সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৪

প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪–১৮৮৩) : বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসিক

বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস 'আলালের ঘরের দুলাল'-এর লেখক প্যারীচাঁদ মিত্র। তার ছদ্মনাম 'টেকচাঁদ ঠাকুর'। জন্ম কলকাতায়, ১৮১৪ সালের ২২ জুলাই। পিতার নাম রামনারায়ণ মিত্র। প্রথম জীবনে রামনারায়ণ হুগলি জেলা থেকে কলকাতা এসেছিলেন। তত্কালে ইউরোপিয় বণিকদের সঙ্গে সখ্যতা তার ভাগ্য ফিরিয়েছিল।


প্যারীচাঁদ মিত্রের শিক্ষাজীবন শুরু হয় পারিবারিক পরিমণ্ডলে। তিনি একজন পণ্ডিত ও মুনশির কাছে যথাক্রমে বাংলা ও ফারসি শিখেছিলেন। পাশাপাশি তিনি শিখেছিলেন ইংরেজি ভাষাও। তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন ১৮২৭ সালে। সেখানে হেনরি ডিরোজিও নামের একজন অসাধারণ শিক্ষকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এ-কলেজেই তিনি তার শিক্ষাজীবন শেষ করেন।

১৮৩৬ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের কর্মজীবন শুরু হয় কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে। পরে তিনি লাইব্রেরিয়ান হিসেবে পদোন্নতি পান এবং আরো পরে প্রতিষ্ঠানটির সেক্রেটারি বা সচিব হন। পাবলিক লাইব্রেরির কাজের পাশাপাশি প্যারীচাঁদ বিভিন্ন ব্যবসার সাথেও জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল কোম্পানি লিমিটেড, পোর্ট ক্যানিং গ্র্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি এবং হাওড়া ডকিং কোম্পানির মতো বিনিয়োগ কোম্পানির অংশীদার ও পরিচালক ছিলেন। ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি ছিলেন সফল।
প্যারীচাঁদ ছিলেন সমাজহিতৈষী ও সংস্কৃতিসেবী। বাঙালি সমাজের কল্যাণে তিনি বহু সংগঠন গড়ে তোলেন। জ্ঞানোপার্জিকা সভা, বেঙ্গল ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ডেভিড হেয়ার মেমোরিয়াল সোসাইটি, রেস ক্লাব, এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড হর্টিকালচারাল সোসাইটি, বেথুন সোসাইটির সাথে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো, জেল ও কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রের পরিদর্শক, কলকাতা হাইকোর্টের গ্র্যান্ড জুরি, বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য, কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এ ছাড়া, তিনি 'পশু-ক্লেশনিবারণীসভারও' সদস্যছিলেন।

প্যারীচাঁদ মিত্র বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হলেও এবং বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকলেও, পরবর্তীকালে সাংবাদিকতা ও বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্যই বিখ্যাত হয়ে আছেন। তিনি মহিলাদের জন্য একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এক্ষেত্রে তাঁর সহযোগী ছিলেন রাধানাথ শিকদার।

প্যারীচাঁদ মিত্র দি ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া এবং বেঙ্গল স্পেক্টেটর পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করতেন। তিনি পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেও সফল হয়েছিলেন। স্ত্রী-শিক্ষা প্রচারেও দিয়েছেন যথেষ্ট সক্রিয়তার পরিচয়। সমাজ-সচেতন প্যারীচাঁদ বিধবা-বিবাহকে সমর্থন করতেনএবংবাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের তীব্র বিরোধী ছিলেন।

১৮৫৭ সালে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস 'আলালের ঘরের দুলাল'। এটি বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃত। এ-উপন্যাসে তিনি যে-ভাষা ব্যবহার করেছেন, পরে তা 'আলালী ভাষা' হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বলা হয়ে থাকে যে, এই উপন্যাসে তিনি প্রথমবারের মতো বাংলা সাহিত্যের গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করেন। উপন্যাসটিতে তিনি ব্যবহার করেন সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা। উপন্যাসটি 'দি স্পয়েল্ড চাইল্ড' নামে ইংরেজিতেও অনূদিত হয়। এ ছাড়াও, তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে আছে:
মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কী উপায় (১৮৫৯),
রামারঞ্জিকা (১৮৬০),
কৃষিপাঠ (১৮৬১),
অভেদী (১৮৭১),
ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত (১৮৭৮),
আধ্যাত্মিকা (১৮৮০),
বামাতোষিণী (১৮৮১), ইত্যাদি।

তিনি বেশ কিছু ইংরেজি গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। প্যারীচাঁদ মিত্র তত্কালীন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথার বিরোধী ছিলেন এবং এর বিরুদ্ধে গ্রন্থও রচনা করেছেন।

১৮৮৩ সালের ২৩শে নভেম্বর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

(সূত্র: বাংলাপিডিয়া ও ইন্টারনেট)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন