সোমবার, ১০ নভেম্বর, ২০১৪

দুর্গেশনন্দিনী - প্রথম খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ : দেবমন্দির

৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনোদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারোহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। কেন না, সম্মুখে প্রকাণ্ড প্রান্তর; কি জানি, যদি কালধর্মে প্রদোষকালে প্রবল ঝটিকা বৃষ্টি আরম্ভ হয়, তবে সেই প্রান্তরে, নিরাশ্রয়ে যৎপরোনাস্তি পীড়িত হইতে হইবে। প্রান্তর পার হইতে না হইতেই সূর্যাস্ত হইল; ক্রমে নৈশ গগন নীলনীরদমালায় আবৃত হইতে লাগিল। নিশারম্ভেই এমন ঘোরতর অন্ধকার দিগন্তসংস্থিত হইল যে, অশ্বচালনা অতি কঠিন বোধ হইতে লাগিল। পান্থ কেবল বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে কোন মতে চলিতে লাগিলেন।

অল্পকাল মধ্যে মহারবে নৈদাঘ ঝটিকা প্রধাবিত হইল, এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বৃষ্টিধারা পড়িতে লাগিল। ঘোটকারূঢ় ব্যক্তি গন্তব্য পথের আর কিছুমাত্র স্থিরতা পাইলেন না। অশ্ব-বল্গা শ্লথ করাতে অশ্ব যথেচ্ছ গমন করিতে লাগিল। এইরূপ কিয়দ্দূর গমন করিলে ঘোটকচরণে কোন কঠিন দ্রব্যসংঘাতে ঘোটকের পদস্খলন হইল। ঐ সময়ে একবার বিদ্যুৎ প্রকাশ হওয়াতে পথিক সম্মুখে প্রকাণ্ড ধবলাকার কোন পদার্থ চকিতমাত্র দেখিতে পাইলেন। ঐ ধবলাকার স্তূপ অট্টালিকা হইবে, এই বিবেচনায় অশ্বারোহী লাফ দিয়া ভূতলে অবতরণ করিলেন। ঐ ধবলাকার স্তূপ অট্টালিকা হইবে, এই বিবেচনায় অশ্বারোহী লাফ দিয়া ভূতলে অবতরণ করিলেন। অবতরণমাত্র জানিতে পারিলেন যে, প্রস্তরনির্মিত সোপানাবলীর সংস্রবে ঘোটকের চরণ স্খলিত হইয়াছিল; অতএব নিকটে আশ্রয়-স্থান আছে জানিয়া, অশ্বকে ছাড়িয়া দিলেন। নিজে অন্ধকারে সাবধানে সোপানমার্গে পদক্ষেপ করিতে লাগিলেন। অচিরাৎ তাড়িতালোকে জানিতে পারিলেন যে, সম্মুখস্থ অট্টালিকা এক দেবমন্দির। কৌশলে মন্দিরের ক্ষুদ্র দ্বারে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন যে দ্বার রুদ্ধ; হস্তমার্জনে জানিলেন, দ্বার বহির্দিক হইতে রুদ্ধ হয় নাই। এই জনহীন প্রান্তরস্থিত মন্দিরে এমন সময়ে কে ভিতর হইতে অর্গল আবদ্ধ করিল, এই চিন্তায় পথিক কিঞ্চিৎ বিস্মিত ও কৌতূহলাবিষ্ট হইলেন। মস্তকোপরি প্রবল বেগে ধারাপাত হইতেছিল, সুতরাং যে কোন ব্যক্তি দেবালয়-মধ্য-বাসী হউক, পথিক দ্বারে ভূয়োভূয়: বলদর্পিত করাঘাত করিতে লাগিলেন, কেহই দ্বারোন্মোচন করিতে আসিল না। ইচ্ছা, পদাঘাতে কবাট মুক্ত করেন, কিন্তু দেবালয়ের পাছে অমর্যাদা হয়, এই আশঙ্কায় পথিক তত দূর করিলেন না; তথাপি তিনি কবাটে যে দারুণ করপ্রহার করিতেছিলেন, কাষ্ঠের কবাট তাহা অধিক ক্ষণ সহিতে পারিল না, অল্পকালেই অর্গলচ্যুত হইল। দ্বার খুলিয়া যাইবামাত্র যুবা যেমন মন্দিরাভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন, অমনই মন্দিরমধ্যে অস্ফুট চীৎকারধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল ও তন্মুহূর্তে মুক্ত দ্বারপথে ঝটিকাবেগ প্রবাহিত হওয়াতে তথা যে ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলিতেছিল, তাহা নিবিয়া গেল। মন্দিরমধ্যে মনুষ্যই বা কে আছে, দেবই বা কি মূর্তি, প্রবেষ্টা তাহার কিছুই দেখিতে পাইলেন না। আপনার অবস্থা এইরূপ দেখিয়া নির্ভীক যুবা পুরুষ কেবল ঈষৎ হাস্য করিয়া, প্রথমত: ভক্তিভাবে মন্দিরমধ্যস্থ অদৃশ্য দেবমূর্তিকে উদ্দেশে প্রণাম করিলেন। পরে গাত্রোত্থান করিয়া অন্ধকারমধ্যে ডাকিয়া কহিলেন, “মন্দিরমধ্যে কে আছ?” কেহই প্রশ্নের উত্তর করিল না; কিন্তু অলঙ্কারঝঙ্কারশব্দ কর্ণে প্রবেশ করিল। পথিক তখন বৃথা বাক্যব্যয় নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া বৃষ্টিধারা ও ঝটিকার প্রবেশ রোধার্থ দ্বার যোজিত করিলেন, এবং ভগ্নার্গলের পরিবর্তে আত্মশরীর দ্বারে নিবিষ্ট করিয়া পুনর্বার কহিলেন, “যে কেহ মন্দিরমধ্যে থাক, শ্রবণ কর; এই আমি সশস্ত্র দ্বারদেশে বসিলাম, আমার বিশ্রামের বিঘ্ন করিও না। বিঘ্ন করিলে, যদি পুরুষ হও, তবে ফলভোগ করিবে; আর যদি স্ত্রীলোক হও, তবে নিশ্চিন্ত হইয়া নিদ্রা যাও, রাজপুত-হস্তে অসিচর্ম থাকিতে তোমাদিগের পদে কুশাঙ্কুরও বিঁধিবে না।”


