকে, কিন্তু হুকুম দেখার অগ্রে দৈবাৎ বরদাবাবুর উপর সাহেবের দৃষ্টিপাত হওয়াতে তিনি সম্মানপূর্বক মকদ্দমার সমস্ত সরেওয়ার সাহেবকে ইংরেজীতে বুঝাইয়া দিলেন ও বলিলেন যে-ব্যক্তিকে গোমখুনি সাজান হইয়াছে তাহাকে আমি কখনই দেখি নাই ও যৎকালীন হুজুরি পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করে তখন তাহারা ঐ লোককে পায় নাই, সেই সময় বেণীবাবু ও রামলাল ছিলেন, যদ্যপি ইহাদিগের সাক্ষ্য অনুগ্রহ করিয়া লয়েন তবে আমি যাহা এজেহার করিতেছি তাহা প্রমাণ হইবে। বরদাবাবুর ভদ্র চেহারায় ও সৎ বিবেচনার কথাবার্তায় সাহেবের অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা হইল —ঠকচাচা সেরেস্তাদারের সহিত অনেক ইশারা করিতেছে কিন্তু সেরেস্তাদার ভজকট দেখিয়া ভাবিতেছে পাছে টাকা উগরিয়া দিতে হয়, অতএব সাহেবের নিকটে ভয় ত্যাগ করিয়া বলিল —হুজুর এ মকদ্দমা আয়ৌর শুন্নেকা জরুর নেহি। সাহেব সেরেস্তাদারের কথায় পেছিয়া পড়িয়া দাঁত দিয়া হাতের নখ কাটিতেছেন ও ভাবিতেছেন—এই অবসরে বরদাবাবু আপন মকদ্দমার আসল কথা আস্তে আস্তে একটি একটি করিয়া পুর্নবার বুঝাইয়া দিলেন, সাহেব তাহা শুনিবামাত্রেই বেণীবাবুর ও রামলালের সাক্ষ্য লইলেন ও তাহাদিগের জবানবন্দিতে নালিশ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রকাশ হইয়া ডিস্মিস্ হইল। হুকুম না হইতে হইতে ঠকচাচা চোঁ করিয়া এক দৌড় মারিল। বরদাবাবু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সেলাম করিয়া আদালতের বাহিরে আসিলেন। কাছারি বরখাস্ত হইলে যাবতীয় লোক তাঁহাকে প্রশাংসা করিতে লাগিল, তিনি সে সব কথায় কান না দিয়া ও মকদ্দমা জিতের দরুন পুলকিত না হইয়া বেণীবাবু ও রামলালের হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে নৌকায় উঠিলেন।
১৬.
ঠকচাচার বাটীতে ঠকচাচীর নিকট পরিচয় দান ও তাহাদিগের কথোপকথন, তন্মধ্যে বাবুরামবাবুর ডাক ও তাঁহার সহিত বিষয় রক্ষার পরামর্শ।
ঠকচাচার বাড়িটি শহরের প্রান্তভাগে ছিল— দুই পার্শ্বে নানা পুষ্করিণী, সম্মুখে একটি পীরের আস্তানা। বাটীর ভিতরে ধানের গোলা, উঠানে হাঁস, মুরগী দিবারাত্রি চরিয়া বেড়াইত। প্রাতঃকাল না হইতে হইতে নানা প্রকার বদমায়েশ লোক ঐ স্থানে পিল পিল করিয়া আসিত। কর্ম লইবার জন্য ঠকচাচা বহুরূপী হইতেন—কখন নরম—কখন গরম—কখন হাসিতেন—কখন মুখ ভারি করিতেন—কখন ধর্ম দেখাইতেন—কখন বল জানাইতেন। কাজকর্ম শেষ হইলে গোসল ও খানা খাইয়া বিবির নিকট বসিয়া বিদ্রির গুড়গুড়িতে ভড়র ভড়র তাঁমাক টানিতেন। সেই সময়ে তাঁহাদের স্ত্রী-পুরুষের সকল দুঃখ-সুখের কথা হইত। ঠকচাচী পাড়ার মেয়ে মহলে বড়ো মান্যা ছিলেন—তাহাদিগের সংস্কার ছিল যে তিনি তন্ত্রমন্ত্র, গুণকরণ, বশীকরণ, মারণ-উচ্চাটন, তুকতাক, জাদু, ভেল্কি ও নানা প্রকার দৈব বিদ্যা ভালো জানেন, এই কারণ নানারকম স্ত্রীলোক আসিয়া সর্বদাই ফুস-ফাস করিত। যেমন দেবা তেমনী দেবী—ঠকচাচা ও ঠকচাচী দু-জনেই রাজযোটক—স্বামী বুদ্ধির জোরে রোজগার করে, স্ত্রী বিদ্যার বলে উপার্জন করে। যে স্ত্রীলোক স্বয়ং উপার্জন করে তাহার একটু একটু গুমর হয়, তাহার নিকট স্বামীর নির্জলা মান পাওয়া ভার, এই জন্যে ঠকচাচাকে মধ্যে মধ্যে দুই-একবার মুখঝাম্টা খাইতে হইত। ঠকচাচী মোড়ার উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন— তুমি হর রোজ এখানে ওখানে ফিরে বেড়াও —তাতে মোর আর লেড়কাবালার কি ফয়দা? তুমি হর ঘড়ি বলো যে বহুত কাম, এতনা বাতে কি মোদের পেটের জ্বালা যায়। মোর দেল বড়ো চায় যে জরি জর পিনে দশজন ভালো ভালো রেন্ডির বিচে ফিরি, লেকেন রোপেয়া কড়ি কছুই দেখি না, তুমি দেয়ানার মতো ফের—চুপচাপ মেরে হাবিলিতে বসেই রই। ঠকচাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আমি যে কোশেশ করি তা কি বলব, মোর কেত্না ফিকির-কেত্না ফন্দি—কেত্না প্যাঁচ—কেত্না শেস্ত তা জবানিতে বলা যায় না, শিকার দন্তে এল এল হয় আবার পেলিয়ে যায়। আলবত শিকার জল্দি এসবে এই কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে এক জনা বাঁদী আসিয়া বলিল—বাবুরামবাবুর বাটী হইতে একজন লোক ডাকতে আসিয়াছে। ঠকচাচা অমনি স্ত্রীর পানে চেয়ে বলিল—দেখ্চ মোকে বাবু হরঘড়ি ডাকে—মোর বাত না হলে কোনো কাম করে না। মুইও ওক্ত বুঝে হাত মারবো।
বাবুরামবাবুর বৈঠকখানা বসিয়া আছেন। নিকটে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবু, বালীর বেণীবাবু ও বৌবাজারের বেচারামবাবু বসিয়া গল্প করিতেছেন। ঠকচাচা গিয়া পালের গোদা হইয়া বসিলেন।
বাবুরাম। ঠকচাচা ! তুমি এলে ভালো হল—লেটা তো কোনো রকমে মিট্চে না —মকদ্দমা করে করে কেবল পালকে জোলকে জড়িয়ে পড়ছি—এক্ষণে বিষয়-আশয় রক্ষা করবার উপায় কি ?
ঠকচাচা। মরদের কামই দরবার করা —মকদ্দমা জিত হলে আফদ দফা হবে। তুমি একটুতে ডর করো কেন ?
বেচারাম। আ মরি ! কী মন্ত্রণাই দিতেছ? তোমা হতেই বাবুরামের সর্বনাশ হবে তার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই—কেমন বেণী ভায়া কি বলো ?
বেণী। আমার মতে খানকে দু-খানা বিষয় বিক্রয় করিয়া দেনা পরিশোধ করা ও ব্যয় অধিক না হয় এমন বন্দোবস্ত করা আবশ্যক আর মকদ্দমা বুঝে পরিষ্কার করা কর্তব্য কিন্তু আমাদিগের কেবল বাঁশবনে রোদন করা—ঠকচাচা যা বলবেন সেই কথাই কথা।
ঠকচাচা। মুই বুক ঠুকে বলছি যেত্না মামলা মোর মারফত হচ্ছে সে সব বেলকুল ফতে হবে —আফদ বেলকুল মুই কেটিয়ে দিব—মরদ হইলে লড়াই চাই—তাতে ডর কি ?
বেচারাম। ঠকচাচা। তুমি বরাবর বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছ। নৌকাডুবির সময়ে তোমার কুদরৎ দেখা গিয়াছে। বিবাহের সময় তোমার জন্যেই আমাদিগের এত কর্মভোগ, বরদাবাবুর উপর মিথ্যা নালিশ করিয়াও বড়ো বাহাদুরি করিয়াছ আর বাবুরামের যে যে কর্মে হাত দিয়াছ সেই সেই কর্ম বিলক্ষণই প্রতুল হইয়াছে। তোমার খুরে দণ্ডবৎ। তোমার সংক্রান্ত সকল কথা স্মরণ করিলে রাগ উপস্থিত হয়—তোমাকে আর কি বলি ? দূঁর দূঁর !! বেণী ভায়া উঠ এখানে আর বসিতে ইচ্ছা করে না।
১৭.
নাপিত ও নাপ্তিনীর কথোপকথন, বাবুরামবাবুর দ্বিতীয় বিবাহকরণের বিচার ও পরে গমন।
বৃষ্টি খুব এক পশলা হইয়া গিয়াছে —পথঘাট পেঁচ পেঁচ সেঁত সেঁত করিতেছে —আকাশ নীল মেঘে ভরা —মধ্যে মধ্যে হড় মড় হড় মড় শব্দ হইতেছে, বেঙগুলা আশে-পাশে যাঁওকো যাঁওকো করিয়া ডাকিতেছে। দোকানী পসারীরা ঝাপ খুলিয়া তামাক খাইতেছে —বাদলার জন্যে লোকের গমনাগমন প্রায় বন্ধ —কেবল গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া গাইতে গাইতে যাইতেছে ও দাসো কাঁদে ভার লইয়া “হ্যাংগো বিসখা সে যিবে মাথুরা” গানে মত্ত হইয়া চলিয়াছে। বৈদ্যবাটীর বাজারের পশ্চিমে কয়েক ঘর নাপিত বাস করিত। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃষ্টি জন্যে আপন দাওয়াতে বসিয়া আছে। এক একবার আকাশের দিকে দেখিতেছে ও এক একবার গুন গুন করিতেছে, তাহার স্ত্রী কোলের ছেলেটিকে আনিয়া বলিল —ঘর-কন্নার কর্ম কিছু থা পাইনে —হেদে ! ছেলেটাকে একবার কাঁকে কর —এদিকে বাসন মাজা হয়নি, ওদিকে ঘর নিকোনো হয়নি, তার পর রাঁদা বাড়া আছে —আমি একলা মেয়েমানুষ এসব কি করে করব আর কোন্ দিগে যাব ? —আমার কি চাট্টে হাত চাট্টে পা? নাপিত অমনি ক্ষুর ভাড় বগল দাবায় করিয়া উঠিয়া বলিল —এখন ছেলে কোলে করবার সময় নয় —কাল বাবুরামবাবুর বিয়ে, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। নাপ্তিনী চমকিয়া উঠিয়া বলিল —ও মা আমি কোজ্জাব ? বুড়ো ঢোস্কা আবার বে করবে। আহা ! ওমন গিন্নী —এমন সতী লক্ষ্মী —তার গলায় আবার একটা সতীন গেঁতে দেবে —মরণ আর কি ! ও মা পুরুষ জাত সব করতে পারে ! নাপিত আশাবায়ুতে মুগ্ধ হইয়াছে —ও সব কথা না শুনিয়া একটা টোকা মাথায় দিয়া সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়া গেল।
সে দিবসটি ঘোর বাদলে গেল। পর দিবস প্রভাতে সূর্য প্রকাশ হইল —যেমন অন্ধকার ঘরে অগ্নি ঢাকা থাকিয়া হঠাৎ প্রকাশ হইলে আগুনের তেজ অধিক বোধ হয় তেমনি দিনকরের কিরণ প্রখর হইতে লাগিল —গাছপালা সকলই যেন পুনর্জীবন পাইল ও মাঠে-বাগানে পশু-পক্ষীর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। বৈদ্যবাটীর ঘাটে মেলা নৌকা ছিল। বাবুরামবাবু, ঠকচাচা, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারাম ও পাকসিক লোকজন লইয়া নৌকায় উঠিয়াছেন এমতো সময়ে বেণীবাবু ও বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত। ঠকচাচা তাহাদিগকে দেখেও দেখেন না —কেবল চিৎকার করিতেছেন —লা খোল দেও। মাঝিরা তকরার করিতেছে —আরে কর্তা অখন বাটা মরি নি গো —মোরা কি লগি ঠেলে, গুণ টেনে যাতি পারবো ? বাবুরামবাবু উক্ত দুইজন আত্মীয়কে পাইয়া বলিলেন —তোমরা এলে হল ভালো, এসো সকলেই যাওয়া যাউক।
বেচারাম। বাবুরাম ! এ বুড়ো বয়সে বে করতে তোমাকে কে পরামর্শ দিল?
বাবুরাম। বেচারাম দাদা। আমি এমন বুড়ো কি ? তোমার চেয়ে আমি অনেক ছোট, তবে যদি বলো আমার চুল পেকেছে ও দাঁত পড়েছে —তা অনেকের অল্প বয়সেও হইয়া থাকে। সেটা বড় ধর্তব্য নয়। আমাকে এদিক্ ওদিক সব দিগেই দেখিতে হয়। দেখো একটা ছেলে বয়ে গিয়েছে আর একটা পাগল হয়েছে —একটি মেয়ে গত আর একটি প্রায় বিধবা। যদি এ পক্ষে দুই-একটি সন্তান হয় তো বংশটি রক্ষে হবে। আর বড়ো অনুরোধে পড়িয়াছি —আমি বে না করলে কনের বাপের জাত যায় —তাহাদিগের আর ঘর নাই।
বক্রেশ্বর। তা বটে তো —কর্তা কি সকল না বিবেচনা করে এ কর্মে প্রবর্ত হইয়াছেন। উঁহার চেয়ে বুদ্ধি ধরে কে ?
বাঞ্ছারাম। আমরা কুলীন মানুষ —আমাদিগের প্রাণ দিয়ে কুল রক্ষা করিতে হয়, আর যে স্থলে অর্থের অনুরোধ সে স্থলে তো কোনো কথাই নাই।
বেচারাম। তোমার কুলের মুখেও ছাই —আর তোমার অর্থের মুখেও ছাই —জন কতক লোক মিলে একটা ঘরকে উচ্ছন্ন দিলে, দূঁর দূঁর ! কেমন বেণী ভায়া কি বলো ?
বেণী। আমি কি বলব ? আমাদিগের কেবল অরণ্যে রোদন করা। ফলে এ বিষয়টিতে বড়ো দুঃখ হইতেছে। এক স্ত্রী সত্ত্বে অন্য স্ত্রীকে বিবাহ করা ঘোর পাপ। যে ব্যক্তি আপন ধর্ম বজায় রাখিতে চাহে সে এ কর্ম কখনই করিতে পারে না। যদ্যপি ইহার উল্টো কোনো শাস্ত্র থাকে সে শাস্ত্রমতে চলা কখনই কর্তব্য নহে। সে শাস্ত্র যে যথার্থ শাস্ত্র নহে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই, যদ্যপি এমন শাস্ত্রমতে চলা যায় তবে বিবাহের বন্ধন অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়ে। স্ত্রীর মন পুরুষের প্রতি তাদৃশ থাকে না ও পুরুষের মন স্ত্রীর প্রতিও চল-বিচল হয়। এরূপ উৎপাত ঘটিলে সংসার সুধারা মতে চলিতে পারে না, এজন্য শাস্ত্রে বিধি থকলেও সে বিধি অগ্রাহ্য। সে যাহা হউক —বাবুরামবাবুর এমন স্ত্রী সত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করা বড়ো কুকর্ম —আমি এ কথার বাষ্পও জানি না —এখন শুনিলাম।
ঠকচাচা। কেতাবীবাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম-কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নূর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি করব ? কেতাবীবাবু কি জানেন এ শাদীতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুকবে ?
বেচারাম। আরে আবাগের বেটা ভূত ! কেবল টাকাই চিনেছিস্ আর কি অন্য কোনো কথা নাই? তুই বড়ো পাপিষ্ঠ —তোকে আর কি বলবো —দূঁর দূঁর ! বেণী ভায়া চলো আমরা যাই।
ঠকচাচা। বাতচিত পিচু হবে —মোরা আর সবুর করতে পারিনে। হাবলি যেতে হয় তো তোমরা জল্দি যাও।
বেচারাম বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিয়া বলিলেন —এমন বিবাহে আমরা প্রাণ থাকিতেও যাব না কিন্তু যদি ধর্ম থাকে তবে তুই যেন আস্তো ফিরে আসিস্নে। তোর মন্ত্রণায় সর্বনাশ হবে —বাবুরামের স্কন্ধে ভালো ভোগ করছিস্ —আর তোকে কি বলব ? দূঁর দূঁর !!!
১৮.
মতিলালের দলবল সুদ্ধ বুড়ো মজুমদারের সহিত সাক্ষাৎ ও তাহার প্রমুখাৎ বাবুরামবাবুর দ্বিতীয় বিবহের বিবরণ ও তদ্বিষয়ে কবিতা।
সূর্য অস্ত হইতেছে — পশ্চিমদিকে আকাশ নানা রঙ্গে শোভিত। জলে-স্থলে দিবাকরের চঞ্চল আভা মৃদু মৃদু হাসিতেছে, — বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে। এমতো সময়ে বাহিরে যাইতে কার না ইচ্ছা হয়? বৈদ্যবাটীর সরে রাস্তায় কয়েকজন বাবু ভেয়ে হো হো মার মার ধর ধর শব্দে চলিতেছে — কেহ কাহার ঘাড়ের উপর পড়িয়াছে — কেহ কাহার ঝাঁকা ফেলিয়া দিতেছে — কেহ কাহার খাদ্যদ্রব্য কাড়িয়া লইতেছে — কেহ বা লম্বা সুরে গান হাঁকিয়া দিতেছে — কেহ বা কুকুর ডাক ডাকিতেছে। রাস্তার দোধারি লোক পালাই পালাই ত্রাহি করিতেছে — সকলেই ভয়ে জড়সড় ও কেঁচো — মনে করিতেছে আজ বাঁচলে অনেকদিন বাঁচবো। যেমন ঝড় চারিদিগে তোল্পাড় করিয়া হু হু শব্দে বেগে বয়, নব বাবুদিগের দঙ্গল সেইমতো চলিয়াছে। এ গুণ পুরুষেরা কে ? আর কে ! এঁরা সেই সকল পুণ্যশ্লোক — এঁরা মতিলাল, হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ, মানগোবিন্দ ও অন্যান্য দ্বিতীয় নলরাজা ও যুধিষ্ঠির। কোনো দিকে দৃক্পাত নেই — একেবারে ফুল্লারবিন্দ — মত্ততায় মাথা ভারি — গুমরে যেন গড়িয়া পড়েন। সকলে আপন মনেই চলিয়াছেন — এমন সময় গ্রামের বুড়ো মুজমদার, মাথায় শিক্কা ফর্ ফর্ করিয়া উড়িতেছে, একহাতে লাঠি ও আর একহাতে গোটা দুই বেগুন লইয়া ঠকর ঠকর করিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল, অমনি সকলে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া রং জুড়ে দিল। মজুমদার কিছু কানে খাটো — তাহারা জিজ্ঞাসা করিল — আরে কও তোমার স্ত্রী কেমন আছেন ? মজুমদার উত্তর করিলেন — পুড়িয়ে খেতে হবে — অমনি তাহারা হাহা হাহা হো হো, লিক্ লিক্ ফিক্ ফিক্ হাসি ও গররায় ছেয়ে ফেলিল। মজুমদার মোহাড়া কাটাইয়া চম্পট দিতে চান কিন্তু তাঁহার ছাড়ান নাই। নব বাবুরা তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া গঙ্গার ঘাটের নিকট বসাইল। এক ছিলিম গুড়ুক খাওয়াইয়া বলিল — মজুমদার। কর্তার বের নাকালটা বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি — তুমি কবি — তোমার মুখের কথা বড়ো মিষ্টি লাগে, না বল্লে ছেড়ে দিব না এবং তোমার স্ত্রীর কাছে এক্ষুণি গিয়া বলিব তোমার অপঘাত মৃত্যু হইয়াছে। মজুমদার দেখিল বিষম প্রমাদ, না বলিলে ছাড় নাই — লাচারে লাঠি ও বেগুন রাখিয়া কথা আরম্ভ করিল।
দুঃখের কথা আর কি বল্ব? কর্তার সঙ্গে গিয়ে ভালো আক্কেল পাইয়াছি। সন্ধ্যা হয় হয় এমতো সময়ে বলাগড়ের ঘাটে নৌকা লাগালো। কতোকগুলিন স্ত্রীলোক জল আনিতে আসিয়াছিল, কর্তাকে দেখিয়া তাহারা একটু ঘোমটা টানিয়া দিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো — আ মরি ! কী চমৎকার বর ! যার কপালে ইনি পড়বেন সে একেবারে এঁকে চাঁপা ফুল করে খোঁপাতে রাখবে। তাহাদিগরে মধ্যে একজন বলিল — বুড়ো হউক ছুড়ো হউক তবু একে মেয়েমানুষটা চক্ষে দেখতে পাবে তো? সেও তো অনেক ভালো। আমার যেমন পোড়া কপাল এমন যেনো আর কারো হয় না, ছয় বৎসরের সময় বে হয় কিন্তু স্বামী কেমন চক্ষে দেখনু না — শুনেছি তাঁর পঞ্চাশ-ষাটটি বিয়ে, বয়সে আশি বছরের উপর — থুরথুরে বুড়ো কিন্তু টাকা পেলে বে করতে আলেন না। বড়ো অধর্ম না হলে আর মেয়ে মানুষের কুলীনের ঘরে জন্ম হয় না। আর একজন বলিল — ওগো জল তোলা হয়ে থাকে তো চলে চল — ঘাটে এসে আর বাক্চাতুরীতে কাজ নাই — তোর তবু স্বামী বেঁচে আছে, আমার যার সঙ্গে বে হয় তাঁর তখন অন্তর্জলী হচ্ছিল। কুলীন বামুনদের কি ধর্ম আছে না কর্ম আছে — এ সব কথা বললে কি হবে? পেটের কথা পেটে রাখাই ভালো। মেয়েগুলার কথোপকথন শুনে আমার কিছু দুঃখ উপস্থিত হইল ও যাওন কালীন বেণীবাবুর কথা স্মরণ হইতে লাগিল। পরে বলাগড়ে উঠিয়া সাওয়ারির অনেক চেষ্টা করা গেল কিন্তু একজন কাহারও পাওয়া গেল না। লগ্ন ভ্রষ্ট হয় এজন্য সকলকে চলিয়া যাইতে হইল। কাদাতে হেঁকোচ হোঁকোচ করিয়া কন্যাকর্তার বাটিতে উপস্থিত হওয়া গেল। দঁকে পড়িয়া আমাদিগের কর্তার যে বেশ হইয়াছিল তাহা কি বল্ব? একটা এঁড়ে গোরুর উপর বসালেই সাক্ষাৎ মহাদেব হইতেন আর ঠকচাচা ও বক্রেশ্বরকে নন্দী ভৃঙ্গীর ন্যায় দেখাইত। শুনিয়াছিলাম যে দানসামগ্রী অনেক দিবে, দালানে উঠিয়া দেখিলাম সে গুড়ে বালি পড়িয়াছে। আশা ভগ্ন হওয়াতে ঠকচাচা এদিক ওদিক চান — গুম্রে গুম্র বেড়ান — আমি মুচকে মুচকে হাসি ও এক একবার ভাবি এস্থলে সাটে হেঁ হুঁ দেওয়া ভালো। বর স্ত্রীআচার করতে গেল, ছোট-বড়ো অনেক মেয়ে ঝুনুর ঝুনুর করিয়া চারিদিকে আসিয়া বর দেখিয়া আঁতকে পড়িল, যখন চারি চক্ষে চাওয়াচাওয়ি হয় তখন কর্তাকে চশমা নাকে দিতে হইয়াছিল — মেয়েগুলা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া ঠাট্টা জুড়ে দিল — কর্তা ক্ষেপে উঠে ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া ডাকেন — ঠকচাচা বাটীর ভিতর দৌড়ে যাইতে উদ্যত হন — অমনি কন্যাকর্তার লোকেরা তাহাকে আচ্ছা করে আল্গা আল্গা রকমে সেখানে শুইয়ে দেয় — বাঞ্ছারামবাবু তেরিয়া হইয়া উঠেন, তাঁরও উত্তম মাধ্যম হয়, বক্রেশ্বরও অর্ধচন্দ্রের দাপটে গলাফুলা পায়রা হন। এই সকল গোলযোগ দেখিয়া আমি বরযাত্রীদিগকে ছাড়িয়া কন্যাযাত্রীদিগের পালে মিশিয়া গেলুম, তারপরে কে কোথায় গেল তাহা কিছুই বলিতে পারি না কিন্তু ঠকচাচাকে ডুলি করিয়া আসিতে হইয়াছিল। — কথায় আছে লোভে পাপ — পাপে মৃত্যু। এক্ষণে যে কবিতা করিয়াছি তাহা শুন।—
ঠকচাচা মহাশয়, সদা করি মহাশয়,
বাবুরামে দেন কানে মন্ত্র।
বাবুরাম অঘা অতি, হইয়াছে ভীমরথী,
ঠকবাক্য শ্রুতি স্মৃতি তন্ত্র ॥
ধনাশায়ে সদোন্মত্ত, ধর্মাধর্ম নাহি তত্ত্ব
অর্থ কিসে থাকিবে বাড়িবে।
সদা এই আন্দোলন, সৎকর্মে নাহি মন,
মন হইল করিবেন বিয়ে॥
সবে বলে ছিছি ছিছি, এ বয়সে মিছামিছি,
নালা কেটে কেন আনো জল !
জাজ্বল্য যে পরিবার, পৌত্র হইবে আবার,
অভাব তোমার কিসে বল ॥
কোনো কথা নাহি শোনে, স্থির করে মনে মনে,
ভারি দাঁও মারিব বিয়েতে।
করিলেন নৌকা ভাড়া, চলিলেন খাড়া খাড়া,
স্বজন ও লোকজন সাতে ॥
বেণীবাবু মানা করে, কে তাঁহার কথা ধরে,
ঘরে গিয়া ভাত তিনি খান।
বেচারাম সদা চটা, ঠকে বলে ঠেঁটা বেটা,
দূঁর দূঁর করে তিনি যান ॥
গণ্ডগ্রাম বলাগোড়, রামা সবে পেতে গড়,
ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে করে ঠাট্টা।
বাবুরাম ছট্ ফট্ দেখে বড়ো সুসংকট।
ভয় পান পাছে লাগে বাঁট্টা ॥
দর্পণ সম্মুখে লয়ে, মুখ দেখে ভয়ে ভয়ে,
রামা সবে কেন দেয় বাধা।
চুলগুলি ঘন বাঁধে হাত দিয়া ঠক কাঁধে
হৃষ্ট মনে চলয়ে তাগাদা ॥
পিছলেতে লণ্ডভণ্ড, গড়ায় কেন কুষ্মাণ্ড,
উৎসাহে আহ্লাদে মন ভরা।
পরিজন লোকজন, দেখে শমনভবন,
কাদা চেহলায় আদমরা॥
যেমন ধর পৌঁছিল, হাড়কাটে গলা দিল,
ঠক আশা আসা হল সার।
কোথায় বা রুপা সোনা, সোনা মাত্র হল শোনা,
কোথায় বা মুক্তার হার॥
ঠক করে তেরি মেরি, দ্বন্দ্বোজ বাধায় ভারি,
মনে রাগ মনে সবে মারে।
স্ত্রীআচারে বর যায়, ঝুনুঝুনু রামা ধায়,
বর দেখে হাঁক থুতে সারে ॥
ছি ছি ছি, এই ঢোস্কা কি ঐ মেয়েটির বর লো।
পেটা লেও ফোগ্লারাম, টিক আহ্লাদে বুড়ো গো।
চুলিগুলি কিবা কালো, মুখখানি তোবড়া ভালো নাকেতে
চশমা দিয়া, সাজলো জুজুবুড়ো গো।
মেয়ে সোনার লতা, হায় কি হল বিধাতা, কুলীনের
কর্মকাণ্ড, ধিক্ ধিক্ ধিক লো।
বুড়ো বর জ্বরজ্বর, থর্ থর্ কাঁপিছে।
চক্ষু কট্ মট্ সট্ মট্ করিছে।
নাহি কথা ঊর্ধ্ব মাথা পেয়ে ব্যথা ডাকিছে।
ঠকচাচা এ কি ঢাঁচা মোকে বাঁচা বলিছে।
লম্ফঝম্ফ ভূমিকম্প ঠক লম্ফ দিতেছে।
দরোয়ান হান্ হান্ সান্ সান্ ধরিছে।
ভূমে পড়ি গড়াগড়ি গোঁপ দাড়ি ঢাকিছে।
নাথি কিল যেন শিল পিল্পিল্ পড়িছে।
এই পর্ব দেখে সর্ব হয়ে খর্ব ভাগিছে।
নমস্কার এ ব্যাপার বাঁচা ভার হইছে।
মজুমদার দেখে দ্বার আত্মসার করিছে।
মার্ মার্ ঘের্ ঘার্ ধর্ ধর্ বাড়িছে।
১৯.
বেণীবাবুর আলয়ে বেচারামবাবুর গমন, বাবু রামবাবুর পীড়া ও গঙ্গাযাত্রা, বরদাবাবুর সহিত কথোপকথনান্তর তাঁহার মৃত্যু।
প্রাতঃকালে বেড়িয়া আসিয়া বেণীবাবু আপন বাগানের আটচালায় বসিয়া আছেন, এদিক ওদিক দেখিতে দেখিতে রাম প্রসাদী পদ ধরিয়াছেন —”এবার বাজি ভোর হল” —পশ্চিম দিকে তরুলতার মেরাপ ছিল তাহার মধ্যে থেকে একটা শব্দ হইতে লাগিল —বেণীভায়া বেণীভায়া —বাজি ভোরই হল বটে। বেণীবাবু চমকিয়া উঠিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারামবাবু বড়ো ত্রস্ত আসিতেছেন, অগ্রবর্তী হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন —বেচারাম দাদা! ব্যাপারটা কি ? বেচারামবাবু বলিলেন —চাদরখানা কাঁধে দেও, শীঘ্র আইস— বাবুরামের বড় ব্যারাম—একবার দেখা আবশ্যক। বেণীবাবু ও বেচারাম শীঘ্র বৈদ্যবাটীতে আসিয়া দেখেন যে বাবুরামের ভারি জ্বর বিকার —দাহ পিপাসা আত্যন্তিক –বিছানায় ছট্ ফট্ করিতেছেন –সম্মুখে শসা কাটা ও গোলাপের নেকড়া কিন্তু উকি উদ্গার মুহুর্মুহু হইতেছে। গ্রামের যাবতীয় লোক চারিদিগে ভেঙে পড়িয়াছে, পীড়ার কথা লইয়া সকলে গোল করিতেছে। কেহ বলে –আমাদের শাকমাছখেকো নাড়ি –জোঁক, জোলাপ, বেলেস্তারা হিতে বিপরীত হইতে পারে, আমাদিগের পক্ষে বৈদ্যের চিকিৎসাই ভালো, তাতে যদি উপশম না হয় তবে তৎকালে ডাক্তার ডাকা যাইবে। কেহ কেহ বলে হাকিমী মত বড়ো ভালো, তাহারা রোগীকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া আরাম করে ও তাহাদের ঔষধপত্র সকল মোহনভোগের মতো খেতে লাগে। কেহ কেহ বলে যা বলো কহ এসব ব্যারাম ডাক্তারে যেন মন্ত্রের চোটে আরাম করে –ডাক্তারি চিকিৎসা না হলে বিশেষ হওয়া সুকঠিন। রোগী এক একবার জল দাও জল দাও বলিতেছে, ব্রজনাথ রায় কবিরাজ নিকটে বসিয়া কহিতেছেন, দারুণ স্যন্নিপাত –মুহুর্মুহু জল দেওয়া ভালো নহে, বিল্বপত্রের রস ছেঁচিয়া একটু একটু দিতে হইবেক, আমরা তো উহার শত্রু নয় যে এ সময়ে যত জল চাবেন তত দিব। রোগীর নিকটে এইরূপ গোলযোগ হইতেছে, পার্শ্বের ঘর গ্রামের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতে ভরিয়া গিয়াছে তাহাদিগের মত যে শিবস্বস্ত্যয়ন, সূর্য অর্ঘ, কালিঘাটে লক্ষ জবা দেওয়া ইত্যাদি দৈবক্রিয়া করা সর্বাগ্রে কর্তব্য। বেণীবাবু দাঁড়িয়ে সকল শুনিতেছেন কিন্তু কে কাহাকে বলে ও কে কাহার কথাই বা শুনে –নানা মুনির নানা মত, সকলেরই আপনার কথা ধ্রুবজ্ঞান, তিনি দুই-একবার আপন বক্তব্য প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিলেন –কিন্তু মঙ্গলাচরণ হইতে না হইতে একেবারে তাঁহার কথা ফেঁসে গেল। কোনো রকমে থা না পাইয়া বেচারামবাবুকে লইয়া বাহির বাটীতে আইলেন ইতিমধ্যে ঠকচাচা নেংচে নেংচে আসিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে পৌঁছিল। বাবুরামের পীড়ার জন্য ঠকচাচা উদ্বিগ্ন –সর্বদাই মনে করিতেছে সব দাঁও বুঝি ফস্কে গেল। তাহাকে দেখিয়া বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন –ঠকচাচা ! পায়ে কি ব্যথা হইয়াছে ? অমনি বেচারাম বলিয়া উঠিলেন –ভায়া ! তুমি কি বলাগড়ের ব্যাপার শুন নাই –ঐ বেদনা উহার কুমন্ত্রণার শাস্তি, আমি নৌকায় যাহা বলিয়াছিলাম তাহা কি ভুলিয়া গেলে ? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা পেঁচ কাটাইবার চেষ্টা করিল। বেণীবাবু তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন –সে যাহা হউক, এক্ষণে কর্তার ব্যারামের জন্য কি তদ্বির হইতেছে ? বাটীর ভিতর তো ভারি গোল। ঠকচাচা বলিল –বোখার শুরু হলে এক্রামদ্দি হাকিমকে মুই সাতে করে এনি –তেনারি বহুত জোলাব ও দাওয়াই দিয়ে বোখারকে দফা করে খেচ্রি খেলান, লেখেন ঐ রোজেতেই বোখার আবার পেল্টে এসে, সে নাগাদ ব্রজনাথ কবিরাজ দেখছে, বেরাম রোজ জেয়াদা মালুম হচ্ছে –মুই বি ভালো বুরা কুচ ঠেওরে উঠতে পারি না। বেণীবাবু বলিলেন –ঠকচাচা রাগ করো না –এ সম্বাদটি আমাদিগের কাছে পাঠানো কর্তব্য ছিল –ভালো, যাহা হইয়াছে তাহার চারা নাই এক্ষণে একজন বিচক্ষণ ইংরেজ ডাক্তার শীঘ্র আনা আবশ্যক। এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে রামলাল ও বরদাপ্রসাদবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাত্রি জাগরণ, সেবা করণের পরিশ্রম ও ব্যাকুলতার জন্য রামলালের মুখ ম্লান হইয়াছে –পিতাকে কি প্রকারে ভালো রাখিবেন ও আরাম করিবেন এই তাঁহার অহরহ চিন্তা। বেণীবাবুকে দেখিয়া বলিলেন –মহশয় ! ঘোর বিপদে পড়িয়াছি, বাটীতে বড়ো গোল কিন্তু সৎপরামর্শ কাহার নিকট পাওয়া যায় না। বরদাবাবু প্রাতে ও বৈকালে আসিয়া তত্ত্ব লয়েন কিন্তু তিনি যাহা বলেন সে অনুসারে আমাকে সকলে চলিতে দেন না –আপনি আসিয়াছেন ভালো হইয়াছে এক্ষণে যাহা কর্তব্য তাহা করুন। বেচারামবাবু বরদাবাবুর প্রতি কিঞ্চিৎকাল নিরীক্ষণ করিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন –বরদাবাবু। তোমার এত গুণ না হলে সকলে তোমাকে কেন পূজা করিবে। এই ঠকচাচা বাবুরামকে মন্ত্রণা দিয়া তোমার নামে গোমখুনি নালিশ করায় ও বাবুরাম ঘটিত অকারণে তোমার উপর নানা প্রকার জুলুম ও বদিয়ত হইয়াছে কিন্তু ঠকচাচা পীড়িত হইলে তুমি তাহাকে আপনি ঔষধ দিয়া ও দেখিয়া শুনিয়া আরাম করিয়াছ, এক্ষণেও বাবুরাম পীড়িত হওয়াতে সৎপরামর্শ দিতে ও তত্ত্ব লইতে কসুর করিতেছ না –কেহ যদি কাহাকে একটা কটুবাক্য কহে তবে তাহাদিগের মধ্যে একেবারে চটাচটি হয়ে শত্রুতা জন্মে, হাজার ঘাট মানামানি হলেও আপন মনভার যায় না কিন্তু তুমি ঘোর অপমানিত ও অপকৃত হইলেও আপন অপমান ও অপকার সহজে ভুলে যাও –অন্যের প্রতি তোমার মনে ভ্রাতৃভাব ব্যতিরেকে আর অন্য কোনো ভাব উদয় হয় না –বারদাবাবু। অনেকে ধর্ম ধর্ম বলে বটে কিন্তু যেমন তোমার ধর্ম এমন ধর্ম আর কাহারো দেখিতে পাই না —মনুষ্য পামর তোমার গুণের বিচার কি করবে কিন্তু যদি দিনরাত সত্য হয় তবে এ গুণের বিচার উপরে হইবে। বেচারামবাবুর কথা শুনিয়া বরদাবাবু কুণ্ঠিত হইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া থাকিলেন পরে বিনয়পূর্বক বলিলেন –মহাশয়। আমাকে এত বলিবেন না –আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি –আমার জ্ঞান বা কি আর ধর্মই বা কি। বেণীবাবু বলিলেন –মহশয়েরা ক্ষান্ত হউন এ সকল কথা পরে হইবেক এক্ষণে কর্তার পীড়ার জন্য কি বিধি তাহা বলুন। বরদাবাবু কহিলেন –আপনাদিগের মত হইলে আমি কলিকাতায় যাইয়া বৈকাল নাগাদ ডাক্তার আনিতে পারি, আমার বিবেচনায় ব্রজনাথ রায়ের ভরসায় থাকা আর কর্তব্য নহে। প্রেমনারায়ণ মজুমদার নিকটে দাঁড়াইয়া ছিলেন –তিনি বলিলেন –ডাক্তারেরা নাড়ির বিষয় ভালো বুঝে না,তাহারা মানুষকে ঘরে মারে, আর কবিরাজকে একেবারে বিদায় করা উচিত নহে বরং একটা রোগ ডাক্তার দেখুক –একটা রোগ কবিরাজ দেখুক। বেণীবাবু বলিলেন –সে বিবেচনা পরে হইবে এক্ষণে বরদাবাবু ডাক্তারকে আনতে যাউন। বরদাবাবু স্নান আহার না করিয়া কলিকাতায় গমন করিলেন, সকলে বলিল বেলাটা অনেক হইয়াছে মহাশয় এক মুটা খেয়ে যাউন –তিনি উত্তর করিলেন –তাহা হইলে বিলম্ব হইবে, সকল কর্ম ভণ্ডুল হইতে পারে।
বাবুরামবাবু বিছানায় পড়িয়া মতি কোথা মতি কোথা বলিয়া অনবরত জিজ্ঞাসা করিতেছেন কিন্তু মতিলালের চুলের টিকি দেখা ভার, তিনি আপন দলবল লইয়া বাগানে বনভোজনে মত্ত আছেন, বাপের পীড়ার সন্বাদ শুনেও শুনেন না। বেণীবাবু এই ব্যবহার দেখিয়া বাগানে তাহার নিকট লোক পাঠাইলেন কিন্তু মতিলাল মিছামছি বলিয়া পাঠাইলেন যে, আমার অতিশয় মাথা ধরিয়াছে কিছুকাল পরে বাটীতে যাইব।
দুই প্রহর দুইটার সময় বাবুরামবাবুর জ্বর বিচ্ছেদকালীন নাড়ি ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। কবিরাজ হাত দেখিয়া বলিল –কর্তাকে স্থানান্তর করা কর্তব্য –উনি প্রবীণ, প্রাচীন ও মহামান্য, অবশ্য যাহাতে উঁহার পরকাল ভালো হয়, তাহা করা উচিত। এই কথা শুনিবামাত্রে পরিবার সকলে রোদন করিতে লাগিল ও আত্মীয় এবং গ্রামবাসীরা সকলে ধরাধরি করিয়া বাবুরামবাবুকে বাটীর দালানে আনিল। এমতো সময়ে বরদাবাবু ডাক্তার সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইলেন, ডাক্তার নাড়ি দেখিয়া বলিলেন –তোমরা শেষাবস্থায় আমাকে ডাকিয়াছ –রোগীকে গঙ্গাতীরে পাঠাবার অগ্রে ডাক্তারকে ডাকিলে ডাক্তার কি করিতে পারে? এই বলিয়া ডাক্তার গমন করিলেন। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় লোক বাবুরামবাবুকে ঘিরিয়া একে একে জিজ্ঞাস করিতে লাগিলে –মহাশয় আমাকে চিনিতে পারেন –আমিকে বলুন দেখি ? বেণীবাবু বলিলেন –রোগীকে আপনারা এত ক্লেশ দিবেন না –এরূপ জিজ্ঞাসাতে কি ফল ? স্বস্ত্যয়নী ব্রাহ্মণেরা স্বস্ত্যয়ন সাঙ্গ করিয়া আশীর্বাদী ফুল লইয়া আসিয়া দেখেন যে তাঁহাদিগের দৈব ক্রিয়ায় কিছুমাত্র ফল হইল না। বাবুরামবাবুর শ্বাসবৃদ্ধি দেখিয়া সকলে তাঁহাকে বৈদ্যবাটীর ঘাটে লইয়া গেল, তথায় আসিয়া গঙ্গাজল পানে ও স্নিগ্ধ বায়ু সেবনে তাঁহার কিঞ্চিৎ চৈতন্য হইল। লোকের ভিড় ক্রমে ক্রমে কিঞ্চিৎ কমিয়া গেল –রামলাল পিতার নিকট বসিয়া আছেন –বরদাপ্রসাদবাবু বাবুরামবাবুর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন ও কিয়ৎকাল পরে আস্তে আস্তে বলিলেন মহাশয় ! এক্ষণে একবার মনের সহিত পরাৎপর পরমেশ্বরকে ধ্যান করুন –তাঁহার কৃপা বিনা আমাদের গতি নাই। এ কথা শুনিবামাত্রেই বাবুরামবাবু বরদাপ্রসাদবাবুর প্রতি দুই-তিন লহমা চাহিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। রামলাল চোখের জল মুছিয়া দিয়া দুই-এক কুশী দুগ্ধ দিলেন –কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া বাবুরামবাবু মৃদু স্বরে বলিলেন –ভাই বরদাপ্রসাদ ! আমি এক্ষণে জানলুম যে তোমার বাড়া জগতে আমার আর বন্ধু নাই –আমি লোকের কুমন্ত্রণায় ভারি ভারি কুকর্ম করিয়াছি, সেই সকল আমার এক একবার স্মরণ হয় আর প্রাণটা যেন আগুনে জ্বলিয়া উঠে –আমি ঘোর নারকী –আমি কি জবাব দিব ? আর তুমি কি আমাকে ক্ষমা করিবে ? এই বলিয়া বরদাবাবুর হাত ধরিয়া বাবুরামবাবু আপন চক্ষু মুদিত করিলেন। নিকটে বন্ধু-বান্ধবেরা ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিতে লাগিল ও বাবুরামবাবুর সজ্ঞানে লোকান্তর হইল।
২০.
মতিলালের যুক্তি, বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধের ঘোঁট, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার অধ্যক্ষতা, শ্রাদ্ধে পণ্ডিতদের বাদানুবাদ ও গোলযোগ।
পিতার মৃত্যু হইলে মতিলাল বাটীতে গদিয়ান হইয়া বসিল। সঙ্গী সকল এক লহমাও তাহার সঙ্গছাড়া নয়। এখন চার পো বুক হইল –মনে করিতে লাগিল, এতদিনের পর ধুমধাম দেদার রকমে চলিবে। বাপের জন্য মতিলালের কিঞ্চিৎ শোক উপস্থিত হইল –সঙ্গীরা বলিল, বড়োবাবু! ভাবো কেন ? বাপ-মা লইয়া চিরকাল কে ঘর করিয়া থাকে ? এখন তো তুমি রাজেশ্বর হইলে। মুঢ়ের শোক নামমাত্র –যে ব্যক্তি পরমপদার্থ পিতামাতাকে কখন সুখ দেয় নাই –নানাপ্রকার যন্ত্রণা দিত, তাহার মনে পিতার শোক কিরূপে লাগিবে? যদি লাগে তবে তাহা ছায়ার ন্যায় ক্ষণেক স্থায়ী, তাহাতে তাহার পিতাকে কখন ভক্তিপূর্বক স্মরণ করা হয় না ও স্মরণার্থে কোনো কর্ম করিতে মনও চায় না। মতিলালের বাপের শোক শীঘ্র ঢাকা পড়িয়া বিষয়-আশয় কি আছে কি না আছে তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রবল হইল। সঙ্গীদিগের বুদ্ধিতে ঘর-দ্বার সিন্দুক-পেটারার ডবল্ ডবল্ তালা দিয়া স্থির হইয়া বসিল। সর্বদা মনের মধ্যে এই ভয়, পাছে মায়ের কি বিমাতার কি ভাইয়ের বা ভগনীর হাতে কোনো রকমে টাকাকড়ি পড়ে তাহা হইলে সে টাকা একেবারে গাপ হইবে। সঙ্গীরা সর্বদা বলে –বড়োবাবু ! টাকা বড়ো চিজ –টাকাতে বাপকেও বিশ্বাস নাই। ছোটবাবু ধর্মের ছালা বেঁধে সত্য সত্য বলিয়ে বেড়ান বটে কিন্তু পতনে পেলে তাঁহার গুরুও কাহাকে রেয়াত করেন না –ও সকল ভণ্ডামী আমরা অনেক দেখিয়াছি –সে যাহা হউক, বরদাবাবুটা অবশ্য কোনো ভেল্কি জানে –বোধ হয় ওটা কামাখ্যাতে দিনকতক ছিল, তা না হলে কর্তার মৃত্যুকালে তাঁহার এত পেশ কি প্রকারে হইল।
দুই-এক দিবস পরেই মতিলাল আত্মীয়-কুটুম্বদিগের নিকট লৌকিকতা রাখিতে যাইতে আরম্ভ করিল। যে সকল লোক দলঘাঁটা, সাল্কে মধ্যস্থ করিতে সর্বদা উদ্যত হয়, জিলাপির ফেরে চলে, তাহারা ঘুরিয়া ফিরিয়া নানা কথা বলে –সে সকল কথা আসমানে উড়ে উড়ে বেড়ায়, জমিতে ছোঁয় ছোঁয় করিয়া ছোঁয় না সুতরাং উল্টে-পাল্টে লইলে তাহার দুই রকম অর্থ হইতে পারে। কেহ কেহ বলে কর্তা সরেশ মানুষ ছিলেন –এমন সকল ছেলে রেখে-ঢেকে যাওয়া বড়ো পূণ্য না হইলে হয় না –তিনি যেমন লোক তেমনি তাঁহার আশ্চর্য মৃত্যুও হইয়াছে বাবু। এতদিন তুমি পর্বতের আড়ালে ছিলে এখন বুঝে-সুঝে চলতে হবে –সংসারটি ঘাড়ে পড়িল –ক্রিয়া-কলাপ আছে –বাপ পিতামহের নাম বজায় রাখিতে হইবে, এ সওয়ায় দায়-দফা আছে। আপনার বিষয় বুঝে শ্রাদ্ধ করিবে, দশ জনার কথা শুনিয়া নেচে উঠবার আবশ্যক নাই। নিজে রামচন্দ্র বালির পিণ্ড দিয়াছিলেন, এ বিষয় আক্ষেপ করা বৃথা, কিন্তু নিতান্ত কিছু না করা সেও তো বড়ো ভালো নয়। বাবু জানো তো কর্তার ঢাক্টাপানা নামটা –তাঁহার নামে আজো বাঘে গোরুতে জল খায়। তাহাতে কি সুদ্ধ তিলকাঞ্চনি রকমে চল্বে ?-গেরেপ্তার হয়েও লোকের মুখ থেকে তর্তে হবে। মতিলাল এ সকল কথায় মারপেঁচ কিছুই বুঝিতে পারে না। আত্মীয়রা আত্মীয়তাপূর্বক দরদ প্রকাশ করে কিন্তু যাহাতে একটা ধুমধাম বেধে যায় ও তাহারা কর্তৃত্ব ফলিয়ে বেড়াতে পারে তাহাই তাহাদিগের মানস অথচ স্পষ্টরূপে জিজ্ঞাসা করিলে এঁ ওঁ করিয়া সেরে দেয়। কেহ বলে ছয়টি রুপার ষোড়শ না করিলে ভালো হয় না –কেহ বলে একটা দান সাগর না করিলে মান থাকা ভার –কেহ বলে একটা দম্পতি বরণ না করিলে সামান্য শ্রাদ্ধ হবে –কেহ বলে কতকগুলিন অধ্যাপক নিমন্ত্রণ ও কাঙালী বিদায় না করিলে মহা অপযশ হইবে। এইরূপে ভারি গোলযোগ হইতে লাগিল –কে বা বিধি চায় ? কে বা তর্ক করিতে বলে ? –কে বা সিদ্ধান্ত শুনে ?– সকলেই গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল –সকলেই স্ব স্ব প্রধান, সকলেরই আপনার কথা পাঁচ কাহন।
তিনদিন পরে বেণীবাবু, বেচারামবাবু, বাঞ্ছারামবাবু ও বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মতিলালের নিকট ঠকচাচা মণিহারা ফণীর ন্যায় বসিয়া আছেন –হাতে মালা –ঠোঁট দু’টি কাঁপাইয়া তসবি পড়িতেছেন, অন্যান্য অনেক কথা হইতেছে কিন্তু সে সব কথায় তাঁহার কিছুতেই মন নাই –দুই চক্ষু দেওয়ালের উপর লক্ষ্য করিয়া ভেল্ ভেল্ করিয়া ঘুরাইতেছেন –তাক্-বাগ কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই –বেণীবাবু প্রভৃতিকে দেখিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া সেলাম করিতে লাগিলেন। ঠকচাচার এত নম্রতা কখনই দেখা যায় নাই। ঢোঁড়া হইয়া পড়িলেই জাঁক যায়। বেণীবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া বলিলেন –আরে। করো কি ? তুমি প্রাচীন মুরুব্বী লোকটা –আমাদিগকে দেখে এত কেন ? বাঞ্ছারামবাবু বলিলেন –অন্য কথা যাউক –এদিকে দিন অতি সংক্ষেপ –উদ্যোগ কিছুই হয় নাই –কর্তব্য কি বলুন ?
বেচারাম। বাবুরামের বিষয়-আশায় অনেক জোড়া –কতক বিষয় বিক্রিসিক্রি করিয়া দেনা পরিশোধ করা কর্তব্য –দেনা করিয়া ধুমধাম শ্রাদ্ধ করা উচিত নহে।
বাঞ্ছারাম। সে কি কথা ! আগে লোকের মুখ থেকে তর্তে হবে, পশ্চাৎ বিষয়-আশয় রক্ষা হইবে। মান-সম্ভ্রম কি বানের জলে ভেসে যাবে ?
বেচারাম। এ পরামর্শ কুপরামর্শ –এমন পরামর্শ কখনই দিব না –কেমন বেণী ভায়া ! কি হলো ?
বেণী। যে স্থলে দেনা অনেক, বিষয়-আশায় বিক্রি করিয়া দিলেও পরিশোধ হয় কি-না সন্দেহ, সে স্থলে পুনরায় দেনা করা একপ্রকার অপহরণ করা, কারণ সে দেনা পরিশোধ কিরূপে হইবে ?
বাঞ্ছারাম। ও সকল ইংরেজী মত –বড়োমানুষদিগের ঢাল সুমরেই চলে –তাহারা এক দিচ্ছে এক নিচ্ছে, একটা সৎকর্মে বাগড়া দিয়ে ভাঙা মঙ্গলচণ্ডী হওয়া ভদ্রলোকের কর্তব্য নয়। আমার নিজের দান করিবার সঙ্গতি নাই, অন্য এক ব্যক্তি দশজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে দান করিতে উদ্যত তাহাতে আমার খোঁচা দিবার আবশ্যক কি ? আর সকলেরই নিকট অনুগত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আছে, তাহারাও পত্রটত্র পাইতে ইচ্ছা করে –তাহাদেরও তো চলা চাই।
বক্রেশ্বর। আপনি ভালো বলেছেন –কথাই আছে যাউক প্রাণ থাকুক মান।
বেচারাম। বাবুরামের পরিবার বেড়া আগুনে পড়িয়াছে –দেখিতেছি ‘রায় নিকেশ হইবে। যাহা করিলে আখেরে ভালো হয় তাহাই আমাদিগের বলা কর্তব্য –দেনা করিয়া মান কেনার মুখে ছাই –আমি এমন অনুগত বামুন রাখি না যে তাহাদিগের পেট পুরাইবার জন্য অন্যের গলায় ছুরি দিবে। এ সব কি কারখানা। দূঁর দূঁর । চলো বেণী ভায়া। আমরা যাই –এই বলিয়া তিনি বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিলেন।
বেণীবাবু ও বেচারামবাবু গমন করিলে বাঞ্ছারাম বলিলেন –আপদের শান্তি। এ দু-টা কিছুই বোঝে-সোঝে না, কেবল গোল করে। সমজদার মানুষের সঙ্গে কথা কইলে প্রাণ ঠাণ্ডা হয়। ঠকচাচা নিকটে আইস –তোমার বিবেচনায় কি হয় ?
ঠকচাচা। মুই বি তোমার সাতে বাতচিত করতে বহুত খোস –তেনারা খাপ্কান –তেনাদের নজদিকে এস্তে মোর ডর লাগে। যে সব বাত তুমি জাহের করলে সে সব সাচ্চা বাত। আদমির হুরমত ও কুদরৎ গেলে জিন্দিগি ফেল্তো। মামলা-মকদ্দমা নেগাবানি তুমি ও মুই করে বেলকুল বখেড়া কেটিয়ে দিব –তাতে ডর কি ?
মতিলালের ধুমধেমে স্বভাব –আয়ব্যয় বোধাবোধ নাই –বিষয় কর্ম কাহাকে বলে জানে না –বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার উপর বড়ো বিশ্বাস, কারণ তাহারা আদালত ঘাঁটা লোক আর তাহারা যেরূপ মন যুগিয়ে ও সলিয়ে কলিয়ে লওয়াইতে লাগিল তাহাতে মতিলাল একেবারে বলিল –এ কর্মে আপনারা অধ্যক্ষ হইয়া যাহাতে নির্বাহ হয় তাহা করুন, আমাকে সহি সনদ করিতে যাহা বলিবেন আমি তৎক্ষণাৎ করিব। বাঞ্ছারামবাবু বলিলেন –কর্তার উইল বাহির করিয়া আমাকে দাও –উইল কেবল তুমি অছি আছ –তোমার ভাইটে পাগল এই জন্য তাহার নাম বাদ দেওয়া গিয়াছিল, সেই উইল লইয়া আদালতে পেশ করিলে তুমি অছি মরকর হইবে, তাহার পরে তোমার সহি সনদে বিষয় বন্ধক বা বিক্রি হইতে পারিবে। মতিলাল বাক্স খুলিয়া উইল বাহির করিয়া দিল। পরে বাঞ্ছারাম আদালতের কর্ম শেষ করিয়া একজন মহাজন খাড়া করিয়া লেখাপড়া ও টাকা সমেত বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন। মতিলাল টাকার মুখ দেখিয়া তৎক্ষণাৎ কাগজাদ সহি করিয়া দিল। টাকার থলিতে হাত দিয়া বাক্সের ভিতর রাখিতে যায় এমন সময় বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা বলিল –বাবুজি ! টাকা তোমার হাতে থাকিলে বেলকুল খরচ হইয়া যাইবে, আমাদিগের হাতে তহবিল থাকিলে বোধ হয় টাকা বাঁচিতে পারিবে, আর তোমার স্বভাব বড়ো ভালো, চক্ষুলজ্জা অধিক, কেহ চাহিলে মুখ মুড়িতে পারিবে না, আমরা লোক বুঝে টেলে দিতে পারব। মতিলাল মনে করিল এ কথা বড়ো ভালো শ্রাদ্ধের পর আমিই বা খরচের টাকা কিরূপে পাই এখন তো বাবা নাই যে চাহিলেই পাব এ কারণে উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হইল।
বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধের ধুম লেগে গেল। ষোড়শ গড়িবার শব্দ –ভেয়ানের গন্ধ –বোল্তা মাছির ভন্ভনানি, ভিজে কাঠের ধুঁয়া, জিনিস পত্রের আমদানি লোকের কোলাহলে বাড়ি ছেয়ে ফেলিল। যাবতীয় পূজারী, দোকানী ও বাজার সরকারে বামুন এক এক তসর জোড় পরিয়া ও গঙ্গামৃত্তিকার ফোঁটা করিয়া পত্রের জন্য গমনাগমন করিতে লাগল, আর তর্কবাগীশ, বিদ্যারত্ন, ন্যায়ালঙ্কার, বাচস্পতি ও বিদ্যাসাগরের তো শেষ নাই, দিন-রাত্রি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও অধ্যাপকের আগমন যেন গো-মড়কে মুচির পার্বণ।
শ্রাদ্ধের দিবস উপস্থিত –সভায় নানা দিগ্দেশীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সমাগম হইয়াছে ও যাবতীয় আত্মকুটুম্ব, স্বজন, সুহৃদ্ বসিয়াছেন –সম্মুখে রুপার দানসাগর –ঘোড়া, পালকি, পিতলের বাসন, বনাত, তৈজসপত্র ও নগদ টাকা –পার্শ্বে কীর্তন হইতেছে –মধ্যে বেচারামবাবু ভাবুক হইয়া ভাব গ্রহণ করিতেছেন। বাটীর বাহিরে অগ্রদানী, রেও ভাট, নাগা, তষ্টিরাম ও কাঙালীতে পরিপূর্ণ –ঠকচাচা কেনিয়ে কেনিয়ে বেড়াচ্ছেন –সভায় বসিতে তাঁহার ভরসা হয় না। অধ্যাপকেরা নস্য লইতেছেন ও শাস্ত্রীয় কথা লইয়া পরস্পরে আলাপ করিতেছেন –তাহাদিগের গুণ এই যে একত্র হইলে ঠাণ্ডা রুপে কথোপকথন করা ভার –একটা না একটা উৎপাত অনায়াসে উপস্থিত হয়। একজন অধ্যাপক ন্যায়শাস্ত্রের একটা ফেঁড়কা উপস্থিত করিলেন – “ঘটত্বাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাভাব বহ্ণিভাবে ধূমা, ধূমাভাবে বহ্ণি”। উৎকলনিবাসী একজন পণ্ডিত কহিলেন –যৌটি ঘটিয়া বাচ্ছিন্তি ভাব প্রতিযোগা সৌটি পর্বত বহ্ণি নামেধিয়া। কাশীজোড়া-নিবাসী পণ্ডিত বলিলেন –কেমন কথা গো ? বাক্যটি প্রিণিধান করো নাই –যে ও ঘটকে পট করে পর্বতকে বহ্ণিমান ধূম –শিরোমণি যে মেকটি মেরে দিচ্ছেন। বঙ্গদেশীয় পণ্ডিত বলিলেন –গটিয়াবচ্ছিন্ন বাব প্রতিযোগা দুমাধামে অগ্নি অগ্নিবাবে দুমা –অগ্নি না হলে দুমা কেম্মে লাগে। এইরূপ তর্ক বির্তক হইতেছে –মুখামুখি হইতে হইতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম –ঠকচাচা ভাবেন পাছে প্রমাদ ঘটে এই বেলা মিটিয়া দেওয়া ভালো –আস্তে আস্তে নিকটে আসিয়া বলিলেন –মুই বলি একটা বদনা ও চেরাগের বাত লিয়ে তোমরা কেন কেজিয়ে করো –মুই তোমাদের দু-টা দু-টা বদনা দিব। অধ্যাপকের মধ্যে একজন চটপটে ব্রাহ্মণ উঠিয়া বলিলেন –তুই বেটা কে রে ? হিন্দুর শ্রাদ্ধে যবন কেন ? এ কি ? পেতনীর শ্রাদ্ধে আলেয়া অধ্যক্ষ না কি ? এই বলিতে বলিতে গালাগালি হাতাহাতি হইতে হইতে ঠেলাঠেলি, বেতাবেতি আরম্ভ হইল। বাঞ্ছারামবাবু তেড়ে আসিয়া বলিলেন –গোলমাল করিয়া শ্রাদ্ধ ভণ্ডুল করিলে পরে বুঝব –একেবারে বড়ো আদালতে এক শমন আনব –একি ছেলের হাতের পিটে ? বক্রেশ্বর বলেন, তা বইকি আর যিনি শ্রাদ্ধ করিবেন তিনি তো সামান্য ছেলে নন, তিনি পরেশ পাথর। বেচারাম বলিলেন –এ তো জানাই আছে যেখানে ঠক ও বাঞ্ছারাম অধ্যক্ষ সেখানে কর্ম সুপ্রতুল হইবে না –দূঁর দূঁর ! গোল কোনক্রমে থামে না –রেও ভাট প্রভৃতি ঝেঁকে আসিতেছে, এক একবার বেত খাইতেছে ও চিৎকার করিয়া বলিতেছে –”ভালো শ্রাদ্ধ কর্লি রে।” অবশেষে সভার ভদ্রলোক সকলে এই ব্যাপার দেখিয়া কহিতে লাগিল “কার শ্রাদ্ধ কে করে খোলা কেটে বামুন মরে” এই বেলা সরে পড়া শ্রেয় –ছুবড়ি ফেলে অমিত্তি কেন হারানো যাবে ?
২১.
মতিলালের গদিপ্রাপ্তি ও বাবুয়ানা, মাতার প্রতি কুব্যবহার —মাতা ভগিনীর বাটী হইতে গমন ও ভ্রাতাকে বাটীতে আসিতে বারণ ও তাহার অন্য দেশে গমন।
বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধে লোকের বড়ো শ্রদ্ধা জন্মিল না, যেমন গর্জন হইয়াছিল তেমন বর্ষণ হয় নাই। অনেক তেলা মাথায় তেল পড়িল –কিন্তু শুকনা মাথা বিনা তৈলে ফেটে গেল। অধ্যাপকদিগের তর্ক করাই সার, ইয়ার গোছের বামুনদিগের চৌচাপটে জিত। অধ্যাপকদিগের নানা প্রকার কঠোর অভ্যাস থাকাতে এক্রোকা স্বভাব জন্মে –তাঁহারা আপন অভিপ্রায় অনুসারে চলেন –সাটে হাঁ-না বলেন না। ইয়ার গোচের ব্রাহ্মণেরা শহরঘেঁষা –বাবুদিগের মন যোগাইয়া কথাবার্তা কহেন –ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, তাঁহারা সকল কর্মেই বাওয়াজিকে বাওয়াজি তরকারিকে তরকারী। অতএব তাঁহাদিগের যে সর্ব স্থানে উচ্চ বিদায় হয় তাহাতে আশ্চর্য কি? অধ্যক্ষেরা ভালো থলিয়া সিঞাইয়া বসিয়াছিলেন –ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও কাঙালী বিদায় বড়ো হউক বা না হউক তাহাদিগের নিজের বিদায়ে ভালো অনুরাগ হইল। যে কর্মটি সকলের চক্ষের উপর পড়িয়াছিল ও এড়াইবার নয় সেই কর্মটি রব করিয়া হইয়াছিল কিন্তু আগুপাছুতে সমান বিবেচনা হয় নাই। এমন অধ্যক্ষতা করা কেবল চিতেন কেটে বাহবা লওয়া।
শ্রাদ্ধের গোল ক্রমে মিটে গেল। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালের বিজাতীয় খোসামোদ করিতে লাগিল। মতিলাল দুর্বল স্বভাব হেতু তাহাদিগের মিষ্ট কথায় ভিজিয়া গিয়া মনে করিল যে পৃথিবীতে তাহাদিগের তুল্য আত্মীয় আর নাই। মতিলালের মান বৃদ্ধির জন্য তাহারা একদিন বলিল –এক্ষণে আপনি কর্তা অতএব স্বর্গীয় কর্তার গদিতে বসা কর্তব্য, তাহা না হইলে তাঁহার পদ কি প্রকারে বজায় থাকিবে? –এই কথা শুনিয়া মতিলাল অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল –ছেলে বেলা তাহার রামায়ণ ও মহাভারত একটু একটু শুনা ছিল এই কারণে মনে হইতে লাগিল যেমন রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠির সমারোহপূর্বক সিংহাসনে অভিসিক্ত হইয়াছিলেন সেইরূপে আমাকেও গদিতে উপবেশন করিতে হইবেক। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা দেখিল ঐ প্রস্তাবে মতিলালের মুখখানি আহ্লাদে চক্ চক্ করিতে লাগিল –তাহার পর দিবসেই দিন স্থির-করিয়া আত্মীয় স্বজনকে আহ্বানপূর্বক মতিলালকে তাহার পিতার গদির উপর বসাইল। গ্রামে ঢিঢিকার হইয়া গেল মতিলাল গদিপ্রাপ্ত হইলেন। এই কথা হাটে, বাজারে, ঘাটে-মাঠে হইতে লাগিল –একজন ঝাঁজওয়ালা বামুন শুনিয়া বলিল –গদিপ্রাপ্ত কি হে ? এটা যে বড়ো লম্বা কথা ! আর গদি বা কার ? এ কি জগৎসেটের গদি না দেবীদাস বালমুকুন্দের গদি ?
যে লোকের ভিতরে সার থাকে সে লোক উচ্চ পদ অথবা বিভব পাইলেও হেলে দোলে না, কিন্তু যাহাতে কিছু পদার্থ নাই তাহার অবস্থার উন্নতি হইলে বানের জলের ন্যায় টল্মল্ করিতে থাকে। মতিলালের মনের গতি সেইরূপ হইতে লাগিল। রাত দিন খেলাধুলা, গোলমাল, গাওনা-বাজনা, হো হা, হাসি-খুশি, আমোদ-প্রমোদ, মোয়াফেল, চোহেল, স্রোতের ন্যায় অবিশ্রান্ত চলিতে আরম্ভ হইল, সঙ্গীদিগের সংখ্যার হ্রাস নাই_ রোজ রোজ রক্তবীজের ন্যায় বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ইহার আশ্চর্য কি ? –ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নাই, আর গুড়ের গন্ধেই পিঁপড়ার পাল পিল পিল করিয়া আইসে। একদিন বক্রেশ্বরের সাইতের পন্থায় আসিয়া মতিলালের মনযোগানো কথা অনেক বলিল কিন্তু বক্রেশ্বরের ফন্দি মতিলাল বাল্যকালাবধি ভালো জানিত –এই জন্যে তাহাকে এই জবাব দেওয়া হইল –মহাশয় ! আমার প্রতি যেরূপ তদারক করিয়াছিলেন তাহাতে আমার পরকালের দফা একেবারে খাইয়া দিয়াছেন –ছেলেবেলা আপনাকে দিতে থুতে আমি কসুর করি নাই –এখন আর যন্ত্রণা কেন দেন? বক্রেশ্বর অধোমুখে মেও মেও করিয়া প্রস্থান করিল। মতিলাল আপন সুখে মত্ত –বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা এক একবার আসিতেন কিন্তু তাহাদিগের সঙ্গে বড়ো দেখাশুনা হইত না –তাঁহারা মোক্তারনামার দ্বারা সকল আদায়-ওয়াশিল করিতেন ও মধ্যে মধ্যে বাবুকে হাততোলা রকমে কিছু কিছু দিতেন। আর ব্যয়ের কিছু নিকেশ প্রকাশ নাই –পরিবারেরও দেখাশুনা নাই –কে কোথায় থাকে –কে কোথায় খায় –কিছুই খোঁজ খবর নাই –এইরূপ হওয়াতে পরিবারদিগের ক্লেশ হইতে লাগিল কিন্তু মতিলাল বাবুয়ানায় এমতো বেহুঁশ যে এসব কথা শুনিয়েও শুনে না।
সাধ্বী স্ত্রীর পতিশোকের অপেক্ষা আর যন্ত্রণা নাই। যদ্যপি সৎ সন্তান থাকে তবে সে শোকের কিঞ্চাৎ শমতা হয়। কুসন্তান হইলে সেই শোকানলে যে ঘৃত পড়ে। মতিলালের কুব্যবহার জন্য তাহার মাতা ঘোরতর তাপিত হইতে লাগিলেন –কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করিতেন না, তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন মতিলালের নিকট আসিয়া বলিলেন –বাবা ! আমার কপালে যাহা ছিল তাহা হইয়াছে, এক্ষণ যে ক-দিন বাঁচি সে ক-দিন যেন তোমার কুকথা না শুনতে হয় –লোকগঞ্জনায় আমি কান পাতিতে পারি না, তোমার ছোট ভাইটির, বড়ো বোনটির ও বিমাতার একটু তত্ত্ব নিও –তারা সবদিন আধপেটাও খেতে পাইয় না –বাবা। আমি নিজের জন্যে কিছু বলি না, তোমাকে ভারও দিই না। মতিলাল এ কথা শুনিয়া দুই চক্ষু লাল করিয়া বলিল –কি তুমি একশ-বার ফেচ্ ফেচ্ করিয়া বক্তেছ? –তুমি জানো না আমি এখন যা মনে করি তাই করিতে পারি? আমার আবার কুকথা কি? এই বলিয়া মাতাকে ঠাস্ করিয়া এক চড় মারিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। অনেকক্ষণ, পরে জননী উঠিয়া অঞ্চল দিয়া চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে বলিলেন –বাবা ! আমি কখন শুনি নাই যে সন্তানে মাকে মারে কিন্তু আমার কপাল হইতে তাহাও ঘটিল –আমার আর কিছু কথা নাই কেবল এইমাত্র বলি যে তুমি ভালো থাকো। মাতা পর দিবস আপন কন্যাকে লইয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া বাটী হইতে গমন করিলেন।
রামলাল পিতার মৃত্যুর পর ভ্রাতার সঙ্গে সদ্ভাব রাখিতে অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন কিন্তু নানা প্রকারে অপমানিত হন। মতিলাল সর্বদা এই ভাবিত বিষয়ের অর্ধেক অংশ দিতে গেলে বড়োমানুষি করা হইবে না কিন্তু বড়োমানুষি না করিলে বাঁচা মিথ্যা, এজন্য যাহাতে ভাই ফাঁকিতে পড়ে তাহাই করিতে হইবে। এই মতলব স্থির করিয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার পরামর্শে মতিলাল রামলালকে বাটী ঢুকিতে বারণ করিয়া দিল। রামলাল ভদ্রাসনে প্রবেশকরণে নিবারিত হইয়া অনেক বিবেচনা করণান্তে মাতা বা ভাগিনী অথবা কাহারো সহিত না সাক্ষাৎ করিয়া দেশান্তর গমন করিলেন।
২২.
বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালকে সওদাগরি কর্ম করিতে পরামর্শ দেন, মতিলাল দিন দেখাইবার জন্য তর্কসিদ্ধান্তের নিকট মানগোবিন্দকে পাঠান, পর দিবস রাহি হয়েন ও ধনামালার সহিত গঙ্গাতে বকাবকি করেন।
মতিলাল দেখিলেন বাটী হইতে মা গেলেন, ভাই গেলেন, ভগিনী গেলেন। আপদের শান্তি ! এতদিনের পর নিষ্কন্টক হইল —ফেচ্ফেচানি একেবারে বন্ধ —এক চোখ রাঙানিতে কর্ম কেয়াল হইয়া উঠিল আর “প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ” সে সব হল বটে কিন্তু শরার রুধির ফুরিয়ে এল —তার উপায় কি? বাবুয়ানার জোগাড় কিরূপে চলে? খুচরা মহাজন বেটাদের টাল্মাটাল আর করিতে পারা যায় না। উটনোওয়ালারাও উটনো বন্ধ করিয়াছে —এদিকে সামনে স্নানযাত্রা —বজরা ভাড়া করিতে আছে —খেমটাওয়ালীদের বায়না দিতে আছে —সন্দেশ মেঠাইয়ের ফরমাইশ দিতে আছে —চরস, গাঁজা ও মদও আনাইতে হইবে —তার আটখানার পাটখানাও হয় নাই। এই সকল চিন্তায় মতিলাল চিন্তিত আছেন এমতো সময়ে বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা আসিয়া উপস্থিত হইল। দুই-একটা কথার পরে তাহারা জিজ্ঞাসা করিল —বড়োবাবু ! কিছু বিমর্ষ কেন? তোমাকে ম্লান দেখিলে যে আমরা ম্লান হই —তোমার যে বয়েস তাতে সর্বদা হাসিখুশি করিবে। গালে হাত কেন? ছি ! ভালো করিয়া বসো। মতিলাল এই মিষ্ট বাক্যে ভিজিয়া আপন মনের কথা সকল ব্যক্ত করিল। বাঞ্ছরাম বলিলেন —তার জন্যে এত ভাবনা কেন? আমরা কি ঘাস কাটছি? আজ একটা ভারি মতলব করিয়া আসিয়াছি —এক বৎসরের মধ্যে দেনা-টেনা সকল শোধ দিয়া পায়ের উপর পা দিয়া পুত্রপৌত্রক্রমে খুব বড়োমানুষি করিতে পারিবে। শাস্ত্রে বলে “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” —সৌদাগরিতেই লোক ফেঁপে উঠে —আমার দেখ্তা কত বেটা টেপাগোঁজা, নড়েভোলা, টয়েবাঁধা, বালতিপোতা, কারবারে হেপায় আণ্ডিল হইয়া গেল —এ সব দেখে কেবল চোখ টাটায় বই তো না! আমরা কেবল একটি কর্ম লয়ে ঘষ্টিঘর্ষণা করিতেছি —এ কি খাটো দুঃখ ! চন্ডীচরণ ঘুঁটে কুড়ায়, রামা চড়ে ঘোড়া।
মতিলাল। এ মতলব বড়ো ভালো —আমার অহরহ টাকার দরকার। সৌদাগরি কি বাজারে ফলে না আপিসে জন্মে? না মেঠাই-মণ্ডার দোকানে কিনিতে মেলে? একজন সাহেবের মুৎসুদ্দি না হইলে আমার কর্ম কাজ জমকাবে না।
বাঞ্ছরাম। বড়োবাবু ! তুমি কেবল গদিয়ান হইয়া থাকিবে, করাকর্মার ভার সব আমাদিগের উপর —আমাদিগের বটলর সাহেবের একজন দোস্ত জান সাহেব সম্প্রতি বিলাত হইতে আসিয়াছে —তাহাকেই খাড়া করিয়া তাহারই মৎসুদ্দি হইতে হইবে। সে লোকটি সৌদাগরি কর্মে ঘুন।
ঠকচাচা। মুইবি সাতে সাতে থাক্ব, মোকে আদালতে, মাল, ফৌজদারি, সৌদাগরি কোনো কাম ছাপা নাই। মোর শেনাবি এ সব ভালো সমজে। বাবু ! আপসোস এই যে মোর কারদানি এ নাগাদ নিদ যেতেচে —লেফিয়ে লেফিয়ে জাহের হল না। মুই চুপ করে থাকবার আদমি নয় দোশমন পেলে তেনাকে জেপ্টে, কেমড়ে মেটিতে পেটিয়ে দি —সৌদাগরি কাম পেলে মুই রোস্তম জালের মাফিক চলব।
মতিলাল। ঠকচাচা —শেনা কে ?
ঠকচাচা। শেনা তোমার ঠকচাচী —তেনার সেফত কি করব? তেনার সুরত জেলেখার মাফিক আর মালুম হয় ফেরেস্তার মাফিক বুজ-সমজ।
বাঞ্ছারাম। ও কথা এখন থাকুক। জান সাহেবকে দশ পনেরো হাজার টাকা সরবরাহ করিতে হইবে তাতে কিছুমাত্র জখম নাই। আমি স্থির করিয়াছি যে কোতলপুরের তালুকখানা বন্ধক দিলে ঐ টাকা পাওয়া যাইতে পারে— বন্ধকী লেখাপড়া আমাদিগের সাহেবের আপিসে করিয়া দিব —খরচ বড়ো হইবে না —আন্দাজ টাকা শ’চার-পাঁচের মধ্যে আর টাকা শ-পাঁচেক মহাজনের আমলা-ফামলাকে দিতে হইবে। সে বেটারা পুন্কে শত্রু —একটা খোঁচা দিলে কর্ম ভণ্ডুল করিতে পারে। সকল কর্মেরই অষ্টম-খষ্টম আগে মিটাইয়া নষ্ট কোষ্ঠী উদ্ধার করিতে হয়। আমি আর বড়ো বিলম্ব করিব না, ঠকচাচাকে লইয়া কলিকাতায় চলিলাম —আমার নানা বরাত —মাথায় আগুন জ্বল্ছে। বড়োবাবু ! তুমি তর্কসিদ্ধান্ত দাদার কাছে থেকে একটা ভালো দিন দেখে শীঘ্র দুর্গা দুর্গা বলিয়া যাত্রা করিয়া একেবারে আমার সোনাগাজির দরুন বাটীতে উঠিবে। কলিকাতায় কিছু দিন অবস্থিতি করিতে হইবে তার পর এই বৈদ্যবাটীর ঘাটেতে যখন চাঁদ সদাগরের মতন সাত জাঁহাজ ধন লইয়া ফিরিয়া আসিয়া দামামা বাজাইয়া উঠিবে তখন আবাল-বৃদ্ধ, যুবতী কুলকন্যা তোমার প্রত্যাগমনের কৌতুক দেখিয়া তোমাকে ধন্য ধন্য করিবে।
আহা ! এমন দিন যেন শীঘ্র উদয় হয় ! এই বলিয়া বাঞ্ছারাম ঠকচাচাকে লইয়া গমন করিলেন।
মতিলাল আপন সঙ্গীদিগকে উপরোক্ত সকল কথা আনুপূর্বিক বলিল। সঙ্গীরা শুনিয়া বগল বাজাইয়া নেচে উঠিল —তাহাদিগের রাতিব টানাটানির জন্য প্রায় বন্ধ। এক্ষণে সাবেক বরাদ্দ বহাল হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তাড়াতাড়ি, হুড়াহুড়ি করিয়া মানগোবিন্দ এক চোঁচা দৌড়ে তর্কসিদ্ধান্তের টোলে উপস্থিত হইয়া হাঁপ ছাড়িতে লাগল। তর্কসিদ্ধান্ত বড়ো প্রাচীন, নস্য লইতেছেন —ফেঁচ্ ফেঁচ্ করিয়া হাঁচতেছেন —খক্ খক্ করিয়া কাশতেছেন —চারিদিকে শিষ্য —সম্মুখে কয়েকখানা তালপাতায় লেখা পুস্তক —চশমা নাকে দিয়ে এক একবার গ্রন্থ দেখিতেছেন, এক একবার ছাত্রদিগকে পাঠ বলিয়া দিতেছেন। বিচলির অভাবে গোরুর জাবনা দেওয়া হয় নাই —গোরু মধ্যে মধ্যে হাম্মা হাম্মা করিতেছে —ব্রাহ্মণী বাটীর ভিতর হইতে চিৎকার করিয়া বলিতেছেন —বুড়ো হইলেই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ হয়, উনি রাতদিন পাঁজি-পুথি ঘাঁটবেন, ঘরকন্নার পানে একবার ফিরে দেখবেন না। এই কথা শিষ্যেরা শুনিয়া পরস্পর গা টেপাটেপি করিয়া চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। তর্কসিদ্ধান্ত বিরক্ত হইয়া ব্রাহ্মণীকে থমাইবার জন্য লাঠি ধরিয়া সুড় সুড় করিয়া উঠিতেছেন এমন সময়ে মানগোবিন্দ ধরে বসিল —ওগো তর্কসিদ্ধান্ত খুড়ো ! আমরা সব সৌদাগরি করিতে যাব একটা ভালো দিন দেখে দেও।
তর্কসিদ্ধান্ত মুখ বিকটসিকট করিয়া গুমরে উঠিলেন —কচুপোড়া খাও —উঠছি আর অমনি পেচু ডাক্ছ আর কি সময় পাওনি? সৌদাগরি করতে যাবে ! তোর বাপের ভিটে নাশ হউক —তোদের আবার দিনক্ষণ কি রে ? বালাই বেরুলে সকলে হাঁপ ছেড়ে গঙ্গাস্নান করবে —যা বল্গে যা যে দিন তোরা এখান থেকে যাবি সেই দিনই শুভ।
মানগোবিন্দ মুখছোপ্পা খাইয়া আসিয়া বলিল যে কালই দিন ভালো, অমনি সাজ্ রে সাজ্ রে শব্দ হইতে লাগিল ও উদ্যোগ পর্বে ধুম বেধে গেল। কেহ সেতারার মেজ্রাপ হাতে দেয় —কেহ বাঁয়ার গাব আছে কি-না তাহা ধপ্ ধপ্ করিয়া পিটে দেখে —কেহ তবলায় চাঁটি দিয়া পরখ করে —কেহ কেহ ঢোলের কড়া টানে —কেহ বেহালায় রজন দিয়া ডাডা ডাডা করে —কেহ বোঁচকা-বুঁচকি বাঁধে —কেহ চরস-গাঁজা মায় ছুরি, কাঠ লইয়া পোঁটলা করে —কেহ ছর্রার গুলী চাটের সহিত সন্তর্পণে রাখে —কেহ পাকামালের ঘাট্তি তদারক করে। এইরূপে সারা দিন ও সারা রাত্রি ছট্ফটানি, ধড় ফড়ানি, আন, নিয়ে আয়, দেখ, শোন, ওরে, হেঁরে, সজ্জাগজ্জা, হোহাতে কেটে গেল।
গ্রামে ঢিঢিকার হইল বাবুরা সৌদাগরি করিতে চলিলেন। পর দিবস প্রভাতে যাবতীয় দোকানী, পসারী, ভিখিরী, কাঙালী ও অন্যান্য অনেকেই রাস্তায় চাহিয়ে আছে ইতিমধ্যে নববাবুরা মত্ত হস্তীর ন্যায় পৈয়িস্ পৈয়িস্ করত মস্ মস্ শব্দে ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আহ্ণিক করিতেছিলেন, গোলমাল শুনিয়া পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে জড়সড় হইলেন। তাঁহাদিগকে ভীত দেখিয়া নববাবুরা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিতে হাসিতে গঙ্গামৃত্তিকা ঝামা ও থুৎকুড়ি গাত্রে বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা ভগ্নাহ্ণিক হইয়া গোবিন্দ গোবিন্দ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন। নববাবুরা নৌকায় উঠিয়া সকলে চিৎকার স্বরে এক সখীসম্বাদ ধরিলেন —নৌকা ভাঁটার জোরে সাঁ সাঁ করিয়া যাইতেছে কিন্তু বাবুরা কেহই স্থির নহেন —এ ছাতের উপর যায় ও হাইল ধরে টানে —এ দাঁড় বহে ও চকমকি নিয়ে আগুন করে। কঞ্চিৎ দূর যাইতে যাইতে ধনামালার সহিত দেখা হইল —ধনামালা বড়ো মুখর —জিজ্ঞাসা করিল গ্রামটাকে তো পুড়িয়ে খাক করলে আবার গঙ্গাকে জ্বালাচ্ছ কেন? নববাবুরা রেগে বলিল —চুপ শূয়ার —তুই জানিস নে যে আমরা সব সৌদাগরি করতে যাচ্ছি? ধনা উত্তর করিল —যদি তোরা সৌদাগর হস্ তো সৌদাগরি কর্ম গলায় দড়ি দিয়া মরুক !
২৩.