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : আলাপ

প্রথমে যুবক নিজ কৌতূহলপরবশতা প্রকাশ করিলেন। বয়োজ্যেষ্ঠাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “অনুভবে বুঝিতেছি, আপনারা ভাগ্যবানের পুরস্ত্রী, পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে সঙ্কোচ হইতেছে; কিন্তু আমার পরিচয় দেওয়ার পক্ষে যে প্রতিবন্ধক, আপনাদের সে প্রতিবন্ধক না থাকিতে পারে, এজন্য জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিতেছি |”

জ্যেষ্ঠা কহিলেন, “স্ত্রীলোকের পরিচয়ই বা কি? যাহারা কুলোপাধি ধারণ করিতে পারে না, তাহা কি বলিয়া পরিচয় দিবে? গোপনে বাস করা যাহাদিগের ধর্ম, তাহারা কি বলিয়া আত্মপ্রকাশ করিবে? যে দিন বিধাতা স্ত্রীলোককে স্বামীর নাম মুখে আনিতে নিষেধ করিয়াছেন, সেই দিন আত্মপরিচয়ের পথও বন্ধ করিয়াছেন।”

যুবক এ কথার উত্তর করিলেন না। তাঁহার মন অন্য দিকে ছিল। নবীনা রমণী ক্রমে ক্রমে অবগুণ্ঠনের কিয়দংশ অপসৃত করিয়া সহচরীর পশ্চাদ্ভাগ হইতে অনিমেষচক্ষুতে যুবকের প্রতি দৃষ্টি করিতেছিলেন। কথোপকথন মধ্যে অকস্মাৎ পথিকেরও সেই দিকে দৃষ্টিপাত হইল; আর দৃষ্টি ফিরিল না; তাঁহার বোধ হইল, যেন তাদৃশ অলৌকিক রূপরাশি আর কখন দেখিতে পাইবেন না। যুবতীর চক্ষুর্দ্বয়ের সহিত পথিকের চক্ষু সংমিলিত হইল। যুবতী অমনি লোচনযুগল বিনত করিলেন। সহচরী বাক্যের উত্তর না পাইয়া পথিকের মুখপানে চাহিলেন। কোন্ দিকে তাঁহার দৃষ্টি, তাহাও নিরীক্ষণ করিলেন, এবং সমভিব্যাহারিণী যে যুবক প্রতি সতৃষ্ণনয়নে চাহিতেছিলেন, তাহা জানিতে পারিয়া, নবীনার কাণে কাণে কহিলেন, “কি লো! শিবসাক্ষাৎ-স্বয়ম্বরা হবি না কি?”

নবীনা, সহচরীকে অঙ্গুলিনিপীড়িত করিয়া তদ্রূপ মৃদুস্বরে কহিল, “তুমি নিপাত যাও |” চতুরা সহচারিণী এই দেখিয়া মনে মনে ভাবিলেন যে, যে লক্ষণ দেখিতেছি, পাছে এই অপরিচিত যুবা পুরুষের তেজ:পুঞ্জ কান্তি দেখিয়া আমার হস্তসমর্পিতা এই বালিকা মন্মথশরজালে বিদ্ধ হয়; তবে আর কিছু হউক না হউক, ইহার মনের সুখ চিরকালের জন্য নষ্ট হইবে, অতএব সে পথ এখনই রুদ্ধ করা আবশ্যক। কিরূপেই বা এ অভিপ্রায় সিদ্ধ হয়? যদি ইঙ্গিতে বা ছলনাক্রমে যুবককে স্থানান্তরে প্রেরণ করিতে পারি, তবে তাহা কর্তব্য বটে, এই ভাবিয়া নারী-স্বভাবসিদ্ধ চতুরতার সহিত কহিলেন, “মহাশয়! স্ত্রীলোকের সুনাম এমনই অপদার্থ বস্তু যে, বাতাসের ভর সহে না। আজিকার এ প্রবল ঝড়ে রক্ষা পাওয়া দুষ্কর, অতএব এক্ষ‎ণে ঝড় থামিয়াছে, দেখি যদি আমরা পদব্রজে বাটী গমন করিতে পারি |”

যুবা পুরুষ উত্তর করিলেন, “যদি একান্ত এ নিশীথে আপনারা পদব্রজে যাইবেন, তবে আমি আপনাদিগকে রাখিয়া আসিতেছি। এক্ষণে আকাশ পরিষ্কার হইয়াছে, আমি এতক্ষণ নিজস্থানে যাত্রা করিতাম, কিন্তু আপনার সখীর সদৃশ রূপসীকে বিনা রক্ষকে রাখিয়া যাইব না বলিয়াই এখন এ স্থানে আছি |”

কামিনী উত্তর করিল, “আপনি আমাদিগের প্রতি যেরূপ দয়া প্রকাশ করিতেছেন, তাহাতে পাছে আমাদিগকে অকৃতজ্ঞ মনে করেন, এজন্যই সকল কথা ব্যক্ত করিয়া বলিতে পারিতেছি না। মহাশয়! স্ত্রীলোকের মন্দ কপালের কথা আপনার সাক্ষাতে আর কি বলিব। আমরা সহজে অবিশ্বাসিনী; আপনি আমাদিগকে রাখিয়া আসিলে আমাদিগের সৌভাগ্য, কিন্তু যখন আমার প্রভু–এই কন্যার পিতা-ইহাকে জিজ্ঞাসা করিবেন, তুমি এ রাত্রে কাহার সঙ্গে আসিয়াছ, তখন ইনি কি উত্তর করিবেন?”

যুবক ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “এই উত্তর করিবেন যে, আমি মহারাজ মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহের সঙ্গে আসিয়াছি |”

যদি তন্মুহূর্তে মন্দিরমধ্যে বজ্রপতন হইত, তাহা হইলেও মন্দিরবাসিনী স্ত্রীলোকেরা অধিকতর চমকিত হইয়া উঠিতেন না। উভয়েই অমনি গাত্রোত্থান করিয়া দণ্ডায়মান হইলেন। কনিষ্ঠা শিবলিঙ্গের পশ্চাতে সরিয়া গেলেন। বাগ্‌বিদগ্ধা বয়োধিকা গলোদেশে অঞ্চল দিয়া দণ্ডবৎ হইলেন; অঞ্জলিবদ্ধকারে কহিলেন, “যুবরাজ! না জানিয়া সহস্র অপরাধ করিয়াছি, অবোধ স্ত্রীলোকদিগকে নিজগুণে মার্জনা করিবেন |”



তৃতীয় পরিচ্ছেদ : মোগল পাঠান

নিশীথকালে জগৎসিহ শৈলেশ্বরের মন্দির হইতে যাত্রা করিলেন। আপাতত: তাঁহার অনুগমনে অথবা মন্দিরাধিষ্ঠাত্রী মনোমোহিনীর সংবাদ কথনে পাঠক মহাশয়দিগের কৌতূহল নিবারণ করিতে পারিলাম না। জগৎসিংহ রাজপুত, কি প্রয়োজনে বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন, কেনই বা প্রান্তরমধ্যে একাকী গমন করিতেছিলেন, তৎপরিচয় উপলক্ষে এই সময়ে বঙ্গদেশ সম্বন্ধীয় রাজকীয় ঘটনা কতক কতক সংক্ষেপে বিবৃত করিতে হইল। অতএব এই পরিচ্ছেদ ইতিবৃত্তসম্পর্কীয়। পাঠকবর্গ একান্ত অধীর হইলে ইহা ত্যাগ করিতে পারেন, কিন্তু গ্রন্থকারের পরামর্শ এই যে, অধৈর্য ভাল নহে।

প্রথমে বঙ্গদেশে বখ্‍‍তিয়ার খিলিজি মহম্মদীয় জয়ধ্বজা সংস্থাপিত করিলে পর, মুসলমানেরা অবাধে শতাব্দী তদ্রাজ্য শাসন করিতে থাকেন। ৯৭২ হেঃ অব্দে সুবিখ্যাত সুলতান বাবর, রণক্ষেত্রে দিল্লীর বাদশাহ ইব্রাহিম লদীকে পরাভূত করিয়া, তৎসিংহাসনে আরোহণ করেন; কিন্তু তৎকালেই বঙ্গদেশ তৈমুরলঙ্গ বংশীয়দিগের দণ্ডাধীন হয় নাই।

যতদিন না মোগল সম্রাটদিগের কুলতিলক আকবরের অভ্যুদয় হয়, ততদিন এ দেশে স্বাধীন পাঠান রাজগণ রাজত্ব করিতেছিলেন। কুক্ষণে নির্বোধ দাউদ খাঁ সুপ্ত সিংহের অঙ্গে হস্তক্ষেপণ করিলেন; আত্মকর্মফলে আকবরের সেনাপতি মনাইম খাঁ কর্তৃক পরাজিত হইয়া রাজ্যভ্রষ্ট হইলেন। দাউদ ৯৮২ হেঃ অব্দে সগণে উড়িষ্যায় পলায়ন করিলেন; বঙ্গরাজ্য মোগল ভূপালের কর-কবলিত হইল। পাঠানেরা উৎকলে সংস্থাপিত হইলে, তথা হইতে তাহাদিগের উচ্ছেদ করা মোগলদিগের কষ্টসাধ্য হইল। ৯৮৬ অব্দে দিল্লীশ্বরের প্রতিনিধি খাঁ জাঁহা খাঁ পাঠানদিগের দ্বিতীয় বার পরাজিত করিয়া উৎকল দেশ নিজ প্রভুর দণ্ডাধীন করিলেন। ইহার পর আর এক দারুণ উপদ্রব উপস্থিত হইয়াছিল। আকবর শাহ কর্তৃক বঙ্গদেশের রাজকর আদায়ের যে নূতন প্রণালী সংস্থাপিত হইল, তাহাতে জায়গীরদার প্রভৃতি ভূমধ্যকারিগণের গুরুতর অসন্তুষ্টি জন্মিল। তাঁহারা নিজ নিজ পূর্বাধিপত্য রক্ষার্থ খড়্গহস্ত হইয়া উঠিলেন। অতি দুর্দম্য রাজবিদ্রোহ উপস্থিত হওয়াতে, সময় পাইয়া উড়িষ্যার পাঠানেরা পুনর্বার মস্তক উন্নত করিল ও কতলু খাঁ নামক এক পাঠানকে আধিপত্যে বরণ করিয়া পুনরপি উড়িষ্যা স্বকরগ্রস্ত করিল। মেদিনীপুরও তাহাদের অধিকারভুক্ত হইল।