মতিলাল দলবল সমেত সোনাগাজিতে আসিয়া একজন গুরুমহাশয়কে তাড়ান, বাবুয়ানা বাড়াবাড়ি হয়, পরে সৌদাগরি করিয়া দেনার ভয়ে প্রস্থান করেন।
সোনাগাজির দরগায় কুনী বুনী বাসা করিয়াছিল —চারি দিক্ শেওলা ও বোনাজে পরিপূর্ণ —স্থানে স্থানে কাকের ও শালিকের বাসা –বাড়িতে আবার আনিয়া দিতেছে –পিলে চিঁ চিঁ করিতেছে –কোনোখানেই এক ফোঁটা চুন পড়ে নাই –রাত্রি হইলে কেবল শেয়াল-কুকুরের ডাক শোনা যাইত ও সকল স্থানে সন্ধ্যা দিত কি-না তাহা সন্দেহ। নিকটে একজন গুরুমহাশয় কতকগুলি ফরগল গলায় বাঁধা ছেলে লইয়া পড়াইতেন –ছেলেদিগের লেখাপড়া যত হউক বা না হউক, বেতের শব্দে ত্রাসে তাহাদিগের প্রাণ উড়িয়া যাইত –যদি কোনো ছেলে একবার ঘাড় তুলিত অথবা কোঁচড় থেকে এক গাল জলপান খাইত তবে তৎক্ষণাৎ তাহার পিঠে চট্ চট্ চাপড় পড়িত। মানব-স্বভাব এই যে কোনো বিষয়ে কর্তৃত্ব থাকিলে যে কর্তৃত্বটি নানারূপে প্রকাশ চাই তাহা না হইলে আপন গৌরবের লাঘব হয় –এই জন্য গুরুমহাশয় আপন প্রভুত্ব ব্যক্ত করণার্থ রাস্তার লোক জড়ো করিতেন ও লোক জড়ো হইলে তাঁহার সরদারি অশেষ বিশেষ রকমে বৃদ্ধি হইত, এ কারণ বালকদিগের যে লঘু পাপে গুরু দণ্ড হইত তাহার আশ্চার্য কি ? গুরুমহাশয়ের পাঠশালাটি প্রায় যমালয়ের ন্যায় –সর্বদাই চটাপট্, পটাপট্, গেলুম রে, মলুম রে, ও ‘গুরুমহাশয়, গুরুমহাশয় তোমার পড়ো হাজির’ এই শব্দই হইত আর কাহার নাকখত –কাহার কানমলা –কেহ ইটেখাড়া –কাহার হাতছড়ি –কাহাকেও কপিকলে লট্কানো –কাহার জলবিচাটি, একটা না একটা প্রকার দণ্ড অনবরতই হইত। সোনাগাজির গুমর কেবল গুরুমহাশয়ের দ্বারাই রাখা হইয়াছিল। কিঞ্চিৎ প্রান্তভাগে দুই-একজন বাউল থাকিত —তাহারা সমস্ত দিন ভিক্ষা করিত। সন্ধ্যার পর পরিশ্রমে অক্লান্ত হইয়া শুয়ে শুয়ে মৃদুস্বরে গান করিত। সোনাগাজির এইরূপ অবস্থা ছিল। মতিলালের শুভাগমনাবধি সোনাগাজির কপাল ফিরিয়া গেল। একেবারে ‘ঘোড়ার চিঁ হিঁ, তবলার চাঁটি, লুচি পুরির খচাখচ’, উল্লাসের কড়াংধুম রাতদিন হইতে লাগিল আর মণ্ডা-মিঠাই, গোলাপ ফুলের আতর ও চরস, গাঁজা, মদের ছড়াছড়ি দেখিয়া অনেকেই গড়াগড়ি দিতে আরম্ভ করিল। কলিকাতার লোক চেনা ভার —অনেকেই বর্ণচোরা আঁব। তাহাদিগের প্রথম এক রকম মূর্তি দেখা যায় পরে আর এক মুর্তি প্রকাশ হয়। ইহার মূল টাকা –টাকার খাতিরেই অনেক ফেরফার হয়। মনুষ্যের দুর্বল স্বভাব হেতুই ধনকে অসাধারণরূপে পূজা করে। যদি লোকে শুনে যে অমুকের এত টাকা আছে তবে কি প্রকারে তাহার অনুগ্রহের পাত্র হইবে এই চেষ্টা কায়মনোবাক্যে করে ও তজ্জন্য যাহা বলিতে বা করিতে হয় তাহাতে কিছুমাত্র ক্রটি করে না। এই কারণে মতিলালের নিকট নানা রকম লোক আসিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ উলার ব্রাহ্মণের ন্যায় মুখপোড়া রকমে আপনার অভিপ্রায় একেবারে ব্যক্ত করে –কেহ-বা কৃষ্ণনগরীয়দিগের ন্যায় ঝাড় বুটা কাটিয়া মুন্শিয়ানা খরচ করে –আসল কথা অনেক বিলম্বে অতি সূক্ষ্ণরূপে প্রকাশ হয় –কেহ বা পূর্বদেশীয় বঙ্গভায়াদিগের মতো কেনিয়ে কেনিয়ে চলেন –প্রথম প্রথম আপনাকে নিষ্প্রয়াস ও নির্লোভ দেখান –আসল মতলব তৎকালে দ্বৈপায়নহ্রদে ডুবাইয়া রাখেন –দীর্ঘকালে সময়বিশেষে প্রকাশ হইলে বোধ হয় তাহার গমনাগমনের তাৎপর্য কেবল “যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্য”।
মতিলালের নিকট যে ব্যক্তি আইসে সেই হাই তুলিলে তুড়ি দেয় –হাঁচিলে “জীব” বলে। ওরে বলিলেই “ওরে ওরে” করে চীৎকার করে ও ভালোমন্দ সকল কথারই উত্তরে –”আজ্ঞা আপনি যা বলেছেন তাই বটে” এই প্রকার বলে। প্রাতঃকালাবধি রাত্রি দুই প্রহর পর্যন্ত মতিলালের নিকট লোক গস্গস্ করিতে লাগিল –ক্ষণ নাই –মুহুর্ত নাই –নিমেষ নাই –সর্বদাই নানা প্রকার লোক আসিতেছে –বসিতেছে –যাইতেছে। তাহাদিগের জুতার ফটাং ফটাং শব্দে বৈঠকখানায় সিঁড়ি কম্পমান –তামাক মুহুর্মুহুঃ আসিতেছে –ধুঁয়া কলের জাহাজের ন্যায় নির্গত হইতেছে। চাকরেরা আর তামাক সাজিতে পারে না –পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। দিবারাত্রি নৃত্য, গীত, বাদ্য, হাসিখুশি, বড়ফট্টাই, ভাঁড়ামো, নকল, ঠাট্টা, বটকেরা, ভাবের গালাগালি, আমাদের ঠেলাঠেলি –চড়ুইভাতি, বনভোজন, নেশা একাদিক্রমে চলিতেছে। যেন রাতারাতি মতিলাল হঠাৎ বাবু হইয়া উঠিয়াছেন।
এই গোলে গুরুমহাশয়ের গুরুত্ব একেবারে লঘু হইয়া গেল –তিনি পূর্বে বৃহৎ পক্ষী ছিলেন এক্ষণে দুর্গা-টুনটুনি হইয়া পড়িলেন। মধ্যে মধ্যে ছেলেদের ঘোষাইবার একটু একটু গোল হইত –তাহা শুনিয়া মতিলাল বলিলেন, এ বেটা এখানে কেন মেও মেও করে –গুরুমশায়ের যন্ত্রণা হইতে আমি বালকাকালেই মুক্ত হইয়াছি আবার গুরুমহাশয় নিকটে কেন? –ওটাকে ‘রায় বিসর্জন দাও। এই কথা শুনিবামাত্র নববাবুরা দুই-এক দিনের মধ্যেই ইট পাটকেলের দ্বারা গুরুমহশয়কে অন্তর্ধান করাইলেন সুতরাং পাঠশালা ভাঙ্গিয়া গেল। বালকেরা বাঁচলুম বলিয়া তাড়ি পাত তুলিয়া গুরুমহশয়কে ভেংচুতে ভেংচুতে ও কলা দেখাইতে দেখাইতে চোঁচা দৌড়ে ঘরে গেল।
এদিকে জান সাহেব হৌস খুলিলেন –নাম হৈল জান কোম্পানি। মতিলাল মুৎসুদ্দি, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা কর্মকর্তা। সাহেব টাকার খাতিরে মুৎসুদ্দিকে তোয়াজ করেন ও মুৎসুদ্দি আপন সঙ্গীদিগকে লইয়া দুই প্রহর তিনটা চারিটার সময় পান চিবুতে চিবুতে রাঙা চকে এক একবার কুঠি যাইয়া দাঁদুড়ে বেড়াইয়া ঘরে আইসেন। সাহেবের এক পয়সার সঙ্গতি ছিল না –বটলর সাহেবের অন্নদাস হইয়া থাকিতেন এক্ষণে চৌরুঙ্গিতে এক বাটী ভাড়া করিয়া নানা প্রকার আসবাব ও তসবির খরিদ করিয়া বাটী সাজাইলেন ও ভালো ভালো গাড়ি, ঘোড়া ও কুকুর ধারে কিনিয়া আনিলেন এবং ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া তৈয়ার করিয়া বাজির খেলা খেলিতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে সাহেবের বিবাহ হইল, সোনার ওয়াচগার্ড পরিয়া ও হীরার আঙ্গুটি হাতে দিয়া সাহেব ভদ্র সমাজে ফিরিতে লাগিলেন। এই সকল ভড়ং দেখিয়া অনেকেরই সংস্কার হইল জান সাহেব ধনী হইয়াছেন, এই জন্য তাঁহার সহিত লেনদেন করণে অনেকে কিছুমাত্র সন্দেহ করিল না কিন্তু দুই-একজন বুদ্ধিমান লোক তাঁহার নিগূঢ় তত্ত্ব জানিয়া আল্গা আল্গা রকমে থাকিতে –কখনই মাখামাখি করিতে না।
কলিকাতার অনেক সৌদাগর আড়তদারিতেই অর্থ উপার্জন করে –হয়তো জাহাজের ভাড়া বিলি করে অথবা কোম্পানির কাগজ কিংবা জিনিসপত্র খরিদ বা বিক্রয় করে ও তাহার উপর ফি শতকরায় কতক টাকা আড়তদারি খরচা লয়। অন্যান্য অনেকে আপন আপন টাকায় এখানকার ও অন্য স্থানের বাজার বুঝিয়া সৌদাগরি করে কিন্তু যাহারা ঐ কর্ম করে তাহাদিগকে অগ্রে সৌদাগরি কর্ম শিখিতে হয় তা না হইলে কর্ম ভালো হইতে পারে না।
জান সাহেবের কিছুমাত্র বোধশোধ ছিল না, জিনিস খরিদ করিয়া পাঠাইলেই মুনাফা হইবে এই তাঁহার সংস্কার ছিল, ফলতঃ আসল মতলব এই পরের স্কন্ধে ভোগ করিয়া রাতারাতি বড়মানুষ হইব। তিনি এই ভাবিতেন যে সৌদাগরি সেস্ত করিয়া – দশটা গুলী মারিতে মারিতে কোনোটা না কোনোটা গুলীতে অবশ্যই শিকার পাওয়া যাইবে। যেমন সাহেব ততোধিক তাহার মুৎসুদ্দি – তিনি গণ্ডমূর্খ – না তাঁহার লেখাপড়াই বোধশোধ আছে –না বিষয়কর্মই বুঝিতে-শুঝিতে পারেন সুতরাং তাহাকে দিয়া কোনো কর্ম করানো কেবল গো-বধ করা মাত্র। মহাজন, দালাল ও সরকারেরা সর্বদাই তাঁহার নিকট জিনিসপত্রের নমুনা লইয়া আসিত ও দর-দামের ঘাটতি-বাড়তি এবং বাজারের খবর বলিত। তিনি বিষয়কর্মের কথার সময়ে ঘোর বিপদে পড়িয়া ফেল্ ফেল্ করিয়া চাহিয়া থাকিতেন – সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন না – কি জানি কথা কহিলে পাছে নিজের বিদ্যা প্রকাশ হয়, কেবল এইমাত্র বলিতেন যে, বাঞ্ছারাম বাবু ও ঠকচাচার নিকট যাও।
আপিসে দুই-একজন কেরানী ছিল, তাহারা ইংরেজীতে সকল হিসাব রাখিত। একদিন মতিলালের ইচ্ছা হইল যে ইংরাজী ক্যাশবহি বোঝা ভালো, এজন্য কেরানীর নিকট হইতে চাহিয়া আনাইয়া একবার এদিক-ওদিক দেখিয়া বহিখানি এক পাশে রাখিয়া দিলেন। মতিলাল আপীসের নীচের ঘরে বসিতেন – ঘরটি কিছু সেতঁসেতেঁ – ক্যাশবহি সেখানে মাসাবধি থাকাতে সর্দিতে খারাব হইয়া গেল ও নববাবুরা তাহা হইতে কাগজ চিরিয়া লইয়া সলতের ন্যায় পাকাইয়া প্রতিদিন কান চুলকাইতে আরম্ভ করিলেন – অল্প দিনের মধ্যেই বহির যাবতীয় কাগজ ফুরাইয়া গেল কেবল মিলাটটি পড়িয়া রহিল। অনন্তর ক্যাশবহির অন্বেষণ হওয়াতে দৃষ্ট হইল যে, তাহার ঠাটখানা আছে, অস্থি ও চর্ম পরহিতার্থে প্রদত্ত হইয়াছে। জান সাহেব হা ক্যাশবহি জো ক্যাশবহি বলিয়া বিলাপ করত মনের খেদ মনেই রাখিলেন।
জান সাহেব বেধড়ক ও দুচকোব্রত জিনিসপত্র খরিদ করিয়া বিলাতে ও অন্যান্য দেশে পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন –জিনিসের কি পরতা হইল ও কাটতি কি রূপ হইবে তাহার কিছুমাত্র খোঁজ-খবর করিতেন না। এই সুযোগ পাইয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা চিলের ন্যায় ছোবল মারিতে লাগিলেন, তাহাতে তাহাদিগের পেট মোটা হইল –অল্পে তৃষ্ণা মেটে না –রাতদিন খাই-খাই শব্দ ও আজ হাতীশালার হাতী খাব, কাল ঘোড়াশালার ঘোড়া খাব, দুইজনে নির্জনে বসিয়া কেবল এই মতলব করিতেন। তাঁহারা ভালো জানিতেন যে তাঁহাদিগের এমন দিন আর হইবে না –লাভের বসন্ত অস্ত হইয়া অলাভের হেমন্ত শীঘ্রই উদয় হইবে অতএব নে থোরই সময় এই।
দুই-এক বৎসরের মধ্যেই জিনিসপত্রের বিক্রির বড়ো মন্দ খবর আইল –সকল জিনিসেতেই লোকসান বই লাভ নাই। জান সাহেব দেখিলেন যে লোকসান প্রায় লক্ষ টাকা হইবে –এই সংবাদে বুকদাবা পাইয়া তাঁহার একেবারে চক্ষুস্থির হইয়া গেল আর তিনি মাসে মাসে প্রায় এক হাজার টাকা করিয়া খরচ করিয়াছেন, তদ্ব্যতিরেকে বেঙ্কে ও মহাজনের নিকটও অনেক দেনা –আপিস কয়েক মাসাবধি তলগড় ও ঢালসুমরে চলিতেছিল এক্ষণে বাহিরে সম্ভ্রমের নৌকা একেবারে ধুপুস্ করিয়া ডুবে গেল, প্রচার হইল যে জান কোম্পানী ফেল হইল। সাহেব বিবি লইয়া চন্দননগরে প্রস্তান করিলেন। ঐ শহর ফরাসীদিগের অধীন –অদ্যাবধি দেনাদার ফৌজদারি মামলার আসামীরা কয়েদের ভয়ে ঐ স্থানে যাইয়া পলাইয়া থাকে।
এদিকে মহাজন ও অন্যান্য পাওনাওয়ালারা আসিয়া মতিলালকে ঘেরিয়া বসিল। মতিলাল চারিদিক শূন্য দেখিতে লাগিলেন –এক পয়সাও হাতে নাই –উট্নাওয়ালাদিগের নিকট হইতে উট্না লইয়া তাঁহার খাওয়া-দাওয়া চলিতেছিল এক্ষণে কি বলবেন ও কি করিবেন কিছুই ঠাওরাইয়া পান না, মধ্যে মধ্যে ঘাড় উঁচু করিয়া দেখেন বাঞ্ছারামবাবু ও ঠকচাচা আইলেন কি-না, কিন্তু দাদার ভরসায় বাঁইয়ে ছুরি, ঐ দুই অবতার তুলতামালের অগ্রেই চম্পট দিয়াছেন। তাহাদিগের নাম উল্লেখ হইলে পাওনাওয়ালারা বলিল যে চিঠিপত্র মতিবাবুর নামে, তাহাদিগের সহিত আমাদিগের কোনো এলেকা নাই, তাহারা কেবল কারপরদাজ বই তো নয়।
এইরূপ গোলযোগ হওয়াতে মতিলাল দলবল সহিত ছদ্মবেশে রাত্রিযোগে বৈদ্যবাটীতে পালাইয়া গেলেন। সেখানকার যাবতীয় লোক তাঁহার বিষয়কর্মের সাত কাণ্ড শুনিয়া খুব হয়েছে খুব হয়েছে বলিয়া হাততালি দিতে লাগিল ও বলিল –আজও রাতদিন হচ্ছে –যে ব্যক্তি এমতো অসৎ –যে আপনার মাকে ভাইকে ভগিনীকে বঞ্চনা করিয়াছে –পাপকর্মে কখনই বিরত হয় নাই, তাহার যদি এরূপ না হবে তবে আর ধর্মাধর্ম কি ?
কর্মক্রমে প্রেমনারায়ণ মজুমদার পরদিন বৈদ্যবাটীর ঘাটে স্নান করিতেছিল –তর্কসিদ্ধান্তকে দেখিয়া বলিল –মহাশয় শুনেছেন –বিট্কেলরা সর্বস্ব খুয়াইয়া ওয়ারিণের ভয়ে আবার এখানে পালিয়ে আসিয়াছে –কালামুখ দেখাইতে লজ্জা হয় না ! বাবুরাম ভালো মুষলং কুলনাশনং রাখিয়া গিয়াছেন। তর্কসিদ্ধান্ত কহিলেন –ছোড়াদের না থাকতে গ্রামটা জুড়িয়ে ছিল –আবার ফিরে এল? আহা ! মা গঙ্গা একটু কৃপা করলে যে আমরা বেঁচে যাইতাম। অন্যান্য অনেক ব্রাহ্মণ স্নান করিতেছিলেন –নববাবুদিগের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া তাঁহাদিগের দাঁতে দাঁতে লেগে গেল, ভাবিতে লাগিলেন যে আমাদিগের স্নান-আহ্ণিক বুঝি অদ্যাবধি শ্রীকৃষ্ণায় অর্পণ করিতে হইবে। দোকানী পসারীরা ঘাটের দিকে দেখিয়া বলিল –কই গো। আমরা শুনিয়াছিলাম যে মতিবাবু সাত সুলুক ধন লইয়া দামামা বাজিয়ে উঠিবেন –এমন সুলুক দূরে যাউক একখানা জেলে ডিঙিও যে দেখতে পাই না। প্রেমনারায়ণ বলিল –তোমরা ব্যস্ত হইও না –মতিবাবু কমলে কামিনীর মুশকিলের দরুন দক্ষিণ মশান প্রাপ্ত হইয়াছেন –বাবু অতি ধর্মশীল –ভগবতীর বরপুত্র –ডিঙে সুলুক ও জাহাজ ত্বরায় দেখা দিবে আর তোমরা মুড়ি কড়াই ভাজিতে ভাজিতেই দামামার শব্দ শুনিবে !
২৪.
শুদ্ধ চিত্তের কথা, ঠকচাচার জালকরণ জন্য গেরেপ্তারি –বরদাবাবুর দুঃখ, মতিলালের ভয়; বেচারাম ও বাঞ্ছারাম উভয়ের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন।
প্রাতঃকালে মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে, –চম্পক, শেফালিকা ও মল্লিকার সৌগন্ধ ছুটিয়াছে। পক্ষিসকল চকুবুহ চকুবুহ করিতেছে –ঘটকের দরুনবাটীতে বেণীবাবু বরদাবাবুকে লইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন। দক্ষিণ দিক থেকে কতকগুলো কুকুর ডাকিয়া উঠিল ও রাস্তার ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল –গোল একটু নরম হইলে “দূঁর দূঁর” ও “গোপীদের বাড়ি যেও না করি রে মানা” এই খোনা স্বরের আনন্দলহরী কর্ণগোচর হইতে লাগিল। বেণীবাবু ও বরদাবাবু উঠিয়া দেখেন যে বহুবাজারের বেচারামবাবু আসিতেছেন –গানে মত্ত, ক্রমাগত তুড়ি দিতেছেন। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করিতেছে –ছোঁড়ারা হো হো করিতেছে, বহুবাজারনিবাসী বিরক্ত হইয়া দূঁর দূঁর করিতেছেন। নিকটে আসিলে বেণীবাবু ও বারদাবাবু উঠিয়া সম্মানপূর্বক অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন। পরস্পর কুশলবার্তা জিজ্ঞাসানন্তর বেচারামবাবু বারদাবাবুর গায়ে হাত দিয়া বলিলেন –ভাই হে। বাল্যাবধি অনেক প্রকার লোক দেখিলাম –অনেকেরই অনেক গুণ আছে বটে কিন্তু তাহাদিগকে দোষে-গুণে ভালো বালি –সে যাহা হউক, নম্রতা, সরলতা, ধর্ম বিষয়ে সাহস ও পর সম্পর্কীয় শুদ্ধচিত্ত তোমার যেমন আছে এমন কাহারও দেখিতে পাই না। আমি নিজে নম্রভাবে বলি বটে কিন্তু সময়বিশেষ অন্যের অহংকার দেখিলে আমার অহংকার উদয় হয় –অহংকার উদয় হইলেই রাগ উপস্থিত হয়, রাগে অহংকার বেড়ে উঠে। আমি কাহাকেও রেয়াত করি না –যখন যাহা মনে উদয় হয় তখন তাহাই মুখে বলি কিন্তু আমার নিজের দোষে তত সরলতা থাকে না –আপনি কোনো মন্দ কর্ম করিলে সেটি স্পষ্ট স্বীকার করিতে ইচ্ছা হয় না, তখন এই মনে হয় এ কথাটি ব্যক্ত করিলে অন্যের নিকট আপনাকে খাটো হইতে হইবে। ধর্ম বিষয়ে আমার সাহস অতি অল্প –মনে ভালো জানি অমুক কর্ম করা কর্তব্য কিন্তু আপন সংস্কার অনুসারে সর্বদা চলাতে সাহসের অভাব হয়। অন্য সম্বন্ধে শুদ্ধচিত্ত রাখা বড়ো কঠিন –আমি জানি বটে যে মনুষ্যদেহ ধারণ করিলে মনুষ্যের ভালো বই মন্দ কখনই চেষ্টা পাওয়া উচিত নহে কিন্তু এটি কর্মেতে দেখানো বড় দুষ্কর। যদি কেহ একটু কটু কথা বলে তবে তাহার প্রতি আর মন থাকে না –তাহাকে একেবারে মন্দ মনুষ্য বোধ হয় –তোমার কেহ অপকার করিলেও তাহার প্রতি তোমার মন শুদ্ধ থাকে –অর্থাৎ তাহার উপকার ভিন্ন অপকার করণে তোমার মন যায় না এবং যদি অন্যে তোমার নিন্দা করে তাহাতেও তুমি বিরক্ত হও না –এ কি কম গুণ ?
বরদা। যে যাহাকে ভালবাসে সে তাহার সব ভালো দেখে আর যে যাহাকে দেখিতে পারে না সে তাহার চলনও বাঁকা দেখে। আপনি যাহা বলিলেন সে সকল অনুগ্রহের কথা –সে সকল আপনার ভালবাসার দরুন –আমার নিজ গুণের দরুন নহে। সকল সময়ে –সকল বিষয়ে –সকল লোকের প্রতি মন শুদ্ধ রাখা মনুষ্যের প্রায় অসাধ্য। আমাদিগের মনে রাগ, দ্বেষ, হিংসা ও অহংকারে ভরা –এ সকল সংযম কি সহজে হয় ? চিত্তকে শুদ্ধ করিতে গেলে অগ্রে নম্রতা আবশ্যক –কাহার কাহার কপট নম্রতা দেখা যায় –কেহ কেহ ভয়প্রযুক্ত নম্র হয় –কেহ কেহ ক্লেশ অথবা বিপদে পড়িলে নম্র হইয়া থাকে –সে প্রকার নম্রতা ক্ষণিক, নম্রতার স্থায়িত্বের জন্য আমাদিগের মনে এই দৃঢ় সংস্কার হওয়া উচিত যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই মহৎ -তিনিই জ্ঞানময় –তিনিই নিষ্কলঙ্ক ও নির্মল, আমরা আজ আছি –কাল নাই, আমাদিগের বলই বা কি, আর বুদ্ধিই বা কি –আমাদিগের ভ্রম, কুমতি ও কুকর্ম দণ্ডে দণ্ডে হইতেছে তবে অহংকারের কারণ কি ? এরূপ নম্রতা মনে জন্মিলে রাগ, দ্বেষ, হিংসা ও অহংকারের খর্বতা হইয়া আসে, তখন অন্য সমন্ধে শুদ্ধচিত্ত হয় –তখন আপন বিদ্যা, বুদ্ধি, ঐশ্বর্য ও পদের অহংকার প্রকাশ করত পরকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা যায় না –তখন পরের সম্পদ দেখিয়া হিংসা হয় না –তখন পরনিন্দা করিতে ও অন্যকে মন্দ ভাবিতে ইচ্ছা হয় না –তখন অন্যদ্বারা অপকৃত হইলেও তাহার প্রতি রাগ বা দ্বেষ উপস্থিত হয় না –তখন কেবল আপন চিত্ত শোধনে ও পরহিত সাধনে মন রত হয়, কিন্তু এরূপ হওয়া ভারি অভ্যাস ভিন্ন হয় না –এক্ষণে অল্প জ্ঞানযোগ হইলেই বিজাতীয় মাৎসর্য জন্মে –আমি যা বলি –আমি যা করি কেবল তাহাই সর্বোত্তম –অন্যে যা বলে বা করে তাহা অগ্রাহ্য।
বেচারাম। ভাই হে ! কথাগুলা শুনে প্রাণ জুড়ায় –আমার সতত ইচ্ছা তোমার সহিত কথোপকথন করি।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে প্রেমানারায়ণ মজুমদার তাড়াতারি করিয়া আসিয়া সম্বাদ দিল কলিকাতার পুলিসের লোকেরা এক জাল তহমতের মামলার দরুন ঠকচাচাকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যাইতেছে। বেচারামবাবু এই কথা শুনিয়া খুব হয়েছে খুব হয়েছে বলিয়া হর্ষিত হইয়া উঠিলেন। বরদাবাবু স্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিলেন।
বেচারাম। আবার যে ভাবছ ? –অমন অসৎ লোক পুলিপলান গেলা দেশটা জুড়ায়।
বরদা। দুঃখ এই যে লোকটা আজন্মকাল অসৎ কর্ম বই সৎ কর্ম করিল না –এক্ষণে যদি জিঞ্জির যায় তাহার পরিবারগুলা অনাহারে মারা যাবে।
বেচারাম। ভাই হে ! তোমার এত গুণ না হইলে লোকে তোমাকে কেন পূজা করে। তোমার প্রতিহিংসা ও অপকার করিতে ঠকচাচা কসুর করে নাই –অনবরত নিন্দা ও গ্লানি করিতে –তোমার উপর গুমখুনি নালিশ করিয়াছিল –ও জাল হপ্তম করিবার বিশেষ চেষ্টা পাইয়াছিল –তাহাতেও তোমার মনে তাহার প্রতি কিছুমাত্র রাগ অথবা দ্বেষ নাই ও প্রত্যুপকার কাহাকে বলে তুমি জানো না –তুমি এই প্রত্যুপকার করিতে যে, সে ব্যক্তি ও তাহার পরিবার পীড়ত হইলে ঔষধ দিয়া ও আনাগোনা করিয়া আরোগ্য করিত। এক্ষণেও তাহার পরিবারের ভাবনা ভাবিতেছ –ভাই হে ! তুমি জেতে কায়স্থ বটে কিন্তু ইচ্ছা করে যে এমন কায়স্থের পায়ের ধুলা লইয়া মাথায় দিই।
বরদা। মহাশয় ! আমাকে এত বলিবেন না –জনগণের মধ্যে আমি অতি হেয় ও অকিঞ্চন। আমি আপনার প্রশাংসার যোগ্য নহি –মহাশয় এরূপ পুনঃ পুনঃ বলিলে আমার অহংকার ক্রমে বৃদ্ধি হইতে পারে।
এদিকে বৈদ্যবাটীতে পুলিসের সারজন্, পেয়াদা ও দারোগা ঠকচাচাকে পিচ্মোড়া করিয়া বাঁধিয়া চল্ বলিয়া হিড় হিড় করিয়া লইয়া আসিতেছে। রাস্তায় লোকারণ্য –কেহ বলে, যেমন কর্ম তেমনি ফল –কেহ বলে, বেটা জাহাজে না উঠলে বিশ্বাস নাই –কেহ বলে, আমার এই ভয় পাছে ঢোঁড়া হয়। ঠকচাচা অধোবদনে চলিতেছে –দাড়ি বাতাসে ফুর ফুর করিয়া উড়িতেছে –দুটি চক্ষু কট্মট্ করিতেছে –বাঁধন খুলিবার জন্য সারজন্কে একটা আদুলি আস্তে আস্তে দিতেছে, সারজনের বড়ো পেট, এমনি আদুলি ঠিকুরে ফেলিয়া দিতেছে। ঠকচাচা বলে –মোকে একবার মতিবাবুর নজদিগে লিয়ে চলো –তেনার জামিন লিয়ে মোকে এজ খালস দেও –মুই কেল হাজির হব। সারজন্ বলছে –তোম বহুৎ বক্তা –ফের বাত কহেগা তো এক থাপ্পড় দেগা। তখন ঠকচাচা সারজনের নিকট হাতজোড় করিয়া কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল। সারজন কোনো কথায় কান না দিয়ে ঠকচাচাকে নৌকায় উঠাইয়া বেলা দুই প্রহর চারি ঘণ্টার সময় পুলিসে আনিয়া হাজির করিল –পুলিসের সাহেবেরা উঠিয়া গিয়াছে সুতরাং ঠকচাচাকে রাত্রিতে বেনিগারদে বিহার করিতে হইল।
ওদিকে ঠকচাচার দুর্গতি শুনিয়া মতিলালের ভেবা-চাকা লেগে গেল। তাহার এই আশঙ্কা হইল এ বজ্রাঘাত পাছে এ পর্যন্ত পড়ে –যখন ঠক বাঁধা গেল তখন আমিও বাঁধা পড়িব তাহাতে সন্দেহ নাই –বোধ হয় এ ব্যাপার জান কোম্পানির ঘটিত, সে যাহা হউক, সাবধান হওয়া উচিত, এই স্থির করিয়া মতিলাল বাটীর সদর দরওয়াজা খুব কষে বন্ধ করিল। রামগোবিন্দ বলিল –বড়োবাবু ! ঠকচাচা জাল এত্তাহামে গেরেপ্তার হইয়াছে –তোমার উপর, গেরেপ্তারি থাকিলে বাটীঘর অনেকক্ষণ ঘেরা হইত, তুমি মিছে মিছে কেন ভয় পাও ? মতিলাল বলিল –তোমরা বুঝ না হে ! দুঃসময়ে পোড়া শোল মাছটাও হাত থেকে পালিয়ে যায়। আজকের দিনটা যো সো করিয়া কাটাইতে পারিলে কাল প্রাতে যশোহরের তালুকে প্রস্থান করি। বাটীতে আর তিষ্ঠনো ভার –নানা উৎপাত –নানা ব্যাঘাত –নানা আশঙ্কা –নানা উপদ্রব, আর এদিকে হাত খাঁকতি হইয়াছে। এই কথা শেষ হইবামাত্রেই দ্বারে টিপ্ টিপ্ করিয়া ঘা পড়িতে লাগিল –”দ্বার খোলো গো –কে আছে গো” এই শব্দ হইতে লাগিল। মতিলাল আস্তে আস্তে বলিল –চুপ করো –যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহাই ঘটিল। মানগোবিন্দ উপর থেকে উঁকি মারিয়া দেখিল একজন পেয়াদা দ্বার ঠেলিতেছে –অমনি টিপেটিপে আসিয়া বলিল –বড়োবাবু ! এই বেলা প্রস্থান করো, বোধ হয় ঠকচাচা দরুন বাসী গেরেপ্তারি উপস্থিত –আগুনের ফিনকি শেষ হয় নাই। যদি নির্জন স্থান না পাও তবে খিড়কির পানা পুষ্করিণীতে দুর্যোধনের ন্যায় জলস্তম্ভ করে থাকো। দোলগোবিন্দ বলিল –তোমরা ঢেউ দেখে লা ডুবাও কেন ? আগে বিষয়টা তলিয়ে বুঝ, বোসো আমি জিজ্ঞাসা করি –কেমন হে পেয়াদাবাবু তুমি কোন্ আদালত হইতে আসিয়াছ ? পেয়াদা বলিল –এজ্ঞে মুই জান সাহেবের চিঠি লিয়ে এসেছি –চিঠি এই লেও –বলিয়া ধাঁ করিয়া উপরে ফেলিয়া দিল। রাম বাঁচলুম ! এতক্ষণে ধরে প্রাণ এল –সকলে বলিয়া উঠিল। অমনি পেছন দিক থেকে হলধর ও গদাধর “ভবে ত্রাণ করো” ধরিয়া উঠিল, নববাবুদের শরতের মেঘের ন্যায় –এই বৃষ্টি –এই রৌদ্র –এই গর্মি –এই খুশি। মতিলাল বলিল, একটু থামো –চিঠিখানা পড়িতে দেও –বোধ করি কর্মকাজের আবার সুযোগ হইবে। মতিলাল চিঠি খুলিলে পরে নববাবুরা সকলে হুমড়ি খাইয়া পড়িল –অনেকগুলো মাথা জড়ো হইল বটে কিন্তু কাহারো পেটে কালির অক্ষর নাই, চিঠি পড়া ভারি বিপত্তি হইল। অনেকক্ষণ পরে নিকটস্থ দে-দের বাটীর একজনকে ডাকাইয়া চিঠির মর্ম এই জানা হইল যে, জান সাহেবের প্রায় অনাহারে দিন যাইতেছে –তাহার টাকার বড়ো দরকার। মানগোবিন্দ বলিল –বেটা বড়ো বেহায়া –তাহার জন্যে এত টাকা গর্ভস্রাবে গেল তবু ছিড়েন নাই, আবার কোন মুখে টাকা চায় ? দোলগোবিন্দ বলিল –ইংরাজকে হাতে রাখা ভালো –ওদের পাতা চাপা কপাল –সময় বিশেষে মাটি মুটটা ধরিলে সোনা মুটটা হইয়া পড়ে। মতিলাল বলিল –তোমরা বকাবকি কেন করো আমাকে কাটিলেও রক্ত নাই –কুটিলেও মাংস নাই।
এখানে বালি হইতে বেচারামবাবু পার হইয়া বৈকালে ছক্ড়া গাড়িতে ছড়র ছড়র শব্দে “সেই যে ভস্মমাখা জটে –যত দেখো ঘটে পটে সকল জটের মুটে” এই গান গাইতে গাইতে উত্তরমুখো চলিয়াছেন –দক্ষিণ দিক থেকে বাঞ্ছারাম বগি হাঁকাইয়া আসিতেছেন –দুইজনে নেক্টা-নেক্টি হওয়াতে ইনি ওঁকে ও উনি একে হুমড়ি খাইয়া দেখিলেন –বাঞ্ছারাম বেচারামের আবছায়া দেখিবা মাত্রেই ঘোড়াকে সপাসপ্ চাবুক কষিয়া দিলেন –বেচারাম অমনি তাড়াতাড়ি আপন গাড়ির ডল্কা দ্বার হাত দিয়া কষে ধরিয়া ও মাথা বাহির করিয়া “ওহে বাঞ্ছারাম ! ওহে বাঞ্ছারাম !” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেন। এই ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকিতে বগি খাড়া হইল ও ছক্ড়া ছননন্ ছননন্ করিয়া নিকটে গেল। বেচারামবাবু বলিলেন –বাঞ্ছারাম ! কপালে পুরুষ –তোমার লাভের খুলি রাবণের চুলির মতো জ্বলছে –এক দফা তো সৌদাগরি কর্ম চৌচাপটে করলে –এক্ষণে তোমার ঠকচাচা যায় –বোধ হয় তাহাতেও আবার একটা মুড়ি পট্তে পারে –কেবল উকিলি ফন্দিতে অধঃপাতে গেলে –মরিতে যে হবে –সেটা একবারও ভাবলে না ?
বাঞ্ছারাম বিরক্ত হইয়া মুখখানা গোঁজ করিলে পর গোঁপ জোড়াটা ফর ফর করিয়া ঘোড়ার পিটের উপর আপনার গায়ের জ্বালা প্রকাশ করিতে করিতে গড়্ গড়্ করিয়া চলিয়া গেলেন।
২৫.
মতিলালের যশোহর জমিদারিতে দলবল সহিত গমন –জমিদারী কর্মকরণের বিবরণ; নীলকরের সঙ্গে দাঙ্গা ও বিচারে নীলকরের খালাস।
বাবুরামবাবুর সকল বিষয় অপেক্ষা যশোহরের তালুকখানি লাভের বিষয় ছিল। দশসালা বন্দোবস্তের সময়ে ঐ তালুকে অনেক পতিত জমি থাকে –তাহার জমা ডৌলে মুসমা ছিল পরে ঐ সকল জমি হাঁসিল হইয়া মাঠ-হারে বিলি হয় ও ক্রমেই জমির এত গুমর হইয়াছিল যে, প্রায় এক কাঠাও খামার বা পতিত ছিল না, প্রজালোকও কিছুদিন চাষাবাদ করিয়া হরবিরূ ফসলের দ্বারা বিলক্ষণ যোত্র করিয়াছিল কিন্তু ঠকচাচার পরামর্শে অনেকের উপর পীড়ন হওয়াতে প্রজারা সিকস্ত হইয়া পড়িল –অনেকে লাখেরাজদারের জমি বাজেয়াপ্ত হওয়াতে ও তাহাদিগের সনন্দ না থাকাতে
তাহারা কেবল আনাগোনা করিয়া ও নজর সেলামী দিয়া ক্রমে ক্রমে প্রস্থান করিল ও অনেক গাঁতিদারও জাল ও জুলুমে ভাজাভাজা হইয়া বিনি মূল্যে আপন আপন জমির স্বত্ব ত্যাগ করত অন্য অন্য অধিকারে পলায়ন করিল। এই কারণে তালুকের আয় দুই-এক বৎসর বৃদ্ধি হওয়াতে ঠকচাচা গোঁপে চাড়া দিয়া হাত ঘুরাইয়া বাবুরামবাবুর নিকট বলিতেন –”মোর কেমন কারদানি দেখো” কিন্তু “ধর্মস্য সূক্ষ্মা গতিঃ” –অল্পদিনের মধ্যেই অনেক প্রজা ভয়ক্রমে হেলে গোরু ও বীজধান লইয়া প্রস্থান করিল। তাহাদিগের জমি বিলি করা ভার হইল, সকলেরই মনে এই ভয় হইতে লাগিল আমরা প্রাণপণ পরিশ্রমে চাষাবাস করিব দু-টাকা দু-সিকি লাভ করিয়া যে একটু শাঁসালো হবে তাহাকেই জমিদার বল বা ছলক্রমে গ্রাস করবেন –তবে আমাদিগের এ অধিকার থাকার কি প্রয়োজন ? তালুকের নায়েব বাপু-বাছা বলিয়াও প্রজালোককে থামাইতে পারিল না। অনেক জমি গরবিলি থাকিল –ঠিকে হারে বিলি হওয়া দূরে থাকুক কম দস্তুরেও কেহ লইতে চাহে না ও নিজ আবাদে খরচ খরচা বাদে খাজনা উঠানো ভার হইল। নায়েব সর্বদাই জমিদারকে এত্তেলা দিতেন, জমিদার সুদামতো পাঠ লিখিতেন –”গোগেস্তা সুরত খাজনা আদায় না হইলে তোমার রুটি যাইবে –তোমার কোনো ওজর শুনা যাইবে না।” সময়বিশেষ বিষয় বুঝিয়া ধমক দিলে কর্মে লাগে। যে স্থলে উৎপাত ধমকের অধিন নহে সে স্থলে ধমক কি কর্মে আসিতে পারে ? নায়েব ফাঁপরে পড়িয়া গয়ং গচ্ছরূপে আমতা আমতা করিয়া চলিতে লাগিল –এদিকে মহল দুই-তিন বৎসর বাকি পড়াতে লাটবন্দী হইল সুতরাং বিষয় রক্ষার্থে গিরিবি লিখিয়া দিয়া বাবুরামবাবু দেনা করিয়া সরকারের মালগুজারি দাখিল করিতেন।
এক্ষণে মতিলাল দলবল সহিত মহলে আসিয়া অবস্থিতি করিল। তাহার মানস এই যে, তালুক থেকে কষে টাকা আদায় করিয়া দেনা-টেনা পরিশোধ করিয়া সাবেক ঠাট বজায় রাখিবে। বাবু জমিদারী কাগজ কখন দৃষ্টি করেন নাই, কাহাকে বলে চিঠা, কাহাকে বলে গোসোয়ারা, কাহাকে বলে জমাওয়াসিল বাকি কিছুই বোধ নাই। নায়েব বলে –হুজুর ! একবার লতাগুলান দেখুন –বাবু কাগজের লতার উপর দৃষ্টি না করিয়া কাছারিবাটীর তরুলতার দিকে ফেল্ ফেল্ করিয়া দেখে ! নায়েব বলে, মহশয় ! এক্ষণে গাঁতি অর্থাৎ খোদকস্তা প্রজা এত ও পাইকস্তা এত। বাবু বলেন― আমি খোদকস্তা, পাইকস্তা শুনতে চাই না –আমি সব এককস্তা করিব। বড়োবাবু ডিহির কাছারিতে আসিয়াছেন এই সংবাদ শুনিয়া যাবতীয় প্রজা একেবারে ধেয়ে আইল ও মনে করিল বদ্জাত নেড়ে বেটা গিয়েছে, বুঝি এত দিনের পর আমাদিগের কপাল ফিরিল। এই কারণে আহ্লাদিতচিত্তে ও সহাস্যবদনে রুক্ষচুলো, শুখনোপেটা ও তলাখাঁক্তি প্রজারা নিকটে আসিয়া সেলামী দিয়া “রবধান” ও “স্যালাম” করিতে লাগিল। মতিলাল ঝনাঝন্ শব্দে স্তুব্ধ হইয়া লিক্ লিক্ করিয়া হাসিতেছেন। বাবুকে খুশি দেখিয়া প্রজারা দাদ্খাই করিতে আরম্ভ করিল। কেহ বলে, অমুক আমার জমির আল ভাঙিয়া লাঙ্গল চষিয়াছে –কেহ বলে, অমুক আমার খেজুরগাছে ভাঁড় বাঁধিয়া রস চুরি করিয়াছে –কেহ বলে, অমুক আমার বাগানে গোরু ছাড়িয়া দিয়া তচ্নচ্ করিয়াছে –কেহ বলে, অমুকের হাঁস আমার ধান খাইয়াছে –কেহ বলে, আমি আজ তিন বৎসর কবজ পাই না –কেহ বলে, আমি খতের টাকা আদায় করিয়াছি, আমার খত ফেরত দাও –কেহ বলে –আমি বাবলা গাছটি কেটে বিক্রি করিয়া ঘরখানি সারাইব –আমাকে চৌট মাফ করিতে হুকুম হউক –কেহ বলে, আমার জমির খারিজ দাখিল হয় নাই আমি তার সেলামি দিতে পারিব না –কেহ বলে, আমার জোতের জমি হাল জরিপে কম হইয়াছে –আমার খজনা মুসমা দেও, তা না হয় তো পরতাল করে দেখো –মতিলাল এ সকল কথার বিন্দু বিসর্গ না বুঝিয়া চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া থাকিলেন। সঙ্গী বাবুরা দুই-একটা অন্খা শব্দ লইয়া রঙ্গ করত খিল্ খিল্ হাসিয়া কাছারিবাটী ছেয়ে দিতে লাগিল ও মধ্যে মধ্যে “উড়ে যায় পাখী তার পাখা গুণি” গান করিতে লাগিল। নায়েব একেবারে কাষ্ঠ, প্রজারা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
যেখানে মনিব চৌকস, সেখানে চাকরের কারিকুরি বড়ো চলে না। নায়েব মতিলালকে গোমুর্খ দেখিয়া নিজমূর্তি ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করিতে লাগিল। অনেক মামলা উপস্থিত হইল, বাবু তাহার ভিতর কিছুই প্রবেশ করিতে পারিলেন না, নায়েব তাঁহার চক্ষে ধুলা দিয়া আপন ইষ্ট সিদ্ধ করিতে লাগিল আর প্রজারাও জানিল যে, বাবুর সহিত দেখা করা কেবল অরণ্যে রোদন করা –নায়েবই সর্বময় কর্তা।
যশোহরে নীলকরের জুলুম অতিশয় বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রজারা নীল বুনিতে ইচ্ছুক নহে কারণ ধান্যাদি বোনাতে অধিক লাভ, আর যিনি নীলকরের কুঠিতে যাইয়া একবার দাদন লইয়াছেন, তাহার দফা একেবারে রফা হয়। প্রজারা প্রাণপণে নীল আবাদ করিয়া দাদনের টাকা পরিশোধ করে বটে কিন্তু হিসাবের লাঙ্গুল বৎসর বৃদ্ধি হয় ও কুঠেলের গোমস্তা ও অন্যান্য কারপরদাজের পেট অল্পে পুরে না। এইজন্য যে প্রজা একবার নীলকরের দাদনের সুধামৃত পান করিয়াছে সে আর প্রাণান্তে কুঠির মুখো হইতে চায় না কিন্তু নীলকরের নীল না তৈয়ার হইলে ভারি বিপত্তি। সম্বৎসর কলিকাতার কোনো না কোনো সৌদাগরের কুঠি হইতে টাকা কর্জ লওয়া হইয়াছে এক্ষণে যদ্যপি নীল তৈয়ার না হয় তবে কর্জ বৃদ্ধি হইবে ও পরে কুঠি উঠিয়া গেলেও যাইতে পারিবে। অপর যে সকল ইংরাজ কুঠির কর্ম কাজ দেখে তাহারা বিলাতে অতি সামান্য লোক কিন্তু কুঠিতে শাজাদার চেলে চলে –কুঠির কর্মের ব্যাঘাত হইলে তাহদিগের এই ভয় যে, পাছে তাহাদিগের আবার ইঁদুর হইতে হয়। এই কারণে নীল তৈয়ার করণার্থ তাহারা সর্বপ্রকারে, সর্বতোভাবে, সবসময়ে যত্নবান হয়।
মতিলাল সঙ্গীগণকে লইয়া হো হো করিতেছেন –নায়েব নাকে চশমা দিয়া দপ্তর খুলিয়া লিখিতেছে ও চুনো বুলাইতেছে, এমতো সময়ে কয়েকজন প্রজা দৌড়ে আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল –মোশাই গো ! কুঠেল বেটা মোদের সর্বনাশ করলে –বেটা সরে জমিতে আপনি এসে মোদের বুননি জমির উপর লাঙ্গল দিতেছে ও হাল-গরু সব ছিনিয়ে নিয়েছে –মোশাই গো ! বেটা কি বুননি নষ্ট করলে। শালা মোদের পাকা ধানে মই দিলে। নায়েব অমনি শতাবধি পাক-সিক জড়ো করিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখে কুঠেল এক শোলার টুপি মাথায় –মুখে চুরুট –হাতে বন্দুক –খাড়া হইয়া হাঁকাহাঁকি করতেছে। নায়েব নিকটে যাইয়া মেঁও মেঁও করিয়া দুই-একটা কথা বলিল, কুঠেল হাঁকায় দেও হাঁকায় দেও, মার মার হুকুম দিল। অমনি দুই পক্ষের লোক লাঠি চালাইতে লাগিল –কুঠেল আপনি তেড়ে এসে গুলী ছুঁড়িবার উপক্রম করিল –নায়েব সরে গিয়া একটা রাংচিত্রের বেড়ার পার্শ্বে লুকাইল। ক্ষণেক কাল মারামারি লাঠালাঠি হইলে পর জমিদারের লোক ভেগে গেল ও কয়েক জন ঘায়েল হইল। কুঠেল আপন বল প্রকাশ করিয়া ডেংডেং করিয়া কুঠিতে চলে গেল ও দাদখায়ী প্রজারা বাটিতে আসিয়া “কি সর্বনাশ” “কি সর্বনাশ” বলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
নীলকরসাহেব দাঙ্গা করিয়া কুঠিতে যাইয়া বিলাতি পানি ফটাস্ করিয়া ব্রান্ডি দিয়া খাইয়া শিস দিতে দিতে “তাজা বতাজা” গান করিতে লাগিলেন –কুকুরটা সম্মুখে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করিতেছে। তিনি মনে জানেন তাহাকে কাবু করা বড় কঠিন, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ্ তাঁহার ঘরে সর্বদা আসিয়া খানা খান ও তাঁহাদিগের সহিত সহবাস করাতে পুলিসের ও আদালতের লোক তাঁহাকে যম দেখে আর যদিও তদারক হয় তবু খুন অথবা অন্য প্রকার গুরুতর দোষ করিলে মফস্বল আদালতে তাহাদিগের সদ্য বিচার হইয়া সাজা হয় –গোরা লোক ঐ সকল দোষ করিলে সুপ্রিম কোর্টে চালান হয় তাহাতে সাক্ষী অথবা ফৈরাদিরা ব্যয়, ক্লেশ ও কর্মক্ষতি জন্য নাচার হইয়া অস্পষ্ট হয় সুতরাং বড়ো আদালতে উক্ত ব্যক্তিদের মকদ্দমা বিচার হইলেও ফেঁসে যায়।
নীলকর যা মনে করিয়াছেন, তাহাই ঘটিল। পরদিন প্রাতে দারোগা আসিয়া জমিদারের কাছারি ঘিরিয়া ফেলিল। দুর্বল হওয়া বড়ো আপদ্ –সবল ব্যক্তির নিকট কেহই এগুতে পারে না। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া ঘরের ভিতর যাইয়া দ্বার বন্ধ করিল। নায়েব সম্মুখে আসিয়া মোটমাট চুক্তি করিয়া অনেকের বাঁধন খুলিয়া দেওয়াইল। দারোগা বড়োই সোরসারাবত করিতেছিল –টাকা পাইবামাত্র যেন আগুনে জল পড়িল। পরে তদারক করিয়া দারোগা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দু-দিক বাঁচাইয়া রিপোর্ট করিল –এদিকে লোভ ওদিকে ভয়। নীলকর অমনি নানা প্রকার জোগাড়ে ব্যস্ত হইল ও ম্যাজিস্ট্রেটের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইতে লাগিল যে, নীলকর ইংরাজ খ্রীষ্টিয়ান –মন্দ কর্ম কখনই করিবে না –কেবল কালা লোক যাবতীয় দুষ্কর্ম করে। এই অবকাশে সেরেস্তাদার ও পেস্কার নিলকরের নিকট হইতে জেয়াদা ঘুষ লইয়া তাহার বিপক্ষে জবানবন্দী চাপিয়া স্বপক্ষীয় কথা সকল পড়িতে আরম্ভ করিল ও ক্রমশ ছুঁচ চালাইতে চালাইতে বেটে চালাইতে লাগিল। এই অবকাশে নীলকর বক্তৃতা করিল –আমি এ স্থানে আসিয়া বাঙালীদিগের নানা প্রকার উপকার করিতেছি – আমি তাহাদিগের লেখাপড়া ও ঔষধপত্রের জন্য বিশেষ ব্যয় করিতেছি –আবার আমার উপর এই তহমত? বাঙালীরা বড়ো বেঈমান ও দাঙ্গাবাজ। ম্যাজিস্ট্রেট এই সকল কথা শুনিয়া টিফিন করিতে গেলেন। টিফিনের পর খুব চুর্চুরে মধুপান করিয়া চুরুট খাইতে খাইতে আদালতে আইলেন –মকদ্দমা পেশ হইলে সাহেব কাগজ পত্রকে বাঘ দেখিয়া সেরেস্তাদারকে একেবারে বলিলেন –”এ মামলা ডিসমিস করো” এই হুকুমে নীলকরের মুখটা একেবারে ফুলিয়া উঠিল, নায়েবের প্রতি তিনি কট্মট্ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। নায়েব অধোবদনে ঢিকুতে ঢিকুতে –ভুঁড়ি নাড়িতে নাড়িতে বলিতে বলিতে চলিলেন –বাঙালীদের জমিদারী রাখা ভার হইল –নীলকর বেটাদের জুলুমে মুলুক খাক হইয়া গেল –প্রজারা ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। হাকিমরা স্বজাতির অনুরোধে তাহাদিগের বশ্য হইয়া পড়ে আর আইনের যেরূপ গতিক তাহাতে নীলকরদের পালাইবার পথও বিলক্ষণ আছে। লোকে বলে জমিদারের দৌরাত্ন্যে প্রজার প্রাণ গেল–এটি বড়ো ভুল। জমিদারেরা জুলুম করে বটে কিন্তু প্রজাকে যতনে বজায় রেখে করে, প্রজা জমিদারের বেগুনক্ষেত। নীলকর সে রকমে চলে না –প্রজা মরুক বা বাঁচুক তাহাতে তাহার বড়ো এসে যায় না –নীলের চাষ বেড়ে গেলেই সব হইল –প্রজা নীলকরের প্রকৃত মূলার ক্ষেত।
২৬.
ঠকচাচার বেনিগারদে নিদ্রাবস্থায় আপন কথা আপনি ব্যক্তকরণ, পুলিসে বাঞ্ছারাম ও বটলরের সহিত সাক্ষাৎ, মকদ্দমা বড়ো আদালতে চালান, ঠকচাচার জেলে কয়েদ, জেলেতে তাহার সহিত অন্যান্য কয়েদীর কথাবার্তা ও তাহার খাবার অপহরণ।
মনের মধ্যে ভয় ও ভাবনা প্রবেশ করিলে নিদ্রার আগমন হয় না। ঠকচাচা বেনিগারদে অতিশয় অস্থির হইলেন,একখানা কম্বলের উপর পড়িয়া এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলেন। উঠিয়া এক একবার দেখেন রাত্রি কত আছে। গাড়ির শব্দ অথবা মনুষ্যের স্বর শুনিলে বোধ করেন এইবার বুঝি প্রভাত হইল। এক একবার ধড়মড়িয়া উঠিয়া সিপাইদিগকে জিজ্ঞাসা করেন –”ভাই ! ভাই ! রাত কেত্না হুয়া? –তাহারা বিরক্ত হইয়া বলে, “আরে কামান দাগ্নেকো দো তিন ঘন্টা দের হেয় আব লৌট রহো, কাহে হর্ ঘড়ি দেক করতে হো?” ঠকচাচা ইহা শুনিয়া কম্বলের উপর গড়াগড়ি দেন। তাঁহার মনে নানা কথা –নানা ভাব –নানা উপায় উদয় হয়। কখন কখন ভাবেন –আমি চিরকালটা জুয়াচুরি ও ফেরেবি মতলবে কেন ফিরলাম –ইহাতে যে টাকাকড়ি রোজগার হইয়াছিল তাহা কোথায়? পাপের কড়ি হাতে থাকে না, লাভের মধ্যে এই দেখি যখন মন্দ কর্ম করিয়াছি তখন ধরা পড়িবার ভয়ে রাত্রে ঘুমাই নাই –সদাই আতঙ্কে থাকিতাম –গাছের পাতা নড়িলে বোধ হইত যেন কেহ ধরিতে আসিতেছে। আমার হামজোলফ খোদাবক্স আমাকে এ প্রকার ফেরেক্কায় চলিতে বার বার মানা করিতেন –তিনি বলিতেন, চাষবাস অথবা কোনো ব্যবসা বা চাকরি করিয়া গুজরান করা ভালো, সিদে পথে থাকিলে মার নাই –তাহাতে শরীর ও মন দুই ভালো থাকে। এইরূপ চলিয়াই খোদাবক্স সুখে আছেন। হায় ! আমি তাহার কথা কেন শুনিলাম না। কখন কখন ভাবেন উপস্থিত বিপদ্ হইতে কি প্রকারে উদ্ধার পাইব? উকিল কৌনসুলি না ধরিলে নয় –প্রমাণ না হইলে আমার সাজা হইতে পারে না –জাল কোন্খানে হয় ও কে করে তাহা কেমন করিয়া প্রকাশ হইবে? এইরূপ নানা প্রকার কথার তোলপাড় করিতে করিতে ভোর হয় হয় এমতো সময়ে শ্রান্তিবশত ঠকচাচার নিদ্রা হইল, তাহাতে আপন দায় সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে ঘুমের ঘোরে বকিতে লাগিলেন –”বাহুল্য! তুলি, কলম ও কল কেহ যেন দেখিতে পায় না –শিয়ালদার বাড়ির তালায়ের ভিতর আছে –বেশ আছে –খবর্দার তুলিও না –তুমি জল্দি ফরিদপুরে পেলিয়ে যাও –মুই খালাস হয়্যে তোমার সাত মোলাকাত করবো।”
প্রভাত হইয়াছে –সূর্যের আভা ঝিলিমিলি দিয়া ঠকচাচার দাড়ির উপর পড়িয়াছে। বেনিগারদের জমাদার তাহার নিকট দাঁড়াইয়া ঐ সকল কথা শুনিয়া চীৎকার করিয়া বলিল –”বদ্জাত ! আবতলক শোয়া হেয় –উঠো, তোম আপ্না বাত আপ্ জাহের কিয়া।” ঠকচাচা অমনি ধড়মড়িয়ে উঠিয়া চকে, নাকে ও দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তস্বি পড়িতে লাগলেন। জমাদারের প্রতি এক একবার মিটমিট করিয়া দেখেন –এক একবার চক্ষু মুদিত করেন। জমাদার ভ্রূকুটি করিয়া বলিল –তোম্ তো ধরম্কা ছালা লে করকে বয়টা হেয় আর শেয়ালদাকো তালায়সে কল-ওল নেকালনেসে তেরি ধরম আওরভি জাহের হোগা। ঠকচাচা এই কথা শুনিবামাত্রে কদলীবৃক্ষের ন্যায় ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন ও বলিলেন “বাবা! মেরি বাইকো বহুত জোর হুয়া। এস সবসে হাম নিদ জানেসে জুট মুট বক্তা হুঁ !” “ভালা ও বাত পিছু বোঝা জাওঙ্গি –আব তৈয়ার হো” এই বলিয়া জমাদার চলিয়া গেল।
এদিকে দশটা ঢং ঢং করিয়া বাজিল, অমনি পুলিসের লোকেরা ঠকচাচা ও অন্যান্য আসামীদিগকে লইয়া হাজির করিল। নয়টা না বাজিতে বাজিতে বাঞ্ছারামবাবু বটলর সাহেবকে লইয়া পুলিসে ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছিলেন ও মনে মনে ভাবিতেছিলেন –ঠকচাচাকে এ যাত্রা রক্ষা করিলে তাহার দ্বারা অনেক কর্ম পাওয়া যাইবে –লোকটা বলতে-কহিতে, লিখিতে-পড়তে, যেতে-আসতে, কাজে-কর্মে, মামলা-মকদ্দমায়, মতলব-মসলতে বড়ো উপযুক্ত। কিন্তু আমার হচ্ছে এ পেশা –টাকা না পাইলে কিছুই তদ্বির হইতে পারে না। ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াইতে পারি না, আর নাচতে বসেছি ঘোমটাই বা কেন? ঠকচাচাও তো অনেকের মাথা খেয়েছেন তবে ওঁর মাথা খেতে দোষ কি ? কিন্তু কাকের মাংস খাইতে গেলে বড়ো কৌশল চাই। বটলর সাহেব বাঞ্ছারামকে অন্যমনস্ক দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল –বেন্সা ! তোম্ কিয়া ভাবতা ? বাঞ্ছারাম উত্তর করিলেন –বোসো সাহেব; হাম রূপেয়া যে সুরতনে ঘরমে ঢোকে ওই ভাবতা। বটলর সাহেব একটু অন্তরে গিয়া বলিলেন –”আস্সা আস্সা –বহুত আস্সা।”
ঠকচাচাকে দেখিবামাত্র বাঞ্ছারাম দৌড়ে গিয়া তাহার হাত ধরিয়া চোক দু-টো পান্সে করিয়া বলিলেন –একি একি! কাল কুসংবাদ শুনিয়া সমস্ত রাত্রিটা বসিয়া কাটাইয়াছি, একবারও চক্ষু বুজি নাই –ভোর হতে না হতে পূজা-আহ্ণিক অমনি ফুলতোলা রকমে সেরে সাহেবকে লইয়া আসিতেছি। ভয় কি ? এ কি ছেলের হাতের পিটে? পুরুষের দশ দশা, আর বড়ো গাছেই ঝড় লাগে। কিন্তু এক কিস্তি টাকা না হইলে তদ্বিরাদি কিছুই হইতে পারে না –সঙ্গে না থাকে তো ঠকচাচীর দুই-একখানা ভারি রকম গহনা আনাইলে কর্ম চলতে পারে। এক্ষণে তুমি তো বাঁচো তার পরে গহনা-টহনা সব হবে। বিপদে পড়িলে সুস্থির হইয়া বিবেচনা করা বড়ো কঠিন, ঠক-চাচা তৎক্ষণাৎ আপন পত্নীকে এক পত্র লিখিয়া দিলেন। ঐ পত্র লইয়া বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্বক চক্ষু টিপিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে একজন সরকারের হাতে দিলেন এবং বলিলেন –তুমি ধাঁ করিয়া বৈদ্যবাটী যাইয়া ঠকচাচীর নিকট হইতে কিছু ভারি রকম গহনা আনিয়া এখানে অথবা আপিসে দেখতে দেখতে আইস, দেখিও গহনা খুব সাবধান করিয়া আনিও, বিলম্ব না হয়, যাবে আর আসবে –যেন এইখানে আছো। সরকার রুষ্ট হইয়া বলিল –মহাশয়। মুখের কথা, অমনি বললেই হইল ? কোথায় কলিকাতা –কোথায় বৈদ্যবাটী –আর ঠকচাচীই বা কোথা ? আমাকে অন্ধকারে ঢেলা মারিয়া বেড়াইতে হইবে, এক মুঠা খাওয়া দূরে থাকুক এখনও এক ঘটি জল মাথায় দিই নাই –আজ ফিরে কেমন করিয়া আসতে পারি ? বাঞ্ছারাম অমনি রেগেমেগে হুম্কে উঠিয়া বলিলেন,–ছোটলোক এক জাতই স্বতন্তর, এরা ভালো কথার কেউ নয়, নাতি-ঝেঁটা না হলে জব্দ হয় না। লোকে তল্লাশ করিয়া দিল্লী যাইতেছে, তুমি বৈদ্যবাটী গিয়া একটা কর্ম নিকেশ করিয়া আসতে পারো না ? সাকুব হইলে ইশারায় কর্ম-বুঝে –তোর চোকে আঙুল দিয়া বললুম তাতেও হোঁশ হইল না ? সরকার অধোমুখে না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বেটো ঘোড়ার ন্যায় ঢিকুতে ঢিকুতে চলিল ও আপনা আপনি বলিতে লাগিল –দুঃখী লোকের মানই বা কি আর অপমানই বা কি ? পেটের জন্য সকলই সহিতে হয়। কিন্তু হেন দিন কবে হবে যে ইনি ঠকচাচার মতো ফাঁদে পড়বেন। আমার দেক্তা উনি অনেক লোকের গলায় ছুরি দিয়াছেন –অনেক লোকের ভিটে মাটি চাটি করিয়াছেন –অনেক লোকের ভিটায় ঘু ঘু চরাইয়াছেন। বাবা ! অনেক উকিলের মুৎসুদ্দি দেখিয়াছি বটে কিন্তু ওর জুড়ি নাই। রকমটা –ভাজেন পটোল, বলেন ঝিঙ্গা, যেখানে ছুঁচ চলে না সেখানে বেটে চালান। এদিকে পূজা-আহ্ণিক, দোল-দুর্গোৎসব, ব্রাহ্মণভোজন ও ইষ্টনিষ্ঠাও আছে। এমন হিন্দুয়ানির মুখে ছাই –আগাগোড়া হারামজাদ্কি ও বদ্জাতি !
এখানে ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম ও বটলর বসিয়া আছেন, মকদ্দমা আর ডাক হয় না। যত বিলম্ব হইতেছে তত ধরফড়ানি বৃদ্ধি হইতেছে। পাঁচটা বাজে বাজে এমন সময়ে ঠকচাচাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে লইয়া খাড়া করিয়া দিল। ঠকচাচা গিয়া সেখানে দেখেন যে শিয়ালদার পুষ্করিণী হইতে জাল করিবার কল ও তথাকার দুই-একজন গাওয়া আনিত হইয়াছে। মকদ্দমার তদারক হওনান্তর ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন যে, এ মামলা বড়ো আদালতে চালান হউক। আসামীর জামিন লওয়া যাইতে পারা যায় না সুতরাং তাহাকে বড়ো জেলে কয়েদ থাকিতে হইবে।
ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম হইবামাত্রে বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া হাত নাড়িয়া বলিলেন –ভয় কি ? একি ছেলের হাতের পিটে ? এ তো জানাই আছে যে,মকদ্দমা বড়ো আদালতে হবে –আমরাও তাই তো চাই। ঠকচাচা মুখখানি ভাবনায় একেবারে শুকিয়ে গেল। পেয়াদা হাত ধরিয়া হিড় হিড় করিয়া নীচে টানিয়া জেলে চালান করিয়া দিল। চাচা টংয়স্ টংয়স্ করিয়া চলিয়াছেন –মুখে বাক্য নাই –চক্ষু তুলিয়া দেখেন না, পাছে কাহারো সহিত দেখা হয় –পাছে কেহ পরিহাস করে। সন্ধ্যা হইয়াছে এমন সময় ঠকচাচা শ্রীঘরে পদার্পণ করিলেন। বড়ো জেলেতে যাহারা দেনার জন্য অথবা দেওয়ানি মকদ্দমা ঘটিত কয়েদ হয় তাহারা একদিকে ও যাহারা ফৌজদারী মামলা হেতু কয়েদ হয় তাহারা অন্য দিকে থাকে। ঐ সকল আসামির বিচার হইলে হয়তো তাহাদিগের ঐ স্থানে মিয়াদ খাটিতে নয়তো হরিং বাটীতে সুরকি কুটিতে হয় অথবা জিঞ্জির বা ফাঁসি হয়। ঠকচাচাকে ফৌজদারী জেলে থাকিতে হইল, তিনি ঐ স্থানে প্রবেশ করিলে যাবতীয় কয়েদী আসিয়া ঘেরিয়া বসিল। ঠকচাচা কটমট করিয়া সকলকে দেখিতে লাগিলেন –একজন আলাপীও দেখিতে পান না। কয়েদীরা বলিল, মুনশীজি !–দেখো কি ? তোমারও যে দশা আমাদেরও সেই দশা, এখন আইস মিলে-জুলে থাকা যাউক। ঠকচাচা বলিলেন –হাঁ বাবা ! মুই নাহক আপদে পড়েছি –মুই খাইনে, ছুঁইনে, মোর কেবল নসিবের ফের। দুই-একজন প্রাচীন কয়েদী বলিল –হাঁ তা বই কি ! অনেকেই মিথ্যা দায়ে মজে যায়। একজন মুখফোড় কয়েদী বলিয়া উঠিল –তোমার দায় মিথ্যা আমাদের বুঝি সত্য ? আঃ। বেটা কি সাওখোড় ও সরফরাজ ? ওহে ভাইসকল সাবধান –এ দেড়ে বেটা বড়ো বিট্কেলে লোক। ঠকচাচা অমনি নরম হইয়া আপনাকে খাটো করিলেন কিন্তু তাহারা ঐ কথা লইয়া অনেকে ক্ষণেক কাল তর্ক-বিতর্ক করিতে ব্যস্ত হইল। লোকের স্বভাবই এই, কোনো কর্ম না থাকিলে একটু সূত্র ধরিয়া ফাল্তো কথা লইয়া গোলমাল করে।
জেলের চারিদিক বন্ধ হইল –কয়েদীরা আহার করিয়া শুইবার উদ্যোগ করিতেছে, ইত্যবসরে ঠকচাচা এক প্রান্তভাগে বসিয়া কাপড় বাঁধা মিঠাই খুলিয়া মুখে ফেলিতে যান অমনি পেছন দিকে থেকে দুই দুই বেটা মিশ কালো কয়েদী –গোঁপ, চুল ও ভুরু সাদা, চোক লাল –হাহা হাহা শব্দে বিকট হাস্য করত মিঠায়ের ঠোঙাটি সট্ করিয়া কাড়িয়া লইল এবং দেখাইয়া দেখাইয়া টপ টপ করিয়া খাইয়া ফেলিল। মধ্যে মধ্যে চর্বণকালীন ঠকচাচার মুখের নিকট মুখ আনিয়া হিহি হিহি করিয়া হাসিতে লাগিল। ঠকচাচা একেবারে অবাক –আস্তে আস্তে মাদুরির উপর গিয়া সুড় সুড় করিয়া শুইয়া পড়িলেন, যেন কিল খেয়ে কিল চুরি।
২৭.
বাদার প্রজার বিবরণ –বাহুল্যের বৃত্তান্ত ও গ্রেপ্তারি, গাড়ি-চাপা লোকের প্রতি বরদাবাবুর সততা,বড়ো আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা করণের ধারা,বাঞ্ছারামের দৌড়াদোড়ি,ঠকচাচা ও বাহুল্যের বিচার ও সাজা।
বাদাতে ধানকাটা আরম্ভ হইয়াছে, সালতি সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়াছে –চারিদিক জলময় –মধ্যে মধ্যে চৌকি দিবার টং, কিন্তু প্রজার নিস্তার নাই –এদিকে মহাজন ওদিকে জমিদারের পাইক। যদি বিকি ভালো হয় তবে তাহদিগের দুই বেলা দুই মুঠা আহার চলিতে পারে নতুবা মাছটা, শাকটা ও জনখাটা ভরসা। ডেঙাতে কেবল হৈমন্তী বুনন হয় –আউস প্রায় বাদাতেই জন্মে। বঙ্গদেশে ধান্য অনায়াসে উৎপন্ন হয় বটে কিন্তু হাজা, শুকা, পোকা, কাঁকড়া ও কার্তিকে ঝড়ে ফসলের বিলক্ষণ ব্যাঘাত হয়; আর ধানের পাইটও আছে, তদারক না করিলে কলা ধরিতে পারে। বাহুল্য প্রাতঃকালে আপন জোতের জমি তদারক করিয়া আপন বাটীর দাওয়াতে বসিয়া তামাক খাইতেছেন; সম্মুখে একটা কাগজের দপ্তর, নিকটে দুই-চারিজন হারামজাদা প্রজা ও আদালতের লোক বসিয়ে আছে –হাকিমের আইনের ও মামলার কথাবার্তা হইতেছে ও কেহ কেহ নূতন দস্তাবেজ তৈয়ার ও সাক্ষী তালিম করিবার ইশারা করিতেছে –কেহ কেহ টাকা টেঁক থেকে খুলিয়া দিতেছে ও আপন আপন মতলব হাঁসিল জন্য নানা প্রকার স্তুতি করিতেছে। বাহুল্য কিছু যেন অন্যমনস্ক –এদিকে ওদিকে দেখিতেছেন –এক একবার আপন কৃষাণকে ফাল্তো ফরমাইশ করিতেছেন, “ওরে ঐ কদুর ডগাটা মাচার উপর তুলে দে, ঐ খেড়ের আঁটিটা বিছিয়ে ধুপে দে,” ও এক এক বার ছমছমে ভাবে চারিদিকে দেখিতেছেন। নিকটস্থ এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল –মৌলুবী সাহেব! ঠকচাচার কিছু মন্দ খবর শুনিতে পাই –কোনো পেঁচ নাই তো ? বাহুল্য কথা ভাঙিতে চান না, দাড়ি নেড়ে –হাত তুলে অতি বিজ্ঞরূপে বলিতেছেন –মরদের উপর হরেক আপদ গেরে, তার ডর করলে চলবে কেন ? অন্য একজন বলিতেছে –এ তো কথাই আছে কিন্তু সে ব্যক্তি বারেঁহা, আপন বুদ্ধির জোরে বিপদ থেকে উদ্ধার হইবে। সে যাহা হউক আপনার উপর কোনো দায় না পড়িলে আমরা বাঁচি –এই ডেঙা ভবানীপুরে আপনি বৈ আমাদের সহায় সম্পত্তি আর নাই –আমাদের বল বলুন, বুদ্ধি বলুন সকলই আপনি। আপনি না থাকলে আমাদের এখান হইতে বাস উঠাইতে হইত। ভাগ্যে আপনি আমাকে কয়েকখানা কবজ বানিয়ে দিয়েছিলেন তাই জমিদার বেটাকে জব্দ করিয়াছি, আমার উপর সেই অবধি কিছু দৌরাত্ম্য করে না –সে ভালো জানে যে আপনি আমার পাল্লায় আছেন। বাহুল্য আহ্লাদে গুড়গুড়িটা ভড় ভড় করিয়া চোক মুখ দিয়া ধুঁয়া নির্গত করত একটু মৃদু মৃদু হাস্য করিলেন। অন্য একজন বলিল –মফস্বলে জমি-জমা শিরে লইতে গেলে জমিদার ও নীলকরদের জব্দ করিবার জন্য দুই উপায় আছে –প্রথমত মৌলুবী সাহেবের মতন লোকের আশ্রয় লওয়া –দ্বিতীয়ত খ্রীষ্টিয়ান হওয়া। আমি দেখিয়াছি অনেক প্রজা পাদরীর দোহাই দিয়া গোকুলের ষাড়েঁর ন্যায় বেড়ায় ! পাদরী সাহেব কড়িতে বলো –সহিতে বলো –সুপারিসে বলো “ভাই লোকদের” সর্বদা রক্ষা করেন। সকল প্রজা যে মনের সহিত খ্রীষ্টিয়ান হয় তা নয় কিন্তু যে পাদরীর মণ্ডলীতে যায় সে নানা উপকার পায়। মাল মকদ্দমায় পাদরীর চিঠি বড়ো কর্মে লাগে। বাহুল্য বলিলেন, সে সচ্ বটে –লেকেন আদমির আপনার দীন খোয়ানা বহুত বুরা। অমনি সকলে বলিল –তা বটে তো, তা বটে তো ; আমরা এই কারণে পাদরীর নিকটে যাই না। এইরূপ খোশ গল্প হইতেছে ইতিমধ্যে দারোগা, জন কয়েক জমাদার ও পুলিসের সার্জন হুড়মুড় করিয়া বাহুল্যের হাত ধরিয়া বলিল –তোম ঠকচাচা কো সাত জাল কিয়া –তোমার উপর গেরেপ্তারি হেয়। এই কথা শুনিবামাত্র নিকটস্থ লোক সকলে ভয় পাইয়া সট্ সট্ করিয়া প্রস্থান করিল। বাহুল্য দারোগা ও সার্জনকে ধন লোভ দেখাইল কিন্তু তাহারা পাছে চাকরি যায় এই ভয়ে ওকথা আমলে আনিল না, তাহার হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। ডেঙ্গা ভবানীপুরে এই কথা শুনিয়া লোকারণ্য হইল ও ভদ্র ভদ্র লোকে বলিতে লাগিল দুষ্কর্মের শাস্তি বিলম্বে বা শীঘ্রে অবশ্যি হইবে। যদি লোকে পাপ করিয়া সুখে কাটাইয়া যায় তবে সৃষ্টিই মিথ্যা হইবে, এমন কখনই হইতে পারে না। বাহুল্য ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়াছেন –অনেকের সহিত দেখা হইতেছে কিন্তু কাহাকে দেখেও দেখেন না। দুই-এক ব্যক্তি যাহারা কখন না কখন তাহার দ্বারা অপকৃত হইয়াছিল, তাহারা এই অবকাশে কিঞ্চিৎ ভরসা পাইয়া নিকটে আসিয়া বলিল –মৌলবী সাহেব ! একি ব্রজের ভাব না-কি ? আপনার কি কোনো ভারি বিষয় কর্ম হইয়াছে ? না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বাহুল্য বংশদ্রোণীর ঘাট পার হইয়া শাগঞ্জে আসিয়া পড়িলেন। সেখানে দুই-একজন টেপুবংশীয় শাজাদা তাঁহাকে দেখিয়া বলিল –কেউঁ তু গেরেপ্তার হোয়া –আচ্ছা হুয়া –এয়সা বদ্জাত আদমিকো সাজা মিলনা বহুত বেহতর। এই সকল কথা বাহুল্যের প্রতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা লাগিতে লাগিল। ঘোরতর অপমানে অপমানিত হইয়া ভবানীপুরে পৌঁছিলেন –কিঞ্চিৎদূরে থেকে বোধ হইল রাস্তার বামদিকে কতকগুলি লোক দাঁড়াইয়া গোল করিতেছে, নিকটে আসিয়া সার্জন বাহুল্যকে লইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখানে এত লোক কেন ? পরে লোক ঠেলিয়া গোলের ভিতর যাইয়া দেখিল, একজন ভদ্রলোক এক আঘাতিত ব্যক্তিকে ক্রোড়ে করিয়া বসিয়া আছেন –আঘাতিত ব্যক্তির মস্তক দিয়া অবিশ্রান্ত রুধির নির্গত হইতেছে, ঐ রক্তে উক্ত ভদ্রলোকের বস্ত্র ভাসিয়া যাইতেছে; সার্জন জিজ্ঞসা করিল, আপনি কে ও এ লোকটি কি প্রকারে জখম হইল? ভদ্রলোক বলিলেন –আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস –আমি এখানে কোনো কর্ম অনুরোধে আসিয়াছিলাম দৈবাৎ এই লোক গাড়ি চাপা পড়িয়া আঘাতিত হইয়াছে, এই জন্য আমি আগুলিয়া বসিয়া আছি –শীঘ্র হাসপাতালে লইয়া যাইব তাহার উদ্যোগ পাইতেছি –একখানা পালকি আনিতে পাঠাইয়াছিলাম কিন্তু বেহারা ইহাকে কোনো মতে লইয়া যাইতে চাহে না, কারণ এই ব্যক্তি জেতে হাড়ি। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে বটে কিন্তু এ ব্যক্তি গাড়িতে উঠিতে অক্ষম, পাল্কি কিংবা ডুলি পাইলে যত ভাড়া লাগে তাহা আমি দিতে প্রস্তুত আছি। সততার এমনি গুণ যে ইহাতে অধমেরও মন ভেজে। বরদাবাবুর এই ব্যবহার দেখিয়া বাহুল্যের আশ্চর্য জন্মিয়া আপন মনে ধিক্কার হইতে লাগিল ! সার্জন বলিল –বাবু, বাঙালীরা হাড়িকে স্পর্শ করে না, বাঙালী হইয়া তোমার এত দূর করা বড়ো সহজ কথা নহে। বোধ হয় তুমি বড়ো অসাধারণ ব্যক্তি, এই বলিয়া আসামীকে পেয়াদার হাওয়ালে রাখিয়া সার্জন আপনি আড়ার নিকট যাইয়া ভয়মৈত্রতা প্রদর্শনপূর্বক পালকি আনিয়া বরদাবাবুর সহিত উক্ত হাড়িকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল।
পূর্বে বড়ো আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা বৎসরে তিন তিন মাস অন্তর হইত এক্ষণে কিছু ঘন ঘন হইয়া থাকে। ফৌজদারী মকদ্দমা নিষ্পত্তি করণার্থে তথায় দুই প্রকার জুরি মকরর হয়, প্রথমত গ্রাঞ্জুরি, যাহারা পুলিশ-চালানি ও অন্যান্য লোক যে ইণ্ডাইটমেণ্ড করে তাহা বিচারযোগ্য কি-না বিবেচনা করিয়া আদালতকে জানান –দ্বিতীয়ত পেটিজুরি, যাহারা গ্রাঞ্জুরি বিবেচনা অনুসারে বিচারযোগ্য মকদ্দমা জজের সহিত বিচার করিয়া আসামিদিগকে দোষী বা নির্দোষ করেন। এক এক সেশনে অর্থাৎ ফৌজদারী আদালতে ১৪ জন গ্রাঞ্জুরি মকরর হয়, যে সকল লোকের দুই লক্ষ টাকার বিষয় বা যাহারা সৌদাগরি করে তাহারাই গ্রাঞ্জুরি হইতে পারে। সেশনে পেটিজুরি প্রায় প্রতিদিন মকরর হয়, তাহাদিগের নাম ডাকিবার কালীন আসামী বা ফৈরাদি স্বেচ্ছানুসারে আপত্তি করিতে পারে অর্থাৎ যাহার প্রতি সন্দেহ হয় তাহাকে না লইয়া অন্য আর একজনকে নিযুক্ত করাইতে পারে কিন্তু বারোজন পেটিজুরি শপথ করিয়া বসিলে আর বদল হয় না। সেকশনের প্রথম দিবসে তিনজন জজ বসেন, যখন যাঁহার পালা তিনি গ্রাঞ্জুরি মকরর হইলে তাঁহাদিগাকে চার্জ অর্থাৎ সেশনীয় মকদ্দমার হালাৎ সকল বুঝাইয়া দেন। চার্জ দিলে পর অন্য দুইজন জজ যাঁহাদের পালা নয় তাঁহারা উঠিয়া যান ও গ্রাঞ্জুরিরা এক কামরার ভিতর যাইয়া প্রত্যেক ইণ্ডাইটমেণ্ডের উপর আপন বিবেচনানুসারে যথার্থ বা অযথার্থ লিখিয়া পাঠাইয়া দেন, তাহার পর বিচার আরম্ভ হয়।
রজনী প্রায় অবসান হয় –মন্দ মন্দ সমীরণ বহিতেছে, এই সুশীতল সময়ে ঠকচাচা মুখ হাঁ করিয়া বেতর নাক ডাকাইয়া নিদ্রা যাইতেছেন। অন্যান্য কয়েদীরা উঠিয়া তামাক খাইতেছে ও কেহ কেহ ঐ শব্দ শুনিয়া “মোস পোড়া খা, মোস পোড়া খা” বলিতেছে কিন্তু ঠকচাচা কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রা যাইতেছেন –”নাসা গর্জন শুনি পরান শিহরে”। কিয়ৎকাল পরে জেলরক্ষক সাহেব আসিয়া কয়েদীদের বলিলেন –তোমরা শীঘ্র প্রস্তুত হও, অদ্য সকলকে আদালতে যাইতে হইবে।
এদিকে সেশন খুলিবামাত্রে দশ ঘণ্টার অগ্রেই বড়ো আদালতের বারান্দা লোকে পরিপূর্ণ হইল –উকিল, কৌন্সুলি, ফৈরাদি, আসামী, সাক্ষী, উকিলের মুৎসুদ্দি, জুরি, সার্জন, জমদার, পেয়াদা –নানা প্রকার লোক থৈ থৈ করিতে লাগিল। বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবকে লইয়া ফিরিতেছেন ও ধনী লোক দেখিলে তাঁহাকে জানুন না জানুন আপনার বামনাই ফলাইবার জন্য হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিতেছেন, কিন্তু যিনি তাঁহাকে ভালো জানেন তিনি তাঁহার শিষ্টাচারিতে ভুলেন না –তিনি এক লহমা কথা কহিয়াই একটা-না-একটা মিথ্যা বরাত অনুরোধে তাঁহার হাত হইতে উদ্ধার হইতেছেন। দেখতে দেখতে জেলখানার গাড়ি আসিল –আগু পিছু দুই দিকে সিপাই। গাড়ি খাড়া হইবামাত্রে সকলে বারান্দা থেকে দেখিতে লাগিল –গাড়ির ভিতর থেকে সকল কয়েদীকে লইয়া আদালতের নীচেকার ঘরের কাঠগড়ার ভিতর রাখিল। বাঞ্ছারাম হন হন করিয়া নীচে আসিয়া ঠকচাচা ও বাহুল্যের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন –তোমরা ভীমার্জুন –ভয় পেও না –এ কি ছেলের হাতের পিটে ?
দুই প্রহর হইবামাত্রে বারান্দার মধ্যস্থল খালি হইল –লোক সকল দুইদিকে দাঁড়াইল –আদালতের পেয়াদা “চুপ্ চুপ্” করিতে লাগিল –জজেরা আসিতেছেন বলিয়া যাবতীয় লোক নিরীক্ষণ করিতেছে এমন সময়ে সার্জন পেয়াদা ও চোপদারেরা বল্লম, বর্শা, আশাসোঁটা, তলোয়ার ও বাদশাহ্র রৌপ্যময় মটুকাকৃতি সজ্জা হস্তে করিয়া দেখা দিল –তাহার পর সরিফ ও ডিপুটি সরিফ ছড়ি হাতে করিয়া দেখা দিল –তাহার পর তিনজন জজ লাল কোর্তা পরা গম্ভীরবদনে মৃদু মৃদু গতিতে বেঞ্চের উপর উঠিয়া কৌন্সুলিদের সেলাম করত উপবেশন করিলেন। কৌন্সুলিরা অমনি দাঁড়াইয়া সম্মানপূর্বক অভিবাদন করিল –চৌকির নাড়ানাড়ি ও লোকের বিজ্বিজিনি এবং ফুসফুসানি বৃদ্ধি হইতে লাগিল –পেয়াদারা মধ্যে মধ্যে “চুপ্ চুপ্ চুপ্” করিতেছে –সার্জনেরা “হিশ হিশ” করিতেছে –ক্রায়র “ওইস –ওইস” বলিয়া সেশন খুলিল। অনন্তর গ্রাঞ্জুরিদিগের নাম ডাকা হইয়া তাহারা মকরর হইল ও আপনাদিগের ফোরম্যান অর্থাৎ প্রধান গ্রাঞ্জুরি নিযুক্ত করিল। এবার রস্ল্ সাহেবের পালা, তিনি গ্রাঞ্জুরির প্রতি অবলোকন করিয়া বলিলেন –মকদ্দমার তালিকা দৃষ্টে বোধ হইতেছে যে, কলিকাতায় জাল করা বৃদ্ধি হইয়াছে কারণ ঐ কালেবের পাঁচ-ছয়টা মকদ্দমা দেখিতে পাই –তাহার মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি যে নালিশ তৎসম্পর্কীয় জবানবন্দিতে প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহারা শিয়ালদাতে জাল কোম্পানির কাগজ তৈয়ার করিয়া কয়েক বৎসরাবধি এই শহরে বিক্রয় করিতেছে –এ মকদ্দমা বিচারযোগ্য কি-না তাহা আমাকে আগ্রে জানাইবেন –অন্যান্য মকদ্দমার দস্তাবেজ দেখিয়া যাহা কর্তব্য তাহা করিবেন তদ্বিষয়ে আমার কিছু বলা-বাহুল্য। এই চার্জ পাইয়া গ্রাঞ্জুরি কামরার ভিতর গমন করিল –বাঞ্ছারাম বিষন্ন ভাবে বটলর সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন। দশ-পনের মিনিটের মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি ইণ্ডাইটমেণ্ড যথার্থ বলিয়া আদালতে প্রেরিত হইল। অমনি জেলের প্রহরী ঠকচাচা ও বাহুল্যকে আনিয়া জজের সম্মুখে কাঠরার ভিতর খাড়া করিয়া দিল ও পেটিজুরি নিযুক্ত হওন কালীন কোর্টের ইণ্টারপ্রিটার চিৎকার করিয়া বলিলেন –মোকাজান ওরফে ঠকচাচা ও বাহুল্য ! তোমলোক্কা উপর জাল কোম্পানির কাগজ বানানেকা নালেশ হুয়া –তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি ? আসামীরা বলিল –জাল বি কাকে বলে আর কোম্পানির কাগজ বি কাকে বলে মোরা কিছুই জানি না, মোরা সেরেফ মাছ ধরবার জাল জানি। মোরা চাষবাস করি মোদের এ কাম নয় –এ কাম সাহেব সুভদের। ইণ্টারপ্রিটার ত্যক্ত হইয়া বলিল তোমলোক বহুত লম্বা লম্বা বাত কহতা হেয় –তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি ? আসামীরা বলিল – মোদের বাপ-দাদারাও কখন করে নাই। ইণ্টারপ্রিটার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মেজ চাপড়িয়া বলিল –হামারি বাতকো জবাব দেও –এ কাম কিয়া কি নেহি ? নেহি নেহি এ হামলোক কাভি কিয়া নেহি –এই উত্তর আসামীরা অবশেষে দিল। উক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার তাৎপর্য এই যে আসামী যদি আপন দোষ স্বীকার করে তবে তাহার বিচার আর হয় না –একেবারে সাজা হয়। অনন্তর ইণ্টারপ্রিটার বলিলেন –শুন –এই বারো ভালা আদমি বয়েট করকে তোমলোক কো বিচার করেগা –কিসিকা উপর আগর ওজর রহে তব আবি কহ –ওন্কো উঠায় করকে দুসরা আদমিকো ওন্কো জাগেমে বটলা যায়েগি। আসামীরা এ কথার ভালো-মন্দ কিছু না বুঝিয়া চুপ করিয়া থাকিল। এদিকে বিচার আরম্ভ হইয়া ফৈরাদির ও সাক্ষীর জবানবন্দীর দ্বারা সরকারের তরফ কৌন্সুলি স্পষ্টরূপে জাল প্রমাণ করিল, পরে আসামিদের কৌন্সুলি আপন তরফ সাক্ষী না তুলিয়া জেরার মারপেছি কথা ও আইনের বিতণ্ডা করত পেটিজুরিকে ভুলাইয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার বত্তৃতা শেষ হইলে পর রস্ল্ সাহেব মকদ্দমা প্রমাণের খোলসা ও জালের লক্ষণ জুরিকে বুঝাইয়া বলিলেন –পেটিজুরি এই চার্জ পাইয়া পরামর্শ করিতে কামরার ভিতর গমন করিল –জুরিরা সকলে ঐক্য না হইলে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতে পারে না। এই অবকাশে বাঞ্ছারাম আসামীদের নিকট আসিয়া ভরসা দিতে লাগিলেন, দুই-চারিটা ভালো-মন্দ কথা হইতেছে ইতিমধ্যে জুরিদের আগমনের গোল পড়ে গেল। তাহারা আসিয়া আপন আপন স্থানে বসিলে ফোরম্যান দাঁড়াইয়া খাড়া হইলেন –আদালত একেবারে নিস্তব্ধ –সকলেই ঘাড় বাড়াইয়া কান পেতে রহিল –কোর্টের ফৌজদারী মমলার প্রধান কর্মচারী ক্লার্ক অব্দি ক্রৌন জিজ্ঞাসা করিল, –জুরি মহাশয়েরা ! ঠকচাচা ও বাহুল্য গিল্টি কি নাট গিল্টি ? ফোরম্যান বলিলেন –গিল্টি –এই কথা শুনিবামাত্র আসামীদের একেবারে ধড় থেকে প্রাণ উড়ে গেল –বাঞ্ছারাম আস্তে-ব্যস্তে আসিয়া বলিলেন –আরে ও ফুল গিল্টি ! এ কি ছেলের হাতের পিটে ? এখুনি নিউ ট্রায়েল অর্থাৎ পুনর্বিচারের জন্য প্রার্থনা করিব। ঠকচাচা দাড়ি নাড়িয়া বলিলেন –মোশাই ! মোদের নসিবে যা আছে তাই হবে মোরা আর টাকাকড়ি সরবরাহ করিতে পারিব না। বাঞ্ছারাম কিঞ্চিৎ চটে উঠিয়া বলিলেন –সুদু হাঁড়িতে পাত বাঁধিয়া কত করিব –এসব কর্মে কেবল কেঁদে কি মাটি ভিজানো যায় ?
এদিকে রস্ল্ সাহেব উল্টে-পাল্টে দেখিয়া আসামীদিগের প্রতি দৃষ্টি করত এই হুকুম দিলেন – “ঠকচাচা ও বাহুল্য ! তোমাদের দোষ বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইল – যে সকল লোক এমন দোষ করে তাহাদের গুরুতর দণ্ড হওয়া উচিৎ, এ কারণে তোমরা পুলিপালমে গিয়া যাবজ্জীবন থাক।” এই হুকুম হইবামাত্র আদালতের প্রহরীরা আসামীদের হাত ধরিয়া নীচে লইয়া গেল। বাঞ্ছারাম পিচ কাটিয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন –কেহ কেহ তাঁহাকে বলিল –এ কি –আপনার মকদ্দমাটা যে ফেঁসে গেল ? তিনি উত্তর করিলেন –এ তো জানাই ছিল –আর এমন সব গলতি মামলায় আমি হাত দি না –আমি এমতো সকল মকদ্দমা কখনই ক্যার করি না।
২৮.
বেণী ও বেচারামবাবুর নিকট বরদাবাবুর সততা ও কাতরতা প্রকাশ এবং ঠকচাচা ও বাহুল্যের কথোপকথন।
বৈদ্যবাটীর বাটী ক্রমে অন্ধকারময় হইল –রক্ষণাবেক্ষণ করে এমন অভিভাবক নাই –পরিজনেরা দুরবস্থায় পড়িল –দিন চলা ভার হইল, গ্রামের লোকে বলিতে লাগিল বালির বাঁধ কতক্ষণ থাকিতে পারে? ধর্মের সংসার হইলে প্রস্তরের গাঁথনি হইত। এদিকে মতিলাল নিরুদ্দেশ –দলবলও অন্তর্ধান –ধুম-ধাম কিছুই শুনা যায় না –প্রেমনারায়ণ মজুমদারের বড়ো আহ্লাদ –বেণীবাবুর বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া তুড়ি দিয়া “বাবলার ফুল লো কানে লো দুলালি, মুড়িমুড়কির নাম রেখেছো রুপালী সোনালী” এই গান গাইতেছেন। ঘরের ভিতরে বেণীবাবু তানপুরায় মেও মেও করিয়া হামির রাগ ভাঁজিয়া “চামেলি ফুলি চম্পা” এই খেয়াল সুরৎ মূর্ছনা ও গমক প্রকাশপূর্বক গান করিতেছেন। ওদিকে বেচারামবাবু “ভবে এসে প্রথমেতে পাইলাম আমি পঞ্জুড়ি” এই নরচন্দ্রী পদ ধরিয়া রাস্তায় যাবতীয় ছোঁড়াগুলাকে ঘাঁটাইয়া আসিতেছেন। ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাততালি দিতেছে। বেচারামবাবু এক একবার বিরক্তি হইয়া “দূঁর দূঁর” করিতেছেন। যৎকালে নাদের শা দিল্লী আক্রমণ করেন তৎকালীন মহম্মদ শা সংগীত শ্রবণে মগ্ন ছিলেন –নাদের শা অস্ত্রধারী হইয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলে মহম্মদ শা কিছুমাত্র না বলিয়া সংগীতসুধা পানে ক্ষণকালের জন্যেও ক্ষান্ত হয়েন নাই –পরে একটি কথাও না কহিয়া স্বয়ং আপন সিংহাসন ছাড়িয়া দেন। বেচারামবাবুর আগমনে বেণীবাবু তদ্রূপ করিলেন না –তিনি অমনি তানপুরা রাখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে বসাইলেন। কিয়ৎক্ষণ শিষ্ট মিষ্ট আলাপ হইলে পর বেচারামবাবু বলিলেন –বেণী ভায়া। এতদিনের পর মুষলপর্ব হইল –ঠকচাচা আপন কর্মদোষে অধঃপাতে গেলেন। তোমার মতিলালও আপন বুদ্ধিদোষে রূপস্ হইলেন। ভায়া ! তুমি আমাকে সবর্দা বলিতে ছেলের বাল্যকালাবধি মাজা বুদ্ধি ও ধর্মজ্ঞান জন্য শিক্ষা না হইলে ঘোর বিপদ ঘটে, এ কথাটির উদাহরণ মতিলালেতেই পাওয়া গেল। দুঃখের কথা কি বলিব? এ সকল দোষ বাবুরামের –তাঁহার কেবল মোক্তারি বুদ্ধি ছিল –বুড়িতে চতুর কিন্তু কাহনে কানা, দূঁর দূঁর !!
বেণী। আর এ সকল কথা বলিয়া আক্ষেপ করিলে কি হইবে? এ সিদ্ধান্ত অনেকদিন পূর্বেই করা হয়েছিল –যখন মতির শিক্ষা বিষয়ে এত অমনোযোগ ও অসৎ সঙ্গ নিবারণের কোনো উপায় হয় নাই তখনই রাম না হতে রামায়ণ হইয়াছিল। যাহা হউক, বাঞ্ছারামেরই পহবারো –বক্রেশ্বরের কেবল আঁকুপাঁকু সার। মাস্টারি কর্ম করিয়া বড়োমানুষের ছেলেদের খোশামোদ করিতে এমন আর কাহাকেও দেখা গেল না –ছেলেপুলেদের শিক্ষা দেওয়া তথৈবচ, কেবল রাত-দিন লব লব, অথচ বাহিরে দেখানো আছে আমি বড়ো কর্ম করিতেছি –যা হউক মতিলালের নিকট বাওয়াজির আশাবায়ু নিবৃত্তি হয় নাই –তিনি “জল দে, জল দে” বলিয়া গগিয়া আকাশ ফাটাইয়াছেন কিন্তু লাভের মেঘও কখন দেখিতে পান নাই –বর্ষণ কি প্রকারে দেখিবেন ?
প্রেমনারায়ণ মজুমদার বলিল –মহাশয়দিগের আর কি কথা নাই? কবিকঙ্কণ গেল –বাল্মীক গেল –ব্যাস গেল –বিষয়কর্মের কথা গেল –একা বাবুরামি হাঙ্গামে পড়ে যে প্রাণ ওষ্ঠগত হইল –মতে ছোড়া যেমন অসৎ তেমনি তার দুর্গতি হইয়াছে, সে চুলায় যাউক, তাহার জন্য কিছু খেদ নাই।
হরি তামাক সাজিয়া হুঁকাটি বেণীবাবুর হাতে দিয়া বলিল –সেই বাঙালবাবু আসিতেছেন। বেণী বাবু উঠিয়া দেখিলেন বরদাপ্রসাদবাবু ছড়ি হাতে করিয়া ব্যস্ত হইয়া আসিতেছেন –অমনি বেণীবাবু ও বেচারামবাবু উঠিয়া অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন –পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা হইলে পর বরদাবাবু বলিলেন –এদিকে তো যা হবার তা হয়ে গেল সম্প্রতি আমার একটি নিবেদন আছে –বৈদ্যবাটীতে আমি বহুকালাবধি আছি –একারণ সাধ্যানুসারে সেখানকার লোকদিগের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য –আমার অধিক ধন নাই বটে কিন্তু আমি যেমন মানুষ বিবেচনা করলে পরমেশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছে, আমি অধিক আশা করিলে কেবল তাঁহার সুবিচারের উপর দোষারোপ করা হয় –এ কর্ম মানবগণের উচিত নহে। যদিও প্রতিবেশীদের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য কিন্তু আমার আলস্য ও দুরদৃষ্টবশত ঐ কর্ম আমা হইতে সম্যক্ রূপে নির্বাহ হয় নাই। এক্ষণে –
বেচারাম। এ কেমন কথা। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় দুঃখী প্রাণী লোককে তুমি নানা প্রকারে সাহায্য করিয়াছ –কি খাদ্য দ্রব্যে –কি বস্ত্রে –কি অর্থে –কি ঔষধে –কি পুস্তকে –কি পরামর্শে –কি পরিশ্রমে, কোনো অংশ ক্রটি করো নাই। ভায়া ! তোমার গুণকীর্তনে তাহাদিগের অশ্রুপাত হয় –আমি এ সব ভালো জানি –আমার নিকট ভাঁড়াও কেন ?