কর্মঠ রাজপ্রতিনিধি খাঁ আজিম, তৎপরে শাহবাজ খাঁ কেহই শত্রুবিজিত দেশ পুনরুদ্ধার করিতে পারিলেন না। পরিশেষে এই আয়াসসাধ্য কার্যোদ্ধার জন্য একজন হিন্দু যোদ্ধা প্রেরিত হইলেন।

মহামতি আকবর তাঁহার পূর্বগামী সম্রাটদিগের হইতে সর্বাংশে বিজ্ঞ ছিলেন। তাঁহার হৃদয়ে বিশেষ প্রতীতি জন্মিয়াছিল যে, এতদ্দেশীয় রাজকার্য সম্পাদনে এতদ্দেশীয় লোকই বিশেষ পটু -বিদেশীয়েরা তাদৃশ নহে; আর যুদ্ধে রাজ্যশাসনে রাজপুতগণ দক্ষাগ্রগণ্য। অতএব তিনি সর্বদা এতদ্দেশীয়, বিশেষত: রাজপুতগণকে গুরুতর রাজকার্যে নিযুক্ত করিতেন।

আখ্যায়িকাবর্ণিত কালে যে সকল রাজপুত উচ্চপদাভিষিক্ত ছিলেন, তন্মধ্যে মানসিংহ একজন প্রধান। তিনি স্বয়ং আকবরের পুত্র সেলিমের শ্যালক। আজিম খাঁ ও শাহবাজ খাঁ উৎকলজয়ে অক্ষম হইলে, আকবর এই মহাত্মাকে বঙ্গ ও বেহারের শাসনকর্তা করিয়া পাঠাইলেন।



চতুর্থ পরিচ্ছেদ : নবীন সেনাপতি

শৈলেশ্বর-মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া জগৎসিংহ পিতৃশিবিরে উপস্থিত হইলে পর, মহারাজ মানসিংহ পুত্রমুখাৎ অবগত হইলেন যে, প্রায় পঞ্চাশৎ সহস্র পাঠান সেনা ধরপুর গ্রামের নিকট শিবির সংস্থাপন করিয়া নিকটস্থ গ্রামসকল লুঠ করিতেছে, এবং স্থানে স্থানে দুর্গ নির্মাণ বা অধিকার করিয়া তদাশ্রয়ে এক প্রকার নির্বিঘ্নে আছে। মানসিংহ দেখিলেন যে, পাঠানদিগের দুবৃত্তির আশু দমন নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে, কিন্তু এ কার্য অতি দু:সাধ্য। কর্তব্যাকর্তব্য নিরুপণ জন্য সমভিব্যাহারী সেনাপতিকে একত্র করিয়া এই সকল বৃত্তান্ত বিবৃত করিলেন এবং কহিলেন, “দিনে দিনে গ্রাম গ্রাম, পরগণা পরগণা দিল্লীশ্বরের হস্তস্খলিত হইতেছে, এক্ষণে পাঠানদিগকে শাসিত না করিলেই নয়, কিন্তু কি প্রকারেই বা তাহাদিগের শাসন হয়? তাহারা আমাদিগের অপেক্ষা সংখ্যায় বলবান্; তাহাতে আবার দুর্গশ্রেণীর আশ্রয়ে থাকিয়া যুদ্ধ করিবে; যুদ্ধে পরাজিত করিলেও তাহাদিগকে বিনষ্ট বা স্থানচ্যুত করিতে পারিব না; সহজেই দুর্গমধ্যে নিরাপদ হইতে পারিবে। কিন্তু সকলে বিবেচনা করিয়া দেখ, যদি রণে আমাদিগকে বিজিত হইতে হয়, তবে শত্রুর অধিকারমধ্যে নিরাশ্রয়ে একেবারে বিনষ্ট হইতে হইবে। এরূপ অন্যায় সাহসে ভর করিয়া দিল্লীশ্বরের এত অধিক সেনানাশের সম্ভাবনা জন্মান, এবং উড়িষ্যাজয়ের আশা একেবারে লোপ করা, আমার বিবেচনায় অনুচিত হইতেছে; সৈদ খাঁর প্রতীক্ষা করাই উচিত হইতেছে; অথচ বৈরিশাসনের আশু কোন উপায় করাও আবশ্যক হইতেছে। তোমরা কি পরামর্শ দাও?”