বরদা। আজ্ঞে না ভাঁড়াই নাই –মহাশয়কে স্বরূপ বলিতেছি, আমা হইতে কাহারো যদি সাহায্য হইয়া থাকে তাহা এত অল্প যে স্মরণ করিলে মনের মধ্যে ধিক্কার জন্মে। সে যা হউক, এখন আমার নিবেদন এই মতিলালের ও ঠকচাচার পরিবারেরা অন্নাভাবে মারা যায় –শুনিতে পাই তাহাদের উপবাসে দিন যাইতেছে, এ কথা শুনিয়া বড়ো দুঃখ হইল, এজন্য আমার নিকট যে দুই শত টাকা ছিল তাহা আনিয়াছি। আপনারা আমার নাম না প্রকাশ করিয়া কোনো কৌশলে এই টাকা পাঠাইয়া দিলে আমি বড়ো আপ্যায়িত হইব।
এই কথা শুনিয়া বেণীবাবু নিস্তব্ধ হইয়া থাকিলেন। বেচারামবাবু ক্ষণেক কাল পরে বরদাবাবুর দিকে দৃষ্টি করিয়া ভক্তিভাবে নয়নবারিতে পরিপূর্ণ হওত তাঁহার গলায় হাত দিয়া বলিলেন –ভাই হে ! ধর্ম যে কি পদার্থ, তুমিই তাহা চিনেছ –আমাদের বৃথা কাল গেল –বেদে ও পুরাণে লেখে যাহার চিত্ত শুদ্ধ সে-ই পরমেশ্বরকে দেখিতে পায় –তোমার যেমন মন পরেমশ্বর তোমাকে তেমনি সুখে রাখুন। তবে রামলালের সংবাদ কিছু পাইয়াছ ?
বরদা। কয়েক মাস হইল হরিদ্বার হইতে এক পত্র পাইয়াছি –তিনি ভালো আছেন –প্রত্যাগমনের কথা কিছুই লেখেন নাই।
বেচারাম। রামলাল ছেলেটি বড়ো ভালো –তাকে দেখলে চক্ষু জুড়ায় –অবশ্য তার ভাল হবে –তোমার সংসর্গের গুণে সে তরে গিয়েছে।
এখানে ঠকচাচা ও বাহুল্য জাহাজে চড়িয়া সাগর পার হইয়া চলিয়াছে। দুটিতে মানিকজোড়ের মতো, এক জায়গায় বসে –এক জায়গায় খায় –এক জায়গায় শোয়, সর্বদা পরস্পরের দুঃখের কথা বলাবলি করে। ঠকচাচা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলে –মোদের নসিব বড়ো বুরা –মোরা একেবারে মেটি হলুম –ফিকির কিছু বেরোয় না, মোর শির থেকে মতলব পেলিয়া গেছে –মোকান বি গেল –বিবি সাথে বি মোলাকাত হল না –মোর বড়ো ডর তেনা বি পেল্টে শাদি করে।
বাহুল্য বলিল –দোস্ত ! ওসব বাত দেল থেকে তফাত করো –দুনিয়াদারি মুসাফিরি –সেরেফ আনা যানা –কোই কিসিকা নেহি –তোমার এক কবিলা, মোর চেট্টে –সব জাহানম্মে ডাল দাও, আবি মোদের কি ফিকিরে বেহতর হয় তার তদ্বির দেখো।
বাতাস হু হু বহিতেছে, জাহাজ একপেশে হইয়া চলিয়াছে, তুফান ভয়নক হইয়া উঠিল। ঠকচাচা ত্রাসে কম্পিতকলেবর হইয়া বলিতেছেন –দোস্ত ! মোর বড়ো ডর মালুম হচ্ছে, আন্দাজ হয় মোর মৌত নজদিগ।
বাহুল্য বলিল –মোদের মৌতের বাকি কি ? মোরা মেম্দো হয়ে আছি চলো মোরা নীচু গিয়া আল্লামির দেবাচা পড়ি –মোর বেলকুল নেকজাবান আছে যদি ডুবি তো পীরের নাম নিয়ে চেল্লাব।
২৯.
বৈদ্যবাটির বাটী দখল লওন –বাঞ্ছারামের কুব্যবহার –পরিবারদিগের দুঃখ ও বাটী হইতে বহিষ্কৃত হওন –বরদাবাবুর দয়া।
বাঞ্ছারামবাবুর ক্ষুধা কিছুতেই নিবৃত হয় নয়া –সর্বক্ষণ কেবল দাঁও মারিবার ফিকির দেখেন এবং কিরূপ পাকচক্র করিলে আপনার ইষ্ট সিদ্ধ হইতে পারে তাহাই সর্বদা মনের মধ্যে তোলপাড় করেন। এইরূপ করাতে তাঁহার ধূর্ত বুদ্ধি ক্রমে প্রখর হইয়া উঠিল। বাবুরাম ঘটিত ব্যাপারে সকল উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে হঠাৎ এক সুন্দর উপায় বাহির হইল। তিনি তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে অনেকক্ষণ পরে আপনার উরুর উপর করাঘাত করিয়া আপনা আপনি বলিলেন –এই তো দিব্য রোজগারের পথ দেখিতেছি –বাবুরামের চীনেবাজারের জায়গা ও ভদ্রাসান বাটী বন্ধক আছে, তাহার মেয়াদ শেষ হইয়াছে –হেরম্ববাবুকে বলিয়া আদালতে একটা নালিশ উপস্থিত করাই, তাহা হইলেই কিছুদিনের জন্যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হইতে পারিবে, এই বলিয়া চাদরখানা কাঁধে দিলেন এবং গঙ্গা দর্শন করিয়া আসি বলিয়া জুতা ফটাস্ ফটাস্ করিয়া মন্ত্রের সাধন কি শরীর পতন, এইরূপ স্থির ভাবে হেরম্ববাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্বারে প্রবেশ করিয়াই চাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন –কর্তা কোথা রে? বাঞ্ছারামের স্বর শুনিয়া হেরম্ববাবু অমনি নামিয়া আসিলেন –হেরম্ববাবু সাদাসিধে লোক –সকল কথাতেই “হ্যাঁ” বলিয়া উত্তর দেন। বাঞ্ছারাম তাঁহার হাত ধরিয়া অতিশয় প্রণয়ভাবে বলিলেন –চৌধুরী মহাশয় ! বাবুরামকে আপনি আমার কথায় টাকা কর্জ দেন –তাহার সংসার ও বিষয়-আশয় ছারখার হইয়া গেল –মান-সম্ভ্রমও তাহার সঙ্গে গিয়াছে –বড়ো ছেলেটা বানর ছোটটা পাগল, দু-টোই নিরুদ্দেশ হইয়াছে, এক্ষণে দেনা অনেক –অন্যান্য পাওনাওয়ালারা নালিশ করিতে উদ্যত –পরে নানা উৎপাত বাধিতে পারে অতএব আপনাকে আর আমি চুপ করিয়া থাকিতে বলিতে পারি না –আপনি মারগেজি কাগজগুলা দিউন –কালিই আমাদের আপিসে নালিশটি দাগিয়া দিতে হইবেক –আপনি কেবল একখানা ওকালতনামা সহি করিয়া দিবেন। পাছে টাকা ডুবে এই ভয় –এ অবস্থায় সকলেরই হইয়া থাকে –হেরম্ববাবু খল-কপট নহেন, সুতরাং বাঞ্ছারামের উক্ত কথা তাঁহার মনে একেবারে চৌচাপটে লেগে গেল, অমনি “হ্যাঁ” বলিয়া কাগজপত্র তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। হনুমান যেমন রাবণের মৃত্যুবাণ পাইয়া আহ্লাদে লঙ্কা হইতে মহাবেগে আসিয়াছিল, বাঞ্ছারামও ঐ সকল কাগজপত্র ইষ্ট কবজের ন্যায় বগলে করিয়া সেইরূপ ত্বরায় সহর্ষে বাটী আসিলেন।
প্রায় সম্বৎসর হয় –বৈদ্যবাটীর সদর দরওয়াজা বন্ধ –ছাত দেওয়াল ও প্রাচীর শেওলায় মলিন হইল –চারিদিকে অসংখ্য বন –কাঁটানটে ও শেয়ালকাঁটায় ভরিয়া গেল। বাটির ভিতরে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী এই দুইটি অবলামাত্র বাস করেন, তাঁহারা আবশ্যকমতে খিড়কি দিয়া বাহির হয়েন। অতি কষ্টে তাঁহাদের দিনপাত হয় –অঙ্গে মলিন বস্ত্র –মাসের মধ্যে পনের দিন অনাহারে যায় –বেণীবাবুর দ্বারা যে টাকা পাইয়াছিলেন তাহা দেনা পরিশোধ ও কয়েক মাসের খরচেই ফুরাইয়া গিয়াছে সুতরাং এক্ষণে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতেছেন ও নিরুপায় হইয়া ভাবিতেছেন।
মতিলালের স্ত্রী বলিতেছেন –ঠাক্রুন ! আমরা আর জন্মে কতই পাপ করেছিলাম তাহা বলিতে পারি না –বিবাহ হইয়াছে বটে কিন্তু স্বামীর মুখ কখনও দেখিলাম না –স্বামী একবারও ফিরে দেখেন না –বেঁচে আছি কি মরেছি তাহাও একবার জিজ্ঞাসা করেন না –স্বামী মন্দ হইলেও তাঁহার নিন্দা করা স্ত্রীলোকের কর্তব্য নহে –আমি স্বামীর নিন্দা করি না –আমার কপাল পোড়া, তাঁহার দোষ কি ? কেবল এইমাত্র বলি এক্ষণে যে ক্লেশ পাইতেছি স্বামী নিকটে থাকিলে এ ক্লেশ ক্লেশ বোধ হইত না। মতিলালের বিমাতা বলিলেন –মা ! আমাদের মতো দুঃখিনী আর নাই –দুঃখের কথা বলতে গেলে বুক ফেটে যায় –দীন-হীনদের দীননাথ বিনা আর গতি নাই ।
লোকের যাবৎ অর্থ থাকে তাবৎ চাকর দাসী নিকটে থাকে, ঐ দুই অবলার ঐরূপ অবস্থা হইলে সকলেই চলিয়া গিয়াছিল, মমতাবশত একজন প্রাচীনা দাসী নিকটে থাকিত –সে আপনি ভিক্ষাশিক্ষা করিয়া দিনপাত করিত। শাশুড়ী বৌয়ে ঐরূপ কথাবার্তা হইতেছে এমতো সময়ে ঐ দাসী থর্ থর্ করে কাঁপতে কাঁপতে আসিয়া বলিল –অগো মাঠাকরুনরা ! জানালা দিয়া দেখো –বাঞ্ছারামবাবু সার্জন ও পেয়াদা সঙ্গে করিয়া বাড়ি ঘিরে ফেলেছেন –আমাকে দেখে বললেন –মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল্। আমি বললুম –মোশাই ! তাঁরা কোথায় যাবেন? অমনি চোক লাল করে আমার উপর হুমকে বল্লেন –তারা জানে না এ বাড়ি বন্ধক আছে –পাওনাওয়ালা কি আপনার টাকা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে? ভালো চায় তো এই বেলা বেরুক তা না হলে গলাটিপি দিয়া বার করে দিব। এই কথা শুনিবা মাত্র শাশুড়ী-বৌয়ে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। এদিকে সদর দরওয়াজা ভাঙ্গিবার শব্দে বাড়ি পরিপূর্ণ হইল, রাস্তায় লোকারণ্য, বাঞ্ছারাম আস্ফালন করিয়া “ভাং ডাল ভাং ডাল” হুকুম দিতেছেন ও হাত নেড়ে বলতেছেন –কার সাধ্য দখল লওয়া বন্ধ করিতে পারে –এ কি ছেলের হাতের পিটে ? কোর্টের হুকুম এখনি বাড়ি ভেঙ্গে দখল লব –ভালো মানুষ টাকা কর্জ দিয়া কি চোর? এ কি অন্যায়? পরিবারেরা এখনি বেরিয়ে যাউক। অনেক লোক জমা হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে দুই ব্যক্তি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল –ওরে বাঞ্ছারাম ! তোর বাড়া নরাধম আর নাই –তোর মন্ত্রণায় এ ঘরটা গেল –চিরকালটা জুয়াচুরি করে এ সংসার থেকে রাশ রাশ টাকা লয়েছিস –এক্ষণে পরিবারগুলোকে আবার পথে বসাইতে বসেছিস –তোর মুখ দেখলেও চান্দ্রায়ণ করিতে হয় –তোর নরকেও ঠাঁই হবে না। বাঞ্ছারাম এ সব কথায় কান না দিয়া দরওয়াজা ভাঙ্গিয়া সার্জন সহিত বাড়ির ভিতর হুরমুড় করিয়া প্রবেশ করত অন্তঃপুরে গমন করেন –এমন সময়ে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী দুইজনে ঐ প্রাচীনা দাসীর দুই হাত ধরিয়া হে পরমেশ্বর ! অবলা দুঃখিনী নারীদের রক্ষা করো, এই বলিতে বলিতে চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। মতিলালের স্ত্রী বলিলেন –মাগো ! আমরা কুলের কামিনী –কিছুই জানি না –কোথায় যাইব? পিতা সবংশে গিয়াছেন –ভাই নাই –বোন নাই –কুটুম্ব নাই –আমাদের কে রক্ষা করিবে? হে পরমেশ্বর ! এখন আমাদের ধর্ম ও জীবন তোমার হাতে –অনাহারে মরি সেও ভালো, যেন ধর্ম নষ্ট হয় না। অনন্তর পাঁচ-সাত পা গিয়া একটি বৃক্ষের তলায় দাঁড়াইয়া ভাবিতেছেন, ইতিমধ্যে একখানা ডুলি সঙ্গে বরদাপ্রসাদবাবু ঘাড় নত করিয়া ম্লানবদনে সম্মুখে আসিয়া বলিলেন –ওগো ! তোমরা কাতর হইও না, আমাকে সন্তানস্বরূপ দেখো –তোমাদের নিকট আমার ভিক্ষা যে ত্বরায় এই ডুলিতে উঠিয়া আমার বাটীতে চলো –তোমাদিগের নিমিত্তে আমি স্বতন্ত্র ঘর প্রস্তত করিয়াছি –সেখানে কিছুদিন অবস্থিতি করো, পরে উপায় করা যাইবে। বরদাবাবুর এই কথা শুনিয়া মতিলালের স্ত্রী ও বিমাতা যেন সমুদ্রে পড়িয়া কূল পাইলেন। কৃতজ্ঞতায় মগ্ন হইয়া বলিলেন, –বাবা ! আমাদিগের ইচ্ছা হয় তোমার পদতলে পড়িয়া থাকি –এ সময় এমতো কথা কে বলে ? বোধ হয় তুমি আর জন্মে আমাদিগের পিতা ছিলে। বরদাবাবু তাঁহাদিগকে ত্বরায় সোয়ারিতে উঠাইয়া আপন গৃহে পাঠাইয়া দিলেন। অন্যের সহিত দেখা হইলে তাহারা পাছে একথা জিজ্ঞসা করে এজন্য গলি-ঘুঁজি দিয়া আপনি শীঘ্র বাটী আইলেন।
৩০.
মতিলালের বারাণসী গমন ও সৎসঙ্গ লাভে চিত্তশোধন। তাহার মাতা ও ভগনীর দুঃখ, রামলাল ও বারদাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ -পরে তাহাদের মতিলালের সঙ্গে দেখা, পথে ভয় ও বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন।
সদুপদেশ ও সৎসঙ্গে সুমতি জন্মে, কাহারো অল্প বয়সে হয় –কাহারো অধিক বয়সে হইয়া থাকে। অল্প বয়সে সুমতি না হইলে বড়ো প্রমাদ ঘটে –যেমন বনে অগ্নি লাগিলে হু হু করিয়া দিগদাহ করে অথবা প্রবল বায়ু উঠিলে একেবারে বেগে গমন করত বৃক্ষ অট্টালিকাদি ছিন্নানি করিয়া ফেলে সেইরূপ শৈশবাবস্থায় দুর্মতি জন্মিলে ক্রমশ রক্তের তেজে সতেজ হওয়াতে ভয়ানক হইয়া উঠে। এ বিষয়ের ভুরি ভুরি নিদর্শন সদাই দেখা যায়। কিন্তু কোনো কোনো ব্যক্তি কিয়াৎকাল দুর্মতি ও অসৎ কর্মে রত থাকিয়া অধিক বয়সে হঠাৎ ধার্মিক হইয়া উঠে, ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপ পরিবর্তনের মূল সদুপদেশ বা সৎসঙ্গ। পরন্তু কাহারো দৈবাৎ কাহারো বা কোনো ঘটনায় কাহারো বা একটি কথাতেই কখন কখন হঠাৎ চেতনা হইয়া থাকে –এরূপ পরিবর্তন অতি অসাধারণ।
মতিলাল যশোহর হইতে নিরাশ হইয়া আসিয়া সঙ্গীদিগকে বলিলেন –আমার কপালে ধন অন্বেষণ করা বৃথা, এক্ষণে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কিছু দিনের জন্য ভ্রমণ করিয়া আসি –তোমরা কেহ আমার সঙ্গে যাবে? সকলেই লক্ষ্মীর বরযাত্রী –অর্থ হাতে থাকিলে কাহাকেও ডাকিতে হয় না –অনেকে আপনা আপনি আসিয়া জুটে যায় কিন্তু অর্থাভাব হইলে সঙ্গী পাওয়া ভার। মতিলালের নিকট যাহারা থাকিত, তাহারা আমোদ-প্রমোদ ও অর্থের অনুরোধে আত্মীয়তা দেখাত –বস্তুত মতিলালের প্রতি তাহাদের কিছুমাত্র আন্তরিক স্নেহ ছিল না। তাহারা যখন দেখিল যে তাহার কোনো যোত্র নাই –চতুর্দিকে দেনা, বাবুয়ানা করা দূরে থাকুক আহারাদিও চলা ভার, তখন মনে করিল উহার সঙ্গে প্রণয় রাখার কি ফল ? এক্ষণে ছট্কে পড়া শ্রেয়। মতিলাল ঐ প্রকার প্রশ্ন করিয়া দেখিলেন কেহই কোনো উত্তর দেয় না। সকলেই ঢোঁক গিলিয়া এঁ ওঁ করিয়া নানা ওজর ও অন্যান্য বরাতের কথা ফেলে। তাহাদিগের ব্যবহারে মতিলাল বিরক্ত হইয়া বলিলেন –বিপদেই বন্ধু টের পাওয়া যায়, এতদিনের পর আমি তোমাদিগকে চিনলাম –যাহা হউক এক্ষণে তোমরা আপন আপন বাটী যাও, আমি দেশ ভ্রমণে চলিলাম। সঙ্গীরা বলিল –বড়োবাবু ! রাগ করিও না –আপনি বরং আগু হউন আমরা আপন আপন বরাত মিটাইয়া পশ্চাৎ জুট্ব। মতিলাল তাহাদের কথায় আর কান না দিয়া পদব্রজে চলিলেন এবং স্থানে স্থানে অতিথি হইয়া ও ভিক্ষা মাঙিয়া তিন মাসের পর বারাণসীতে উত্তরিলেন। এই প্রকার দুরবস্থায় পড়িয়া ক্রমাগত একাকী চিন্তা করাতে তাঁহার মনের গতি বিভিন্ন হইতে লাগিল। বহু ব্যয়ে নির্মিত মন্দির, ঘাট ও অট্টালিকা ভগ্ন হইয়া যাবার উপক্রম হইতেছে –বহু বহু শাখায় বিস্তীর্ণ তেজস্বী প্রাচীন বৃক্ষের জীর্ণাবস্থা দৃষ্ট হইল –নদ-নদী, গিরি-গুহার অবস্থা চিরকাল সমান থাকে না –ফলত কালেতে সকলেরই পরিবর্তন ও ক্ষয় হইয়া থাকে –সকলই অনিত্য –সকলই অসার। মানবগণও রোগ, জরা, বিয়োগ, শোক ও নানা দুঃখে অভিভূত ও সংসারে মদ মাৎসর্য ও আমোদ সকলই জলবিম্ববৎ। মতিলাল ঐ সকল ধ্যান করিয়া প্রতিদিন বারাণসী ধামের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করত বৈকালে গঙ্গাতীরস্থ এক নির্জন স্থানে বসিয়া দেহের অসারত্ব, আত্মার সারত্ব, এবং আপন চরিত্র ও কর্মাদি পুনঃ পুনঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। এইরূপ চিন্তা করাতে তাঁহার তমঃ খর্ব হইতে লাগিল সুতরাং আপনার পূর্ব কর্মাদি ও উপস্থিত দুর্মতি প্রভৃতি জাগরূক হইয়া উঠিল। মনের এবম্প্রকার গতি হওয়াতে তাঁহার আপনার প্রতি ধিক্কার জন্মিল এবং ঐ ধিক্কারে অত্যন্ত সন্তাপ হইতে লাগিল। তখন আপনাকে সর্বদা এই জিজ্ঞাসা করিতেন –আমার পরিত্রাণ কিরূপে হইতে পারে –আমি যে কুকর্ম করিয়াছি তাহা স্মরণ করিলে এখনও হৃদয় দাবানলের ন্যায় জ্বালিয়া উঠে। এইরূপ ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন –আহারাদি ও পরিধেয় বস্ত্রাদির প্রতি দৃক্পাতও নাই –ক্ষিপ্তপ্রায় ভ্রমণ করিয়া বেড়ান। কিছুকাল এই প্রকারে ক্ষেপণ হইলে দৈবাৎ এক দিবস দেখিলেন একজন প্রাচীন পুরুষ তরুতলে বসিয়া মনঃসংযোগ পূর্বক এক একবার একখানি গ্রন্থ দেখিতেছেন ও এক একবার চক্ষু মুদিত করিয়া ধ্যান করিতেছেন। ঐ ব্যক্তিকে দেখিলে হঠাৎ বোধ হয় সে বহুদর্শী –জ্ঞানের সারাংশ গ্রহণ এবং মনঃসংযম বিলক্ষণ হইয়াছে। তাঁহার মুখ দর্শন করিলে তৎক্ষণাৎ ভক্তির উদয় হয়। মতিলাল তাঁহাকে দেখিবামাত্রে নিকটে যাইয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেন। কিয়ৎকাল পরে ঐ প্রাচীন পুরুষ মতিলালের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন –বাবা ! তোমার আকার প্রকারে বোধ হয় তুমি ভদ্র সন্তান –কিন্তু এমতো সন্তাপিত হইয়াছ কেন ? এই মিষ্ট কথায় উৎসাহ পাইয়া, মতিলাল অকপটে আনুপূর্বিক আপন পরিচয় দিয়া কহিলেন –মহাশয় ! আপনাকে অতি বিজ্ঞ দেখিতেছি –আমি আপনার দাস হইলাম –আমাকে কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিউন। সেই প্রাচীন পুরুষ মতিলালের সরল চিত্ত দেখিয়া তুষ্ট হইলেন। মানব স্বভাব এই যে পরস্পরের প্রতি সন্তোষ না জন্মিলে মন খোলাখুলি হয় না, প্রথম আলাপেই যদি এমতো তুষ্টি জন্মে তাহা হইলে পরস্পরের মনের কথা শীঘ্রই ব্যক্ত হয়, আর একজন সারল্য প্রকাশ করিলে অন্য ব্যক্তি অতিশয় কপট না হইলে কখনই কপটতা প্রকাশ করিতে পারে না। ঐ প্রাচীন পুরুষ অতি ধার্মিক, মতিলালের সরলতায় তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পারমার্থিক বিষয়ে তাঁহার যে অভিপ্রায় ছিল তাহা ক্রমশঃ ব্যক্ত করিলেন। তিনি বারম্বার বলিলেন –বাবা ! সকল ধর্মের তাৎপর্য এই কায়মনোচিত্তে ভক্তি-স্নেহ ও প্রেম প্রকাশপূর্বক পরমেশ্বরের উপসনা করা, এই কথাটি সর্বদা ধ্যান করো ও মন, বাক্য ও কর্ম দ্বারা অভ্যাস করো। এই উপদেশটি তোমার মনে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইলেই মনের গতি একেবারে ফিরিয়া যাবে, তখন অন্যান্য ধর্ম অনুষ্ঠান আপনা আপনি হইবে কিন্তু পরমেশ্বরের প্রেমার্থ মনের দ্বারা, বাক্যের দ্বারা ও কর্মের দ্বারা সদা একরূপ থাকা অতি কঠিন –সংসারে রাগ, দ্বেষ, লোভ, মোহ ইত্যাদি রিপু সকল বিজাতীয় ব্যাঘাত করে এজন্য একাগ্রতা ও দৃঢ়তার অত্যন্ত আবশ্যক। মতিলাল উক্ত উপদেশ গ্রহণপূর্বক মনের সহিত প্রতিদিন পরমেশ্বরের ধ্যান ও উপাসনায় রত এবং আত্মদোষানুসন্ধানে ও শোধনে সযত্ন হইলেন। কিছুকাল এইরূপ করাতে তাঁহার মনোমধ্যে জগদীশ্বরের প্রতি ভক্তির উদয় হইল। সাধুসঙ্গের কী অনির্বচনীয় মাহাত্ম্য। যিনি মতিলালের উপদেশক, তিনি ধার্মিক চূড়ামণি, তাঁহার সহবাসে মতিলালের যে এমন মতি হইবে ইহা কোন্ বিচিত্র।
পরমেশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে যাবতীয় মনুষ্যের প্রতি মতিলালের মনে ভ্রাতৃবৎ ভাব জন্মিল –তখন পিতা-মাতা ও পরিবারের প্রতি স্নেহ, পরদুঃখ মোচন ও পরহিতার্থ বাসনা উত্তরোত্তর প্রবল হইতে লাগিল। সত্য ও সরলতার বিপরীত দর্শন অথবা শ্রবণ হইলেই বিজাতীয় অসুখ হইত। মতিলাল আপন মনের ভাব ও পূর্ব কথা সর্বদাই ঐ প্রচীন পুরুষের নিকট বলিতেন ও মধ্যে মধ্যে খেদ করিয়া কহিতেন –গুরো ! আমি অতি দুরাত্মা, পিতা, মাতা, ভাই, ভগিনী ও অন্যান্য লোকের প্রতি যে প্রকার ব্যবহার করিয়াছি তাহাতে নরকেও যে আমার স্থান হয় এমন বোধ হয় না। ঐ প্রাচীন পুরুষ সান্ত্বনা করিয়া বলিতেন –বাবা ! তুমি প্রাণপণে সদভ্যাসে রত থাকো –মনুষ্য মাত্রেই মনোজ, বাক্যজ ও কর্মজ পাপ করিয়া থাকে, পরিত্রাণের ভরসা কেবল সেই দয়াময়ের দয়া –যে ব্যক্তি আপন পাপ জন্য অন্তঃকরণের সহিত সন্তাপিত হইয়া আত্মশোধনার্থ প্রকৃতরূপে যত্নশীল হয় তাহার কদাপি মার নাই। মতিলাল এ সকল শুনেন ও অধোবদন হইয়া ভাবেন এবং সময়ে সময়ে বলেন আমার মা, বিমাতা, ভগিনী, ভ্রাতা, স্ত্রী –ইঁহারা কোথায় গেলেন? ইঁহাদের জন্য মন উচাটন হইতেছে।
শরতের আবির্ভাব –ত্রিযামা অবসান –বৃন্দাবনের কিবা শোভা ! চারিদিকে তাল, তমাল, শাল, পিয়াল, বকুল আদি নানাজাতি বৃক্ষ –তদুপরি সহস্র সহস্র পক্ষী নানা রবে গান করিতেছে –বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে –যমুনার তরঙ্গ যেন রঙ্গচ্ছলে পুলিনের একাঙ্গ হইতেছে –ব্রজবালক ও ব্রজবালিকারা কুঞ্জে কুঞ্জে পথে পথে বীণা বাজাইয়া ভজন গাইতেছে। নিশাবসানে দেবালয় সকলে মঙ্গলারতির সময় সহস্র সহস্র শঙ্খ-ঘণ্টার ধ্বনি হইতেছে। কেশী ঘাটে কচ্ছপ সকল কিল্বিল্ করিতেছে –বৃক্ষাদির উপরে লক্ষ লক্ষ বানর উল্লম্ফন প্রোল্লম্ফন করিতেছে –কখন লাঙ্গুল জড়ায় –কখন প্রসারণ করে –কখন বিকট বদন প্রদর্শনপূর্বক ঝুপ করিয়া পড়িয়া লোকের খাদ্য সামগ্রী কাড়িয়া লয়।
নানা বনে শত শত তীর্থযাত্রী পরিক্রমণ করিতেছে –নানা স্থান দর্শন করিয়া শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলার কথা কহিতেছে। এদিকে প্রখর রবি –মৃত্তিকা উত্তপ্ত –পদব্রাজে যাওয়া অতি কঠিন, এ কারণ অনেক যাত্রী স্থানে স্থানে বৃক্ষতলে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে। মতিলালের মাতা কন্যার হাত ধরিয়া ভ্রমণ করিতেছিলেন, অত্যন্ত শ্রান্তিযুক্ত হওয়াতে একটি নির্জন স্থানে বসিয়া কন্যার ক্রোড়ে মস্তক রাখিয়া শয়ন করিলেন। কন্যা আপন অঞ্চল দিয়া আক্লান্ত মাতার ঘর্ম মুছিয়া বাতাস করিতে লাগিল। মাতা কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইয়া বলিলেন –প্রমদা ! বাছা তুই একটু বিশ্রাম কর –আমি উঠে বসি। কন্যা উত্তর করিল –মা ! তোমার শ্রান্তি দূর হওয়াতেই আমার শ্রান্তি গিয়াছে –তুমি শুয়ে থাকো আমি তোমার দু-টি পায়ে হাত বুলাই। কন্যার এইরূপ সস্নেহ বাক্য শুনিয়া মাতা সজল নয়নে বলিলেন –বাছা ! তোর মুখ দেখেই বেঁচে আছি –জন্মান্তরে কত পাপ করেছিলাম, তা না হলে এত দুঃখ কেন হবে ? আপনি অনাহারে মরি তাতে খেদ নাই, তোকে এক মুটা খাওয়াই এমন সঙ্গতি নাই –এই আমার বড়ো দুঃখ ! এ দুঃখ রাখবার কি ঠাঁই আছে ? আমার দু-টি পুত্র কোথায় ? বৌটি বা কেমন আছে ? কেনই বা রাগ করে এলাম ? মতি আমাকে মেরেছিল –মেরেই ছিল, ছেলেতে আবদার করে কি-না বলে –কি-না করে ? এখন তার আর রামের জন্যে আমার প্রাণ সর্বদাই ধড়ফড় করে। কন্যা মাতার চক্ষের জল মুছাইয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে মাতার একটু তন্দ্রা হইল। কন্যা মাতাকে নিদ্রিত দেখিয়া সুস্থির হইয়া বসিয়া একটু একটু বাতাস দিতে আরম্ভ করিল। দুহিতার শরীরে মশা ও ডাঁশ বসিয়া কামড়াইতে লাগিল কিন্তু পাছে মায়ের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এজন্য তিনি স্থির হইয়া থাকিলেন। স্ত্রীলোকেদের স্নেহ ও সহিষ্ণুতা আশ্চর্য ! বোধ হয় পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোক এ বিষয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। মাতা নিদ্রাবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছেন যেন একটি পীতবসন নবকিশোর তাঁহার নিকটে আসিয়া বলিতেছেন –”মা ! তুই আর কাঁদিস্ না –তুই বড়ো পুণ্যবতী –অনেক দুঃখী-কাঙালীর দুঃখ নিবারণ করিয়াছিস –তুই কাহারো ভালো বই কখন মন্দ করিস নাই। –তোর শীঘ্র ভালো হবে –তুই দুই পুত্র পাইয়া সুখী হইবি।” দুঃখিনী মাতা চমকিয়া উঠিয়া চক্ষুউন্মীলন করিয়া দেখেন কেবল কন্যা নিকটে আছে আর কেহই নাই। পরে কন্যাকে কিছু না বলিয়া তাহার হস্ত ধারণপূর্বক বহু ক্লেশে আপনাদের কুঞ্জে প্রত্যাগমন করিলেন।
মায়ে-ঝিয়ে সর্বদা কথোপকথন হয় – মা বলেন, বাছা ! মন বড় চঞ্চল হইতেছে, বাড়ি যাব সর্বদা এই ভাবতেছি। কন্যা কিছুই উপায় না দেখিয়া বলিল –মা ! আমাদিগের সম্বলের মধ্যে দুই-একখানি কাপড় ও জল খাবার ঘটিটি আছে –ইহা বিক্রয় করিলে কি হতে পারবে ? কিছু দিন স্থির হও আমি রাঁধুনী অথবা দাসীর কর্ম করিয়া কিছু সঞ্চয় করি তাহা হইলেই আমাদের পথ খরচের সংস্থান হইবে। মা এ কথা শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিস্তব্ধ থাকিলেন, চক্ষের জল আর রাখিতে পারিলেন না। মাতাকে কাতর দেখিয়া কন্যাও কাতর হইল। নিকটে একজন ব্রজবাসিনী থাকিতেন, তিনি সর্বদা তাহাদিগের তত্ত্ব লইতেন, দৈবাৎ ঐ সময়ে আসিয়া তাহাদিগকে দুঃখিত দেখিয়া সান্ত্বনা করণানন্তর সকল বৃত্তান্ত শুনিলেন। তাহাদিগের দুঃখে দুঃখিত হইয়া সেই ব্রজবাসিনী বলিলেন –মায়ী ! কি বলব আমার হাতে কড়ি নাই –আমার ইচ্ছা হয় সর্বস্ব দিয়া তোমাদের দুঃখ মোচন করি, এখন একটি উপায় বলে দি তোমরা তাই করো। শুনিতে পাই এক বাঙালী বাবু চাকরি ও তেজারতের দ্বারা কিছু বিষয় করিয়া মথুরায় আসিয়া বাস করিতেছেন –তিনি বড়ো দয়ালু ও দাতা, তোমরা তাঁর কাছে গিয়া পথ খরচ চাহিলে অবশ্যই পাইবে। দুঃখিনী মাতা ও কন্যা অন্য কোনো উপায় না দেখাতে প্রস্তাবিত উপায়ই অবলম্বন করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহারা ব্রজবাসিনীর নিকট বিদায় লইয়া দুই দিনের মধ্যে মথুরায় উপস্থিত হইলেন। সেখানে এক সরোবরের নিকটে যাইয়া দেখেন কতকগুলিন আতুর, অন্ধ, ভগ্নাঙ্গ, দুঃখী, দরিদ্র লোক একত্র বসিয়া রোদন করিতেছে। মাতা তাহাদিগের মধ্যে একজন প্রাচীনা স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা করিলেন –বাছা! তোমরা কাঁদিতেছ কেন ? ঐ স্ত্রীলোক বলিল –মা ! এখানে এক বাবু আছেন তাঁহার গুণের কথা কি বলিব ? তিনি গরীব দুঃখীর বাড়ি বাড়ি ফিরিয়া তাহাদের খাওয়া-পরা দিয়া সর্বদা তত্ত্ব লয়েন আর কাহারো ব্যারাম হইলে আপনি তার শেওরে বসিয়া সারারাত্রি জাগিয়া ঔষধ-পথ্য দেন। তিনি আমাদের সকলের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী। সেই বাবুর গুণ মনে করতে গেলে চক্ষে জল আইসে –যে মেয়ে এমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করিয়াছেন তিনিই ধন্য –তাঁহার অবশ্যই স্বর্গ ভোগ হইবে –এমন লোক যেখানে বাস করেন সে স্থান পুণ্য স্থান। আমাদিগের পোড়া কপাল যে ঐ বাবু এখন এ দেশ হইতে চলিলেন –এর পর আমাদের দশা কি হবে তাই ভাবিয়া কাঁদছি। মাতা ও কন্যা এই কথা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন –বোধ হয় আমাদিগের আশা নিষ্ফল হইল –কপালে দুঃখ আছে, ললাটের লিপি কে ঘুচাইবে ? উক্ত প্রাচীনা তাহাদিগের বিষণ্ণ ভাব দেখিয়া বলিল, –আমার অনুমান হয় তোমারা ভদ্র ঘরের মেয়ে –ক্লেশে পড়িয়াছ। যদি কিছু টাকাকড়ি চাহ তবে এই বেলা আমার সঙ্গে ঐ বাবুর নিকটে যাবে চলো, তিনি গরীব-দুঃখী ছাড়া অনেক ভদ্রলোকেরও সাহায্য করেন। মাতা ও কন্যা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং সেই বৃদ্ধার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া আপনারা বাটীর বাহিরে থাকিলেন, বুড়ী ভিতরে গেল।
দিবা অবসান –সূর্য অস্ত হইতেছে –দিনকরের কিরণে বৃক্ষাদির ও সরোবরের বর্ণ সুবর্ণ হইতেছে। যেখানে মাতা ও কন্যা দাঁড়াইয়াছিলেন সেখানে একখানি ছোট উদ্যান ছিল। স্থানে স্থানে মেরাপে নানা প্রকার লতা, চারিদিকে কেয়ারি ও মধ্যে এক এক চবুতারা। ঐ বাগানের ভিতরে দুইজন ভদ্রলোক হাত ধরাধরি করিয়া কৃষ্ণার্জুনের ন্যায় বেড়াইতেছিল। দৈবাৎ ঐ দুই স্ত্রীলোকের প্রতি দৃষ্টিপাত হওয়াতে তাঁহারা ব্যস্তসমস্ত হইয়া বাগান হইতে বাহির হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আসিলেন। মাতা ও কন্যা তাঁহাদিগকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া একটু অন্তরে দাঁড়াইলেন। ঐ দুইজন ভদ্রলোকের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি কোমল বাক্যে বলিলেন –আপনারা আমাদিগকে সন্তানস্বরূপ বোধ করিবেন –লজ্জা করিবেন না –আপনারা কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন, আমাদিগের নিকট বিশেষ করিয়া বলুন, যদি আমাদিগের দ্বারা কোনো সাহায্য হইতে পারে আমরা তাহাতে কোনো প্রকার ক্রটি করিব না। এই কথা শুনিয়া মাতা কন্যার হাত ধরিয়া কিঞ্চিৎ অগ্রবর্তিনী হইয়া আপন অবস্থা সংক্ষেপে ব্যক্ত করিলেন। তাঁহার কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে ঐ দুইজন ভদ্রলোক পরস্পর মুখাবলোকন করিয়া তাহাদিগের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি একেবারে মায়াতে মুগ্ধ হইয়া মা মা বলিয়া ভূমিতে পড়িয়া গেলেন, অন্য আর একজন অধিকবয়স্ক ব্যক্তি দুঃখিনী মাতার চরণে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিলেন –মা গো ! দেখো কি? যে ভূমিতে পড়িয়াছে সে তোমার অঞ্চলের ধন –সে তোমার রাম, আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস। মাতা এই কথা শুনিবামাত্রে মুখের কাপড় খুলিয়া বলিলেন –বাবা ! তুমি কি বলিলে ? এ অভাগিনীর কি এমন কপাল হবে ? রামলাল চৈতন্য পাইয়া চরণে মস্তক দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, জননী পুত্রের মস্তক ক্রোড়ে রাখিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাহার মুখাবলোকন করিয়া আপন তাপিত মনে সান্তুনাবারি সেচন করিতে লাগিলেন ও ভগিনী আপন অঞ্চল দিয়া ভ্রাতার চক্ষের জল ও গায়ের ধূলা পুঁছাইয়া দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। এদিকে ঐ বুড়ী বাটীর মধ্যে বাবুকে না পাইয়া তাড়াতাড়ি বাগানে আসিয়া দেখে যে বাবু তাহার সমভিব্যাহারিণী প্রাচীনা স্ত্রীলোকের কোলে মস্তক দিয়া ভূমে শয়ন করিয়া আছেন –ও মা এ কি গো ! ওগো বাবুর কি ব্যারাম হয়েছে ? আমি কি কবিরাজ ডেকে আনব ? বুড়ী এই বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। বরদাপ্রসাদবাবু বলিলেন, স্থির হও –বাবুর পীড়া হয় নাই, এই যে দুইটি স্ত্রীলোক –এঁরা বাবুর মা ও ভগিনী। বুড়ী উত্তর করিল –বাবু ! দুঃখী বলে কি ঠাট্টা করতে হয় ? বাবু হলেন লক্ষপতি, আর এঁরা হল পথের কাঙালিনী –আমার সঙ্গে এসে কেও হলেন মা, কেও হলেন বোন। বোধ হয় এরা কামিখ্যার মেয়ে –ভেল্কিতে ভুলিয়েছে বাবা। এমন মেয়েমানুষ কখন দেখি না –এদের জাদুকে গড় করি মা ! বুড়ী এইরূপ বকতে বকতে ত্যক্ত হইয়া চলিয়া গেল।
এখানে সকলে সুস্থির হইয়া বাটী আগমন করিলেন, তথায় পুত্রবধুকে ও সপত্নীকে দেখিয়া মাতার পরম সন্তোষ হইল, পরে আপনার আর আর পরিবারের কথা অবগত হইয়া বলিলেন, বাবা রাম ! চলো, বাটী যাই –আমার মতি কোথায় –তার জন্য মন বড়ো অস্থির হইতেছে। রামলাল পূর্বেই বাটী যাওনের উদ্যোগ করিয়াছিলেন –নৌকাদি ঘাটে প্রস্তুত ছিল। মাতার আজ্ঞানুসারে উত্তম দিন দেখিয়া সকলকে লইয়া যাত্রা করিলেন –যাত্রাকালীন মথুরার যাবতীয় লোক ভেঙে পড়িল –সহস্র সহস্র চক্ষু বারিতে পরিপূর্ণ হইল –সহস্র সহস্র কর তাঁহার আশীর্বাদার্থ উত্থিত হইল। যে বুড়ী বিরক্ত হইয়াছিল সে জোড়হাত করিয়া রামলালের মাতার নিকট আসিয়া কাঁদিতে লাগিল, নৌকা যে পর্যন্ত দৃষ্টিপথ অতিক্রম না করিল সে পর্যন্ত সকলে যমুনার তীরে যেন প্রাণশূন্য দেহে দাঁড়াইয়া রহিল।
এদিকে একটানা –দক্ষিণে বায়ুর সঞ্চার নাই –নৌকা স্রোতের জোরে বেগে চলিয়া অল্প দিনের মধ্যেই বারাণসীতে আসিয়া উত্তীর্ণ হইল। বারাণসীর মধ্যে প্রাতঃকালীন কিবা শোভা। কত কত দোবেদী, চৌবেদী, রামাৎ, নেমাৎ, শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, পরমহংস ও ব্রহ্মচারী স্তোত্র পাঠ করিতেছেন –কত কত সামবেদী কঠ কৌথুমাদির মন্ত্র ও অগ্নি বায়ুর সূক্ত উচ্চারণ করিতেছেন –কত কত সুরাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র, বঙ্গ ও মগধস্থ নানাবর্ণ পট্টবস্ত্র পরিধারিণী নারীরা স্নাত হইয়া মন্দির প্রদক্ষিণ করিতেছে –কত কত দেবালয় ধূপ, ধূনা, পুষ্প, চন্দনের সৌগন্ধে আমোদিত হইতেছে –কত কত ভক্ত “হর হর বিশ্বেশ্বর” শব্দ করতঃ গাল ও কক্ষবাদ্য করিয়া উন্মত্ত হইয়া চলিয়াছে –কত কত রক্তবসনা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী অট্ট অট্ট হাস্য করত ভৈরবালয়ে ভৈরবভাবিনী ভাবে ভ্রমণ করিতেছে –কত কত সন্ন্যাসী, উদাসীন ও উর্দ্ধবাহু জটাজুট সংযুক্ত ও ভস্ম বিভূতি আবৃত হইয়া শরীর ও ইন্দ্রিয়াদি নিগ্রহে সযত্ন আছেন –কত কত যোগী নিজ নিজ বিরল স্থানে সমাধি জন্য রেচক, পূরক ও কুম্ভক করিতেছেন –কত কত কলায়ত, ধাড়ি ও আতাই বীণা, মৃদঙ্গ, রবাব ও তানপুরা লইয়া ধ্রুপদ, ধরু, খেয়াল প্রবন্ধ, ছন্দ, সোরবন্ধ, তেরানা, সারগম, চতুরং ও নক্সগুলে মশগুল হইয়া আছে। রামলাল ও অন্যান্য সকলে মণিকর্ণিকার ঘাটে স্নানাদি করিয়া কাশীতে চারি দিবস অবস্থিতি করিলেন। রামলাল মায়ের ও ভগিনীর নিকট সর্বদা থাকিতেন, বৈকালে বরদাবাবুকে লইয়া ইতস্তত ভ্রমণ করিতেন। এক দিন পর্যটন করিতে করিতে দেখিলেন সম্মুখে একটি মনোরম আশ্রম, সেখানে এক প্রাচীন ব্যক্তি বসিয়া ভাগীরথীর শোভা দেখিতেছেন নদী বেগবতী –বারি তর তর শব্দের চলিয়াছে –আপনার নির্মলত্ব হেতুক বৈকালিক বিচিত্র আকাশকে যেন ক্রোড়ে লইয়া যাইতেছে। রামলাল ঐ ব্যক্তির নিকট যাইবামাত্রে তিনি পূর্বপরিচিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন –কেমন শুকোপনিষৎ পাঠে তোমার কি বোধ হইল ? রামলাল তাঁহার মুখবলোকন করণানন্তর প্রণাম করিলেন। সেই প্রাচীন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন –বাবা ! আমার ভ্রম হইয়াছে –আমার একজন শিষ্য আছে তাহার মুখ ঠিক তোমার মতো, আমি তাহাকেই বোধ করিয়া তোমাকে সম্বোধন করিয়াছিলাম। পরে রামলাল ও বরদাবাবু তাঁহার নিকট বসিয়া নানা প্রকার শাস্ত্রীয় আলাপ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে চিন্তাযুক্ত এক ব্যক্তি অধোবদনে নিকটে আসিয়া বসিলেন। বরদাবাবু তাঁহাকে নিরীক্ষণ করত বলিলেন –রাম ! দেখো কি ?–নিকটে যে তোমার দাদা ! রামলাল এই কথা শুনিবামাত্রে লোমাঞ্চিত হইয়া মতিলালের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, মতিলাল রামলালকে অবলোকনপূর্বক চমকিয়া উঠিয়া আলিঙ্গন করিলেন। ক্ষণেক কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া –”ভাই হে ! আমাকে কি ক্ষমা করিবে” –মতিলাল এই কথা বলিয়া অনুজের গলায় হাত জড়াইয়া স্কন্ধদেশ নয়নবারিতে অভিষিক্ত করিলেন। দুইজনেই কিয়াৎক্ষণ মৌন ভাবে থাকিলেন –মুখ হইতে কথা নিঃসরণ হয় না –ভাই যে কি পদার্থ তাহা উভয়েরই ঐ সময়ে বিলক্ষণ বোধ হইল। পরে বরদাবাবুর চরণধূলা লইয়া মতিলাল জোড় হাতে বলিলেন –মহাশয় ! আপনি যে কি বস্তু তাহা আমি এত দিনের পর জানিলাম –এ নরাধমকে ক্ষমা করুন। বরদাবাবু দুই ভ্রাতার হাত ধরিয়া উক্ত প্রাচীন ব্যক্তির নিকট হইতে বিদায় লইয়া পথিমধ্যে তাহাদিগের পরস্পরের যাবতীয় পূর্ব কথা শুনিতে শুনিতে ও বলিতে বলিতে চলিলেন এবং আলাপ দ্বারা মতিলালের চিত্তের বিভিন্নতা দেখিয়া অসীম আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন। পরিবারেরা যে স্থানে ছিলেন, তথায় আসিলে মতিলাল কিঞ্চিৎ দূর থেকে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন –”কই মা কোথায় ? –মা! তোমার সেই কুসন্তান আবার এল –সে আজো বেঁচে আছে –মরে নাই –আমি যে ব্যবহার করিয়াছি তার পর যে তোমার নিকট মুখ দেখাই এমন ইচ্ছা করে না –এক্ষণে আমার বাসনা এই যে একবার তোমার চরণ দর্শন করিয়া প্রাণ ত্যাগ করি। মাতা এই কথা শুনিবামাত্রে প্রফুল্লচিত্তে অশ্রুযুক্ত নয়নে নিকটে আসিয়া জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুখাবলোকনে অমূল্য ধন প্রাপ্ত হইলেন। মতিলাল মাতাকে দেখিবামাত্রেই তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া পড়িয়া থাকিলেন। ক্ষণেক কাল পরে মাতা হাত ধরিয়া উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাহার চক্ষের জল পুঁছাইয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন –মতি! তোমার বিমাতা, ভগিনী ও স্ত্রী আছেন তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করো। মতিলাল ভগিনী ও বিমাতাকে প্রণাম করিয়া আপন পত্নীকে দেখিয়া পূর্বকথা স্মরণ হওয়াতে রোদন করিয়া বলিলেন –মা ! আমি যেমন কুপুত্র, কুভ্রাতা, তেমনি কুস্বামী –এমন সৎস্ত্রীর যোগ্য আমি কোনো প্রকারেই নহি ! স্ত্রী-পুরুষ বিবাহকালীন পরমেশ্বরের নিকট এক প্রকার শপথ করে যে তাহার যাব্জজীবন পরস্পর প্রেম করিবে, মহাক্লেশে পড়িলেও ছাড়াছাড়ি হইবে না –স্ত্রী অন্য পুরুষের প্রতি মন কখন হইবে না এবং পুরুষেরও অন্য স্ত্রীর প্রতি মন কদাপি যাইবে না –ঐরূপ মননে ঘোর পাপ। এই শপথের বিপরীত কর্ম আমা হইতে অনেক হইয়াছে তবে স্ত্রী কর্তৃক আমি পরিত্যক্ত কেন না হই ? আর আমার এমন যে ভাই ও ভগিনী তাহাদিগের প্রতি যৎপরোনাস্তি নিগ্রহ করিয়াছি –তুমি যে মা –যার বাড়া পৃথিবীতে অমূল্য বস্তু আর নাই –তোমাকে অসীম ক্লেশ দিয়াছি –পুত্র হইয়া তোমাকে প্রহার করিয়াছি। মা ! এ সকল পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে ? এক্ষণে আমার শীঘ্র মৃত্যু হইলে মনে যে দাবানাল জ্বলিতেছে তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাই, কিন্তু বোধ করি মৃত্যুর মৃত্যু হইয়াছে কারণ তাহার দূতস্বরূপ রোগের কিছু চিহ্ণ দেখি না –যাহা হউক তোমরা সকলে বাটী যাও –আমি এই ধামে গুরুর নিকট থাকিয়া কঠোর অভ্যাসে প্রাণ ত্যাগ করিব।
অনন্তর বরদাবাবু, রামলাল ও তাহার মাতা মতিলালের গুরুকে আনাইয়া বিস্তর বুঝাইয়া মতিলালকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। মুঙ্গেরের নিকট রজনীযোগে নৌকা চাপা হইলে চৌয়াড়ের মতো আকৃতি একজন লোক ঘনিয়া ঘনিয়া কাছে আসিয়া “আগুন আছে –আগুন আছে” বলিয়া উঁচু হইয়া দেখিতে লাগিল। তাহার রকম-সকম দেখিয়া বরদাবাবু বলিলেন –সকলে সতর্ক হও, তদনন্তর নৌকার ছাতের উপর উঠিয়া দেখিলেন একটা ঝোপের ভিতরে প্রায় বিশ –ত্রিশজন অস্ত্রধারী লোক ঘাপ্টি মারিয়া বসিয়া আছে –ঐ ব্যক্তি সংকেত করিলে চড়াও হইবে। অমনি রামলাল ও বরদাবাবু বাহির হইয়া বন্দুক লইয়া আওয়াজ করিতে লাগিলেন, বন্দুকের আওয়াজে ডাকাইতেরা বনের ভিতর প্রবেশ করিল। বরদাবাবু ও রামলালের মানস যে তলওয়ার হাতে লইয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া দুই –একজনকে ধরিয়া আনিয়া নিকটস্থ দারোগার জিম্মা করিয়া দেন কিন্তু পরিবারেরা সকলে নিষেধ করিল। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া বলিল –আমার বাল্যাবস্থা অবধি সর্ব প্রকারেই কুশিক্ষা হইয়াছে –আমার বাবুয়ানাতেই সর্বনাশ হইয়াছে। রামলাল কসরৎ করিত তাহাতে আমি পরিহাস করিতাম –কিন্তু আজ জানিলাম যে বালককালাবধি মর্দনা কসরৎ না করিলে সাহস হয় না। সম্প্রতি আমার অতিশয় ভয় হইয়াছিল, যদ্যপি রামলাল ও বারদাবাবু না থাকিতেন তবে আমরা সকলেই কাটা যাইতাম।
অল্পকালের মধ্যে সকলে বৈদ্যবাটীতে পৌঁহুছিয়া বরদাবাবুর বাটীতে উঠিলেন। বরদাবাবু ও রামলালের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া গ্রামস্থ যাবতীয় লোক চতুর্দিকে থেকে দেখা করিতে আসিল –সকলেরই মনে আনন্দের উদয় হইল –সকলেরই বদন আহ্লাদে দেদীপ্যমান হইল –সকলেই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইয়া প্রার্থনা ও আশীর্বাদের পুষ্প বৃষ্টি করিতে লাগিল।
হেরম্বচন্দ্র চৌধুরীবাবু পর দিবস আসিয়া বলিলেন –রামবাবু ! আমি বুঝিতে পারি নাই –বাঞ্ছারামের পরামর্শে তোমাদিগের ভদ্রাসন দখল করিয়া লইয়াছি –আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি যে তোমাদিগের পরিবারকে বাহির করিয়া বাটী দখল লইয়াছি। তোমার অসাধারণ গুণ –এক্ষণে আমি বাটী অমনি ফিরিয়া দিতেছি, আপনারা স্বচ্ছন্দে সেখানে গিয়া বাস করুন। রামলাল বলিলেন –আপনার নিকট আমি বড়ো উপকৃত হইলাম, যদ্যপি আপনার বাটী ফিরিয়া দিবার মানষ হয় তবে আপনার যাহা যথার্থ পাওনা আছে গ্রহণ করিলে আমরা বাধিত হইব। হেরম্ববাবু এই প্রস্তাবে সম্মত হইলে রামলাল তৎক্ষণাৎ নিজে হইতে টাকা দিয়া দুই ভায়ের নামে কওয়ালা লিখিয়া লইয়া পরিবারের সহিত পৈতৃক ভদ্রাসনে গেলেন এবং উর্দ্ধদৃষ্টি করত কৃতজ্ঞচিত্তে মনে মনে বলিলেন –”জগদীশ্বর ! তোমা হইতে কি-না হইতে পারে !”
অনন্তর রামলালের বিবাহ হইল ও দুই ভাইয়ে অতিশয় সম্প্রীতিতে মায়েরও অন্যান্য পরিবারের সুখবর্ধক হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন। বরদাবাবু বরদাপ্রসাদাৎ বদরগঞ্জে বিষয়কর্মার্থ গমন করিলেন –বেচারামবাবু বিষয়-বিভব বিক্রয় করিয়া প্রকৃত বেচারাম হইয়া বারাণসীতে বাস করিলেন –বেণীবাবু কিছু দিন বিনা শিক্ষায় শৌখিন হইয়া আইন ব্যবসাতে মনোযোগ করিলেন –বাঞ্ছারাম বহুত ফন্দি ও ফেরেক্কা করিয়া বজ্রাঘাতে মরিয়া গেলেন –বক্রেশ্বর খোশামোদ ও বরামদ করিয়া ফ্যা ফ্যা করতঃ বেড়াইতে লাগিলেন –ঠকচাচা ও বাহুল্য পুলিপালমে গিয়া জাল করাতে সেখানে তাহাদিগের বাজিঞ্জির মাটি কাটিতে হয় এবং কিছুদিন পরে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইয়া তাহাদের মৃত্যু হইল –ঠকচাচী কোনো উপায় না দেখিয়া চুড়িওয়ালী হইয়া ভেটিয়ারি গান “চুড়িয়ালের চুড়িয়া” গাইতে গাইতে গলি গলি ফিরিতে লাগিল –হলধর, গদাধর ও আর আর ব্রজবালক মতিলালের স্বভাব ভিন্ন দেখিয়া অন্যান্য কাপ্তেনবাবুর অন্বেষণ করিতে উদ্যত হইল –জান সাহেব ইনসালবেন্ট লইয়া দালালি কর্ম আরম্ভ করিলেন –প্রেমনারায়ণ মজুমদার ভেক লইয়া “মহাদেবের মনের কথা রে অরে ভক্ত বই আর কে জানে” এই বলিয়া চীৎকার করিয়া নবদ্বীপে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন –প্রমদার স্বামী অনেক স্থানে পাণিগ্রহণ করিয়া ছিলেন, এক্ষণে শূন্যপাণি হওয়াতে বৈদ্যবাটীতে আসিয়া শ্যালকদিগের স্কন্ধে ভোগ করত কেবল কলাইকন্দ, ঘেয়ারূ, তাজফেনি, বেদানা, সেও ও জলগোজা খাইয়া টপ্পা মারিতে আরম্ভ করিলেন –তাহার পরে যে সকল ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিতে বাকী রহিল –”আমার কথাটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল”।
বাবুরামবাবুর পরিচয়—মতিলালের বাঙ্গালা, সংস্কৃত ও ফার্সী শিক্ষা।
বৈদ্যাবাটীর বাবুরাম বাবু বড়ো বৈষয়িক ছিলেন। তিনি মাল ও ফৌজদারী আদালতে অনেক কর্ম করিয়া বিখ্যাত হন। কর্মকাজ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া উৎকোচাদি গ্রহণ না করিয়া যথার্থ পথে চলা বড়ো প্রাচীন প্রথা ছিল না – বাবুরাম সেই প্রথানুসারেই চলিতেন। একে কর্মে পটু – তাতে তোষামোদ ও কৃতাঞ্জলি দ্বারা সাহেব-সুবাদিগকে বশীভূত করিয়াছিলেন এজন্য অল্পদিনের মধ্যেই প্রচুর ধন উপার্জন করিলেন। এদেশে ধন অথবা পদ বাড়িলেই মান বাড়ে, বিদ্যা ও চরিত্রের তাদৃক্ গৌরব হয় না। বাবুরাম বাবুর অবস্থা পূর্বে বড়ো মন্দ ছিল, তৎকালে গ্রামে কেবল দুই এক ব্যক্তি তাঁহার তত্ত্ব করিত। পরে তাঁহার সুদৃশ্য অট্টালিকা, বাগ-বাগিচা, তালুক ও অন্যান্য ঐশ্বর্য-সম্পত্তি হওয়াতে অনুগত ও অমাত্য বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অসংখ্য হইল। অবকাশ কালে বাটিতে আসিলে তাঁহার বৈঠকখানা লোকারণ্য হইত, যেমন মেঠাইওয়ালার দোকানে মিষ্ট থাকিলেই তাহা মক্ষিকায় পরিপূর্ণ হয় তেমন ধনের আমাদানি হইলেই লোকের আমদানি হয়। বাবুরামবাবুর বাটীতে যখন যাও তাঁহার নিকট লোক ছাড়া নাই—কি বড়ো, কি ছোট, সকলেই চারিদিকে বসিয়া তুষ্টিজনক নানা কথা কহিতেছে, বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা ভঙ্গিক্রমে তোষামদ করিত আর এলোমেলো লোকেরা একেবারেই জল উঁচু-নিচু বলিত। এইরূপে কিছু কাল যাপন করিয়া বাবুরাম বাবু পেন্সন লইলেন ও আপন বাটীতে বসিয়া জমিদারী ও সওদাগরী কর্ম করিতে আরম্ভ করিলেন।
লোকের সর্বপ্রকারে সুখ প্রায় হয় না ও সর্ববিষয়ে বুদ্ধিও প্রায় থাকে না। বাবুরাম বাবু কেবল ধন উপার্জনেই মনোযোগ করিতেন। কি প্রকারে বিষয়-বিভব বাড়িবে, কি প্রকারে দশজন লোক জানিবে, কি প্রকারে গ্রামস্থ লোক-সকল করজোড়ে থাকিবে— কি প্রকারে ক্রিয়াকাণ্ড সর্বোত্তম হইবে— এই সকল বিষয় সর্বদা চিন্তা করিতেন। তাঁহার এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। বাবুরামবাবু বলরাম ঠাকুরের সন্তান, এজন্য জাতিরক্ষার্থ কন্যাদ্বয় জন্মিবামাত্র বিস্তর ব্যয় ভূষণ করিয়া তাহাদের বিবাহ দিয়াছিলেন, কিন্তু জামাতারা কুলীন, অনেক স্থানে দারপরিগ্রহ করিয়াছিল— বিশেষ পারিতোষিক না পাইলে বৈদ্যবাটীর শ্বশুরবাটীতে উঁকিও মারিত না। পুত্র মতিলাল বাল্যাবস্থা অবধি আদর পাইয়া সর্বদা বাইন করিত—কখন বলিত বাবা চাঁদ ধরিব—কখন বলিত বাবা তোপ খাব। যখন চিৎকার করিয়া কান্দিতে আরম্ভ করিত নিকটস্থ সকল লোক বলিত ঐ বান্কে ছেলেটার জ্বালায় ঘুমানো ভার। বালকটি পিতা-মাতার নিকট আস্কারা পাইয়া পাঠশালায় যাইবার নামও করিত না। যিনি বাটীর সরকার তাঁহার উপর শিক্ষা করাইবার ভার ছিল। প্রথম প্রথম গুরু মহাশয়ের নিকটে গেলে মতিলাল আঁ আঁ করিয়া কান্দিয়া তাঁহাকে আঁচড় ও কামড় দিত—গুরুমহাশয় কর্তার নিকট গিয়া বলিতেন, মহাশয়! আপনার পুত্রকে শিক্ষা করানো আমার কর্ম নয়। কর্তা প্রত্যুত্তর দিতেন—ও আমার সবেধন নীলমণি-ভুলাইয়া-টুলাইয়া গায় হাত বুলাইয়া শেখাও। পরে বিস্তর কৌশলে মতিলাল পাঠশালায় আসিতে আরম্ভ করিল। গুরুমহাশয় পায়ের উপর পা, বেত হাতে দেয়ালে ঠেসান দিয়া ঢুলছেন ও বলছেন “ল্যাখ রে ল্যাখ।” মতিলাল ঐ অবকাশে উঠিয়া তাঁহার মুখের নিকট কলা দেখাচ্ছে আর নাচ্ছে — গুরুমশায় নাক ডাকিতেছেন—শিষ্য কি করিতেছে তাহা কিছুই জানেন না। তাঁহার চক্ষু উন্মীলিত হইলেই মতিলাল আপন পাততাড়ির নিকট বসিয়া কাগের ছা বগের ছা লিখিত। সন্ধ্যাকালে ছাত্রদিগকে ঘোষাইতে আরম্ভ করিলে মতিলাল গোলে হরিবোল দিত—কেবল গণ্ডার এণ্ডা ও বুড়িকা ও পণিকার শেষ অক্ষর বলিয়া ফাঁকি সিদ্ধান্ত করিত,—মধ্যে মধ্যে গুরুমহাশয় নিদ্রিত হইলে তাঁহার নাকে কাটি দিয়া ও কোঁচার উপর জলন্ত অঙ্গার ফেলিয়া তীরের ন্যায় প্রস্থান করিত। আর আহারের সময় চুনের জল ঘোল বলিয়া অন্য লোকের হাত দিয়া পান করাইত। গুরুমহাশয় দেখিলেন বালকটি অতিশয় ত্রিপণ্ড, মা সরস্বতীকে একবারে জলপান করিয়া বসিল, অতএব মনে করিলেন যদি এত বেত্রাঘাতে সুযুত না হইল, কেবল গুরুমারা বিদ্যাই শিক্ষা করিল তবে এমতো শিষ্যের হাত হইতে ত্বরায় মুক্ত হওয়া কর্তব্য, কিন্তু কর্তা ছাড়েন না—অতএব কৌশল করিতে হইল। বোধ হয় গুরুমহাশয়গিরি অপেক্ষা সরকারি ভালো, ইহাতে বেতন দুই টাকা ও খোরাক-পোষাক—উপরি লাভের মধ্যে তালপাত কলাপাত ও কাগজ ধরিবার কালে এক একটা সিধে ও এক এক জোড়া কাপড় মাত্র, কিন্তু বাজার সরকারি কর্মে নিত্য কাঁচা কড়ি। এই বিবেচনা করিয়া কর্তার নিকট গিয়া কহিলেন—মতিবাবুর কলাপাত ও কাগজ লেখা শেষ হইয়াছে এবং এক প্রস্থ জমিদারী কাগজও লেখানো গিয়াছে। বাবুরামবাবু এই সংবাদ পাইয়া আহ্লাদে মগ্ন হইলেন, নিকটস্থ পারিষদেরা বলিল— না হবে কেন! সিংহের সন্তান কি কখন শৃগাল হইতে পারে ?
পরে বাবুরাম বাবু বিবেচনা করিলেন ব্যাকরণাদি ও কিঞ্চিত ফার্সী শিক্ষা করানো আবশ্যক। এই স্থির করিয়া বাটীর পূজারী ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিলেন—কেমন হে তোমার ব্যাকরণ-ট্যাকরণ পড়াশুনা আছে ? পূজারী ব্রাহ্মণ গণ্ডমুর্খ—মনে করিল যে চাউল-কলা পাই তাতে তো কিছুই আঁটে না—এত দিনের পর বুঝি কিছু প্রাপ্তির পন্থা হইল, এই ভাবিয়া প্রত্যুত্তর করিল— আজ্ঞে হাঁ, আমি কুইনমোড়ার ঈশ্বরচন্দ্র বেদান্তবাগীশের টোলে ব্যাকরণাদি একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর অধ্যয়ন করি, কপাল মন্দ, পড়াশুনার দরুন কিছুই লাভবান হয় না, কেবল আদা জল খাইয়া মহাশয়ের নিকট পড়িয়া আছি। বাবুরাম বাবু বলিলেন—তুমি অদ্যাবধি আমার পুত্রকে ব্যাকারণ শিক্ষা করাও। পূজারী ব্রাহ্মণ আশা বায়ুতে মুগ্ধ হইয়া মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের দুই-এক পাত শিক্ষা করিয়া পড়াইতে আরম্ভ করিলেন। মতিলাল মনে করিলেন গুরু-মহাশয়ের হাত হইতে তো মুক্ত হইয়াছি এখন এ বেটা চাউল-কলাখেকো বামুনকে কেমন করিয়া তাড়াই? আমি বাপ-মার আদরের ছেলে—লিখি বা না লিখি, তাঁহারা আমাকে কিছুই বলিবেন না—লেখাপড়া শেখা কেবল টাকার জন্য—আমার বাপের অতুল বিষয়—আমার লেখাপড়ায় কাজ কি? কেবল নাম সহি করিতে পারিলেই হইল। আর যদি লেখাপড়া শিখিব তবে আমার এয়ারবক্সিদিগের দশা কি হইবে? আমোদ করিবার এই সময়,—এখন কি লেখা-পড়ার যন্ত্রণা ভালো লাগে ?
মতিলাল এই স্থির করিয়া পূজারী ব্রাহ্মণকে বলিল—অরে বামুন, তুই যদি হ, য, ব, র, ল, শিখাইতে আমার নিকট আর আসিস ঠাকুর ফেলিয়া দিয়া তোর চাউল-কলা পাইবার উপায় সুদ্ধ ঘুচাইয়া দিব কিন্তু বাবার কাছে গিয়া একথা বললে ছাতের উপর হতে তোর মাথায় এমন এক এগারঞ্চি ঝাড়িব যে তোর ব্রাহ্মণীকে কালই হাতের নোয়া খুলিতে হইবে। পূজারী ব্রাহ্মণ হ, য, ব, র, ল প্রসাদ্যৎ ক্ষণেক কাল হ, য, ব, র, ল হইয়া থাকিলেন পরে আপনা আপনি বিচার করিলেন—ছয় মাস প্রাণপণে পরিশ্রম করিয়াছি এক পয়সাও হস্তগত হয় নাই, আবার “লাভঃ পরং গোবধঃ” —প্রাণ নিয়া টানাটানি—এক্ষণে ছেড়ে দিলে কেঁদে বাঁচি। পূজারী ব্রাহ্মণ যৎকালে এই সকল পর্যালোচনা করিতেছিলেন মতিলাল তাঁহার মুখাবলোকন করিয়া বলিল—বড়ো যে বসে বসে ভাবছিস্? টাকা চাই? এই নে—কিন্তু বাবার কাছে গিয়া বল্ গে আমি সব শিখেছি। পূজারী ব্রাহ্মণ কর্তার নিকট গিয়া বলিল—মহাশয় মতিলাল সামান্য বালক নহে—তাহার অসাধারণ মেধা, যাহা একবার শুনে তাহাই মনে করিয়া রখে। বাবুরামবাবুর নিকট একজন আচার্য ছিল—বলিল, মতিলালের পরিচয় দিবার আবশ্যক নাই। উটি ক্ষণজন্মা ছেলে, বেঁচে থাকিলে দিক্পাল হইবে।
অনন্তর পুত্রকে ফার্সী পড়াইবার জন্য বাবুরাম বাবু একজন মুন্শী অন্বেষণ করিতে লাগিলেন। অনেক অনুসন্ধানের পর আলাদি দরজির নানা হবিবল হোসেন তেল কাঠ ও ১।।০ টাকা মাহিনাতে নিযুক্ত হইল। মুন্শী সাহেবের দন্ত নাই, পাকা দাড়ি, শনের ন্যায় গোঁফ, শিখাইবার সময় চক্ষু রাঙা করেন ও বলেন, ‘আরে বে পড়’ ও কাফ গাফ আয়েন গায়েন উচ্চারণে তাঁহার বদন সর্বদা বিকট হয়। একে বিদ্যা শিক্ষাতে কিছু অনুরাগ নাই তাতে ঐরূপ শিক্ষক অতএব মতিলালের ফার্সী পড়াতে ঐরূপ ফল হইল। এক দিবস মুন্শী সাহেব হেঁট হইয়া কেতাব দেখিতেছেন ও হাত নেড়ে সুর করিয়া মস্নবির বয়েত পড়িতেছেন ইত্যবসরে মতিলাল পিছন দিগ্ দিয়া একখান জ্বলন্ত টিকে দাড়ির উপর ফেলিয়া দিল। তৎক্ষণাৎ দাউদাউ করিয়া দাড়ি জ্বলিয়া উঠিল। মতিলাল বলিল—কেমন রে বেটা নেড়ে আমাকে পড়াবি? মুন্শী সাহেব দাড়ি ঝাড়িতে ঝাড়িতে ও তোবা তোবা বলিতে বলিতে প্রস্থান করিলেন এবং জ্বালার চোটে চিৎকার করিয়া বলিলেন—এস্ মাফিক বেতমিজ আওর বদ্জাৎ লেড়কা কাভি দেখা নেই—এস্ কাম্সে মুল্কমে চাস কর্ণা আচ্ছি হ্যায়। এস্ জেগে আনা ভি হারাম হ্যায়-তোবা-তোবা-তোবা !!!
০২.
মতিলালের ইংরাজী শিখাবার উদ্যোগ গো বাবুরামবাবুর বালীতে গমন।
মুন্শী সাহেবের দুর্গতির কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু বলিলেন-মতিলাল তো আমার তেমন ছেলে নয়- সে বেটা জেতে নেড়ে-কত ভালো হবে ? পরে ভাবিলেন যে ফার্সী চলন উঠিয়া যাইতেছে, এখন ইংরেজী পড়ানো ভালো। যেমন ক্ষিপ্তের কখন কখন জ্ঞানোদয় হয় তেমনি অবিজ্ঞ লোকেরও কখন কখন বিজ্ঞতা উপস্থিত হয়। বাবুরামবাবু ঐ বিষয় স্থির করিয়া বিবেচনা করিতে লাগিলেন আমি বারাণসীবাবুর ন্যায় ইংরেজী জানি-‘‘সরকার কম স্পিক ন্যাট’’ -আমার নিকটস্থ লোকেরাও তদ্রূপ বিদ্বান্, অতএব একজন বিজ্ঞ ব্যক্তির নিকট পরামর্শ লওয়া কর্তব্য। আপন কুটুম্ব ও আত্মীয়দিগের নাম স্মরণ করাতে মনে হইল বালীর বেণীবাবু বড়ো যোগ্য লোক। বিষয় কর্ম করিলে তৎপরতা জন্মে। এজন্য অবিলম্বে একজন চাকর ও পাইক সঙ্গে লইয়া বৈদ্যবাটীর ঘাটে আসিলেন।
আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে মাঝিরা বৈঁতির জাল ফেলিয়া ইলিশ মাছ ধরে ও দুই প্রহরে সময় মাল্লারা প্রায় আহার করিতে যায় এজন্য বৈদ্যবাটীর ঘাটে খেয়া কিংবা চলতি নৌকা ছিল না। বাবুরামবাবু চৌগোঁপ্পা-নাকে তিলক-কস্তাপেড়ে ধুতি পরা-ফুলপুকুরে জুতা পায়-উদরটি গণেশের মতো-কোঁচনো চাদরখানি কাঁধে-একগাল পান-ইতস্ততঃ বেড়াইয়া চাকরকে বলছেন-ওরে হরে ! শীঘ্র বালী যাইতে হইবে দুই-চার পয়সায় একখানা চলতি পানসি ভাড়া কর তো।
বড়ো মানুষের খানসামারা মধ্যে মধ্যে বেআদব হয়, হরি বলিল-মোশায়ের যেমন কান্ড ! ভাত খেতে বস্তেছিনু-ডাকাডাকিতে ভাত ফেলে রেখে এসেচি-ভেটেল পান্সি হইলে অল্প ভাড়ায় হইত-এখন জোয়ার-দাঁড় টান্তে ও ঝিঁকে মারতে মাঝিদের কাল ঘাম ছুটবে-গহনার নৌকায় গেলে দুই-চার পয়সা হতে পারে-চলতি পান চার পয়সায় ভাড়া করা আমার কর্ম নয়-এ কি থুতকুড়ি দিয়া ছাতু গোলা ?
বাবুরামবাবু দুটা চক্ষু কট্মট্ করিয়া বলিলেন-তোবেটার বড়ো মুখ বেড়েছে-ফের যদি এমন কথা কবি তো ঠাস্ করে চড় মারবো। বাঙালী ছোট জাতিরা একটু ঠোকর খাইলেই ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপে, হরি তিরস্কার খাইয়া জড়সড় হইয়া বলিল-এজ্ঞে না, বলি এখন কি নৌকা পাওয়া যায় ? এই বল্তে বল্তে একখানা বোট গুণ টেনে ফিরিয়া যাইতেছিল, মাঝির সহিত অনেক কস্তাকস্তি ধস্তাধস্তি করিয়া ।।০ ভাড়া চুক্তি হইল-বাবুরামবাবু চাকর ও পাইকের সহিত বোটের উপর উঠিলেন। কিঞ্চিৎদূর আসিয়া দুই দিগ্ দেখিতে দেখিতে বলিতেছেন-ওরে হরে ! বোটখানা পাওয়া গিয়াছে ভালো-মাঝি ! ও বাড়িটা কার রে ? ওটা কি চিনির কল ? অহে চকমকি ঝেড়ে এক ছিলিম তামাক সাজো তো ? পরে ভড় ভড় করিয়া হুঁকা টানিতেছেন-শুশুকগুলা এক এক বার ভেসে ভেসে উঠতেছে-বাবু স্বয়ং উঁচু হইয়া দেখ্তেছেন ও গুন গুন করিয়া সখীসংবাদ গাইতেছেন-‘‘দেখে এলাম শ্যাম তোমার বৃন্দাবন ধাম কেবল আছে নাম’’। ভাঁটা হাওয়াতে বোট সাঁ সাঁ করিয়া চলিতে লাগিল-মাঝিরাও অবকাশ পাইল-কেহ বা গলুয়ে বসিল, কেহ বা বোকা ছাগলের দাড়ি বাহির করিয়া চারি দিগে দেখিতে লাগিল ও চাটগেঁয়ে সুরে গান আরম্ভ করিল ‘‘খুলে পড়বে কানের সোনা শুনে বাঁশির সুর’’-
সূর্য অস্ত না হইতে হইতে বোট দেওনাগাজির ঘাটেতে গিয়া লাগিল। বাবুরামবাবুর শরীরটি কেবল মাংসপিন্ড-চারিজন মাঝিতে কুঁতিয়া ধরাধরি করিয়া উপরে তুলিয়া দিল। বেণীবাবু কুটুম্বকে দেখিয়া ‘‘আস্তে আজ্ঞা হউক, বসতে আজ্ঞা হউক’’ প্রভৃতি নানবিধ শিষ্টালাপ করিলেন। বাবুর বাটীর চাকর রাম তৎক্ষণাৎ তামুক সাজিয়া আনিয়া দিল। বাবুরামবাবু ঘোর হুঁকারি, দুই-এক টান টানিয়া বলিলেন-ওহে হুঁকাটা পীসে পীসে বল্ছে, খুড়া খুড়া বল্ছে না কেন ? বুদ্ধিমান লোকের নিকট চাকর থাকিলে সেও বুদ্ধিমান হয়। রাম অমনি হুঁকায় ছিঁচ্কা দিয়া-জল ফিরাইয়া-মিঠেকড়া তামাক সেজে-বড়ো দেকে নল করে হুঁকা আনিয়া দিল। বাবুরামবাবু হুঁকা সম্মুখে পাইয়া একবারে যেন ইজারা করিয়া লইলেন-ভড়র ভড়র টানছেন- ধুঁয়া সৃষ্টি করছেন-ও বিজর বিজর বক্ছেন।
বেণীবাবু। মহাশয় একবার উঠে একটা পান খেলে ভালো হয় না ?
বাবুরামবাবু। সন্ধ্যা হল-আর জল খাওয়া থাকুক-এ আমার ঘর-আমাকে বলতে হবে কেন ?
-দেখো মতিলালের বুদ্ধিশুদ্ধি ভালো হইয়াছে-ছেলেটিকে দেখে চক্ষু জুড়ায়। সম্প্রতি ইংরেজী পড়াইতে বাঞ্ছা করি-অল্প-স্বল্প মাহিনাতে একজন মাস্টার দিতে পারো ?
বেণীবাবু। মাস্টার অনেক আছে, কিন্তু ২০/২৫ টাকা মাসে দিলে একজন মাঝারি গোছের লোক পাওয়া যায়।
বাবুরামবাবু। কত- ২৫ টাকা !!! অহে ভাই, বাটীতে নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ-প্রতিদিন একশত পাত পড়ে-আবার কিছুকাল পরেই ছেলেটির বিবাহ দিতে হইবে। যদি এত টাকা দিব তবে তোমার নিকট নৌকা ভাড়া করিয়া কেন এলাম ?
এই বলিয়া বেণীবাবুর গায়ে হাত দিয়া হা হা করিয়া হাসিতে লাগিলেন।
বেণীবাবু। তবে কলিকাতার কোনো স্কুলে ভর্তি করিয়া দিউন। একজন আত্মীয়-কুটুম্বের বাটীতে ছেলেটি থাকিবে, মাসে ৩/৪ টাকার মধ্যে পড়াশুনা হইতে পারিবে।
বাবুরামবাবু। এত ? তুমি বলে-কয়ে কমজম করিয়া দিতে পারো না ? স্কুলে পড়া কি ঘরে পড়ার চেয়ে ভালো ?
বেণীবাবু। যদ্যপি ঘরে একজন বিচক্ষণ শিক্ষক রাখিয়া ছেলেকে পড়ানো যায় তবে বড়ো ভালো হয়, কিন্তু তেমন শিক্ষক অল্প টাকায় পাওয়া যায় না, স্কুলে পড়ার গুণও আছে-দোষও আছে। ছেলেদিগের সঙ্গে একত্র পড়াশুনা করিলে পরস্পরের উৎসাহ জন্মে কিন্তু সঙ্গদোষ হইলে কোনো কোনো ছেলে বিগড়িয়া যাইতে পারে, আর ২৫/৩০ জন বালক এক শ্রেণীতে পড়িলে হট্টগোল হয়, প্রতিদিন সকলের প্রতি সমান তদারকও হয়না, সুতরাং সকলের সমানরূপ শিক্ষাও হয় না।
বাবুরামবাবু। তা যাহা হউক-মতিকে তোমার কাছে পাঠিয়ে দিব, দেখেশুনে যাহাতে সুলভ হয় তাহাই করিয়া দিও। যে সকল সাহেবের কর্মকাজ করিয়াছিলাম এক্ষণে তাহাদের কেহ নাই-থাকিলে ধরে-পড়ে অমনি ভর্তি করিতে পারিতাম। আর আমার ছেলে মোটামুটি শিখিলেই বস্ আছে, বড়ো পড়াশুনা করিলে স্বধর্মে থাকিবে না। ছেলেটি যাহাতে মানুষ হয় তাহাই করিয়া দিও-ভাই সকল ভার তোমার উপর।
বেণীবাবু। ছেলেকে মানুষ করিতে গেলে ঘরে-বাইরে তদারক চাই। বাপকে স্বচক্ষে সব দেখ্তে হয়-ছেলের সঙ্গে ছেলে খাটতে হয়। অনেক কর্ম বরাতে চলে বটে কিন্তু এ কর্মে পরের মুখেঝাল খাওয়া হয় না।
বাবুরামবাবু। সে সব বটে-মতি কি তোমার ছেলে নয় ? আমি এক্ষণে গঙ্গাস্নান করিব-পুরাণ শুনিব-বিষয়-আশয় দেখিব-আমার অবকাশ কই ভাই ? আর আমার ইংরেজী শেখা সেকেলে রকম। মতি তোমার-তোমার-তোমার !!! আমি তাকে তোমার কাছে পাঠাইয়া দিয়া নিশ্চন্ত হইব, তুমি যা জানো তাই করিবে কিন্তু ভাই ! দেখো যেন বড়ো ব্যয় হয় না- আমি কাচ্চাবাচ্চাওয়ালা মানুষ-তুমি সকল তো বুঝতে পারো ?
অনন্তর অনেক শিষ্টালাপের পর বাবুরামবাবু বৈদ্যবাটিতে প্রত্যাগমন করিলেন।
০৩.
মতিলালের বালীতে আগমন ও তথায় লীলাখেলা, পরে ইংরাজী শিক্ষার্থে বহুবাজারে অবস্থিতি।
রবিবারে কুঠিওয়ালারা বড়ো ঢিলে দেন—হচ্ছে হবে—খাচ্ছি খাব—বলিয়া অনেক বেলায় স্নান-আহার করেন—তাহার পরে কেহ বা বড়ে টেপেন—কেহ বা তাস পেটেন—কেহ বা মাছ ধরেন—কেহ বা তবলায় চাঁটি দেন— কেহ বা সেতার লইয়া পিড়িং পিড়িং করেন— কেহ বা শয়নে পদ্মনাভ ভালো বুঝেন—কেহ বা বেড়াতে যান—কেহ বা বহি পড়েন। কিন্তু পড়াশুনা অথবা সৎ কথার আলোচনা অতি অল্প হইয়া থাকে। হয় তো মিথ্যা গালগল্প কিংবা দলাদলির ঘোঁট, কি শম্ভু তিনটা কাঁঠাল খাইয়াছে এই প্রকার কথাতেই কাল ক্ষেপণ হয়। বালীর বেণীবাবুর অন্য প্রকার বিবেচনা ছিল। এদেশের লোকদিগের সংস্কার এই যে স্কুলে পড়া শেষ হইলে লেখাপড়ার শেষ হইল। কিন্তু এ বড়ো ভ্রম, আজন্ম মরণ পর্যন্ত সাধনা করিলেও বিদ্যার কুল পাওয়া যায় না, বিদ্যার চর্চা যত হয় ততই জ্ঞান বৃদ্ধি হইতে পারে। বেণীবাবু এ বিষয় ভালো বুঝিতেন এবং তদনুসারে চলিতেন। তিনি প্রাতঃকালে উঠিয়া আপনার গৃহকর্ম সকল দেখিয়া পুস্তক লইয়া বিদ্যানুশীলন করিতেছিলেন। ইতিমধ্যে চৌদ্দ বৎসরের একটি বালক—গলায় মাদুলি—কানে কামড়ি, হাতে বালা ও বাজু, সম্মুখে আসিয়া টিপ করিয়া একটি গড় করিল। বেণীবাবু এক মনে পুস্তক দেখিতেছিলেন বালকের জুতার শব্দে চম্কিয়া উঠিয়া দেখিয়া বলিলেন, ‘এসো বাবা মতিলাল এসো—বাটীর সব ভালো তো? মতিলাল বসিয়া সকল কুশল সমাচার করিল। বাণীবাবু কহিলেন—অদ্য রাত্রে এখানে থাকো কল্য প্রাতে তোমাকে কলিকাতায় লইয়া স্কুলে ভর্তি করিয়া দিব। ক্ষণেক কাল পরে মতিলাল জলযোগ করিয়া দেখিল অনেক বেলা আছে। চঞ্চল স্বভাব—এক স্থানে কিছু কাল বসিতে দারুন ক্লেশ বোধ হয়—এজন্য আস্তে আস্তে উঠিয়া বাটীর চতুর্দিকে দাঁদুড়ে বেড়াইতে লাগিল— কখন ঢেঁস্কেলের ঢেঁকিতে পা দিতেছে—কখন বা ছাতের উপর গিয়া দুপদুপ করিতেছে—কখন বা পথিকদিগকে ইট- পাটকেল মারিয়া পিট্রান দিতেছে; এইরূপে দুপ-দুপ করিয়া বালী প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল—কাহারো বাগানে ফুল ছেঁড়ে—কাহারো গাছের ফল পাড়ে—কাহারো মট্কার উপর উঠিয়া লাফয়—কাহারো জলের কলসী ভাঙিয়া দেয়।
বালীর সকল লোকেই ত্যক্ত হইয়া বলাবলি করিতে লাগিল—এ ছোঁড়া কে রে? যেমন ঘরপোড়া দ্বারা লস্কা ছারখার হইয়াছিল আমাদিগের গ্রামটা সেইরূপ তচ্নচ্ হবে না –কি? কেহ কেহ ঐ বালকের পিতার নাম শুনিয়া বলিল—আহা বাবুরামবাবুর এ পুত্র—না হবে কেন? “পুত্রে যশসি তোয়েচ নরাণাং পুণ্যক্ষণম্।”
সন্ধ্যা হইল—শৃগালদিগের হোয়া হোয়া ও ঝিঁ ঝিঁ পোকার ঝিঁ ঝিঁ শব্দে গ্রাম শব্দায়মান হইতে লাগিল। বলীতে অনেক ভদ্রলোকের বসতি—প্রায় অনেকের বাটীতে শালগ্রাম আছেন এজন্য শঙ্খ-ঘণ্টা ধ্বনির ন্যূনতা ছিল না। বেণীবাবু অধ্যয়নান্তর গামোড়া দিয়া তামাক খাইতেছেন ইত্যবসরে একটা গোল উপস্থিত হইল। পাঁচ-সাতজন লোক নিকটে আসিয়া বলিল—মশাই গো! বৈদ্যবাটীর জমিদারের ছেলে আমাদের উপর ইঁটঁ মারিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঝাঁকা ফেলিয়া দিয়াছে—কেহ বলিল—আমাকে ঠেলে ফেলে দিয়াছে—কেহ বলিল—আমার মুখে থুতু দিয়াছে—কেহ বলিল—আমার ঘিয়ের হাঁড়ি ভাঙিয়াছে। বাণীবাবু পরদুঃখে কাতর—সকলকে তুষেতেষে ও কিছু কিছু দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন, পরে ভাবিলেন এ ছেলের তো বিদ্যা নগদ হইবে—এক বেলাতেই গ্রাম কাঁপিয়া দিয়াছে—এক্ষণে এখন হইতে প্রস্থান করিলে আমার হাড় জুড়ায়।
গ্রামের প্রাণকৃঞ্চ খুড়ে, ভগবতী ঠাকুরদাদা ও ফচ্কে রাজকৃষ্ণ আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—বাণীবাবু এ ছেলে কে? —আমরা আহার করিয়া নিদ্রা যাইতেছিলাম—গোলের দাপটে উঠে পড়েছিলাম—কাঁচা ঘুম ভাঙাতে শরীরটা মাটি মাটি করিতেছে। বেণীবাবু কহিলেন—আর ও কথা কেনে বলো? একটা ভারি কর্মভোগে পড়িয়াছি—আমার একটি জমিদার ষণ্ডা কুটুম্ব আছে—তাহার হ্রস্ব দীর্ঘ কিছুই জ্ঞান নাই—কেবল কতকগুলো টাকা আছে। ছেলেটিকে স্কুলে ভর্তি করাইবার জন্য আমার নিকট পাঠাইয়াছেন—কিন্তু এর মধ্যেই হাড় কালি হইল—এমন ছেলেকে তিনদিন রাখিলেই বাটীতে ঘুঘু চরিবে। এইরূপ কথোপকথন হইতেছে—জন কয়েক চেংড়া পশ্চাতে মতিলাল ‘ভজ নর শম্ভুসুতেরে’ বলিয়া চিৎকার করিতে করিতে আসিল। বেণীবাবু বলিলেন—ঐ আসছে রে বাবু—চুপ কর—আবার দুই-এক ঘা বসিয়ে দেবে না-কি? পাপকে বিদায় পারিলে বাঁচি। মতিলাল বেণীবাবুকে দেখিয়া দাঁত বাহির করিয়া ঈষদ্ধাস্য করত কিঞ্চিৎ সস্কুচিত হইল। বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন—বাবু কোথায় গিয়েছিলে? মতিলাল বলিল—মহাশয়দের গ্রামটা কত বড়ো তাই দেখে এলেম।
পরে বাটীর ভিতর যাইয়া মতিলাল রাম চাকরকে তামাক আনিতে বলিল। অম্বুরি অথবা ভেলসায় সানে না—কড়া তামাকের উপর কড়া তামাক খাইতে লাগিল। রাম তামাক যোগাইয়া উঠিতে পারে না—এই আনে—এই নাই । এইরূপ মুহুর্মুহু তামাক দেওয়াতে রাম অন্য কোনো কর্ম করিতে পারিল না। বাণীবাবু রোয়াকে বসিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিলেন ও এক-এক বার পিছন ফিরিয়া মিট মিট করিয়া উঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলেন।
আহারের সময় উপস্থিত হইল। বেণীবাবু অন্তঃপুরে মতিলালকে লইয়া উত্তম অন্ন-ব্যঞ্জন ও নানা প্রকার চর্চা-চোষ্য-লেহ্য-পেয় দ্বারা পরিতোষ করাইয়া তাম্বুলগ্রহণান্তর আপনি শয়ন করিতে গেলেন। মতিলাল শয়নগারে গিয়া পান-তামাক খাইয় বিছেনার ভিতর ঢুকিল। কিছু কাল এপাশ ওপাশ করিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া এক-এক বার পায়চারি করিতে লাগিল ও এক-এক বার নীলু ঠাকুরের সখীসংবাদ অথবা রাম বসুর বিরহ গাইতে লাগিল। গানের চোটে বাটীর সকলের নিদ্রা ছুটে পালাইল।
চণ্ডীমণ্ডপে রাম ও কাশীজোড়া নিবাসী পেলারাম মালী শয়ন করিয়াছিল। দিবসে পরিশ্রম করিলে নিদ্রাটি বড়ো আরামে হয়, কিন্তু ব্যঘাত হইলে অত্যন্ত বিরক্তি জন্মে। গানের চিৎকারে চাকরের ও মালীর নিদ্রা ভাঙিয়া গেল ।
পেলারাম। অহে বাপা রাম ! এ সড়ার চিড়কারে মোর লিদ্রা হতেছে না—উঠে বাগানে বীজ গুঁড়া কি পেড়াইব?
রাম। (গা মোড় দিয়া) আরে রাত ঝিঁ ঝিঁ কচ্চে—এখন কেন উঠ্বি ? বাবু ভালো নালা কেটে জল এনেছে—এ ছোঁড়া কান ঝালা-পালা কল্লে—গেলে বাঁচি।
পরদিন প্রভাতে বেণীবাবু মতিলালকে লইয়া বৌবাজারের বেচারাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন। বেচারামবাবু কেনারামবাবুর পুত্র—বুনিয়াদী বড়ো মানুষ—সন্তানাদি কিছুই নাই—সাদাসিধে লোক কিন্তু জন্মাবধি গঁর্ণখাঁদা—অল্প অল্প পিট্পিটে ও চিড়চিড়ে। বেণীবাবুকে দেখিয়া স্বাভাবিক নাকিস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন—’আরে কও কি মনে করে?’
বাণীবাবু। মতিলাল মহাশয়ের বাটীতে থাকিয়া স্কুলে পড়বে—শনিবার শনিবার ছুটি পাইলে বৈদ্যবাটী যাইবে। বাবুরামবাবুর কলিকাতায় আপনার মতো আত্নীয় আর নাই এজন্য এই অনুরোধ করিতে আসিয়াছি।
বেচারাম। তার আটক কি? —এও ঘর সেও ঘর। আমার ছেলেপুলে নাই— কেবল দুই ভাগিনেয় আছে—মতীলাল স্বচ্ছন্দে থাকুক।
বেচারামবাবুর নাকিস্বরের কথা শুনিয়া মতিলাল খিল খিল করিয়া হাসিতে লাগিল। অমনি বাণীবাবু উহুঁ উহুঁ করত চোখ টিপ্তে লাগিলেন ও মনে করিলেন এমন ছেলে সঙ্গে থাকিলে কোথাও সুখ নাই। বেচারামবাবু মতিলালের হাসি শুনিয়া বলিলেন—বেণী ভায়া ! ছেলেটি কিছু বেদ্ড়া দেখতে পাই যে? বোধ হয় বালককালাবধি বিশেষ নাই পাইয়া থাকিবে। বাণীবাবু অতি অনুসন্ধনী—পূর্বকথা সকলি জানেন, আপনিও ভুগেছেন—কিন্তু নিজ গুণে সকল ঢেকে ঢুকে লইলেন—গুপ্ত কথা ব্যক্ত করিলে মতিলাল মারা যায়—তাহার কলিকাতায় থাকাও হয় না ও স্কুলে পড়াও হয় না। বেণীবাবু নিতান্ত বাসনা সে কিছু লেখাপড়া শিখিয়া কোনো প্রকার মানুষ হয়।
অনন্তর অন্যান্য প্রকার অনেক আলাপ করিয়া বেচারামবাবুর নিকট হইতে বিদায় হইয়া বেণীবাবু মতিলালকে সঙ্গে করিয়া শরবোরণ সাহেবের স্কুলে আসিলেন। হিন্দু কলেজ হওয়াতে শরবোরণ সাহেবের স্কুল কিঞ্চিৎ মেড়ে পড়িয়াছিল এজন্য সাহেব দিন রাত্রি উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন—তাঁহার শরীর মোটা—ভুরুতে রোঁ ভরা—গালে সর্বদা পান—বেত হাতে—এক একবার ক্লাসে ক্লাসে বেড়াইতেন ও এক একবার চৌকিতে বসিয়া গুড়গুড়ি টানিতেন। বেণীবাবু তাঁহার স্কুলে মতিলালকে ভর্তি করিয়া দিয়া বলীতে প্রত্যাগমন করিলেন।
০৪.
কলিকাতায় ইংরাজী শিক্ষার বিবরণ, শিশুশিক্ষার প্রকরণ, মতিলালের কুসঙ্গ ও ধৃত হইয়া পুলিশে আনয়ন।
প্রথম যখন ইংরাজেরা কলিকাতায় বাণিজ্য করিতে আইসেন, সে সময়ে সেট বসাখ বাবুরা সওদাগরী করিতেন, কিন্তু কলিকাতার একজনও ইংরাজী ভাষা জানিত না। ইংরাজদিগের সহিত কারবারের কথাবর্তা ইশারা দ্বারা হইত। মানব স্বভাব এই যে, চাড় পড়িলেই ফিকির বেরোয়, ইশারা দ্বারাই ক্রমে ক্রমে কিছু কিছু ইংরজী কথা শিক্ষা হইতে আরম্ভ হইল। পরে সুপরিম কোর্ট স্থাপিত হইলে, আইন-আদালতের ধাক্কায় ইংরাজী চর্চা বাড়িয়া উঠিল। ঐ সময় রামরাম মিশ্রী ও আনন্দিরাম দাস অনেক ইংরাজী কথা শিখিয়াছিলেন। রামরাম মিশ্রীর শিষ্য রামনারায়ণ মিশ্রী উকিলের কেরানিগিরি করিতেন ও অনেক লোকের দরখাস্ত লিখিয়া দিতেন, তাঁহার একটি স্কুল ছিল তথায় ছাত্রদিগকে ১৪।১৬ টাকা করিয়া মাসে মাহিনা দিতে হইত। পরে রামলোচন নাপিত, কৃষ্ণমোহন বসু প্রভৃতি অনেকেই স্কুল-মাস্টারগিরি করিয়াছিলেন। ছেলেরা তামস্ডিস্ পড়িত ও কথার মানে মুখস্থ করিত। বিবাহে অথবা ভোজের সভায়, যে ছেলে জাইন ঝাড়িতে পারিতে, সকলে তাহাকে চেয়ে দেখিতেন ও সাবাস বাওহা দিতেন।
ফ্রেন্কো ও আরাতুন পিট্রস প্রভৃতির দেখাদেখি শরবোরণ সাহেব কিছু কাল পরে স্কুল করিয়াছিলেন। ঐ স্কুলে সম্ভ্রান্ত লোকের ছেলেরা পড়িতেন।
যদি ছেলেদিগের আন্তরিক ইচ্ছা থাকে, তবে তাহারা যে স্কুলে পড়ুক আপন আপন পরিশ্রমের জোরে কিছু না কিছু অবশ্যই শিখিতে পারে। সকল স্কুলেরই দোষ গুণ আছে , এবং এমন এমন অনেক ছেলেও আছে যে এ স্কুল ভালো নয়, ও স্কুল ভালো নয় বলিয়া, আজি এখানে কালি ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়—মনে করে, গোলমালে কাল কাটাইয়া দিতে পারিলেই বাপ-মাকে ফাঁকি দিলাম। মতিলাল শরবোরণ সাহেবের স্কুলে দুই-একদিন পড়িয়া, কালুস সাহেবের স্কুলে ভর্তি হইল।
লেখাপড়া শিখিবার তৎপর্য এই যে, সৎ স্বভাব ও সৎ চরিত্র হইবে—সুবিবেচনা জন্মিবে ও যে যে-বিষয়-কর্মে লাগিতে পারে, তাহা ভালো করিয়া শেখা হইবে। এই অভিপ্রায় অনুসারে বালকদিগের শিক্ষা হইলে তাহারা সর্বপ্রকারে ভদ্র হয় ও ঘরে-বাহিরে সকল কর্ম ভালোরূপ বুঝিতেও পরে—করিতেও পারে। কিন্তু এমতো শিক্ষা দিতে হইলে, বাপ-মারও যত্ন চাই—শিক্ষকেরও যত্ন চাই। বাপ যে পথে যাবেন, ছেলেও সেই পথে যাবে। ছেলেকে সৎ করিতে হইলে, আগে বাপের সৎ হওয়া উচিত। বাপ মদে ডুবে থাকিয়া ছেলেকে মদ খেতে মানা করিলে, সে তাহা শুন্বে কেন? বাপ অসৎ কর্মে রত হইয়া নীতি উপদেশ দিলে, ছেলে তাকে বিড়াল তপস্বী জ্ঞান করিয়া উপহাস করিবে। যাহার বাপ ধর্মপথে চলে তাহার পুত্রের উপদেশ বড়ো আবশ্যক করে না—বাপের দেখাদেখি পুত্রের সৎ স্বভাব আপনা আপনি জন্মে ও মাতারও আপন শিশুর প্রতি র্সবদা দৃষ্টি রাখা আবশ্যক। জননীর মিষ্টবাক্যে, স্নেহে এবং মুখচুম্বনে শিশুর মন যেমন নরম হয়, এমন কিছুতেই হয় না। শিশু যদি নিশ্চয়রূপে জানে যে এমন এমন কর্ম করিলে আমাকে মা কোলে লইয়া আদর করিবে না, তাহা হইলেই তাহার সৎ সংস্কার বদ্ধমূল হয়। শিক্ষকের কর্তব্য যে, শিষ্যকে কতকগুলা বহি পড়াইয়া কেবল তোতা পাখী না করেন। যাহা পড়িবে তাহা মুখস্থ করিলে স্মরণশক্তির বৃদ্ধি হয় বটে, কিন্তু তাহাতে যদ্যপি বুদ্ধির জোর ও কাজের বিদ্যা না হইল, তবে সে লেখাপড়া শেখা কেবল লোক দেখাবার জন্য। শিষ্য বড়ো হউক বা ছোট হউক, তাহাকে এমন করিয়া বুঝাইয়া দিতে হইবেক যে, পড়াশুনাতে তাহার মন লাগে—সেরূপ বুঝানো শিক্ষার সুধারা ও কৌশলের দ্বারা হইতে পারে—কেবল তাঁইস করিলে হয় না।
বৈদ্যবাটীর বাটীতে থাকিয়া মতিলাল কিছুমাত্র সুনীতি শেখে নাই। এক্ষণে বহুবাজারে থাকিতে হিতে বিপরীত হইল। বেচারামবাবুর দুই জন ভাগিনেয় ছিল, তাহাদের নাম হলধর ও গদাধর, তাহারা জন্মাবধি পিতা কেমন দেখে নাই। মাতার ও মাতুলের ভয়ে এক একবার পাঠশালায় গিয়া বসিত, কিন্তু সে নামমাত্র, কেবল পথে ঘাটে—ছাতে মাঠে—ছুটাছুটি হুটোহুটি করিয়া বেড়াইত। কেহ দমন করিলে দমন শুনিত না—মাকে বলিত, তুমি এমন করো তো আমরা বেরিয়ে যাব। একে চায় আরে পায়—তাহারা দেখিল মতিলালও তাহাদেরই একজন। দুই-এক দিনের মধ্যেই হলাহলি গলাগলি ভাব হইল। এক জায়গায় বসে—এক জায়গায় খায়—এক জায়গায় শোয়। পরস্পর এ ওর কাঁধে হাত দেয় ও ঘরে-দ্বারে বাহিরে-ভিতরে হাত ধরাধরি ও গলা জড়াজড়ি করিয়া বেড়ায়। বেচারামবাবুর ব্রাক্ষ্ণণী তাহাদিগকে দেখিয়া এক এবার বলিতেন—আহা এরা যান এক মার পেটের তিনটি ভাই ।
কি শিশু কি যুবা কি বৃদ্ধ ক্রমাগত চুপ করিয়া, অথবা এক প্রকার কর্ম লইয়া থাকিতে পারে না। সমস্ত দিন রাত্রির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন কর্মে সময় কাটাইবার উপায় চাই। শিশুদিগের প্রতি এমন নিয়ম করিতে হইবেক যে তাহারা খেলাও করিবে—পড়াশুনাও করিবে। ক্রমাগত খেলা করা অথবা ক্রমাগত পড়াশুনা করা ভালো নহে। খেলাধুলা করিবার বিশেষ তাৎর্পয এই যে, শরীর তাজা হইয়া উঠিলে তাহাতে পড়াশুনা করিতে অধিক মন যায়। ক্রমাগত পড়াশুনা করিলে মন দুর্বল হইয়া পড়ে—যাহা শেখা যায় তাহা মনে ভেসে ভেসে থাকে— ভালো করিয়া প্রবেশ করে না। কিন্তু খেলারও হিসাব আছে, যে-যে খেলায় শারীরিক পরিশ্রম হয়, সেই খেলাই উপকারক। তাস পাশা প্রভৃতিতে কিছুমাত্র ফল নাই—তাহাতে কেবল অলস্য স্বভাব বাড়ে—সেই আলস্যেতে নানা উৎপাত ঘটে। যেমন ক্রমাগত পড়াশুনা করিলে পড়াশুনা ভালো হয় না, তেমন ক্রমাগত খেলাতেও বুদ্ধি হোঁতকা হয়। কেননা খেলায় কেবল শরীর সবল হইতে থাকে—মনের কিছুমাত্র শাসন হ্য় না, কিন্তু মন একটা না একটা বিষয় লইয়া অবশ্যই নিযুক্ত থকিবে, এমন অবস্থায় তাহা কি কুপথে বই সুপথে যাইতে পারে? অনেক বালক এইরূপেই অধঃপাতে গিয়া থাকে।
হলধর, গদাধর ও মতিলাল গোকুলের ষাঁড়ের ন্যায় বেড়ায়— যাহা মনে যায় তাই করে— কাহারো কথা শুনে না— কাহাকেও মানে না। হয় তাস—নয় পাশা— নয় ঘুড়ি—পায়রা—নয় বুলবুল, একটা না একটা লইয়া সর্বদা আমোদেই আছে।
খাবার অবকাশ নাই—শোবার অবকাশ নাই—বাটীর ভিতর যাইবার জন্য চাকর ডাকিতে আসিলে, অমনি বলে—যা বেটা যা, আমরা যাব না। দাসী আসিয়া বলে অগো মা-ঠাকুরানী যে শুতে পান না। তাহাকেও বলে—দূর হ হারামজাদী ! দাসী মধ্যে মধ্যে বলে, আ মরি, কী মিষ্ট কথাই শিখেছ! ক্রমে ক্রমে পাড়ার যত হতভাগা লক্ষ্ণীছাড়া—উনপাজুরে—বরাখুরে ছোঁড়ারা জুটিতে আরম্ভ হইল। দিবারাত্রি হট্রগোল—বৈঠকখানায় কান পাতা ভার—কেবল হো হো শব্দ— হাসির গর্রা ও তামাক-চরস গাঁজার ছররা, ধোঁয়াতে অন্ধকার হইতে লাগিল। কার সাধ্য সে দিক দিয়া যায়— কার বাপের সাধ্য যে মানা করে। বেচারামবাবু এক একবার গন্ধ পান—নাক টিপে ধরেন আর বলেন— দূঁর দূঁর।
সঙ্গদোষের ন্যায় আর ভয়ানক নাই। বাপ-মা ও শিক্ষক সর্বদা যত্ন করিলেও সঙ্গদোষে সব যায়, যে স্থলে ঐরূপ যত্ন কিছুমাত্র নাই, সে স্থলে সঙ্গদোষে কত মন্দ হয়, তাহা বলা যায় না।
মতিলাল যে সকল সঙ্গী পাইল, তাহাতে তাহার সুস্বভাব হওয়া দূরে থাকুক, কুস্বভাব ও কুমতি দিন দিন বাড়িতে লাগিল। সপ্তাহে দুই-এক দিন স্কুলে যায় ও অতিকষ্টে সাক্ষিগোপালের ন্যায় বসিয়া থাকে। হয় তো ছেলেদের সঙ্গে ফট্কি নাট্কি করে— নয় তো সিলেট লইয়া ছবি আঁকে— পড়াশুনায় পাঁচ মিনিটও মন দেয় না। সর্বদা মন উড়ু উড়ু, কতক্ষণে সমবয়সীদের সঙ্গে ধুমধাম ও আহলাদ আমোদ করিব! এমন এমন শিক্ষকও আছেন যে, মতিলালের মতো ছেলের মন কৌশলের দ্বারা পড়াশুনায় ভেজাইতে পারেন। তাঁহারা শিক্ষা করাইবার নানা প্রকার ধারা জানেন—যাহার প্রতি যে ধারা খাটে, সেই ধারা অনুসারে শিখা দেন। এক্ষণে সরকারী স্কুলে যেরূপ ভড়ুঙ্গে রকম শিক্ষা হইয়া থাকে, কালুস সাহেবের স্কুলেও সেইরূ্প শিক্ষা হইত। প্রত্যেক ক্লাসের প্রত্যেক বালকের প্রতি সমান তদারক হইত না—ভারি ভারি বহি পড়িবার অগ্রে সহজ সহজ বহি ভালোরূপে বুঝিতে পারে কি-না, তাহার অনুসন্ধান হইত না—অধিক বহি ও অনেক করিয়া পড়া দিলেই স্কুলের গৌরব হইবে এই দৃঢ় সংস্কার ছিল— ছেলেরা মুখস্ত বলে গেলেই হইল, —বুঝুক না বুঝুক জানা অবশ্যক বোধ হইত না এবং কি কি শিক্ষা করাইলে উত্তরকালে কর্মে লাগিতে পারিবে তাহারও বিবেচনা হইত না। এমতো স্কুলে যে ছেলে পড়ে তাহার বিদ্যা শিক্ষা কপালের বড়ো জোর না হইলে হয় না।
মতিলাল যেমন বাপের বেটা—যেমন সহবাস পাইয়াছিল—যেমন স্থানে বাস করিত—যেমন স্কুলে পড়িতে লাগিল তেমনি তাহার বিদ্যাও ভারি হইল। এক প্রকার শিক্ষক প্রায় কোনো স্কুলে থাকে না, কেহ-বা প্রাণান্তিক পরিশ্রম করিয়া মরে—কেহ বা গোঁপে তা দিয়া উপর চাল চলিয়া বেড়ায়। বটতলার বক্রেশ্বরবাবু কালুস সাহেবের সোনার কাটি রুপার কাটি ছিলেন। তিনি যাবতীয় বড়ো মানুষের বাটীতে যাইতেন ও সকলেকেই বলিতেন—আপনার ছেলের আমি সর্বদা তদারক করিয়া থাকি—মহাশয়ের ছেলে না হবে কেন! সে তো ছেলে নয় পরশ পাথর! স্কুলের উপর উপর ক্লাসের ছেলেদিগকে পড়াইবার ভার ছিল, কিন্তু যাহা পড়াইতেন, তাহা নিজে বুঝিতে পারিতেন কি-না সন্দেহ। এ কথা প্রকাশ হইল ঘোর অপমান হইবে, এজন্য চেপে চুপে রাখিতেন। বালকদিগকে কেবল মথন পড়ায়তেন—মানে জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, ডিক্সনেরী দেখ। ছেলেরা যাহা তরজমা করিত, তাহার কিছু না কিছু কাটাকুটি করিতে হয়, সব বজায় রাখিলে মাস্টারগিরি চলে না, কার্য শদ্ব কাটিয়া কর্ম লিখিতেন, অথবা কর্ম শব্দ কাটিয়া কার্য লিখিতেন—ছেলেরা জিজ্ঞাসা করিলে বলিতেন, তোমরা বড়ো বে-আদব, আমি যাহা বলিব তাহার উপর আবার কথা কও? মধ্যে মধ্যে বড়োমানুষের ছেলেদের লইয়া বড়ো আদর করিতেন ও জিজ্ঞাসা করিতেন—তোমাদের অমুক জায়গার ভাড়া কত—অমুক তালুকের মুনাফা কত? মতিলাল অল্প দিনের মধ্যে বক্রেশ্বরবাবুর অতি প্রিয়পাত্র হইল। আজ ফুলটি, কাল ফলটি, আজ বইখানি, কাল হাত-রুমালখানি আনিত, বক্রেশ্বরবাবু মনে করিতেন মতিলালের মত ছেলেদিগকে হাতছাড়া করা ভালো নয়—ইহারা বড়ো হইয়া উঠিলে আমার বেগুন ক্ষেত হইবে! স্কুলের তদারকের কথা লইয়া খুঁটিনাটি করিলে আমার কি পরকালে সাক্ষী দিবে?
শারদীয় পূজার সময় উপস্থিত—বাজারে ও স্থানে স্থানে অতিশয় গোল—ঐ গোলে মতিলালের গোলে হরিবোল বাড়িতে লাগিল। স্কুলে থাকিতে গেলে ছটফটানি ধরে—একবার এদিগে দেখে—এবার ওদিগে দেখে—একবার বসে—একবার ডেক্স বাজায়,—এক লহমাও স্থির থাকে না। শনিবারে স্কুলে আসিয়া বক্রেশ্বরবাবুকে বলিয়া কহিয়া হাপ স্কুল করিয়া বাটী যায়। পথে পানের খিলি খরিদ করিয়া, দুই পাশে পায়রাওয়ালা ও ঘুড়িওয়ালা দোকান দেখিয়া যাইতেছে—অম্লান মুখ, কাহারও প্রতি দৃক্পাত নাই, ইতিমধ্যে পুলিশের একজন সারজন ও কয়েকজন পেয়াদা দৌড়িয়া আসিয়া তাহার হাত ধরিল। সারজন কহিল—তোমারা নাম পর পুলিশমে গেরেফ্তারি হুয়া—তোমকো জরির জানে হোগা । মতিলাল হাত বাগড়া বাগড়ি করিতে আরম্ভ করিল। সারজন বলবান—জোরে হিড় হিড় করিয়া টানায়া লইয়া যাইতে লাগিল। মতিলাল ভূমিতে পড়িয়া গেল—সমস্ত শরীরে ছড়াই গিয়া ধুলায় পরিপূর্ণ হইল, তবুও একবার ছিনিয়া পলাইতে চেষ্টা করিতে লাগিল, সারজনও মধ্যে মধ্যে দুই এক কিল ও ঘুষা মারিতে লাগিল। অবশেষে রাস্তায় পড়িয়া বাপকে স্মরণ করিয়া কাঁদিতে লাগিল, এক এক বার তাহার মনে উদয় হইল যে কেন এমন কর্ম করিয়াছিলাম—কুলোকের সঙ্গী হইয়া আমার সর্বনাশ হইল। রাস্তায় অনেক লোক জমিয়া গেল। এ ওকে জিজ্ঞাসা করে—ব্যাপারটা কি? দুই একজন বুড়ী বলাবলি কেইতে লাগিল, আহ, কার বাছাকে এমন করিয়া মারে গা—ছেলেটির মুখ যেন চাঁদের মতো—ওর কথা শুনে আমাদের প্রাণ কেঁদে উঠে।
সূর্য অস্ত না হইতে হইতে মতিলাল পুলিশে আনীত হইল, তথায় দেখিল যে হলধর, গদাধর ও পড়ার রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ প্রভৃতিকেও ধরিয়া আনিয়াছে। তাহারা সকলে অধোমুখে একপাশে দাঁড়াইয়া আছে। বেলাকিয়র সাহেব ম্যাজেস্ট্রেট—তাঁহাকে তজ্বিজ্ করিতে হইবে, কিন্তু তিনি বাটী গিয়াছেন, এজন্য সকল আসামীকে বেনিগারদে থাকিতে হইল।
০৫.
বাবুরামবাবুকে সংবাদ দেওনার্থে প্রেমনারায়ণকে প্রেরণ, বাবুরামের সভাবর্ণন, ঠকচাচার পরিচয়, বাবুরামের স্ত্রীর সহিত কথোপকথন, কলিকাতায় আগমন, প্রভাতকালীন কলিকাতার বর্ণন, বাবুরামের বাঞ্ছারামের বাটীতে গমন, তথায় আত্নীয়দিগের সহিত সাক্ষাৎ ও মতিলাল সংক্রান্ত কথোপকথন ।
“শ্যামের নাগাল পালাম না গো সই—ওগো মরমেতে মরে রই”—টক্—টক্—পটাস্—পটাস্, মিয়াজান গাড়োয়ান এক একবার গান করিতেছে—টিটকারি দিতেছে ও শালার গোরু চলতে পারে না বলে লেজ মুচড়াইয়া সপাৎ সপাৎ মারিতেছে। একটু একটু মেঘ হইয়াছে—একটু একটু বৃষ্টি পড়িতেছে—গোরু দুটা হন্ হন্ করিয়া চলিয়া একখানা ছকড়া গাড়ীকে পিছে ফেলিয়া গেল। সেই ছকড়ায় প্রেমনারায়ণ মজুমদার যাইতেছিলেন—গাড়ীখানা বাতাসে দোলে—ঘোড়া দুটা বেটো ঘোড়ার বাবা—পক্ষিরাজের বংশ—টংয়স টংয়স ডংয়স ডংয়স করিয়া চলিতেছে—পটাপট্ পটাপট্ চাবুক পড়িতেছে কিন্তু কোনোক্রমেই চাল বেগড়ায় না। প্রেমনারায়ণ দুইটা ভাত মুখে দিয়া সওয়ার হইয়াছেন—গাড়ীর হোঁকোঁচ হোঁকোঁচে প্রাণ ওষ্ঠগত। গোরুর গাড়ী এগিয়ে গেল তাহাতে আরো বিরক্ত হইলেন। এ বিষয়ে প্রেমনারায়ণের দোষ দেওয়া মিছে—অভিমান ছাড়া লোক পাওয়া ভার। প্রায় সকলেই আপনাকে আপনি বড়ো জানে। একটুকু মনের ক্রটি হইলেই কেহ কেহ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে—কেহ কেহ মুখটি গোঁজ করিয়া বসিয়া থাকে। প্রেমনারায়ণ বিরক্ত হইয়া আপন মনের কথা আপনি বলিতে লাগিলেন—চাকরি করা ঝাক্মারি—চাকরে কুকুরে সমান—হুকুম করিলে দৌড়িতে হয়। মতে, হলা, গদার জ্বালায় চিরকালটা জ্বলে মরেছি—আমাকে খেতে দেয় নাই—শুতে দেয় নাই—আমার নামে গান বাঁধিত—সর্বদা ক্ষুদে পিঁপড়ার কামড়ের মতো ঠাট্টা করিত—আমাকে ত্যক্ত করিবার জন্য রাস্তার ছোঁড়াদের টুইয়ে দিত ও মধ্যে মধ্যে আপনারাও আমার পেছনে হাততালি দিয়া হো হো করিত। এ সব সহিয়া কোন্ ভালো মানুষ টিকিতে পারে? ইহাতে সহজ মানুষ পাগল হয়। আমি যে কলিকাতা ছেড়ে পলাই নাই এই আমার বাহাদুরি—আমার বড়ো গুরুবল যে অদ্যাপিও সরকারগিরি কর্মটি বজায় আছে। ছোঁড়াদের যেমন কর্ম তেমনি ফল। এখন জেলে পচে মরুক—আর যেন খালাস হয় না—কিন্তু এ কথা কেবল কথার কথা, আমি নিজেই খালাসের তদ্বিরে যাইতেছি। মানিবওয়ারি কর্ম, চারা কি? মানুষকে পেটের জ্বালায় সব করিতে হয়।
বৈদ্যবাটীর বাবুরামবাবু বাবু হইয়া বলিয়াছেন। হরে পা টিপিতেছেন । এক পাশে দুই—একজন ভট্টাচার্য বসিয়া শাস্ত্রীয় তর্ক করতেছে—আজ লাউ খেতে আছে—কাল বেগুন খেতে নাই—লবণ দিয়ে দুগ্ধ খাইলে সদ্যগোমাংস ভক্ষণ করা হয় ইত্যাদি কথা লইয়া ঢেঁকির কচ্কচি করিতেছেন। এক পাশে কয়েকজন শতরঞ্চ খেলিতেছে । তাহার মধ্যে একজন খেলোয়াড় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে—তাহার সর্বনাশ উপস্থিত উঠসার কিস্তিতেই মাত। এক পাশে দুই-একজন গায়ক যন্ত্র মিলাইতেছে—তানপুরা মেঁও মেঁও করিয়া ডাকিতেছে। এক পাশে মুহুরীরা বসিয়া খাতা লিখিতেছে —সম্মুখে কর্জদার প্রজা ও মহাজন সকলে দাঁড়াইয়া আছে—অনেকের দেনা-পাওনা ডিক্রি ডিস্মিস হইতেছে—বৈঠকখানা লোকে থই থই করিতেছে। মহাজনেরা কেহ কেহ বলিতেছে—মহাশয় কাহারো তিন বৎসর—কাহারো চার বৎসর হইল আমরা জিনিস সরবরাহ করিয়াছি, কিন্তু টাকা না পাওয়াতে বড়ো ক্লেশ হইতেছে—আমরা অনেক হাঁটহাঁটি করিলাম—আমাদের কাজকর্ম সব গেল। খুচরা খুচরা মহাজনেরা যথা—তেলওয়ালা, কাঠওয়ালা, সন্দেশওয়ালা তাহারাও কেঁদে ককিয়ে কহিতেছে—মহাশয় আমরা মারা গেলাম—আমাদের পুঁটিমাছের প্রাণ—এমন করিলে আমরা—কেমন করে বাঁচিতে পারি ? টাকার তাগাদা করিতে করিতে আমাদের পায়ের বাঁধন ছিড়িয়া গেল, —আমাদের দোকান-পাট সব বন্ধ হইল, মাগ ছেলেও শুকিয়ে মরিল। দেওয়ানজী এক একবার উত্তর করিতেছে—তোরা আজ যা, টাকা পাবি বই কি—এত বকিস্ কেন? তাহার উপর যে চোড়ে কথা কহিতেছে অমনি বাবুরামবাবু চোখ-মুখ ঘুরাইয়া তাহাকে গালিগালাজ দিয়া বাহির করিয়া দিতেছেন। বাঙালী বড়োমানুষ বাবুরা দেশসুদ্ধ লোকের জিনিস ধারে লন—টাকা দিতে হইলে গায়ে জ্বর অইসে —বাক্সের ভিতর টাকা থাকে কিন্তু টাল-মাটাল না করিলে বৈঠকখানা লোকে সরগরম ও জমজমা হয় না। গরীব-দুঃখী মহাজন বাঁচিল কি মরিল তাহাতে কিছু এসে যায় না, কিন্তু এরূপ বড়োমানুষি করিলে বাপ পিতামহের নাম বজায় থাকে। অন্য কতকগুলা ফতো বড়োমানুষ আছে—তাহাদের উপরে চাকন চিকণ, ভিতরে খ্যাঁড়। বাহিরে কোঁচার পত্তন ঘরে ছুঁচার কীর্তন, আয় দেখে ব্যয় করিতে হইলেই যমে ধরে—তাহাতে বাগানও হয় না—বাবুগিরিও চলে না। কেবল চটক দেখাইয়া মহাজনের চক্ষে ধূলা দেয় —ধারে টাকা কি জিনিস পাইলে দুআওরি লয়— বড়ো পেড়াপীড়ি হইলে এর নিয়ে ওকে দেয় অবশেষে সমন-ওয়ারিন বাহির হইলে বিষয়-আশয় বেনামী করিয়া গা ঢাকা হয়।
বাবুরামবাবুর টাকাতে অতিশয় মায়া—বড়ো হাত ভারি—বাক্স থেকে টাকা বাহির করিতে হইলে বিষম দায় হয়। মহাজনদিগের সহিত কচ্কচি ঝক্ঝকি করিতেছেন, ইতিমধ্যে প্রেমনারায়ণ মজুমদার আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কলিকাতার সকল সমাচার কানে কানে বলিলেন। বাবুরামবাবু শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া থাকিলেন —বোধ হইল যেন বজ্র ভাঙিয়া তাহার মাথায় পড়িল। ক্ষণেক কাল পরে সুস্থির হইয়া ভাবিয়া মোকাজান মিয়াকে ডাকাইলেন। মোকাজান আদালতের কর্মে বড়ো পটু। অনেক জমিদার নীলকর প্রভৃতি সর্বদা তাহার সহিত পরামর্শ করিত। জাল করিতে —সাক্ষী সাজাইয়া দিতে— দারোগা ও আমলাদিগকে বশ করিতে —গাঁতের মাল লইয়া হজম করিতে —দাঙ্গা-হাঙ্গামের জোটপাট ও হয়কে নয় করিতে নয়কে হয় করিতে তাহার তুল্য আর একজন পাওয়া ভার। তাহাকে আদর করিয়া সকলে ঠকচাচা বলিয়া ডাকিত, তিনিও তাহাতে গলিয়া যাইতেন এবং মনে করিতেন আমার শুভক্ষণে জন্ম হইয়াছে— রমজান ঈদ শবেবরাত আমার করা সার্থক — বোধ হয় পীরের কাছে কষে ফয়তা দিলে আমার কুদ্রত আরও বাড়িয়া উঠিবে। এই ভাবিয়া একটা বদনা লইয়া অজু করিতেছিলেন, বাবুরামবাবুর ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে তাড়াতাড়ি করিয়া আসিয়া নির্জনে সকল সংবাদ শুনিলেন। কিছুকাল ভাবিয়া বলিলেন — ডর কি বাবু ? এমন কত শত মকদ্দমা মুই উড়াইয়া দিয়েছি — এ বা কোন ছার ? মোর কাছে পাকা পাকা লোক আছে — তেনাদের সাথে করে লিয়ে যাব — তেনাদের জবানবন্দিতে মকদ্দমা জিত্ব, কিছু ডর কর না — কেল খুব ফজরে এসবো, এজ্ চললাম।
বাবুরামবাবু সাহস পাইলেন বটে, তথাপি ভাবনায় অস্থির হইতে লাগিলেন। আপনার স্ত্রীকে বড়ো ভালোবাসিতেন, স্ত্রী যাহা বলিতেন সেই কথাই কথা — স্ত্রী যদি বলিতেন এ জল নয় — দুধ, তবে চোখে দেখিলেও বলিতেন এ জল নয় — এ দুধ — না হলে গৃহিণী কেন বলবেন ? অন্যান্য লোকে আপন আপন পত্নীকে ভালবাসে বটে, কিন্তু তাহারা বিবেচনা করিতে পারে যে স্ত্রীর কথা কোন্ বিষয়ে ও কতদূর পর্যন্ত শুনা উচিত। সুপুরুষ আপন পত্নীকে অন্তকরণের সহিত ভালবাসে কিন্তু স্ত্রীর সকল কথা শুনিতে গেলে পুরুষকে শাড়ী পরিয়া বাটীর ভিতর থাকা উচিত। বাবুরামবাবু স্ত্রী উঠ বলিলে উঠিতেন — বস বলিলে বসিতেন। কয়েক মাস হইল গৃহিণীর একটি নবকুমার হইয়াছে — কোলে লইয়া আদর করিতেছেন — দুই দিকে দুই কন্যা বসিয়াছে, ঘরকন্নার ও অন্যান্য কথা হইতেছে, এমতো সময়ে কর্তা বাটীর মধ্যে গিয়ে বিষণ্ণভাবে বসিলেন এবং বলিলেন—গিন্নী ! আমার কপাল বড়ো মন্দ—মনে করিয়াছিলাম মতি মানুষমুনুষ হইলে তাহাকে সকল বিষয়ের ভার দিয়া আমরা কাশীতে গিয়া বাস করিব, কিন্তু সে আশায় বুঝি বিধি নিরাশ করলেন।
গৃহিণী। ওগো—কি—কি—শীঘ্র বলো, কথা শুনে যে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল—আমার মতি তো ভালো আছে ?
কর্তা। হাঁ—ভালো আছে—শুনিলাম পুলিশের লোক আজ তাহাকে ধরে হিঁচুড়ে লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে।
গৃহিণী। কি বল্লে ?—মতিকে হিঁচুড়িয়া লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে? ওগো, কেন কয়েদ করেছে? আহা বাছার গায়ে কতই ছড় গিয়াছে, বুঝি আমার বাছা খেতেও পায় নাই—শুতেও পায় নাই ! ওগো কি হবে? আমার মতিকে এখুনি আনিয়া দাও।
এই বলিয়া গৃহিণী কাঁদিতে লাগিলেন—দুই কন্যা চক্ষের জল মুছাইতে মুছাইতে নানা প্রকার সান্ত্বনা করিতে আরম্ভ করিল। গৃহিণীর রোদন দেখিয়া কোলের শিশুটিও কাঁদিতে লাগিল।
ক্রমে ক্রমে কথাবার্তার ছলে কর্তা অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন মতিলাল মধ্যে মধ্যে বাড়িতে আসিয়া মায়ের নিকট হইতে নানা প্রকার ছল করিয়া টাকা লইয়া যাইত। গৃহিণী এ কথা প্রকাশ করেন নাই—কি জানি কর্তা রাগ করিতে পারেন—অথচ ছেলেটিও আদুরে—গোসা করিলে পাছে প্রমাদ ঘটে। ছেলেপুলের সংক্রান্ত সকল কথা স্ত্রীলোকদিগের স্বামীর নিকট বলা ভালো। রোগ লুকাইয়া রাখিলে কখনই ভালো হয় না। কর্তা গৃহিণীর সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া পরদিন কলিকাতার যে স্থানে যাইবেন তথায় আপনার কয়েকজন আত্মীয়কে উপস্থিত হইবার জন্য রাত্রিতেই চিঠি পাঠাইয়া দিলেন।
সুখের রাত্রি দেখিতে দেখিতে যায়। যখন মন চিন্তার সাগরে ডুবে থাকে তখন রাত্রি অতিশয় বড়ো বোধ হয়। মনে হয় রাত্রি পোহাইল কিন্তু পোহাইতে পোহাইতেও পোহায় না। বাবুরামবাবুর মনে নানা কথা, নানা ভাব, নানা কৌশল, নানা উপায় উদয় হইতে লাগিল। ঘরে আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না, প্রভাত না হইতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া নৌকায় উঠিলেন। নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাঁটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে—কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে—বলদেরা গোরু লইয়া চলিতেছে—ধোবার গাধা থপাস থপাস করিয়া যাইতেছে—মাছের ও তরকারির বাজরা হু-হু করিয়া আসিতেছে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে। কেহ বলিছে, বাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল—কেহ বলে, আমার শাশুড়ী মাগী বড়ো বৌকাঁটকি—কেহ বলে, দিদি, আমার আর বাঁচতে সাধ নাই—বৌছুঁড়ী আমাকে দু’পা দিয়া থেত্লায়, বেটা কিছুই বলে না; ছোঁড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে—কেহ বলে, আহা অমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে,—কেহ বলে, আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল— কবে মরি কবে বাঁচি এই বেলা তার বিয়েটি দিয়ে নি।
এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আকাশে স্থানে স্থানে কানা মেঘ আছে। রাস্তাঘাট সেঁত সেঁত করিতেছে। বাবুরামবাবু এক ছিলিম তামাক খাইয়া একখানা ভাড়া গাড়ী অথবা পাল্কির চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাড়া বনিয়া উঠিল না—অনেক চড়া বোধ হইল। রাস্তায় অনেক ছোঁড়া একত্র জমিল। বাবুরামবাবুর রকম সকম দেখিয়া কেহ কেহ বলিল—ওগো বাবু, ঝাঁকা মুটের উপর বসে যাবে? তাহা হইলে দু-পয়সায় হয়। তোর বাপের ভিটে নাশ করেছে—বলিয়া যেমন বাবুরাম দৌড়িয়া মারিতে যাবেন অমনি দড়াম করিয়া পড়িয়া গেলেন। ছেঁড়াগুলো হো হো করিয়া দূরে থেকে হাততালি দিতে লাগিল। বাবুরামবাবু অধোমুখে শীঘ্র একখানা লকাটে রকম কেরাঞ্চিতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া উঠিলেন এবং খন্ খন্ ঝন্ ঝন্ শব্দে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাঞ্ছারামবাবুর বৈঠকখানায় উকিল বটলর সাহেবের মুৎসুদ্ধি—আইন-আদালত মামলা-মকদ্দমায় বড়ো ধড়িবাজ। মাসের মাহিনা ৫০ টাকা কিন্তু প্রাপ্তির সীমা নাই, বাটীতে নিত্য ক্রিয়াকাণ্ড হয়। তাহার বৈঠকখানায় বালীর বেণীবাবু, বহুবাজারের বেচারামবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া অপেক্ষা করিয়া বসিয়াছিলেন।
বেচারাম। বাবুরাম। ভালো দুধ দিয়া কালসাপ পুষিয়াছিলে। তোমাকে পুনঃপুনঃ বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম আমার কথা গ্রাহ্য করো নাই—ছেলে হতে ইহকালও গেল—পরকালও গেল। মতি দেদার মদ খায়—জোয়া খেলে—অখাদ্য আহার করে। জোয়া খেলিতে খেলিতে ধরা পড়িয়া চৌকিদারকে নির্ঘাত মারিয়াছে। হলা, গদা ও আর-আর ছোঁড়ারা তাহার সঙ্গে ছিল। আমার ছেলেপুলে নাই। মনে করিয়াছিলাম হলা ও গদা এক গণ্ডুষ জল দিবে এখন সে গুড়ে বালি পড়িল। ছোঁড়াদের কথা আর কি বলিব ? দূঁর দূঁর।
বাবুরাম। কে কাহাকে মন্দ করিয়াছে তাহা নিশ্চয় করা বড়ো কঠিন —এক্ষণে তদ্বিরের কথা বলুন।
বেচারাম। বাবুরাম যা ইচ্ছা তাই করো—আমি জ্বালাতন হইয়াছি—রাত্রে ঠাকুরঘরের ভিতর যাইয়া বোতল বোতল মদ খায়—চরস গাঁজার ধোঁয়াতে কড়িকাট কালো করিয়াছে—রূপা-সোনার জিনিস চুরি করিয়া বিক্রি করিয়াছে। আবার বলে একদিন শালগ্রামকে পোড়াইয়া চুন করিয়া পানের সঙ্গে খাইয়া ফেলিব। আমি আবার তাহাদের খালাসের জন্য টাকা দিব ? দূঁর দূঁর।
বক্রেশ্বর। মতিলাল এত মন্দ নহে—আমি স্বচক্ষে স্কুলে দেখিয়াছি তাহার স্বভাব বড়ো ভালো —সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর, তবে এমনটা কেন হইল বলতে পারি না।
ঠকচাচা। মুই বলি এসব ফেল্ত বাতের দরকার কি ? ত্যাল-খেড়ের বাতেতে কি মোদের প্যাট ভরবে? মকদ্দমাটার বনিয়াদটা পেকড়ে সেজিয়া ফেলা যাওক।
বাঞ্ছারাম। (মনে মনে বড়ো আহলাদ—মনে করিতেছেন বুঝি চিড়া-দই পেকে উঠিল) কারবারী লোক না হইলে কারবারের কথা বুঝে না। ঠকচাচা যাহা বলিতেছেন তাহাই কাজের কথা। দুই-একজন পাকা সাক্ষীকে ভালো তালিম করিয়া রাখিতে হইবে—আমাদিগকে বটলর সাহেবকে উকিল ধরিতে হইবে—তাতে যদি মকদ্দমা জিত না হয় তবে বড়ো আদালতে লইয়া যাব—বড়ো আদালতে কিছু না হয়—কৌন্সেল পর্যন্ত যাব,—কৌন্সেলে কিছু না হয় তো বিলাত পর্যন্ত করিতে হইবে। এ কি ছেলের হাতে পিটে ? কিন্তু আমাদিগের বটলর সাহেব না থাকিলে কিছুই হইবে না। সাহেব বড়ো ধমিষ্ঠ—তিনি অনেক মকদ্দমা আকাশে ফাঁদ পাতিয়া নিকাশ করিয়াছেন আর সাক্ষীদিগকে যেন পাখী পড়াইয়া তইয়ার করেন।
বক্রেশ্বর। আপদে পড়িলেই বিদ্যা-বুদ্ধির আবশ্যক হয়। মকদ্দমার তদ্বির অবশ্যই করিতে হইবেক। বেতদ্বিরে দাঁড়াইয়া হারা ও হাততালি খাওয়া কি ভালো ?
বাঞ্ছারাম। বটলর সাহেবের মতো বুদ্ধিমান উকিল আর দেখতে পাই না। তাঁহার বুদ্ধির বলিহারি যাই। এ সকল মকদ্দমা তিনি তিন কথাতে উড়াইয়া দিবেন। এক্ষণে শীঘ্র উঠুন—তাঁহার বাটিতে চলুন।
বেণী। মহাশয় আমাকে ক্ষমা করুন। প্রাণ বিয়োগ হইলেও অধর্ম করিব না। খাতিরে সব কর্ম করতে পারি কিন্তু পরকালটি খোয়াইতে পারি না। বাস্তবিক দোষ থাকলে দোষ স্বীকার করা ভালো—সত্যের মার নাই—বিপদে মিথ্যা পথ আশ্রয় করিলে বিপদ বাড়িয়া উঠে।
ঠকচাচা। হা-হা-হা-হা—মকদ্দমা করা কেতাবী লোকের কাম নয়—তেনারা একটা ধাব্কাতেই পেলিয়ে যায়। এনার বাত মাফিক কাম করলে মোদের মেটির ভিতর জলদি যেতে হবে—কেয়া খুব।
বাঞ্ছারাম। আপনাদের সাজ করিতে দোল ফুরাল। বেণীবাবু স্থিরপ্রজ্ঞ —নীতিশাস্ত্রে জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, তাঁহার সঙ্গে তখন একদিন বালীতে গিয়া তর্ক করা যাইবেক। এক্ষণে আপনারা গাত্রোত্থান করুন।
বেচারাম। বেণীভায়া ! তোমার যে মত আমার সেই মত—আমার তিন কাল গিয়েছে—এককাল ঠেকেছে, আমি প্রাণ গেলেও অধর্ম করিব না—আর কাহার জন্যে বা অধর্ম করিব? ছোঁড়ারা আমার হাড় ভাজা ভাজা করিয়াছে—তাদের জন্যে আমি আবার খরচ করিব—তাদের জন্য মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াইব ? তাহারা জেলে যায় তো এক প্রকার আমি বাঁচি। তাদের জন্যে আমার খেদ কি? তাদের মুখ দেখিলে গা জ্বলে উঠে—দূঁর দূঁর ! ! !
০৬.
মতিলালের মাতার চিন্তা, ভগিনীদ্বয়ের কথোপকথন, বেণী ও বেচারামবাবুর নীতি বিষয়ে কথোপকথন ও বরদাপ্রসাদবাবুর পরিচয়।
বৈদ্যবাটীর বাটিতে স্বস্ত্যয়নের ধুম লেগে গেল। সূর্য উদয় না হইতে হইতে শ্রীধর ভট্টাচার্য, রামগোপাল চূড়ামণি প্রভৃতি জপ করিতে বসিলেন। কেহ তুলসী দেন —কেহ বিল্বপত্র বাছেন —কেহ বববম্ বববম্ করিয়া গালবাদ্য করেন —কেহ বলেন যদি মঙ্গল না হয় তবে আমি বামুন নাহি —কেহ কহেন যদি মন্দ হয় তবে আমি পৈতে ওলাব। বাটীর সকলেই শশব্যস্ত —কাহারো মনে কিছু মাত্র সুখ নাই।
গৃহিণী জানালার নিকট বসিয়া কাতরে আপন ইষ্টদেবতাকে ডাকিতেছেন। কোলের ছেলেটি চুষি লইয়া চুষিতেছে —মধ্যে মধ্যে হাত পা নাড়িয়া খেলা করিতেছে। শিশুটির প্রতি এক একবার দৃষ্টিপাত করিয়া গৃহিণী মনে মনে বলিতেছেন —জাদু ! তুমি আবার কেমন হবে বলতে পারি না। ছেলে না হবার এক জ্বালা —হবার শতেক জ্বালা —যদি ছেলের একটু রোগ হল, তো মার প্রাণ অমনি উড়ে গেল। ছেলে কিসে ভালো হবে এজন্য মা শরীর একেবারে ঢেলে দেয় —তখন খাওয়া বলো —শোয়া বলো, সব ঘুরে যায়। দিনকে দিন জ্ঞান হয় না, রাতকে রাত জ্ঞান হয় না। এত দুঃখের ছেলে বড়ো হয়ে যদি সুসন্তান হয় তবেই সব সার্থক —তা না হলে মার জীয়ন্তে মৃত্যু —সংসারে কিছুই ভালো লাগে না —পাড়াপড়শীর কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছা হয় না —বড়ো মুখটি ছোট হয়ে যায় আর মনে হয় যে পৃথিবী দোফাঁক হও আমি তোমার ভিতরে সেঁদুই। মতিকে যে করে মানুষ করেছি তা গুরুদেবই জানেন —এখন বাছা উড়তে শিখে আমাকে ভালো সাজাই দিতেছেন। মতির কুকর্মের কথা শুনে অমি ভাজা ভাজা হয়েছি, দুঃখেতে ও ঘৃণাতে মরে রয়েছি। কর্তাকে সকল কথা বলি না, সকল কথা শুনিলে তিনি পাগল হতে পারেন। দূর হউক, আর ভাবতে পারি না। আমি মেয়েমানুষ, ভেবেই বা কি করিব—যা কপালে আছে তাই হবে।
দাসী আসিয়া খোকাকে লইয়া গেল। গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিলেন। মনের ধর্মই এই যখন এক বিষয়ে মগ্ন থাকে তখন সে বিষয়টি হঠাৎ ভুলিয়া আর একটি বিষয়ে প্রায় যায় না। এই কারণে গৃহিণী আহ্নিক করিতে বসিয়াও আহ্নিক করিতে পারিলেন না। এক একবার যত্ন করেন জপে মন দি, কিন্তু মন সেদিকে ধায় না। মতির কথা মনে উদয় হইতে লাগিল —সে যেন প্রবল স্রোত, কার সাধ্যি নিবারণ করে। কখন কখন বোধ হইতে লাগিল তাহার কয়েদ হুকুম হইয়াছে —তাহাকে বাঁধিয়া জেলে লইয়া যাইতেছে, তাহার পিতা নিকটে দাঁড়াইয়া আছেন, দুঃখেতে ঘার হেঁট করিয়া রোদন করিতেছেন। কখন বা জ্ঞান হইতেছে, পুত্র নিকটে আসিয়া বলিতেছেন, মা আমাকে ক্ষমা করো —আমি যা করিয়াছি তা করিয়াছি আর আমি কখন তোমার মনে বেদনা দিব না, আবার এক একবার বোধ হইতেছে যে মতির ঘোর বিপদ উপস্থিত, তাহাকে জন্মের মতো দেশান্তর যাইতে হইবেক। গৃহিণীর চটক ভাঙিয়া গেলে আপনাআপনি বলিতে লাগিলেন —এ দিনের বেলা আমি কি স্বপ্ন দেখিতেছি? না এ তো স্বপ্ন নয়, তবে কি খেয়াল দেখিলাম? কে জানে আমার মনটা আজ কেন এমন হচ্চে। এই বলিয়া চক্ষের জল ফেলতে ফেলতে ভূমিতে আস্তে আস্তে শয়ন করিলেন। দুই কন্যা মোক্ষদা ও প্রমদা ছাতের উপর বসিয়া মাথা শুকাইতেছিলেন।
মোক্ষদা। ওরে প্রমদা। চুলগুলো ভালো করে এলিয়ে দে না, তোর চুল গুলা যে বড়ো উষ্কখুষ্ক হয়েছে! না হবেই বা কেন? সাত জন্মের তো একটু তেল পড়ে না—মানুষের তেলে-জলেই শরীর, বারো মাস রুক্ষু নেয়ে নেয়ে কি একটা রোগনারা করবি? তুই এত ভাবিস্ কেন ? ভেবে ভেবে যে দড়ি বেটে গেলি।
প্রমদা। দিদি। আমি কি সাধ করে ভাবি? মনে বুঝে না, কি করি ? ছেলেবেলা বাপ একজন কুলীনের ছেলেকে ধরে এনে আমাকে বিবাহ দিয়েছিলেন —এ কথা বড়ো হয়ে শুনেছি। পতি কত শত স্থানে বিয়ে করেছেন, আর তাঁহার যেরূপ চরিত্র তাতে তাঁহার মুখ দেখতে ইচ্ছা হয় না। অমন স্বামী না থাকা ভালো।
মোক্ষদা। হাবি ! অমন কথা বলিস নে —স্বামী মন্দ হউক ছন্দ হউক, মেয়েমানুষের এয়ত্ থাকা ভালো।
প্রমদা। তবে শুনবে? আর বৎসর যখন আমি পালা জ্বরে ভুগতেছিনু —দিবারাত্রি বিছানায় পড়ে থাকতুম —উঠিয়া দাঁড়াইবার শক্তি ছিল না, সে সময় স্বামী আসিয়া উপস্থিত হলেন। স্বামী কেমন, জ্ঞান হওয়া অবধি দেখি নাই, মেয়ে মানুষের স্বামীর ন্যায় ধন নাই। মনে করিলাম দুই দণ্ড কাচে বসে কথা কহিলে রোগের যন্ত্রণা কম হবে। দিদি বললে প্রত্যয় যাবে না —তিনি আমার কাছে দাঁড়াইয়াই অমনি বল্লেন —ষোল বৎসর হইল তোমাকে বিবাহ করে গিয়াছি —তুমি আমার এক স্ত্রী —টাকার দরকারে তোমার নিকটে আসিতেছি —শীঘ্র যাব —তোমার বাপকে বললাম। তিনি তো ফাঁকি দিলেন —তোমার হাতের গহনা খুলিয়া দাও। আমি বললাম —মাকে জিজ্ঞাসা করি —মা যা বলবেন তাই করবো। এই কথা শুনিবা মাত্র আমার হাতের বালাগাছটা জোর করে খুলে নিলেন। আমি একটু হাত বাগড়া বাগড়ি করেছিনু, আমাকে একটা লাথি মারিয়া চলিয়া গেলেন —তাতে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিনু, তারপর মা আসিয়া আমাকে অনেকক্ষণ বাতাস করাতে আমার চেতনা হয়।
মোক্ষদা। প্রমদা। তোর দুঃখের কথা শুনিয়া আমার চক্ষে জল আইসে, দেখ তোর তবু এয়ত্ আছে, আমার তাও নাই।
প্রমদা। দিদি। স্বামীর এই রকম। ভাগ্যে কিছুদিন মামার বাড়ি ছিলাম তাই একটু লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম শিখিয়াছি। সমস্ত দিন কর্ম-কাজ ও মধ্যে মধ্যে লেখাপড়া ও হুনুরি কর্ম করিয়া মনের দুঃখ ঢেকে বেড়াই। একলা বসে যদি একটু ভাবি তো মনটা অমনি জ্বলে উঠে।
মোক্ষদা। কি করবে? আর জন্মে কত পাপ করা গিয়েছিল তাই আমাদের এত ভোগ হইতেছে। খাটা খাটুনি করলে শরীরটা ভালো থাকে মনও ভালো থাকে। চুপ করিয়া বসে থাকিলে দুর্ভাবনা বলো, দুর্মতি বলো, রোগ বলো, সকলি আসিয়া ধরে। আমাকে এ কথা মামা বলে দেন —আমি এই করে বিধবা হওয়ার যন্ত্রণাকে অনেক খাটো করেছি, আর সর্বদা ভাবি যে সকলই পরমেশ্বরের হাত, তাঁর প্রতি মন থাকাই আসল কর্ম। বোন্ ! ভাবতে গেলে ভাবনার সমুদ্রে পড়তে হয়। তার কূল-কিনারা নাই। ভেবে কি করবি? দশটা ধর্ম -কর্ম কর্ —বাপ -মার সেবা কর —ভাই দুটির প্রতি যত্ন কর, আবার তাদের ছেলেপুলে হলে লালন —পালন করিস্ —তারাই আমাদের ছেলেপুলে।
প্রমদা। দিদি। যা বলতেছ তা সত্য বটে কিন্তু বড়ো ভাইটি তো একেবারে অধঃপাতে গিয়েছে। কেবল কুকথা কুকর্ম ও কুলোক লইয়া আছে। তার যেমন স্বভাব তেমনি বাপ-মার প্রতি ভক্তি —তেমনি আমাদের প্রতিও স্নেহ। বোনের স্নেহ ভায়ের প্রতি যতটা হয় ভায়ের স্নেহ তার শত অংশের এক অংশও হয় না। বোন ভাই-ভাই করে সারা হন কিন্তু ভাই সর্বদা মনে করেন বোন বিদায় হলেই বাঁচি। আমরা বড়ো বোন —মতি যদি কখন কখন কাছে এসে দু-একটা ভালো কথা বলে তাতেও মনটা ঠাণ্ডা হয় কিন্তু তার যেমন ব্যবহার তা তো জানো ?
মোক্ষদা। সকল ভাই এরূপ করে না। এমন ভাইও আছে যে বড়ো বোনকে মার মতো দেখে, ছোট বোনকে মেয়ের মতো দেখে। সত্যি বল্চ এমন ভাই আছে যে ভাইকেও যেমন দেখে বোনকে তেমন দেখে। দু-দণ্ড বোনের সঙ্গে কথাবার্তা না কহিলে তৃপ্তি বোধ করে না ও বোনের আপদ্ পড়িলে প্রাণপণে সাহায্য করে।
প্রমদা। তা বটে কিন্তু আমাদিগের যেমন পোড়া কপাল তেমন ভাই পেয়েছি। হায় ! পৃথিবীতে কোনো প্রকার সুখ হয় না।
দাসী আসিয়া বলিল —মা ঠাকুরুন কাঁদছেন —এই কথা শুনিবামাত্র দুই বোনে তাড়াতাড়ি করিয়া নীচে নামিয়ে গেলেন।
চাঁদনীর রাত্রি। গঙ্গার উপর চন্দ্রের আভা পড়িয়াছে—মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে—বনফুলের সৌগন্ধ মিশ্রিত হইয়া এক একবার যেন আমোদ করিতেছে—ঢেউগুলা নেচে উঠিতেছে। নিকটবর্তী ঝোপের পাখীসকল নানা রবে ডাকিতেছে। বালীর বেণীবাবু দেওনাগাজীর ঘাটে বসিয়া এদিক্ ওদিক্ দেখিতে দেখিতে কেদারা রাগিণীতে “শিখেহো” খেয়াল গাইতেছেন। গানেতে মগ্ন হইয়াছেন, মধ্যে মধ্যে তালও দিতেছেন। ইতিমধ্যে পেছন দিক্ থেকে “বেণী ভায়া, বেণী ভায়া, ও শিখেহো” বলিয়া একটা শব্দ হইতে লাগিল। বেণীবাবু ফিরিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত। অমনি আস্তেব্যস্তে উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে নিকটে আনিয়া বসাইলেন।
বেচারাম। বেণী ভায়া। তুমি আজ বাবুরামকে খুব ওয়াজিব কথা বলিয়াছ। তোমাদের গ্রামে নিমন্ত্রণে আসিয়াছিলাম —তোমার উপর আমি বড়ো তুষ্ট হইয়াছি —এজন্য ইচ্ছা হইল তোমার সঙ্গে একবার দেখা করে যাই।
বেণী। বেচারাম দাদা। আমরা নিজে দুঃখী প্রাণী লোক, মজুরী করে এনে দিনপাত করি। যেসব স্থানে জ্ঞানের অথবা ধর্মকথার চর্চা হয় সেই সব স্থানে যাই। বড়োমানুষ কুটুম্ব ও আলাপী অনেক আছে বটে কিন্তু তাহাদিগের নিকট চক্ষুলজ্জা অথবা দায়ে পড়ে কিংবা নিজ প্রয়োজনেই কখন কখন যাই, সাধ করে বড়ো যাই না, আর গেলেও মনের প্রীতি হয় না কারণ বড়োমানুষ বড়োমানুষকেই খাতির করে, আমরা গেলে হদ্দ বল্বে—”আজো বড়ো গরমি—কেমন কাজকর্ম ভালো হচ্ছে—অরে এক ছিলিম তামাক দে।” যদি একবার হেসে কথা কহিলেন তবে বাপের সঙ্গে বত্তে গেলাম। এক্ষণে টাকার যত মান তত মান বিদ্যারও নাই ধর্মেরও নাই। আর বড়োমানুষের খোসামোদ করাও বড় দায়। কথাই আছে “বড়োর পিরীতি বালির বাঁধ, ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ” কিন্তু লোকে বুঝে না —টাকার এমন কুহক যে লোকে লাথিও খাচ্ছে এবং নিকট গিয়া যে আজ্ঞাও করছে। সে যাহা হউক, বড়োমানুষের সঙ্গে থাকলে পরকাল রাখা ভার, আজকের যে ব্যাপারটি হইয়াছিল তাতে পরকালটি নিয়ে বিলক্ষণ টানাটানি !
বেচারাম। বাবুরামের রকম সকম দেখিয়া বোধ হয় যে তাহার গতিক ভালো নয়। আহা। কি মন্ত্রী পাইয়াছেন। এক বেটা নেড়ে তাহার নাম ঠকচাচা। সে বেটা জোয়াচোরের পাদশা। তার হাড়ে ভেল্কি হয়। বাঞ্ছারাম উকিলের বাটীর লোক ! তিনি বর্ণচোরা আঁব —ভিজে বেড়ালের মতো আস্তে আস্তে সলিয়া কলিয়া লওয়ান্। তাঁহার জাদুতে যিনি পড়েন তাঁহার দফা একেবারে রফা হয়, আর বক্রেশ্বর মাস্টারগিরি করেন —নীতি শিখান অথচ জল উঁচু নীচু বলনের শিরোমণি। দূঁর দূঁর ! যাহা হউক, তোমার এ ধর্মজ্ঞান কি ইংরাজী পড়িয়া হইয়াছে ?
বেণী। আমার এমন কি ধর্মজ্ঞান আছে? এরূপ আমাকে বলা কেবল অনুগ্রহ প্রকাশ করা। যৎকিঞ্চিৎ যাহা হিতাহিত বোধ হইয়াছে তাহা বদরগঞ্জের বরদাবাবুর প্রসাদাৎ। সেই মহাশয়ের সহিত অনেক দিন সহবাস করিয়াছিলাম। তিনি দয়া করিয়া কিঞ্চিৎ উপদেশ দিয়াছেন।
বেচারাম। বরদাবাবু কে ? তাহার বৃত্তান্ত বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি। এমন কথা সকল শুনতে বড়ো ইচ্ছা হয়।
বেণী। বরদাবাবুর বাটী বঙ্গদেশে—পরগনে এটেকাগমারি। পিতার বিয়োগ হইলে কলিকাতায় আইসেন—অন্নবস্ত্রের ক্লেশ আত্যন্তিক ছিল —আজ খান এমতে যোত্র ছিল না। বাল্যাবস্থাবধি পরমার্থ প্রসঙ্গে সর্বদা রত থাকিতেন, এজন্য ক্লেশ পাইলেও ক্লেশ বোধ হইত না। একখানি সামান্য খোলার ঘরে বাস করিতেন—খুড়ার নিকট মাস মাস যে দুটি টাকা পাইতেন তাহাই কেবল ভরসা ছিল। দুই-একজন সৎলোকের সঙ্গে আলাপ ছিল —তদ্ভিন্ন কাহারও নিকট যাইতেন না, কাহার উপর কিছু ভার দিতেন না। দাসদাসী রাখিবার সঙ্গতি ছিল না—আপনার বাজার আপনি করিতেন—আপনার রান্না আপনি রাঁধিতেন, রাঁধিবার সময় পড়াশুনা অভ্যাস করিতেন, আর কি প্রাতে কি মধ্যাহ্নে কি রাত্রে একচিত্তে পরমেশ্বরকে ধ্যান করিতেন। স্কুলে ছেঁড়া ও মলিন বস্ত্রেই যাইতেন, বড়োমানুষের ছেলেরা পরিহাস ও ব্যঙ্গ করিত। তিনি শুনিতেন না ও সকলকে ভাই দাদা ইত্যাদি মিষ্ট বাক্যের দ্বারা ক্ষান্ত করিতেন। ইংরাজী পড়িলে অনেকের মনে মাৎসর্য হয় —তাহারা পৃথিবীকে সরাখান্ দেখে। বরদাবাবুর মনে মাৎসর্য কোনো প্রকারে করিতে পারিত না। তাঁহার স্বভাব অতি শান্ত ও নম্র ছিল, বিদ্যা শিখিয়া স্কুল ত্যাগ করিলেন। স্কুল ত্যাগ করিবারমাত্র স্কুলে একটি ৩০ টাকার কর্ম হইল। তাহাতে আপনি ও মা ও স্ত্রী ও খুড়ার পুত্রকে বাসায় আনিয়া রাখিলেন এবং তাঁহারা কিরূপে ভালো থাকিবেন তাহাতেই অতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। বাসার নিকট অনেক গরীব-দুঃখী লোক ছিল তাহাদিগেকে সর্বদা তত্ত্ব করিতেন —আপনার সাধ্যক্রমে দান করিতেন ও কাহারো পীড়া হইলে আপনি গিয়া দেখিতেন এবং ঔষধাদি আনিয়া দিতেন। ঐ সকল লোকের ছেলেরা অর্থাভাবে স্কুলে পড়িতে পারিত না এজন্য প্রাতে তিনি আপনি তাহাদিগকে পড়াইতেন। খুড়ার কাল হইলে খুড়াতুতো ভায়ের ঘোরতর ব্যামোহ হয়, তাহার নিকট দিনরাত বসিয়া সেবা-শুশ্রূষা করাতে তিনি আরাম হন। বরদাবাবুর খুড়ীর প্রতি অসাধারণ ভক্তি ছিল, তাঁহাকে মায়ের মতো দেখিতেন। অনেকের পরমার্থ বিষয়ে শ্মশান বৈরাগ্য দেখা যায়। বন্ধু অথবা পরিবারের মধ্যে কাহারো বিয়োগ হইলে অথবা কেহ কোনো বিপদে পড়িলে জগৎ অসার ও পরমেশ্বরই সারাৎসার এই বোধ হয়। বরদাবাবুর মনে ঐ ভাব নিরন্তর আছে, তাঁহার সহিত আলাপ অথবা তাঁহার কর্ম দ্বারা তাহা জানা যায় কিন্তু তিনি একথা লইয়া অন্যের কাছে কখনই ভড়ং করেন না। তিনি চটুকে মানুষ নহেন —জাঁক ও চটকের জন্য কোনো কর্ম করেন না। সৎকর্ম যাহা করেন তাহা অতি গোপনে করিয়া থাকেন। অনেক লোকের উপকার করেন বটে কিন্তু যাহার উপকার করেন কেবল সেই ব্যক্তিই জানে, অন্য লোকে টের পাইলে অতিশয় কুণ্ঠিত হয়েন। তিনি নানা প্রকার বিদ্যা জানেন কিন্তু তাঁহার অভিমান কিছুমাত্র নাই। লোকে একটু শিখিয়া পুঁটি মাছের মতো ফর্ ফর্ করিয়া বেড়ায় ও মনে করে আমি বড়ো বুঝি —আমি যেমন লিখি এমন লিখিতে কেহ পারে না —আমার বিদ্যা যেমন, এমন বিদ্যা কাহারো নাই —আমি যাহা বলিব সেই কথাই কতা। বরদাবাবু অন্য প্রকার ব্যক্তি, তাঁহার বিদ্যাবুদ্ধি প্রগাঢ় তথাচ সামান্য লোকের কথাও অগ্রাহ্য করেন না এবং মতান্তরের কোন কথা শুনিলে কিছু মাত্র বিরক্তও হয়েন না বরং আহলাদপূর্বক শুনিয়া আপন মতের দোষগুণ পুনর্বার বিবেচনা করেন। ঐ মহাশয়ের নানা গুণ, সকল খুঁটিয়া বর্ণনা করা ভার —মোট এই বলা যাইতে পারে যে তাঁহার মতো নম্র ও ধর্মভীতু লোক কেহ কখন দেখে নাই —প্রাণ বিয়োগ হইলেও কখন অধর্মে তাঁহার মতি হয় না। এমতো লোকের সহবাসে যত সৎ উপদেশ পাওয়া যায় বহি পড়িলে তত হয় না।
বেচারাম। এমতো লোকের কথা শুনে কান জুড়ায়। রাত অনেক হইল, পারাপারের পথ, বাটী যাই। কাল যেন পুলিশে একবার দেখা হয়।
০৭.
কলিকাতার আদিবৃত্তান্ত, জাস্টিস অব পিস নিয়োগ, পুলিশ বর্ণন, মতিলালের পুলিশে বিচার ও খালাস, বাবুরামবাবুর পুত্র লইয়া বৈদ্যবাটী গমন, ঝড়ের উত্থান ও নৌকা জলমগ্ন হওনের আশঙ্কা।
সংসারের গতি অদ্ভুত—মানববুদ্ধির অগম্য। কি কারণে কি হয় তাহা স্থির করা সুকঠিন। কলিকাতার আদি বৃত্তান্ত স্মরণ করিলে সকলেরই আশ্চার্য বোধ হইবে ও সেই কলিকাতা যে এই কলিকাতা হইবে ইহা কাহারো স্বপ্নেও বোধ হয় নাই।
কোম্পানীর কুঠি প্রথমে হুগলীতে ছিল, তাঁহাদিগের গোমস্তা জাব চার্নক সাহেব সেখানকার ফৌজদারের সহিত বিবাদ করেন, তখন কোম্পানীর এত জারিজুরি চলতো না সুতরাং গোমস্তাকে হুড়ো খেয়ে পালিয়ে আসিতে হইয়াছিল। জাব চার্নকের বারাকপুরে এক বাটী ও বাজার ছিল এই কারণে বারাকপুরের নাম অদ্যাবধি চার্নক বলিয়া খ্যাত আছে। জাব চার্নক একজন সতীকে চিতার নিকট হইতে ধরিয়া আনিয়া বিবাহ করিয়াছিলেন কিন্তু, ঐ বিবাহ পরস্পরের সুখজনক হইয়াছিল কি-না তাহা প্রকাশ হয় নাই। তিনি নূতন কুঠি করিবার জন্য উলুবেড়িয়ায় গমনাগমন করিয়াছিলেন ও তাঁহার ইচ্ছাও হয়েছিল যে সেখানে কুঠি হয় কিন্তু অনেক অনেক কর্ম হ পর্যন্ত হইয়া ক্ষ বাকি থাকিতেও ফিরিয়া যায়। জাব চার্নক বটুকখানা অঞ্চল দিয়া যাতায়াত করিতেন, তথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ ছিল তাহার তলায় বসিয়া মধ্যে মধ্যে আরাম করিতেন ও তামাকু খাইতেন, সেই স্থানে অনেক ব্যাপারীরাও জড়ো হইত। ঐ গাছের ছায়াতে তাঁহার এমনি মায়া হইল যে সেই স্থানেই কুঠি করিতে স্থির করিলেন। সূতানটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই তিন গ্রাম একেবারে খরিদ হইয়া আবাদ হইতে আরম্ভ হইল; পরে বাণিজ্য নিমিত্ত নানা জাতীয় লোক আসিয়া বসতি করিল ও কলিকাতা ক্রমে ক্রমে শহর হইয়া গুলজার হইতে লাগিল।
ইংরাজী ১৬৮৯ সালে কলিকাতা শহর হইতে আরম্ভ হয়। তাহার তিন বৎসর পরে জাব চার্নকের মৃত্যু হইল, তৎকালে গড়ের মাঠ ও চৌরঙ্গী জঙ্গল ছিল, এক্ষণে যে স্থানে পারমিট্ আছে পূর্বে তথায় গড় ছিল ও যে স্থানকে এক্ষণে ক্লাইব স্ট্রীট বলিয়া ডাকে সেই স্থানে সওদাগরি কর্ম হইত।
কলিকাতায় পূর্বে অতিশয় মারীভয় ছিল এজন্য যে— যে ইংরাজেরা তাহা হইতে পরিত্রাণ পাইত তাহারা প্রতি বৎসর নভেম্বর মাসের ১৫ তারিখে একত্র হইয়া আপন আপন মঙ্গলবার্তা বলাবলি করিত।
ইংরাজদিগের এক প্রধান গুণ এই যে, যে স্থানে বাস করে তাহা অতি পরিষ্কার রাখে। কলিকাতা ক্রমে ক্রমে সাফসুতরা হওয়াতে পীড়াও ক্রমে ক্রমে কমিয়া গেল কিন্তু বাঙালীরা ইহা বুঝিয়াও বুঝেন না। অদ্যাবধি লক্ষপতির বাটীর নিকটে এমন খানা আছে যে দুর্গন্ধে নিকট যাওয়া ভার।
কলিকাতার মাল, আদালত ও ফৌজদারী এই তিন কর্ম নির্বাহের ভার একজন সাহেবের উপর ছিল। তাঁহার অধীনে একজন বাঙালী কার্মচারী থাকিতেন ঐ সাহেবকে জমিদার বলিয়া ডাকিত। পরে অন্যান্য প্রকার আদালত ও ইংরাজদিগের দৌরাত্ম্য নিবারণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট স্থাপিত হইল, আর পুলিশের কর্ম স্বতন্ত্র হইয়া সুচারুরূপে চলিতে লাগিল। ইংরাজী ১৭৯৮ সালে স্যার জন রিচার্ডসন প্রভৃতি জাস্টিস অব পিস মোকরর হইলেন। তদনন্তর ১৮০০ সালে ব্লাকিয়র সাহেব প্রভৃতি ঐ কর্মে নিযুক্ত হন।
যাঁহারা জাস্টিস অব পিস হয়েন তাঁহাদিগের হুকুম এদেশের সর্বস্থানে জারি হয়। যাঁহারা কেবল ম্যাজিস্ট্রেট, জাস্টিস অব পিস নহেন, তাঁহদিগের আপন আপন সরহদ্দের বাহিরে হুকুম জারি করিতে গেলে তথাকার আদালতের মদৎ আবশ্যক হইত এজন্যে সম্প্রতি মফস্বলের অনেক ম্যাজিস্ট্রেট জাস্টিস অব পিস হইয়াছেন।
ব্লাকিয়র সাহেবের মৃত্যু প্রায় চারি বৎসর হইয়াছে। লোকে বলে ইংরাজের ঔরসে ও ব্রাহ্মণীর গর্ভে তাঁহার জন্ম হয়। তাঁহার প্রথম শিক্ষা এখানে হয়—পরে বিলাতে যাইয়া ভালো রূপ শিক্ষা করেন। পুলিশের ম্যাজিস্ট্রেসী কর্মপ্রাপ্ত হইলে তাঁহার দবদবায় কলিকাতা শহর কাঁপিয়া গিয়াছিল—সকলেই থরহরি কাঁপিত। কিছুকাল পরে সন্ধান-সুলুক করা ও ধরা-পাকড়ার কর্ম ত্যাগ করিয়া তিনি কেবল বিচার করিতেন। বিচারে সুপারগ ছিলেন, তাহার কারণ এই দেশের ভাষা ও রীতি-ব্যবহার ও ঘাঁত-ঘুঁত সকল ভালো বুঝিতেন—ফৌজদারী আইন তাঁহার কণ্ঠস্থ ছিল ও বহুকাল সুপ্রিম কোর্টের ইন্টারপ্রিটর থাকাতে মকদ্দমা কিরূপে করিতে হয় তদ্বিষয়ে তাঁহার উত্তম জ্ঞান জন্মিয়াছিল।
সময় জলের মতো যায়—দেখতে দেখতে সোমবার হইল—গির্জার ঘড়িতে ঢং ঢং করিয়া দশটা বাজিল। সারজন্, সিপাই, দারোগা. নায়েব, ফাঁড়িদার, চৌকিদার ও নানা প্রকার লোকে পুলিশ পরিপূর্ণ হইল। কোথাও বা কতকগুলা বাড়িওয়ালী ও বেশ্যা বসিয়া পানের ছিবে ফেলছে – কোথাও বা কতকগুলা লোক মারি খেয়ে রক্তের কাপড় সুদ্ধ দাঁড়িয়া আছে—কোথাও বা কতকগুলা চোর অধোমুখে এক পার্শ্বে বসিয়া ভাবছে—কোথাও বা দুই-একজন টয়ে বাঁধা ইংরেজীওয়ালা দরখাস্ত লিখছে—কোথাও বা ফৈরাদিরা নীচে উপরে টংঅস টংঅস করিয়া ফিরিতেছে— কোথাও বা সাক্ষী সকল পরস্পর ফুস ফুস করিতেছে—কোথাও বা পেশাদার জামিনেরা তীর্থের কাকের ন্যায় বসিয়া আছে—কোথাও বা উকিলদিগের দালাল ঘাপ্টি মেরে জাল ফেলিতেছে—কোথাও বা উকিলেরা সাক্ষীদিগের কানে মন্ত্র দিতেছে—কোথাও বা আমলারা চালানি মকদ্দমা টুক্ছে—কোথাও বা সারজনেরা বুকের ছাতি ফুলাইয়া মস্ মস্ করিয়া বেড়াচ্ছে—কোথাও বা সরদার সরদার কেরানীরা বলাবলি করচে—এ সাহেবটা গাধা, ও সাহেব পটু, এ সাহেব নরম, ও সাহেব কড়া— কালকের ও মকদ্দমাটার হুকুম ভালো হয় নাই। পুলিশ গস্ গস্ করিতেছে— সাক্ষাৎ যমালয়—কার কপালে কি হয়— সকলেই সশঙ্ক।
বাবুরামবাবু আপন উকিল, মন্ত্রী ও আত্মীয়গণ সহিত তাড়াতাড়ি আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঠকচাচার মাথায় মেন্তাই পাগড়ি, গায়ে পিরহান, পায়ে নাগোরা জুতা, হাতে ফটিকের মালা—বুজর্গ ও নবীর নাম নিয়া এক একবার দাড়ি নেড়ে তসবি পড়িতেছেন কিন্তু সে কেবল ভেক। ঠকচাচার মতো চালাক লোক পাওয়া ভার। পুলিশে আসিয়া চারিদিকে যেন লাটিমের মতো ঘুরিতে লাগিলেন। একবার এদিগে যান—একবার ওদিকে যান—একবার সাক্ষীদিগের কানে ফুস্ করেন—এক একবার বাবুরামবাবুর হাত ধরিয়া টেনে লইয়া যান—এক একবার বটলর সাহেবের সঙ্গে তর্ক করেন—এক একবার বাঞ্ছারামবাবুকে বুঝান। পুলিশের যাবতীয় লোক ঠকচাচাকে দেখিতে লাগিল। অনেকের বাপ পিতামহ চোর-ছেঁচড় হইলেও তাহাদিগের সন্তান-সন্ততিরা দুর্বল স্বভাব হেতু বোধ করে যে তাঁহারা অসাধারণ ও বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন, এজন্য অন্যের নিকট আপন পরিচয় দিতে হইলে একেবারে বলিয়া বসে আমি অমুকের পুত্র অমুকের নাতি। ঠকচাচার নিকট যে আলাপ করিতে আসিতেছে, তাহাকে অমনি বলিতেছেন— মুই আবদুর রহমান গুলমোহাম্মদের লেড়কা ও আমপক্ আমপক্ গোলাম হোসেনের পোতা। একজন ঠোঁটকাটা সরকার উত্তর করিল, আরে তুমি কাজ-কর্ম কি করো তাই বলো— তোমার বাপ-পিতামহের নাম নেড়ে পাড়ার দুই-এক বেটা শোরখেকো জানতে পারে কলিকাতা শহরে কে জানবে? তারা কি সইসগিরি কর্ম করিত? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা দুই চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া বলিলেন— কি বল্ব এ পুলিশ, দুসরা জেগা হলে তোর উপরে লাফিয়ে পড়ে কেমড়ে ধরতুম। এই বলিয়া বাবুরামবাবুর হাত ধরিয়া দাঁড়াইলেন ও সরকারকে পাকতঃ দেখাইলেন যে আমার কত হুরমত—কত ইজ্জত।
ইতিমধ্যে পুলিশের সিঁড়ির নিকট একটা গোল উঠল, একখানা গাড়ী গড় গড় করিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল—গাড়ীর দ্বার খুলিবামাত্র একজন জীর্ণশীর্ণ প্রাচীন সাহেব নামিলেন—সারজনেরা অমনি টুপি খুলিয়া কুরনিশ করিতে লাগিল ও সকলেই বলিয়া উঠিল ব্লাকিয়র সাহেব আসছেন। সাহেব বেঞ্চের উপর বসিয়া কয়েকটা মারপিটের মকদ্দমা ফয়সালা করিলেন পরে মতিলালের মকদ্দমা ডাক হইল। একদিকে কালে খাঁ ও ফতে খাঁ ফৈরাদি দাঁড়াইল আর একদিকে বৈদ্যাবাটীর বাবুরামবাবু, বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বৌবাজারের বেচারামবাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও বৈঠকখানার বটলর সাহেব দাঁড়াইলেন। বাবুরামবাবুর গায়ে জোড়া, মাথায় খিড়কিদার পাগড়ি, নাকে তিলক, তার উপরে হোমের ফোঁটা—দুই হাত জোড়া করিয়া কাঁদো কাঁদো ভাবে সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন—মনে করিতেছেন যে চক্ষের জল দেখিলে অবশ্যই সাহাবের দয়া উদয় হইবে। মতিলাল, হলধর, গদাধর ও অন্যান্য আসামীরা সাহেবের সম্মুখে আনীত হইল। মতিলাল লজ্জায় ঘাড় হেঁট করিয়া রহিল, তাহার অনাহারে শুষ্ক বদন দেখিয়া বাবুরামবাবুর হৃদয় বিদীর্ণ হইতে লাগিল। ফৈরাদিরা এজেহার করিল যে আসামীরা কুস্থানে যাইয়া জুয়া খেলিত, তাহাদিগকে ধরাতে বড়ো মারপিট করিয়া ছিনিয়ে পালায়—মারপিটের দাগ গায়ের কাপড় খুলিয়া দেখাইল। বটলর সাহেব ফৈরাদির ও ফৈরাদির সাক্ষীর উপর অনেক জেরা করিয়া মতিলালের সংক্রান্ত এজেহার কতক কাঁচিয়া ফেলিলেন। এমতো কাঁচানো আশ্চার্য নহে কারণ একে উকিলী ফন্দি, তাতে পূর্বে গড়াপেটা হইয়াছিল— টাকাতে কি-না হতে পারে ? ‘কড়িতে বুড়ার বিয়ে হয়।’ পরে বটলর সাহেব আপন সাক্ষীসকলকে তুলিলেন। তাহারা বলিল, মারপিটের দিনে মতিলাল বৈদ্যবাটীর বাটিতে ছিল কিন্তু ব্লাকিয়র সাহাবের খুঁচনিতে এক এক বার ঘাবড়িয়া যাইতে লাগিল। ঠকচাচা দেখিলেন গতিক বড়ো ভালো নয়—পা পিছলে যাইতে পারে—মকদ্দমা করিতে গেলে প্রায় লোকের দিগ্বিদগ্ জ্ঞান থাকে না— সত্যের সহিত ফারখতাখতি করিয়া আদালতে ঢুকতে হয়— কি প্রকারে জয়ী হইব তাহাতেই কেবল একিদা থাকে, এই কারণে তিনি সম্মুখে আসিয়া স্বয়ং সাক্ষী দিলেন অমুক দিবস অমুক তারিখে অমুক সময়ে তিনি মতিলালকে বৈদ্যবাটীর বাটীতে ফার্সী পড়াইতেছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট অনেক সওয়াল করিলেন কিন্তু ঠকচাচা হেল্বার-দোল্বার পাত্র নয়—মামলার বড়ো টঙ্ক, আপনার আসল কথা কোনো রকমেই কমপোক্ত হইল না। অমনি বটলর সাহেব বক্তৃতা করিতে লাগিলেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষণেক কাল ভাবিয়া হুকুম দিলেন মতিলাল খালাস ও অন্যান্য আসামীর এক এক মাস মেয়াদ এবং ত্রিশ ত্রিশ টাকা জরিমানা। হুকুম হইবামাত্র হরিবোলের শব্দ উঠিল ও বাবুরামবাবু চিৎকার করিয়া বলিলেন—ধর্মাবতার ! বিচার সুক্ষ্ণ হইল, আপনি শীঘ্র গবর্ণর হউন।
পুলিশের উঠানে সকলে আসিলে হলধর ও গদাধর প্রেমনারায়ণ মজুমদারকে দেখিয়া তাহার খেপানের গান তাহার কানে কানে গাইতে লাগিল— ‘প্রেমনারায়ণ মজুমদার কলা খাও, কর্ম কাজ নাই কিছু বাড়ি চলে যাও। হেন করি অনুমান তুমি হও হনুমান, সমুদ্রের তীরে গিয়া স্বচ্ছন্দে লাফাও।’ প্রেমনারায়ণ বলিল—বটে রে বিটলেরা—বেহায়ার বালাই দূর—তোরা জেলে যাচ্ছিস্ তবুও দুষ্টুমি করিতে ক্ষান্ত নহিস্—এই বলতে বলতে তাহাদিগকে জেলে লইয়া গেল।
বেণীবাবু ধর্মভীতু লোক—ধর্মের পরাজয় অধর্মের জয় দেখিয়া স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া আছেন— ঠকচাচা দাড়ি নেড়ে হাসিতে হাসিতে দম্ভ করিয়া বলিলেন—কেমন গো এখন কেতাবীবাবু কি বলেন, এনার মসলতে কাম করলে মোদের দফা রফা হইত। বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বলিলেন—একি ছেলের হাতের পিটে? বক্রেশ্বর বলিলেন—সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর। বেচারামবাবু বলিলেন—দূঁর দূঁর ! এমন অধর্মও করিতে চাই না—মকদ্দমা জিতও চাই না—দূঁর দূঁর ! এই বলিয়া বেণীবাবুর হাত ধরিয়া ঠিকুরে বেরিয়ে গেলেন।
বাবুরামবাবু কালীঘাটে পূজা দিয়া নৌকায় উঠিলেন। বাঙালীরা জাতের গুমর সর্বদা করিয়া থাকেন, কিন্তু কর্ম পড়িলে যবনও বাপের ঠাকুর হইয়া উঠে। বাবুরামবাবু ঠকচাচাকে সাক্ষাৎ ভীষ্মদেব বোধ করিলেন ও তাহার গলায় হাত দিয়া মকদ্দমা জিতের কথাবার্তায় মগ্ন হইলেন—কোথায় বা পান পানির আয়েব— কোথায় বা আহ্নিক— কোথায় বা সন্ধ্যা ? সবই ঘুরে গেল। এক একবার বলা হচ্ছে, বটলর সাহেব ও বাঞ্ছারামবাবুর তুল্য লোক নাই— এক একবার বলা হচ্ছে, বেচারাম ও বেণীর মতো বোকা আর দেখা যায় না। মতিলাল এদিক ওদিক দেখছে— এক একবার গোলুয়ে দাঁড়াচ্ছে—এক একবার দাঁড় ধরে টানছে—এক একবার ছতরির উপর বসছে— এক একবার হাইল ধরে ঝিঁকে মারছে। বাবুরামবাবু মধ্যে মধ্যে বলতেছেন— মতিলাল বাবা ও কি ? স্থির হয়্যে বসো। কাশীজোড়ার শঙ্কুরে মালী তামাক সাজছে— বাবুর আহলাদ দেখে তাহারও মনে স্ফুতি হইয়াছে—জিজ্ঞাসা করছে—বাও মোশাই। এবাড় কি পূজাড় সময় বাকুলে বাওলাচ হবে? এটা কি তুড়ার কড় ? সাড়ারা কত কড় করেছে ?
প্রায় একভাবে কিছুই যায় না—যেমন মনেতে রাগ চাপা থাকিলে একবার না একবার অবশ্যই প্রকাশ পায় তেমনি বড়ো গ্রীষ্ম ও বাতাস বন্ধ হইলে প্রায় ঝড় হইয়া থাকে। সূর্য অস্ত যাইতেছে— সন্ধ্যার আগমন— দেখিতে দেখিতে পশ্চিমে একটা কালো মেঘ উঠিল— দুই-এক লহমার মধ্যেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া আসিল— হু-হু করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল— কোলের মানুষ দেখা যায় না— সামাল সামাল ডাক পড়ে গেল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যু চম্কিতে আরম্ভ হইল ও মুহুর্মু হুঃ মুহুর্মুহুঃ বজ্রের ঝঞ্জন কড়মড় হড়মড় শব্দে সকলের ত্রাস হইতে লাগিল— বৃষ্টির ঝরঝর তড়তড়িতে কার সাধ্য বাহিরে দাঁড়ায়। ঢেউগুলা এক একবার বেগে উচ্চ হইয়া উঠে আবার নৌকার উপর ধপাস্ ধপাস্ করিয়া পড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যে দুই-তিনখানা নৌকা মারা গেল। ইহা দেখিয়া অন্য নৌকার মাঝিরা কিনারায় ভিড়তে চেষ্টা করিল কিন্তু বাতাসের জোরে অন্য দিগে গিয়া পড়িল। ঠকচাচার বকুনি বন্ধ—দেখিয়া শুনিয়া জ্ঞাশূন্য— তখন এক একবার মালা লইয়া তসবি পড়েন— তখন আপনার মহম্মদ, আলী ও সত্যপীরের নাম লইতে লাগিলেন। বাবুরামবাবু অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, দুষ্কর্মের সাজা এইখানেই অরম্ভ হয়! দুষ্কর্ম করিলে কাহার মন সুস্থির থাকে? অন্যের কাছে চাতুরীর দ্বারা দুষ্কর্ম ঢাকা হইতে পারে বটে কিন্তু কোনো কর্মই মনের অগোচর থাকে না। পাপী টের পান যেন তাঁহার মনে কেহ ছুঁচ বিঁধছে— সর্বদাই আতঙ্ক— সর্বদাই ভয়— সর্বদাই অসুখ—মধ্যে মধ্যে যে হাসিটুকু হাসেন সে কেবল দেঁতোর হাসি। বাবুরামবাবু ত্রাসে কাঁদিতে লাগিলেন ও বলিলেন—ঠকচাচা কি হইবে। দেখিতে পাই অপঘাত মৃত্যু হইল— বুঝি আমাদিগের পাপের এই দণ্ড। হায় হায় ছেলেকে খালাস করিয়া আনিলাম, ইহাকে গৃহিণীর নিকট নিয়ে যাইতে পারিলাম না— যদি মরি তো গৃহিণীও শোকে মরিয়া যাইবেন। এখন আমার বেণী ভায়ার কথা স্মরণ হয়— বোধ হয় ধর্মপথে থাকিলে ভালো ছিল। ঠকচাচারও ভয় হইয়াছে কিন্তু তিনি পুরানো পাপী— মুখে বড়ো দড়— বলিলেন— ডর কেন করো বাবু? লা ডুবি হইলে মুই তোমাকে কাঁধে করে সেঁতরে লি্য়ে যাব— আফদ তো মরদের হয়। ঝড় ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া উঠিল— নৌকা, টলমল করিয়া ডুবুডুবু হইল, সকলেই আঁকু পাঁকু ও ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল, ঠকচাচা মনে মনে কহেন “চাচা আপনা বাঁচ”।
০৮.