বৃদ্ধ সেনাপতিগণ সকলে একমত হইয়া পরামর্শ স্থির করিলেন যে, আপাতত: সৈদ খাঁর প্রতীক্ষায় থাকাই কর্তব্য। রাজা মানসিংহ কহিলেন, “আমি অভিপ্রায় করিতেছি যে, সমুদায় সৈন্যনাশের সম্ভাবনা না রাখিয়া কেবল অল্পসংখ্যক সেনা কোন দক্ষ সেনাপতির সহিত শত্রুসমক্ষে প্রেরণ করি |”

একজন প্রাচীন মোগল সৈনিক কহিলেন, “মহারাজ! যথা তাবৎ সেনা পাঠাইতেও আশঙ্কা, তথা অল্পসংখ্যক সেনার দ্বারা কোন্ কার্য সাধন হইবে?”

মানসিংহ কহিলেন, “অল্প সেনা সম্মুখ রণে অগ্রসর হইতে পাঠাইতে চাহিতেছি না। ক্ষুদ্র বল অস্পষ্ট থাকিয়া গ্রামপীড়নাসক্ত পাঠানদিগের দলসকল কতক দমনে রাখিতে পারিবে |”

তখন মোগল কহিল, “মহারাজ! নিশ্চিত কালগ্রাসে কোন্ সেনাপতি যাইবে?”

মানসিংহ ভ্রূভঙ্গী করিয়া বলিলেন, “কি! এত রাজপুত ও মোগল মধ্যে মৃত্যুকে ভয় করে না, এমন কি কেহই নাই?”

এই কথা শ্রুতিমাত্র পাঁচ-সাতজন মোগল ও রাজপুত গাত্রোত্থান করিয়া কহিল, “মহারাজ! দাসেরা যাইতে প্রস্তুত আছে |” জগৎসিংহও তথায় উপস্থিত ছিলেন ; তিনি সর্বাপেক্ষা বয়:কনিষ্ঠ; সকলের পশ্চাতে থাকিয়া কহিলেন, “অনুমতি হইলে এ দাসও দিল্লীশ্বরের কার্যসাধনে যত্ন করে!”

রাজা মানসিংহ সস্মিতবদনে কহিলেন, “না হবে কেন? আজ জানিলাম যে, মোগল রাজপুত নাম লোপের বিলম্ব আছে। তোমরা সকলেই এ দুষ্কর কার্যে প্রস্তুত, এখন কাহাকে রাখিয়া কাহাকে পাঠাই?”

একজন পারিষদ সহাস্যে কহিল, “মহারাজ! অনেকে যে, এ কার্যে উদ্যত হইয়াছেন, সে ভালই হইয়াছে। এই উপলক্ষে সেনাব্যয়ের অল্পতা করিতে পারিবেন। যিনি সর্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র সেনা লইয়া যাইতে স্বীকৃত হয়েন, তাঁহাকেই রাজকার্য সাধনের ভার দিউন |”

রাজা কহিলেন, “এ উত্তম পরামর্শ।” পরে প্রথম উদ্যমকারীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কত সংখ্যক সেনা লইয়া যাইতে ইচ্ছা কর?” সেনাপতি কহিলেন, “পঞ্চদশ সহস্র পদাতিবলে রাজকার্য উদ্ধার করিব |”



পঞ্চম পরিচ্ছেদ : গড় মান্দারণ

যে পথে বিষ্ণুপুর প্রদেশ হইতে জগৎসিংহ জাহানাবাদে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন, সেই পথের চিহ্ন অদ্যাপি বর্তমান আছে। তাহার কিঞ্চিৎ দক্ষিণে মান্দারণ গ্রাম। মান্দারণ এক্ষণে ক্ষুদ্র গ্রাম, কিন্তু তৎকালে ইহা সৌষ্ঠবশালী নগর ছিল। যে রমণীদিগের সহিত জগৎসিংহের মন্দির-মধ্যে সাক্ষাৎ হয়, তাঁহারা মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া এই গ্রামাভিমুখে গমন করেন।

গড় মান্দারণে কয়েকটি প্রাচীন দুর্গ ছিল, এই জন্যই তাহার নাম মান্দারণ হইয়া থাকিবে। নগরমধ্যে আমোদর নদী প্রবাহিত; এক স্থানে নদীর গতি এতাদৃশ বক্রতা প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, তদ্দ্বারা পার্শ্বস্থ এক খণ্ড ত্রিকোণ ভূমির দুই দিক্ বেষ্টিত হইয়াছিল; তৃতীয় দিকে মানবহস্তনিখাত এক গড় ছিল; এই ত্রিকোণ ভূমিখণ্ডের অগ্রদেশে যথায় নদীর বক্রগতি আরম্ভ হইয়াছে, তথায় এক বৃহৎ দুর্গ জল হইতে আকাশপথে উত্থান করিয়া বিরাজমান ছিল। অট্টালিকা আমূলশির:পর্যন্ত কৃষ্ণপ্রস্তরনির্মিত; দুই দিকে প্রবল নদীপ্রবাহ দুর্গমূল প্রহত করিত। অদ্যাপি পর্যটক গড় মান্দারণ গ্রামে এই আয়াসলঙ্ঘ্য দুর্গের বিশাল স্তূপ দেখিতে পাইবেন; দুর্গের নিম্নভাগমাত্র এক্ষণে বর্তমান আছে, অট্টালিকা কালের করাল স্পর্শে ধূলিরাশি হইয়া গিয়াছে; তদুপরি তিন্তিড়ী, মাধবী প্রভৃতি বৃক্ষ ও লতাসকল কাননাকারে বহুতর ভুজঙ্গ ভল্লুকাদি হিংস্র পশুগণকে আশ্রয় দিতেছে। নদীপারে অপর কয়েকটা দুর্গ ছিল।