উকিল বটলর সাহেবের আপিস—বৈদ্যবাটীর বাটীতে কর্তার জন্য ভাবনা, বাঞ্ছারামবাবুর তথায় গমন ও বিষাদ, বাবুরামবাবুর সংবাদ ও আগমন।
বটলর সাহেব আপিসে আসিয়াছেন। বর্তমান মাসে কত কর্ম হইল উল্টে পাল্টে দেখিতেছেন, নিকটে একটা কুকুর শুয়ে আছে, সাহেব এক একবার শিস্ দিতেছেন—এক একবার নাকে নস্য গুঁজে হাতের আঙুল চট্কাইতেছেন—এক একবার কেতাবের উপর নজর করিতেছেন—এক একবার দুই পা ফাঁক করিয়া দাঁড়াইতেছেন—এক একবার ভাবিতেছেন আদালতের কয়েক আপিসে খরচার দরুন অনেক টাকা দিতে হইবেক—টাকার জোট্পাট্ কিছুই হয় নাই অথচ টারম্ খোলবার আগে টাকা দাখিল না করিলে কর্ম বন্ধ হয়—ইতিমধ্যে হোয়র্ড উকিলের সরকার আসিয়া তাঁহার হাতে দুইখানা কাগজ দিল। কাগজ পাইবামাত্র সাহেবের মুখ আহলাদে চক্চক্ করিতে লাগিল, অমনি বলিতেছেন বেন্শারাম। জলদি হিঁয়া আও। বাঞ্ছারামবাবু চৌকির উপর চাদরখানা ফেলিয়া কানে একটা কলম গুঁজিয়া শীঘ্র উপস্থিত হইলেন।
বটলর। বেন্শারাম। হাম বড়া খোশ হুয়া। বাবুরামকা উপর দো নালিশ হুয়া—এক ইজেক্টমেন্ট আর এক একুটি, হামকো নটিশ ও সুপিনা হৌয়র্ড সাহেব আবি ভেজ দিয়া।
বাঞ্ছারাম শুনিবামাত্র বগল বাজিয়ে উঠিলেন ও বলিলেন— সাহেব দেখো আমি কেমন মুৎসুদ্দি—বাবুরামকে এখানে আনাতে একা দুদে কত ক্ষীর ছেনা ননী হইবেক। ঐ দু’খানা কাগজ আমাকে শীঘ্র দাও আমি স্বয়ং বৈদ্যবাটীতে যাই—অন্য লোকের কর্ম নয়। এক্ষণে অনেক দমবাজি ও ধড়িবাজির আবশ্যক। একবার গাছের উপর উঠাতে পারলেই টাকার বৃষ্টি করিব, আর এখন আমাদের তপ্ত খোলা—বড়ো খাঁই—একটা ছোবল মেরে আলাল হিসাবে কিছু আনিতে হইবে।
বৈদ্যবাটীর বাটীতে বোধন বসিয়াছে— নহবত ধাঁধাঁগুড়গুড় ধাঁধাঁগুড় করিয়া বাজিতেছে। মুর্শুদাবাদি রোশনচৌকি পেওঁ পেওঁ করিয়া ভোরের রাগ আলাপ করিতেছে। দালানে মতিলালের জন্য স্বস্ত্যয়ন আরম্ভ হইয়াছে। একদিগে চণ্ডীপাঠ হইতেছে— একদিগে শিবপূজার নিমিত্তে গঙ্গামৃত্তিকা ছানা হইতেছে। মধ্যস্থলে শালগ্রাম শিলা রাখিয়া তুলসী দেওয়া হইতেছে। ব্রাহ্মণেরা মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে ও পরস্পর বলাবলি করিতেছে আমাদিগের দৈব ব্রাহ্মণ্য তো নগদই প্রকাশ হইল— মতিলালের খালাস হওয়া দূরে থাকুক এক্ষণে কর্তাও তাহার সঙ্গে গেলেন। কল্য যদি নৌকায় উঠিয়া থাকেন, সে নৌকা ঝড়ে অবশ্য মারা পড়িয়াছে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই— যা হউক, সংসারটা একেবারে গেল— এখন ছ্যাং চেংড়ার কীর্তন হইবে— ছোটবাবু কি রকম হইয়া উঠেন বলা যায় না— বোধ হয় আমাদের প্রাপ্তির দফা একেবারে উঠে গেল। ঐ ব্রাহ্মণদিগের মধ্যে একজন আস্তে আস্তে বলতে লাগিলেন— ওহে তোমরা ভাবছো কেন? আমাদের প্রাপ্তি কেহ ছাড়ায় না— আমরা শাঁকের করাত— যেতে কাটি আস্তে কাটি— যদি কর্তার পঞ্চত্ব হইয়া থাকে তবে তো একটা জাঁকাল শ্রাদ্ধ হইবে, কর্তার বয়েস হইয়াছে, মাগী টাকা লয়ে আতু-আতু পুতু-পুতু করিলে দশজনে মুখে কালি চুন দিবে। আর একজন বললেন, বসুধারার মতো ফোঁটা ফোঁটা পড়ে নিত্য পাই, নিত্য খাই—এক বর্ষণে কি চিরকালের তৃষ্ণা যাবে ?
বাবুরামবাবুর স্ত্রী অতি সাধ্বী। স্বামীর গমনাবধি অন্নজল ত্যাগ করিয়া অস্থির হইয়াছিলেন। বাটীর জানালা থেকে গঙ্গা দর্শন হইত— সারারাত্রি জানালায় বসিয়া আছেন। এক একবার যখন প্রচণ্ড বায়ু বেগে বহে, তিনি অমনি আতঙ্কে শুখাইয়া যান। এক একবার তুফানের উপর দৃষ্টিপাত করেন কিন্তু দেখিবামাত্র হৃকম্পন উপস্থিত হয়। এক একবার বজ্রঘাতের শব্দ শুনেন, তাহাতে অস্থির হইয়া কাতরে পরমেশ্বরকে ডাকেন। এই প্রকারে কিছুকাল গেল, গঙ্গার উপর নৌকার গমনাগমন প্রায় বন্ধ। মধ্যে মধ্যে যখন একেকটা শব্দ শুনেন অমনি উঠিয়া দেখেন। এক একবার দূর হইতে এক একটা মিড়মিড়ে আলো দেখতে পান, তাহাতে বোধ করেন ঐ আলোটা কোনো নৌকার আলো হইবে— কিয়ৎক্ষণ পরেই একখানা নৌকা দৃষ্টিগোচর হয়, তাহাতে মনে করেন এ নৌকা বুঝি ঘাটে আসিয়া লাগিবে— যখন নৌকা ভেড়-ভেড় করিয়া ভেড়ে না— বরাবর চলে যায়, তখন নৈরাশ্যের বেদনা শেলস্বরূপ হইয়া হৃদয়ে লাগে। রাত্রি প্রায় শেষ হইল, ঝড় বৃষ্টি ক্রমে ক্রমে থামিয়া গেল। সৃষ্টির অস্থির অবস্থার পর স্থির অবস্থা অধিক শোভাকর হয়। আকাশে নক্ষত্র প্রকাশ হইল—চন্দ্রের আভা গঙ্গার উপর যেন নৃত্য করিতে লাগিল ও পৃথিবী এমতো নিঃশব্দ হইল যে, গাছের পাতাটি নড়িলেও স্পষ্টরূপ শুনা যায়। এইরূপ দর্শনে অনেকেরই মনে নানাভাবের উদয় হয়। গৃহিণী এক একবার চারিদিকে দেখিতেছেন ও অধৈর্য হইয়া আপনা আপনি বলিতেছেন —জগদীশ্বর ! আমি জানত কাহার মন্দ করি নাই— কোনো পাপও করি নাই—এতকালের পর আমাকে কি বৈধব্য-যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইবে? আমার ধনে কাজ নেই, গহনার কাজ নাই— কাঙালিনী হইয়া থাকি সেও ভালো— সে দুঃখে দুঃখ বোধ হইবে না কিন্তু এই ভিক্ষা দেও যেন পতি-পুত্রের মুখ দেখতে দেখতে মরিতে পারি। এইরূপ ভাবনায় গৃহিণীর মন অতিশয় ব্যাকুল হইতে লাগিল। তিনি বড়ো বুদ্ধিমতী ও চাপা মেয়ে ছিলেন, আপনি রোদন করিলে পাছে কন্যারা কাতর হয়, এ কারণে ধৈর্য ধরিয়া রহিলেন। শেষ রাত্রে বাটীতে প্রভাতী নহবত বাজিতে লাগিল। ঐ বাদ্যে সাধারণের মন আকৃষ্ট হয় সত্য কিন্তু তাপিত মনে ঐরূপ বাদ্য দুঃখের মোহনা খুঁলিয়া দেয়, এ কারণ বাদ্য শ্রবণে গৃহিণীর মনের তাপ যেন উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। ইতিমধ্যে একজন জেলিয়া বৈদ্যবাটীর বাটিতে মাছ বেচতে আসিল। তাহার নিকট অনুসন্ধান করাতে সে বলিল ঝড়ের সময় বাঁশবেড়ের চড়ার নিকট একখানা নৌকা ডুবুডুবু হইয়াছিল, বোধ হয় সে নৌকাখানা ডুবিয়া গিয়াছে— তাতে একজন মোটা বাবু, একজন মুসলমান, একটি ছেলেবাবু ও আর আর অনেক লোক ছিল। এই সংবাদ একেবারে যেন বজ্রাঘাত তুল্য হইল। বাটীতে বাদ্যোদ্যম বন্ধ হইল ও পরিবারেরা চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
অনন্তর সন্ধ্যা হয় এমন সময় বাঞ্ছারামবাবু তড়বড় করিয়া বৈদ্যবাটীর বাটীর বৈঠকখানায় উপস্থিত হইয়া জিজ্ঞসা করিলেন— কর্তা কোথায়? চাকরের নিকট সংবাদ প্রাপ্ত হওয়াতে একেবারে মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িলেন এবং বলিলেন— হায় হায় বড় লোকটাই গেল। অনেকক্ষণ খেদ বিষাদ করিয়া চাকরকে বললেন, এক ছিলিম তামাক আন্ তো। একজন তামাক আনিয়া দিলে খাইতে খাইতে ভাবিতেছেন— বাবুরামবাবু তো গেলেন এক্ষণে তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে আমিও যে যাই। বড়ো আশা করিয়া আসিয়াছিলাম কিন্তু আশা আসা মাত্র হইল। বাটীতে পূজা-প্রতিমা ঠন্ঠনাচ্ছে— কোত্থেকে কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারি নাই। দমসম দিয়া টাকাটা হাত করিতে পারিলে অনেক কর্মে আসিত— কতক সাহেবকে দিতাম— কতক আপনি লইতাম— তারপরে এর মুণ্ডু ওর ঘাড়ে দিয়া হর বর সর করিতাম। কে জানে যে আকাশ ভেঙে একেবারে মাথার উপর পড়বে? বাঞ্ছারামবাবু চাকরদিগকে দেখাইয়া লোক-দেখানো একটু কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন কিন্তু সে কান্না কেবল টাকার দরুন। তাঁহাকে দেখিয়া স্বস্ত্যয়নি ব্রাহ্মণেরা নিকটে আসিয়া বসিলেন। গলায়দড়ে জাত প্রায় বড়ো ধূর্ত—অন্ত পাওয়া ভার। কেহ কেহ বাবুরামবাবুর গুণ বর্ণন করতে লাগিলেন— কেহ কেহ বলিলেন, আমরা পিতৃহীন হইলাম— কেহ কেহ লোভ সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, এখন বিলাপের সময় নয় যাতে তাঁর পরকাল ভালো হয় এমনতো চেষ্টা করা কর্তব্য— তিনি তো কম লোক ছিলেন না? বাঞ্ছারামবাবু তামাক খাচ্ছেন ও হাঁ হাঁ বলছেন— ও কথায় বড়ো আদর করেন না— তিনি ভালো জানেন বেল পাকলে কাকের কি? আপিনি এমনি বুকভাঙা হইয়া পড়িয়াছেন যে উঠে যেতে পা এগোয় না— যা শুনেন তাতেই সাটে হেঁ হুঁ করেন— আপনি কি করিবেন— কার মাথা খাবেন— কিছুই মতলব বাহির করিতে পারিতেছেন না। এক একবার ভাবতেছেন তদ্বির না করিলে দুই একখানা ভালো বিষয় যাইতে পারে এ কথা পরিবারদিগকে জানালে এখনি টাকা বেরোয়— আবার এক একবার মনে করতেছেন এমতো টাট্কা শোকের সময় বললে কথা ভেসে যাবে। এইরূপ সাত-পাঁচ ভাবছেন, ইতিমধ্যে দরজায় গোল উঠিল— একজন ঠিকা চাকর আসিয়া একখানা চিঠি দিল— শিরোনামা বাবুরামবাবুর হাতের লেখা কিন্তু সে ব্যক্তি সরেওয়ার কিছুই বলিতে পারিল না, বাটীর ভিতরে চিঠি লইয়া যাওয়াতে গৃহিণী আস্তেব্যস্তে খুলিয়া পড়িলেন। সে চিঠি এই “কাল রাত্রে ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম— নৌকা আঁদিতে এগিয়ে পড়ে, মাঝিরা কিছুই ঠাহর করিতে পারে নাই, এমনি ঝড়ের জোর যে নৌকা একবারে উল্টে যায়। নৌকা ডুবিবার সময় এক একবার বড়ো ত্রাস হয় ও এক একবার তোমাকে স্মরণ করি— তুমি যেন আমার কাছে দাঁড়াইয়া বলিতেছ— বিপদ কালে ভয় করিও না— কায়মনোচিত্তে পরমেশ্বেরকে ডাকো— তিনি দয়াময়, তোমাকে বিপদ থেকে অবশ্যই উদ্ধার করিবেন। আমিও সেইমতো করিয়াছিলাম। যখন নৌকা থেকে জলে পড়িলাম তখন দেখিলাম একটা চড়ার উপর পড়িয়াছি সেখানে হাঁটু জল। নৌকা তুফানের তোড়ে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি চড়ার উপর থাকিয়া প্রাতঃকালে বাঁশবেড়িয়াতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছি। মতিলাল অনেকক্ষণ জলে থাকাতে পীড়িত হইয়াছিল। তাকুত করাতে আরম হইয়াছে, বোধ করি রাততক বাঠীতে পৌঁছিব।”
চিঠি পড়িবামাত্র যেন অনলে জল পড়িল—গৃহিণী কিছু কাল ভাবিয়া বলিলেন, এ দুঃখিনীর কি এমন কপাল হবে? এই বলিতে বলিতে বাবুরামবাবু আপন পুত্র ও ঠকচাচা সহিত বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। চারিদিকে মহাগোল পড়িয়া গেল। পরিবারের মন সন্তাপের মেঘে আচ্ছন্ন ছিল এক্ষণে আহ্লাদের সূর্য উদয় হইল। গৃহিণী দুই কন্যার হাত ধরিয়া স্বামী ও পুত্রের মুখ দেখিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন, মনে করিয়াছিলেন মতিলালকে অনুযোগ করিবেন— এক্ষণে সে সব ভুলিয়া গেলেন। দুইটি কন্যা ভ্রাতার হাত ধরিয়া ও পিতার চরণে পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। ছোট পুত্রটি পিতাকে দেখিয়া যেন অমূল্য ধন পাইল— অনেকক্ষণ গলা জড়াইয়া থাকিল— কোল থেকে নামিতে চায় না। আন্যান্য স্ত্রীলোকেরা দাঁড়াগোপান দিয়া মঙ্গলাচরণ করিতে লাগিল। বাবুরামবাবু মায়াতে মুগ্ধ হওয়াতে অনেকক্ষণ কথা কহিতে পারিলেন না। মতিলাল মনে মনে কহিতে লাগিল নৌকাডুবি হওয়াতে বাঁচলুম তা না হলে মায়ের কাছে মুখ খেতে খেতে প্রাণ যাইত।
বাহির বাটীতে স্বস্ত্যয়নি ব্রাহ্মণেরা কর্তাকে দেখিয়া আশীর্বাদ করণান্তর বলিলেন, “নচ দৈবাৎ পরং বলং” দৈব বল অপেক্ষা শ্রেষ্ট বল নাই— মহাশয় একে পুণ্যবান তাতে যে দৈব করা গিয়াছে আপনার কি বিপদ হইতে পারে? যদ্যপি তা হইল তবে আমরা অব্রাহ্মণ। এ কথায় ঠকচাচা চিড়চিড়িয়া উঠিয়া বলিলেন— যদি এনাদের কেরদানিতে সব আপদ দফা হল তবে কি মোর মেহনত ফেলতো, মুই তো তসবি পড়েছি ? অমনি ব্রাহ্মণেরা নরম হইয়া সামঞ্জস্য করিয়া বলতে লাগিলেন— ওহে যেমন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের সারথি ছিলেন তেমনিতুমি কর্তাবাবুর সারথিই— তোমার বুদ্ধিবলেই তো সব হইয়াছে— তুমি অবতার বিশেষ, যেখানে তুমি আছ— যেখানে আমরা আছি— সেখানে দায়-দফা ছুটে পালায়। বাঞ্ছারামবাবু মণিহারা ফণী হইয়া ছিলেন— বাবুরামকে দেখাইবার জন্য পানসে চক্ষে একটু একটু মায়কান্না কাঁদিতে লাগিলেন। তখন তাঁহার দশ হাত ছাতি হইয়াছে এবং দৃঢ় বিশ্বাস হইয়াছে যে চার ফেললেই, মাছ পড়িবে। তিনি ব্রাহ্মণদিগের কথা শুনিয়া তেড়ে আসিয়া ডান হাত নেড়ে বল্তে লাগিলেন— এ কি ছেলের হাতের পিটে ? যদি কর্তার আপদ হবে তবে আমি কলিকাতায় কি ঘাস কাটি?
০৯.
শিশুশিক্ষা ও সুশিক্ষা না হওয়াতে মতিলালের ক্রমে ক্রমে মন্দ হওন ও অনেক সঙ্গী পাইয়া বাবু হইয়া উঠন এবং ভদ্র কন্যার প্রতি অত্যাচার করণ।
ছেলে একবার বিগ্ড়ে উঠলে আর সুযুত হওয়া ভার। শিশুকাল অবধি যাহাতে মনে সদ্ভাব জন্মে এমতো উপায় করা কর্তব্য, তাহা হইলে সেই সকল সদ্ভাব ক্রমে ক্রমে পেকে উঠতে পারে তখন কুকর্মে মন না গিয়া সৎকর্মের প্রতি ইচ্ছা প্রবল হয়, কিন্তু বাল্যকালে কুসঙ্গ অথবা অসদুপদেশ পাইলে বয়সের চঞ্চলতা হেতু সকলই উল্টে যাইবার সম্ভাবনা। অতএব যে পর্যন্ত ছেলেবুদ্ধি থাকিবে সে পর্যন্ত নানা প্রকার সৎ অভ্যাস করানো আবশ্যক। বালকদিগের এইরূপ শিক্ষা পঁচিশ বৎসর পর্যন্ত হইলে তাহাদিগের মন্দ পথে যাইবার সম্ভাবনা থাকে না। তখন তাহাদিগের মন এমতো পবিত্র হয় যে কুকর্মের উল্লেখমাত্রেই রাগ ও ঘৃণা উপস্থিত হয়।
এতদ্দেশীয় শিশুদিগের এরূপ শিক্ষা হওয়া বড়ো কঠিন, প্রথমতঃ ভালো শিক্ষক নাই—দ্বিতীয়তঃ ভালো বহি নাই—এমতো এমতো বহি চাই যাহা পড়িলে মনে সদ্ভাব ও সুবিবেচনা জন্মিয়া ক্রমে ক্রমে দৃঢ়তর হয়। কিন্তু সাধারণের সংস্কার এই যে কেবল কতকগুলিন শব্দের অর্থ শিক্ষা হইলেই আসল শিক্ষ হইল। তৃতীয়তঃ কি কি উপায় দ্বারা মনের মধ্যে সদ্ভাব জন্মে তাহা অতি অল্প লোকের বোধ আছে। চতুর্থতঃ শিশুদিগের যে প্রকার সহবাস হইয়া থাকে তাহাতে তাহাদিগের সদ্ভাব জন্মানো ভার। হয় তো কাহারো বাপ জুয়াচোর বা মদখোর, নয় তো কাহারো খুড়া বা জেঠা ইন্দ্রিয়দোষে আসক্ত—হয় তো কাহারো মাতা লেখাপড়া কিছুই না জানাতে আপন সন্তানাদির শিক্ষাতে কিছু-মাত্র যত্ন করেন না ও পরিবারের অন্যান্য লোক এবং চাকরদাসীর দ্বারা নানা প্রকার কুশিক্ষা হয়—নয় তো পাড়াতে বা পাঠশালাতে যে সকল বালকের সহিত সহবাস হয়, তাহাদের কুসংসর্গ ও কুকর্ম শিক্ষা হইয়া একেবারে সর্বনাশোৎপত্তি হয়। যে স্থলে উপরোক্ত একটি কারণ থাকে, সে স্থলে শিশুদিগের সদুপদেশের গুরুতর ব্যাঘাত—সকল কারণ একত্র হইলে ভয়ঙ্কর হইয়া উঠে— সে যেমন খড়ে আগুন লাগা— যে দিক জ্বলে উঠে সেই দিকেই যেন কেহ ঘৃত ঢালিয়া দেয় ও অল্প সময়ের মধ্যেই অগ্নি ছড়িয়া পড়িয়া যাহা পায় তাহাই ভস্ম করিয়া ফেলে।
অনেকেরই বোধ হইয়াছিল পুলিশের ব্যাপার নিষ্পন্ন হওয়াতে মতিলাল সুযুত হইয়া আসিবে। কিন্তু যে ছেলের মনে কিছুমাত্র সৎসংস্কার জন্মে নাই ও মান বা অপমানের ভয় নাই তাহার কোন সাজাতেই মনের মধ্যে ঘৃণা হয় না। কুমতি ও সুমতি মন থেকে উৎপন্ন হয় সুতরাং মনের সহিত তাহাদিগের সম্বন্ধ—শারীরিক আঘাত অথবা ক্লেশ হইলেও মনের গতি কিরূপে বদল হইতে পারে? যখন সারজন মতিলালকে রাস্তায় হিঁচুড়িয়া টানিয়া লইয়া গিয়াছিল তখন তাহার একটু ক্লেশ ও অপমান বোধ হইয়াছিল বটে কিন্তু সে ক্ষণিক—বেনিগারদে যাওয়াতে তাহার কিছুমাত্র ভাবনা বা ভয় বা অপমানবোধ হয় নাই। সে সমস্ত রাত্রি ও পরদিবস গান গাইয়া ও শেয়াল-কুকুরের ডাক ডাকিয়া নিকটস্থ লোকদিগকে এমতো জ্বালাতন করিয়াছিল যে, তাহারা কানে হাত দিয়া রাম রাম ডাক ছাড়িয়া বলাবলি করিয়াছিল—কয়েদ হওয়া অপেক্ষা এ ছোঁড়ার কাছে থাকা ঘোর যন্ত্রণা। পরদিবস ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দাঁড়াইবার সময় বাপকে দেখাইবার জন্য শিশু পরামানিকের ন্যায় একটুকু অধোবদন হইয়াছিল কিন্তু মনে মনে কিছুতেই দৃকপাত হয় নাই—জেলেই যাউক আর জিঞ্জিরেই যাউক কিছুতেই ভয় নাই।
যে সকল বালকদের ভয় নাই, ডর নাই, লজ্জা নাই কেবল কুকর্মেতেই রত—তাহাদিগের রোগ সামান্য রোগ নহে—সে রোগ মনের রোগ। তাহার উপর প্রকৃত ঔষধ পড়িলেই ক্রমে ক্রমে উপশম হইতে পারে। কিন্তু ঐ বিষয়ে বাবুরামবাবুর কিছুমাত্র বোঁধ-শোধ ছিল না। তঁহার দৃঢ় সংস্কার ছিল মতিলাল বড়ো ভাল ছেলে, তাহার নিন্দা শুনিলে প্রথম প্রথম রাগ করিয়া উঠিতেন—কিন্তু অন্যান্য লোকে বলিতে ছাড়িত না, তিনিও শুনিয়ে শুনিতেন না। পরে দেখিয়া শুনিয়া তাঁহার মনের মধ্যে কিঞ্চিৎ সন্দেহ জন্মিল কিন্তু পাছে অন্যের কাছে খাটো হইতে হয় এজন্য মনে মনে গুমরে গুমরে থাকিতেন, কাহারো নিকট কিছুই ব্যক্ত করিতেন না, কেবল বাটীর দরওয়ানকে চুপি চুপি বলিয়া দিলেন মতিলাল যেন দরজার বাহির না হইতে পারে। তখন রোগ প্রবল হইয়াছিল সুতরাং উপযুক্ত ঔষধ হয় নাই, কেবল আটকে রাখতে অথবা নজরবন্দী করায় কি হইতে পারে? মন বিগড়ে গেলে লোহার বাড় দিলেও থামে না বরং তাহাতে ধূর্তমি আরও বেড়ে উঠে।
মতিলাল প্রথম প্রথম প্রাচীর টপকিয়া বাহিরে যাইতে লাগিল। হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ ও মানগোবিন্দ খালাস হইয়া বৈদ্যবাটীতে আসিয়া আড্ডা গাড়িল ও পাড়ার কেবলরাম, বাঞ্ছারাম, ভজকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ এবং অন্যান্য শ্রীদাম, সুবল ক্রমে ক্রমে জুটে গেল। এই সকল বালকের সহিত সহবাস হওয়াতে মতিলাল একেবারে ভয়ভাঙা হইল— বাপকে পুসিদা করা ক্রমে ক্রমে ঘুচিয়া গেল। যে যে বালক বাল্যাবস্থা অবধি নির্দোষ খেলা অথবা সৎআমোদ করিতে না শিখে তাহারা ইতর আমোদেই রত হয়। ইংরাজদিগের ছেলেরা পিতা-মাতার উপদেশে শরীর ও মনকে ভালো রাখিবার জন্য নানা প্রকার নির্দোষ খেলা শিক্ষা করে, কেহ বা তসবির আঁকে— কাহারো বা ফুলের উপর সক হয়— কেহ বা সংগীত শিখে— কেহ বা শিকার করিতে অথবা মর্দানা কস্ত করিতে রত হয়— যাহার যেমন ইচ্ছা, সে সেই মতো এইরূপ নির্দোষ ক্রীড়া করে। এতদ্দেশীয় বালকেরা যেমন দেখে তেমনি করে— তাহাদিগের সর্বদা এই ইচ্ছা যে জরি-জহরত ও মুক্ত-প্রবাল পরিব—মোহসাহেব ও বেশ্যা লইয়া বাগানে যাইব এবং খুব ধুমধামে বাবুগিরি করিব। জাঁকজমক ও ধুমধামে থাকা যুবকালেরই ধর্ম, কিন্তু তাহাতে পূর্বে সাবধান না হইলে এইরূপ ইচ্ছা ক্রমে বেড়ে উঠে ও নানাপ্রকার দোষ উপস্থিত হয়—সেই সকল দোষে শরীর ও মন অবশেষে একেবারে অধঃপাতে যায়।
মতিলাল ক্রমে ক্রমে মেরোয়া হইয়া উঠিল, এমনি ধূর্ত হইল যে পিতার চক্ষে ধূলা দিয়া নানা অভদ্র ও অসৎকর্ম করিতে লাগিল। সর্বদাই সঙ্গীদিগের সহিত বলাবলি করিত বুড়া বেটা একবার চোখ বুজলেই মনের সাধে বাবুয়ানা করি। মতিলাল বাপ-মার নিকট টাকা চাহিলেই টাকা দিতে হইত— বিলম্ব হইলেই তাহাদিগকে বলে বসিত—আমি গলায় দড়ি দিব অথবা বিষ খাইয়া মরিব। বাপ-মা ভয় পাইয়া মনে করিতেন কপালে যাহা আছে তাই হবে এখন ছেলেটি প্রাণে বাঁচিয়া থাকিলে আমরা বাঁচি ও আমাদিগের শিবরাত্রির সলিতা বেঁচে থাকুক, তবু এক গণ্ডুষ জল পাব। মতিলাল ধুমধামে সর্বদাই ব্যস্ত—বাটীতে তিলার্ধ থাকে না। কখন বনভোজনে মত্ত—কখন যাত্রার দলে আকড়া দিতে আসক্ত—কখন পাঁচালির দল করিতেছে—কখন সকের কবিওয়ালদিগের সঙ্গে দেওরা দেওরা করিয়া চেঁচাইতেছে— কখন বারোয়ারী পূজার জন্য দৌড়াদৌড়ি করিতেছে— কখন খেম্টার নাচ দেখিতে বসিয়া গিয়াছে— কখন অনর্থক মারপিট, দাঙ্গা-হাঙ্গামে উন্মত্ত আছে। নিকটে সিদ্ধি, চরস, গাঁজাগুলি, মদ অনবরত চলিতেছে—গুড়ুক্ পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। বাবুরা সকলেই সর্বদা ফিটফাট— মাথায় ঝাঁকড়া চুল, দাঁতে মিসি, সিপাই পেড়ে ঢাকাই ধুতি পরা বুটোদার এক্লাই ও গাজের মেরজাই গায়ে, মাথায় জরির তাজ, হাতে আতরে ভুরভুরে রেশমের হাত রুমাল ও এক এক ছড়ি, পায়ে রূপার বগলসওয়ালা ইংরাজী জুতা। ভাত খাইবার অবকাশ নাই কিন্তু খাস্তার কচুরি, খাসা গোল্লা, বর্ফি, নিখুঁতি, মনোহরা ও গোলাবি খিলি সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে।
প্রথম প্রথম কুমতি দমন না হইলে ক্রমে ক্রমে বেড়ে উঠে। পরে একেবারে পশুবৎ হইয়া পড়ে—ভালো-মন্দ কিছুই বোধ থাকে না, আর যেমন আফিম খাইতে আরম্ভ করিলে ক্রমে ক্রমে মাত্রা অবশ্যই অধিক হইয়া উঠে তেমনি কূকর্মে রত হইলে অন্যান্য গুরুতর কূকর্ম করিবার ইচ্ছা আপনা আপনি আসয়া উপস্থিত হয়। মতিলাল ও তাঁহার সঙ্গী বাবুরা যে সকল আমোদে রত হইল ক্রমে তাহা অতি সামান্য আমোদ বোধ হইতে লাগিল— তাহাতে আর বিশেষ সন্তোষ হয় না, অতএব ভারি ভারি আমোদের উপায় দেখিতে লাগিল। সন্ধ্যার পর বাবুরা দঙ্গল বাঁধিয়া বাহির হন—হয় তো কাহারো বাড়িতে পড়িয়া লুটতরাজ করেন নয় তো কাহারো কানাচে আগুন লাগাইয়া দেন— হয় তো কোন বেশ্যার বাটীতে গিয়া শোর সরাবত করিয়া তাহার কেশ ধরিয়া টানেন বা মশারি পোড়ান কিংবা কাপড় ও গহনা চুরি করিয়া আনেন নয় তো কোনো কুলকামিনীর ধর্ম নষ্ট করিতে চেষ্টা পান। গ্রামস্থ সকল লোক অত্যন্ত ব্যস্ত, আঙুল মটকাইয়া সর্বদা বলে— তোরা ত্বরায় নিপাত হ।
এইরূপ কিছুকাল যায়—দুই-চারি দিবস হইল বাবুরামবাবু কোনো কর্মের অনুরোধে কলিকাতায় গিয়াছেন। একদিন সন্ধ্যার সময় বৈদ্যবাটীর নিকট দিয়া একখানা জানানা সোয়ারি যাইতেছিল। নববাবুরা ঐ সোয়ারি দেখিবামাত্র দৌড়ে গিয়ে চারিদিক ঘেরিয়া ফেলিল ও বেহারাদিগের উপর মারপিট আরম্ভ করিল, তাহাতে বেহারারা পাল্কি ফেলিয়া প্রাণভয়ে অন্তরে গেল। বাবুরা পাল্কি খুলিয়া দেখিল একটি পরমা সুন্দরী কন্যা তাহার ভেতরে অছেন— মতিলাল তেড়ে গিয়া কন্যার হাত ধরিয়া পাল্কি থেকে টানিয়া বাহির করিয়া আনিল। কন্যাটি ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন—চারিদিক শূন্যাকার দেখেন ও রোদন করিতে করিতে মনে মনে পরমেশ্বরকে ডাকেন— প্রভু ! এই অবলা অনাথাকে, রক্ষা করো— আমার প্রাণ যায় সেও ভালো যেন ধর্ম নষ্ট না হয়। সকলে টানাটানি করাতে কন্যাটি ভূমিতে পড়িয়া গেলেন তবুও তাহারা হিঁচুড়ে জোরে বাটীর ভিতর লইয়া গেল। কন্যার ক্রন্দন মতিলালের মাতার কর্ণগোচর হওয়াতে তিনি আস্তে-আস্তে বাটীর বাহিরে আসিলেন, অমনি বাবুরা চারিদিকে পলায়ন করিল। গৃহিণীকে দেখিয়া কন্যা তাঁহার পায়ে পড়িয়া কাতরে বলিলেন—মা গো ! আমার ধর্ম রক্ষা করো—তুমি বড়ো সাধ্বী। সাধ্বী স্ত্রী না হইলে সাধ্বী স্ত্রীর বিপদ অন্যে বুঝিতে পারে না। গৃহিণী কন্যাকে উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাঁহার চক্ষের জল পুঁছিয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন— মা ! কেঁদো না। ভয় নাই। তোমাকে আমি বুকের উপর রাখিব, তুমি আমার পেটের সন্তান— যে স্ত্রী পতিব্রতা তাহার ধর্ম পরমেশ্বর রক্ষা করেন। এই বলিয়া তিনি কন্যাকে অভয় দিয়া সান্তনা করণান্তর আপনি সঙ্গে করিয়া লইয়া তাঁহার পিতৃ আলয়ে রাখিয়া আসিলেন।
১০.
বৈদ্যবাটীর বাজার বর্ণন, বেচারামবাবুর আগমন, বাবুরামবাবুর সভায় মতিলালের বিবাহের ঘোঁট ও বিবাহ করণার্থে মণিরামপুরে যাত্রা এবং তথায় গোলযোগ।
শেওড়াপুলির নিস্তারিণীর আরতি ডেডাং ডেডাং করিয়া হইতেছে। বেচারামবাবু ঐ দেবীর আলয় দেখিয়া পদব্রজে চলিয়াছেন। রাস্তার দোধারি দোকান —কোনোখানে বন্দীপুর ও গোপাল পুরের আলু স্তূপাকার রহিয়াছে—কোনোখানে মুড়ি-মুড়কি ও চালডাল বিক্রয় হইতেছে —কোনোখানে কলু ভায়া ঘানিগাছের কাছে বসিয়া ভাষা রামায়ণ পড়িতেছেন —গোরু ঘুরিয়া যায় অমনি টিটকারি দেন, আবার আলে ফিরিয়া আইলে চিৎকার করিয়া উঠেন “ও রাম আমরা বানর, রাম আমরা বানর” —কোনোখানে জেলের মেয়ে মাছের ভাগা দিয়া নিকটে প্রদীপ রাখিয়া “মাছ নেবে গো, মাছ নেবে গো” বলিতেছে —কোনোখানে কাপুড়ে মহাজন বিরাট পর্ব লইয়া বেদব্যাসের শ্রাদ্ধ করিতেছে। এই সকল দেখিতে দেখিতে বেচারামবাবু যাইতেছেন। একাকী বেড়াতে গেলে সর্বদা যে সব কথা তোলাপড়া হয় সেই সকল কথাই মনে উপস্থিত হয়। তৎকালে বেচারামবাবু সদ্য সংকীর্তন লইয়া আমোদ করিতেন। বসতি ছাড়াইয়া নির্জন স্থান দিয়া যাইতে যাইতে মনোহরসাহী একটা তুক্ক তাঁহার স্মরণ হইল। রাত্রি অন্ধকার —পথে প্রায় লোকজনের গমনাগমন নাইে—কেবল দুই-একখানা গোরুর গাড়ী কেঁকোর কেঁকোর করিয়া ফিরিয়া যাইতেছে ও স্থানে স্থানে এক একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করিতেছে। বেচারামবাবু তুক্কর সুর দেদার রকমে ভাঁজিতে লাগিলেন —তাঁহার খোনা আওয়াজ আশপাশের দুই-একজন পাড়াগেঁয়ে মেয়েমানুষ শুনিবামাত্রে আঁও মাঁও করিয়া উঠিল —পল্লীগ্রামের স্ত্রীলোকদিগের আজন্মকালাবধি এই সংস্কার আছে যে খোনা কেবল ভূতেতেই করিয়া থাকে। ঐ গোলযোগ শুনিয়া বেচারামবাবু কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া দ্রুতগতি একেবারে বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন।
বাবুরামবাবু ভারি মজলিস করিয়া বসিয়া আছেন। বালীর বেণীবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু, বাহির সিমলার বাঞ্ছারামবাবু ও অন্যান্য অনেকে উপস্থিত। গদির নিকট ঠকচাচা একখানা চৌকির উপর বসিয়া আছেন। অনেকগুলি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত শাস্ত্রালাপ করিতেছেন। কেহ কেহ ন্যায়শাস্ত্রের ফেঁক্ড়ি ধরিয়াছেন —কেহ কেহ তিথিতত্ত্ব, কেহ বা মলমাসতত্ত্বের কথা লইয়া তর্ক করিতে ব্যস্ত আছেন —কেহ কেহ দশম স্কন্ধের শ্লোক ব্যাখ্যা করিতেছেন —কেহ কেহ বহুব্রীহি ও দ্বন্দ্ব লইয়া মহা দ্বন্দ্ব করিতেছেন। কামাখ্যা-নিবাসী একজন ঢেঁকিয়াল ফুক্কন কর্তার নিকট বসিয়া হুকা টানিতে টানিতে বলিতেছেন —আপনি বড়ো বাগ্যমান পুরুষ —আপনার দুইটি লড়বড়ে ও দুইটি পেঁচা মুড়ি —এ বচ্চর একটু লেড়াং ভেড়াং আছে কিন্তু একটি যাগ করলে সব রাঙা ফুকনের মাচাং যাইতে পারবে ও তাহার বশীবুত অবে —ইতিমধ্যে বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি আসিবামাত্র সকলেই উঠে দাড়াইয়া “আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক” বলিতে লাগিল। পুলিশের ব্যাপার অবধি বেচারামবাবু চটিয়া রহিয়াছিলেন কিন্তু শিষ্টাচারে ও মিষ্টকথায় কে না ভোলে ? ঘন ঘন “যে আজ্ঞা মহাশয়ে” তাহার মন একটু নরম হইল এবং তিনি সহাস্য বদনে বেণীবাবুর কাছে ঘেঁষে বসিলেন। বাবুরামবাবু বলিলেন —মহাশয়ের বসাটা ভালো হইল না —গদির উপর আসিয়া বসুন। মিল মাফিক লোক পাইলে মানিকজোড় হয়। বাবুরামবাবু অনেক অনুরোধ করিলেন বটে কিন্তু বেচারামবাবু বেণীবাবুর কাছছাড়া হইলেন না। কিয়ৎক্ষণ অন্যান্য কথাবার্তার পর বেচারামবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন মতিলালের বিবাহের সম্বন্ধ কোথায় হইল ?
বাবুরাম। সম্বন্ধ অনেক আসিয়াছিল। গুপ্তিপাড়ার হরিদাসবাবু, নাকাসী পাড়ার শ্যামাচরণবাবু, কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু ও অন্যান্য অনেক স্থানের অনেক ব্যক্তি সম্বন্ধের কথা উপস্থিত করিয়াছিল। সে সব ত্যাগ করিয়া এক্ষণে মণিরামপুরের মাধববাবুর কন্যার সহিত বিবাহ ধার্য করা গিয়াছে। মাধববাবু যোত্রাপন্ন লোক আর আমাদিগের দশ টাকা পাওয়া-থোয়া হইতে পারিবে।
বেচারাম। বেণী ভায়া ! এ বিষয়ে তোমার কি মত ? কথাগুলো খুলে বলো দেখি।
বেণী। বেচারাম দাদা। খুলে খেলে কথা বলা বড় দায় — বোবার শত্রু নাই আর কর্ম যখন ধার্য হইয়াছে তখন আন্দোলনে কি ফল ?
বেচারাম। আরে তোমাকে বলতেই হবে —আমি সব বিষয়ের নিগূড় তত্ত্ব জানিতে চাই।
বেণী। তবে শুনুন— মনিরামপুরের মাধববাবু দাঙ্গাবাজ লোক —ভদ্র চালচুলা নাই, কেবল গোরু কেটে জুতাদানি ধার্মিকতা আছে —বিবাহেতে জিনিসপত্র টাকাকড়ি দিতে পারেন কিন্তু বিবাহ দিতে গেলে কেবল কি টাকাকড়ির উপর দৃষ্টি করা কর্তব্য ? অগ্রে ভদ্রঘর খোঁজা উচিত, তারপর ভালো মেয়ে খোঁজা কর্তব্য, তারপর পাওনা-থোওনা হয় বড়ো ভালো — না হয় —নাই। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু অতি সুমানুষ —তিনি পরিশ্রম দ্বারা যাহা উপায় করেন তাহাতেই সানন্দচিত্তে কাল যাপন করেন —পরের বিষয়ের উপর কখন চেয়েও দেখেন না —তাঁহার অবস্থা বড়ো ভালো নয় বটে কিন্তু তিনি আপন সন্তানাদির সদুপদেশে সর্বদা যত্নবান ও পরিবারেরা কি প্রকারে ভালো থাকিবে ও কি প্রকারে তাহাদিগের সুমতি হইবে সর্বদা কেবল এই চিন্তা করিয়া থাকেন। এমন লোকের সঙ্গে কুটুম্বিতা হইলে তো সর্বাংশে সুখজনক হইত।
বেচারাম। বাবুরামবাবু ! তুমি কাহার বুদ্ধিতে এ সম্বন্ধ করিয়াছ ? টাকার লোভেই গেলে যে ! তোমাকে কি বল্ব ? এ আমাদিগের জেতের দোষ। বিবাহের কথা উপস্থিত হইলে লোকে অমনি বলে বসে —কেমন গো রূপোর ঘড়া দেবে তো ? মুক্তোর মালা দেবে তো ? আরে আবাগের বেটা কুটুম্ব ভদ্র কি অভদ্র তা আগে দেখ্—মেয়ে ভালো কি মন্দ তার অন্বেষণ কর্ ? সে সব ছোট কথা —কেবল দশ টাকা লাভ হইলেই সব হইল —দূঁর দূঁর !
বাঞ্ছারাম। কুলও চাই —রূপও চাই —ধনও চাই ! টাকাটা একেবারে অগ্রাহ্য করলে সংসার কিরূপে চলবে ?
বক্রেশ্বর। তা বই কি —ধনের খাতির অবশ্য রাখতে হয়। নির্ধন লোকের সহিত আলাপে ফল কি ? সে আলাপে কি পেট ভরে ?
ঠকচাচা চৌকির উপর থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়িয়া বললেন, মোর উপর এতনা টিটকারি দিয়া বাত হচ্ছে কেন ? মুই তো এ শাদি করতে বলি —একটা নামজাদা লোকের বেটি না আন্লে আদমির কাছে বহুত শরমের বাত, মুই রাতদিন ঠেওরে ঠেওরে দেখেছি যে, মণিরামপুরের মাধববাবু আচ্ছা আদমি —তেনার নামে বাগে গোরুতে জল খায় —দাঙ্গা-হাঙ্গামের ওক্তে লেঠেল মেংলে লেঠেল মিল্বে —আদালতের বেলকুল আদমি তেনার দস্তের বিচ —আপদ পড়লে হাজারো সুরতে মদত্ মিলবে। কাঁচড়াপাড়ার রামহরিবাবু সেকস্ত আদ্মি —ঘেসাট-ঘোসাট করে প্যাট-টালে —তেনার সাথে খেসি কামে কি ফায়দা ?
বেচারাম। বাবুরাম! ভালো মন্ত্রী পাইয়াছ ! এমন মন্ত্রীর কথা শুনিলে তোমাকে সশরীর স্বর্গে যাইতে হইবে —আর কিবা ছে্লেই পেয়েছ ! —তাহার আবার বিয়ে ? বেণী ভায়া তোমার মত কি ?
বেণী। আমার মত এই যে —পিতা প্রথমে ছেলেকে ভালো রূপে শিক্ষা দিবেন ও ছেলে যাহাতে সর্বপ্রকারের সৎ হয় এমতো চেষ্টা সম্যক্রূপে পাইবেন —ছেলের যখন বিবাহ করিবার বয়েস হইবে তখন তিনি বিশেষরূপে সাহায্য করিবেন। অসময় বিবাহ দিলে ছেলের নানাপ্রকার হানি করা হয়।
এই সকল কথা শুনিয়া বাবুরামবাবু ধড়মরিয়া উঠিয়া তাড়াতাড়ি বাটীর ভিতর গেলেন। গৃহিণী পাড়ার স্ত্রীলোকদিগের সহিত বিবাহ সংক্রান্ত কথাবার্তা কহিতেছিলেন। কর্তা নিকটে গিয়া বাহির বাটীর সকল কথা শুনাইয়া থতমত খাইয়া দাঁড়াইলেন ও বলিলেন —তবে কি মতিলালের বিবাহ কিছু দিন স্থগিত থাকিবে ? গৃহিণী উত্তর করিলেন —তুমি কেমন কথা বলো —শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে ষেটের কোলে মতিলালের বয়েস ষোল বৎসর হইল —আর কি বিবাহ না দেওয়া ভালো দেখায়? এ কথা লইয়া এখন গোলমাল করিলে লগ্ন বয়ে যাবে, কি করছো—একজন ভালো মানুষের কি জাত যাবে? —বড় লয়ে শীঘ্র যাও। গৃহিণীর উপদেশে কর্তার মনের চাঞ্চল্য দূর হইল —বাটীর বাহিরে আসিয়া রোশনাই জ্বালিতে হুকুম দিলেন; অমনি ঢোল, রোশনচৌকি, ইংরাজী বাজনা বাজিয়া উঠিল ও বরকে তক্তনামার উপর উঠাইয়া বাবুরামবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া আপন বন্ধু-বান্ধব কুটুম্ব-সজ্জন সঙ্গে লইয়া হেল্তে দুল্তে চলিলেন। ছাতের উপর থেকে গৃহিণী ছেলের মুখখানি দেখিতে লাগিলেন। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা বলিয়া উঠিল —ও মতির মা ! আহা বাছার কী রূপই বেরিয়েছে। বরের সব ইয়ার-বক্সি চলিয়াছে, পেছনে রংমশাল লইয়া কাহারো গা পোড়াইয়া দিতেছে, কাহারো ঘরের নিকট পটকা ছুঁড়িতেছে, কাহারো কাছে তুবরিতে আগুন দিতেছে। গরীব-দুঃখী লোকসকল দেক্সেক হইল কিন্তু কাহারো কিছু বলিতে সাহস হইল না।
কিয়ৎক্ষণ পরে বর মণীরামপুরে গিয়া উত্তীর্ণ হইল —বর দেখতে রাস্তার দোধারি লোক ভেঙে পড়িল —স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগিল —ছেলেটির শ্রী আছে বটে কিন্তু নাকটি একটু টেকালো হলে ভালো হইত —কেহ বলতে লাগিল রংটি কিছু ফিকে একটু মাজা হলে আরও খুলতো। বিবাহ ভারি লগ্নে হবে কিন্তু রাত্রি দশটা না বাজতে বাজতে মাধববাবু দরওয়ান ও লন্ঠন সঙ্গে করিয়া বরযাত্রীদিগের আগ্বাড়ান লইতে আইলেন —রাস্তায় বৈবাহিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হওয়াতে প্রায় অর্ধঘন্টা শিষ্টাচারেতেই গেল —ইনি বলেন মহাশয় আগে চলুন, উনি বলেন মহাশয় আগে চলুন। বালীর বেণীবাবু এগিয়ে আসিয়া বলিলেন —আপনারা দু’জনের মধ্যে যিনি হউন একজন এগিয়ে পড়ুন আর রাস্তায় দাঁড়াইয়া হিম খাইতে পারি না। এইরূপ মীমাংসা হওয়াতে সকলে কন্যাকর্তার বাটীর নিকট আসিয়া ভিতরে প্রবেশ করিতে লাগিলেন ও বর যাইয়া মজলিসে বসিল। ভাট, রেও ও বারওয়ারীওয়ালা চারিদিকে ঘেরিয়া দাঁড়াইল —গ্রামভাটি ও নানা প্রকার ভাবের কথা উপস্থিত হইতে লাগিল —ঠকচাচা দাঁড়াইয়া রফা করিতেছেন —অনেক দম-সম দেন কিন্তু ফলের দফায় নামমাত্র —রেওদিগের মধ্যে একটা ষণ্ডা তেড়ে এসে বলিল, এ নেড়ে বেটা কেরে ? বেরো বেটা এখান থেকে —হিন্দুর কর্মে মুসলমান কেন ? ঠকচাচা অমনি রাগ উপস্থিত হইল। তিনি দাড়ি নেড়ে চোখ রাঙাইয়া গালি দিতে লাগিলেন। হলধর, গদাধর ও অন্যান্য নব বাবুরা একে চায় আরে পায়। তাহারা দেখিল যে প্রকার মেঘ করিয়া আসিতেছে —ঝড় হইতে পারে —অতএব ফরাস ছেড়ে, কেহ সেজ নেবায় —কেহ ঝাড়ে ঝাড়ে টক্কর লাগাইয়া দেয় —কেহ এর ওর মাথার উপর ফেলিয়া দেয়, কন্যাকর্তার তরফের দুইজন লোক এই সকল গোলযোগ দেখিয়া দুই-একটি শক্ত কথা বলাতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম হইল —মতিলাল বিবাদ দেখিয়া মনে মনে ভাবে, বুঝি আমার কপালে বিয়ে নাই —হয় তো সুতা হাতে সার হইয়া বাটী ফিরিয়া যাইতে হবে।
১১.
মতিলালের বিবাহ উপলক্ষে কবিতা ও আগরপাড়ার অধ্যাপকদিগের বাদানুবাদ।
আগরপাড়ার অধ্যাপকেরা বৈকালে গাছের তলায় বিছানা করিয়া বসিয়া আছেন। কেহ কেহ নস্য লইতেছেন —কেহ বা তামাক খাইতেছেন —কেহ বা খক্ খক্ করিয়া কাশিতেছেন —কেহ বা দুই-একটি খোশ-গল্প ও হাসি-মস্করার কথা কহিতেছেন। তাঁহাদিগর মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন —বিদ্যারত্ন কেমন আছেন? ব্রাহ্মণ পেটের জ্বালায় মণিরামপুরে নিমন্ত্রণে গিয়া পা ভাঙিয়া বসিয়াছে —আহা কাল যে করে লাঠি ধরিয়া স্নান করিতে যাইতেছিলেন তাহাকে দেখিয়া আমার দুঃখ হইল।
বিদ্যাভূষণ। বিদ্যারত্ন ভালো আছেন, চুন হলুদ ও সেঁকতাপ দেওয়াতে বেদনা অনেক কমিয়া গিয়াছে। মণিরামপুরের নিমন্ত্রণ উপলক্ষে কবিকঙ্কণ দাদা যে কবিতা রচনা করিয়াছেন, তাহাতে রং আছে —বলি শুনুন :
ডিমিকি ডিমিকি, তাথিয়ে থিয়ে বোলে নহবত বাজে।
মাধব ভবন। দেবেন্দ্রসদন। জিনি ভুবন বিরাজে।
অদ্ভুত সভা। আলোকের আভা। ঝাড়ের প্রভা মাজে মাজে।
চারিদিকে নানা ফুল। ছড়াছড়ি দুই কুল। বাদ্যের কুল কুল ঝাঁজে।
খোপে খোপে গাঁদা মালা। রাঙা কাপড় রুপার বালা। এতক্ষণে বিয়ের শালা সাজে।
সামেয়ানা ফর্ ফর্। তালি তাতে বহুতর। জল পড়ে ঝর্ ঝর্ হাজে।
লেঠিয়াল মজবুত। দরওয়ান রজপুত। নিনাদ অদ্ভুত গাজে।
লুচি চিনি মনোহরা। ভাঁড়ারেতে খুব ভরা। আল্পনার ডোরা ডোরা সাজে।
ভাট বন্দী কত কত। শ্লোক পড়ে শত শত। ছন্দ নানামতো ভাঁজে।
আগরপাড়া কবিবর। বিরচয়ে ওঁহিপর। ঝুপ করে এল বর সমাজে।
হলধর গদাধর উসু খুসু করে।
ছট্ ফট্ ছট্ ফট্ করে তারা মরে।
ঠকচাচা হন কাঁচা শুনে বাজে কথা।
হলধর গদাধর খাইতেছে মাথা।
পড়াপড়্ পড়াপড়্ ফাঁড়িবার শব্দ।
গুপাগুপ্ গুপাগুপ্ কিলে করে জব্দ।
ঠনাঠন্ ঠনাঠন্ ঝাড়ে ঝাড়ে লাগে।
সট্ সট্ সট্ সট্ করে সবে ভাগে।
মতিলাল দেখে কাল বসে বসে দোলে।
সুতাসার কি আমার আছয়ে কপালে।
বক্রেশ্বর বোকেশ্বর খোশামদে পাক্কা।
চলে যান কিল খান খান গলা ধাক্কা।
বাঞ্ছারাম অবিরাম ফিকিরেতে টন্ক।
চড় খেয়ে আচাড় খেয়ে হইলেন বঙ্ক।
বেচারাম সব বাম দেখে যান টেরে।
দূঁর দূঁর দূঁর দূঁর বলে অনিবারে।
বেণীবাবু খান খাবু নাই গতি গঙ্গা।
হুপ্ হাপ্ গুপ্ গাপ্ বেড়ে উঠে দাঙ্গা।
বাবুরাম ধরে থাম থাম থাম করে।
ঠক ঠক ঠক ঠক কেঁপে মরে ডরে।
ঠকচাচা মোরে বাঁচা বলে তাড়াতাড়ি।
মুসলমান বেঈমান আছে মুড়ি ঝুড়ি।
যায় সরে ধীরে ধীরে মুখে কাপড় মোড়া।
সবে বলে এই বেটা যত কুয়ের গোড়া।
রেওভাট করে সাট ধরে তাকে পড়ে।
চড়্ চড়্ চড়্ চড়্ দাড়ি তার ছেঁড়ে।
সেখের পো ওহো ওহো বলে তোবা তোবা।
জান যায় হায় হায় মাফ করো বাবা।
খুব করি হাত ধরি মোরে দাও ছেড়ে।
ভালা বুরা নেহি জান্তা জেতে মুই নেড়ে।
এ মোকামে কোই কামে আনা ঝকমারি।
হয়রান পেরেসান বেইজ্জতে মরি।
না বুজিয়া না সুজিয়া হেন্দুদের সাতে।
এসেছি বসিয়া আছি সেরফ্ দোস্তিতে।
এ সাদিতে না থাকিতে বার বার নানা।
চাচি মোর ফুপা মোর সবে করে মানা।
না শুনিয়া না রাখিয়া তেনাদের কথা।
জান যায় দাড়ি যায় যায় মোর মাথা।
মহা ঘোর ঝাপে লাঠিয়াল সাজিছে।
কড়্ মড়্ হড়্ মড়্ করে তারা আসিছে।
সপাসপ্ লপালপ্ বেত পিঠে পড়িছে।
গেলুম্রে মলুম্রে বলে সবে ডাকিছে।
বরযাত্রী কন্যাযাত্রী কে কোথা ভাগিছে।
মার মার ধর ধর এই শব্দ বাড়িছে।
বর লয়্যে মাধববাবু অন্তঃপুরে যাইছে।
সভা ভেঙে ছারখার একেবারে হইছে।
সবে বলে ঠক মুখে খুলে কাপড় বেড়।
দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড় দাড়ি ছেঁড়।
বাবুরাম নির্ নাম হইয়ে চলিল।
রেসালা দোশালা সব কোথায় রহিল।
কাপড় চোপড় ছিঁড়ে পড়ে খুলে।
বাতাসে অবশে ওড়ে দুলে দুলে।
চাদর ফাদর নাহি কিছু গায়ে।
হোঁচট মোচট খান সুদু পায়ে।
চলিছে ধলিছে বড়ো অধোমুখে।
পড়েছি ডুবেছি আমি ঘোর দুঃখে।
ক্ষুধাতে তৃষ্ণাতে মোর ছাতি ফাটে।
মিঠাই না পাই নাহি মুড়কি জোটে।
রজনী অমনি হইতেছে ঘোর
বাতাস নিশ্বাস মধ্যে হল জোর।
বহে ঝড় হড়্ মড়্ চারিদিগে।
পবন শমন যেন এল বেগে।
কি করি একাকী না লোক না জন।
নিকট বিকট হইবে মরণ।
চলিতে বলিতে মন নাহি লাগে।
বিধাতা শত্রুতা করিলে কি হবে।
না জানি গৃহিণী মোর মৃত্যু শুনে।
দুঃখেতে খেদেতে মরিবেন প্রাণে।
বিবাহ নির্বাহ হল কি না হল।
ঠ্যাঙাতে লাঠিতে কিন্তু প্রাণ গেল।
সম্বন্ধ নির্বন্ধ কেন করিলাম।
মানেতে প্রাণেতে আমি মজিলাম।
আসিতে আসিতে দোকান দেখিল।
অবাধা তাগাদা যাইয়া ঢুকিল।
পার্শ্বেতে দর্মাতে শুয়ে আছে পড়ে।
অস্থির দুস্থির বুরো ঠক নেড়ে।
কেমনে এখানে বাবুরাম বলে।
একালা আমাকে ফেলিয়া আইলে।
এ কর্ম কি কর্ম সখার উচিত।
বিপদে আপদে প্রকাশে পিরিত।
ঠক কয় মহাশয় চুপ করো।
দোকানী না জানি তেনাদের চর।
পেলিয়ে যাইলে সব বাত হবে।
বাঁচিলে জানেতে মহবত রবে।
প্রভাতে দোঁহাতে করিল গমন
রচিয়ে তোটকে শ্রীকবিকঙ্কণ।
তর্কবাগীশ বাবুরামবাবুর বড়ো গোঁড়া কবিতা শুনিবামাত্র জ্বলিয়া উঠে বলিলেন —আ মরি ! কিবা কবিতা —সাক্ষাৎ সরস্বতী মূর্তিমান —কিংবা কালিদাস মরিয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন —কবিকঙ্কণের ভারি বিদ্যা —এমন ছেলে বাঁচা ভার। পয়ারও চমৎকার ! মেজের মাটি —পাথর বাটি —শীতল পাটি —নারকেল কাটি ! ব্রাহ্মণ পণ্ডিত হইয়া বড়োমানুষের সর্বদা প্রশংসা করিবে গ্লানি করা তো ভদ্র কর্ম নয় —এই বলিয়া তিনি রাগ করিয়া সে স্থান হইতে উঠিয়া চলিয়া যান। সকলে হাঁ —হাঁ —দাঁড়ান গো বলিয়া তাঁহাকে জোর করিয়া বসাইলেন।
অন্য আর একজন অধ্যাপকও কথা চাপা দিয়া অন্যান্য কথা ফেলিয়া সলিয়ে-কলিয়ে বাবুরামবাবু ও মাধববাবুর তারিফ করিতে আরম্ভ করিলেন। বামুনে বুলি প্রায় বড়ো মোটা —সকল সময় সবকথা তলিয়ে বুঝিতে পারে না —ন্যায়শাস্ত্রে ফেঁকড়ি পড়িয়া কেবল ন্যায়শাস্ত্রীয় বুদ্ধি হয় সাংসারিক বুদ্ধির চালনা হয় না। তর্কবাগীশ অমনি গলিয়া গিয়া উপস্থিত কথায় আমোদ করিতে লাগিলেন।
১২.
বেচারামবাবুর নিকট বেণীবাবুর গমন, মতিলালের ভ্রাতা রামলালের উত্তম চরিত্র হওনের কারণ, বারদাপ্রসাদবাবুর প্রসঙ্গ— মন শোধনের উপায়।
বৌবাজারের বেচারামবাবু বৈঠকখানায় বসিয়া আছেন। নিকটে দুই-একজন লোক কীর্তন-অঙ্গ গাইতেছেন। বাবু গোষ্ঠ, দান, মান, মাথুর খণ্ডিতা, উৎকণ্ঠিতা কলহান্তরিতা ক্রমে ক্রমে ফরমাইশ করিতেছেন। কীর্তনিয়ারা মনোহরসাহী রেনিটি ও নানা প্রকার সুরে কীর্তন করিতেছে, সে সকল শুনিয়া কেহ কেহ দশা পাইয়া একেবারে গড়াগড়ি দিতেছে। বেচারামবাবু চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় স্তব্ধ হইয়া রহিয়াছেন এমতো সময়ে বালীর বেণীবাবু গিয়া উপস্থিত।
বেচারামবাবু অমনি কীর্তন বন্ধ করাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, আরে কত্তা বেণীভায়া। বেঁচে আছো কি? বাবুরাম নেকড়ার আগুন —ছেড়েও ছাড়ে না অথচ আমরা তাঁহার যে কর্মে যাই সেই কর্মে লণ্ডভণ্ড হইয়া আসিতে হয়। মনিরামপুরের ব্যাপারেতে ভালো আক্কেল পাইয়াছি —কথাই আছে, যে হয় ঘরের শত্রু সেই যায় বর যাত্রী।
বেণী। বাবুরামবাবুর কথা আর বলবেন না —দেক্সেক্ হওয়া গিয়াছে —ইচ্ছা হয় বালীর ঘর-দ্বার ছাড়িয়া প্রস্থান করি। “অপরম্বা কিং ভবিষ্যতি” —আর বা কপালে কি আছে।
বেচারাম। ভালো, বাবুরামের তো এই গতিক —আপনি যেমন —মন্ত্রী যেমন —সঙ্গীরা যেমন —পুত্র যেমন —সকল কর্ম-কারখানা তেমন। তাহার ছোট ছেলেটি ভালো হইতেছে এর কারণ কি ? সে যে গোবর কুঁড়ে পদ্ম ফুল।
বেণী। আপনি এ কথা জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। — এ কথাটি অসম্ভব বটে কিন্তু ইহার বিশেষ কারণ আছে। পূর্বে আমি বরদাপ্রসাদ বিশ্বাসবাবুর পরিচয় দিয়াছি তাহা আপনার স্মরণ থাকিতে পারে। কিয়ৎকালাবধি ঐ মহাশয় বৈদ্যবাটীতে অবস্থিতি করিয়া আছেন। আমি মনের মধ্যে বিবেচনা করিয়া দেখিলাম বাবুরামবাবুর কনিষ্ঠ পুত্র রামলাল যদ্যপি মতিলালের মতো হয় তবে বাবুরামের বংশ ত্বরায় নির্বংশ হইবে কিন্তু ঐ ছেলেটি ভালো হইতে পারে, তাহার উত্তম সুযোগ হইয়াছে। এই সকল বিবেচনা করিয়া রামলালকে সঙ্গে করিয়া উক্ত বিশ্বাসবাবুর নিকট গিয়াছিলাম। ছেলেটির সেই পর্যন্ত বিশ্বাসবাবুর প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে তাঁহার নিকটেই সর্বদা পড়িয়া আছে, আপন বাটীতে বড় থাকে না। তাঁহাকে পিতার তুল্য দেখে।
বেচারাম। পূর্বে ঐ বিশ্বাসবাবুরই গুণ বর্ণনা করিয়াছিলে বটে —যাহা হউক একাধারে এত গুণ কখনও শুনি নাই, এক্ষণে তাঁহার ভালো পদ হইয়াছে —মনে গর্মি না জন্মিয়া এত নম্রতা কি প্রকারে হইল ?
বেণী। যে ব্যক্তি বাল্যকালাবধি সম্পত্তি প্রাপ্ত হয় ও কখন বিপদে না পড়িয়া কেবল সম্পদেই বাড়িতে থাকে তাহার নম্রতা প্রায় হওয়া ভার —সে ব্যক্তি অন্যের মনের গতি বুঝিতে পারে না অর্থাৎ কি বা পরের প্রিয়, কি বা পরের অপ্রিয়, তাহা তাহার কিছুমাত্র বোধ হয় না, কেবল আপন সুখে সর্বদা মত্ত থাকে —আপনাকে বড়ো দেখে ও তাহার আত্মীয়বর্গ প্রায় তাহার সম্পদেরই খাতির করিয়া থাকে। এমতো অবস্থায় মনের গর্মি বড়ো ভয়ানক হইয়া উঠে —এমতো স্থলে নম্রতা ও দয়া কখনই স্থায়ী হইতে পারে না। এই কারণে কলিকাতার বড়োমানুষের ছেলেরা প্রায় ভালো হয় না। একে বাপের বিষয়, তাতে ভারি পদ সুতরাং সকলের প্রতি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করিয়া বেড়ায়। চোট না খাইলে —বিপদে না পড়িলে মন স্থির হয় না। মনুষ্যের নম্রতা অগ্রেই আবশ্যক। নম্র না হইলে লোকে ধর্মে বাড়িতেও পারে না।
বেচারাম। বরদাবাবু এত ভালো কি প্রকারের হইলেন ?
বেণী। বরদাবাবু বাল্যাবস্থা অবধি ক্লেশে পড়িয়াছিলেন। ক্লেশে পড়িয়া পরমেশ্বরকে অনবরত ধ্যান করিতেন —এইমতো অনবরত ধ্যান করাতে তাঁহার মনে দৃঢ় সংস্কার হইয়াছে যে, যে-কর্ম পরমেশ্বরের প্রিয় তাহাই করা কর্তব্য। যে-যে কর্ম তাঁহার অপ্রিয় তাহা প্রাণ গেলেও করা কর্তব্য নহে। ঐ সংস্কার অনুসারে তিনি চলিয়া থাকেন।
বেচারাম। পরমেশ্বরের প্রিয় অপ্রিয় কর্ম তিনি কি প্রকারে স্থির করিয়াছেন।
বেণী। ঐ বিষয়ে জ্ঞান প্রাপ্ত হইবার দুই উপায়ে আছে। প্রথমতঃ, মনঃসংযম করিতে হয়। মনের সংযম নিষিদ্ধ স্থির হইয়া ধ্যান ও মনের সম্ভাব বৃদ্ধি করা অবশ্যক। স্থিরতর চিত্তে ধ্যানের দ্বারা মনকে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে হিতাহিত বিবেচনা শক্তি চালনা হইতে থাকে, ঐ শক্তি যেমন প্রবল হইয়া উঠে তেমনি লোকে ঈশ্বরের অপ্রিয় কর্মে বিরত হইয়া প্রিয় কর্মেতে রত হইতে থাকে। দ্বিতীয়তঃ সাধুলোকে যাহা লিখিয়াছেন তাহা পাঠ ও আন্দোলন করিলে ঐ শক্তি ক্রমশঃ অভ্যাস হয়। বরদাবাবু আপনাকে ভালো করিবার জন্য কোনো অংশ কসুর করেন নাই। অদ্যাবধি তিনি সাধারণ লোকের ন্যায় কেবল হো হো করিয়া বেড়ান না। প্রাতঃকালে উঠিয়া নিয়ত পরমেশ্বরের উপাসনা করিয়া থাকেন —তৎকালীন তাঁহার মনে যে ভাব উদয় হয় তাহা তাঁহার নয়নের জল দ্বারাই প্রকাশ পায়। তাহার পরে তিনি আপনি কি মন্দ ও কি ভালো কর্ম করিয়াছেন তাহা সুস্থির হইয়া উল্টে পাল্টে দেখেন —তিনি আপন গুণ কখনই গ্রহণ করেন না —কোন অংশে কিঞ্চিৎমাত্র দোষ দেখিলেই অতিশয় সন্তাপিত হন কিন্তু অন্যের গুণ শ্রবণে আমোদ করেন, দোষ জানিতে পারিলে ভ্রাতৃভাবে কেবল কিছু দুঃখ প্রকাশ করেন। এইরূপ অভ্যাসের দ্বারা তাঁহার চিত্ত নির্মল ও শান্ত হইয়াছে। যে ব্যক্তি মনকে এরূপ সংযত করে সে যে ধর্মেতে বাড়িবে তাহাতে আশ্চর্য কি ?
বেচারাম। বেণী ভায়া। বরদাবাবুর কথা শুনিয়া কর্ণ জুড়াইল, এমতো লোকের সহিত একবার দেখা করিতে হইবে, দিবসে তিনি কি করিয়া থাকেন ?
বেণীবাবু। তিনি দিবসে বিষয় কর্ম করিয়া থাকেন বটে কিন্তু অন্যান্য লোকের মতো নহে। অনেকেই বিষয় কর্মে প্রবৃত্ত হইয়া কেবল পদ ও অর্থের বিষয় ভাবেন, কিন্তু তিনি তাহা বড় ভাবেন না। তাঁহার ভালো জানা আছে যে পদ ও অর্থ জলবিম্বের ন্যায় দেখিতে ভালো —শুনিতে ভালো —কিন্তু মরিলে সঙ্গে যায় না বরং সাবধানপূর্বক না চলিলে ঐ উভয় দ্বারা কুমতি জন্মিয়া থাকে, তাঁহার বিষয় কর্ম করিবার প্রাধান তাৎপর্য এই যে তদ্দ্বারা আপন ধর্মের চালনা ও পরীক্ষা করিবেন। বিষয়কর্ম করিতে গেলে লোভ, রাগ, হিংসা, অবিচার ইত্যাদি প্রবল হইয়া উঠে ও ঐ সকল রিপুর দাপটে অনেকেই মারা যায়, তাহাতে যে সামলিয়া যায় সে-ই প্রকৃত ধার্মিক। ধর্ম মুখে বলা সহজ কিন্তু কর্মের দ্বারা না দেখাইলে মুখে বলা কেবল ভণ্ডামি; বরদাবাবু সর্বদা বলিয়া থাকেন সংসার পাঠশালার স্বরূপ, বিষয় কর্মের দ্বারা মনের সদভ্যাস হইলে ধর্ম অটুট হয়।
বেচারাম। তবে কি বরদাবাবু অর্থকে অগ্রাহ্য করেন ?
বেণী। না না —অর্থকে হেয় বোধ করেন না —কিন্তু তাঁহার বিবেচনাতে ধর্ম অগ্রে অর্থ তাহার পরে, অর্থাৎ ধর্মকে বজায় রাখিয়া অর্থ উপার্জন করিতে হইবেক।
বেচারাম। বরদাবাবু রাত্রে বাড়িতে কি করেন ?
বেণী। সন্ধ্যার পর পরিবারের সহিত সদালাপ ও পড়াশুনা করিয়া থাকেন। তাঁহার সচ্চরিত্র দেখিয়া পরিবারের সকলে তাঁহার মতো হইতে চেষ্টা করে, পরিবারের প্রতি তাঁহার এমতো স্নেহ যে স্ত্রী মনে করেন এমন স্বামী যেন জন্মে জন্মে পাই, সন্তানেরা তাঁহাকে এক দণ্ড না দেখিলে ছটফট করে। বরদাবাবুর পুত্রগুলি যেমন ভালো, কন্যাগুলিও তেমনি ভালো। অনেকের বাটীতে ভায়ে-বোনে সর্বদা কচ্কচি-কলহ করিয়া থাকে। বারদাবাবুর সন্তানেরা কেহ কাহাকেও উচ্চ কথা কহে না, কি লেখার সময়, কি পড়ার সময়, কি খাবার সময়, সকল সময়ই তাহারা পরস্পর স্নেহ পূর্বক কথাবার্তা কহিয়া থাকে —বাপ-মা ভালো না হইলে সন্তান ভালো হয় না।
বেচারাম। আমি শুনিয়াছি বরদাবাবু সর্বদা পাড়ায় ঘুরিয়া বেড়ান।
বেণী। এ কথা সত্য বটে —তিনি অন্যের ক্লেশ, বিপদ অথবা পীড়া শুনিলে বাটীতে স্থির হইয়া থাকিতে পারেন না। নিকটস্থ অনেক লোকের নানা প্রকারে উপকার করিয়া থাকেন কিন্তু ঐ কথা ঘুণাক্ষরে কাহাকেও বলেন না ও অন্যের উপকার করিলে আপনাকে উপকৃত বোধ করেন।
বেচারাম। বেণী ভায়া। এমন প্রকার লোক চক্ষে দেখা দূরে থাকুক কোনো কালে কখন কানেও শুনি নাই —এমতো লোকের নিকটে বুড়ো থাকিলেও ভালো হয় —ছেলে তো ভালো হবেই। আহা। বাবুরামের ছোট ছেলেটি ভালো হইলেই বড়ো সুখজনক হইবে।
১৩.
বরদাপ্রসাদবাবুর উপদেশ দেওন –তাঁহার বিজ্ঞতা ও ধর্মনিষ্ঠা এবং সুশিক্ষার প্রণালী। তাঁহার নিকট রামলালের উপদেশ, তজ্জন্য তাঁহার পিতার ভাবনা ও ঠকচাচার সহিত পরামর্শ। রামলালের গুণ বিষয়ে মনান্তর ও তাঁহার বড়ো ভগিনীর পীড়া ও বিয়োগ।
বরদাপ্রসাদবাবুর বিদ্যাশিক্ষা বিষয় বিজাতীয় বিচক্ষণতা ছিল। তিনি মানব স্বভাব ভালো জানিতেন। মনের কি কি শক্তি কি কি ভাব এবং কি কি প্রকারে ঐ সকল শক্তি ও ভাবের চালনা হইলে মনুষ্য বুদ্ধিমান ও ধার্মিক হইতে পারে তদ্বিষয়ে তাঁহার বিশেষ বিজ্ঞতা ছিল। শিক্ষকের কর্মটি বড়ো সহজ নহে। অনেকে যৎকিঞ্চিৎ ফুলতোলা রকম শিখিয়া অন্য কর্ম-কাজ না জুটিলে শিক্ষক হইয়া বলেন –এমতো সকল লোকের দ্বারা ভালো শিক্ষা হইতে পারে না। প্রকৃত শিক্ষক হইতে গেলে মনের গতি ও ভাব সকলকে ভালো রূপে জানিতে হয় এবং কি প্রকারে শিক্ষা দিলে কর্মে আসিতে পারে তাহা সুস্থির হইয়া দেখিতে হয় ও শুনিতে হয় ও শিখিতে হয়। এ সকল না করিয়া তাড়াহুড়া রকমে শিক্ষা দিলে কেবল পাথরে কোপ মারা হয় –একশত বার কোদাল পড়িলেও এক মুঠা মাটি কাটা হয় না, বরদাপ্রসাদ বাবু বহুদর্শী ছিলেন –অনেক কালাবধি শিক্ষার বিষয়ে মনোযোগী থাকাতে শিক্ষা দেওয়ার প্রণালী ভালো জানিতেন, তিনি যে প্রকারে শিক্ষা করাইতেন তাহাতে সার শিক্ষা হইত। এক্ষণে সরকারী বিদ্যালয়ে যে প্রকার শিক্ষা হয় তাহাতে শিক্ষার আসল অভিপ্রায় সিদ্ধ হয় না, কারণ মনের শক্তি ও মনের ভাবাদির সুন্দর রূপ চালনা হয় না, ছাত্রেরা কেবল মুখস্থ করিতে শিখে। তাতে কেবল স্মরণশক্তি জাগরিত –বিবেচনাশক্তি প্রায় নিদ্রিত থাকে, মনের ভাবাদির চলনার তো কথাই নাই। শিক্ষার প্রধান তাৎপর্য এই যে ছাত্রদিগের বয়ঃক্রম অনুসারে মনের শক্তি ও ভাব সকল সমানরূপে চালিত হইবেক। এক শক্তির অধিক চালনা ও অন্য শক্তির অল্প চালনা করা কর্তব্য হয় না। যেমন শরীরের সকল অঙ্গকে মজবুত করিলে শরীরটি নিরেট হয় তেমনি মনের সকল শক্তিকে সমানরূপে চালনা করিলে আসল বুদ্ধি হয়। মনে সদ্ভাবাদিরও চালনা সমানরূপে করা আবশ্যক। একটি সদ্ভাবের চালনা করিলেই সকল সদ্ভাবের চালনা হয় না। সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মিলেও দয়ার লেশ না থাকিতে পারে –দয়ার ভাগ অধিক থাকিয়া দেনা-পাওনা বিষয়ে কাণ্ডজ্ঞান না থাকা অসম্ভব নহে –দেনা-পাওনা বিষয়ে খাড়া থাকিয়াও পিতা-মাতা স্ত্রী-পুত্রের উপর অযত্ন ও নিস্নেহ হইবার সম্ভাবনা –পিতা-মাতা-স্ত্রী-পুত্রের প্রতি স্নেহ থাকিতে পারে অথচ সরলতা কিছু মাত্র না থাকা অসম্ভব নহে। ফলেও বরদাপ্রসাদ বাবু ভালো জানিতেন যে মনের ভাবাদির চালনার মূল পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি –ঐ ভক্তির যেমন বৃদ্ধি হইবে তেমনি মনের সকল ভাবের চালনা হইতে থাকিবে, তাহা না হইলে ঐ কর্মটি জলের উপরে আঁক কাটার প্রায় হইয়া পড়ে।
রামলাল ভাগ্যক্রমে বরদাবাবুর শিষ্য হইয়াছিল। রামলালের মনের সকল শক্তি ও ভাবের চালনা সুন্দররূপে হইতে লাগিল। মনের ভাবের চালনা সৎ লোকের সহবাসে যেমন হয়, তেমন শিক্ষা দ্বারা হয় না। যেমন কলমের দ্বারা জাম গাছের ডাল আঁব গাছের ডাল হয়, তেমন সহবাসের দ্বারা এক রকম মন অন্য আর এক রকম হইয়া পড়ে। সৎমনের এমন মহাত্ম্য যে –তাহার ছায়া অধম মনের উপর পড়িলে, অধম রূপ ক্রমে ক্রমে সেই ছায়ার স্বরূপ হইয়া বসে।
বরদাবাবুর সহবাসে রামলালের মনের ঢাঁচা প্রায় তাহার মনের মতো হইয়া উঠিল। রামলাল প্রাতঃকালে উঠিয়া শরীরকে বলিষ্ঠ করিবার জন্য ফর্দা জায়গায় ভ্রমণ ও বায়ু সেবন করেন –তাঁর দৃঢ় সংস্কার হইল যে, শরীরে জোর না হইলে মনের জোর হয় না। তাহার পরে বাটীতে আসিয়া উপাসনা ও আত্মবিচার করেন এবং যে সকল বহি পড়িলে ও যে-যে লোকের সহিত আলাপ করিলে বুদ্ধি ও মনের সদ্ভাব বৃদ্ধি হয় কেবল সেই সকল বহি পড়েন ও সেই সকল লোকের সাহিত আলাপ করেন। সৎ লোকের নাম শুনিলেই তাঁহার নিকট গমনাগমন করেন –তাঁহার জাতি অথবা অবস্থার বিষয় কিছুমাত্র অনুসন্ধান করেন না। রামলালের বোধশোধ এমতো পরিষ্কার হইল যে, যাহার সঙ্গে আলাপ করেন তাহার সহিত কেবল কেজো কথাই কহেন –ফাল্তো কথা কিছুই কহেন না, অন্য লোক ফাল্তো কথা কহিলে আপন বুদ্ধির জোরে কুরুনির ন্যায় সার সার কথা বাহির করিয়া লয়েন। তিনি মনের মধ্যে সর্বদাই ভাবেন পরমেশ্বরের প্রতি ভক্তি, নীতিজ্ঞান ও সদ্বুদ্ধি যাহাতে বাড়ে তাহাই করা কর্তব্য। এই মতে চলাতে তাঁহার স্বভাব-চরিত্র ও কর্মসকল উত্তর উত্তর প্রশাংসনীয় হইতে লাগিল।
সততা কখনই চাপা থাকে না –পাড়ার সকল লোকে বলাবলি করে –রামলাল দৈত্যকূলের প্রহ্লাদ। তাহাদিগের বিপদ-আপদে রামলাল আগে বুক দিয়া পড়ে। কি পরিশ্রম দ্বারা, কি অর্থ দ্বারা, কি বুদ্ধি দ্বারা, যাহার যাতে উপকার হয় তাহাই করে। কি প্রাচীন, কি যুবা, কি শিশু, সকলেই রামলালের অনুগত ও আত্মীয় হইল –রামলালের নিন্দা শুনিলে তাহাদিগের কর্ণে শেল সম লাগিত –প্রশংসা শুনিলে মহা আনন্দ হইত। পাড়ার প্রাচীন স্ত্রীলোকেরা পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিল –আমাদিগের এমন একটি ছেলে হলে বাছাকে কাছছাড়া হতে দিতুম না –আহা ! ওর মা কত পূণ্য করেছিল যে এমন ছেলে পেয়েছে। যুবতী স্ত্রীলোকেরা রামলালের রূপ গুণ দেখিয়া শুনিয়া মনে মনে কহিত, এমনি পুরুষ যেন স্বামী হয়।
রামলালের সৎ স্বভাব ও সৎ চরিত্র ক্রমে ক্রমে ঘরে-বাহিরে নানা প্রকারে পাইতে লাগিল, তাঁহার পরিবার মধ্যে কাহারও প্রতি কোনো অংশে কর্তব্য কর্মের ত্রুটি হইত না।
রামলালের পিতা তাঁহাকে দেখিয়া এক একবার মনে করিতেন, ছোট পুত্রটি হিন্দুয়ানী বিষয় আল্গা আল্গা রকম –তিলক সেবা করে না –কোশা-কোশী লইয়া পূজা করে না। হরিনামের মালাও জপে না, অথচ আপন মত অনুসারে উপাসনা করে ও কোনো অধর্মে রত নহে –আমরা ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা কথা কহি –ছেলেটি সত্য বৈ অন্য কথা জানে না –বাপ-মার প্রতি বিশেষ ভক্তিও আছে, অধিকন্তু আমাদের অনুরোধে কোনো অন্যায় কর্ম করিতে কখনই স্বীকার করে না –আমার বিষয়-আশয়ে অনেক জোর আছে –সত্য মিথ্যা দুই-ই-চাই। অপর বাটীতে দোল দুর্গোৎসব ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ হইয়া থাকে –এ সকল কি প্রকারে রক্ষা হইবে ? মতিলাল মন্দ বটে কিন্তু সে ছেলেটির হিন্দুয়ানী আছে –বোধ হয় দোষে-গুণে বড়ো মন্দ নয় –বয়েসকালে ভারিত্ব হইলে সব সেরে যাবে। রামলালের মাতা ও ভগিনীরা তাঁহার গুণে দিন দিন আর্দ্র হইতে লাগিলেন। ঘোর অন্ধকারের পর আলোক দর্শনে যেমন আহলাদ জন্মে তেমনি তাঁহাদিগের মনে আনন্দ হইল, মতিলালের অসদ্ব্যবহারে তাঁহারা ম্রিয়মাণ ছিলেন, মনে কিছুমাত্র সুখ ছিল না, –লোক গঞ্জনায় অধোমুখ হইয়া থাকিতেন, এক্ষণে রামলালের সদ্গুণে মনে সুখ ও মুখ উজ্জ্বল হইল। দাসদাসীরা পূর্বে মতিলালের নিকট কেবল গালাগালি ও মার খাইয়া পালাই পালাই ডাক ছাড়িত –এক্ষণে রামলালের মিষ্ট বাক্যে ও অনুগ্রহে ভিজিয়া আপন আপন কর্মে অধিক মনোযোগী হইল। মতিলাল, হলধর ও গদাধর রামলালের কাণ্ড-কারখানা দেখিয়া পরস্পর বলাবলি করিত, ছোঁড়া পাগল হল –বোধ হয় মাথায় দোষ জন্মিয়াছে। কর্তাকে বলিয়া ওকে পাগলা গারদে পাঠান যাউক –একরত্তি ছোঁড়া, দিবারাত্রি ধর্ম ধর্ম বলে –ছেলে মুখে বুড়ো কথা ভালো লাগে না। মানগোবিন্দ, রামগোবিন্দ ও দোলগোবিন্দ মধ্যে মধ্যে বলে –মতিবাবু ! তুমি কপালে পুরুষ –রামলালের গতিক ভালো নয় –ওটা ধর্ম ধর্ম করিয়া নিকেশ হবে, তারপর তুমিই সমস্ত বিষয়টা লইয়া পায়ের উপর পা দিয়া নিছক মজা মারো। আর ওটা যদিও বাঁচে তবু কেবল জড়ভরতের মতো হবে। আ মরি ! যেমন গুরু তেমন চেলা –পৃথিবীতে আর শিক্ষক পাইলেন না ! একটা বাঙালের কাছে গুরুমন্ত্র পাইয়া সকলের নিকট ধর্ম ধর্ম করিয়া বেড়ান। বড়ো বাড়াবাড়ি করলে ওকে আর ওর গুরুকে একেবারে বিসর্জন দিব। আ মরি ! টগরে ছোঁড়া বলে বেড়ায়, দাদা কুসঙ্গ ছাড়লে বড়ো সুখের বিষয় হবে –আবার বলে বরদাবাবুর নিকট গমনাগমন করিলে ভালো হয়। বরদাবাবু বুদ্ধির ঢেঁকি। গুণবানের জেঠা। খবরদার মতিবাবু, তুমি যেন দমে পড়ে সেটার কাছে যেও না। আমরা আবার শিখব কি ? তার ইচ্ছা হয় তো সে আমাদের কাছে এসে শিখে যাউক। আমরা এক্ষণে রং চাই –মজা চাই –আয়েস চাই।
ঠকচাচা সর্বদাই রামলালের গুণাগুণ শুনেন ও বসিয়া বসিয়া ভাবেন। ঠকের আঁচ সময় পাইলেই বাবুরামের বিষয়ের উপর দুই-এক ছোবল মারিবেন। এই পর্যন্ত অনেক মামলা গোলমালে গিয়াছে –ছোবল মারিবার সময় হয় নাই কিন্তু চারের উপর চার দিয়া ছিপ ফেলার কসুর হয় নাই। রামলাল যে প্রকার হইয়া উঠিল তাহাতে যে মাছ পড়ে এমন বোধ হইল না –পেঁচ পড়িলেই সে পেঁচের ভিতর যাইতে বাপকে মানা করিবে। অতএব ঠকচাচা ভারি ব্যাঘাত উপস্থিত দেখিল এবং ভাবিল আশার চাঁদ বুঝি নৈরাশ্যের মেঘে ডুবে গেল, আর প্রকাশ বা না পায়। তিনি মনোমধ্যে অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন বাবুরামকে বলিলেন, বাবু সাহেব। তোমার ছোট লাড়কার ডৌল নেকা করে মোর বড়ো গর্মি হচ্ছে। মোর মালুম হয় ওনা দেওয়ানা হয়েছে –তেনা মোর উপর বড়ো খাপ্পা, দশ আদমির নজদিগে বলে মুই তোমাকে খারাপ করলাম –এ বাতশুনে মোর দেলে বড়ো চোট লেগেছে। বাবু সাহেব ! এ বহুত বুরাবাত –এজ এস মাফিক মোরে বললে –কেল তোমাকেও শক্ত শক্ত বলতে পারে। লেড়কা ভালো হবে –নরম হবে –বেতমিজ ও বজ্জাত হল, এলাজ দেয়া মোনাসেব। আর যে রবক সবক পড়ে তাতে যে জমিদারি থাকে এতনা মোর এক্কেলে মালুম হয় না।
যে ব্যক্তির ঘটে বড়ো বুদ্ধি নাই সে পরের কথায় অস্থির হইয়া পড়ে। যেমন কাঁচা মাঝির হাতে তুফানে নৌকা পড়িলে টল্মল্ করিতে থাকে –কুল-কিনারা পেয়েও পায় না –সেই মতো ঐ ব্যক্তি চারিদিকে অন্ধকার দেখে – ভালো-মন্দ কিছুই স্থির করিতে পারে না। একে বাবুরামবাবুর মাজা বুদ্ধি নহে তাতে ঠকচাচার করা ব্রহ্মজ্ঞান, এই জন্য ভেবাচেকা লেগে তিনি ভদ্রজংলার মতো ফেল্ফেল্ করিয়া চাহিয়া রহিলেন ও ক্ষণেক কাল পরে জিজ্ঞাসা করিলেন –উপায় কি ! ঠকচাচা বলিলেন –মোশার লেড়কা বুরা নহে, বারদাবাবুই সব বদের জড় –ওনাকে তফাত করিলে লেড়কা ভালো হবে –বাবু সাহেব। হেন্দুর লেড়কা হবে হেন্দু মাফিক পাল-পর্বণ করা মোনাসেব, আর দুনিয়াদারি করিতে গেলে ভালা-বুরা দুই-ই চাই –দুনিয়া সাচ্চা নয় –মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করবো ?
যাহার যেরূপ সংস্কার সেইমতো কথা শুনিলে ঐ কথা বড়ো মনের মতো হয়। হিন্দুয়ানী ও বিষয় রক্ষা সংক্রান্ত কথাতেই লক্ষ্য সিদ্ধ হইবে, তাহা ঠকচাচা ভালো জানিতেন ও ঐ কথাতেই কর্ম কেয়াল হইল। বাবুরামবাবু উক্ত পরামর্শ শুনিয়া তা বটে তো তা বটে তো বলিয়া কহিলেন –যদি তোমার এই মত তো শীঘ্র কর্ম নিকেশ করো –টাকাকড়ি যাহা আবশ্যক হবে আমি তাহা দিব কিন্তু কল-কৌশল তোমার।
রামলালের সংক্রান্ত ঘষ্টি ঘর্ষণা এইরূপ হইতে লাগিল। নানা মুনির নানা মত –কেহ বলে ছেলেটি এ অংশে ভালো –কেহ বলে ও অংশে ভালো নহে –কেহ বলে এই মুখ্য গুণটি না থাকাতে এক কলসী দুগ্ধে এক ফোঁটা গোবর পড়িয়াছে –কেহ বলে ছেলেটি সর্ব বিষয়ে গুণান্বিত, এইরূপ কিছুকাল যায় –দৈবাৎ বাবুরামবাবুর বড়ো কন্যার সাংঘাতিক পীড়া উপস্থিত হইল। পিতা-মাতা কন্যাকে ভারি ভারি বৈদ্য আনাইয়া দেখাইতে লাগিলেন। মতিলাল ভগিনীকে একবারও দেখিতে আইল না। –পরম্পরায় বলিয়া বেড়াইতে লাগিল ভদ্র লোকের ঘরে বিধবা হইয়া থাকা অপেক্ষা শীঘ্র মরা ভাল, এবং ঐ সময়ে তাহার আমোদ আহ্লাদ বাড়িয়া উঠিল –কিন্তু রামলাল আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া ভগিনীর সেবা-শুশ্রূষা করিতে লাগলেন ও ভগিনীর আরোগ্যের জন্য অতিশয় চিন্তান্বিত ও যত্নবান হইলেন। ভগিনী পীড়া হইতে রক্ষা পাইলেন না –মৃত্যুকালীন ছোট ভ্রাতার মস্তকে হাত দিয়া বলিলেন –রাম ! যদি মরে আবার মেয়ে জন্ম হয় তবে যেন তোমার মতো ভাই পাই –তুমি আমার যা করেছ তাহা আমি মুখে বলিতে পারিনে –তোমার যেমন মন তেমনি পরমেশ্বর তোমাকে সুখে রাখিবেন –এই বলিয়া ভগিনী প্রাণ ত্যাগ করিলেন।
১৪.
মতিলাল ও তাহার দলবল একজন কবিরাজ লইয়া তামাশা-ফষ্টি করণ, রামলালের সহিত বরদাপ্রসাদবাবুর দেশ ভ্রমণের ফলের কথা, হুগলী হইতে গুমখুনির পরওয়ানা ও বরদাবাবু প্রভৃতির তথায় গমন।
বেলেল্লা ছোঁড়াদের আয়েসে আশ মেটে না, প্রতিদিন তাহাদের নূতন নূতন টাটকা টাটকা রং চাই। বাহিরে কোনো রকম আমোদের সূত্র না পাইলে ঘরে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসে। যদি প্রাচীন খুড়া জেঠা থাকে তবেই বাঁচোয়া, কারণ বেসম্পর্ক ঠাট্টা চলে অথবা জো সো করে তাঁহাদিগের গঙ্গাযাত্রার ফিকিরও হইতে পারে, নতুবা বিষম সংকট –একেবারে চারিদিকে সরিষাফুল দেখে।
মতিলাল ও তাহার সঙ্গীরা নানা রঙ্গের রঙ্গী হইয়া অনেক প্রকার লীলা করিতে লাগিল কিন্তু কোন্ লীলা যে শেষ লীলা হইবে, তাহা বলা বড়ো কঠিন। তাহাদিগের আমোদ-প্রমোদের তৃষ্ণা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। এক এক রকমের আমোদ দুই-একদিন ভালো লাগে –তাহার পরেই বাসী হইয়া পড়ে, আবার অন্য কোনো রং না হইলে ছট্ফটানি উপস্থিত হয়। এইরূপে মতিলাল দলবল লইয়া কাল কাটায়। পালাক্রমে এক একজনকে এক একটা নূতন নূতন আমোদের ফোয়ারা খুলিয়া দিতে হইত, এজন্য একদিন হলধর দোলগোবিন্দের গায়ে লেপমুড়ি দিয়া ভাইলেক সকলকে শিখাইয়া পড়াইয়া ব্রজনাথ কবিরাজের বাটীতে গমন করিল। কবিরাজের বাটীতে ঔষধ প্রস্তুতের ধুম লেগে গিয়াছে – কোনোখানে রসাসিন্ধু মাড়া যাইতেছে –কোনোখানে মধ্যম নারায়ণ তৈলের জ্বাল হইতেছে –কোনোখানে সোনা ভস্ম হইতেছে। কবিরাজ মহাশয় এক হাতে ঔষধের ডিপে ও আর এক হাতে এক বোতল গুড়ুচ্যাদি তৈল লইয়া বাহিরে যাইতেছিলেন, এমন সময়ে হলধর উপস্থিত হইয়া বলিল, রায় মহাশয় ! অনুগ্রহ করিয়া শীঘ্র আসুন –জমিদারবাবুর বাটিতে একটি বালকের ঘোরতর জ্বরবিকার হইয়াছে বোধ হয় রোগীর এখন তখন হইয়াছে তবে তাহার আয়ু ও আপনার হাতযশ –অনুমান হয় মাতব্বর মাতব্বর ঔষধ পড়িলে আরাম হইলেও হইতে পারে। যদি আপনি ভালো করিতে পারেন যথাযোগ্য পুরস্কার পাইবেন। এই কথা শুনিয়া কবিরাজ তাড়াতাড়ি করিয়া রোগীর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। যতগুলিন নববাবু নিকটে ছিল তাহারা বলিয়া উঠিল –আসতে আজ্ঞা হউক, আসতে আজ্ঞা হউক কবিরাজ মহাশয় ! আমাদিগকে বাঁচাউন –দোলগোবিন্দ দশ-পনের দিন পর্যন্ত জ্বরবিকারে বিছানায় পড়িয়া আছে –দাহ পিপাসা অতিশয় –রাত্রে নিদ্রা নাই –কেবল ছট্ফট করিতেছে, –মহাশয় এক ছিলিম তামাক খাইয়া ভালো করিয়া হাত দেখুন। ব্রজনাথ রায় প্রাচীন, পড়াশুনা বড়ো নাই –আপন ব্যবসায়ে ধামাধরা গোছ –দাদা যা বলেন তাইতেই মত –সুতরাং স্বয়ংসিদ্ধ নহেন, আপনি কেটে ছিঁড়ে কিছুই করিতে পারে না। রায় মহাশয়ের শরীর ক্ষীণ, দন্ত নাই, কথা জড়িয়া পড়ে, কিন্তু মুখের মধ্যে যথেষ্ট গোঁপ – গোঁপও পেকে গিয়াছে কিন্তু স্নেহপ্রযুক্ত কখনই ফেলিতেন না। রোগীর হাত দেখিয়া নিশ্বাস ত্যাগ করিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিলেন। হলধর জিজ্ঞাসা করিলেন – কবিরাজ মহাশয় যে চুপ করিয়া থাকিলেন? কবিরাজ উত্তর না দিয়া রোগীর প্রতি দৃষ্টি করিতে লাগিলেন, রোগীও এক একবার ফেল্ ফেল্ করিয়া চায় – এক একবার জিহ্বা বাহির করে –এক একবার দন্ত কড়মড় করে –এক একবার শ্বাসের টান দেখায় –এক একবার কবিরাজের গোঁপ ধরিয়া টানে। রায় মহাশয় সরে সরে বসেন, রোগী গড়িয়া গড়িয়া গিয়া তাহার তেলের বোতল লইয়া টানাটানি করে। ছোঁড়ারা জিজ্ঞাসা করিল –রায় মহাশয় ! এ কি ? তিনি বলিলেন –এ পীড়াটি ভয়ানক –বোধ হয় জ্বরবিকার ও উল্বণ হইয়াছে। পূর্বে সংবাদ পাইলে আরাম করিতে পারিতাম, এক্ষণে শিবের অসাধ্য। এই বলিতে বলিতে রোগী তেলের বোতল টানিয়া লইয়া এক গণ্ডুষ তৈল মাখিয়া ফেলিল। কবিরাজ দেখিলেন যে ছ-বুড়ির ফলে অমিত্তি হারাইতে হয়, এজন্য তাড়াতাড়ি বোতল লইয়া ভালো করিয়া ছিপি আঁটিয়া দিয়া উঠিলেন। সকলে বলিল –মহাশয় যান কোথায়? কবিরাজ কহিলেন –উল্বণ ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি হইতেছে বোধ হয়, এক্ষণে রোগীকে এ স্থানে রাখা আর কর্তব্য নহে –যাহাতে তাহার পরকাল ভালো হয় এমতো চেষ্টা করা উচিত। রোগী এই কথা শুনিয়া ধড়মড়িয়া উঠিল –কবিরাজ এই দেখিয়া চোঁ চোঁ করিয়া পিট্টান দিলেন –বৈদ্যবাটীর অবতারেরা সকলেই পশ্চাৎ পশ্চাৎ দৌড়ে যাইতে লাগিল –কবিরাজ কিছুদূর যাইয়া হতভোম্বা হইয়া থ্মকিয়া দাঁড়াইলেন –নববাবুরা কবিরাজকে গলাধাক্কা দিয়া ফেলিয়া ঘাড়ে করিয়া লইয়া হরিবোল শব্দ করিতে করিতে গঙ্গাতীরে আনিল। দোলগোবিন্দ নিকটে আসিয়া কহিল –কবিরাজ মামা ! আমাকে গঙ্গায় পাঠাইতে বিধি দিয়াছিলে –এক্ষণে রোজার ঘারে বোঝা –এসো বাবা ! এক্ষণে তোমাকে অন্তর্জলি করিয়া চিতায় ফেলি। খামখেয়ালী লোকের দণ্ডে দণ্ডে মত ফেরে, আবার কিছুকাল পরে বলিল –আর আমাকে গঙ্গায় পাঠাইবে? যাও বাবা ! ঘরের ছেলে ঘরে যাও, কিন্তু তেলের বোতলটা দিয়ে যাও। এই বলিয়া তেলের বোতল লইয়া সকলে রগরগে করিয়া তেল মাখিয়া ঝুপঝাপ করিয়া গঙ্গায় পড়িল। কবিরাজ এই সকল দেখিয়া শুনিয়া হতজ্ঞান হইলেন ! এক্ষণে পালাইতে পারিলেই বাঁচি, এই ভাবিয়া পা বাড়াইতেছেন –ইতিমধ্যে হলধর সাঁতার দিতে দিতে চিৎকার করিয়া বলিল –ওগো কবরেজ মামা ! বড়ো পিত্ত বৃদ্ধি হইয়াছে, পান দুই রসাসিন্ধু দিতে হবে –পালিও না। বাবা ! যদি পালাও তো মামীকে হাতের লোহা খুলিতে হবে। কবিরাজ ঔষধের ডিপেটা ছুঁড়িয়া ফেলিয়া বাপ বাপ করিতে করিতে বাসায় প্রস্থান করিলেন।
ফাল্গুন মাসে গাছপালা গজিয়ে উঠে ও ফুলের সৌগন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। বরদাবাবুর বাসাবাটী গঙ্গার ধারে –সম্মুখে একখানি আটচালা ও চতুষ্পার্শে বাগান। বরদাবাবু প্রতিদিন বৈকালে ঐ আটচালায় বসিয়া বায়ু সেবন করিতেন এবং নানা বিষয় ভাবিতেন ও আত্মীয় লোক উপস্থিত থাকিলে তাহাদিগের সহিত আলাপ করিতেন। রামলাল সর্বদা নিকটে থাকিত, তাহার সহিত বরদাবাবুর মনের কথা হইত। রামলাল এই প্রকারে অনেক উপদেশ পায় –সুযোগ পাইলেই কি কি উপায়ে পরমার্থ জ্ঞান ও চিত্তশোধন হইতে পারে তদ্বিষয়ে গুরুকে খুঁচিয়া খুঁচিয়া জিজ্ঞাসা করিত। একদিন রামলাল বলিল –মহাশয় ! আমার দেশ ভ্রমণ করিতে বড়ো ইচ্ছা যায় –বাটীতে থাকিয়া দাদার কুকথা ও ঠকচাচার কুমন্ত্রণা শুনিয়া তাক্ত হইয়াছি কিন্তু মা-বাপের ও ভগিনীর স্নেহপ্রযুক্ত বাড়ি ছেড়ে যাইতে পা বাধুবাধু করে কি করিব কিছুই স্থির করিতে পারি না।
বরদা। দেশ ভ্রমণে অনেক উপকার। দেশ ভ্রমণ না করিলে লোকের বহুদর্শিত্ব জন্মে না, নানা প্রকার দেশ নানা প্রকার লোক দেখিতে দেখিতে মন দরাজ হয়। ভিন্ন ভিন্ন স্থানের লোকদিগের কি প্রকার রীতি-নীতি, কিরূপ ব্যবহার ও কি কারণে তাহাদিগের ভালো অথবা মন্দ অবস্থা হইয়াছে তাহা খুঁটিয়া অনুসন্ধান করিলে অনেক উপদেশ পাওয়া যায়; আর নানা জাতীয় ব্যক্তির সহিত সহবাস হওয়াতে মনের দ্বেষভাব দূরে যাইয়া সদ্ভাব বাড়িতে থাকে। ঘরে বসিয়া পড়াশুনা করিলে কেতাবী বুদ্ধি হয় –পড়াশুনাও চাই –সৎলোকের সহবাসও চাই –বিষয়কর্মও চাই –নানা প্রকার লোকের সহিত আলাপও চাই। এই কয়েকটি কর্মের দ্বারা বুদ্ধি পরিষ্কার এবং সদ্ভাব বৃদ্ধিশীল হয় কিন্তু ভ্রমণ করিতে গিয়া কি কি বিষয়ে ভালো করিয়া অনুসন্ধান করিতে হইবে তাহা অগ্রে জানা আবশ্যক, তাহা না জানিয়া ভ্রমণ করা বলদের ন্যায় ঘুরিয়া বেড়ানো মাত্র। আমি এমন কথা বলি না যে এরূপ ভ্রমণ করাতে কিছুমাত্র উপকার নাই –আমার সে অভিপ্রায় নহে, ভ্রমণ করিলে কিছু না কিছু উপকার অবশ্যই আছে কিন্তু যে ব্যক্তি ভ্রমণকালে কি কি অনুসন্ধান করিতে হয় তাহা না জানে ও সেই সকল অনুসন্ধান করিতে না পারে তাহার ভ্রমণের পরিশ্রম সর্বাংশে সফল হয় না। বাঙালীদিগের মধ্যে অনেকে এ দেশ হইতে ও দেশে গিয়া থাকেন কিন্তু ঐ সকল দেশ সংক্রান্ত আসল কথা জিজ্ঞাসা করিলে কয়জন উত্তমরূপে উত্তর করিতে পারে ? এ দোষটি বড়ো তাহাদিগের নহে –এটি তাহাদিগের শিক্ষার দোষ। দেখাশুনা, অন্বেষণ ও বিবেচনা করিতে না শিখিলে একবারে আকাশ থেকে ভালো বুদ্ধি পাওয়া যায় না। শিশুদিগকে এমতো তরিবত দিতে হইবে যে তাহারা প্রথমে নানা বস্তুর নক্সা দেখিতে পায় –সকল তসবির দেখিতে দেখিতে একটার সহিত আর একটার তুলনা করিবে অর্থাৎ এর হাত আছে, ওর পা নাই, এর মুখ এমন, ওর লেজ নাই, এইরূপ তুলনা করিলে দর্শনশক্তি ও বিবেচনাশক্তি দুয়েরই চালনা হইতে থাকিবে। কিছুকাল পরে এইরূপ তুলনা করা আপনা-আপনি সহজ বোধ হইবে তখন নানা বস্তু কি কারণে পরস্পর ভিন্ন হইয়াছে তাহা বিবেচনা করিতে পারিবে, তাহার পরে কোন্ কোন্ শ্রেণীতে আসিতে পারে তাহা অনায়াসে বোধগম্য হইবে। এই প্রকার উপদেশ দিতে দিতে অনুসন্ধান করণের অভ্যাস ও বিবেচনাশক্তির চালনা হয়। কিন্তু এরূপ শিক্ষা এদেশে প্রায় হয় না এজন্য আমাদিগের বুদ্ধি গোলমেলে ও ভাসা ভাসা হইয়া পড়ে –কোনো প্রস্তাব উপস্থিত হইলে কোন্ কথাটা বা সার ও কোন্ কথাটা বা অসার তাহা শীঘ্র বোধগম্য হয় না ও কিরূপ অনুসন্ধান করিলে প্রস্তাবের বিবেচনা হইয়া ভালো মীমাংসা হইতে পারে তাহাও অনেকের বুদ্ধিতে আসে না অতএব অনেকের ভ্রমণ যে মিথ্যা ভ্রমণ হয় এ কথা অলীক নহে কিন্তু তোমার যে প্রকার শিক্ষা হইয়াছে তাহাতে বোধ হয় ভ্রমণ করিলে তোমার অনেক উপকার দর্শিবে।
রামলাল। যদি বিদেশে যাই তবে যে স্থানে বসতি আছে সেই সেই স্থানে কিছুকাল অবস্থিতি করিতে হইবে কিন্তু আমি কোন্ জাতীয় ও কি প্রকার লোকের সহিত অধিক সহবাস করিব ?
বরদা। এ কথাটি বড়ো সহজ নহে –ঠাওরিয়া উত্তর দিতে হবে। সকল জাতিতেই ভালো-মন্দ লোক আছে–ভালো লোক পাইলেই তাহার সহিত সহবাস করিবে। ভালো লোকের লক্ষণ তুমি বেশ জানো, পুনরায় বলা অনাবশ্যক। ইংরেজদিগের নিকটে থাকিলে লোকে সাহসী হয় –তাহারা সাহসকে পূজা করে –যে ইংরাজ অসাহসিক কর্ম করে সে ভদ্রসমাজে যাইতে পারে না কিন্তু সাহসী হইলে যে সর্বপ্রকারে ধার্মিক হয় এমতো নহে –সাহস সকলের বড়ো আবশ্যক বটে কিন্তু যে সাহস ধর্ম জ্ঞান হইতে উৎপন্ন হয় সেই সাহসই সাহস –তোমাকে পূর্বেই বলিয়াছি ও এখনও বলিতেছি সর্বদা পরমার্থ চর্চা করিবে নতুবা যাহা দেখিবে –যাহা শুনিবে –যাহা শিখিবে তাহাতেই অহংকার বৃদ্ধি হইবে। আর মনুষ্য যাহা দেখে তাহাই করিতে ইচ্ছা হয়, বিশেষতঃ বাঙালীরা সাহেবদিগের সহবাসে অনেক ফাল্তো সাহেবানি শিখিয়া অভিমানে ভরে যায় ও যে-কিছু কর্ম করে তাহা অহংকার হইতেই করিয়া থাকে –এ কথাটিও স্মরণ থাকিলে ক্ষতি নাই।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে বাগানের পশ্চিম দিক থেকে জনকয়েক পিয়াদা হন্ হন্ করিয়া আসিয়া বরদাবাবুকে ঘিরিয়া ফেলিল –বরদাবাবু তাহাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন –তোমরা কে? তাহারা উত্তর করিল –আমরা পুলিশের লোক –আপনার নামে গোমখুনির নালিশ হইয়াছে –আপনাকে হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের আদালতে যাইয়া জবাব দিতে হইবে আর আমরা এখানে গোমতল্লাশ করিব। এই কথা শুনিবামাত্রে রামলাল দাঁড়াইয়া উঠিল ও পরওয়ানা পড়িয়া মিথ্যা নালিশ জন্য রাগে কাঁপিতে লাগিল। বরদাবাবু তাহার হাতে ধরিয়া বসাইলেন এবং বলিলেন –ব্যস্ত হইও না, বিষয়টা তলিয়ে দেখা যাউক –পৃথিবীতে নানাপ্রকার উৎপাত ঘটিয়া থাকে। আপদ্ উপস্থিত হইলে কোনোমতে অস্থির হওয়া কর্তব্য নহে–বিপদকালে চঞ্চল হওয়া নির্বুদ্ধির কর্ম, আর আমার উপর যে দোষ হইয়াছে তাহা মনে বেশ জানি যে আমি করি নাই –তবে আমার ভয় কি? কিন্তু আদালতের হুকুম অবশ্য মানিতে হইবে এজন্য সেখানে শীঘ্র হাজির হইব। এক্ষণে পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করুক ও দেখুক যে আমি কাহাকেও লুকাইয়ে রাখি নাই। আদেশ পাইয়া পেয়াদারা চারিদিকে তল্লাশ করিল কিন্তু গুমি পাইল না।
অনন্তর বরদাবাবু নৌকা আনাইয়া হুগলী যাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিলেন, ইতিমধ্যে বালীর বেণীবাবু দৈবাৎ আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে ও রামলালকে সঙ্গে করিয়া বরদাবাবু হুগলীতে গমন করিলেন। বেণীবাবু ও রামলাল কিঞ্চিৎ চিন্তাযুক্ত হইয়া থাকিলেন কিন্তু বরদাবাবু সহাস্যবদনে নানা-প্রকার কথাবার্তায় তাহদিগকে সুস্থির করিতে লাগিলেন।
১৫.
হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বর্ণন, বারদাবাবু, রামলাল ও বেণীবাবুর সহিত ঠকচাচার সাক্ষাৎ, সাহেবের আগমন ও তজবিজ আরম্ভ এবং বরদাবাবুর খালাস।
হুগলীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি বড়ো সরগরম। আসামী, ফৈরাদি, সাক্ষী, কয়েদী, উকল ও আমলা সকলেই উপস্থিত আছে, সাহেব কখন আসিবে —সাহেব কখন আসিবে বলিয়া অনেকে টো টো করিয়া ফিরিতেছে, কিন্তু সাহেবের দেখা নাই। বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একটি গাছের নীচে কম্বল পাতিয়া বসিয়া আছেন। তাঁহার নিকট দুই একজন আমলা-ফয়লা আসিয়া ঠারে ঠোরে চুক্তির কথা কহিতেছে, কিন্তু বরদাবাবু তাহাতে ঘাড় পাতেন। তাঁহাকে ভয় দেখাইবার জন্য তাহারা বলিতেছে —সাহেবের হুকুম বড়ো কড়া —কর্মকাজ সকলই আমাদিগের হাতের ভিতর —আমরা যা মনে করি তাহাই করিতে পারি —জবানবন্দি করানো আমাদিগের কর্ম —কলমের মারপেঁচে সকলই উলটে দিতে পারি, কিন্তু রুধির চাই —তদ্বির করতে হয় তো এই সময় করা কর্তব্য, একটা হুকুম হইয়া গেলে আমাদিগের ভালো করা অসাধ্য হইবে। এই সকল কথা শুনিয়া রামলালের এক একবার ভয় হইতেছে কিন্তু বরদাবাবু অকুতোভয়ে বলিতেছেন—আপনাদিগের যাহা কর্তব্য তাহাই করিবেন, আমি কখনই ঘুষ দিব না, আমি নির্দোষ —আমার কিছুই ভয় নাই। আমলারা বিরক্ত হইয়া আপন আপন স্থানে চলিয়া গেল। দুই একজন উকিল বরদাবাবুর নিকটে আসিয়া বলিল —দেখিতেছি মহাশয় অতি ভদ্রলোক —অবশ্য কোনো দায়ে পড়িয়াছেন, কিন্তু মকদ্দমাটি যেন বেতদ্বিরে যায় না —যদি সাক্ষীর যোগাড় করিতে চাহেন এখান হইতে করিয়া দিতে পারি, কিঞ্চিৎ ব্যয় করিলেই সকল সুযোগ হইতে পারে। সাহেব এল এল হইয়াছে, যাহা করিতে হয় এই বেলা করুন। বরদাবাবু উত্তর করিলেন —আপনাদিগের বিস্তর অনুগ্রহ কিন্তু আমাকে বেড়ি পরিতে হয় তাহাও পরিব—তাহাতে আমার ক্লেশ হইবে না —অপমান হইবে বটে, সে অপমান স্বীকার করতে প্রস্তুত আছি —কিন্তু প্রাণ গেলেও মিথ্যা পথে যাইব না। ঈস্ ! মহাশয় যে সত্য যুগের মানুষ —বোধ হয় রাজা যুধিষ্ঠির মরিয়া জন্মিয়াছেন —না ? এইরূপ ব্যঙ্গ করিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে তাহারা চলিয়া গেল।
এই প্রকারে দুটো বাজিয়া গেল —সাহেবের দেখা নাই, সকলেই তীর্থের কাকের ন্যায় চাহিয়া আছে। কেহ কেহ একজন আচার্য ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞাসা করিতেছে—অহে ! গণে বলো দেখি সাহেব আসিবেন কি-না ? অমনি আচার্য বলিতেছেন —একটা ফুলের নাম করো দেখি ? কেহ বলে জবা —আচার্য আঙুলে গনিয়া বলিতেছেন —না, আজ সাহেব আসিবেন না —বাটীতে কর্ম আছে। আচার্যের কথায় বিশ্বাস করিয়া সকলে দপ্তর বাঁধিতে উদ্যত হইল ও বলিয়া উঠিল —রাম বাঁচলুম। বাসায় গিয়া চদ্দপ্যে হওয়া যাউক। ঠকচাচা ভিড়ের ভিতর বসিয়াছিল, জন চারেক লোক সঙ্গে —বগলে একটা কাগজের পোঁটলা —মুখে কাপড়, —চোখ দুটি মিট মিট করিতেছে। দাড়িটি ঝুলিয়া পরিয়াছে, ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়া যাইতেছে। এমতো সময় তাহার উপর রামলালের নজর পড়িল। রামলাল অমনি বরদা ও বেণীবাবুকে বলিল —দেখুন দেখুন ঠকচাচা এখানে আসিয়াছে —বোধ হয় ও এই মকদ্দমার জড় —না হলে আমাকে দেখিয়া মুখ ফেরায় কেন ? বরদাবাবু মুখ তুলিয়া দেখিয়া উত্তর করিলেন —এ কথাটি আমারও মনে লাগে —আমাদিগের দিকে আড়ে আড়ে চায় আবার চোখের উপর চোখ পরিলে ঘাড় ফিরিয়া অন্যের সহিত কথা কয় —বোধ হয় ঠকচাচাই সরষের ভিতর ভূত। বেণীবাবুর সদা হাস্য বদন —রহস্য দ্বারা অনেক অনুসন্ধান করেন। চুপ করিয়া না থাকিতে পারিয়া ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া চিৎকার করিয়া ডাকিতে লাগিলেন। পাঁচ-সাত ডাক তো ফাওয়ে গেল —ঠকচাচা বগল থেকে কাগজ খুলিয়া দেখিতেছে —বড়ো ব্যস্ত —শুনেও শুনে না —ঘাড়ও তোলে না। বেণীবাবু তাহার নিকটে আসিয়া হাত ঠেলিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন —ব্যাপারটা কি? তুমি এখানে কেন? ঠকচাচা কথাই কন না, কাগজ উল্টে-পাল্টে দেখিতেছেন —এদিকে যমলজ্জা উপস্থিত —কিন্তু বেণীবাবুকেও টেলে দিতে হইবে, তাঁহার কথায় উত্তর না দিয়ে বলিল —বাবু ! দরিয়ার বড়ো মৌজ হইয়াছে —এজ তোমরা কি সুরতে যাবে? ভালো, তা যা হউক তুমি এখানে কেন? আরে ঐ বাতই মোকে বার বার পুচ করো কেন? মোর বহুত কাম, থোড়া ঘড়ি বাদ মুই তোমার সাতে বাত করব —আমি জেরা ফিরে এসি, এই বলিয়া ঠকচাচা ধাঁ করিয়া সরিয়া গিয়া একজন লোকের সঙ্গে ফাল্ত কথায় ব্যস্ত হইল।
তিনটা বাজিয়া গেল —সকল লোকে ঘুরে-ফিরে ত্যক্ত হইল, মফস্বলে কর্মের নিকাশ নাই —আদালতে হেঁটে হেঁটে লোকের প্রাণ যায়। কাছারি ভাঙো ভাঙো হইয়াছে এমতো সময়ে ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ীর গড় গড় শব্দ হইতে লাগিল, অমনি সকলে চিৎকার করিয়া উঠিল —সাহেব আস্ছেন আস্ছেন। আচার্যের মুখ শুকাইয়া গেল —দুই-একজন লোক বলিল —মহাশয়ের চমৎকার গণনা —আচার্য কহিলেন, আজ কিঞ্চিৎ রুক্ষ সামগ্রী খাইয়াছিলাম এই জন্য গণনায় ব্যতিক্রম হইয়াছে। আমলা-ফয়লারা স্ব স্ব স্থানে দাঁড়াইল। সাহেব কাছারি প্রবেশ করিবামাত্রেই সকলে জমি পর্যন্ত ঘাড় হেঁট করিয়া সেলাম বাজাইল। সাহেব শিস্ দিতে দিতে বেঞ্চের উপর বসিলেন —হুক্কাবরদার আলবলা আনিয়া দিল —তিনি মেজের উপর দুই পা তুলিয়া চৌকিতে শুইয়া পড়িয়া আলবলা টনিতেছেন ও লেবগুব ওয়াটার মাখানো হাতরুমাল বাহির করিয়া মুখ পুঁচিতেছেন। নাজিরদপ্তর লোকে ভারিয়া গেল —জবানবন্দিনবিস্ হন্ হন্ করিয়া জবানবন্দি লিখিতেছে কিন্তু যাহার কড়ি তাহার জয় —সেরেস্তাদার জোড়া গায়ে, খিরকিদার পাগড়ি মাথায়, রাশি রাশি মিছিল লইয়া সাহেবের নিকট গায়েনের সুরে পড়িতেছে, সাহেব খবরের কাগজ দেখিতেছেন ও আপনার দরকারি চিঠিও লিখিতেছেন, এক একটা মিছিল পড়া হলেই জিজ্ঞাসা করেন —ওয়েল কেয়া হোয়া ? সেরেস্তাদারের যেমন ইচ্ছা তেমনি করিয়া বুঝান ও সেরেস্তাদারের যে রায় সাহেবেরও সেই রায়।
বরদাবাবু বেণীবাবু ও রামলালকে লইয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন। যেরূপ বিচার হইতেছে তাহা দেখিয়া তাঁহার জ্ঞান হত হইল। জবানবন্দিনবিসের নিকট তাঁহার মকদ্দমার যেরূপ জবানবন্দি হইয়াছে তাহাতে তাঁহার কিছুমাত্র মঙ্গল হইবার সম্ভাবনা নাই —সেরেস্তাদার যে আনুকূল্য করে তাহাও অসম্ভব, এক্ষণে অনাথার দৈব সখা। এই সকল মনোমধ্যে ভাবিতেছেন ইতিমধ্যে তাঁহার মকদ্দমা ডাক হইল। ঠকচাচা অন্তরে বসিয়াছিল, অমনি বুক ফুলাইয়া সাক্ষীদিগকে সঙ্গে করিয়া সাহেবের সম্মুখে দাঁড়াইল। মিছিলের কাগজাত পড়া হইলে সেরেস্তাদার বলিল, খোদাওয়ান্দ ! গোমখুনি সাফ সাবুদ হুয়া —ঠকচাচা অমনি গোঁপে চাড়া দিয়া বরদাবাবুর প্রতি কট্মট্ করিয়া দেখিতে লাগিল, মনে করিতেছে এতক্ষণের পর কর্ম কেয়াল হইল। মিছিল পড়া হইলে অন্যান্য মকদ্দমায় আসামীদের কিছুই জিজ্ঞাসা হয় না —তাহাদিগের প্রায় ছাগল বলিদানের ব্যাপারই হইয়া থাকে, কিন্তু হুকুম দেখার অগ্রে দৈবাৎ বরদাবাবুর উপর সাহেবের দৃষ্টিপাত হওয়াতে তিনি সম্মানপূর্বক মকদ্দমার সমস্ত সরেওয়ার সাহেবকে ইংরেজীতে বুঝাইয়া দিলেন ও বলিলেন যে-ব্যক্তিকে গোমখুনি সাজান হইয়াছে তাহাকে আমি কখনই দেখি নাই ও যৎকালীন হুজুরি পেয়াদারা আমার বাটী তল্লাশ করে তখন তাহারা ঐ লোককে পায় নাই, সেই সময় বেণীবাবু ও রামলাল ছিলেন, যদ্যপি ইহাদিগের সাক্ষ্য অনুগ্রহ করিয়া লয়েন তবে আমি যাহা এজেহার করিতেছি তাহা প্রমাণ হইবে। বরদাবাবুর ভদ্র চেহারায় ও সৎ বিবেচনার কথাবার্তায় সাহেবের অনুসন্ধান করিতে ইচ্ছা হইল —ঠকচাচা সেরেস্তাদারের সহিত অনেক ইশারা করিতেছে কিন্তু সেরেস্তাদার ভজকট দেখিয়া ভাবিতেছে পাছে টাকা উগরিয়া দিতে হয়, অতএব সাহেবের নিকটে ভয় ত্যাগ করিয়া বলিল —হুজুর এ মকদ্দমা আয়ৌর শুন্নেকা জরুর নেহি। সাহেব সেরেস্তাদারের কথায় পেছিয়া পড়িয়া দাঁত দিয়া হাতের নখ কাটিতেছেন ও ভাবিতেছেন—এই অবসরে বরদাবাবু আপন মকদ্দমার আসল কথা আস্তে আস্তে একটি একটি করিয়া পুর্নবার বুঝাইয়া দিলেন, সাহেব তাহা শুনিবামাত্রেই বেণীবাবুর ও রামলালের সাক্ষ্য লইলেন ও তাহাদিগের জবানবন্দিতে নালিশ সম্পূর্ণরূপে মিথ্যা প্রকাশ হইয়া ডিস্মিস্ হইল। হুকুম না হইতে হইতে ঠকচাচা চোঁ করিয়া এক দৌড় মারিল। বরদাবাবু ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে সেলাম করিয়া আদালতের বাহিরে আসিলেন। কাছারি বরখাস্ত হইলে যাবতীয় লোক তাঁহাকে প্রশাংসা করিতে লাগিল, তিনি সে সব কথায় কান না দিয়া ও মকদ্দমা জিতের দরুন পুলকিত না হইয়া বেণীবাবু ও রামলালের হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে নৌকায় উঠিলেন।
১৬.
ঠকচাচার বাটীতে ঠকচাচীর নিকট পরিচয় দান ও তাহাদিগের কথোপকথন, তন্মধ্যে বাবুরামবাবুর ডাক ও তাঁহার সহিত বিষয় রক্ষার পরামর্শ।
ঠকচাচার বাড়িটি শহরের প্রান্তভাগে ছিল— দুই পার্শ্বে নানা পুষ্করিণী, সম্মুখে একটি পীরের আস্তানা। বাটীর ভিতরে ধানের গোলা, উঠানে হাঁস, মুরগী দিবারাত্রি চরিয়া বেড়াইত। প্রাতঃকাল না হইতে হইতে নানা প্রকার বদমায়েশ লোক ঐ স্থানে পিল পিল করিয়া আসিত। কর্ম লইবার জন্য ঠকচাচা বহুরূপী হইতেন—কখন নরম—কখন গরম—কখন হাসিতেন—কখন মুখ ভারি করিতেন—কখন ধর্ম দেখাইতেন—কখন বল জানাইতেন। কাজকর্ম শেষ হইলে গোসল ও খানা খাইয়া বিবির নিকট বসিয়া বিদ্রির গুড়গুড়িতে ভড়র ভড়র তাঁমাক টানিতেন। সেই সময়ে তাঁহাদের স্ত্রী-পুরুষের সকল দুঃখ-সুখের কথা হইত। ঠকচাচী পাড়ার মেয়ে মহলে বড়ো মান্যা ছিলেন—তাহাদিগের সংস্কার ছিল যে তিনি তন্ত্রমন্ত্র, গুণকরণ, বশীকরণ, মারণ-উচ্চাটন, তুকতাক, জাদু, ভেল্কি ও নানা প্রকার দৈব বিদ্যা ভালো জানেন, এই কারণ নানারকম স্ত্রীলোক আসিয়া সর্বদাই ফুস-ফাস করিত। যেমন দেবা তেমনী দেবী—ঠকচাচা ও ঠকচাচী দু-জনেই রাজযোটক—স্বামী বুদ্ধির জোরে রোজগার করে, স্ত্রী বিদ্যার বলে উপার্জন করে। যে স্ত্রীলোক স্বয়ং উপার্জন করে তাহার একটু একটু গুমর হয়, তাহার নিকট স্বামীর নির্জলা মান পাওয়া ভার, এই জন্যে ঠকচাচাকে মধ্যে মধ্যে দুই-একবার মুখঝাম্টা খাইতে হইত। ঠকচাচী মোড়ার উপর বসিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছেন— তুমি হর রোজ এখানে ওখানে ফিরে বেড়াও —তাতে মোর আর লেড়কাবালার কি ফয়দা? তুমি হর ঘড়ি বলো যে বহুত কাম, এতনা বাতে কি মোদের পেটের জ্বালা যায়। মোর দেল বড়ো চায় যে জরি জর পিনে দশজন ভালো ভালো রেন্ডির বিচে ফিরি, লেকেন রোপেয়া কড়ি কছুই দেখি না, তুমি দেয়ানার মতো ফের—চুপচাপ মেরে হাবিলিতে বসেই রই। ঠকচাচা কিঞ্চিৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন—আমি যে কোশেশ করি তা কি বলব, মোর কেত্না ফিকির-কেত্না ফন্দি—কেত্না প্যাঁচ—কেত্না শেস্ত তা জবানিতে বলা যায় না, শিকার দন্তে এল এল হয় আবার পেলিয়ে যায়। আলবত শিকার জল্দি এসবে এই কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে এক জনা বাঁদী আসিয়া বলিল—বাবুরামবাবুর বাটী হইতে একজন লোক ডাকতে আসিয়াছে। ঠকচাচা অমনি স্ত্রীর পানে চেয়ে বলিল—দেখ্চ মোকে বাবু হরঘড়ি ডাকে—মোর বাত না হলে কোনো কাম করে না। মুইও ওক্ত বুঝে হাত মারবো।
বাবুরামবাবুর বৈঠকখানা বসিয়া আছেন। নিকটে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবু, বালীর বেণীবাবু ও বৌবাজারের বেচারামবাবু বসিয়া গল্প করিতেছেন। ঠকচাচা গিয়া পালের গোদা হইয়া বসিলেন।
বাবুরাম। ঠকচাচা ! তুমি এলে ভালো হল—লেটা তো কোনো রকমে মিট্চে না —মকদ্দমা করে করে কেবল পালকে জোলকে জড়িয়ে পড়ছি—এক্ষণে বিষয়-আশয় রক্ষা করবার উপায় কি ?
ঠকচাচা। মরদের কামই দরবার করা —মকদ্দমা জিত হলে আফদ দফা হবে। তুমি একটুতে ডর করো কেন ?
বেচারাম। আ মরি ! কী মন্ত্রণাই দিতেছ? তোমা হতেই বাবুরামের সর্বনাশ হবে তার কিছুমাত্র সন্দেহ নাই—কেমন বেণী ভায়া কি বলো ?
বেণী। আমার মতে খানকে দু-খানা বিষয় বিক্রয় করিয়া দেনা পরিশোধ করা ও ব্যয় অধিক না হয় এমন বন্দোবস্ত করা আবশ্যক আর মকদ্দমা বুঝে পরিষ্কার করা কর্তব্য কিন্তু আমাদিগের কেবল বাঁশবনে রোদন করা—ঠকচাচা যা বলবেন সেই কথাই কথা।
ঠকচাচা। মুই বুক ঠুকে বলছি যেত্না মামলা মোর মারফত হচ্ছে সে সব বেলকুল ফতে হবে —আফদ বেলকুল মুই কেটিয়ে দিব—মরদ হইলে লড়াই চাই—তাতে ডর কি ?
বেচারাম। ঠকচাচা। তুমি বরাবর বীরত্ব প্রকাশ করিয়াছ। নৌকাডুবির সময়ে তোমার কুদরৎ দেখা গিয়াছে। বিবাহের সময় তোমার জন্যেই আমাদিগের এত কর্মভোগ, বরদাবাবুর উপর মিথ্যা নালিশ করিয়াও বড়ো বাহাদুরি করিয়াছ আর বাবুরামের যে যে কর্মে হাত দিয়াছ সেই সেই কর্ম বিলক্ষণই প্রতুল হইয়াছে। তোমার খুরে দণ্ডবৎ। তোমার সংক্রান্ত সকল কথা স্মরণ করিলে রাগ উপস্থিত হয়—তোমাকে আর কি বলি ? দূঁর দূঁর !! বেণী ভায়া উঠ এখানে আর বসিতে ইচ্ছা করে না।
১৭.
নাপিত ও নাপ্তিনীর কথোপকথন, বাবুরামবাবুর দ্বিতীয় বিবাহকরণের বিচার ও পরে গমন।
বৃষ্টি খুব এক পশলা হইয়া গিয়াছে —পথঘাট পেঁচ পেঁচ সেঁত সেঁত করিতেছে —আকাশ নীল মেঘে ভরা —মধ্যে মধ্যে হড় মড় হড় মড় শব্দ হইতেছে, বেঙগুলা আশে-পাশে যাঁওকো যাঁওকো করিয়া ডাকিতেছে। দোকানী পসারীরা ঝাপ খুলিয়া তামাক খাইতেছে —বাদলার জন্যে লোকের গমনাগমন প্রায় বন্ধ —কেবল গাড়োয়ান চিৎকার করিয়া গাইতে গাইতে যাইতেছে ও দাসো কাঁদে ভার লইয়া “হ্যাংগো বিসখা সে যিবে মাথুরা” গানে মত্ত হইয়া চলিয়াছে। বৈদ্যবাটীর বাজারের পশ্চিমে কয়েক ঘর নাপিত বাস করিত। তাহাদিগের মধ্যে একজন বৃষ্টি জন্যে আপন দাওয়াতে বসিয়া আছে। এক একবার আকাশের দিকে দেখিতেছে ও এক একবার গুন গুন করিতেছে, তাহার স্ত্রী কোলের ছেলেটিকে আনিয়া বলিল —ঘর-কন্নার কর্ম কিছু থা পাইনে —হেদে ! ছেলেটাকে একবার কাঁকে কর —এদিকে বাসন মাজা হয়নি, ওদিকে ঘর নিকোনো হয়নি, তার পর রাঁদা বাড়া আছে —আমি একলা মেয়েমানুষ এসব কি করে করব আর কোন্ দিগে যাব ? —আমার কি চাট্টে হাত চাট্টে পা? নাপিত অমনি ক্ষুর ভাড় বগল দাবায় করিয়া উঠিয়া বলিল —এখন ছেলে কোলে করবার সময় নয় —কাল বাবুরামবাবুর বিয়ে, আমাকে এক্ষুণি যেতে হবে। নাপ্তিনী চমকিয়া উঠিয়া বলিল —ও মা আমি কোজ্জাব ? বুড়ো ঢোস্কা আবার বে করবে। আহা ! ওমন গিন্নী —এমন সতী লক্ষ্মী —তার গলায় আবার একটা সতীন গেঁতে দেবে —মরণ আর কি ! ও মা পুরুষ জাত সব করতে পারে ! নাপিত আশাবায়ুতে মুগ্ধ হইয়াছে —ও সব কথা না শুনিয়া একটা টোকা মাথায় দিয়া সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়া গেল।
সে দিবসটি ঘোর বাদলে গেল। পর দিবস প্রভাতে সূর্য প্রকাশ হইল —যেমন অন্ধকার ঘরে অগ্নি ঢাকা থাকিয়া হঠাৎ প্রকাশ হইলে আগুনের তেজ অধিক বোধ হয় তেমনি দিনকরের কিরণ প্রখর হইতে লাগিল —গাছপালা সকলই যেন পুনর্জীবন পাইল ও মাঠে-বাগানে পশু-পক্ষীর ধ্বনি প্রতিধ্বনি হইতে লাগিল। বৈদ্যবাটীর ঘাটে মেলা নৌকা ছিল। বাবুরামবাবু, ঠকচাচা, বক্রেশ্বর, বাঞ্ছারাম ও পাকসিক লোকজন লইয়া নৌকায় উঠিয়াছেন এমতো সময়ে বেণীবাবু ও বেচারামবাবু আসিয়া উপস্থিত। ঠকচাচা তাহাদিগকে দেখেও দেখেন না —কেবল চিৎকার করিতেছেন —লা খোল দেও। মাঝিরা তকরার করিতেছে —আরে কর্তা অখন বাটা মরি নি গো —মোরা কি লগি ঠেলে, গুণ টেনে যাতি পারবো ? বাবুরামবাবু উক্ত দুইজন আত্মীয়কে পাইয়া বলিলেন —তোমরা এলে হল ভালো, এসো সকলেই যাওয়া যাউক।
বেচারাম। বাবুরাম ! এ বুড়ো বয়সে বে করতে তোমাকে কে পরামর্শ দিল?
বাবুরাম। বেচারাম দাদা। আমি এমন বুড়ো কি ? তোমার চেয়ে আমি অনেক ছোট, তবে যদি বলো আমার চুল পেকেছে ও দাঁত পড়েছে —তা অনেকের অল্প বয়সেও হইয়া থাকে। সেটা বড় ধর্তব্য নয়। আমাকে এদিক্ ওদিক সব দিগেই দেখিতে হয়। দেখো একটা ছেলে বয়ে গিয়েছে আর একটা পাগল হয়েছে —একটি মেয়ে গত আর একটি প্রায় বিধবা। যদি এ পক্ষে দুই-একটি সন্তান হয় তো বংশটি রক্ষে হবে। আর বড়ো অনুরোধে পড়িয়াছি —আমি বে না করলে কনের বাপের জাত যায় —তাহাদিগের আর ঘর নাই।
বক্রেশ্বর। তা বটে তো —কর্তা কি সকল না বিবেচনা করে এ কর্মে প্রবর্ত হইয়াছেন। উঁহার চেয়ে বুদ্ধি ধরে কে ?
বাঞ্ছারাম। আমরা কুলীন মানুষ —আমাদিগের প্রাণ দিয়ে কুল রক্ষা করিতে হয়, আর যে স্থলে অর্থের অনুরোধ সে স্থলে তো কোনো কথাই নাই।
বেচারাম। তোমার কুলের মুখেও ছাই —আর তোমার অর্থের মুখেও ছাই —জন কতক লোক মিলে একটা ঘরকে উচ্ছন্ন দিলে, দূঁর দূঁর ! কেমন বেণী ভায়া কি বলো ?
বেণী। আমি কি বলব ? আমাদিগের কেবল অরণ্যে রোদন করা। ফলে এ বিষয়টিতে বড়ো দুঃখ হইতেছে। এক স্ত্রী সত্ত্বে অন্য স্ত্রীকে বিবাহ করা ঘোর পাপ। যে ব্যক্তি আপন ধর্ম বজায় রাখিতে চাহে সে এ কর্ম কখনই করিতে পারে না। যদ্যপি ইহার উল্টো কোনো শাস্ত্র থাকে সে শাস্ত্রমতে চলা কখনই কর্তব্য নহে। সে শাস্ত্র যে যথার্থ শাস্ত্র নহে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই, যদ্যপি এমন শাস্ত্রমতে চলা যায় তবে বিবাহের বন্ধন অতিশয় দুর্বল হইয়া পড়ে। স্ত্রীর মন পুরুষের প্রতি তাদৃশ থাকে না ও পুরুষের মন স্ত্রীর প্রতিও চল-বিচল হয়। এরূপ উৎপাত ঘটিলে সংসার সুধারা মতে চলিতে পারে না, এজন্য শাস্ত্রে বিধি থকলেও সে বিধি অগ্রাহ্য। সে যাহা হউক —বাবুরামবাবুর এমন স্ত্রী সত্ত্বে পুনরায় বিবাহ করা বড়ো কুকর্ম —আমি এ কথার বাষ্পও জানি না —এখন শুনিলাম।
ঠকচাচা। কেতাবীবাবু সব বাতেতেই ঠোকর মারেন। মালুম হয় এনার দুসরা কোই কাম-কাজ নাই। মোর ওমর বহুত হল —নূর বি পেকে গেল —মুই ছোকরাদের সাত হর ঘড়ি তকরার কি করব ? কেতাবীবাবু কি জানেন এ শাদীতে কেতনা রোপেয়া ঘর ঢুকবে ?
বেচারাম। আরে আবাগের বেটা ভূত ! কেবল টাকাই চিনেছিস্ আর কি অন্য কোনো কথা নাই? তুই বড়ো পাপিষ্ঠ —তোকে আর কি বলবো —দূঁর দূঁর ! বেণী ভায়া চলো আমরা যাই।
ঠকচাচা। বাতচিত পিচু হবে —মোরা আর সবুর করতে পারিনে। হাবলি যেতে হয় তো তোমরা জল্দি যাও।
বেচারাম বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিয়া বলিলেন —এমন বিবাহে আমরা প্রাণ থাকিতেও যাব না কিন্তু যদি ধর্ম থাকে তবে তুই যেন আস্তো ফিরে আসিস্নে। তোর মন্ত্রণায় সর্বনাশ হবে —বাবুরামের স্কন্ধে ভালো ভোগ করছিস্ —আর তোকে কি বলব ? দূঁর দূঁর !!!
১৮.
মতিলালের দলবল সুদ্ধ বুড়ো মজুমদারের সহিত সাক্ষাৎ ও তাহার প্রমুখাৎ বাবুরামবাবুর দ্বিতীয় বিবহের বিবরণ ও তদ্বিষয়ে কবিতা।
সূর্য অস্ত হইতেছে — পশ্চিমদিকে আকাশ নানা রঙ্গে শোভিত। জলে-স্থলে দিবাকরের চঞ্চল আভা মৃদু মৃদু হাসিতেছে, — বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে। এমতো সময়ে বাহিরে যাইতে কার না ইচ্ছা হয়? বৈদ্যবাটীর সরে রাস্তায় কয়েকজন বাবু ভেয়ে হো হো মার মার ধর ধর শব্দে চলিতেছে — কেহ কাহার ঘাড়ের উপর পড়িয়াছে — কেহ কাহার ঝাঁকা ফেলিয়া দিতেছে — কেহ কাহার খাদ্যদ্রব্য কাড়িয়া লইতেছে — কেহ বা লম্বা সুরে গান হাঁকিয়া দিতেছে — কেহ বা কুকুর ডাক ডাকিতেছে। রাস্তার দোধারি লোক পালাই পালাই ত্রাহি করিতেছে — সকলেই ভয়ে জড়সড় ও কেঁচো — মনে করিতেছে আজ বাঁচলে অনেকদিন বাঁচবো। যেমন ঝড় চারিদিগে তোল্পাড় করিয়া হু হু শব্দে বেগে বয়, নব বাবুদিগের দঙ্গল সেইমতো চলিয়াছে। এ গুণ পুরুষেরা কে ? আর কে ! এঁরা সেই সকল পুণ্যশ্লোক — এঁরা মতিলাল, হলধর, গদাধর, রামগোবিন্দ, দোলগোবিন্দ, মানগোবিন্দ ও অন্যান্য দ্বিতীয় নলরাজা ও যুধিষ্ঠির। কোনো দিকে দৃক্পাত নেই — একেবারে ফুল্লারবিন্দ — মত্ততায় মাথা ভারি — গুমরে যেন গড়িয়া পড়েন। সকলে আপন মনেই চলিয়াছেন — এমন সময় গ্রামের বুড়ো মুজমদার, মাথায় শিক্কা ফর্ ফর্ করিয়া উড়িতেছে, একহাতে লাঠি ও আর একহাতে গোটা দুই বেগুন লইয়া ঠকর ঠকর করিয়া সম্মুখে উপস্থিত হইল, অমনি সকলে তাহাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইয়া রং জুড়ে দিল। মজুমদার কিছু কানে খাটো — তাহারা জিজ্ঞাসা করিল — আরে কও তোমার স্ত্রী কেমন আছেন ? মজুমদার উত্তর করিলেন — পুড়িয়ে খেতে হবে — অমনি তাহারা হাহা হাহা হো হো, লিক্ লিক্ ফিক্ ফিক্ হাসি ও গররায় ছেয়ে ফেলিল। মজুমদার মোহাড়া কাটাইয়া চম্পট দিতে চান কিন্তু তাঁহার ছাড়ান নাই। নব বাবুরা তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া গঙ্গার ঘাটের নিকট বসাইল। এক ছিলিম গুড়ুক খাওয়াইয়া বলিল — মজুমদার। কর্তার বের নাকালটা বিস্তারিত করিয়া বলো দেখি — তুমি কবি — তোমার মুখের কথা বড়ো মিষ্টি লাগে, না বল্লে ছেড়ে দিব না এবং তোমার স্ত্রীর কাছে এক্ষুণি গিয়া বলিব তোমার অপঘাত মৃত্যু হইয়াছে। মজুমদার দেখিল বিষম প্রমাদ, না বলিলে ছাড় নাই — লাচারে লাঠি ও বেগুন রাখিয়া কথা আরম্ভ করিল।
দুঃখের কথা আর কি বল্ব? কর্তার সঙ্গে গিয়ে ভালো আক্কেল পাইয়াছি। সন্ধ্যা হয় হয় এমতো সময়ে বলাগড়ের ঘাটে নৌকা লাগালো। কতোকগুলিন স্ত্রীলোক জল আনিতে আসিয়াছিল, কর্তাকে দেখিয়া তাহারা একটু ঘোমটা টানিয়া দিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে পরস্পর বলাবলি করতে লাগলো — আ মরি ! কী চমৎকার বর ! যার কপালে ইনি পড়বেন সে একেবারে এঁকে চাঁপা ফুল করে খোঁপাতে রাখবে। তাহাদিগরে মধ্যে একজন বলিল — বুড়ো হউক ছুড়ো হউক তবু একে মেয়েমানুষটা চক্ষে দেখতে পাবে তো? সেও তো অনেক ভালো। আমার যেমন পোড়া কপাল এমন যেনো আর কারো হয় না, ছয় বৎসরের সময় বে হয় কিন্তু স্বামী কেমন চক্ষে দেখনু না — শুনেছি তাঁর পঞ্চাশ-ষাটটি বিয়ে, বয়সে আশি বছরের উপর — থুরথুরে বুড়ো কিন্তু টাকা পেলে বে করতে আলেন না। বড়ো অধর্ম না হলে আর মেয়ে মানুষের কুলীনের ঘরে জন্ম হয় না। আর একজন বলিল — ওগো জল তোলা হয়ে থাকে তো চলে চল — ঘাটে এসে আর বাক্চাতুরীতে কাজ নাই — তোর তবু স্বামী বেঁচে আছে, আমার যার সঙ্গে বে হয় তাঁর তখন অন্তর্জলী হচ্ছিল। কুলীন বামুনদের কি ধর্ম আছে না কর্ম আছে — এ সব কথা বললে কি হবে? পেটের কথা পেটে রাখাই ভালো। মেয়েগুলার কথোপকথন শুনে আমার কিছু দুঃখ উপস্থিত হইল ও যাওন কালীন বেণীবাবুর কথা স্মরণ হইতে লাগিল। পরে বলাগড়ে উঠিয়া সাওয়ারির অনেক চেষ্টা করা গেল কিন্তু একজন কাহারও পাওয়া গেল না। লগ্ন ভ্রষ্ট হয় এজন্য সকলকে চলিয়া যাইতে হইল। কাদাতে হেঁকোচ হোঁকোচ করিয়া কন্যাকর্তার বাটিতে উপস্থিত হওয়া গেল। দঁকে পড়িয়া আমাদিগের কর্তার যে বেশ হইয়াছিল তাহা কি বল্ব? একটা এঁড়ে গোরুর উপর বসালেই সাক্ষাৎ মহাদেব হইতেন আর ঠকচাচা ও বক্রেশ্বরকে নন্দী ভৃঙ্গীর ন্যায় দেখাইত। শুনিয়াছিলাম যে দানসামগ্রী অনেক দিবে, দালানে উঠিয়া দেখিলাম সে গুড়ে বালি পড়িয়াছে। আশা ভগ্ন হওয়াতে ঠকচাচা এদিক ওদিক চান — গুম্রে গুম্র বেড়ান — আমি মুচকে মুচকে হাসি ও এক একবার ভাবি এস্থলে সাটে হেঁ হুঁ দেওয়া ভালো। বর স্ত্রীআচার করতে গেল, ছোট-বড়ো অনেক মেয়ে ঝুনুর ঝুনুর করিয়া চারিদিকে আসিয়া বর দেখিয়া আঁতকে পড়িল, যখন চারি চক্ষে চাওয়াচাওয়ি হয় তখন কর্তাকে চশমা নাকে দিতে হইয়াছিল — মেয়েগুলা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া ঠাট্টা জুড়ে দিল — কর্তা ক্ষেপে উঠে ঠকচাচা ঠকচাচা বলিয়া ডাকেন — ঠকচাচা বাটীর ভিতর দৌড়ে যাইতে উদ্যত হন — অমনি কন্যাকর্তার লোকেরা তাহাকে আচ্ছা করে আল্গা আল্গা রকমে সেখানে শুইয়ে দেয় — বাঞ্ছারামবাবু তেরিয়া হইয়া উঠেন, তাঁরও উত্তম মাধ্যম হয়, বক্রেশ্বরও অর্ধচন্দ্রের দাপটে গলাফুলা পায়রা হন। এই সকল গোলযোগ দেখিয়া আমি বরযাত্রীদিগকে ছাড়িয়া কন্যাযাত্রীদিগের পালে মিশিয়া গেলুম, তারপরে কে কোথায় গেল তাহা কিছুই বলিতে পারি না কিন্তু ঠকচাচাকে ডুলি করিয়া আসিতে হইয়াছিল। — কথায় আছে লোভে পাপ — পাপে মৃত্যু। এক্ষণে যে কবিতা করিয়াছি তাহা শুন।—
ঠকচাচা মহাশয়, সদা করি মহাশয়,
বাবুরামে দেন কানে মন্ত্র।
বাবুরাম অঘা অতি, হইয়াছে ভীমরথী,
ঠকবাক্য শ্রুতি স্মৃতি তন্ত্র ॥
ধনাশায়ে সদোন্মত্ত, ধর্মাধর্ম নাহি তত্ত্ব
অর্থ কিসে থাকিবে বাড়িবে।
সদা এই আন্দোলন, সৎকর্মে নাহি মন,
মন হইল করিবেন বিয়ে॥
সবে বলে ছিছি ছিছি, এ বয়সে মিছামিছি,
নালা কেটে কেন আনো জল !
জাজ্বল্য যে পরিবার, পৌত্র হইবে আবার,
অভাব তোমার কিসে বল ॥
কোনো কথা নাহি শোনে, স্থির করে মনে মনে,
ভারি দাঁও মারিব বিয়েতে।
করিলেন নৌকা ভাড়া, চলিলেন খাড়া খাড়া,
স্বজন ও লোকজন সাতে ॥
বেণীবাবু মানা করে, কে তাঁহার কথা ধরে,
ঘরে গিয়া ভাত তিনি খান।
বেচারাম সদা চটা, ঠকে বলে ঠেঁটা বেটা,
দূঁর দূঁর করে তিনি যান ॥
গণ্ডগ্রাম বলাগোড়, রামা সবে পেতে গড়,
ইঙ্গিতে ভঙ্গিতে করে ঠাট্টা।
বাবুরাম ছট্ ফট্ দেখে বড়ো সুসংকট।
ভয় পান পাছে লাগে বাঁট্টা ॥
দর্পণ সম্মুখে লয়ে, মুখ দেখে ভয়ে ভয়ে,
রামা সবে কেন দেয় বাধা।
চুলগুলি ঘন বাঁধে হাত দিয়া ঠক কাঁধে
হৃষ্ট মনে চলয়ে তাগাদা ॥
পিছলেতে লণ্ডভণ্ড, গড়ায় কেন কুষ্মাণ্ড,
উৎসাহে আহ্লাদে মন ভরা।
পরিজন লোকজন, দেখে শমনভবন,
কাদা চেহলায় আদমরা॥
যেমন ধর পৌঁছিল, হাড়কাটে গলা দিল,
ঠক আশা আসা হল সার।
কোথায় বা রুপা সোনা, সোনা মাত্র হল শোনা,
কোথায় বা মুক্তার হার॥
ঠক করে তেরি মেরি, দ্বন্দ্বোজ বাধায় ভারি,
মনে রাগ মনে সবে মারে।
স্ত্রীআচারে বর যায়, ঝুনুঝুনু রামা ধায়,
বর দেখে হাঁক থুতে সারে ॥
ছি ছি ছি, এই ঢোস্কা কি ঐ মেয়েটির বর লো।
পেটা লেও ফোগ্লারাম, টিক আহ্লাদে বুড়ো গো।
চুলিগুলি কিবা কালো, মুখখানি তোবড়া ভালো নাকেতে
চশমা দিয়া, সাজলো জুজুবুড়ো গো।
মেয়ে সোনার লতা, হায় কি হল বিধাতা, কুলীনের
কর্মকাণ্ড, ধিক্ ধিক্ ধিক লো।
বুড়ো বর জ্বরজ্বর, থর্ থর্ কাঁপিছে।
চক্ষু কট্ মট্ সট্ মট্ করিছে।
নাহি কথা ঊর্ধ্ব মাথা পেয়ে ব্যথা ডাকিছে।
ঠকচাচা এ কি ঢাঁচা মোকে বাঁচা বলিছে।
লম্ফঝম্ফ ভূমিকম্প ঠক লম্ফ দিতেছে।
দরোয়ান হান্ হান্ সান্ সান্ ধরিছে।
ভূমে পড়ি গড়াগড়ি গোঁপ দাড়ি ঢাকিছে।
নাথি কিল যেন শিল পিল্পিল্ পড়িছে।
এই পর্ব দেখে সর্ব হয়ে খর্ব ভাগিছে।
নমস্কার এ ব্যাপার বাঁচা ভার হইছে।
মজুমদার দেখে দ্বার আত্মসার করিছে।
মার্ মার্ ঘের্ ঘার্ ধর্ ধর্ বাড়িছে।
১৯.
বেণীবাবুর আলয়ে বেচারামবাবুর গমন, বাবু রামবাবুর পীড়া ও গঙ্গাযাত্রা, বরদাবাবুর সহিত কথোপকথনান্তর তাঁহার মৃত্যু।
প্রাতঃকালে বেড়িয়া আসিয়া বেণীবাবু আপন বাগানের আটচালায় বসিয়া আছেন, এদিক ওদিক দেখিতে দেখিতে রাম প্রসাদী পদ ধরিয়াছেন —”এবার বাজি ভোর হল” —পশ্চিম দিকে তরুলতার মেরাপ ছিল তাহার মধ্যে থেকে একটা শব্দ হইতে লাগিল —বেণীভায়া বেণীভায়া —বাজি ভোরই হল বটে। বেণীবাবু চমকিয়া উঠিয়া দেখেন যে বৌবাজারের বেচারামবাবু বড়ো ত্রস্ত আসিতেছেন, অগ্রবর্তী হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন —বেচারাম দাদা! ব্যাপারটা কি ? বেচারামবাবু বলিলেন —চাদরখানা কাঁধে দেও, শীঘ্র আইস— বাবুরামের বড় ব্যারাম—একবার দেখা আবশ্যক। বেণীবাবু ও বেচারাম শীঘ্র বৈদ্যবাটীতে আসিয়া দেখেন যে বাবুরামের ভারি জ্বর বিকার —দাহ পিপাসা আত্যন্তিক –বিছানায় ছট্ ফট্ করিতেছেন –সম্মুখে শসা কাটা ও গোলাপের নেকড়া কিন্তু উকি উদ্গার মুহুর্মুহু হইতেছে। গ্রামের যাবতীয় লোক চারিদিগে ভেঙে পড়িয়াছে, পীড়ার কথা লইয়া সকলে গোল করিতেছে। কেহ বলে –আমাদের শাকমাছখেকো নাড়ি –জোঁক, জোলাপ, বেলেস্তারা হিতে বিপরীত হইতে পারে, আমাদিগের পক্ষে বৈদ্যের চিকিৎসাই ভালো, তাতে যদি উপশম না হয় তবে তৎকালে ডাক্তার ডাকা যাইবে। কেহ কেহ বলে হাকিমী মত বড়ো ভালো, তাহারা রোগীকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া আরাম করে ও তাহাদের ঔষধপত্র সকল মোহনভোগের মতো খেতে লাগে। কেহ কেহ বলে যা বলো কহ এসব ব্যারাম ডাক্তারে যেন মন্ত্রের চোটে আরাম করে –ডাক্তারি চিকিৎসা না হলে বিশেষ হওয়া সুকঠিন। রোগী এক একবার জল দাও জল দাও বলিতেছে, ব্রজনাথ রায় কবিরাজ নিকটে বসিয়া কহিতেছেন, দারুণ স্যন্নিপাত –মুহুর্মুহু জল দেওয়া ভালো নহে, বিল্বপত্রের রস ছেঁচিয়া একটু একটু দিতে হইবেক, আমরা তো উহার শত্রু নয় যে এ সময়ে যত জল চাবেন তত দিব। রোগীর নিকটে এইরূপ গোলযোগ হইতেছে, পার্শ্বের ঘর গ্রামের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতে ভরিয়া গিয়াছে তাহাদিগের মত যে শিবস্বস্ত্যয়ন, সূর্য অর্ঘ, কালিঘাটে লক্ষ জবা দেওয়া ইত্যাদি দৈবক্রিয়া করা সর্বাগ্রে কর্তব্য। বেণীবাবু দাঁড়িয়ে সকল শুনিতেছেন কিন্তু কে কাহাকে বলে ও কে কাহার কথাই বা শুনে –নানা মুনির নানা মত, সকলেরই আপনার কথা ধ্রুবজ্ঞান, তিনি দুই-একবার আপন বক্তব্য প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিলেন –কিন্তু মঙ্গলাচরণ হইতে না হইতে একেবারে তাঁহার কথা ফেঁসে গেল। কোনো রকমে থা না পাইয়া বেচারামবাবুকে লইয়া বাহির বাটীতে আইলেন ইতিমধ্যে ঠকচাচা নেংচে নেংচে আসিয়া তাঁহাদিগের সম্মুখে পৌঁছিল। বাবুরামের পীড়ার জন্য ঠকচাচা উদ্বিগ্ন –সর্বদাই মনে করিতেছে সব দাঁও বুঝি ফস্কে গেল। তাহাকে দেখিয়া বেণীবাবু জিজ্ঞাসা করিলেন –ঠকচাচা ! পায়ে কি ব্যথা হইয়াছে ? অমনি বেচারাম বলিয়া উঠিলেন –ভায়া ! তুমি কি বলাগড়ের ব্যাপার শুন নাই –ঐ বেদনা উহার কুমন্ত্রণার শাস্তি, আমি নৌকায় যাহা বলিয়াছিলাম তাহা কি ভুলিয়া গেলে ? এই কথা শুনিয়া ঠকচাচা পেঁচ কাটাইবার চেষ্টা করিল। বেণীবাবু তাহার হাত ধরিয়া বলিলেন –সে যাহা হউক, এক্ষণে কর্তার ব্যারামের জন্য কি তদ্বির হইতেছে ? বাটীর ভিতর তো ভারি গোল। ঠকচাচা বলিল –বোখার শুরু হলে এক্রামদ্দি হাকিমকে মুই সাতে করে এনি –তেনারি বহুত জোলাব ও দাওয়াই দিয়ে বোখারকে দফা করে খেচ্রি খেলান, লেখেন ঐ রোজেতেই বোখার আবার পেল্টে এসে, সে নাগাদ ব্রজনাথ কবিরাজ দেখছে, বেরাম রোজ জেয়াদা মালুম হচ্ছে –মুই বি ভালো বুরা কুচ ঠেওরে উঠতে পারি না। বেণীবাবু বলিলেন –ঠকচাচা রাগ করো না –এ সম্বাদটি আমাদিগের কাছে পাঠানো কর্তব্য ছিল –ভালো, যাহা হইয়াছে তাহার চারা নাই এক্ষণে একজন বিচক্ষণ ইংরেজ ডাক্তার শীঘ্র আনা আবশ্যক। এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে রামলাল ও বরদাপ্রসাদবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। রাত্রি জাগরণ, সেবা করণের পরিশ্রম ও ব্যাকুলতার জন্য রামলালের মুখ ম্লান হইয়াছে –পিতাকে কি প্রকারে ভালো রাখিবেন ও আরাম করিবেন এই তাঁহার অহরহ চিন্তা। বেণীবাবুকে দেখিয়া বলিলেন –মহশয় ! ঘোর বিপদে পড়িয়াছি, বাটীতে বড়ো গোল কিন্তু সৎপরামর্শ কাহার নিকট পাওয়া যায় না। বরদাবাবু প্রাতে ও বৈকালে আসিয়া তত্ত্ব লয়েন কিন্তু তিনি যাহা বলেন সে অনুসারে আমাকে সকলে চলিতে দেন না –আপনি আসিয়াছেন ভালো হইয়াছে এক্ষণে যাহা কর্তব্য তাহা করুন। বেচারামবাবু বরদাবাবুর প্রতি কিঞ্চিৎকাল নিরীক্ষণ করিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাঁহার হাত ধরিয়া বলিলেন –বরদাবাবু। তোমার এত গুণ না হলে সকলে তোমাকে কেন পূজা করিবে। এই ঠকচাচা বাবুরামকে মন্ত্রণা দিয়া তোমার নামে গোমখুনি নালিশ করায় ও বাবুরাম ঘটিত অকারণে তোমার উপর নানা প্রকার জুলুম ও বদিয়ত হইয়াছে কিন্তু ঠকচাচা পীড়িত হইলে তুমি তাহাকে আপনি ঔষধ দিয়া ও দেখিয়া শুনিয়া আরাম করিয়াছ, এক্ষণেও বাবুরাম পীড়িত হওয়াতে সৎপরামর্শ দিতে ও তত্ত্ব লইতে কসুর করিতেছ না –কেহ যদি কাহাকে একটা কটুবাক্য কহে তবে তাহাদিগের মধ্যে একেবারে চটাচটি হয়ে শত্রুতা জন্মে, হাজার ঘাট মানামানি হলেও আপন মনভার যায় না কিন্তু তুমি ঘোর অপমানিত ও অপকৃত হইলেও আপন অপমান ও অপকার সহজে ভুলে যাও –অন্যের প্রতি তোমার মনে ভ্রাতৃভাব ব্যতিরেকে আর অন্য কোনো ভাব উদয় হয় না –বারদাবাবু। অনেকে ধর্ম ধর্ম বলে বটে কিন্তু যেমন তোমার ধর্ম এমন ধর্ম আর কাহারো দেখিতে পাই না —মনুষ্য পামর তোমার গুণের বিচার কি করবে কিন্তু যদি দিনরাত সত্য হয় তবে এ গুণের বিচার উপরে হইবে। বেচারামবাবুর কথা শুনিয়া বরদাবাবু কুণ্ঠিত হইয়া ঘাড় হেঁট করিয়া থাকিলেন পরে বিনয়পূর্বক বলিলেন –মহাশয়। আমাকে এত বলিবেন না –আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি –আমার জ্ঞান বা কি আর ধর্মই বা কি। বেণীবাবু বলিলেন –মহশয়েরা ক্ষান্ত হউন এ সকল কথা পরে হইবেক এক্ষণে কর্তার পীড়ার জন্য কি বিধি তাহা বলুন। বরদাবাবু কহিলেন –আপনাদিগের মত হইলে আমি কলিকাতায় যাইয়া বৈকাল নাগাদ ডাক্তার আনিতে পারি, আমার বিবেচনায় ব্রজনাথ রায়ের ভরসায় থাকা আর কর্তব্য নহে। প্রেমনারায়ণ মজুমদার নিকটে দাঁড়াইয়া ছিলেন –তিনি বলিলেন –ডাক্তারেরা নাড়ির বিষয় ভালো বুঝে না,তাহারা মানুষকে ঘরে মারে, আর কবিরাজকে একেবারে বিদায় করা উচিত নহে বরং একটা রোগ ডাক্তার দেখুক –একটা রোগ কবিরাজ দেখুক। বেণীবাবু বলিলেন –সে বিবেচনা পরে হইবে এক্ষণে বরদাবাবু ডাক্তারকে আনতে যাউন। বরদাবাবু স্নান আহার না করিয়া কলিকাতায় গমন করিলেন, সকলে বলিল বেলাটা অনেক হইয়াছে মহাশয় এক মুটা খেয়ে যাউন –তিনি উত্তর করিলেন –তাহা হইলে বিলম্ব হইবে, সকল কর্ম ভণ্ডুল হইতে পারে।
বাবুরামবাবু বিছানায় পড়িয়া মতি কোথা মতি কোথা বলিয়া অনবরত জিজ্ঞাসা করিতেছেন কিন্তু মতিলালের চুলের টিকি দেখা ভার, তিনি আপন দলবল লইয়া বাগানে বনভোজনে মত্ত আছেন, বাপের পীড়ার সন্বাদ শুনেও শুনেন না। বেণীবাবু এই ব্যবহার দেখিয়া বাগানে তাহার নিকট লোক পাঠাইলেন কিন্তু মতিলাল মিছামছি বলিয়া পাঠাইলেন যে, আমার অতিশয় মাথা ধরিয়াছে কিছুকাল পরে বাটীতে যাইব।
দুই প্রহর দুইটার সময় বাবুরামবাবুর জ্বর বিচ্ছেদকালীন নাড়ি ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। কবিরাজ হাত দেখিয়া বলিল –কর্তাকে স্থানান্তর করা কর্তব্য –উনি প্রবীণ, প্রাচীন ও মহামান্য, অবশ্য যাহাতে উঁহার পরকাল ভালো হয়, তাহা করা উচিত। এই কথা শুনিবামাত্রে পরিবার সকলে রোদন করিতে লাগিল ও আত্মীয় এবং গ্রামবাসীরা সকলে ধরাধরি করিয়া বাবুরামবাবুকে বাটীর দালানে আনিল। এমতো সময়ে বরদাবাবু ডাক্তার সঙ্গে করিয়া উপস্থিত হইলেন, ডাক্তার নাড়ি দেখিয়া বলিলেন –তোমরা শেষাবস্থায় আমাকে ডাকিয়াছ –রোগীকে গঙ্গাতীরে পাঠাবার অগ্রে ডাক্তারকে ডাকিলে ডাক্তার কি করিতে পারে? এই বলিয়া ডাক্তার গমন করিলেন। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় লোক বাবুরামবাবুকে ঘিরিয়া একে একে জিজ্ঞাস করিতে লাগিলে –মহাশয় আমাকে চিনিতে পারেন –আমিকে বলুন দেখি ? বেণীবাবু বলিলেন –রোগীকে আপনারা এত ক্লেশ দিবেন না –এরূপ জিজ্ঞাসাতে কি ফল ? স্বস্ত্যয়নী ব্রাহ্মণেরা স্বস্ত্যয়ন সাঙ্গ করিয়া আশীর্বাদী ফুল লইয়া আসিয়া দেখেন যে তাঁহাদিগের দৈব ক্রিয়ায় কিছুমাত্র ফল হইল না। বাবুরামবাবুর শ্বাসবৃদ্ধি দেখিয়া সকলে তাঁহাকে বৈদ্যবাটীর ঘাটে লইয়া গেল, তথায় আসিয়া গঙ্গাজল পানে ও স্নিগ্ধ বায়ু সেবনে তাঁহার কিঞ্চিৎ চৈতন্য হইল। লোকের ভিড় ক্রমে ক্রমে কিঞ্চিৎ কমিয়া গেল –রামলাল পিতার নিকট বসিয়া আছেন –বরদাপ্রসাদবাবু বাবুরামবাবুর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন ও কিয়ৎকাল পরে আস্তে আস্তে বলিলেন মহাশয় ! এক্ষণে একবার মনের সহিত পরাৎপর পরমেশ্বরকে ধ্যান করুন –তাঁহার কৃপা বিনা আমাদের গতি নাই। এ কথা শুনিবামাত্রেই বাবুরামবাবু বরদাপ্রসাদবাবুর প্রতি দুই-তিন লহমা চাহিয়া অশ্রুপাত করিতে লাগিলেন। রামলাল চোখের জল মুছিয়া দিয়া দুই-এক কুশী দুগ্ধ দিলেন –কিঞ্চিৎ সুস্থ হইয়া বাবুরামবাবু মৃদু স্বরে বলিলেন –ভাই বরদাপ্রসাদ ! আমি এক্ষণে জানলুম যে তোমার বাড়া জগতে আমার আর বন্ধু নাই –আমি লোকের কুমন্ত্রণায় ভারি ভারি কুকর্ম করিয়াছি, সেই সকল আমার এক একবার স্মরণ হয় আর প্রাণটা যেন আগুনে জ্বলিয়া উঠে –আমি ঘোর নারকী –আমি কি জবাব দিব ? আর তুমি কি আমাকে ক্ষমা করিবে ? এই বলিয়া বরদাবাবুর হাত ধরিয়া বাবুরামবাবু আপন চক্ষু মুদিত করিলেন। নিকটে বন্ধু-বান্ধবেরা ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করিতে লাগিল ও বাবুরামবাবুর সজ্ঞানে লোকান্তর হইল।
২০.
মতিলালের যুক্তি, বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধের ঘোঁট, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার অধ্যক্ষতা, শ্রাদ্ধে পণ্ডিতদের বাদানুবাদ ও গোলযোগ।
পিতার মৃত্যু হইলে মতিলাল বাটীতে গদিয়ান হইয়া বসিল। সঙ্গী সকল এক লহমাও তাহার সঙ্গছাড়া নয়। এখন চার পো বুক হইল –মনে করিতে লাগিল, এতদিনের পর ধুমধাম দেদার রকমে চলিবে। বাপের জন্য মতিলালের কিঞ্চিৎ শোক উপস্থিত হইল –সঙ্গীরা বলিল, বড়োবাবু! ভাবো কেন ? বাপ-মা লইয়া চিরকাল কে ঘর করিয়া থাকে ? এখন তো তুমি রাজেশ্বর হইলে। মুঢ়ের শোক নামমাত্র –যে ব্যক্তি পরমপদার্থ পিতামাতাকে কখন সুখ দেয় নাই –নানাপ্রকার যন্ত্রণা দিত, তাহার মনে পিতার শোক কিরূপে লাগিবে? যদি লাগে তবে তাহা ছায়ার ন্যায় ক্ষণেক স্থায়ী, তাহাতে তাহার পিতাকে কখন ভক্তিপূর্বক স্মরণ করা হয় না ও স্মরণার্থে কোনো কর্ম করিতে মনও চায় না। মতিলালের বাপের শোক শীঘ্র ঢাকা পড়িয়া বিষয়-আশয় কি আছে কি না আছে তাহা জানিবার ইচ্ছা প্রবল হইল। সঙ্গীদিগের বুদ্ধিতে ঘর-দ্বার সিন্দুক-পেটারার ডবল্ ডবল্ তালা দিয়া স্থির হইয়া বসিল। সর্বদা মনের মধ্যে এই ভয়, পাছে মায়ের কি বিমাতার কি ভাইয়ের বা ভগনীর হাতে কোনো রকমে টাকাকড়ি পড়ে তাহা হইলে সে টাকা একেবারে গাপ হইবে। সঙ্গীরা সর্বদা বলে –বড়োবাবু ! টাকা বড়ো চিজ –টাকাতে বাপকেও বিশ্বাস নাই। ছোটবাবু ধর্মের ছালা বেঁধে সত্য সত্য বলিয়ে বেড়ান বটে কিন্তু পতনে পেলে তাঁহার গুরুও কাহাকে রেয়াত করেন না –ও সকল ভণ্ডামী আমরা অনেক দেখিয়াছি –সে যাহা হউক, বরদাবাবুটা অবশ্য কোনো ভেল্কি জানে –বোধ হয় ওটা কামাখ্যাতে দিনকতক ছিল, তা না হলে কর্তার মৃত্যুকালে তাঁহার এত পেশ কি প্রকারে হইল।
দুই-এক দিবস পরেই মতিলাল আত্মীয়-কুটুম্বদিগের নিকট লৌকিকতা রাখিতে যাইতে আরম্ভ করিল। যে সকল লোক দলঘাঁটা, সাল্কে মধ্যস্থ করিতে সর্বদা উদ্যত হয়, জিলাপির ফেরে চলে, তাহারা ঘুরিয়া ফিরিয়া নানা কথা বলে –সে সকল কথা আসমানে উড়ে উড়ে বেড়ায়, জমিতে ছোঁয় ছোঁয় করিয়া ছোঁয় না সুতরাং উল্টে-পাল্টে লইলে তাহার দুই রকম অর্থ হইতে পারে। কেহ কেহ বলে কর্তা সরেশ মানুষ ছিলেন –এমন সকল ছেলে রেখে-ঢেকে যাওয়া বড়ো পূণ্য না হইলে হয় না –তিনি যেমন লোক তেমনি তাঁহার আশ্চর্য মৃত্যুও হইয়াছে বাবু। এতদিন তুমি পর্বতের আড়ালে ছিলে এখন বুঝে-সুঝে চলতে হবে –সংসারটি ঘাড়ে পড়িল –ক্রিয়া-কলাপ আছে –বাপ পিতামহের নাম বজায় রাখিতে হইবে, এ সওয়ায় দায়-দফা আছে। আপনার বিষয় বুঝে শ্রাদ্ধ করিবে, দশ জনার কথা শুনিয়া নেচে উঠবার আবশ্যক নাই। নিজে রামচন্দ্র বালির পিণ্ড দিয়াছিলেন, এ বিষয় আক্ষেপ করা বৃথা, কিন্তু নিতান্ত কিছু না করা সেও তো বড়ো ভালো নয়। বাবু জানো তো কর্তার ঢাক্টাপানা নামটা –তাঁহার নামে আজো বাঘে গোরুতে জল খায়। তাহাতে কি সুদ্ধ তিলকাঞ্চনি রকমে চল্বে ?-গেরেপ্তার হয়েও লোকের মুখ থেকে তর্তে হবে। মতিলাল এ সকল কথায় মারপেঁচ কিছুই বুঝিতে পারে না। আত্মীয়রা আত্মীয়তাপূর্বক দরদ প্রকাশ করে কিন্তু যাহাতে একটা ধুমধাম বেধে যায় ও তাহারা কর্তৃত্ব ফলিয়ে বেড়াতে পারে তাহাই তাহাদিগের মানস অথচ স্পষ্টরূপে জিজ্ঞাসা করিলে এঁ ওঁ করিয়া সেরে দেয়। কেহ বলে ছয়টি রুপার ষোড়শ না করিলে ভালো হয় না –কেহ বলে একটা দান সাগর না করিলে মান থাকা ভার –কেহ বলে একটা দম্পতি বরণ না করিলে সামান্য শ্রাদ্ধ হবে –কেহ বলে কতকগুলিন অধ্যাপক নিমন্ত্রণ ও কাঙালী বিদায় না করিলে মহা অপযশ হইবে। এইরূপে ভারি গোলযোগ হইতে লাগিল –কে বা বিধি চায় ? কে বা তর্ক করিতে বলে ? –কে বা সিদ্ধান্ত শুনে ?– সকলেই গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল –সকলেই স্ব স্ব প্রধান, সকলেরই আপনার কথা পাঁচ কাহন।
তিনদিন পরে বেণীবাবু, বেচারামবাবু, বাঞ্ছারামবাবু ও বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মতিলালের নিকট ঠকচাচা মণিহারা ফণীর ন্যায় বসিয়া আছেন –হাতে মালা –ঠোঁট দু’টি কাঁপাইয়া তসবি পড়িতেছেন, অন্যান্য অনেক কথা হইতেছে কিন্তু সে সব কথায় তাঁহার কিছুতেই মন নাই –দুই চক্ষু দেওয়ালের উপর লক্ষ্য করিয়া ভেল্ ভেল্ করিয়া ঘুরাইতেছেন –তাক্-বাগ কিছুই স্থির করিতে পারেন নাই –বেণীবাবু প্রভৃতিকে দেখিয়া ধড়মড়িয়া উঠিয়া সেলাম করিতে লাগিলেন। ঠকচাচার এত নম্রতা কখনই দেখা যায় নাই। ঢোঁড়া হইয়া পড়িলেই জাঁক যায়। বেণীবাবু ঠকচাচার হাত ধরিয়া বলিলেন –আরে। করো কি ? তুমি প্রাচীন মুরুব্বী লোকটা –আমাদিগকে দেখে এত কেন ? বাঞ্ছারামবাবু বলিলেন –অন্য কথা যাউক –এদিকে দিন অতি সংক্ষেপ –উদ্যোগ কিছুই হয় নাই –কর্তব্য কি বলুন ?
বেচারাম। বাবুরামের বিষয়-আশায় অনেক জোড়া –কতক বিষয় বিক্রিসিক্রি করিয়া দেনা পরিশোধ করা কর্তব্য –দেনা করিয়া ধুমধাম শ্রাদ্ধ করা উচিত নহে।
বাঞ্ছারাম। সে কি কথা ! আগে লোকের মুখ থেকে তর্তে হবে, পশ্চাৎ বিষয়-আশয় রক্ষা হইবে। মান-সম্ভ্রম কি বানের জলে ভেসে যাবে ?
বেচারাম। এ পরামর্শ কুপরামর্শ –এমন পরামর্শ কখনই দিব না –কেমন বেণী ভায়া ! কি হলো ?
বেণী। যে স্থলে দেনা অনেক, বিষয়-আশায় বিক্রি করিয়া দিলেও পরিশোধ হয় কি-না সন্দেহ, সে স্থলে পুনরায় দেনা করা একপ্রকার অপহরণ করা, কারণ সে দেনা পরিশোধ কিরূপে হইবে ?
বাঞ্ছারাম। ও সকল ইংরেজী মত –বড়োমানুষদিগের ঢাল সুমরেই চলে –তাহারা এক দিচ্ছে এক নিচ্ছে, একটা সৎকর্মে বাগড়া দিয়ে ভাঙা মঙ্গলচণ্ডী হওয়া ভদ্রলোকের কর্তব্য নয়। আমার নিজের দান করিবার সঙ্গতি নাই, অন্য এক ব্যক্তি দশজন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে দান করিতে উদ্যত তাহাতে আমার খোঁচা দিবার আবশ্যক কি ? আর সকলেরই নিকট অনুগত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আছে, তাহারাও পত্রটত্র পাইতে ইচ্ছা করে –তাহাদেরও তো চলা চাই।
বক্রেশ্বর। আপনি ভালো বলেছেন –কথাই আছে যাউক প্রাণ থাকুক মান।
বেচারাম। বাবুরামের পরিবার বেড়া আগুনে পড়িয়াছে –দেখিতেছি ‘রায় নিকেশ হইবে। যাহা করিলে আখেরে ভালো হয় তাহাই আমাদিগের বলা কর্তব্য –দেনা করিয়া মান কেনার মুখে ছাই –আমি এমন অনুগত বামুন রাখি না যে তাহাদিগের পেট পুরাইবার জন্য অন্যের গলায় ছুরি দিবে। এ সব কি কারখানা। দূঁর দূঁর । চলো বেণী ভায়া। আমরা যাই –এই বলিয়া তিনি বেণীবাবুর হাত ধরিয়া উঠিলেন।
বেণীবাবু ও বেচারামবাবু গমন করিলে বাঞ্ছারাম বলিলেন –আপদের শান্তি। এ দু-টা কিছুই বোঝে-সোঝে না, কেবল গোল করে। সমজদার মানুষের সঙ্গে কথা কইলে প্রাণ ঠাণ্ডা হয়। ঠকচাচা নিকটে আইস –তোমার বিবেচনায় কি হয় ?
ঠকচাচা। মুই বি তোমার সাতে বাতচিত করতে বহুত খোস –তেনারা খাপ্কান –তেনাদের নজদিকে এস্তে মোর ডর লাগে। যে সব বাত তুমি জাহের করলে সে সব সাচ্চা বাত। আদমির হুরমত ও কুদরৎ গেলে জিন্দিগি ফেল্তো। মামলা-মকদ্দমা নেগাবানি তুমি ও মুই করে বেলকুল বখেড়া কেটিয়ে দিব –তাতে ডর কি ?
মতিলালের ধুমধেমে স্বভাব –আয়ব্যয় বোধাবোধ নাই –বিষয় কর্ম কাহাকে বলে জানে না –বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার উপর বড়ো বিশ্বাস, কারণ তাহারা আদালত ঘাঁটা লোক আর তাহারা যেরূপ মন যুগিয়ে ও সলিয়ে কলিয়ে লওয়াইতে লাগিল তাহাতে মতিলাল একেবারে বলিল –এ কর্মে আপনারা অধ্যক্ষ হইয়া যাহাতে নির্বাহ হয় তাহা করুন, আমাকে সহি সনদ করিতে যাহা বলিবেন আমি তৎক্ষণাৎ করিব। বাঞ্ছারামবাবু বলিলেন –কর্তার উইল বাহির করিয়া আমাকে দাও –উইল কেবল তুমি অছি আছ –তোমার ভাইটে পাগল এই জন্য তাহার নাম বাদ দেওয়া গিয়াছিল, সেই উইল লইয়া আদালতে পেশ করিলে তুমি অছি মরকর হইবে, তাহার পরে তোমার সহি সনদে বিষয় বন্ধক বা বিক্রি হইতে পারিবে। মতিলাল বাক্স খুলিয়া উইল বাহির করিয়া দিল। পরে বাঞ্ছারাম আদালতের কর্ম শেষ করিয়া একজন মহাজন খাড়া করিয়া লেখাপড়া ও টাকা সমেত বৈদ্যবাটীর বাটীতে উপস্থিত হইলেন। মতিলাল টাকার মুখ দেখিয়া তৎক্ষণাৎ কাগজাদ সহি করিয়া দিল। টাকার থলিতে হাত দিয়া বাক্সের ভিতর রাখিতে যায় এমন সময় বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা বলিল –বাবুজি ! টাকা তোমার হাতে থাকিলে বেলকুল খরচ হইয়া যাইবে, আমাদিগের হাতে তহবিল থাকিলে বোধ হয় টাকা বাঁচিতে পারিবে, আর তোমার স্বভাব বড়ো ভালো, চক্ষুলজ্জা অধিক, কেহ চাহিলে মুখ মুড়িতে পারিবে না, আমরা লোক বুঝে টেলে দিতে পারব। মতিলাল মনে করিল এ কথা বড়ো ভালো শ্রাদ্ধের পর আমিই বা খরচের টাকা কিরূপে পাই এখন তো বাবা নাই যে চাহিলেই পাব এ কারণে উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হইল।
বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধের ধুম লেগে গেল। ষোড়শ গড়িবার শব্দ –ভেয়ানের গন্ধ –বোল্তা মাছির ভন্ভনানি, ভিজে কাঠের ধুঁয়া, জিনিস পত্রের আমদানি লোকের কোলাহলে বাড়ি ছেয়ে ফেলিল। যাবতীয় পূজারী, দোকানী ও বাজার সরকারে বামুন এক এক তসর জোড় পরিয়া ও গঙ্গামৃত্তিকার ফোঁটা করিয়া পত্রের জন্য গমনাগমন করিতে লাগল, আর তর্কবাগীশ, বিদ্যারত্ন, ন্যায়ালঙ্কার, বাচস্পতি ও বিদ্যাসাগরের তো শেষ নাই, দিন-রাত্রি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও অধ্যাপকের আগমন যেন গো-মড়কে মুচির পার্বণ।
শ্রাদ্ধের দিবস উপস্থিত –সভায় নানা দিগ্দেশীয় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের সমাগম হইয়াছে ও যাবতীয় আত্মকুটুম্ব, স্বজন, সুহৃদ্ বসিয়াছেন –সম্মুখে রুপার দানসাগর –ঘোড়া, পালকি, পিতলের বাসন, বনাত, তৈজসপত্র ও নগদ টাকা –পার্শ্বে কীর্তন হইতেছে –মধ্যে বেচারামবাবু ভাবুক হইয়া ভাব গ্রহণ করিতেছেন। বাটীর বাহিরে অগ্রদানী, রেও ভাট, নাগা, তষ্টিরাম ও কাঙালীতে পরিপূর্ণ –ঠকচাচা কেনিয়ে কেনিয়ে বেড়াচ্ছেন –সভায় বসিতে তাঁহার ভরসা হয় না। অধ্যাপকেরা নস্য লইতেছেন ও শাস্ত্রীয় কথা লইয়া পরস্পরে আলাপ করিতেছেন –তাহাদিগের গুণ এই যে একত্র হইলে ঠাণ্ডা রুপে কথোপকথন করা ভার –একটা না একটা উৎপাত অনায়াসে উপস্থিত হয়। একজন অধ্যাপক ন্যায়শাস্ত্রের একটা ফেঁড়কা উপস্থিত করিলেন – “ঘটত্বাবচ্ছিন্ন প্রতিযোগিতাভাব বহ্ণিভাবে ধূমা, ধূমাভাবে বহ্ণি”। উৎকলনিবাসী একজন পণ্ডিত কহিলেন –যৌটি ঘটিয়া বাচ্ছিন্তি ভাব প্রতিযোগা সৌটি পর্বত বহ্ণি নামেধিয়া। কাশীজোড়া-নিবাসী পণ্ডিত বলিলেন –কেমন কথা গো ? বাক্যটি প্রিণিধান করো নাই –যে ও ঘটকে পট করে পর্বতকে বহ্ণিমান ধূম –শিরোমণি যে মেকটি মেরে দিচ্ছেন। বঙ্গদেশীয় পণ্ডিত বলিলেন –গটিয়াবচ্ছিন্ন বাব প্রতিযোগা দুমাধামে অগ্নি অগ্নিবাবে দুমা –অগ্নি না হলে দুমা কেম্মে লাগে। এইরূপ তর্ক বির্তক হইতেছে –মুখামুখি হইতে হইতে হাতাহাতি হইবার উপক্রম –ঠকচাচা ভাবেন পাছে প্রমাদ ঘটে এই বেলা মিটিয়া দেওয়া ভালো –আস্তে আস্তে নিকটে আসিয়া বলিলেন –মুই বলি একটা বদনা ও চেরাগের বাত লিয়ে তোমরা কেন কেজিয়ে করো –মুই তোমাদের দু-টা দু-টা বদনা দিব। অধ্যাপকের মধ্যে একজন চটপটে ব্রাহ্মণ উঠিয়া বলিলেন –তুই বেটা কে রে ? হিন্দুর শ্রাদ্ধে যবন কেন ? এ কি ? পেতনীর শ্রাদ্ধে আলেয়া অধ্যক্ষ না কি ? এই বলিতে বলিতে গালাগালি হাতাহাতি হইতে হইতে ঠেলাঠেলি, বেতাবেতি আরম্ভ হইল। বাঞ্ছারামবাবু তেড়ে আসিয়া বলিলেন –গোলমাল করিয়া শ্রাদ্ধ ভণ্ডুল করিলে পরে বুঝব –একেবারে বড়ো আদালতে এক শমন আনব –একি ছেলের হাতের পিটে ? বক্রেশ্বর বলেন, তা বইকি আর যিনি শ্রাদ্ধ করিবেন তিনি তো সামান্য ছেলে নন, তিনি পরেশ পাথর। বেচারাম বলিলেন –এ তো জানাই আছে যেখানে ঠক ও বাঞ্ছারাম অধ্যক্ষ সেখানে কর্ম সুপ্রতুল হইবে না –দূঁর দূঁর ! গোল কোনক্রমে থামে না –রেও ভাট প্রভৃতি ঝেঁকে আসিতেছে, এক একবার বেত খাইতেছে ও চিৎকার করিয়া বলিতেছে –”ভালো শ্রাদ্ধ কর্লি রে।” অবশেষে সভার ভদ্রলোক সকলে এই ব্যাপার দেখিয়া কহিতে লাগিল “কার শ্রাদ্ধ কে করে খোলা কেটে বামুন মরে” এই বেলা সরে পড়া শ্রেয় –ছুবড়ি ফেলে অমিত্তি কেন হারানো যাবে ?
২১.