বাঙ্গালার পাঠান সম্রাটদিগের শিরোভূষণ হোসেন শাহার বিখ্যাত সেনাপতি ইস্‌মাইল গাজি এই দুর্গ নির্মাণ করেন। কিন্তু কালক্রমে জয়ধরসিংহ নামে একজন হিন্দু সৈনিক ইহা জায়গীর পান। এক্ষণে বীরেন্দ্রসিংহনামা জয়ধরসিংহের একজন উত্তরপুরুষ এখানে বসতি করিতেন।

যৌবনকালে বীরেন্দ্রসিংহের পিতার সহিত সম্প্রীতি ছিল না। বীরেন্দ্রসিংহ স্বভাবত: দাম্ভিক এবং অধীর ছিলেন, পিতার আদেশ কদাচিৎ প্রতিপালন করিতেন, এজন্য পিতাপুত্রে সর্বদা বিবাদ বচসা হইত। পুত্রের বিবাহার্থ বৃদ্ধ ভূস্বামী নিকটস্থ স্বজাতীয় অপর কোন ভূস্বামিকন্যার সহিত সম্বন্ধ স্থির করিলেন। কন্যার পিতা পুত্রহীন, এজন্য এই বিবাহে বীরেন্দ্রের সম্পত্তিবৃদ্ধির সম্ভাবনা; কন্যাও সুন্দরী বটে, সুতরাং এমত সম্বন্ধ বৃদ্ধের বিবেচনায় অতি আদরণীয় বোধ হইল; তিনি বিবাহের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বীরেন্দ্র সে সম্বন্ধে আদর না করিয়া নিজ পল্লীস্থ এক পতিপুত্রহীনা দরিদ্রা রমণীর দুহিতাকে গোপনে বিবাহ করিয়া আবার বিবাহ করিতে অস্বীকৃত হইলেন। বৃদ্ধ রোষপরবশ হইয়া পুত্রকে গৃহ-বহিষ্কৃত করিয়া দিলেন; যুবা পিতৃগৃহ হইতে বহিষ্কৃত হইয়া যোদ্ধৃবৃত্তি অবলম্বন করণাশয়ে দিল্লী যাত্রা করিলেন। তাঁহার সহধর্মিনী তৎকালে অন্তঃসত্ত্বা, এজন্য তাঁহাকে সমভিব্যাহারে লইয়া যাইতে পারিলেন না। তিনি মাতৃকুটীরে রহিলেন।

এদিকে পুত্র দেশান্তর যাইলে পর বৃদ্ধ ভূস্বামীর অন্তঃকরণে পুত্র-বিচ্ছেদে মনঃপীড়ার সঞ্চার হইতে লাগিল; গতানুশোচনার পরবশ হইয়া পুত্রের সংবাদ আনয়নে যত্নবান হইলেন; কিন্তু যত্নে কৃতকার্য হইতে পারিলেন না। পুত্রকে পুনরানয়ন করিতে না পারিয়া তৎপরিবর্তে পুত্রবধূকে দরিদ্রার গৃহ হইতে সাদরে নিজালয়ে আনিলেন। উপযুক্ত কালে বীরেন্দ্রসিংহের পত্নী এক কন্যা প্রসব করিলেন। কিছু দিন পরে কন্যার প্রসূতির পরলোক প্রাপ্তি হইল।

বীরেন্দ্র দিল্লীতে উপনীত হইয়া মোগল সম্রাটের আজ্ঞাকারী রাজপুতসেনা-মধ্যে যোদ্ধৃত্বে বৃত হইলেন; অল্পকালে নিজগুণে উচ্চপদস্থ হইতে পারিলেন। বীরেন্দ্রসিংহ কয়েক বৎসরে ধন ও যশ সঞ্চার করিয়া পিতার লোকান্তরসংবাদ পাইলেন। আর এক্ষণে বিদেশ পর্যটন বা পরাধীনবৃত্তি নিষ্প্রয়োজন বিবেচনা করিয়া বাটী প্রত্যাগমন করিলেন। বীরেন্দ্রের সহিত দিল্লী হইতে অনেকানেক সহচর আসিয়াছিল। তন্মধ্যে জনৈক পরিচারিকা আর এক পরমহংস ছিলেন। এই আখ্যায়িকায় এই দুই জনের পরিচয় আবশ্যক হইবেক। পরিচারিকার নাম বিমলা, পরমহংসের নাম অভিরাম স্বামী।




ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ : অভিরাম স্বামীর মন্ত্রণা

তিলোত্তমা ও বিমলা শৈলেশ্বরের হইতে নির্বিঘ্নে দুর্গে প্রত্যাগমন করিলেন। প্রত্যাগমনের তিন চারি দিবস পরে বীরেন্দ্রসিংহ নিজ দেওয়ানখানায় মছনদে বসিয়া আছেন, এমন সময় অভিরাম স্বামী তথায় উপস্থিত হইলেন। বীরেন্দ্রসিংহ গাত্রোত্থানপূর্বক দণ্ডবৎ হইলেন; অভিরাম স্বামী বীরেন্দ্রের হস্তদত্ত কুশাসনোপরি উপবিষ্ট হইলেন, অনুমতিক্রমে বীরেন্দ্র পুনরুপবেশন করিলেন। অভিরাম স্বামী কহিলেন, “বীরেন্দ্র! অদ্য তোমার সহিত কোন বিশেষ কথা আছে |”

বীরেন্দ্রসিংহ কহিলেন, “আজ্ঞা করুন |”

অভিরাম স্বামী কহিলেন, “এক্ষণে মোগল পাঠানের তুমুল সংগ্রাম উপস্থিত |”

বী। হাঁ; কোন বিশেষ গুরুতর ঘটনা উপস্থিত হওয়াই সম্ভব।

অ। সম্ভব–এক্ষণে কি কর্তব্য স্থির করিয়াছ?

বীরেন্দ্র সদর্পে উত্তর করিলেন, “শত্রু উপস্থিত হইলে বাহুবলে পরাঙ্মুখ করিব |”

পরমহংস অধিকতর মৃদুভাবে কহিলেন, “বীরেন্দ্র! এ তোমার তুল্য বীরের উপযুক্ত প্রত্যুত্তর; কিন্তু কথা এই যে, কেবল বীরত্বে জয়লাভ নাই; যথানীতি সন্ধিবিগ্রহ করিলেই জয়লাভ। তুমি নিজে বীরাগ্রগণ্য; কিন্তু তোমার সেনা সহস্রাধিক নহে; কোন্ যোদ্ধা সহস্রেক সেনা লইয়া শতগুণ সেনা বিমুখ করিতে পারে? মোগল পাঠান উভয় পক্ষেই সেনা-বলে তোমার অপেক্ষা শতগুণে বলবান্; এক পক্ষের সাহায্য ব্যতীত অপর পক্ষের হস্ত হইতে উদ্ধার পাইতে পারিবে না। এ কথায় রুষ্ট হইও না, স্থিরচিত্তে বিবেচনা কর। আরও কথা এই যে, দুই পক্ষেরই সহিত শত্রুভাবে প্রয়োজন কি? শত্রু ত মন্দ; দুই শত্রুর অপেক্ষা এক শত্রু ভাল না? অতএব আমার বিবেচনায় পক্ষাবলম্বন করাই উচিত |”

বীরেন্দ্র বহুক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া কহিলেন, “কোন্ পক্ষ অবলম্বন করিতে অনুমতি করেন?”

অভিরাম স্বামী উত্তর করিলেন, “যতো ধর্মস্ততো জয়:,-যে পক্ষ অবলম্বন করিলে অধর্ম নাই, সেই পক্ষে যাও, রাজবিদ্রোহিতা মহাপাপ, রাজপক্ষ অবলম্বন কর |”

বীরেন্দ্র পুনর্বার ক্ষণেক চিন্তা করিয়া কহিলেন, “রাজা কে? মোগল পাঠান উভয়েই রাজত্ব লইয়া বিবাদ |”

অভিরাম স্বামী উত্তর করিলেন, “যিনি করগ্রাহী, তিনিই রাজা |”

বী। আকবর শাহ?

অ। অবশ্য।

এই কথায় বীরেন্দ্রসিংহ অপ্রসন্ন মুখভঙ্গী করিলেন; ক্রমে চক্ষু আরক্তবর্ণ হইল; অভিরাম স্বামী আকারেঙ্গিত দেখিয়া কহিলেন, “বীরেন্দ্র! ক্রোধ সংবরণ কর, আমি তোমাকে দিল্লীশ্বরের অনুগত হইতে বলিয়াছি; মানসিংহের আনুগত্য করিতে বলি নাই |”

বীরেন্দ্রসিংহ দক্ষিণ হস্ত প্রসারণ করিয়া পরমহংসকে দেখাইলেন; দক্ষিণ বাম হস্তের উপর বাম হস্তের অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কহিলেন, “ও পাদপদ্মের আশীর্বাদে এই হস্ত মানসিংহের রক্তে প্লাবিত করিব |”

অভিরাম স্বামী কহিলেন, “স্থির হও; রাগান্ধ হইয়া আত্মকার্য নষ্ট করিও না; মানসিংহের পূর্বকৃত অপরাধের অবশ্য দণ্ড করিও, কিন্তু আকবর শাহের সহিত যুদ্ধে কার্য কি?”

বীরেন্দ্র সক্রোধে কহিতে লাগিলেন, “আকবর শাহের পক্ষ হইলে কোন্ সেনাপতির অধীন হইয়া যুদ্ধ করিতে হইবে? কোন্ যোদ্ধার সাহায্য করিতে হইবে? কাহার আনুগত্য করিতে হইবে? মানসিংহের। গুরুদেব! এ দেহ বর্তমানে এ কার্য বীরেন্দ্রসিংহ হইতে হইবে না |”