মতিলালের গদিপ্রাপ্তি ও বাবুয়ানা, মাতার প্রতি কুব্যবহার —মাতা ভগিনীর বাটী হইতে গমন ও ভ্রাতাকে বাটীতে আসিতে বারণ ও তাহার অন্য দেশে গমন।
বাবুরামবাবুর শ্রাদ্ধে লোকের বড়ো শ্রদ্ধা জন্মিল না, যেমন গর্জন হইয়াছিল তেমন বর্ষণ হয় নাই। অনেক তেলা মাথায় তেল পড়িল –কিন্তু শুকনা মাথা বিনা তৈলে ফেটে গেল। অধ্যাপকদিগের তর্ক করাই সার, ইয়ার গোছের বামুনদিগের চৌচাপটে জিত। অধ্যাপকদিগের নানা প্রকার কঠোর অভ্যাস থাকাতে এক্রোকা স্বভাব জন্মে –তাঁহারা আপন অভিপ্রায় অনুসারে চলেন –সাটে হাঁ-না বলেন না। ইয়ার গোচের ব্রাহ্মণেরা শহরঘেঁষা –বাবুদিগের মন যোগাইয়া কথাবার্তা কহেন –ঝোপ বুঝে কোপ মারেন, তাঁহারা সকল কর্মেই বাওয়াজিকে বাওয়াজি তরকারিকে তরকারী। অতএব তাঁহাদিগের যে সর্ব স্থানে উচ্চ বিদায় হয় তাহাতে আশ্চর্য কি? অধ্যক্ষেরা ভালো থলিয়া সিঞাইয়া বসিয়াছিলেন –ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ও কাঙালী বিদায় বড়ো হউক বা না হউক তাহাদিগের নিজের বিদায়ে ভালো অনুরাগ হইল। যে কর্মটি সকলের চক্ষের উপর পড়িয়াছিল ও এড়াইবার নয় সেই কর্মটি রব করিয়া হইয়াছিল কিন্তু আগুপাছুতে সমান বিবেচনা হয় নাই। এমন অধ্যক্ষতা করা কেবল চিতেন কেটে বাহবা লওয়া।
শ্রাদ্ধের গোল ক্রমে মিটে গেল। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালের বিজাতীয় খোসামোদ করিতে লাগিল। মতিলাল দুর্বল স্বভাব হেতু তাহাদিগের মিষ্ট কথায় ভিজিয়া গিয়া মনে করিল যে পৃথিবীতে তাহাদিগের তুল্য আত্মীয় আর নাই। মতিলালের মান বৃদ্ধির জন্য তাহারা একদিন বলিল –এক্ষণে আপনি কর্তা অতএব স্বর্গীয় কর্তার গদিতে বসা কর্তব্য, তাহা না হইলে তাঁহার পদ কি প্রকারে বজায় থাকিবে? –এই কথা শুনিয়া মতিলাল অত্যন্ত আহ্লাদিত হইল –ছেলে বেলা তাহার রামায়ণ ও মহাভারত একটু একটু শুনা ছিল এই কারণে মনে হইতে লাগিল যেমন রামচন্দ্র ও যুধিষ্ঠির সমারোহপূর্বক সিংহাসনে অভিসিক্ত হইয়াছিলেন সেইরূপে আমাকেও গদিতে উপবেশন করিতে হইবেক। বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা দেখিল ঐ প্রস্তাবে মতিলালের মুখখানি আহ্লাদে চক্ চক্ করিতে লাগিল –তাহার পর দিবসেই দিন স্থির-করিয়া আত্মীয় স্বজনকে আহ্বানপূর্বক মতিলালকে তাহার পিতার গদির উপর বসাইল। গ্রামে ঢিঢিকার হইয়া গেল মতিলাল গদিপ্রাপ্ত হইলেন। এই কথা হাটে, বাজারে, ঘাটে-মাঠে হইতে লাগিল –একজন ঝাঁজওয়ালা বামুন শুনিয়া বলিল –গদিপ্রাপ্ত কি হে ? এটা যে বড়ো লম্বা কথা ! আর গদি বা কার ? এ কি জগৎসেটের গদি না দেবীদাস বালমুকুন্দের গদি ?
যে লোকের ভিতরে সার থাকে সে লোক উচ্চ পদ অথবা বিভব পাইলেও হেলে দোলে না, কিন্তু যাহাতে কিছু পদার্থ নাই তাহার অবস্থার উন্নতি হইলে বানের জলের ন্যায় টল্মল্ করিতে থাকে। মতিলালের মনের গতি সেইরূপ হইতে লাগিল। রাত দিন খেলাধুলা, গোলমাল, গাওনা-বাজনা, হো হা, হাসি-খুশি, আমোদ-প্রমোদ, মোয়াফেল, চোহেল, স্রোতের ন্যায় অবিশ্রান্ত চলিতে আরম্ভ হইল, সঙ্গীদিগের সংখ্যার হ্রাস নাই_ রোজ রোজ রক্তবীজের ন্যায় বৃদ্ধি হইতে লাগিল। ইহার আশ্চর্য কি ? –ভাত ছড়ালে কাকের অভাব নাই, আর গুড়ের গন্ধেই পিঁপড়ার পাল পিল পিল করিয়া আইসে। একদিন বক্রেশ্বরের সাইতের পন্থায় আসিয়া মতিলালের মনযোগানো কথা অনেক বলিল কিন্তু বক্রেশ্বরের ফন্দি মতিলাল বাল্যকালাবধি ভালো জানিত –এই জন্যে তাহাকে এই জবাব দেওয়া হইল –মহাশয় ! আমার প্রতি যেরূপ তদারক করিয়াছিলেন তাহাতে আমার পরকালের দফা একেবারে খাইয়া দিয়াছেন –ছেলেবেলা আপনাকে দিতে থুতে আমি কসুর করি নাই –এখন আর যন্ত্রণা কেন দেন? বক্রেশ্বর অধোমুখে মেও মেও করিয়া প্রস্থান করিল। মতিলাল আপন সুখে মত্ত –বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা এক একবার আসিতেন কিন্তু তাহাদিগের সঙ্গে বড়ো দেখাশুনা হইত না –তাঁহারা মোক্তারনামার দ্বারা সকল আদায়-ওয়াশিল করিতেন ও মধ্যে মধ্যে বাবুকে হাততোলা রকমে কিছু কিছু দিতেন। আর ব্যয়ের কিছু নিকেশ প্রকাশ নাই –পরিবারেরও দেখাশুনা নাই –কে কোথায় থাকে –কে কোথায় খায় –কিছুই খোঁজ খবর নাই –এইরূপ হওয়াতে পরিবারদিগের ক্লেশ হইতে লাগিল কিন্তু মতিলাল বাবুয়ানায় এমতো বেহুঁশ যে এসব কথা শুনিয়েও শুনে না।
সাধ্বী স্ত্রীর পতিশোকের অপেক্ষা আর যন্ত্রণা নাই। যদ্যপি সৎ সন্তান থাকে তবে সে শোকের কিঞ্চাৎ শমতা হয়। কুসন্তান হইলে সেই শোকানলে যে ঘৃত পড়ে। মতিলালের কুব্যবহার জন্য তাহার মাতা ঘোরতর তাপিত হইতে লাগিলেন –কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করিতেন না, তিনি অনেক বিবেচনা করিয়া একদিন মতিলালের নিকট আসিয়া বলিলেন –বাবা ! আমার কপালে যাহা ছিল তাহা হইয়াছে, এক্ষণ যে ক-দিন বাঁচি সে ক-দিন যেন তোমার কুকথা না শুনতে হয় –লোকগঞ্জনায় আমি কান পাতিতে পারি না, তোমার ছোট ভাইটির, বড়ো বোনটির ও বিমাতার একটু তত্ত্ব নিও –তারা সবদিন আধপেটাও খেতে পাইয় না –বাবা। আমি নিজের জন্যে কিছু বলি না, তোমাকে ভারও দিই না। মতিলাল এ কথা শুনিয়া দুই চক্ষু লাল করিয়া বলিল –কি তুমি একশ-বার ফেচ্ ফেচ্ করিয়া বক্তেছ? –তুমি জানো না আমি এখন যা মনে করি তাই করিতে পারি? আমার আবার কুকথা কি? এই বলিয়া মাতাকে ঠাস্ করিয়া এক চড় মারিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল। অনেকক্ষণ, পরে জননী উঠিয়া অঞ্চল দিয়া চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে বলিলেন –বাবা ! আমি কখন শুনি নাই যে সন্তানে মাকে মারে কিন্তু আমার কপাল হইতে তাহাও ঘটিল –আমার আর কিছু কথা নাই কেবল এইমাত্র বলি যে তুমি ভালো থাকো। মাতা পর দিবস আপন কন্যাকে লইয়া কাহাকেও কিছু না বলিয়া বাটী হইতে গমন করিলেন।
রামলাল পিতার মৃত্যুর পর ভ্রাতার সঙ্গে সদ্ভাব রাখিতে অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন কিন্তু নানা প্রকারে অপমানিত হন। মতিলাল সর্বদা এই ভাবিত বিষয়ের অর্ধেক অংশ দিতে গেলে বড়োমানুষি করা হইবে না কিন্তু বড়োমানুষি না করিলে বাঁচা মিথ্যা, এজন্য যাহাতে ভাই ফাঁকিতে পড়ে তাহাই করিতে হইবে। এই মতলব স্থির করিয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচার পরামর্শে মতিলাল রামলালকে বাটী ঢুকিতে বারণ করিয়া দিল। রামলাল ভদ্রাসনে প্রবেশকরণে নিবারিত হইয়া অনেক বিবেচনা করণান্তে মাতা বা ভাগিনী অথবা কাহারো সহিত না সাক্ষাৎ করিয়া দেশান্তর গমন করিলেন।
২২.
বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা মতিলালকে সওদাগরি কর্ম করিতে পরামর্শ দেন, মতিলাল দিন দেখাইবার জন্য তর্কসিদ্ধান্তের নিকট মানগোবিন্দকে পাঠান, পর দিবস রাহি হয়েন ও ধনামালার সহিত গঙ্গাতে বকাবকি করেন।
মতিলাল দেখিলেন বাটী হইতে মা গেলেন, ভাই গেলেন, ভগিনী গেলেন। আপদের শান্তি ! এতদিনের পর নিষ্কন্টক হইল —ফেচ্ফেচানি একেবারে বন্ধ —এক চোখ রাঙানিতে কর্ম কেয়াল হইয়া উঠিল আর “প্রহারেণ ধনঞ্জয়ঃ” সে সব হল বটে কিন্তু শরার রুধির ফুরিয়ে এল —তার উপায় কি? বাবুয়ানার জোগাড় কিরূপে চলে? খুচরা মহাজন বেটাদের টাল্মাটাল আর করিতে পারা যায় না। উটনোওয়ালারাও উটনো বন্ধ করিয়াছে —এদিকে সামনে স্নানযাত্রা —বজরা ভাড়া করিতে আছে —খেমটাওয়ালীদের বায়না দিতে আছে —সন্দেশ মেঠাইয়ের ফরমাইশ দিতে আছে —চরস, গাঁজা ও মদও আনাইতে হইবে —তার আটখানার পাটখানাও হয় নাই। এই সকল চিন্তায় মতিলাল চিন্তিত আছেন এমতো সময়ে বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা আসিয়া উপস্থিত হইল। দুই-একটা কথার পরে তাহারা জিজ্ঞাসা করিল —বড়োবাবু ! কিছু বিমর্ষ কেন? তোমাকে ম্লান দেখিলে যে আমরা ম্লান হই —তোমার যে বয়েস তাতে সর্বদা হাসিখুশি করিবে। গালে হাত কেন? ছি ! ভালো করিয়া বসো। মতিলাল এই মিষ্ট বাক্যে ভিজিয়া আপন মনের কথা সকল ব্যক্ত করিল। বাঞ্ছরাম বলিলেন —তার জন্যে এত ভাবনা কেন? আমরা কি ঘাস কাটছি? আজ একটা ভারি মতলব করিয়া আসিয়াছি —এক বৎসরের মধ্যে দেনা-টেনা সকল শোধ দিয়া পায়ের উপর পা দিয়া পুত্রপৌত্রক্রমে খুব বড়োমানুষি করিতে পারিবে। শাস্ত্রে বলে “বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ” —সৌদাগরিতেই লোক ফেঁপে উঠে —আমার দেখ্তা কত বেটা টেপাগোঁজা, নড়েভোলা, টয়েবাঁধা, বালতিপোতা, কারবারে হেপায় আণ্ডিল হইয়া গেল —এ সব দেখে কেবল চোখ টাটায় বই তো না! আমরা কেবল একটি কর্ম লয়ে ঘষ্টিঘর্ষণা করিতেছি —এ কি খাটো দুঃখ ! চন্ডীচরণ ঘুঁটে কুড়ায়, রামা চড়ে ঘোড়া।
মতিলাল। এ মতলব বড়ো ভালো —আমার অহরহ টাকার দরকার। সৌদাগরি কি বাজারে ফলে না আপিসে জন্মে? না মেঠাই-মণ্ডার দোকানে কিনিতে মেলে? একজন সাহেবের মুৎসুদ্দি না হইলে আমার কর্ম কাজ জমকাবে না।
বাঞ্ছরাম। বড়োবাবু ! তুমি কেবল গদিয়ান হইয়া থাকিবে, করাকর্মার ভার সব আমাদিগের উপর —আমাদিগের বটলর সাহেবের একজন দোস্ত জান সাহেব সম্প্রতি বিলাত হইতে আসিয়াছে —তাহাকেই খাড়া করিয়া তাহারই মৎসুদ্দি হইতে হইবে। সে লোকটি সৌদাগরি কর্মে ঘুন।
ঠকচাচা। মুইবি সাতে সাতে থাক্ব, মোকে আদালতে, মাল, ফৌজদারি, সৌদাগরি কোনো কাম ছাপা নাই। মোর শেনাবি এ সব ভালো সমজে। বাবু ! আপসোস এই যে মোর কারদানি এ নাগাদ নিদ যেতেচে —লেফিয়ে লেফিয়ে জাহের হল না। মুই চুপ করে থাকবার আদমি নয় দোশমন পেলে তেনাকে জেপ্টে, কেমড়ে মেটিতে পেটিয়ে দি —সৌদাগরি কাম পেলে মুই রোস্তম জালের মাফিক চলব।
মতিলাল। ঠকচাচা —শেনা কে ?
ঠকচাচা। শেনা তোমার ঠকচাচী —তেনার সেফত কি করব? তেনার সুরত জেলেখার মাফিক আর মালুম হয় ফেরেস্তার মাফিক বুজ-সমজ।
বাঞ্ছারাম। ও কথা এখন থাকুক। জান সাহেবকে দশ পনেরো হাজার টাকা সরবরাহ করিতে হইবে তাতে কিছুমাত্র জখম নাই। আমি স্থির করিয়াছি যে কোতলপুরের তালুকখানা বন্ধক দিলে ঐ টাকা পাওয়া যাইতে পারে— বন্ধকী লেখাপড়া আমাদিগের সাহেবের আপিসে করিয়া দিব —খরচ বড়ো হইবে না —আন্দাজ টাকা শ’চার-পাঁচের মধ্যে আর টাকা শ-পাঁচেক মহাজনের আমলা-ফামলাকে দিতে হইবে। সে বেটারা পুন্কে শত্রু —একটা খোঁচা দিলে কর্ম ভণ্ডুল করিতে পারে। সকল কর্মেরই অষ্টম-খষ্টম আগে মিটাইয়া নষ্ট কোষ্ঠী উদ্ধার করিতে হয়। আমি আর বড়ো বিলম্ব করিব না, ঠকচাচাকে লইয়া কলিকাতায় চলিলাম —আমার নানা বরাত —মাথায় আগুন জ্বল্ছে। বড়োবাবু ! তুমি তর্কসিদ্ধান্ত দাদার কাছে থেকে একটা ভালো দিন দেখে শীঘ্র দুর্গা দুর্গা বলিয়া যাত্রা করিয়া একেবারে আমার সোনাগাজির দরুন বাটীতে উঠিবে। কলিকাতায় কিছু দিন অবস্থিতি করিতে হইবে তার পর এই বৈদ্যবাটীর ঘাটেতে যখন চাঁদ সদাগরের মতন সাত জাঁহাজ ধন লইয়া ফিরিয়া আসিয়া দামামা বাজাইয়া উঠিবে তখন আবাল-বৃদ্ধ, যুবতী কুলকন্যা তোমার প্রত্যাগমনের কৌতুক দেখিয়া তোমাকে ধন্য ধন্য করিবে।
আহা ! এমন দিন যেন শীঘ্র উদয় হয় ! এই বলিয়া বাঞ্ছারাম ঠকচাচাকে লইয়া গমন করিলেন।
মতিলাল আপন সঙ্গীদিগকে উপরোক্ত সকল কথা আনুপূর্বিক বলিল। সঙ্গীরা শুনিয়া বগল বাজাইয়া নেচে উঠিল —তাহাদিগের রাতিব টানাটানির জন্য প্রায় বন্ধ। এক্ষণে সাবেক বরাদ্দ বহাল হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা। তাড়াতাড়ি, হুড়াহুড়ি করিয়া মানগোবিন্দ এক চোঁচা দৌড়ে তর্কসিদ্ধান্তের টোলে উপস্থিত হইয়া হাঁপ ছাড়িতে লাগল। তর্কসিদ্ধান্ত বড়ো প্রাচীন, নস্য লইতেছেন —ফেঁচ্ ফেঁচ্ করিয়া হাঁচতেছেন —খক্ খক্ করিয়া কাশতেছেন —চারিদিকে শিষ্য —সম্মুখে কয়েকখানা তালপাতায় লেখা পুস্তক —চশমা নাকে দিয়ে এক একবার গ্রন্থ দেখিতেছেন, এক একবার ছাত্রদিগকে পাঠ বলিয়া দিতেছেন। বিচলির অভাবে গোরুর জাবনা দেওয়া হয় নাই —গোরু মধ্যে মধ্যে হাম্মা হাম্মা করিতেছে —ব্রাহ্মণী বাটীর ভিতর হইতে চিৎকার করিয়া বলিতেছেন —বুড়ো হইলেই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ হয়, উনি রাতদিন পাঁজি-পুথি ঘাঁটবেন, ঘরকন্নার পানে একবার ফিরে দেখবেন না। এই কথা শিষ্যেরা শুনিয়া পরস্পর গা টেপাটেপি করিয়া চাওয়াচাওয়ি করিতেছে। তর্কসিদ্ধান্ত বিরক্ত হইয়া ব্রাহ্মণীকে থমাইবার জন্য লাঠি ধরিয়া সুড় সুড় করিয়া উঠিতেছেন এমন সময়ে মানগোবিন্দ ধরে বসিল —ওগো তর্কসিদ্ধান্ত খুড়ো ! আমরা সব সৌদাগরি করিতে যাব একটা ভালো দিন দেখে দেও।
তর্কসিদ্ধান্ত মুখ বিকটসিকট করিয়া গুমরে উঠিলেন —কচুপোড়া খাও —উঠছি আর অমনি পেচু ডাক্ছ আর কি সময় পাওনি? সৌদাগরি করতে যাবে ! তোর বাপের ভিটে নাশ হউক —তোদের আবার দিনক্ষণ কি রে ? বালাই বেরুলে সকলে হাঁপ ছেড়ে গঙ্গাস্নান করবে —যা বল্গে যা যে দিন তোরা এখান থেকে যাবি সেই দিনই শুভ।
মানগোবিন্দ মুখছোপ্পা খাইয়া আসিয়া বলিল যে কালই দিন ভালো, অমনি সাজ্ রে সাজ্ রে শব্দ হইতে লাগিল ও উদ্যোগ পর্বে ধুম বেধে গেল। কেহ সেতারার মেজ্রাপ হাতে দেয় —কেহ বাঁয়ার গাব আছে কি-না তাহা ধপ্ ধপ্ করিয়া পিটে দেখে —কেহ তবলায় চাঁটি দিয়া পরখ করে —কেহ কেহ ঢোলের কড়া টানে —কেহ বেহালায় রজন দিয়া ডাডা ডাডা করে —কেহ বোঁচকা-বুঁচকি বাঁধে —কেহ চরস-গাঁজা মায় ছুরি, কাঠ লইয়া পোঁটলা করে —কেহ ছর্রার গুলী চাটের সহিত সন্তর্পণে রাখে —কেহ পাকামালের ঘাট্তি তদারক করে। এইরূপে সারা দিন ও সারা রাত্রি ছট্ফটানি, ধড় ফড়ানি, আন, নিয়ে আয়, দেখ, শোন, ওরে, হেঁরে, সজ্জাগজ্জা, হোহাতে কেটে গেল।
গ্রামে ঢিঢিকার হইল বাবুরা সৌদাগরি করিতে চলিলেন। পর দিবস প্রভাতে যাবতীয় দোকানী, পসারী, ভিখিরী, কাঙালী ও অন্যান্য অনেকেই রাস্তায় চাহিয়ে আছে ইতিমধ্যে নববাবুরা মত্ত হস্তীর ন্যায় পৈয়িস্ পৈয়িস্ করত মস্ মস্ শব্দে ঘাটে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অনেক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত আহ্ণিক করিতেছিলেন, গোলমাল শুনিয়া পশ্চাতে দৃষ্টিপাত করিয়া একেবারে জড়সড় হইলেন। তাঁহাদিগকে ভীত দেখিয়া নববাবুরা খিল্ খিল্ করিয়া হাসিতে হাসিতে গঙ্গামৃত্তিকা ঝামা ও থুৎকুড়ি গাত্রে বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণেরা ভগ্নাহ্ণিক হইয়া গোবিন্দ গোবিন্দ করিতে করিতে প্রস্থান করিলেন। নববাবুরা নৌকায় উঠিয়া সকলে চিৎকার স্বরে এক সখীসম্বাদ ধরিলেন —নৌকা ভাঁটার জোরে সাঁ সাঁ করিয়া যাইতেছে কিন্তু বাবুরা কেহই স্থির নহেন —এ ছাতের উপর যায় ও হাইল ধরে টানে —এ দাঁড় বহে ও চকমকি নিয়ে আগুন করে। কঞ্চিৎ দূর যাইতে যাইতে ধনামালার সহিত দেখা হইল —ধনামালা বড়ো মুখর —জিজ্ঞাসা করিল গ্রামটাকে তো পুড়িয়ে খাক করলে আবার গঙ্গাকে জ্বালাচ্ছ কেন? নববাবুরা রেগে বলিল —চুপ শূয়ার —তুই জানিস নে যে আমরা সব সৌদাগরি করতে যাচ্ছি? ধনা উত্তর করিল —যদি তোরা সৌদাগর হস্ তো সৌদাগরি কর্ম গলায় দড়ি দিয়া মরুক !
২৩.
মতিলাল দলবল সমেত সোনাগাজিতে আসিয়া একজন গুরুমহাশয়কে তাড়ান, বাবুয়ানা বাড়াবাড়ি হয়, পরে সৌদাগরি করিয়া দেনার ভয়ে প্রস্থান করেন।
সোনাগাজির দরগায় কুনী বুনী বাসা করিয়াছিল —চারি দিক্ শেওলা ও বোনাজে পরিপূর্ণ —স্থানে স্থানে কাকের ও শালিকের বাসা –বাড়িতে আবার আনিয়া দিতেছে –পিলে চিঁ চিঁ করিতেছে –কোনোখানেই এক ফোঁটা চুন পড়ে নাই –রাত্রি হইলে কেবল শেয়াল-কুকুরের ডাক শোনা যাইত ও সকল স্থানে সন্ধ্যা দিত কি-না তাহা সন্দেহ। নিকটে একজন গুরুমহাশয় কতকগুলি ফরগল গলায় বাঁধা ছেলে লইয়া পড়াইতেন –ছেলেদিগের লেখাপড়া যত হউক বা না হউক, বেতের শব্দে ত্রাসে তাহাদিগের প্রাণ উড়িয়া যাইত –যদি কোনো ছেলে একবার ঘাড় তুলিত অথবা কোঁচড় থেকে এক গাল জলপান খাইত তবে তৎক্ষণাৎ তাহার পিঠে চট্ চট্ চাপড় পড়িত। মানব-স্বভাব এই যে কোনো বিষয়ে কর্তৃত্ব থাকিলে যে কর্তৃত্বটি নানারূপে প্রকাশ চাই তাহা না হইলে আপন গৌরবের লাঘব হয় –এই জন্য গুরুমহাশয় আপন প্রভুত্ব ব্যক্ত করণার্থ রাস্তার লোক জড়ো করিতেন ও লোক জড়ো হইলে তাঁহার সরদারি অশেষ বিশেষ রকমে বৃদ্ধি হইত, এ কারণ বালকদিগের যে লঘু পাপে গুরু দণ্ড হইত তাহার আশ্চার্য কি ? গুরুমহাশয়ের পাঠশালাটি প্রায় যমালয়ের ন্যায় –সর্বদাই চটাপট্, পটাপট্, গেলুম রে, মলুম রে, ও ‘গুরুমহাশয়, গুরুমহাশয় তোমার পড়ো হাজির’ এই শব্দই হইত আর কাহার নাকখত –কাহার কানমলা –কেহ ইটেখাড়া –কাহার হাতছড়ি –কাহাকেও কপিকলে লট্কানো –কাহার জলবিচাটি, একটা না একটা প্রকার দণ্ড অনবরতই হইত। সোনাগাজির গুমর কেবল গুরুমহাশয়ের দ্বারাই রাখা হইয়াছিল। কিঞ্চিৎ প্রান্তভাগে দুই-একজন বাউল থাকিত —তাহারা সমস্ত দিন ভিক্ষা করিত। সন্ধ্যার পর পরিশ্রমে অক্লান্ত হইয়া শুয়ে শুয়ে মৃদুস্বরে গান করিত। সোনাগাজির এইরূপ অবস্থা ছিল। মতিলালের শুভাগমনাবধি সোনাগাজির কপাল ফিরিয়া গেল। একেবারে ‘ঘোড়ার চিঁ হিঁ, তবলার চাঁটি, লুচি পুরির খচাখচ’, উল্লাসের কড়াংধুম রাতদিন হইতে লাগিল আর মণ্ডা-মিঠাই, গোলাপ ফুলের আতর ও চরস, গাঁজা, মদের ছড়াছড়ি দেখিয়া অনেকেই গড়াগড়ি দিতে আরম্ভ করিল। কলিকাতার লোক চেনা ভার —অনেকেই বর্ণচোরা আঁব। তাহাদিগের প্রথম এক রকম মূর্তি দেখা যায় পরে আর এক মুর্তি প্রকাশ হয়। ইহার মূল টাকা –টাকার খাতিরেই অনেক ফেরফার হয়। মনুষ্যের দুর্বল স্বভাব হেতুই ধনকে অসাধারণরূপে পূজা করে। যদি লোকে শুনে যে অমুকের এত টাকা আছে তবে কি প্রকারে তাহার অনুগ্রহের পাত্র হইবে এই চেষ্টা কায়মনোবাক্যে করে ও তজ্জন্য যাহা বলিতে বা করিতে হয় তাহাতে কিছুমাত্র ক্রটি করে না। এই কারণে মতিলালের নিকট নানা রকম লোক আসিতে আরম্ভ করিল। কেহ কেহ উলার ব্রাহ্মণের ন্যায় মুখপোড়া রকমে আপনার অভিপ্রায় একেবারে ব্যক্ত করে –কেহ-বা কৃষ্ণনগরীয়দিগের ন্যায় ঝাড় বুটা কাটিয়া মুন্শিয়ানা খরচ করে –আসল কথা অনেক বিলম্বে অতি সূক্ষ্ণরূপে প্রকাশ হয় –কেহ বা পূর্বদেশীয় বঙ্গভায়াদিগের মতো কেনিয়ে কেনিয়ে চলেন –প্রথম প্রথম আপনাকে নিষ্প্রয়াস ও নির্লোভ দেখান –আসল মতলব তৎকালে দ্বৈপায়নহ্রদে ডুবাইয়া রাখেন –দীর্ঘকালে সময়বিশেষে প্রকাশ হইলে বোধ হয় তাহার গমনাগমনের তাৎপর্য কেবল “যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্য”।
মতিলালের নিকট যে ব্যক্তি আইসে সেই হাই তুলিলে তুড়ি দেয় –হাঁচিলে “জীব” বলে। ওরে বলিলেই “ওরে ওরে” করে চীৎকার করে ও ভালোমন্দ সকল কথারই উত্তরে –”আজ্ঞা আপনি যা বলেছেন তাই বটে” এই প্রকার বলে। প্রাতঃকালাবধি রাত্রি দুই প্রহর পর্যন্ত মতিলালের নিকট লোক গস্গস্ করিতে লাগিল –ক্ষণ নাই –মুহুর্ত নাই –নিমেষ নাই –সর্বদাই নানা প্রকার লোক আসিতেছে –বসিতেছে –যাইতেছে। তাহাদিগের জুতার ফটাং ফটাং শব্দে বৈঠকখানায় সিঁড়ি কম্পমান –তামাক মুহুর্মুহুঃ আসিতেছে –ধুঁয়া কলের জাহাজের ন্যায় নির্গত হইতেছে। চাকরেরা আর তামাক সাজিতে পারে না –পালাই পালাই ডাক ছাড়িতেছে। দিবারাত্রি নৃত্য, গীত, বাদ্য, হাসিখুশি, বড়ফট্টাই, ভাঁড়ামো, নকল, ঠাট্টা, বটকেরা, ভাবের গালাগালি, আমাদের ঠেলাঠেলি –চড়ুইভাতি, বনভোজন, নেশা একাদিক্রমে চলিতেছে। যেন রাতারাতি মতিলাল হঠাৎ বাবু হইয়া উঠিয়াছেন।
এই গোলে গুরুমহাশয়ের গুরুত্ব একেবারে লঘু হইয়া গেল –তিনি পূর্বে বৃহৎ পক্ষী ছিলেন এক্ষণে দুর্গা-টুনটুনি হইয়া পড়িলেন। মধ্যে মধ্যে ছেলেদের ঘোষাইবার একটু একটু গোল হইত –তাহা শুনিয়া মতিলাল বলিলেন, এ বেটা এখানে কেন মেও মেও করে –গুরুমশায়ের যন্ত্রণা হইতে আমি বালকাকালেই মুক্ত হইয়াছি আবার গুরুমহাশয় নিকটে কেন? –ওটাকে ‘রায় বিসর্জন দাও। এই কথা শুনিবামাত্র নববাবুরা দুই-এক দিনের মধ্যেই ইট পাটকেলের দ্বারা গুরুমহশয়কে অন্তর্ধান করাইলেন সুতরাং পাঠশালা ভাঙ্গিয়া গেল। বালকেরা বাঁচলুম বলিয়া তাড়ি পাত তুলিয়া গুরুমহশয়কে ভেংচুতে ভেংচুতে ও কলা দেখাইতে দেখাইতে চোঁচা দৌড়ে ঘরে গেল।
এদিকে জান সাহেব হৌস খুলিলেন –নাম হৈল জান কোম্পানি। মতিলাল মুৎসুদ্দি, বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা কর্মকর্তা। সাহেব টাকার খাতিরে মুৎসুদ্দিকে তোয়াজ করেন ও মুৎসুদ্দি আপন সঙ্গীদিগকে লইয়া দুই প্রহর তিনটা চারিটার সময় পান চিবুতে চিবুতে রাঙা চকে এক একবার কুঠি যাইয়া দাঁদুড়ে বেড়াইয়া ঘরে আইসেন। সাহেবের এক পয়সার সঙ্গতি ছিল না –বটলর সাহেবের অন্নদাস হইয়া থাকিতেন এক্ষণে চৌরুঙ্গিতে এক বাটী ভাড়া করিয়া নানা প্রকার আসবাব ও তসবির খরিদ করিয়া বাটী সাজাইলেন ও ভালো ভালো গাড়ি, ঘোড়া ও কুকুর ধারে কিনিয়া আনিলেন এবং ঘোড়দৌড়ের ঘোড়া তৈয়ার করিয়া বাজির খেলা খেলিতে লাগিলেন। কিছু দিন পরে সাহেবের বিবাহ হইল, সোনার ওয়াচগার্ড পরিয়া ও হীরার আঙ্গুটি হাতে দিয়া সাহেব ভদ্র সমাজে ফিরিতে লাগিলেন। এই সকল ভড়ং দেখিয়া অনেকেরই সংস্কার হইল জান সাহেব ধনী হইয়াছেন, এই জন্য তাঁহার সহিত লেনদেন করণে অনেকে কিছুমাত্র সন্দেহ করিল না কিন্তু দুই-একজন বুদ্ধিমান লোক তাঁহার নিগূঢ় তত্ত্ব জানিয়া আল্গা আল্গা রকমে থাকিতে –কখনই মাখামাখি করিতে না।
কলিকাতার অনেক সৌদাগর আড়তদারিতেই অর্থ উপার্জন করে –হয়তো জাহাজের ভাড়া বিলি করে অথবা কোম্পানির কাগজ কিংবা জিনিসপত্র খরিদ বা বিক্রয় করে ও তাহার উপর ফি শতকরায় কতক টাকা আড়তদারি খরচা লয়। অন্যান্য অনেকে আপন আপন টাকায় এখানকার ও অন্য স্থানের বাজার বুঝিয়া সৌদাগরি করে কিন্তু যাহারা ঐ কর্ম করে তাহাদিগকে অগ্রে সৌদাগরি কর্ম শিখিতে হয় তা না হইলে কর্ম ভালো হইতে পারে না।
জান সাহেবের কিছুমাত্র বোধশোধ ছিল না, জিনিস খরিদ করিয়া পাঠাইলেই মুনাফা হইবে এই তাঁহার সংস্কার ছিল, ফলতঃ আসল মতলব এই পরের স্কন্ধে ভোগ করিয়া রাতারাতি বড়মানুষ হইব। তিনি এই ভাবিতেন যে সৌদাগরি সেস্ত করিয়া – দশটা গুলী মারিতে মারিতে কোনোটা না কোনোটা গুলীতে অবশ্যই শিকার পাওয়া যাইবে। যেমন সাহেব ততোধিক তাহার মুৎসুদ্দি – তিনি গণ্ডমূর্খ – না তাঁহার লেখাপড়াই বোধশোধ আছে –না বিষয়কর্মই বুঝিতে-শুঝিতে পারেন সুতরাং তাহাকে দিয়া কোনো কর্ম করানো কেবল গো-বধ করা মাত্র। মহাজন, দালাল ও সরকারেরা সর্বদাই তাঁহার নিকট জিনিসপত্রের নমুনা লইয়া আসিত ও দর-দামের ঘাটতি-বাড়তি এবং বাজারের খবর বলিত। তিনি বিষয়কর্মের কথার সময়ে ঘোর বিপদে পড়িয়া ফেল্ ফেল্ করিয়া চাহিয়া থাকিতেন – সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন না – কি জানি কথা কহিলে পাছে নিজের বিদ্যা প্রকাশ হয়, কেবল এইমাত্র বলিতেন যে, বাঞ্ছারাম বাবু ও ঠকচাচার নিকট যাও।
আপিসে দুই-একজন কেরানী ছিল, তাহারা ইংরেজীতে সকল হিসাব রাখিত। একদিন মতিলালের ইচ্ছা হইল যে ইংরাজী ক্যাশবহি বোঝা ভালো, এজন্য কেরানীর নিকট হইতে চাহিয়া আনাইয়া একবার এদিক-ওদিক দেখিয়া বহিখানি এক পাশে রাখিয়া দিলেন। মতিলাল আপীসের নীচের ঘরে বসিতেন – ঘরটি কিছু সেতঁসেতেঁ – ক্যাশবহি সেখানে মাসাবধি থাকাতে সর্দিতে খারাব হইয়া গেল ও নববাবুরা তাহা হইতে কাগজ চিরিয়া লইয়া সলতের ন্যায় পাকাইয়া প্রতিদিন কান চুলকাইতে আরম্ভ করিলেন – অল্প দিনের মধ্যেই বহির যাবতীয় কাগজ ফুরাইয়া গেল কেবল মিলাটটি পড়িয়া রহিল। অনন্তর ক্যাশবহির অন্বেষণ হওয়াতে দৃষ্ট হইল যে, তাহার ঠাটখানা আছে, অস্থি ও চর্ম পরহিতার্থে প্রদত্ত হইয়াছে। জান সাহেব হা ক্যাশবহি জো ক্যাশবহি বলিয়া বিলাপ করত মনের খেদ মনেই রাখিলেন।
জান সাহেব বেধড়ক ও দুচকোব্রত জিনিসপত্র খরিদ করিয়া বিলাতে ও অন্যান্য দেশে পাঠাইতে আরম্ভ করিলেন –জিনিসের কি পরতা হইল ও কাটতি কি রূপ হইবে তাহার কিছুমাত্র খোঁজ-খবর করিতেন না। এই সুযোগ পাইয়া বাঞ্ছারাম ও ঠকচাচা চিলের ন্যায় ছোবল মারিতে লাগিলেন, তাহাতে তাহাদিগের পেট মোটা হইল –অল্পে তৃষ্ণা মেটে না –রাতদিন খাই-খাই শব্দ ও আজ হাতীশালার হাতী খাব, কাল ঘোড়াশালার ঘোড়া খাব, দুইজনে নির্জনে বসিয়া কেবল এই মতলব করিতেন। তাঁহারা ভালো জানিতেন যে তাঁহাদিগের এমন দিন আর হইবে না –লাভের বসন্ত অস্ত হইয়া অলাভের হেমন্ত শীঘ্রই উদয় হইবে অতএব নে থোরই সময় এই।
দুই-এক বৎসরের মধ্যেই জিনিসপত্রের বিক্রির বড়ো মন্দ খবর আইল –সকল জিনিসেতেই লোকসান বই লাভ নাই। জান সাহেব দেখিলেন যে লোকসান প্রায় লক্ষ টাকা হইবে –এই সংবাদে বুকদাবা পাইয়া তাঁহার একেবারে চক্ষুস্থির হইয়া গেল আর তিনি মাসে মাসে প্রায় এক হাজার টাকা করিয়া খরচ করিয়াছেন, তদ্ব্যতিরেকে বেঙ্কে ও মহাজনের নিকটও অনেক দেনা –আপিস কয়েক মাসাবধি তলগড় ও ঢালসুমরে চলিতেছিল এক্ষণে বাহিরে সম্ভ্রমের নৌকা একেবারে ধুপুস্ করিয়া ডুবে গেল, প্রচার হইল যে জান কোম্পানী ফেল হইল। সাহেব বিবি লইয়া চন্দননগরে প্রস্তান করিলেন। ঐ শহর ফরাসীদিগের অধীন –অদ্যাবধি দেনাদার ফৌজদারি মামলার আসামীরা কয়েদের ভয়ে ঐ স্থানে যাইয়া পলাইয়া থাকে।
এদিকে মহাজন ও অন্যান্য পাওনাওয়ালারা আসিয়া মতিলালকে ঘেরিয়া বসিল। মতিলাল চারিদিক শূন্য দেখিতে লাগিলেন –এক পয়সাও হাতে নাই –উট্নাওয়ালাদিগের নিকট হইতে উট্না লইয়া তাঁহার খাওয়া-দাওয়া চলিতেছিল এক্ষণে কি বলবেন ও কি করিবেন কিছুই ঠাওরাইয়া পান না, মধ্যে মধ্যে ঘাড় উঁচু করিয়া দেখেন বাঞ্ছারামবাবু ও ঠকচাচা আইলেন কি-না, কিন্তু দাদার ভরসায় বাঁইয়ে ছুরি, ঐ দুই অবতার তুলতামালের অগ্রেই চম্পট দিয়াছেন। তাহাদিগের নাম উল্লেখ হইলে পাওনাওয়ালারা বলিল যে চিঠিপত্র মতিবাবুর নামে, তাহাদিগের সহিত আমাদিগের কোনো এলেকা নাই, তাহারা কেবল কারপরদাজ বই তো নয়।
এইরূপ গোলযোগ হওয়াতে মতিলাল দলবল সহিত ছদ্মবেশে রাত্রিযোগে বৈদ্যবাটীতে পালাইয়া গেলেন। সেখানকার যাবতীয় লোক তাঁহার বিষয়কর্মের সাত কাণ্ড শুনিয়া খুব হয়েছে খুব হয়েছে বলিয়া হাততালি দিতে লাগিল ও বলিল –আজও রাতদিন হচ্ছে –যে ব্যক্তি এমতো অসৎ –যে আপনার মাকে ভাইকে ভগিনীকে বঞ্চনা করিয়াছে –পাপকর্মে কখনই বিরত হয় নাই, তাহার যদি এরূপ না হবে তবে আর ধর্মাধর্ম কি ?
কর্মক্রমে প্রেমনারায়ণ মজুমদার পরদিন বৈদ্যবাটীর ঘাটে স্নান করিতেছিল –তর্কসিদ্ধান্তকে দেখিয়া বলিল –মহাশয় শুনেছেন –বিট্কেলরা সর্বস্ব খুয়াইয়া ওয়ারিণের ভয়ে আবার এখানে পালিয়ে আসিয়াছে –কালামুখ দেখাইতে লজ্জা হয় না ! বাবুরাম ভালো মুষলং কুলনাশনং রাখিয়া গিয়াছেন। তর্কসিদ্ধান্ত কহিলেন –ছোড়াদের না থাকতে গ্রামটা জুড়িয়ে ছিল –আবার ফিরে এল? আহা ! মা গঙ্গা একটু কৃপা করলে যে আমরা বেঁচে যাইতাম। অন্যান্য অনেক ব্রাহ্মণ স্নান করিতেছিলেন –নববাবুদিগের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া তাঁহাদিগের দাঁতে দাঁতে লেগে গেল, ভাবিতে লাগিলেন যে আমাদিগের স্নান-আহ্ণিক বুঝি অদ্যাবধি শ্রীকৃষ্ণায় অর্পণ করিতে হইবে। দোকানী পসারীরা ঘাটের দিকে দেখিয়া বলিল –কই গো। আমরা শুনিয়াছিলাম যে মতিবাবু সাত সুলুক ধন লইয়া দামামা বাজিয়ে উঠিবেন –এমন সুলুক দূরে যাউক একখানা জেলে ডিঙিও যে দেখতে পাই না। প্রেমনারায়ণ বলিল –তোমরা ব্যস্ত হইও না –মতিবাবু কমলে কামিনীর মুশকিলের দরুন দক্ষিণ মশান প্রাপ্ত হইয়াছেন –বাবু অতি ধর্মশীল –ভগবতীর বরপুত্র –ডিঙে সুলুক ও জাহাজ ত্বরায় দেখা দিবে আর তোমরা মুড়ি কড়াই ভাজিতে ভাজিতেই দামামার শব্দ শুনিবে !
২৪.
শুদ্ধ চিত্তের কথা, ঠকচাচার জালকরণ জন্য গেরেপ্তারি –বরদাবাবুর দুঃখ, মতিলালের ভয়; বেচারাম ও বাঞ্ছারাম উভয়ের সাক্ষাৎ ও কথোপকথন।
প্রাতঃকালে মন্দ মন্দ বায়ু বহিতেছে, –চম্পক, শেফালিকা ও মল্লিকার সৌগন্ধ ছুটিয়াছে। পক্ষিসকল চকুবুহ চকুবুহ করিতেছে –ঘটকের দরুনবাটীতে বেণীবাবু বরদাবাবুকে লইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন। দক্ষিণ দিক থেকে কতকগুলো কুকুর ডাকিয়া উঠিল ও রাস্তার ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল –গোল একটু নরম হইলে “দূঁর দূঁর” ও “গোপীদের বাড়ি যেও না করি রে মানা” এই খোনা স্বরের আনন্দলহরী কর্ণগোচর হইতে লাগিল। বেণীবাবু ও বরদাবাবু উঠিয়া দেখেন যে বহুবাজারের বেচারামবাবু আসিতেছেন –গানে মত্ত, ক্রমাগত তুড়ি দিতেছেন। কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করিতেছে –ছোঁড়ারা হো হো করিতেছে, বহুবাজারনিবাসী বিরক্ত হইয়া দূঁর দূঁর করিতেছেন। নিকটে আসিলে বেণীবাবু ও বারদাবাবু উঠিয়া সম্মানপূর্বক অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন। পরস্পর কুশলবার্তা জিজ্ঞাসানন্তর বেচারামবাবু বারদাবাবুর গায়ে হাত দিয়া বলিলেন –ভাই হে। বাল্যাবধি অনেক প্রকার লোক দেখিলাম –অনেকেরই অনেক গুণ আছে বটে কিন্তু তাহাদিগকে দোষে-গুণে ভালো বালি –সে যাহা হউক, নম্রতা, সরলতা, ধর্ম বিষয়ে সাহস ও পর সম্পর্কীয় শুদ্ধচিত্ত তোমার যেমন আছে এমন কাহারও দেখিতে পাই না। আমি নিজে নম্রভাবে বলি বটে কিন্তু সময়বিশেষ অন্যের অহংকার দেখিলে আমার অহংকার উদয় হয় –অহংকার উদয় হইলেই রাগ উপস্থিত হয়, রাগে অহংকার বেড়ে উঠে। আমি কাহাকেও রেয়াত করি না –যখন যাহা মনে উদয় হয় তখন তাহাই মুখে বলি কিন্তু আমার নিজের দোষে তত সরলতা থাকে না –আপনি কোনো মন্দ কর্ম করিলে সেটি স্পষ্ট স্বীকার করিতে ইচ্ছা হয় না, তখন এই মনে হয় এ কথাটি ব্যক্ত করিলে অন্যের নিকট আপনাকে খাটো হইতে হইবে। ধর্ম বিষয়ে আমার সাহস অতি অল্প –মনে ভালো জানি অমুক কর্ম করা কর্তব্য কিন্তু আপন সংস্কার অনুসারে সর্বদা চলাতে সাহসের অভাব হয়। অন্য সম্বন্ধে শুদ্ধচিত্ত রাখা বড়ো কঠিন –আমি জানি বটে যে মনুষ্যদেহ ধারণ করিলে মনুষ্যের ভালো বই মন্দ কখনই চেষ্টা পাওয়া উচিত নহে কিন্তু এটি কর্মেতে দেখানো বড় দুষ্কর। যদি কেহ একটু কটু কথা বলে তবে তাহার প্রতি আর মন থাকে না –তাহাকে একেবারে মন্দ মনুষ্য বোধ হয় –তোমার কেহ অপকার করিলেও তাহার প্রতি তোমার মন শুদ্ধ থাকে –অর্থাৎ তাহার উপকার ভিন্ন অপকার করণে তোমার মন যায় না এবং যদি অন্যে তোমার নিন্দা করে তাহাতেও তুমি বিরক্ত হও না –এ কি কম গুণ ?
বরদা। যে যাহাকে ভালবাসে সে তাহার সব ভালো দেখে আর যে যাহাকে দেখিতে পারে না সে তাহার চলনও বাঁকা দেখে। আপনি যাহা বলিলেন সে সকল অনুগ্রহের কথা –সে সকল আপনার ভালবাসার দরুন –আমার নিজ গুণের দরুন নহে। সকল সময়ে –সকল বিষয়ে –সকল লোকের প্রতি মন শুদ্ধ রাখা মনুষ্যের প্রায় অসাধ্য। আমাদিগের মনে রাগ, দ্বেষ, হিংসা ও অহংকারে ভরা –এ সকল সংযম কি সহজে হয় ? চিত্তকে শুদ্ধ করিতে গেলে অগ্রে নম্রতা আবশ্যক –কাহার কাহার কপট নম্রতা দেখা যায় –কেহ কেহ ভয়প্রযুক্ত নম্র হয় –কেহ কেহ ক্লেশ অথবা বিপদে পড়িলে নম্র হইয়া থাকে –সে প্রকার নম্রতা ক্ষণিক, নম্রতার স্থায়িত্বের জন্য আমাদিগের মনে এই দৃঢ় সংস্কার হওয়া উচিত যিনি সৃষ্টিকর্তা তিনিই মহৎ -তিনিই জ্ঞানময় –তিনিই নিষ্কলঙ্ক ও নির্মল, আমরা আজ আছি –কাল নাই, আমাদিগের বলই বা কি, আর বুদ্ধিই বা কি –আমাদিগের ভ্রম, কুমতি ও কুকর্ম দণ্ডে দণ্ডে হইতেছে তবে অহংকারের কারণ কি ? এরূপ নম্রতা মনে জন্মিলে রাগ, দ্বেষ, হিংসা ও অহংকারের খর্বতা হইয়া আসে, তখন অন্য সমন্ধে শুদ্ধচিত্ত হয় –তখন আপন বিদ্যা, বুদ্ধি, ঐশ্বর্য ও পদের অহংকার প্রকাশ করত পরকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা যায় না –তখন পরের সম্পদ দেখিয়া হিংসা হয় না –তখন পরনিন্দা করিতে ও অন্যকে মন্দ ভাবিতে ইচ্ছা হয় না –তখন অন্যদ্বারা অপকৃত হইলেও তাহার প্রতি রাগ বা দ্বেষ উপস্থিত হয় না –তখন কেবল আপন চিত্ত শোধনে ও পরহিত সাধনে মন রত হয়, কিন্তু এরূপ হওয়া ভারি অভ্যাস ভিন্ন হয় না –এক্ষণে অল্প জ্ঞানযোগ হইলেই বিজাতীয় মাৎসর্য জন্মে –আমি যা বলি –আমি যা করি কেবল তাহাই সর্বোত্তম –অন্যে যা বলে বা করে তাহা অগ্রাহ্য।
বেচারাম। ভাই হে ! কথাগুলা শুনে প্রাণ জুড়ায় –আমার সতত ইচ্ছা তোমার সহিত কথোপকথন করি।
এইরূপ কথাবার্তা হইতেছে ইতিমধ্যে প্রেমানারায়ণ মজুমদার তাড়াতারি করিয়া আসিয়া সম্বাদ দিল কলিকাতার পুলিসের লোকেরা এক জাল তহমতের মামলার দরুন ঠকচাচাকে গ্রেপ্তার করিয়া লইয়া যাইতেছে। বেচারামবাবু এই কথা শুনিয়া খুব হয়েছে খুব হয়েছে বলিয়া হর্ষিত হইয়া উঠিলেন। বরদাবাবু স্তব্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিলেন।
বেচারাম। আবার যে ভাবছ ? –অমন অসৎ লোক পুলিপলান গেলা দেশটা জুড়ায়।
বরদা। দুঃখ এই যে লোকটা আজন্মকাল অসৎ কর্ম বই সৎ কর্ম করিল না –এক্ষণে যদি জিঞ্জির যায় তাহার পরিবারগুলা অনাহারে মারা যাবে।
বেচারাম। ভাই হে ! তোমার এত গুণ না হইলে লোকে তোমাকে কেন পূজা করে। তোমার প্রতিহিংসা ও অপকার করিতে ঠকচাচা কসুর করে নাই –অনবরত নিন্দা ও গ্লানি করিতে –তোমার উপর গুমখুনি নালিশ করিয়াছিল –ও জাল হপ্তম করিবার বিশেষ চেষ্টা পাইয়াছিল –তাহাতেও তোমার মনে তাহার প্রতি কিছুমাত্র রাগ অথবা দ্বেষ নাই ও প্রত্যুপকার কাহাকে বলে তুমি জানো না –তুমি এই প্রত্যুপকার করিতে যে, সে ব্যক্তি ও তাহার পরিবার পীড়ত হইলে ঔষধ দিয়া ও আনাগোনা করিয়া আরোগ্য করিত। এক্ষণেও তাহার পরিবারের ভাবনা ভাবিতেছ –ভাই হে ! তুমি জেতে কায়স্থ বটে কিন্তু ইচ্ছা করে যে এমন কায়স্থের পায়ের ধুলা লইয়া মাথায় দিই।
বরদা। মহাশয় ! আমাকে এত বলিবেন না –জনগণের মধ্যে আমি অতি হেয় ও অকিঞ্চন। আমি আপনার প্রশাংসার যোগ্য নহি –মহাশয় এরূপ পুনঃ পুনঃ বলিলে আমার অহংকার ক্রমে বৃদ্ধি হইতে পারে।
এদিকে বৈদ্যবাটীতে পুলিসের সারজন্, পেয়াদা ও দারোগা ঠকচাচাকে পিচ্মোড়া করিয়া বাঁধিয়া চল্ বলিয়া হিড় হিড় করিয়া লইয়া আসিতেছে। রাস্তায় লোকারণ্য –কেহ বলে, যেমন কর্ম তেমনি ফল –কেহ বলে, বেটা জাহাজে না উঠলে বিশ্বাস নাই –কেহ বলে, আমার এই ভয় পাছে ঢোঁড়া হয়। ঠকচাচা অধোবদনে চলিতেছে –দাড়ি বাতাসে ফুর ফুর করিয়া উড়িতেছে –দুটি চক্ষু কট্মট্ করিতেছে –বাঁধন খুলিবার জন্য সারজন্কে একটা আদুলি আস্তে আস্তে দিতেছে, সারজনের বড়ো পেট, এমনি আদুলি ঠিকুরে ফেলিয়া দিতেছে। ঠকচাচা বলে –মোকে একবার মতিবাবুর নজদিগে লিয়ে চলো –তেনার জামিন লিয়ে মোকে এজ খালস দেও –মুই কেল হাজির হব। সারজন্ বলছে –তোম বহুৎ বক্তা –ফের বাত কহেগা তো এক থাপ্পড় দেগা। তখন ঠকচাচা সারজনের নিকট হাতজোড় করিয়া কাকুতি মিনতি করিতে লাগিল। সারজন কোনো কথায় কান না দিয়ে ঠকচাচাকে নৌকায় উঠাইয়া বেলা দুই প্রহর চারি ঘণ্টার সময় পুলিসে আনিয়া হাজির করিল –পুলিসের সাহেবেরা উঠিয়া গিয়াছে সুতরাং ঠকচাচাকে রাত্রিতে বেনিগারদে বিহার করিতে হইল।
ওদিকে ঠকচাচার দুর্গতি শুনিয়া মতিলালের ভেবা-চাকা লেগে গেল। তাহার এই আশঙ্কা হইল এ বজ্রাঘাত পাছে এ পর্যন্ত পড়ে –যখন ঠক বাঁধা গেল তখন আমিও বাঁধা পড়িব তাহাতে সন্দেহ নাই –বোধ হয় এ ব্যাপার জান কোম্পানির ঘটিত, সে যাহা হউক, সাবধান হওয়া উচিত, এই স্থির করিয়া মতিলাল বাটীর সদর দরওয়াজা খুব কষে বন্ধ করিল। রামগোবিন্দ বলিল –বড়োবাবু ! ঠকচাচা জাল এত্তাহামে গেরেপ্তার হইয়াছে –তোমার উপর, গেরেপ্তারি থাকিলে বাটীঘর অনেকক্ষণ ঘেরা হইত, তুমি মিছে মিছে কেন ভয় পাও ? মতিলাল বলিল –তোমরা বুঝ না হে ! দুঃসময়ে পোড়া শোল মাছটাও হাত থেকে পালিয়ে যায়। আজকের দিনটা যো সো করিয়া কাটাইতে পারিলে কাল প্রাতে যশোহরের তালুকে প্রস্থান করি। বাটীতে আর তিষ্ঠনো ভার –নানা উৎপাত –নানা ব্যাঘাত –নানা আশঙ্কা –নানা উপদ্রব, আর এদিকে হাত খাঁকতি হইয়াছে। এই কথা শেষ হইবামাত্রেই দ্বারে টিপ্ টিপ্ করিয়া ঘা পড়িতে লাগিল –”দ্বার খোলো গো –কে আছে গো” এই শব্দ হইতে লাগিল। মতিলাল আস্তে আস্তে বলিল –চুপ করো –যাহা ভাবিয়াছিলাম তাহাই ঘটিল। মানগোবিন্দ উপর থেকে উঁকি মারিয়া দেখিল একজন পেয়াদা দ্বার ঠেলিতেছে –অমনি টিপেটিপে আসিয়া বলিল –বড়োবাবু ! এই বেলা প্রস্থান করো, বোধ হয় ঠকচাচা দরুন বাসী গেরেপ্তারি উপস্থিত –আগুনের ফিনকি শেষ হয় নাই। যদি নির্জন স্থান না পাও তবে খিড়কির পানা পুষ্করিণীতে দুর্যোধনের ন্যায় জলস্তম্ভ করে থাকো। দোলগোবিন্দ বলিল –তোমরা ঢেউ দেখে লা ডুবাও কেন ? আগে বিষয়টা তলিয়ে বুঝ, বোসো আমি জিজ্ঞাসা করি –কেমন হে পেয়াদাবাবু তুমি কোন্ আদালত হইতে আসিয়াছ ? পেয়াদা বলিল –এজ্ঞে মুই জান সাহেবের চিঠি লিয়ে এসেছি –চিঠি এই লেও –বলিয়া ধাঁ করিয়া উপরে ফেলিয়া দিল। রাম বাঁচলুম ! এতক্ষণে ধরে প্রাণ এল –সকলে বলিয়া উঠিল। অমনি পেছন দিক থেকে হলধর ও গদাধর “ভবে ত্রাণ করো” ধরিয়া উঠিল, নববাবুদের শরতের মেঘের ন্যায় –এই বৃষ্টি –এই রৌদ্র –এই গর্মি –এই খুশি। মতিলাল বলিল, একটু থামো –চিঠিখানা পড়িতে দেও –বোধ করি কর্মকাজের আবার সুযোগ হইবে। মতিলাল চিঠি খুলিলে পরে নববাবুরা সকলে হুমড়ি খাইয়া পড়িল –অনেকগুলো মাথা জড়ো হইল বটে কিন্তু কাহারো পেটে কালির অক্ষর নাই, চিঠি পড়া ভারি বিপত্তি হইল। অনেকক্ষণ পরে নিকটস্থ দে-দের বাটীর একজনকে ডাকাইয়া চিঠির মর্ম এই জানা হইল যে, জান সাহেবের প্রায় অনাহারে দিন যাইতেছে –তাহার টাকার বড়ো দরকার। মানগোবিন্দ বলিল –বেটা বড়ো বেহায়া –তাহার জন্যে এত টাকা গর্ভস্রাবে গেল তবু ছিড়েন নাই, আবার কোন মুখে টাকা চায় ? দোলগোবিন্দ বলিল –ইংরাজকে হাতে রাখা ভালো –ওদের পাতা চাপা কপাল –সময় বিশেষে মাটি মুটটা ধরিলে সোনা মুটটা হইয়া পড়ে। মতিলাল বলিল –তোমরা বকাবকি কেন করো আমাকে কাটিলেও রক্ত নাই –কুটিলেও মাংস নাই।
এখানে বালি হইতে বেচারামবাবু পার হইয়া বৈকালে ছক্ড়া গাড়িতে ছড়র ছড়র শব্দে “সেই যে ভস্মমাখা জটে –যত দেখো ঘটে পটে সকল জটের মুটে” এই গান গাইতে গাইতে উত্তরমুখো চলিয়াছেন –দক্ষিণ দিক থেকে বাঞ্ছারাম বগি হাঁকাইয়া আসিতেছেন –দুইজনে নেক্টা-নেক্টি হওয়াতে ইনি ওঁকে ও উনি একে হুমড়ি খাইয়া দেখিলেন –বাঞ্ছারাম বেচারামের আবছায়া দেখিবা মাত্রেই ঘোড়াকে সপাসপ্ চাবুক কষিয়া দিলেন –বেচারাম অমনি তাড়াতাড়ি আপন গাড়ির ডল্কা দ্বার হাত দিয়া কষে ধরিয়া ও মাথা বাহির করিয়া “ওহে বাঞ্ছারাম ! ওহে বাঞ্ছারাম !” বলিয়া চিৎকার করিতে লাগিলেন। এই ডাকাডাকি, হাঁকাহাঁকিতে বগি খাড়া হইল ও ছক্ড়া ছননন্ ছননন্ করিয়া নিকটে গেল। বেচারামবাবু বলিলেন –বাঞ্ছারাম ! কপালে পুরুষ –তোমার লাভের খুলি রাবণের চুলির মতো জ্বলছে –এক দফা তো সৌদাগরি কর্ম চৌচাপটে করলে –এক্ষণে তোমার ঠকচাচা যায় –বোধ হয় তাহাতেও আবার একটা মুড়ি পট্তে পারে –কেবল উকিলি ফন্দিতে অধঃপাতে গেলে –মরিতে যে হবে –সেটা একবারও ভাবলে না ?
বাঞ্ছারাম বিরক্ত হইয়া মুখখানা গোঁজ করিলে পর গোঁপ জোড়াটা ফর ফর করিয়া ঘোড়ার পিটের উপর আপনার গায়ের জ্বালা প্রকাশ করিতে করিতে গড়্ গড়্ করিয়া চলিয়া গেলেন।
২৫.
মতিলালের যশোহর জমিদারিতে দলবল সহিত গমন –জমিদারী কর্মকরণের বিবরণ; নীলকরের সঙ্গে দাঙ্গা ও বিচারে নীলকরের খালাস।
বাবুরামবাবুর সকল বিষয় অপেক্ষা যশোহরের তালুকখানি লাভের বিষয় ছিল। দশসালা বন্দোবস্তের সময়ে ঐ তালুকে অনেক পতিত জমি থাকে –তাহার জমা ডৌলে মুসমা ছিল পরে ঐ সকল জমি হাঁসিল হইয়া মাঠ-হারে বিলি হয় ও ক্রমেই জমির এত গুমর হইয়াছিল যে, প্রায় এক কাঠাও খামার বা পতিত ছিল না, প্রজালোকও কিছুদিন চাষাবাদ করিয়া হরবিরূ ফসলের দ্বারা বিলক্ষণ যোত্র করিয়াছিল কিন্তু ঠকচাচার পরামর্শে অনেকের উপর পীড়ন হওয়াতে প্রজারা সিকস্ত হইয়া পড়িল –অনেকে লাখেরাজদারের জমি বাজেয়াপ্ত হওয়াতে ও তাহাদিগের সনন্দ না থাকাতে
তাহারা কেবল আনাগোনা করিয়া ও নজর সেলামী দিয়া ক্রমে ক্রমে প্রস্থান করিল ও অনেক গাঁতিদারও জাল ও জুলুমে ভাজাভাজা হইয়া বিনি মূল্যে আপন আপন জমির স্বত্ব ত্যাগ করত অন্য অন্য অধিকারে পলায়ন করিল। এই কারণে তালুকের আয় দুই-এক বৎসর বৃদ্ধি হওয়াতে ঠকচাচা গোঁপে চাড়া দিয়া হাত ঘুরাইয়া বাবুরামবাবুর নিকট বলিতেন –”মোর কেমন কারদানি দেখো” কিন্তু “ধর্মস্য সূক্ষ্মা গতিঃ” –অল্পদিনের মধ্যেই অনেক প্রজা ভয়ক্রমে হেলে গোরু ও বীজধান লইয়া প্রস্থান করিল। তাহাদিগের জমি বিলি করা ভার হইল, সকলেরই মনে এই ভয় হইতে লাগিল আমরা প্রাণপণ পরিশ্রমে চাষাবাস করিব দু-টাকা দু-সিকি লাভ করিয়া যে একটু শাঁসালো হবে তাহাকেই জমিদার বল বা ছলক্রমে গ্রাস করবেন –তবে আমাদিগের এ অধিকার থাকার কি প্রয়োজন ? তালুকের নায়েব বাপু-বাছা বলিয়াও প্রজালোককে থামাইতে পারিল না। অনেক জমি গরবিলি থাকিল –ঠিকে হারে বিলি হওয়া দূরে থাকুক কম দস্তুরেও কেহ লইতে চাহে না ও নিজ আবাদে খরচ খরচা বাদে খাজনা উঠানো ভার হইল। নায়েব সর্বদাই জমিদারকে এত্তেলা দিতেন, জমিদার সুদামতো পাঠ লিখিতেন –”গোগেস্তা সুরত খাজনা আদায় না হইলে তোমার রুটি যাইবে –তোমার কোনো ওজর শুনা যাইবে না।” সময়বিশেষ বিষয় বুঝিয়া ধমক দিলে কর্মে লাগে। যে স্থলে উৎপাত ধমকের অধিন নহে সে স্থলে ধমক কি কর্মে আসিতে পারে ? নায়েব ফাঁপরে পড়িয়া গয়ং গচ্ছরূপে আমতা আমতা করিয়া চলিতে লাগিল –এদিকে মহল দুই-তিন বৎসর বাকি পড়াতে লাটবন্দী হইল সুতরাং বিষয় রক্ষার্থে গিরিবি লিখিয়া দিয়া বাবুরামবাবু দেনা করিয়া সরকারের মালগুজারি দাখিল করিতেন।
এক্ষণে মতিলাল দলবল সহিত মহলে আসিয়া অবস্থিতি করিল। তাহার মানস এই যে, তালুক থেকে কষে টাকা আদায় করিয়া দেনা-টেনা পরিশোধ করিয়া সাবেক ঠাট বজায় রাখিবে। বাবু জমিদারী কাগজ কখন দৃষ্টি করেন নাই, কাহাকে বলে চিঠা, কাহাকে বলে গোসোয়ারা, কাহাকে বলে জমাওয়াসিল বাকি কিছুই বোধ নাই। নায়েব বলে –হুজুর ! একবার লতাগুলান দেখুন –বাবু কাগজের লতার উপর দৃষ্টি না করিয়া কাছারিবাটীর তরুলতার দিকে ফেল্ ফেল্ করিয়া দেখে ! নায়েব বলে, মহশয় ! এক্ষণে গাঁতি অর্থাৎ খোদকস্তা প্রজা এত ও পাইকস্তা এত। বাবু বলেন― আমি খোদকস্তা, পাইকস্তা শুনতে চাই না –আমি সব এককস্তা করিব। বড়োবাবু ডিহির কাছারিতে আসিয়াছেন এই সংবাদ শুনিয়া যাবতীয় প্রজা একেবারে ধেয়ে আইল ও মনে করিল বদ্জাত নেড়ে বেটা গিয়েছে, বুঝি এত দিনের পর আমাদিগের কপাল ফিরিল। এই কারণে আহ্লাদিতচিত্তে ও সহাস্যবদনে রুক্ষচুলো, শুখনোপেটা ও তলাখাঁক্তি প্রজারা নিকটে আসিয়া সেলামী দিয়া “রবধান” ও “স্যালাম” করিতে লাগিল। মতিলাল ঝনাঝন্ শব্দে স্তুব্ধ হইয়া লিক্ লিক্ করিয়া হাসিতেছেন। বাবুকে খুশি দেখিয়া প্রজারা দাদ্খাই করিতে আরম্ভ করিল। কেহ বলে, অমুক আমার জমির আল ভাঙিয়া লাঙ্গল চষিয়াছে –কেহ বলে, অমুক আমার খেজুরগাছে ভাঁড় বাঁধিয়া রস চুরি করিয়াছে –কেহ বলে, অমুক আমার বাগানে গোরু ছাড়িয়া দিয়া তচ্নচ্ করিয়াছে –কেহ বলে, অমুকের হাঁস আমার ধান খাইয়াছে –কেহ বলে, আমি আজ তিন বৎসর কবজ পাই না –কেহ বলে, আমি খতের টাকা আদায় করিয়াছি, আমার খত ফেরত দাও –কেহ বলে –আমি বাবলা গাছটি কেটে বিক্রি করিয়া ঘরখানি সারাইব –আমাকে চৌট মাফ করিতে হুকুম হউক –কেহ বলে, আমার জমির খারিজ দাখিল হয় নাই আমি তার সেলামি দিতে পারিব না –কেহ বলে, আমার জোতের জমি হাল জরিপে কম হইয়াছে –আমার খজনা মুসমা দেও, তা না হয় তো পরতাল করে দেখো –মতিলাল এ সকল কথার বিন্দু বিসর্গ না বুঝিয়া চিত্রপুত্তলিকার ন্যায় বসিয়া থাকিলেন। সঙ্গী বাবুরা দুই-একটা অন্খা শব্দ লইয়া রঙ্গ করত খিল্ খিল্ হাসিয়া কাছারিবাটী ছেয়ে দিতে লাগিল ও মধ্যে মধ্যে “উড়ে যায় পাখী তার পাখা গুণি” গান করিতে লাগিল। নায়েব একেবারে কাষ্ঠ, প্রজারা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া পড়িল।
যেখানে মনিব চৌকস, সেখানে চাকরের কারিকুরি বড়ো চলে না। নায়েব মতিলালকে গোমুর্খ দেখিয়া নিজমূর্তি ক্রমে ক্রমে প্রকাশ করিতে লাগিল। অনেক মামলা উপস্থিত হইল, বাবু তাহার ভিতর কিছুই প্রবেশ করিতে পারিলেন না, নায়েব তাঁহার চক্ষে ধুলা দিয়া আপন ইষ্ট সিদ্ধ করিতে লাগিল আর প্রজারাও জানিল যে, বাবুর সহিত দেখা করা কেবল অরণ্যে রোদন করা –নায়েবই সর্বময় কর্তা।
যশোহরে নীলকরের জুলুম অতিশয় বৃদ্ধি হইয়াছে। প্রজারা নীল বুনিতে ইচ্ছুক নহে কারণ ধান্যাদি বোনাতে অধিক লাভ, আর যিনি নীলকরের কুঠিতে যাইয়া একবার দাদন লইয়াছেন, তাহার দফা একেবারে রফা হয়। প্রজারা প্রাণপণে নীল আবাদ করিয়া দাদনের টাকা পরিশোধ করে বটে কিন্তু হিসাবের লাঙ্গুল বৎসর বৃদ্ধি হয় ও কুঠেলের গোমস্তা ও অন্যান্য কারপরদাজের পেট অল্পে পুরে না। এইজন্য যে প্রজা একবার নীলকরের দাদনের সুধামৃত পান করিয়াছে সে আর প্রাণান্তে কুঠির মুখো হইতে চায় না কিন্তু নীলকরের নীল না তৈয়ার হইলে ভারি বিপত্তি। সম্বৎসর কলিকাতার কোনো না কোনো সৌদাগরের কুঠি হইতে টাকা কর্জ লওয়া হইয়াছে এক্ষণে যদ্যপি নীল তৈয়ার না হয় তবে কর্জ বৃদ্ধি হইবে ও পরে কুঠি উঠিয়া গেলেও যাইতে পারিবে। অপর যে সকল ইংরাজ কুঠির কর্ম কাজ দেখে তাহারা বিলাতে অতি সামান্য লোক কিন্তু কুঠিতে শাজাদার চেলে চলে –কুঠির কর্মের ব্যাঘাত হইলে তাহদিগের এই ভয় যে, পাছে তাহাদিগের আবার ইঁদুর হইতে হয়। এই কারণে নীল তৈয়ার করণার্থ তাহারা সর্বপ্রকারে, সর্বতোভাবে, সবসময়ে যত্নবান হয়।
মতিলাল সঙ্গীগণকে লইয়া হো হো করিতেছেন –নায়েব নাকে চশমা দিয়া দপ্তর খুলিয়া লিখিতেছে ও চুনো বুলাইতেছে, এমতো সময়ে কয়েকজন প্রজা দৌড়ে আসিয়া চিৎকার করিয়া বলিল –মোশাই গো ! কুঠেল বেটা মোদের সর্বনাশ করলে –বেটা সরে জমিতে আপনি এসে মোদের বুননি জমির উপর লাঙ্গল দিতেছে ও হাল-গরু সব ছিনিয়ে নিয়েছে –মোশাই গো ! বেটা কি বুননি নষ্ট করলে। শালা মোদের পাকা ধানে মই দিলে। নায়েব অমনি শতাবধি পাক-সিক জড়ো করিয়া তাড়াতাড়ি আসিয়া দেখে কুঠেল এক শোলার টুপি মাথায় –মুখে চুরুট –হাতে বন্দুক –খাড়া হইয়া হাঁকাহাঁকি করতেছে। নায়েব নিকটে যাইয়া মেঁও মেঁও করিয়া দুই-একটা কথা বলিল, কুঠেল হাঁকায় দেও হাঁকায় দেও, মার মার হুকুম দিল। অমনি দুই পক্ষের লোক লাঠি চালাইতে লাগিল –কুঠেল আপনি তেড়ে এসে গুলী ছুঁড়িবার উপক্রম করিল –নায়েব সরে গিয়া একটা রাংচিত্রের বেড়ার পার্শ্বে লুকাইল। ক্ষণেক কাল মারামারি লাঠালাঠি হইলে পর জমিদারের লোক ভেগে গেল ও কয়েক জন ঘায়েল হইল। কুঠেল আপন বল প্রকাশ করিয়া ডেংডেং করিয়া কুঠিতে চলে গেল ও দাদখায়ী প্রজারা বাটিতে আসিয়া “কি সর্বনাশ” “কি সর্বনাশ” বলিয়া কাঁদিতে লাগিল।
নীলকরসাহেব দাঙ্গা করিয়া কুঠিতে যাইয়া বিলাতি পানি ফটাস্ করিয়া ব্রান্ডি দিয়া খাইয়া শিস দিতে দিতে “তাজা বতাজা” গান করিতে লাগিলেন –কুকুরটা সম্মুখে দৌড়ে দৌড়ে খেলা করিতেছে। তিনি মনে জানেন তাহাকে কাবু করা বড় কঠিন, ম্যাজিস্ট্রেট ও জজ্ তাঁহার ঘরে সর্বদা আসিয়া খানা খান ও তাঁহাদিগের সহিত সহবাস করাতে পুলিসের ও আদালতের লোক তাঁহাকে যম দেখে আর যদিও তদারক হয় তবু খুন অথবা অন্য প্রকার গুরুতর দোষ করিলে মফস্বল আদালতে তাহাদিগের সদ্য বিচার হইয়া সাজা হয় –গোরা লোক ঐ সকল দোষ করিলে সুপ্রিম কোর্টে চালান হয় তাহাতে সাক্ষী অথবা ফৈরাদিরা ব্যয়, ক্লেশ ও কর্মক্ষতি জন্য নাচার হইয়া অস্পষ্ট হয় সুতরাং বড়ো আদালতে উক্ত ব্যক্তিদের মকদ্দমা বিচার হইলেও ফেঁসে যায়।
নীলকর যা মনে করিয়াছেন, তাহাই ঘটিল। পরদিন প্রাতে দারোগা আসিয়া জমিদারের কাছারি ঘিরিয়া ফেলিল। দুর্বল হওয়া বড়ো আপদ্ –সবল ব্যক্তির নিকট কেহই এগুতে পারে না। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া ঘরের ভিতর যাইয়া দ্বার বন্ধ করিল। নায়েব সম্মুখে আসিয়া মোটমাট চুক্তি করিয়া অনেকের বাঁধন খুলিয়া দেওয়াইল। দারোগা বড়োই সোরসারাবত করিতেছিল –টাকা পাইবামাত্র যেন আগুনে জল পড়িল। পরে তদারক করিয়া দারোগা ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট দু-দিক বাঁচাইয়া রিপোর্ট করিল –এদিকে লোভ ওদিকে ভয়। নীলকর অমনি নানা প্রকার জোগাড়ে ব্যস্ত হইল ও ম্যাজিস্ট্রেটের মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইতে লাগিল যে, নীলকর ইংরাজ খ্রীষ্টিয়ান –মন্দ কর্ম কখনই করিবে না –কেবল কালা লোক যাবতীয় দুষ্কর্ম করে। এই অবকাশে সেরেস্তাদার ও পেস্কার নিলকরের নিকট হইতে জেয়াদা ঘুষ লইয়া তাহার বিপক্ষে জবানবন্দী চাপিয়া স্বপক্ষীয় কথা সকল পড়িতে আরম্ভ করিল ও ক্রমশ ছুঁচ চালাইতে চালাইতে বেটে চালাইতে লাগিল। এই অবকাশে নীলকর বক্তৃতা করিল –আমি এ স্থানে আসিয়া বাঙালীদিগের নানা প্রকার উপকার করিতেছি – আমি তাহাদিগের লেখাপড়া ও ঔষধপত্রের জন্য বিশেষ ব্যয় করিতেছি –আবার আমার উপর এই তহমত? বাঙালীরা বড়ো বেঈমান ও দাঙ্গাবাজ। ম্যাজিস্ট্রেট এই সকল কথা শুনিয়া টিফিন করিতে গেলেন। টিফিনের পর খুব চুর্চুরে মধুপান করিয়া চুরুট খাইতে খাইতে আদালতে আইলেন –মকদ্দমা পেশ হইলে সাহেব কাগজ পত্রকে বাঘ দেখিয়া সেরেস্তাদারকে একেবারে বলিলেন –”এ মামলা ডিসমিস করো” এই হুকুমে নীলকরের মুখটা একেবারে ফুলিয়া উঠিল, নায়েবের প্রতি তিনি কট্মট্ করিয়া দেখিতে লাগিলেন। নায়েব অধোবদনে ঢিকুতে ঢিকুতে –ভুঁড়ি নাড়িতে নাড়িতে বলিতে বলিতে চলিলেন –বাঙালীদের জমিদারী রাখা ভার হইল –নীলকর বেটাদের জুলুমে মুলুক খাক হইয়া গেল –প্রজারা ভয়ে ত্রাহি ত্রাহি করিতেছে। হাকিমরা স্বজাতির অনুরোধে তাহাদিগের বশ্য হইয়া পড়ে আর আইনের যেরূপ গতিক তাহাতে নীলকরদের পালাইবার পথও বিলক্ষণ আছে। লোকে বলে জমিদারের দৌরাত্ন্যে প্রজার প্রাণ গেল–এটি বড়ো ভুল। জমিদারেরা জুলুম করে বটে কিন্তু প্রজাকে যতনে বজায় রেখে করে, প্রজা জমিদারের বেগুনক্ষেত। নীলকর সে রকমে চলে না –প্রজা মরুক বা বাঁচুক তাহাতে তাহার বড়ো এসে যায় না –নীলের চাষ বেড়ে গেলেই সব হইল –প্রজা নীলকরের প্রকৃত মূলার ক্ষেত।
২৬.
ঠকচাচার বেনিগারদে নিদ্রাবস্থায় আপন কথা আপনি ব্যক্তকরণ, পুলিসে বাঞ্ছারাম ও বটলরের সহিত সাক্ষাৎ, মকদ্দমা বড়ো আদালতে চালান, ঠকচাচার জেলে কয়েদ, জেলেতে তাহার সহিত অন্যান্য কয়েদীর কথাবার্তা ও তাহার খাবার অপহরণ।
মনের মধ্যে ভয় ও ভাবনা প্রবেশ করিলে নিদ্রার আগমন হয় না। ঠকচাচা বেনিগারদে অতিশয় অস্থির হইলেন,একখানা কম্বলের উপর পড়িয়া এপাশ ওপাশ করিতে লাগিলেন। উঠিয়া এক একবার দেখেন রাত্রি কত আছে। গাড়ির শব্দ অথবা মনুষ্যের স্বর শুনিলে বোধ করেন এইবার বুঝি প্রভাত হইল। এক একবার ধড়মড়িয়া উঠিয়া সিপাইদিগকে জিজ্ঞাসা করেন –”ভাই ! ভাই ! রাত কেত্না হুয়া? –তাহারা বিরক্ত হইয়া বলে, “আরে কামান দাগ্নেকো দো তিন ঘন্টা দের হেয় আব লৌট রহো, কাহে হর্ ঘড়ি দেক করতে হো?” ঠকচাচা ইহা শুনিয়া কম্বলের উপর গড়াগড়ি দেন। তাঁহার মনে নানা কথা –নানা ভাব –নানা উপায় উদয় হয়। কখন কখন ভাবেন –আমি চিরকালটা জুয়াচুরি ও ফেরেবি মতলবে কেন ফিরলাম –ইহাতে যে টাকাকড়ি রোজগার হইয়াছিল তাহা কোথায়? পাপের কড়ি হাতে থাকে না, লাভের মধ্যে এই দেখি যখন মন্দ কর্ম করিয়াছি তখন ধরা পড়িবার ভয়ে রাত্রে ঘুমাই নাই –সদাই আতঙ্কে থাকিতাম –গাছের পাতা নড়িলে বোধ হইত যেন কেহ ধরিতে আসিতেছে। আমার হামজোলফ খোদাবক্স আমাকে এ প্রকার ফেরেক্কায় চলিতে বার বার মানা করিতেন –তিনি বলিতেন, চাষবাস অথবা কোনো ব্যবসা বা চাকরি করিয়া গুজরান করা ভালো, সিদে পথে থাকিলে মার নাই –তাহাতে শরীর ও মন দুই ভালো থাকে। এইরূপ চলিয়াই খোদাবক্স সুখে আছেন। হায় ! আমি তাহার কথা কেন শুনিলাম না। কখন কখন ভাবেন উপস্থিত বিপদ্ হইতে কি প্রকারে উদ্ধার পাইব? উকিল কৌনসুলি না ধরিলে নয় –প্রমাণ না হইলে আমার সাজা হইতে পারে না –জাল কোন্খানে হয় ও কে করে তাহা কেমন করিয়া প্রকাশ হইবে? এইরূপ নানা প্রকার কথার তোলপাড় করিতে করিতে ভোর হয় হয় এমতো সময়ে শ্রান্তিবশত ঠকচাচার নিদ্রা হইল, তাহাতে আপন দায় সংক্রান্ত স্বপ্ন দেখিতে দেখিতে ঘুমের ঘোরে বকিতে লাগিলেন –”বাহুল্য! তুলি, কলম ও কল কেহ যেন দেখিতে পায় না –শিয়ালদার বাড়ির তালায়ের ভিতর আছে –বেশ আছে –খবর্দার তুলিও না –তুমি জল্দি ফরিদপুরে পেলিয়ে যাও –মুই খালাস হয়্যে তোমার সাত মোলাকাত করবো।”
প্রভাত হইয়াছে –সূর্যের আভা ঝিলিমিলি দিয়া ঠকচাচার দাড়ির উপর পড়িয়াছে। বেনিগারদের জমাদার তাহার নিকট দাঁড়াইয়া ঐ সকল কথা শুনিয়া চীৎকার করিয়া বলিল –”বদ্জাত ! আবতলক শোয়া হেয় –উঠো, তোম আপ্না বাত আপ্ জাহের কিয়া।” ঠকচাচা অমনি ধড়মড়িয়ে উঠিয়া চকে, নাকে ও দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে তস্বি পড়িতে লাগলেন। জমাদারের প্রতি এক একবার মিটমিট করিয়া দেখেন –এক একবার চক্ষু মুদিত করেন। জমাদার ভ্রূকুটি করিয়া বলিল –তোম্ তো ধরম্কা ছালা লে করকে বয়টা হেয় আর শেয়ালদাকো তালায়সে কল-ওল নেকালনেসে তেরি ধরম আওরভি জাহের হোগা। ঠকচাচা এই কথা শুনিবামাত্রে কদলীবৃক্ষের ন্যায় ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন ও বলিলেন “বাবা! মেরি বাইকো বহুত জোর হুয়া। এস সবসে হাম নিদ জানেসে জুট মুট বক্তা হুঁ !” “ভালা ও বাত পিছু বোঝা জাওঙ্গি –আব তৈয়ার হো” এই বলিয়া জমাদার চলিয়া গেল।
এদিকে দশটা ঢং ঢং করিয়া বাজিল, অমনি পুলিসের লোকেরা ঠকচাচা ও অন্যান্য আসামীদিগকে লইয়া হাজির করিল। নয়টা না বাজিতে বাজিতে বাঞ্ছারামবাবু বটলর সাহেবকে লইয়া পুলিসে ঘুরিয়া ফিরিয়া বেড়াইতেছিলেন ও মনে মনে ভাবিতেছিলেন –ঠকচাচাকে এ যাত্রা রক্ষা করিলে তাহার দ্বারা অনেক কর্ম পাওয়া যাইবে –লোকটা বলতে-কহিতে, লিখিতে-পড়তে, যেতে-আসতে, কাজে-কর্মে, মামলা-মকদ্দমায়, মতলব-মসলতে বড়ো উপযুক্ত। কিন্তু আমার হচ্ছে এ পেশা –টাকা না পাইলে কিছুই তদ্বির হইতে পারে না। ঘরের খেয়ে বনের মহিষ তাড়াইতে পারি না, আর নাচতে বসেছি ঘোমটাই বা কেন? ঠকচাচাও তো অনেকের মাথা খেয়েছেন তবে ওঁর মাথা খেতে দোষ কি ? কিন্তু কাকের মাংস খাইতে গেলে বড়ো কৌশল চাই। বটলর সাহেব বাঞ্ছারামকে অন্যমনস্ক দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল –বেন্সা ! তোম্ কিয়া ভাবতা ? বাঞ্ছারাম উত্তর করিলেন –বোসো সাহেব; হাম রূপেয়া যে সুরতনে ঘরমে ঢোকে ওই ভাবতা। বটলর সাহেব একটু অন্তরে গিয়া বলিলেন –”আস্সা আস্সা –বহুত আস্সা।”
ঠকচাচাকে দেখিবামাত্র বাঞ্ছারাম দৌড়ে গিয়া তাহার হাত ধরিয়া চোক দু-টো পান্সে করিয়া বলিলেন –একি একি! কাল কুসংবাদ শুনিয়া সমস্ত রাত্রিটা বসিয়া কাটাইয়াছি, একবারও চক্ষু বুজি নাই –ভোর হতে না হতে পূজা-আহ্ণিক অমনি ফুলতোলা রকমে সেরে সাহেবকে লইয়া আসিতেছি। ভয় কি ? এ কি ছেলের হাতের পিটে? পুরুষের দশ দশা, আর বড়ো গাছেই ঝড় লাগে। কিন্তু এক কিস্তি টাকা না হইলে তদ্বিরাদি কিছুই হইতে পারে না –সঙ্গে না থাকে তো ঠকচাচীর দুই-একখানা ভারি রকম গহনা আনাইলে কর্ম চলতে পারে। এক্ষণে তুমি তো বাঁচো তার পরে গহনা-টহনা সব হবে। বিপদে পড়িলে সুস্থির হইয়া বিবেচনা করা বড়ো কঠিন, ঠক-চাচা তৎক্ষণাৎ আপন পত্নীকে এক পত্র লিখিয়া দিলেন। ঐ পত্র লইয়া বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবের প্রতি দৃষ্টিপাতপূর্বক চক্ষু টিপিয়া ঈষৎ হাস্য করিতে করিতে একজন সরকারের হাতে দিলেন এবং বলিলেন –তুমি ধাঁ করিয়া বৈদ্যবাটী যাইয়া ঠকচাচীর নিকট হইতে কিছু ভারি রকম গহনা আনিয়া এখানে অথবা আপিসে দেখতে দেখতে আইস, দেখিও গহনা খুব সাবধান করিয়া আনিও, বিলম্ব না হয়, যাবে আর আসবে –যেন এইখানে আছো। সরকার রুষ্ট হইয়া বলিল –মহাশয়। মুখের কথা, অমনি বললেই হইল ? কোথায় কলিকাতা –কোথায় বৈদ্যবাটী –আর ঠকচাচীই বা কোথা ? আমাকে অন্ধকারে ঢেলা মারিয়া বেড়াইতে হইবে, এক মুঠা খাওয়া দূরে থাকুক এখনও এক ঘটি জল মাথায় দিই নাই –আজ ফিরে কেমন করিয়া আসতে পারি ? বাঞ্ছারাম অমনি রেগেমেগে হুম্কে উঠিয়া বলিলেন,–ছোটলোক এক জাতই স্বতন্তর, এরা ভালো কথার কেউ নয়, নাতি-ঝেঁটা না হলে জব্দ হয় না। লোকে তল্লাশ করিয়া দিল্লী যাইতেছে, তুমি বৈদ্যবাটী গিয়া একটা কর্ম নিকেশ করিয়া আসতে পারো না ? সাকুব হইলে ইশারায় কর্ম-বুঝে –তোর চোকে আঙুল দিয়া বললুম তাতেও হোঁশ হইল না ? সরকার অধোমুখে না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বেটো ঘোড়ার ন্যায় ঢিকুতে ঢিকুতে চলিল ও আপনা আপনি বলিতে লাগিল –দুঃখী লোকের মানই বা কি আর অপমানই বা কি ? পেটের জন্য সকলই সহিতে হয়। কিন্তু হেন দিন কবে হবে যে ইনি ঠকচাচার মতো ফাঁদে পড়বেন। আমার দেক্তা উনি অনেক লোকের গলায় ছুরি দিয়াছেন –অনেক লোকের ভিটে মাটি চাটি করিয়াছেন –অনেক লোকের ভিটায় ঘু ঘু চরাইয়াছেন। বাবা ! অনেক উকিলের মুৎসুদ্দি দেখিয়াছি বটে কিন্তু ওর জুড়ি নাই। রকমটা –ভাজেন পটোল, বলেন ঝিঙ্গা, যেখানে ছুঁচ চলে না সেখানে বেটে চালান। এদিকে পূজা-আহ্ণিক, দোল-দুর্গোৎসব, ব্রাহ্মণভোজন ও ইষ্টনিষ্ঠাও আছে। এমন হিন্দুয়ানির মুখে ছাই –আগাগোড়া হারামজাদ্কি ও বদ্জাতি !
এখানে ঠকচাচা, বাঞ্ছারাম ও বটলর বসিয়া আছেন, মকদ্দমা আর ডাক হয় না। যত বিলম্ব হইতেছে তত ধরফড়ানি বৃদ্ধি হইতেছে। পাঁচটা বাজে বাজে এমন সময়ে ঠকচাচাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে লইয়া খাড়া করিয়া দিল। ঠকচাচা গিয়া সেখানে দেখেন যে শিয়ালদার পুষ্করিণী হইতে জাল করিবার কল ও তথাকার দুই-একজন গাওয়া আনিত হইয়াছে। মকদ্দমার তদারক হওনান্তর ম্যাজিস্ট্রেট হুকুম দিলেন যে, এ মামলা বড়ো আদালতে চালান হউক। আসামীর জামিন লওয়া যাইতে পারা যায় না সুতরাং তাহাকে বড়ো জেলে কয়েদ থাকিতে হইবে।
ম্যাজিস্ট্রেটের হুকুম হইবামাত্রে বাঞ্ছারাম তেড়ে আসিয়া হাত নাড়িয়া বলিলেন –ভয় কি ? একি ছেলের হাতের পিটে ? এ তো জানাই আছে যে,মকদ্দমা বড়ো আদালতে হবে –আমরাও তাই তো চাই। ঠকচাচা মুখখানি ভাবনায় একেবারে শুকিয়ে গেল। পেয়াদা হাত ধরিয়া হিড় হিড় করিয়া নীচে টানিয়া জেলে চালান করিয়া দিল। চাচা টংয়স্ টংয়স্ করিয়া চলিয়াছেন –মুখে বাক্য নাই –চক্ষু তুলিয়া দেখেন না, পাছে কাহারো সহিত দেখা হয় –পাছে কেহ পরিহাস করে। সন্ধ্যা হইয়াছে এমন সময় ঠকচাচা শ্রীঘরে পদার্পণ করিলেন। বড়ো জেলেতে যাহারা দেনার জন্য অথবা দেওয়ানি মকদ্দমা ঘটিত কয়েদ হয় তাহারা একদিকে ও যাহারা ফৌজদারী মামলা হেতু কয়েদ হয় তাহারা অন্য দিকে থাকে। ঐ সকল আসামির বিচার হইলে হয়তো তাহাদিগের ঐ স্থানে মিয়াদ খাটিতে নয়তো হরিং বাটীতে সুরকি কুটিতে হয় অথবা জিঞ্জির বা ফাঁসি হয়। ঠকচাচাকে ফৌজদারী জেলে থাকিতে হইল, তিনি ঐ স্থানে প্রবেশ করিলে যাবতীয় কয়েদী আসিয়া ঘেরিয়া বসিল। ঠকচাচা কটমট করিয়া সকলকে দেখিতে লাগিলেন –একজন আলাপীও দেখিতে পান না। কয়েদীরা বলিল, মুনশীজি !–দেখো কি ? তোমারও যে দশা আমাদেরও সেই দশা, এখন আইস মিলে-জুলে থাকা যাউক। ঠকচাচা বলিলেন –হাঁ বাবা ! মুই নাহক আপদে পড়েছি –মুই খাইনে, ছুঁইনে, মোর কেবল নসিবের ফের। দুই-একজন প্রাচীন কয়েদী বলিল –হাঁ তা বই কি ! অনেকেই মিথ্যা দায়ে মজে যায়। একজন মুখফোড় কয়েদী বলিয়া উঠিল –তোমার দায় মিথ্যা আমাদের বুঝি সত্য ? আঃ। বেটা কি সাওখোড় ও সরফরাজ ? ওহে ভাইসকল সাবধান –এ দেড়ে বেটা বড়ো বিট্কেলে লোক। ঠকচাচা অমনি নরম হইয়া আপনাকে খাটো করিলেন কিন্তু তাহারা ঐ কথা লইয়া অনেকে ক্ষণেক কাল তর্ক-বিতর্ক করিতে ব্যস্ত হইল। লোকের স্বভাবই এই, কোনো কর্ম না থাকিলে একটু সূত্র ধরিয়া ফাল্তো কথা লইয়া গোলমাল করে।
জেলের চারিদিক বন্ধ হইল –কয়েদীরা আহার করিয়া শুইবার উদ্যোগ করিতেছে, ইত্যবসরে ঠকচাচা এক প্রান্তভাগে বসিয়া কাপড় বাঁধা মিঠাই খুলিয়া মুখে ফেলিতে যান অমনি পেছন দিকে থেকে দুই দুই বেটা মিশ কালো কয়েদী –গোঁপ, চুল ও ভুরু সাদা, চোক লাল –হাহা হাহা শব্দে বিকট হাস্য করত মিঠায়ের ঠোঙাটি সট্ করিয়া কাড়িয়া লইল এবং দেখাইয়া দেখাইয়া টপ টপ করিয়া খাইয়া ফেলিল। মধ্যে মধ্যে চর্বণকালীন ঠকচাচার মুখের নিকট মুখ আনিয়া হিহি হিহি করিয়া হাসিতে লাগিল। ঠকচাচা একেবারে অবাক –আস্তে আস্তে মাদুরির উপর গিয়া সুড় সুড় করিয়া শুইয়া পড়িলেন, যেন কিল খেয়ে কিল চুরি।
২৭.
বাদার প্রজার বিবরণ –বাহুল্যের বৃত্তান্ত ও গ্রেপ্তারি, গাড়ি-চাপা লোকের প্রতি বরদাবাবুর সততা,বড়ো আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা করণের ধারা,বাঞ্ছারামের দৌড়াদোড়ি,ঠকচাচা ও বাহুল্যের বিচার ও সাজা।
বাদাতে ধানকাটা আরম্ভ হইয়াছে, সালতি সাঁ সাঁ করিয়া চলিয়াছে –চারিদিক জলময় –মধ্যে মধ্যে চৌকি দিবার টং, কিন্তু প্রজার নিস্তার নাই –এদিকে মহাজন ওদিকে জমিদারের পাইক। যদি বিকি ভালো হয় তবে তাহদিগের দুই বেলা দুই মুঠা আহার চলিতে পারে নতুবা মাছটা, শাকটা ও জনখাটা ভরসা। ডেঙাতে কেবল হৈমন্তী বুনন হয় –আউস প্রায় বাদাতেই জন্মে। বঙ্গদেশে ধান্য অনায়াসে উৎপন্ন হয় বটে কিন্তু হাজা, শুকা, পোকা, কাঁকড়া ও কার্তিকে ঝড়ে ফসলের বিলক্ষণ ব্যাঘাত হয়; আর ধানের পাইটও আছে, তদারক না করিলে কলা ধরিতে পারে। বাহুল্য প্রাতঃকালে আপন জোতের জমি তদারক করিয়া আপন বাটীর দাওয়াতে বসিয়া তামাক খাইতেছেন; সম্মুখে একটা কাগজের দপ্তর, নিকটে দুই-চারিজন হারামজাদা প্রজা ও আদালতের লোক বসিয়ে আছে –হাকিমের আইনের ও মামলার কথাবার্তা হইতেছে ও কেহ কেহ নূতন দস্তাবেজ তৈয়ার ও সাক্ষী তালিম করিবার ইশারা করিতেছে –কেহ কেহ টাকা টেঁক থেকে খুলিয়া দিতেছে ও আপন আপন মতলব হাঁসিল জন্য নানা প্রকার স্তুতি করিতেছে। বাহুল্য কিছু যেন অন্যমনস্ক –এদিকে ওদিকে দেখিতেছেন –এক একবার আপন কৃষাণকে ফাল্তো ফরমাইশ করিতেছেন, “ওরে ঐ কদুর ডগাটা মাচার উপর তুলে দে, ঐ খেড়ের আঁটিটা বিছিয়ে ধুপে দে,” ও এক এক বার ছমছমে ভাবে চারিদিকে দেখিতেছেন। নিকটস্থ এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল –মৌলুবী সাহেব! ঠকচাচার কিছু মন্দ খবর শুনিতে পাই –কোনো পেঁচ নাই তো ? বাহুল্য কথা ভাঙিতে চান না, দাড়ি নেড়ে –হাত তুলে অতি বিজ্ঞরূপে বলিতেছেন –মরদের উপর হরেক আপদ গেরে, তার ডর করলে চলবে কেন ? অন্য একজন বলিতেছে –এ তো কথাই আছে কিন্তু সে ব্যক্তি বারেঁহা, আপন বুদ্ধির জোরে বিপদ থেকে উদ্ধার হইবে। সে যাহা হউক আপনার উপর কোনো দায় না পড়িলে আমরা বাঁচি –এই ডেঙা ভবানীপুরে আপনি বৈ আমাদের সহায় সম্পত্তি আর নাই –আমাদের বল বলুন, বুদ্ধি বলুন সকলই আপনি। আপনি না থাকলে আমাদের এখান হইতে বাস উঠাইতে হইত। ভাগ্যে আপনি আমাকে কয়েকখানা কবজ বানিয়ে দিয়েছিলেন তাই জমিদার বেটাকে জব্দ করিয়াছি, আমার উপর সেই অবধি কিছু দৌরাত্ম্য করে না –সে ভালো জানে যে আপনি আমার পাল্লায় আছেন। বাহুল্য আহ্লাদে গুড়গুড়িটা ভড় ভড় করিয়া চোক মুখ দিয়া ধুঁয়া নির্গত করত একটু মৃদু মৃদু হাস্য করিলেন। অন্য একজন বলিল –মফস্বলে জমি-জমা শিরে লইতে গেলে জমিদার ও নীলকরদের জব্দ করিবার জন্য দুই উপায় আছে –প্রথমত মৌলুবী সাহেবের মতন লোকের আশ্রয় লওয়া –দ্বিতীয়ত খ্রীষ্টিয়ান হওয়া। আমি দেখিয়াছি অনেক প্রজা পাদরীর দোহাই দিয়া গোকুলের ষাড়েঁর ন্যায় বেড়ায় ! পাদরী সাহেব কড়িতে বলো –সহিতে বলো –সুপারিসে বলো “ভাই লোকদের” সর্বদা রক্ষা করেন। সকল প্রজা যে মনের সহিত খ্রীষ্টিয়ান হয় তা নয় কিন্তু যে পাদরীর মণ্ডলীতে যায় সে নানা উপকার পায়। মাল মকদ্দমায় পাদরীর চিঠি বড়ো কর্মে লাগে। বাহুল্য বলিলেন, সে সচ্ বটে –লেকেন আদমির আপনার দীন খোয়ানা বহুত বুরা। অমনি সকলে বলিল –তা বটে তো, তা বটে তো ; আমরা এই কারণে পাদরীর নিকটে যাই না। এইরূপ খোশ গল্প হইতেছে ইতিমধ্যে দারোগা, জন কয়েক জমাদার ও পুলিসের সার্জন হুড়মুড় করিয়া বাহুল্যের হাত ধরিয়া বলিল –তোম ঠকচাচা কো সাত জাল কিয়া –তোমার উপর গেরেপ্তারি হেয়। এই কথা শুনিবামাত্র নিকটস্থ লোক সকলে ভয় পাইয়া সট্ সট্ করিয়া প্রস্থান করিল। বাহুল্য দারোগা ও সার্জনকে ধন লোভ দেখাইল কিন্তু তাহারা পাছে চাকরি যায় এই ভয়ে ওকথা আমলে আনিল না, তাহার হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। ডেঙ্গা ভবানীপুরে এই কথা শুনিয়া লোকারণ্য হইল ও ভদ্র ভদ্র লোকে বলিতে লাগিল দুষ্কর্মের শাস্তি বিলম্বে বা শীঘ্রে অবশ্যি হইবে। যদি লোকে পাপ করিয়া সুখে কাটাইয়া যায় তবে সৃষ্টিই মিথ্যা হইবে, এমন কখনই হইতে পারে না। বাহুল্য ঘাড় হেঁট করিয়া চলিয়াছেন –অনেকের সহিত দেখা হইতেছে কিন্তু কাহাকে দেখেও দেখেন না। দুই-এক ব্যক্তি যাহারা কখন না কখন তাহার দ্বারা অপকৃত হইয়াছিল, তাহারা এই অবকাশে কিঞ্চিৎ ভরসা পাইয়া নিকটে আসিয়া বলিল –মৌলবী সাহেব ! একি ব্রজের ভাব না-কি ? আপনার কি কোনো ভারি বিষয় কর্ম হইয়াছে ? না রাম না গঙ্গা কিছুই না বলিয়া বাহুল্য বংশদ্রোণীর ঘাট পার হইয়া শাগঞ্জে আসিয়া পড়িলেন। সেখানে দুই-একজন টেপুবংশীয় শাজাদা তাঁহাকে দেখিয়া বলিল –কেউঁ তু গেরেপ্তার হোয়া –আচ্ছা হুয়া –এয়সা বদ্জাত আদমিকো সাজা মিলনা বহুত বেহতর। এই সকল কথা বাহুল্যের প্রতি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা লাগিতে লাগিল। ঘোরতর অপমানে অপমানিত হইয়া ভবানীপুরে পৌঁছিলেন –কিঞ্চিৎদূরে থেকে বোধ হইল রাস্তার বামদিকে কতকগুলি লোক দাঁড়াইয়া গোল করিতেছে, নিকটে আসিয়া সার্জন বাহুল্যকে লইয়া দাঁড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, এখানে এত লোক কেন ? পরে লোক ঠেলিয়া গোলের ভিতর যাইয়া দেখিল, একজন ভদ্রলোক এক আঘাতিত ব্যক্তিকে ক্রোড়ে করিয়া বসিয়া আছেন –আঘাতিত ব্যক্তির মস্তক দিয়া অবিশ্রান্ত রুধির নির্গত হইতেছে, ঐ রক্তে উক্ত ভদ্রলোকের বস্ত্র ভাসিয়া যাইতেছে; সার্জন জিজ্ঞসা করিল, আপনি কে ও এ লোকটি কি প্রকারে জখম হইল? ভদ্রলোক বলিলেন –আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস –আমি এখানে কোনো কর্ম অনুরোধে আসিয়াছিলাম দৈবাৎ এই লোক গাড়ি চাপা পড়িয়া আঘাতিত হইয়াছে, এই জন্য আমি আগুলিয়া বসিয়া আছি –শীঘ্র হাসপাতালে লইয়া যাইব তাহার উদ্যোগ পাইতেছি –একখানা পালকি আনিতে পাঠাইয়াছিলাম কিন্তু বেহারা ইহাকে কোনো মতে লইয়া যাইতে চাহে না, কারণ এই ব্যক্তি জেতে হাড়ি। আমার সঙ্গে গাড়ি আছে বটে কিন্তু এ ব্যক্তি গাড়িতে উঠিতে অক্ষম, পাল্কি কিংবা ডুলি পাইলে যত ভাড়া লাগে তাহা আমি দিতে প্রস্তুত আছি। সততার এমনি গুণ যে ইহাতে অধমেরও মন ভেজে। বরদাবাবুর এই ব্যবহার দেখিয়া বাহুল্যের আশ্চর্য জন্মিয়া আপন মনে ধিক্কার হইতে লাগিল ! সার্জন বলিল –বাবু, বাঙালীরা হাড়িকে স্পর্শ করে না, বাঙালী হইয়া তোমার এত দূর করা বড়ো সহজ কথা নহে। বোধ হয় তুমি বড়ো অসাধারণ ব্যক্তি, এই বলিয়া আসামীকে পেয়াদার হাওয়ালে রাখিয়া সার্জন আপনি আড়ার নিকট যাইয়া ভয়মৈত্রতা প্রদর্শনপূর্বক পালকি আনিয়া বরদাবাবুর সহিত উক্ত হাড়িকে হাসপাতালে পাঠাইয়া দিল।
পূর্বে বড়ো আদালতে ফৌজদারী মকদ্দমা বৎসরে তিন তিন মাস অন্তর হইত এক্ষণে কিছু ঘন ঘন হইয়া থাকে। ফৌজদারী মকদ্দমা নিষ্পত্তি করণার্থে তথায় দুই প্রকার জুরি মকরর হয়, প্রথমত গ্রাঞ্জুরি, যাহারা পুলিশ-চালানি ও অন্যান্য লোক যে ইণ্ডাইটমেণ্ড করে তাহা বিচারযোগ্য কি-না বিবেচনা করিয়া আদালতকে জানান –দ্বিতীয়ত পেটিজুরি, যাহারা গ্রাঞ্জুরি বিবেচনা অনুসারে বিচারযোগ্য মকদ্দমা জজের সহিত বিচার করিয়া আসামিদিগকে দোষী বা নির্দোষ করেন। এক এক সেশনে অর্থাৎ ফৌজদারী আদালতে ১৪ জন গ্রাঞ্জুরি মকরর হয়, যে সকল লোকের দুই লক্ষ টাকার বিষয় বা যাহারা সৌদাগরি করে তাহারাই গ্রাঞ্জুরি হইতে পারে। সেশনে পেটিজুরি প্রায় প্রতিদিন মকরর হয়, তাহাদিগের নাম ডাকিবার কালীন আসামী বা ফৈরাদি স্বেচ্ছানুসারে আপত্তি করিতে পারে অর্থাৎ যাহার প্রতি সন্দেহ হয় তাহাকে না লইয়া অন্য আর একজনকে নিযুক্ত করাইতে পারে কিন্তু বারোজন পেটিজুরি শপথ করিয়া বসিলে আর বদল হয় না। সেকশনের প্রথম দিবসে তিনজন জজ বসেন, যখন যাঁহার পালা তিনি গ্রাঞ্জুরি মকরর হইলে তাঁহাদিগাকে চার্জ অর্থাৎ সেশনীয় মকদ্দমার হালাৎ সকল বুঝাইয়া দেন। চার্জ দিলে পর অন্য দুইজন জজ যাঁহাদের পালা নয় তাঁহারা উঠিয়া যান ও গ্রাঞ্জুরিরা এক কামরার ভিতর যাইয়া প্রত্যেক ইণ্ডাইটমেণ্ডের উপর আপন বিবেচনানুসারে যথার্থ বা অযথার্থ লিখিয়া পাঠাইয়া দেন, তাহার পর বিচার আরম্ভ হয়।
রজনী প্রায় অবসান হয় –মন্দ মন্দ সমীরণ বহিতেছে, এই সুশীতল সময়ে ঠকচাচা মুখ হাঁ করিয়া বেতর নাক ডাকাইয়া নিদ্রা যাইতেছেন। অন্যান্য কয়েদীরা উঠিয়া তামাক খাইতেছে ও কেহ কেহ ঐ শব্দ শুনিয়া “মোস পোড়া খা, মোস পোড়া খা” বলিতেছে কিন্তু ঠকচাচা কুম্ভকর্ণের ন্যায় নিদ্রা যাইতেছেন –”নাসা গর্জন শুনি পরান শিহরে”। কিয়ৎকাল পরে জেলরক্ষক সাহেব আসিয়া কয়েদীদের বলিলেন –তোমরা শীঘ্র প্রস্তুত হও, অদ্য সকলকে আদালতে যাইতে হইবে।
এদিকে সেশন খুলিবামাত্রে দশ ঘণ্টার অগ্রেই বড়ো আদালতের বারান্দা লোকে পরিপূর্ণ হইল –উকিল, কৌন্সুলি, ফৈরাদি, আসামী, সাক্ষী, উকিলের মুৎসুদ্দি, জুরি, সার্জন, জমদার, পেয়াদা –নানা প্রকার লোক থৈ থৈ করিতে লাগিল। বাঞ্ছারাম বটলর সাহেবকে লইয়া ফিরিতেছেন ও ধনী লোক দেখিলে তাঁহাকে জানুন না জানুন আপনার বামনাই ফলাইবার জন্য হাত তুলিয়া আশীর্বাদ করিতেছেন, কিন্তু যিনি তাঁহাকে ভালো জানেন তিনি তাঁহার শিষ্টাচারিতে ভুলেন না –তিনি এক লহমা কথা কহিয়াই একটা-না-একটা মিথ্যা বরাত অনুরোধে তাঁহার হাত হইতে উদ্ধার হইতেছেন। দেখতে দেখতে জেলখানার গাড়ি আসিল –আগু পিছু দুই দিকে সিপাই। গাড়ি খাড়া হইবামাত্রে সকলে বারান্দা থেকে দেখিতে লাগিল –গাড়ির ভিতর থেকে সকল কয়েদীকে লইয়া আদালতের নীচেকার ঘরের কাঠগড়ার ভিতর রাখিল। বাঞ্ছারাম হন হন করিয়া নীচে আসিয়া ঠকচাচা ও বাহুল্যের সহিত সাক্ষাৎ করিয়া বলিলেন –তোমরা ভীমার্জুন –ভয় পেও না –এ কি ছেলের হাতের পিটে ?
দুই প্রহর হইবামাত্রে বারান্দার মধ্যস্থল খালি হইল –লোক সকল দুইদিকে দাঁড়াইল –আদালতের পেয়াদা “চুপ্ চুপ্” করিতে লাগিল –জজেরা আসিতেছেন বলিয়া যাবতীয় লোক নিরীক্ষণ করিতেছে এমন সময়ে সার্জন পেয়াদা ও চোপদারেরা বল্লম, বর্শা, আশাসোঁটা, তলোয়ার ও বাদশাহ্র রৌপ্যময় মটুকাকৃতি সজ্জা হস্তে করিয়া দেখা দিল –তাহার পর সরিফ ও ডিপুটি সরিফ ছড়ি হাতে করিয়া দেখা দিল –তাহার পর তিনজন জজ লাল কোর্তা পরা গম্ভীরবদনে মৃদু মৃদু গতিতে বেঞ্চের উপর উঠিয়া কৌন্সুলিদের সেলাম করত উপবেশন করিলেন। কৌন্সুলিরা অমনি দাঁড়াইয়া সম্মানপূর্বক অভিবাদন করিল –চৌকির নাড়ানাড়ি ও লোকের বিজ্বিজিনি এবং ফুসফুসানি বৃদ্ধি হইতে লাগিল –পেয়াদারা মধ্যে মধ্যে “চুপ্ চুপ্ চুপ্” করিতেছে –সার্জনেরা “হিশ হিশ” করিতেছে –ক্রায়র “ওইস –ওইস” বলিয়া সেশন খুলিল। অনন্তর গ্রাঞ্জুরিদিগের নাম ডাকা হইয়া তাহারা মকরর হইল ও আপনাদিগের ফোরম্যান অর্থাৎ প্রধান গ্রাঞ্জুরি নিযুক্ত করিল। এবার রস্ল্ সাহেবের পালা, তিনি গ্রাঞ্জুরির প্রতি অবলোকন করিয়া বলিলেন –মকদ্দমার তালিকা দৃষ্টে বোধ হইতেছে যে, কলিকাতায় জাল করা বৃদ্ধি হইয়াছে কারণ ঐ কালেবের পাঁচ-ছয়টা মকদ্দমা দেখিতে পাই –তাহার মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি যে নালিশ তৎসম্পর্কীয় জবানবন্দিতে প্রকাশ পাইতেছে যে, তাহারা শিয়ালদাতে জাল কোম্পানির কাগজ তৈয়ার করিয়া কয়েক বৎসরাবধি এই শহরে বিক্রয় করিতেছে –এ মকদ্দমা বিচারযোগ্য কি-না তাহা আমাকে আগ্রে জানাইবেন –অন্যান্য মকদ্দমার দস্তাবেজ দেখিয়া যাহা কর্তব্য তাহা করিবেন তদ্বিষয়ে আমার কিছু বলা-বাহুল্য। এই চার্জ পাইয়া গ্রাঞ্জুরি কামরার ভিতর গমন করিল –বাঞ্ছারাম বিষন্ন ভাবে বটলর সাহেবের প্রতি দেখিতে লাগিলেন। দশ-পনের মিনিটের মধ্যে ঠকচাচা ও বাহুল্যের প্রতি ইণ্ডাইটমেণ্ড যথার্থ বলিয়া আদালতে প্রেরিত হইল। অমনি জেলের প্রহরী ঠকচাচা ও বাহুল্যকে আনিয়া জজের সম্মুখে কাঠরার ভিতর খাড়া করিয়া দিল ও পেটিজুরি নিযুক্ত হওন কালীন কোর্টের ইণ্টারপ্রিটার চিৎকার করিয়া বলিলেন –মোকাজান ওরফে ঠকচাচা ও বাহুল্য ! তোমলোক্কা উপর জাল কোম্পানির কাগজ বানানেকা নালেশ হুয়া –তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি ? আসামীরা বলিল –জাল বি কাকে বলে আর কোম্পানির কাগজ বি কাকে বলে মোরা কিছুই জানি না, মোরা সেরেফ মাছ ধরবার জাল জানি। মোরা চাষবাস করি মোদের এ কাম নয় –এ কাম সাহেব সুভদের। ইণ্টারপ্রিটার ত্যক্ত হইয়া বলিল তোমলোক বহুত লম্বা লম্বা বাত কহতা হেয় –তোমলোক এ কাম কিয়া কি নেহি ? আসামীরা বলিল – মোদের বাপ-দাদারাও কখন করে নাই। ইণ্টারপ্রিটার অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া মেজ চাপড়িয়া বলিল –হামারি বাতকো জবাব দেও –এ কাম কিয়া কি নেহি ? নেহি নেহি এ হামলোক কাভি কিয়া নেহি –এই উত্তর আসামীরা অবশেষে দিল। উক্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার তাৎপর্য এই যে আসামী যদি আপন দোষ স্বীকার করে তবে তাহার বিচার আর হয় না –একেবারে সাজা হয়। অনন্তর ইণ্টারপ্রিটার বলিলেন –শুন –এই বারো ভালা আদমি বয়েট করকে তোমলোক কো বিচার করেগা –কিসিকা উপর আগর ওজর রহে তব আবি কহ –ওন্কো উঠায় করকে দুসরা আদমিকো ওন্কো জাগেমে বটলা যায়েগি। আসামীরা এ কথার ভালো-মন্দ কিছু না বুঝিয়া চুপ করিয়া থাকিল। এদিকে বিচার আরম্ভ হইয়া ফৈরাদির ও সাক্ষীর জবানবন্দীর দ্বারা সরকারের তরফ কৌন্সুলি স্পষ্টরূপে জাল প্রমাণ করিল, পরে আসামিদের কৌন্সুলি আপন তরফ সাক্ষী না তুলিয়া জেরার মারপেছি কথা ও আইনের বিতণ্ডা করত পেটিজুরিকে ভুলাইয়া দিতে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাহার বত্তৃতা শেষ হইলে পর রস্ল্ সাহেব মকদ্দমা প্রমাণের খোলসা ও জালের লক্ষণ জুরিকে বুঝাইয়া বলিলেন –পেটিজুরি এই চার্জ পাইয়া পরামর্শ করিতে কামরার ভিতর গমন করিল –জুরিরা সকলে ঐক্য না হইলে আপন অভিপ্রায় ব্যক্ত করিতে পারে না। এই অবকাশে বাঞ্ছারাম আসামীদের নিকট আসিয়া ভরসা দিতে লাগিলেন, দুই-চারিটা ভালো-মন্দ কথা হইতেছে ইতিমধ্যে জুরিদের আগমনের গোল পড়ে গেল। তাহারা আসিয়া আপন আপন স্থানে বসিলে ফোরম্যান দাঁড়াইয়া খাড়া হইলেন –আদালত একেবারে নিস্তব্ধ –সকলেই ঘাড় বাড়াইয়া কান পেতে রহিল –কোর্টের ফৌজদারী মমলার প্রধান কর্মচারী ক্লার্ক অব্দি ক্রৌন জিজ্ঞাসা করিল, –জুরি মহাশয়েরা ! ঠকচাচা ও বাহুল্য গিল্টি কি নাট গিল্টি ? ফোরম্যান বলিলেন –গিল্টি –এই কথা শুনিবামাত্র আসামীদের একেবারে ধড় থেকে প্রাণ উড়ে গেল –বাঞ্ছারাম আস্তে-ব্যস্তে আসিয়া বলিলেন –আরে ও ফুল গিল্টি ! এ কি ছেলের হাতের পিটে ? এখুনি নিউ ট্রায়েল অর্থাৎ পুনর্বিচারের জন্য প্রার্থনা করিব। ঠকচাচা দাড়ি নাড়িয়া বলিলেন –মোশাই ! মোদের নসিবে যা আছে তাই হবে মোরা আর টাকাকড়ি সরবরাহ করিতে পারিব না। বাঞ্ছারাম কিঞ্চিৎ চটে উঠিয়া বলিলেন –সুদু হাঁড়িতে পাত বাঁধিয়া কত করিব –এসব কর্মে কেবল কেঁদে কি মাটি ভিজানো যায় ?
এদিকে রস্ল্ সাহেব উল্টে-পাল্টে দেখিয়া আসামীদিগের প্রতি দৃষ্টি করত এই হুকুম দিলেন – “ঠকচাচা ও বাহুল্য ! তোমাদের দোষ বিলক্ষণ সপ্রমাণ হইল – যে সকল লোক এমন দোষ করে তাহাদের গুরুতর দণ্ড হওয়া উচিৎ, এ কারণে তোমরা পুলিপালমে গিয়া যাবজ্জীবন থাক।” এই হুকুম হইবামাত্র আদালতের প্রহরীরা আসামীদের হাত ধরিয়া নীচে লইয়া গেল। বাঞ্ছারাম পিচ কাটিয়া একপার্শ্বে দাঁড়াইয়া আছেন –কেহ কেহ তাঁহাকে বলিল –এ কি –আপনার মকদ্দমাটা যে ফেঁসে গেল ? তিনি উত্তর করিলেন –এ তো জানাই ছিল –আর এমন সব গলতি মামলায় আমি হাত দি না –আমি এমতো সকল মকদ্দমা কখনই ক্যার করি না।
২৮.
বেণী ও বেচারামবাবুর নিকট বরদাবাবুর সততা ও কাতরতা প্রকাশ এবং ঠকচাচা ও বাহুল্যের কথোপকথন।
বৈদ্যবাটীর বাটী ক্রমে অন্ধকারময় হইল –রক্ষণাবেক্ষণ করে এমন অভিভাবক নাই –পরিজনেরা দুরবস্থায় পড়িল –দিন চলা ভার হইল, গ্রামের লোকে বলিতে লাগিল বালির বাঁধ কতক্ষণ থাকিতে পারে? ধর্মের সংসার হইলে প্রস্তরের গাঁথনি হইত। এদিকে মতিলাল নিরুদ্দেশ –দলবলও অন্তর্ধান –ধুম-ধাম কিছুই শুনা যায় না –প্রেমনারায়ণ মজুমদারের বড়ো আহ্লাদ –বেণীবাবুর বাড়ির দাওয়ায় বসিয়া তুড়ি দিয়া “বাবলার ফুল লো কানে লো দুলালি, মুড়িমুড়কির নাম রেখেছো রুপালী সোনালী” এই গান গাইতেছেন। ঘরের ভিতরে বেণীবাবু তানপুরায় মেও মেও করিয়া হামির রাগ ভাঁজিয়া “চামেলি ফুলি চম্পা” এই খেয়াল সুরৎ মূর্ছনা ও গমক প্রকাশপূর্বক গান করিতেছেন। ওদিকে বেচারামবাবু “ভবে এসে প্রথমেতে পাইলাম আমি পঞ্জুড়ি” এই নরচন্দ্রী পদ ধরিয়া রাস্তায় যাবতীয় ছোঁড়াগুলাকে ঘাঁটাইয়া আসিতেছেন। ছোঁড়ারা হো হো করিয়া হাততালি দিতেছে। বেচারামবাবু এক একবার বিরক্তি হইয়া “দূঁর দূঁর” করিতেছেন। যৎকালে নাদের শা দিল্লী আক্রমণ করেন তৎকালীন মহম্মদ শা সংগীত শ্রবণে মগ্ন ছিলেন –নাদের শা অস্ত্রধারী হইয়া সম্মুখে উপস্থিত হইলে মহম্মদ শা কিছুমাত্র না বলিয়া সংগীতসুধা পানে ক্ষণকালের জন্যেও ক্ষান্ত হয়েন নাই –পরে একটি কথাও না কহিয়া স্বয়ং আপন সিংহাসন ছাড়িয়া দেন। বেচারামবাবুর আগমনে বেণীবাবু তদ্রূপ করিলেন না –তিনি অমনি তানপুরা রাখিয়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া সম্মানপূর্বক তাঁহাকে বসাইলেন। কিয়ৎক্ষণ শিষ্ট মিষ্ট আলাপ হইলে পর বেচারামবাবু বলিলেন –বেণী ভায়া। এতদিনের পর মুষলপর্ব হইল –ঠকচাচা আপন কর্মদোষে অধঃপাতে গেলেন। তোমার মতিলালও আপন বুদ্ধিদোষে রূপস্ হইলেন। ভায়া ! তুমি আমাকে সবর্দা বলিতে ছেলের বাল্যকালাবধি মাজা বুদ্ধি ও ধর্মজ্ঞান জন্য শিক্ষা না হইলে ঘোর বিপদ ঘটে, এ কথাটির উদাহরণ মতিলালেতেই পাওয়া গেল। দুঃখের কথা কি বলিব? এ সকল দোষ বাবুরামের –তাঁহার কেবল মোক্তারি বুদ্ধি ছিল –বুড়িতে চতুর কিন্তু কাহনে কানা, দূঁর দূঁর !!
বেণী। আর এ সকল কথা বলিয়া আক্ষেপ করিলে কি হইবে? এ সিদ্ধান্ত অনেকদিন পূর্বেই করা হয়েছিল –যখন মতির শিক্ষা বিষয়ে এত অমনোযোগ ও অসৎ সঙ্গ নিবারণের কোনো উপায় হয় নাই তখনই রাম না হতে রামায়ণ হইয়াছিল। যাহা হউক, বাঞ্ছারামেরই পহবারো –বক্রেশ্বরের কেবল আঁকুপাঁকু সার। মাস্টারি কর্ম করিয়া বড়োমানুষের ছেলেদের খোশামোদ করিতে এমন আর কাহাকেও দেখা গেল না –ছেলেপুলেদের শিক্ষা দেওয়া তথৈবচ, কেবল রাত-দিন লব লব, অথচ বাহিরে দেখানো আছে আমি বড়ো কর্ম করিতেছি –যা হউক মতিলালের নিকট বাওয়াজির আশাবায়ু নিবৃত্তি হয় নাই –তিনি “জল দে, জল দে” বলিয়া গগিয়া আকাশ ফাটাইয়াছেন কিন্তু লাভের মেঘও কখন দেখিতে পান নাই –বর্ষণ কি প্রকারে দেখিবেন ?
প্রেমনারায়ণ মজুমদার বলিল –মহাশয়দিগের আর কি কথা নাই? কবিকঙ্কণ গেল –বাল্মীক গেল –ব্যাস গেল –বিষয়কর্মের কথা গেল –একা বাবুরামি হাঙ্গামে পড়ে যে প্রাণ ওষ্ঠগত হইল –মতে ছোড়া যেমন অসৎ তেমনি তার দুর্গতি হইয়াছে, সে চুলায় যাউক, তাহার জন্য কিছু খেদ নাই।
হরি তামাক সাজিয়া হুঁকাটি বেণীবাবুর হাতে দিয়া বলিল –সেই বাঙালবাবু আসিতেছেন। বেণী বাবু উঠিয়া দেখিলেন বরদাপ্রসাদবাবু ছড়ি হাতে করিয়া ব্যস্ত হইয়া আসিতেছেন –অমনি বেণীবাবু ও বেচারামবাবু উঠিয়া অভ্যর্থনা করিয়া তাঁহাকে বসাইলেন –পরস্পরের কুশল জিজ্ঞাসা হইলে পর বরদাবাবু বলিলেন –এদিকে তো যা হবার তা হয়ে গেল সম্প্রতি আমার একটি নিবেদন আছে –বৈদ্যবাটীতে আমি বহুকালাবধি আছি –একারণ সাধ্যানুসারে সেখানকার লোকদিগের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য –আমার অধিক ধন নাই বটে কিন্তু আমি যেমন মানুষ বিবেচনা করলে পরমেশ্বর আমাকে অনেক দিয়েছে, আমি অধিক আশা করিলে কেবল তাঁহার সুবিচারের উপর দোষারোপ করা হয় –এ কর্ম মানবগণের উচিত নহে। যদিও প্রতিবেশীদের তত্ত্ব লওয়া আমার কর্তব্য কিন্তু আমার আলস্য ও দুরদৃষ্টবশত ঐ কর্ম আমা হইতে সম্যক্ রূপে নির্বাহ হয় নাই। এক্ষণে –
বেচারাম। এ কেমন কথা। বৈদ্যবাটীর যাবতীয় দুঃখী প্রাণী লোককে তুমি নানা প্রকারে সাহায্য করিয়াছ –কি খাদ্য দ্রব্যে –কি বস্ত্রে –কি অর্থে –কি ঔষধে –কি পুস্তকে –কি পরামর্শে –কি পরিশ্রমে, কোনো অংশ ক্রটি করো নাই। ভায়া ! তোমার গুণকীর্তনে তাহাদিগের অশ্রুপাত হয় –আমি এ সব ভালো জানি –আমার নিকট ভাঁড়াও কেন ?
বরদা। আজ্ঞে না ভাঁড়াই নাই –মহাশয়কে স্বরূপ বলিতেছি, আমা হইতে কাহারো যদি সাহায্য হইয়া থাকে তাহা এত অল্প যে স্মরণ করিলে মনের মধ্যে ধিক্কার জন্মে। সে যা হউক, এখন আমার নিবেদন এই মতিলালের ও ঠকচাচার পরিবারেরা অন্নাভাবে মারা যায় –শুনিতে পাই তাহাদের উপবাসে দিন যাইতেছে, এ কথা শুনিয়া বড়ো দুঃখ হইল, এজন্য আমার নিকট যে দুই শত টাকা ছিল তাহা আনিয়াছি। আপনারা আমার নাম না প্রকাশ করিয়া কোনো কৌশলে এই টাকা পাঠাইয়া দিলে আমি বড়ো আপ্যায়িত হইব।
এই কথা শুনিয়া বেণীবাবু নিস্তব্ধ হইয়া থাকিলেন। বেচারামবাবু ক্ষণেক কাল পরে বরদাবাবুর দিকে দৃষ্টি করিয়া ভক্তিভাবে নয়নবারিতে পরিপূর্ণ হওত তাঁহার গলায় হাত দিয়া বলিলেন –ভাই হে ! ধর্ম যে কি পদার্থ, তুমিই তাহা চিনেছ –আমাদের বৃথা কাল গেল –বেদে ও পুরাণে লেখে যাহার চিত্ত শুদ্ধ সে-ই পরমেশ্বরকে দেখিতে পায় –তোমার যেমন মন পরেমশ্বর তোমাকে তেমনি সুখে রাখুন। তবে রামলালের সংবাদ কিছু পাইয়াছ ?
বরদা। কয়েক মাস হইল হরিদ্বার হইতে এক পত্র পাইয়াছি –তিনি ভালো আছেন –প্রত্যাগমনের কথা কিছুই লেখেন নাই।
বেচারাম। রামলাল ছেলেটি বড়ো ভালো –তাকে দেখলে চক্ষু জুড়ায় –অবশ্য তার ভাল হবে –তোমার সংসর্গের গুণে সে তরে গিয়েছে।
এখানে ঠকচাচা ও বাহুল্য জাহাজে চড়িয়া সাগর পার হইয়া চলিয়াছে। দুটিতে মানিকজোড়ের মতো, এক জায়গায় বসে –এক জায়গায় খায় –এক জায়গায় শোয়, সর্বদা পরস্পরের দুঃখের কথা বলাবলি করে। ঠকচাচা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া বলে –মোদের নসিব বড়ো বুরা –মোরা একেবারে মেটি হলুম –ফিকির কিছু বেরোয় না, মোর শির থেকে মতলব পেলিয়া গেছে –মোকান বি গেল –বিবি সাথে বি মোলাকাত হল না –মোর বড়ো ডর তেনা বি পেল্টে শাদি করে।
বাহুল্য বলিল –দোস্ত ! ওসব বাত দেল থেকে তফাত করো –দুনিয়াদারি মুসাফিরি –সেরেফ আনা যানা –কোই কিসিকা নেহি –তোমার এক কবিলা, মোর চেট্টে –সব জাহানম্মে ডাল দাও, আবি মোদের কি ফিকিরে বেহতর হয় তার তদ্বির দেখো।
বাতাস হু হু বহিতেছে, জাহাজ একপেশে হইয়া চলিয়াছে, তুফান ভয়নক হইয়া উঠিল। ঠকচাচা ত্রাসে কম্পিতকলেবর হইয়া বলিতেছেন –দোস্ত ! মোর বড়ো ডর মালুম হচ্ছে, আন্দাজ হয় মোর মৌত নজদিগ।
বাহুল্য বলিল –মোদের মৌতের বাকি কি ? মোরা মেম্দো হয়ে আছি চলো মোরা নীচু গিয়া আল্লামির দেবাচা পড়ি –মোর বেলকুল নেকজাবান আছে যদি ডুবি তো পীরের নাম নিয়ে চেল্লাব।
২৯.
বৈদ্যবাটির বাটী দখল লওন –বাঞ্ছারামের কুব্যবহার –পরিবারদিগের দুঃখ ও বাটী হইতে বহিষ্কৃত হওন –বরদাবাবুর দয়া।
বাঞ্ছারামবাবুর ক্ষুধা কিছুতেই নিবৃত হয় নয়া –সর্বক্ষণ কেবল দাঁও মারিবার ফিকির দেখেন এবং কিরূপ পাকচক্র করিলে আপনার ইষ্ট সিদ্ধ হইতে পারে তাহাই সর্বদা মনের মধ্যে তোলপাড় করেন। এইরূপ করাতে তাঁহার ধূর্ত বুদ্ধি ক্রমে প্রখর হইয়া উঠিল। বাবুরাম ঘটিত ব্যাপারে সকল উল্টে-পাল্টে দেখতে দেখতে হঠাৎ এক সুন্দর উপায় বাহির হইল। তিনি তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিয়া ভাবিতে ভাবিতে অনেকক্ষণ পরে আপনার উরুর উপর করাঘাত করিয়া আপনা আপনি বলিলেন –এই তো দিব্য রোজগারের পথ দেখিতেছি –বাবুরামের চীনেবাজারের জায়গা ও ভদ্রাসান বাটী বন্ধক আছে, তাহার মেয়াদ শেষ হইয়াছে –হেরম্ববাবুকে বলিয়া আদালতে একটা নালিশ উপস্থিত করাই, তাহা হইলেই কিছুদিনের জন্যে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হইতে পারিবে, এই বলিয়া চাদরখানা কাঁধে দিলেন এবং গঙ্গা দর্শন করিয়া আসি বলিয়া জুতা ফটাস্ ফটাস্ করিয়া মন্ত্রের সাধন কি শরীর পতন, এইরূপ স্থির ভাবে হেরম্ববাবুর বাটীতে গিয়া উপস্থিত হইলেন। দ্বারে প্রবেশ করিয়াই চাকরকে জিজ্ঞাসা করিলেন –কর্তা কোথা রে? বাঞ্ছারামের স্বর শুনিয়া হেরম্ববাবু অমনি নামিয়া আসিলেন –হেরম্ববাবু সাদাসিধে লোক –সকল কথাতেই “হ্যাঁ” বলিয়া উত্তর দেন। বাঞ্ছারাম তাঁহার হাত ধরিয়া অতিশয় প্রণয়ভাবে বলিলেন –চৌধুরী মহাশয় ! বাবুরামকে আপনি আমার কথায় টাকা কর্জ দেন –তাহার সংসার ও বিষয়-আশয় ছারখার হইয়া গেল –মান-সম্ভ্রমও তাহার সঙ্গে গিয়াছে –বড়ো ছেলেটা বানর ছোটটা পাগল, দু-টোই নিরুদ্দেশ হইয়াছে, এক্ষণে দেনা অনেক –অন্যান্য পাওনাওয়ালারা নালিশ করিতে উদ্যত –পরে নানা উৎপাত বাধিতে পারে অতএব আপনাকে আর আমি চুপ করিয়া থাকিতে বলিতে পারি না –আপনি মারগেজি কাগজগুলা দিউন –কালিই আমাদের আপিসে নালিশটি দাগিয়া দিতে হইবেক –আপনি কেবল একখানা ওকালতনামা সহি করিয়া দিবেন। পাছে টাকা ডুবে এই ভয় –এ অবস্থায় সকলেরই হইয়া থাকে –হেরম্ববাবু খল-কপট নহেন, সুতরাং বাঞ্ছারামের উক্ত কথা তাঁহার মনে একেবারে চৌচাপটে লেগে গেল, অমনি “হ্যাঁ” বলিয়া কাগজপত্র তাঁহার হস্তে সমর্পণ করিলেন। হনুমান যেমন রাবণের মৃত্যুবাণ পাইয়া আহ্লাদে লঙ্কা হইতে মহাবেগে আসিয়াছিল, বাঞ্ছারামও ঐ সকল কাগজপত্র ইষ্ট কবজের ন্যায় বগলে করিয়া সেইরূপ ত্বরায় সহর্ষে বাটী আসিলেন।
প্রায় সম্বৎসর হয় –বৈদ্যবাটীর সদর দরওয়াজা বন্ধ –ছাত দেওয়াল ও প্রাচীর শেওলায় মলিন হইল –চারিদিকে অসংখ্য বন –কাঁটানটে ও শেয়ালকাঁটায় ভরিয়া গেল। বাটির ভিতরে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী এই দুইটি অবলামাত্র বাস করেন, তাঁহারা আবশ্যকমতে খিড়কি দিয়া বাহির হয়েন। অতি কষ্টে তাঁহাদের দিনপাত হয় –অঙ্গে মলিন বস্ত্র –মাসের মধ্যে পনের দিন অনাহারে যায় –বেণীবাবুর দ্বারা যে টাকা পাইয়াছিলেন তাহা দেনা পরিশোধ ও কয়েক মাসের খরচেই ফুরাইয়া গিয়াছে সুতরাং এক্ষণে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইতেছেন ও নিরুপায় হইয়া ভাবিতেছেন।
মতিলালের স্ত্রী বলিতেছেন –ঠাক্রুন ! আমরা আর জন্মে কতই পাপ করেছিলাম তাহা বলিতে পারি না –বিবাহ হইয়াছে বটে কিন্তু স্বামীর মুখ কখনও দেখিলাম না –স্বামী একবারও ফিরে দেখেন না –বেঁচে আছি কি মরেছি তাহাও একবার জিজ্ঞাসা করেন না –স্বামী মন্দ হইলেও তাঁহার নিন্দা করা স্ত্রীলোকের কর্তব্য নহে –আমি স্বামীর নিন্দা করি না –আমার কপাল পোড়া, তাঁহার দোষ কি ? কেবল এইমাত্র বলি এক্ষণে যে ক্লেশ পাইতেছি স্বামী নিকটে থাকিলে এ ক্লেশ ক্লেশ বোধ হইত না। মতিলালের বিমাতা বলিলেন –মা ! আমাদের মতো দুঃখিনী আর নাই –দুঃখের কথা বলতে গেলে বুক ফেটে যায় –দীন-হীনদের দীননাথ বিনা আর গতি নাই ।
লোকের যাবৎ অর্থ থাকে তাবৎ চাকর দাসী নিকটে থাকে, ঐ দুই অবলার ঐরূপ অবস্থা হইলে সকলেই চলিয়া গিয়াছিল, মমতাবশত একজন প্রাচীনা দাসী নিকটে থাকিত –সে আপনি ভিক্ষাশিক্ষা করিয়া দিনপাত করিত। শাশুড়ী বৌয়ে ঐরূপ কথাবার্তা হইতেছে এমতো সময়ে ঐ দাসী থর্ থর্ করে কাঁপতে কাঁপতে আসিয়া বলিল –অগো মাঠাকরুনরা ! জানালা দিয়া দেখো –বাঞ্ছারামবাবু সার্জন ও পেয়াদা সঙ্গে করিয়া বাড়ি ঘিরে ফেলেছেন –আমাকে দেখে বললেন –মেয়েদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বল্। আমি বললুম –মোশাই ! তাঁরা কোথায় যাবেন? অমনি চোক লাল করে আমার উপর হুমকে বল্লেন –তারা জানে না এ বাড়ি বন্ধক আছে –পাওনাওয়ালা কি আপনার টাকা গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবে? ভালো চায় তো এই বেলা বেরুক তা না হলে গলাটিপি দিয়া বার করে দিব। এই কথা শুনিবা মাত্র শাশুড়ী-বৌয়ে ঠক্ ঠক্ করিয়া কাঁপিতে লাগিলেন। এদিকে সদর দরওয়াজা ভাঙ্গিবার শব্দে বাড়ি পরিপূর্ণ হইল, রাস্তায় লোকারণ্য, বাঞ্ছারাম আস্ফালন করিয়া “ভাং ডাল ভাং ডাল” হুকুম দিতেছেন ও হাত নেড়ে বলতেছেন –কার সাধ্য দখল লওয়া বন্ধ করিতে পারে –এ কি ছেলের হাতের পিটে ? কোর্টের হুকুম এখনি বাড়ি ভেঙ্গে দখল লব –ভালো মানুষ টাকা কর্জ দিয়া কি চোর? এ কি অন্যায়? পরিবারেরা এখনি বেরিয়ে যাউক। অনেক লোক জমা হইয়াছিল। তাহাদের মধ্যে দুই ব্যক্তি অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া বলিল –ওরে বাঞ্ছারাম ! তোর বাড়া নরাধম আর নাই –তোর মন্ত্রণায় এ ঘরটা গেল –চিরকালটা জুয়াচুরি করে এ সংসার থেকে রাশ রাশ টাকা লয়েছিস –এক্ষণে পরিবারগুলোকে আবার পথে বসাইতে বসেছিস –তোর মুখ দেখলেও চান্দ্রায়ণ করিতে হয় –তোর নরকেও ঠাঁই হবে না। বাঞ্ছারাম এ সব কথায় কান না দিয়া দরওয়াজা ভাঙ্গিয়া সার্জন সহিত বাড়ির ভিতর হুরমুড় করিয়া প্রবেশ করত অন্তঃপুরে গমন করেন –এমন সময়ে মতিলালের বিমাতা ও স্ত্রী দুইজনে ঐ প্রাচীনা দাসীর দুই হাত ধরিয়া হে পরমেশ্বর ! অবলা দুঃখিনী নারীদের রক্ষা করো, এই বলিতে বলিতে চক্ষের জল পুঁছিতে পুঁছিতে খিড়কি দিয়া বাহির হইয়া আসিলেন। মতিলালের স্ত্রী বলিলেন –মাগো ! আমরা কুলের কামিনী –কিছুই জানি না –কোথায় যাইব? পিতা সবংশে গিয়াছেন –ভাই নাই –বোন নাই –কুটুম্ব নাই –আমাদের কে রক্ষা করিবে? হে পরমেশ্বর ! এখন আমাদের ধর্ম ও জীবন তোমার হাতে –অনাহারে মরি সেও ভালো, যেন ধর্ম নষ্ট হয় না। অনন্তর পাঁচ-সাত পা গিয়া একটি বৃক্ষের তলায় দাঁড়াইয়া ভাবিতেছেন, ইতিমধ্যে একখানা ডুলি সঙ্গে বরদাপ্রসাদবাবু ঘাড় নত করিয়া ম্লানবদনে সম্মুখে আসিয়া বলিলেন –ওগো ! তোমরা কাতর হইও না, আমাকে সন্তানস্বরূপ দেখো –তোমাদের নিকট আমার ভিক্ষা যে ত্বরায় এই ডুলিতে উঠিয়া আমার বাটীতে চলো –তোমাদিগের নিমিত্তে আমি স্বতন্ত্র ঘর প্রস্তত করিয়াছি –সেখানে কিছুদিন অবস্থিতি করো, পরে উপায় করা যাইবে। বরদাবাবুর এই কথা শুনিয়া মতিলালের স্ত্রী ও বিমাতা যেন সমুদ্রে পড়িয়া কূল পাইলেন। কৃতজ্ঞতায় মগ্ন হইয়া বলিলেন, –বাবা ! আমাদিগের ইচ্ছা হয় তোমার পদতলে পড়িয়া থাকি –এ সময় এমতো কথা কে বলে ? বোধ হয় তুমি আর জন্মে আমাদিগের পিতা ছিলে। বরদাবাবু তাঁহাদিগকে ত্বরায় সোয়ারিতে উঠাইয়া আপন গৃহে পাঠাইয়া দিলেন। অন্যের সহিত দেখা হইলে তাহারা পাছে একথা জিজ্ঞসা করে এজন্য গলি-ঘুঁজি দিয়া আপনি শীঘ্র বাটী আইলেন।
৩০.
মতিলালের বারাণসী গমন ও সৎসঙ্গ লাভে চিত্তশোধন। তাহার মাতা ও ভগনীর দুঃখ, রামলাল ও বারদাবাবুর সহিত সাক্ষাৎ -পরে তাহাদের মতিলালের সঙ্গে দেখা, পথে ভয় ও বৈদ্যবাটীতে প্রত্যাগমন।
সদুপদেশ ও সৎসঙ্গে সুমতি জন্মে, কাহারো অল্প বয়সে হয় –কাহারো অধিক বয়সে হইয়া থাকে। অল্প বয়সে সুমতি না হইলে বড়ো প্রমাদ ঘটে –যেমন বনে অগ্নি লাগিলে হু হু করিয়া দিগদাহ করে অথবা প্রবল বায়ু উঠিলে একেবারে বেগে গমন করত বৃক্ষ অট্টালিকাদি ছিন্নানি করিয়া ফেলে সেইরূপ শৈশবাবস্থায় দুর্মতি জন্মিলে ক্রমশ রক্তের তেজে সতেজ হওয়াতে ভয়ানক হইয়া উঠে। এ বিষয়ের ভুরি ভুরি নিদর্শন সদাই দেখা যায়। কিন্তু কোনো কোনো ব্যক্তি কিয়াৎকাল দুর্মতি ও অসৎ কর্মে রত থাকিয়া অধিক বয়সে হঠাৎ ধার্মিক হইয়া উঠে, ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়। এইরূপ পরিবর্তনের মূল সদুপদেশ বা সৎসঙ্গ। পরন্তু কাহারো দৈবাৎ কাহারো বা কোনো ঘটনায় কাহারো বা একটি কথাতেই কখন কখন হঠাৎ চেতনা হইয়া থাকে –এরূপ পরিবর্তন অতি অসাধারণ।
মতিলাল যশোহর হইতে নিরাশ হইয়া আসিয়া সঙ্গীদিগকে বলিলেন –আমার কপালে ধন অন্বেষণ করা বৃথা, এক্ষণে উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কিছু দিনের জন্য ভ্রমণ করিয়া আসি –তোমরা কেহ আমার সঙ্গে যাবে? সকলেই লক্ষ্মীর বরযাত্রী –অর্থ হাতে থাকিলে কাহাকেও ডাকিতে হয় না –অনেকে আপনা আপনি আসিয়া জুটে যায় কিন্তু অর্থাভাব হইলে সঙ্গী পাওয়া ভার। মতিলালের নিকট যাহারা থাকিত, তাহারা আমোদ-প্রমোদ ও অর্থের অনুরোধে আত্মীয়তা দেখাত –বস্তুত মতিলালের প্রতি তাহাদের কিছুমাত্র আন্তরিক স্নেহ ছিল না। তাহারা যখন দেখিল যে তাহার কোনো যোত্র নাই –চতুর্দিকে দেনা, বাবুয়ানা করা দূরে থাকুক আহারাদিও চলা ভার, তখন মনে করিল উহার সঙ্গে প্রণয় রাখার কি ফল ? এক্ষণে ছট্কে পড়া শ্রেয়। মতিলাল ঐ প্রকার প্রশ্ন করিয়া দেখিলেন কেহই কোনো উত্তর দেয় না। সকলেই ঢোঁক গিলিয়া এঁ ওঁ করিয়া নানা ওজর ও অন্যান্য বরাতের কথা ফেলে। তাহাদিগের ব্যবহারে মতিলাল বিরক্ত হইয়া বলিলেন –বিপদেই বন্ধু টের পাওয়া যায়, এতদিনের পর আমি তোমাদিগকে চিনলাম –যাহা হউক এক্ষণে তোমরা আপন আপন বাটী যাও, আমি দেশ ভ্রমণে চলিলাম। সঙ্গীরা বলিল –বড়োবাবু ! রাগ করিও না –আপনি বরং আগু হউন আমরা আপন আপন বরাত মিটাইয়া পশ্চাৎ জুট্ব। মতিলাল তাহাদের কথায় আর কান না দিয়া পদব্রজে চলিলেন এবং স্থানে স্থানে অতিথি হইয়া ও ভিক্ষা মাঙিয়া তিন মাসের পর বারাণসীতে উত্তরিলেন। এই প্রকার দুরবস্থায় পড়িয়া ক্রমাগত একাকী চিন্তা করাতে তাঁহার মনের গতি বিভিন্ন হইতে লাগিল। বহু ব্যয়ে নির্মিত মন্দির, ঘাট ও অট্টালিকা ভগ্ন হইয়া যাবার উপক্রম হইতেছে –বহু বহু শাখায় বিস্তীর্ণ তেজস্বী প্রাচীন বৃক্ষের জীর্ণাবস্থা দৃষ্ট হইল –নদ-নদী, গিরি-গুহার অবস্থা চিরকাল সমান থাকে না –ফলত কালেতে সকলেরই পরিবর্তন ও ক্ষয় হইয়া থাকে –সকলই অনিত্য –সকলই অসার। মানবগণও রোগ, জরা, বিয়োগ, শোক ও নানা দুঃখে অভিভূত ও সংসারে মদ মাৎসর্য ও আমোদ সকলই জলবিম্ববৎ। মতিলাল ঐ সকল ধ্যান করিয়া প্রতিদিন বারাণসী ধামের চতুর্দিকে প্রদক্ষিণ করত বৈকালে গঙ্গাতীরস্থ এক নির্জন স্থানে বসিয়া দেহের অসারত্ব, আত্মার সারত্ব, এবং আপন চরিত্র ও কর্মাদি পুনঃ পুনঃ চিন্তা করিতে লাগিলেন। এইরূপ চিন্তা করাতে তাঁহার তমঃ খর্ব হইতে লাগিল সুতরাং আপনার পূর্ব কর্মাদি ও উপস্থিত দুর্মতি প্রভৃতি জাগরূক হইয়া উঠিল। মনের এবম্প্রকার গতি হওয়াতে তাঁহার আপনার প্রতি ধিক্কার জন্মিল এবং ঐ ধিক্কারে অত্যন্ত সন্তাপ হইতে লাগিল। তখন আপনাকে সর্বদা এই জিজ্ঞাসা করিতেন –আমার পরিত্রাণ কিরূপে হইতে পারে –আমি যে কুকর্ম করিয়াছি তাহা স্মরণ করিলে এখনও হৃদয় দাবানলের ন্যায় জ্বালিয়া উঠে। এইরূপ ভাবনায় নিমগ্ন থাকেন –আহারাদি ও পরিধেয় বস্ত্রাদির প্রতি দৃক্পাতও নাই –ক্ষিপ্তপ্রায় ভ্রমণ করিয়া বেড়ান। কিছুকাল এই প্রকারে ক্ষেপণ হইলে দৈবাৎ এক দিবস দেখিলেন একজন প্রাচীন পুরুষ তরুতলে বসিয়া মনঃসংযোগ পূর্বক এক একবার একখানি গ্রন্থ দেখিতেছেন ও এক একবার চক্ষু মুদিত করিয়া ধ্যান করিতেছেন। ঐ ব্যক্তিকে দেখিলে হঠাৎ বোধ হয় সে বহুদর্শী –জ্ঞানের সারাংশ গ্রহণ এবং মনঃসংযম বিলক্ষণ হইয়াছে। তাঁহার মুখ দর্শন করিলে তৎক্ষণাৎ ভক্তির উদয় হয়। মতিলাল তাঁহাকে দেখিবামাত্রে নিকটে যাইয়া সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া দাঁড়াইয়া থাকিলেন। কিয়ৎকাল পরে ঐ প্রাচীন পুরুষ মতিলালের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন –বাবা ! তোমার আকার প্রকারে বোধ হয় তুমি ভদ্র সন্তান –কিন্তু এমতো সন্তাপিত হইয়াছ কেন ? এই মিষ্ট কথায় উৎসাহ পাইয়া, মতিলাল অকপটে আনুপূর্বিক আপন পরিচয় দিয়া কহিলেন –মহাশয় ! আপনাকে অতি বিজ্ঞ দেখিতেছি –আমি আপনার দাস হইলাম –আমাকে কিঞ্চিৎ সদুপদেশ দিউন। সেই প্রাচীন পুরুষ মতিলালের সরল চিত্ত দেখিয়া তুষ্ট হইলেন। মানব স্বভাব এই যে পরস্পরের প্রতি সন্তোষ না জন্মিলে মন খোলাখুলি হয় না, প্রথম আলাপেই যদি এমতো তুষ্টি জন্মে তাহা হইলে পরস্পরের মনের কথা শীঘ্রই ব্যক্ত হয়, আর একজন সারল্য প্রকাশ করিলে অন্য ব্যক্তি অতিশয় কপট না হইলে কখনই কপটতা প্রকাশ করিতে পারে না। ঐ প্রাচীন পুরুষ অতি ধার্মিক, মতিলালের সরলতায় তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতে লাগিলেন। অনন্তর পারমার্থিক বিষয়ে তাঁহার যে অভিপ্রায় ছিল তাহা ক্রমশঃ ব্যক্ত করিলেন। তিনি বারম্বার বলিলেন –বাবা ! সকল ধর্মের তাৎপর্য এই কায়মনোচিত্তে ভক্তি-স্নেহ ও প্রেম প্রকাশপূর্বক পরমেশ্বরের উপসনা করা, এই কথাটি সর্বদা ধ্যান করো ও মন, বাক্য ও কর্ম দ্বারা অভ্যাস করো। এই উপদেশটি তোমার মনে দৃঢ়রূপে বদ্ধমূল হইলেই মনের গতি একেবারে ফিরিয়া যাবে, তখন অন্যান্য ধর্ম অনুষ্ঠান আপনা আপনি হইবে কিন্তু পরমেশ্বরের প্রেমার্থ মনের দ্বারা, বাক্যের দ্বারা ও কর্মের দ্বারা সদা একরূপ থাকা অতি কঠিন –সংসারে রাগ, দ্বেষ, লোভ, মোহ ইত্যাদি রিপু সকল বিজাতীয় ব্যাঘাত করে এজন্য একাগ্রতা ও দৃঢ়তার অত্যন্ত আবশ্যক। মতিলাল উক্ত উপদেশ গ্রহণপূর্বক মনের সহিত প্রতিদিন পরমেশ্বরের ধ্যান ও উপাসনায় রত এবং আত্মদোষানুসন্ধানে ও শোধনে সযত্ন হইলেন। কিছুকাল এইরূপ করাতে তাঁহার মনোমধ্যে জগদীশ্বরের প্রতি ভক্তির উদয় হইল। সাধুসঙ্গের কী অনির্বচনীয় মাহাত্ম্য। যিনি মতিলালের উপদেশক, তিনি ধার্মিক চূড়ামণি, তাঁহার সহবাসে মতিলালের যে এমন মতি হইবে ইহা কোন্ বিচিত্র।
পরমেশ্বরের প্রতি ঐকান্তিক ভক্তি হওয়াতে যাবতীয় মনুষ্যের প্রতি মতিলালের মনে ভ্রাতৃবৎ ভাব জন্মিল –তখন পিতা-মাতা ও পরিবারের প্রতি স্নেহ, পরদুঃখ মোচন ও পরহিতার্থ বাসনা উত্তরোত্তর প্রবল হইতে লাগিল। সত্য ও সরলতার বিপরীত দর্শন অথবা শ্রবণ হইলেই বিজাতীয় অসুখ হইত। মতিলাল আপন মনের ভাব ও পূর্ব কথা সর্বদাই ঐ প্রচীন পুরুষের নিকট বলিতেন ও মধ্যে মধ্যে খেদ করিয়া কহিতেন –গুরো ! আমি অতি দুরাত্মা, পিতা, মাতা, ভাই, ভগিনী ও অন্যান্য লোকের প্রতি যে প্রকার ব্যবহার করিয়াছি তাহাতে নরকেও যে আমার স্থান হয় এমন বোধ হয় না। ঐ প্রাচীন পুরুষ সান্ত্বনা করিয়া বলিতেন –বাবা ! তুমি প্রাণপণে সদভ্যাসে রত থাকো –মনুষ্য মাত্রেই মনোজ, বাক্যজ ও কর্মজ পাপ করিয়া থাকে, পরিত্রাণের ভরসা কেবল সেই দয়াময়ের দয়া –যে ব্যক্তি আপন পাপ জন্য অন্তঃকরণের সহিত সন্তাপিত হইয়া আত্মশোধনার্থ প্রকৃতরূপে যত্নশীল হয় তাহার কদাপি মার নাই। মতিলাল এ সকল শুনেন ও অধোবদন হইয়া ভাবেন এবং সময়ে সময়ে বলেন আমার মা, বিমাতা, ভগিনী, ভ্রাতা, স্ত্রী –ইঁহারা কোথায় গেলেন? ইঁহাদের জন্য মন উচাটন হইতেছে।
শরতের আবির্ভাব –ত্রিযামা অবসান –বৃন্দাবনের কিবা শোভা ! চারিদিকে তাল, তমাল, শাল, পিয়াল, বকুল আদি নানাজাতি বৃক্ষ –তদুপরি সহস্র সহস্র পক্ষী নানা রবে গান করিতেছে –বায়ু মন্দ মন্দ বহিতেছে –যমুনার তরঙ্গ যেন রঙ্গচ্ছলে পুলিনের একাঙ্গ হইতেছে –ব্রজবালক ও ব্রজবালিকারা কুঞ্জে কুঞ্জে পথে পথে বীণা বাজাইয়া ভজন গাইতেছে। নিশাবসানে দেবালয় সকলে মঙ্গলারতির সময় সহস্র সহস্র শঙ্খ-ঘণ্টার ধ্বনি হইতেছে। কেশী ঘাটে কচ্ছপ সকল কিল্বিল্ করিতেছে –বৃক্ষাদির উপরে লক্ষ লক্ষ বানর উল্লম্ফন প্রোল্লম্ফন করিতেছে –কখন লাঙ্গুল জড়ায় –কখন প্রসারণ করে –কখন বিকট বদন প্রদর্শনপূর্বক ঝুপ করিয়া পড়িয়া লোকের খাদ্য সামগ্রী কাড়িয়া লয়।
নানা বনে শত শত তীর্থযাত্রী পরিক্রমণ করিতেছে –নানা স্থান দর্শন করিয়া শ্রীকৃষ্ণের নানা লীলার কথা কহিতেছে। এদিকে প্রখর রবি –মৃত্তিকা উত্তপ্ত –পদব্রাজে যাওয়া অতি কঠিন, এ কারণ অনেক যাত্রী স্থানে স্থানে বৃক্ষতলে বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে। মতিলালের মাতা কন্যার হাত ধরিয়া ভ্রমণ করিতেছিলেন, অত্যন্ত শ্রান্তিযুক্ত হওয়াতে একটি নির্জন স্থানে বসিয়া কন্যার ক্রোড়ে মস্তক রাখিয়া শয়ন করিলেন। কন্যা আপন অঞ্চল দিয়া আক্লান্ত মাতার ঘর্ম মুছিয়া বাতাস করিতে লাগিল। মাতা কিঞ্চিৎ স্নিগ্ধ হইয়া বলিলেন –প্রমদা ! বাছা তুই একটু বিশ্রাম কর –আমি উঠে বসি। কন্যা উত্তর করিল –মা ! তোমার শ্রান্তি দূর হওয়াতেই আমার শ্রান্তি গিয়াছে –তুমি শুয়ে থাকো আমি তোমার দু-টি পায়ে হাত বুলাই। কন্যার এইরূপ সস্নেহ বাক্য শুনিয়া মাতা সজল নয়নে বলিলেন –বাছা ! তোর মুখ দেখেই বেঁচে আছি –জন্মান্তরে কত পাপ করেছিলাম, তা না হলে এত দুঃখ কেন হবে ? আপনি অনাহারে মরি তাতে খেদ নাই, তোকে এক মুটা খাওয়াই এমন সঙ্গতি নাই –এই আমার বড়ো দুঃখ ! এ দুঃখ রাখবার কি ঠাঁই আছে ? আমার দু-টি পুত্র কোথায় ? বৌটি বা কেমন আছে ? কেনই বা রাগ করে এলাম ? মতি আমাকে মেরেছিল –মেরেই ছিল, ছেলেতে আবদার করে কি-না বলে –কি-না করে ? এখন তার আর রামের জন্যে আমার প্রাণ সর্বদাই ধড়ফড় করে। কন্যা মাতার চক্ষের জল মুছাইয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিল। কিয়ৎকাল পরে মাতার একটু তন্দ্রা হইল। কন্যা মাতাকে নিদ্রিত দেখিয়া সুস্থির হইয়া বসিয়া একটু একটু বাতাস দিতে আরম্ভ করিল। দুহিতার শরীরে মশা ও ডাঁশ বসিয়া কামড়াইতে লাগিল কিন্তু পাছে মায়ের নিদ্রা ভঙ্গ হয় এজন্য তিনি স্থির হইয়া থাকিলেন। স্ত্রীলোকেদের স্নেহ ও সহিষ্ণুতা আশ্চর্য ! বোধ হয় পুরুষ অপেক্ষা স্ত্রীলোক এ বিষয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ। মাতা নিদ্রাবস্থায় স্বপ্ন দেখিতেছেন যেন একটি পীতবসন নবকিশোর তাঁহার নিকটে আসিয়া বলিতেছেন –”মা ! তুই আর কাঁদিস্ না –তুই বড়ো পুণ্যবতী –অনেক দুঃখী-কাঙালীর দুঃখ নিবারণ করিয়াছিস –তুই কাহারো ভালো বই কখন মন্দ করিস নাই। –তোর শীঘ্র ভালো হবে –তুই দুই পুত্র পাইয়া সুখী হইবি।” দুঃখিনী মাতা চমকিয়া উঠিয়া চক্ষুউন্মীলন করিয়া দেখেন কেবল কন্যা নিকটে আছে আর কেহই নাই। পরে কন্যাকে কিছু না বলিয়া তাহার হস্ত ধারণপূর্বক বহু ক্লেশে আপনাদের কুঞ্জে প্রত্যাগমন করিলেন।
মায়ে-ঝিয়ে সর্বদা কথোপকথন হয় – মা বলেন, বাছা ! মন বড় চঞ্চল হইতেছে, বাড়ি যাব সর্বদা এই ভাবতেছি। কন্যা কিছুই উপায় না দেখিয়া বলিল –মা ! আমাদিগের সম্বলের মধ্যে দুই-একখানি কাপড় ও জল খাবার ঘটিটি আছে –ইহা বিক্রয় করিলে কি হতে পারবে ? কিছু দিন স্থির হও আমি রাঁধুনী অথবা দাসীর কর্ম করিয়া কিছু সঞ্চয় করি তাহা হইলেই আমাদের পথ খরচের সংস্থান হইবে। মা এ কথা শুনিয়া দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া নিস্তব্ধ থাকিলেন, চক্ষের জল আর রাখিতে পারিলেন না। মাতাকে কাতর দেখিয়া কন্যাও কাতর হইল। নিকটে একজন ব্রজবাসিনী থাকিতেন, তিনি সর্বদা তাহাদিগের তত্ত্ব লইতেন, দৈবাৎ ঐ সময়ে আসিয়া তাহাদিগকে দুঃখিত দেখিয়া সান্ত্বনা করণানন্তর সকল বৃত্তান্ত শুনিলেন। তাহাদিগের দুঃখে দুঃখিত হইয়া সেই ব্রজবাসিনী বলিলেন –মায়ী ! কি বলব আমার হাতে কড়ি নাই –আমার ইচ্ছা হয় সর্বস্ব দিয়া তোমাদের দুঃখ মোচন করি, এখন একটি উপায় বলে দি তোমরা তাই করো। শুনিতে পাই এক বাঙালী বাবু চাকরি ও তেজারতের দ্বারা কিছু বিষয় করিয়া মথুরায় আসিয়া বাস করিতেছেন –তিনি বড়ো দয়ালু ও দাতা, তোমরা তাঁর কাছে গিয়া পথ খরচ চাহিলে অবশ্যই পাইবে। দুঃখিনী মাতা ও কন্যা অন্য কোনো উপায় না দেখাতে প্রস্তাবিত উপায়ই অবলম্বন করিতে বাধ্য হইলেন। তাঁহারা ব্রজবাসিনীর নিকট বিদায় লইয়া দুই দিনের মধ্যে মথুরায় উপস্থিত হইলেন। সেখানে এক সরোবরের নিকটে যাইয়া দেখেন কতকগুলিন আতুর, অন্ধ, ভগ্নাঙ্গ, দুঃখী, দরিদ্র লোক একত্র বসিয়া রোদন করিতেছে। মাতা তাহাদিগের মধ্যে একজন প্রাচীনা স্ত্রীলোককে জিজ্ঞাসা করিলেন –বাছা! তোমরা কাঁদিতেছ কেন ? ঐ স্ত্রীলোক বলিল –মা ! এখানে এক বাবু আছেন তাঁহার গুণের কথা কি বলিব ? তিনি গরীব দুঃখীর বাড়ি বাড়ি ফিরিয়া তাহাদের খাওয়া-পরা দিয়া সর্বদা তত্ত্ব লয়েন আর কাহারো ব্যারাম হইলে আপনি তার শেওরে বসিয়া সারারাত্রি জাগিয়া ঔষধ-পথ্য দেন। তিনি আমাদের সকলের সুখে সুখী ও দুঃখে দুঃখী। সেই বাবুর গুণ মনে করতে গেলে চক্ষে জল আইসে –যে মেয়ে এমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করিয়াছেন তিনিই ধন্য –তাঁহার অবশ্যই স্বর্গ ভোগ হইবে –এমন লোক যেখানে বাস করেন সে স্থান পুণ্য স্থান। আমাদিগের পোড়া কপাল যে ঐ বাবু এখন এ দেশ হইতে চলিলেন –এর পর আমাদের দশা কি হবে তাই ভাবিয়া কাঁদছি। মাতা ও কন্যা এই কথা শুনিয়া পরস্পর বলাবলি করিতে লাগিলেন –বোধ হয় আমাদিগের আশা নিষ্ফল হইল –কপালে দুঃখ আছে, ললাটের লিপি কে ঘুচাইবে ? উক্ত প্রাচীনা তাহাদিগের বিষণ্ণ ভাব দেখিয়া বলিল, –আমার অনুমান হয় তোমারা ভদ্র ঘরের মেয়ে –ক্লেশে পড়িয়াছ। যদি কিছু টাকাকড়ি চাহ তবে এই বেলা আমার সঙ্গে ঐ বাবুর নিকটে যাবে চলো, তিনি গরীব-দুঃখী ছাড়া অনেক ভদ্রলোকেরও সাহায্য করেন। মাতা ও কন্যা তৎক্ষণাৎ সম্মত হইলেন এবং সেই বৃদ্ধার পশ্চাৎ পশ্চাৎ যাইয়া আপনারা বাটীর বাহিরে থাকিলেন, বুড়ী ভিতরে গেল।
দিবা অবসান –সূর্য অস্ত হইতেছে –দিনকরের কিরণে বৃক্ষাদির ও সরোবরের বর্ণ সুবর্ণ হইতেছে। যেখানে মাতা ও কন্যা দাঁড়াইয়াছিলেন সেখানে একখানি ছোট উদ্যান ছিল। স্থানে স্থানে মেরাপে নানা প্রকার লতা, চারিদিকে কেয়ারি ও মধ্যে এক এক চবুতারা। ঐ বাগানের ভিতরে দুইজন ভদ্রলোক হাত ধরাধরি করিয়া কৃষ্ণার্জুনের ন্যায় বেড়াইতেছিল। দৈবাৎ ঐ দুই স্ত্রীলোকের প্রতি দৃষ্টিপাত হওয়াতে তাঁহারা ব্যস্তসমস্ত হইয়া বাগান হইতে বাহির হইয়া তাঁহাদিগের নিকট আসিলেন। মাতা ও কন্যা তাঁহাদিগকে দেখিয়া সঙ্কুচিত হইয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া একটু অন্তরে দাঁড়াইলেন। ঐ দুইজন ভদ্রলোকের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি কোমল বাক্যে বলিলেন –আপনারা আমাদিগকে সন্তানস্বরূপ বোধ করিবেন –লজ্জা করিবেন না –আপনারা কি নিমিত্ত এখানে আগমন করিয়াছেন, আমাদিগের নিকট বিশেষ করিয়া বলুন, যদি আমাদিগের দ্বারা কোনো সাহায্য হইতে পারে আমরা তাহাতে কোনো প্রকার ক্রটি করিব না। এই কথা শুনিয়া মাতা কন্যার হাত ধরিয়া কিঞ্চিৎ অগ্রবর্তিনী হইয়া আপন অবস্থা সংক্ষেপে ব্যক্ত করিলেন। তাঁহার কথা সমাপ্ত হইতে না হইতে ঐ দুইজন ভদ্রলোক পরস্পর মুখাবলোকন করিয়া তাহাদিগের মধ্যে যাহার কম বয়েস তিনি একেবারে মায়াতে মুগ্ধ হইয়া মা মা বলিয়া ভূমিতে পড়িয়া গেলেন, অন্য আর একজন অধিকবয়স্ক ব্যক্তি দুঃখিনী মাতার চরণে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিলেন –মা গো ! দেখো কি? যে ভূমিতে পড়িয়াছে সে তোমার অঞ্চলের ধন –সে তোমার রাম, আমার নাম বরদাপ্রসাদ বিশ্বাস। মাতা এই কথা শুনিবামাত্রে মুখের কাপড় খুলিয়া বলিলেন –বাবা ! তুমি কি বলিলে ? এ অভাগিনীর কি এমন কপাল হবে ? রামলাল চৈতন্য পাইয়া চরণে মস্তক দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন, জননী পুত্রের মস্তক ক্রোড়ে রাখিয়া অশ্রুপাত করিতে করিতে তাহার মুখাবলোকন করিয়া আপন তাপিত মনে সান্তুনাবারি সেচন করিতে লাগিলেন ও ভগিনী আপন অঞ্চল দিয়া ভ্রাতার চক্ষের জল ও গায়ের ধূলা পুঁছাইয়া দিয়া নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। এদিকে ঐ বুড়ী বাটীর মধ্যে বাবুকে না পাইয়া তাড়াতাড়ি বাগানে আসিয়া দেখে যে বাবু তাহার সমভিব্যাহারিণী প্রাচীনা স্ত্রীলোকের কোলে মস্তক দিয়া ভূমে শয়ন করিয়া আছেন –ও মা এ কি গো ! ওগো বাবুর কি ব্যারাম হয়েছে ? আমি কি কবিরাজ ডেকে আনব ? বুড়ী এই বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিল। বরদাপ্রসাদবাবু বলিলেন, স্থির হও –বাবুর পীড়া হয় নাই, এই যে দুইটি স্ত্রীলোক –এঁরা বাবুর মা ও ভগিনী। বুড়ী উত্তর করিল –বাবু ! দুঃখী বলে কি ঠাট্টা করতে হয় ? বাবু হলেন লক্ষপতি, আর এঁরা হল পথের কাঙালিনী –আমার সঙ্গে এসে কেও হলেন মা, কেও হলেন বোন। বোধ হয় এরা কামিখ্যার মেয়ে –ভেল্কিতে ভুলিয়েছে বাবা। এমন মেয়েমানুষ কখন দেখি না –এদের জাদুকে গড় করি মা ! বুড়ী এইরূপ বকতে বকতে ত্যক্ত হইয়া চলিয়া গেল।
এখানে সকলে সুস্থির হইয়া বাটী আগমন করিলেন, তথায় পুত্রবধুকে ও সপত্নীকে দেখিয়া মাতার পরম সন্তোষ হইল, পরে আপনার আর আর পরিবারের কথা অবগত হইয়া বলিলেন, বাবা রাম ! চলো, বাটী যাই –আমার মতি কোথায় –তার জন্য মন বড়ো অস্থির হইতেছে। রামলাল পূর্বেই বাটী যাওনের উদ্যোগ করিয়াছিলেন –নৌকাদি ঘাটে প্রস্তুত ছিল। মাতার আজ্ঞানুসারে উত্তম দিন দেখিয়া সকলকে লইয়া যাত্রা করিলেন –যাত্রাকালীন মথুরার যাবতীয় লোক ভেঙে পড়িল –সহস্র সহস্র চক্ষু বারিতে পরিপূর্ণ হইল –সহস্র সহস্র কর তাঁহার আশীর্বাদার্থ উত্থিত হইল। যে বুড়ী বিরক্ত হইয়াছিল সে জোড়হাত করিয়া রামলালের মাতার নিকট আসিয়া কাঁদিতে লাগিল, নৌকা যে পর্যন্ত দৃষ্টিপথ অতিক্রম না করিল সে পর্যন্ত সকলে যমুনার তীরে যেন প্রাণশূন্য দেহে দাঁড়াইয়া রহিল।
এদিকে একটানা –দক্ষিণে বায়ুর সঞ্চার নাই –নৌকা স্রোতের জোরে বেগে চলিয়া অল্প দিনের মধ্যেই বারাণসীতে আসিয়া উত্তীর্ণ হইল। বারাণসীর মধ্যে প্রাতঃকালীন কিবা শোভা। কত কত দোবেদী, চৌবেদী, রামাৎ, নেমাৎ, শৈব, শাক্ত, গাণপত্য, পরমহংস ও ব্রহ্মচারী স্তোত্র পাঠ করিতেছেন –কত কত সামবেদী কঠ কৌথুমাদির মন্ত্র ও অগ্নি বায়ুর সূক্ত উচ্চারণ করিতেছেন –কত কত সুরাষ্ট্র, মহারাষ্ট্র, বঙ্গ ও মগধস্থ নানাবর্ণ পট্টবস্ত্র পরিধারিণী নারীরা স্নাত হইয়া মন্দির প্রদক্ষিণ করিতেছে –কত কত দেবালয় ধূপ, ধূনা, পুষ্প, চন্দনের সৌগন্ধে আমোদিত হইতেছে –কত কত ভক্ত “হর হর বিশ্বেশ্বর” শব্দ করতঃ গাল ও কক্ষবাদ্য করিয়া উন্মত্ত হইয়া চলিয়াছে –কত কত রক্তবসনা ত্রিশূলধারিণী ভৈরবী অট্ট অট্ট হাস্য করত ভৈরবালয়ে ভৈরবভাবিনী ভাবে ভ্রমণ করিতেছে –কত কত সন্ন্যাসী, উদাসীন ও উর্দ্ধবাহু জটাজুট সংযুক্ত ও ভস্ম বিভূতি আবৃত হইয়া শরীর ও ইন্দ্রিয়াদি নিগ্রহে সযত্ন আছেন –কত কত যোগী নিজ নিজ বিরল স্থানে সমাধি জন্য রেচক, পূরক ও কুম্ভক করিতেছেন –কত কত কলায়ত, ধাড়ি ও আতাই বীণা, মৃদঙ্গ, রবাব ও তানপুরা লইয়া ধ্রুপদ, ধরু, খেয়াল প্রবন্ধ, ছন্দ, সোরবন্ধ, তেরানা, সারগম, চতুরং ও নক্সগুলে মশগুল হইয়া আছে। রামলাল ও অন্যান্য সকলে মণিকর্ণিকার ঘাটে স্নানাদি করিয়া কাশীতে চারি দিবস অবস্থিতি করিলেন। রামলাল মায়ের ও ভগিনীর নিকট সর্বদা থাকিতেন, বৈকালে বরদাবাবুকে লইয়া ইতস্তত ভ্রমণ করিতেন। এক দিন পর্যটন করিতে করিতে দেখিলেন সম্মুখে একটি মনোরম আশ্রম, সেখানে এক প্রাচীন ব্যক্তি বসিয়া ভাগীরথীর শোভা দেখিতেছেন নদী বেগবতী –বারি তর তর শব্দের চলিয়াছে –আপনার নির্মলত্ব হেতুক বৈকালিক বিচিত্র আকাশকে যেন ক্রোড়ে লইয়া যাইতেছে। রামলাল ঐ ব্যক্তির নিকট যাইবামাত্রে তিনি পূর্বপরিচিতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন –কেমন শুকোপনিষৎ পাঠে তোমার কি বোধ হইল ? রামলাল তাঁহার মুখবলোকন করণানন্তর প্রণাম করিলেন। সেই প্রাচীন কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হইয়া বলিলেন –বাবা ! আমার ভ্রম হইয়াছে –আমার একজন শিষ্য আছে তাহার মুখ ঠিক তোমার মতো, আমি তাহাকেই বোধ করিয়া তোমাকে সম্বোধন করিয়াছিলাম। পরে রামলাল ও বরদাবাবু তাঁহার নিকট বসিয়া নানা প্রকার শাস্ত্রীয় আলাপ করিতে লাগিলেন। ইত্যবসরে চিন্তাযুক্ত এক ব্যক্তি অধোবদনে নিকটে আসিয়া বসিলেন। বরদাবাবু তাঁহাকে নিরীক্ষণ করত বলিলেন –রাম ! দেখো কি ?–নিকটে যে তোমার দাদা ! রামলাল এই কথা শুনিবামাত্রে লোমাঞ্চিত হইয়া মতিলালের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন, মতিলাল রামলালকে অবলোকনপূর্বক চমকিয়া উঠিয়া আলিঙ্গন করিলেন। ক্ষণেক কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া –”ভাই হে ! আমাকে কি ক্ষমা করিবে” –মতিলাল এই কথা বলিয়া অনুজের গলায় হাত জড়াইয়া স্কন্ধদেশ নয়নবারিতে অভিষিক্ত করিলেন। দুইজনেই কিয়াৎক্ষণ মৌন ভাবে থাকিলেন –মুখ হইতে কথা নিঃসরণ হয় না –ভাই যে কি পদার্থ তাহা উভয়েরই ঐ সময়ে বিলক্ষণ বোধ হইল। পরে বরদাবাবুর চরণধূলা লইয়া মতিলাল জোড় হাতে বলিলেন –মহাশয় ! আপনি যে কি বস্তু তাহা আমি এত দিনের পর জানিলাম –এ নরাধমকে ক্ষমা করুন। বরদাবাবু দুই ভ্রাতার হাত ধরিয়া উক্ত প্রাচীন ব্যক্তির নিকট হইতে বিদায় লইয়া পথিমধ্যে তাহাদিগের পরস্পরের যাবতীয় পূর্ব কথা শুনিতে শুনিতে ও বলিতে বলিতে চলিলেন এবং আলাপ দ্বারা মতিলালের চিত্তের বিভিন্নতা দেখিয়া অসীম আহ্লাদ প্রকাশ করিলেন। পরিবারেরা যে স্থানে ছিলেন, তথায় আসিলে মতিলাল কিঞ্চিৎ দূর থেকে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন –”কই মা কোথায় ? –মা! তোমার সেই কুসন্তান আবার এল –সে আজো বেঁচে আছে –মরে নাই –আমি যে ব্যবহার করিয়াছি তার পর যে তোমার নিকট মুখ দেখাই এমন ইচ্ছা করে না –এক্ষণে আমার বাসনা এই যে একবার তোমার চরণ দর্শন করিয়া প্রাণ ত্যাগ করি। মাতা এই কথা শুনিবামাত্রে প্রফুল্লচিত্তে অশ্রুযুক্ত নয়নে নিকটে আসিয়া জ্যেষ্ঠ পুত্রের মুখাবলোকনে অমূল্য ধন প্রাপ্ত হইলেন। মতিলাল মাতাকে দেখিবামাত্রেই তাঁহার চরণে মস্তক দিয়া পড়িয়া থাকিলেন। ক্ষণেক কাল পরে মাতা হাত ধরিয়া উঠাইয়া আপন অঞ্চল দিয়া তাহার চক্ষের জল পুঁছাইয়া দিতে লাগিলেন ও বলিলেন –মতি! তোমার বিমাতা, ভগিনী ও স্ত্রী আছেন তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎ করো। মতিলাল ভগিনী ও বিমাতাকে প্রণাম করিয়া আপন পত্নীকে দেখিয়া পূর্বকথা স্মরণ হওয়াতে রোদন করিয়া বলিলেন –মা ! আমি যেমন কুপুত্র, কুভ্রাতা, তেমনি কুস্বামী –এমন সৎস্ত্রীর যোগ্য আমি কোনো প্রকারেই নহি ! স্ত্রী-পুরুষ বিবাহকালীন পরমেশ্বরের নিকট এক প্রকার শপথ করে যে তাহার যাব্জজীবন পরস্পর প্রেম করিবে, মহাক্লেশে পড়িলেও ছাড়াছাড়ি হইবে না –স্ত্রী অন্য পুরুষের প্রতি মন কখন হইবে না এবং পুরুষেরও অন্য স্ত্রীর প্রতি মন কদাপি যাইবে না –ঐরূপ মননে ঘোর পাপ। এই শপথের বিপরীত কর্ম আমা হইতে অনেক হইয়াছে তবে স্ত্রী কর্তৃক আমি পরিত্যক্ত কেন না হই ? আর আমার এমন যে ভাই ও ভগিনী তাহাদিগের প্রতি যৎপরোনাস্তি নিগ্রহ করিয়াছি –তুমি যে মা –যার বাড়া পৃথিবীতে অমূল্য বস্তু আর নাই –তোমাকে অসীম ক্লেশ দিয়াছি –পুত্র হইয়া তোমাকে প্রহার করিয়াছি। মা ! এ সকল পাপের কি প্রায়শ্চিত্ত আছে ? এক্ষণে আমার শীঘ্র মৃত্যু হইলে মনে যে দাবানাল জ্বলিতেছে তাহা হইতে নিষ্কৃতি পাই, কিন্তু বোধ করি মৃত্যুর মৃত্যু হইয়াছে কারণ তাহার দূতস্বরূপ রোগের কিছু চিহ্ণ দেখি না –যাহা হউক তোমরা সকলে বাটী যাও –আমি এই ধামে গুরুর নিকট থাকিয়া কঠোর অভ্যাসে প্রাণ ত্যাগ করিব।
অনন্তর বরদাবাবু, রামলাল ও তাহার মাতা মতিলালের গুরুকে আনাইয়া বিস্তর বুঝাইয়া মতিলালকে সঙ্গে করিয়া আনিলেন। মুঙ্গেরের নিকট রজনীযোগে নৌকা চাপা হইলে চৌয়াড়ের মতো আকৃতি একজন লোক ঘনিয়া ঘনিয়া কাছে আসিয়া “আগুন আছে –আগুন আছে” বলিয়া উঁচু হইয়া দেখিতে লাগিল। তাহার রকম-সকম দেখিয়া বরদাবাবু বলিলেন –সকলে সতর্ক হও, তদনন্তর নৌকার ছাতের উপর উঠিয়া দেখিলেন একটা ঝোপের ভিতরে প্রায় বিশ –ত্রিশজন অস্ত্রধারী লোক ঘাপ্টি মারিয়া বসিয়া আছে –ঐ ব্যক্তি সংকেত করিলে চড়াও হইবে। অমনি রামলাল ও বরদাবাবু বাহির হইয়া বন্দুক লইয়া আওয়াজ করিতে লাগিলেন, বন্দুকের আওয়াজে ডাকাইতেরা বনের ভিতর প্রবেশ করিল। বরদাবাবু ও রামলালের মানস যে তলওয়ার হাতে লইয়া তাহাদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া দুই –একজনকে ধরিয়া আনিয়া নিকটস্থ দারোগার জিম্মা করিয়া দেন কিন্তু পরিবারেরা সকলে নিষেধ করিল। মতিলাল এই ব্যাপার দেখিয়া বলিল –আমার বাল্যাবস্থা অবধি সর্ব প্রকারেই কুশিক্ষা হইয়াছে –আমার বাবুয়ানাতেই সর্বনাশ হইয়াছে। রামলাল কসরৎ করিত তাহাতে আমি পরিহাস করিতাম –কিন্তু আজ জানিলাম যে বালককালাবধি মর্দনা কসরৎ না করিলে সাহস হয় না। সম্প্রতি আমার অতিশয় ভয় হইয়াছিল, যদ্যপি রামলাল ও বারদাবাবু না থাকিতেন তবে আমরা সকলেই কাটা যাইতাম।
অল্পকালের মধ্যে সকলে বৈদ্যবাটীতে পৌঁহুছিয়া বরদাবাবুর বাটীতে উঠিলেন। বরদাবাবু ও রামলালের প্রত্যাগমনের সংবাদ শুনিয়া গ্রামস্থ যাবতীয় লোক চতুর্দিকে থেকে দেখা করিতে আসিল –সকলেরই মনে আনন্দের উদয় হইল –সকলেরই বদন আহ্লাদে দেদীপ্যমান হইল –সকলেই মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী হইয়া প্রার্থনা ও আশীর্বাদের পুষ্প বৃষ্টি করিতে লাগিল।
হেরম্বচন্দ্র চৌধুরীবাবু পর দিবস আসিয়া বলিলেন –রামবাবু ! আমি বুঝিতে পারি নাই –বাঞ্ছারামের পরামর্শে তোমাদিগের ভদ্রাসন দখল করিয়া লইয়াছি –আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি যে তোমাদিগের পরিবারকে বাহির করিয়া বাটী দখল লইয়াছি। তোমার অসাধারণ গুণ –এক্ষণে আমি বাটী অমনি ফিরিয়া দিতেছি, আপনারা স্বচ্ছন্দে সেখানে গিয়া বাস করুন। রামলাল বলিলেন –আপনার নিকট আমি বড়ো উপকৃত হইলাম, যদ্যপি আপনার বাটী ফিরিয়া দিবার মানষ হয় তবে আপনার যাহা যথার্থ পাওনা আছে গ্রহণ করিলে আমরা বাধিত হইব। হেরম্ববাবু এই প্রস্তাবে সম্মত হইলে রামলাল তৎক্ষণাৎ নিজে হইতে টাকা দিয়া দুই ভায়ের নামে কওয়ালা লিখিয়া লইয়া পরিবারের সহিত পৈতৃক ভদ্রাসনে গেলেন এবং উর্দ্ধদৃষ্টি করত কৃতজ্ঞচিত্তে মনে মনে বলিলেন –”জগদীশ্বর ! তোমা হইতে কি-না হইতে পারে !”
অনন্তর রামলালের বিবাহ হইল ও দুই ভাইয়ে অতিশয় সম্প্রীতিতে মায়েরও অন্যান্য পরিবারের সুখবর্ধক হইয়া পরম সুখে কাল যাপন করিতে লাগিলেন। বরদাবাবু বরদাপ্রসাদাৎ বদরগঞ্জে বিষয়কর্মার্থ গমন করিলেন –বেচারামবাবু বিষয়-বিভব বিক্রয় করিয়া প্রকৃত বেচারাম হইয়া বারাণসীতে বাস করিলেন –বেণীবাবু কিছু দিন বিনা শিক্ষায় শৌখিন হইয়া আইন ব্যবসাতে মনোযোগ করিলেন –বাঞ্ছারাম বহুত ফন্দি ও ফেরেক্কা করিয়া বজ্রাঘাতে মরিয়া গেলেন –বক্রেশ্বর খোশামোদ ও বরামদ করিয়া ফ্যা ফ্যা করতঃ বেড়াইতে লাগিলেন –ঠকচাচা ও বাহুল্য পুলিপালমে গিয়া জাল করাতে সেখানে তাহাদিগের বাজিঞ্জির মাটি কাটিতে হয় এবং কিছুদিন পরে যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইয়া তাহাদের মৃত্যু হইল –ঠকচাচী কোনো উপায় না দেখিয়া চুড়িওয়ালী হইয়া ভেটিয়ারি গান “চুড়িয়ালের চুড়িয়া” গাইতে গাইতে গলি গলি ফিরিতে লাগিল –হলধর, গদাধর ও আর আর ব্রজবালক মতিলালের স্বভাব ভিন্ন দেখিয়া অন্যান্য কাপ্তেনবাবুর অন্বেষণ করিতে উদ্যত হইল –জান সাহেব ইনসালবেন্ট লইয়া দালালি কর্ম আরম্ভ করিলেন –প্রেমনারায়ণ মজুমদার ভেক লইয়া “মহাদেবের মনের কথা রে অরে ভক্ত বই আর কে জানে” এই বলিয়া চীৎকার করিয়া নবদ্বীপে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন –প্রমদার স্বামী অনেক স্থানে পাণিগ্রহণ করিয়া ছিলেন, এক্ষণে শূন্যপাণি হওয়াতে বৈদ্যবাটীতে আসিয়া শ্যালকদিগের স্কন্ধে ভোগ করত কেবল কলাইকন্দ, ঘেয়ারূ, তাজফেনি, বেদানা, সেও ও জলগোজা খাইয়া টপ্পা মারিতে আরম্ভ করিলেন –তাহার পরে যে সকল ঘটনা হইয়াছিল, তাহা বর্ণনা করিতে বাকী রহিল –”আমার কথাটি ফুরাল, নটে গাছটি মুড়াল”।
অপূর্ব! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
উত্তরমুছুন