সপ্তম পরিচ্ছেদ : অসাবধানতা

দুর্গের যে ভাগে দুর্গমূল বিধৌত করিয়া আমোদর নদী কলকল রবে প্রবহণ করে, সেই অংশে এক কক্ষবাতায়নে বসিয়া তিলোত্তমা নদীজলাবর্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত, পশ্চিমগগনে অস্তাচলগত দিনমণির ম্লান কিরণে যে সকল মেঘ কাঞ্চনকান্তি ধারণ করিয়াছিল, তৎসহিত নীলাম্বরপ্রতিবিম্ব স্রোতস্বতীজলমধ্যে কম্পিত হইতেছিল; নদীপারস্থিত উচ্চ অট্টালিকা এবং দীর্ঘ তরুবর সকল বিমলাকাশপটে চিত্রবৎ দেখাইতেছিল; দুর্গমধ্যে ময়ূর সারসাদি কলনাদী পক্ষিগণ প্রফুল্লচিত্তে রব করিতেছিল; কোথাও রজনীর উদয়ে নীড়ান্বেষণে ব্যস্ত বিহঙ্গম নীলাম্বর-তলে বিনা শব্দে উড়িতেছিল; আম্রকানন দোলাইয়া আমোদর-স্পর্শ-শীতল নৈদাঘ বায়ু তিলোত্তমার অলককুন্তল অথবা অংসারূঢ় চারুবাস কম্পিত করিতেছিল।

তিলোত্তমা সুন্দরী। পাঠক! কখন কিশোর বয়সে কোন স্থিরা, ধীরা, কোমল-প্রকৃতি কিশোরীর নবসঞ্চারিত লাবণ্য প্রেমচক্ষুতে দেখিয়াছেন? একবার মাত্র দেখিয়া চিরজীবন মধ্যে যাহার মাধুর্য বিস্মৃত হইতে পারেন নাই; কৈশোরে, যৌবনে, প্রগলভর বয়সে, কার্যে, বিশ্রামে, জাগ্রতে, নিদ্রায়, পুন:পুন: যে মনোমোহিনী মূর্তি স্মরণ-পথে স্বপ্নবৎ যাতায়াত করে, অথচ তৎসম্বন্ধে কখনও চিত্তমালিন্যজনক লালসা জন্মায় না, এমন তরুণী দেখিয়াছেন? যদি দেখিয়া থাকেন, তবেই তিলোত্তমার অবয়ব মনোমধ্যে স্বরূপ অনুভূত করিতে পারিবেন। যে মূর্তি সৌন্দর্যপ্রভাপ্রাচুর্যে মন প্রদীপ্ত করে, যে মূর্তি কোমলতা, মাধুর্যাদি গুণে চিত্তের সন্তুষ্টি জন্মায়, এ সেই মূর্তি। যে মূর্তি সন্ধ্যাসমীরণ-কম্পিতা বসন্তলতার ন্যায় স্মৃতিমধ্যে দুলিতে থাকে, এ সেই মূর্তি।

তিলোত্তমার বয়স ষোড়শ বৎসর, সুতরাং তাঁহার দেহায়তন প্রগলভ।বয়সী রমণীদিগের ন্যায় অদ্যাপি সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয় নাই। দেহায়তনে ও মুখাবয়বে কিঞ্চিৎ বালিকাভাব ছিল। সুগঠিত সুগোল ললাট, অপ্রশস্ত নহে, অথচ অতিপ্রশস্তও নহে, নিশীথ-কৌমুদীদীপ্ত নদীর ন্যায় প্রশান্তভাব-প্রকাশক; তৎপার্শ্বে অতি নিবিড়-বর্ণ কুঞ্চিতালক কেশসকল ভ্রূযুগে, কপোলে, গণ্ডে, অংসে, উরসে আসিয়া পড়িয়াছে; মস্তকের পশ্চাদ্ভাগের অন্ধকারময় কেশরাশি সুবিন্যস্ত মুক্তাহারে গ্রথিত রহিয়াছে; ললাটতলে ভ্রূযুগ সুবঙ্কিম, নিবিড় বর্ণ, চিত্রকরলিখিতবৎ হইয়াও কিঞ্চিৎ অধিক সূক্ষ্মাকার; আর এক সূতা স্থূল হইলে নির্দোষ হইত। পাঠক কি চঞ্চল চক্ষু ভালবাস? তবে তিলোত্তমা তোমার মনোরঞ্জিনী হইতে পারিবে না। তিলোত্তমার চক্ষু অতি শান্ত; তাহাতে “বিদ্যুদ্দামস্ফুরণচকিত” কটাক্ষ নিক্ষেপ হইত না। চক্ষু দুটি অতি প্রশস্ত, অতি সুঠাম, অতি শান্তজ্যোতি:। আর চক্ষুর বর্ণ, ঊষাকালে সূর্যোদয়ের কিঞ্চিৎ পূর্বে, চন্দ্রাস্তের সময়ে আকাশের যে কোমল নীলবর্ণ প্রকাশ পায়, সেইরূপ; সেই প্রশস্ত পরিষ্কার চক্ষে যখন তিলোত্তমা দৃষ্টি করিতেন, তখন তাহাতে কিছুমাত্র কুটিলতা থাকিত না; তিলোত্তমা অপাঙ্গে অর্ধদৃষ্টি করিতে জানিতেন না, দৃষ্টিতে কেবল স্পষ্টতা আর সরলতা; দৃষ্টির সরলতাও বটে; মনের সরলতাও বটে; তবে যদি তাঁহার পানে কেহ চাহিয়া দেখিত, তবে তৎক্ষণাৎ কোমল পল্লব দুখানি পড়িয়া যাইত; তিলোত্তমা তখন ধরাতল ভিন্ন অন্যত্র দৃষ্টি করিতেন না। ওষ্ঠাধর দুখানি গোলাবী, রসে টলমল করিত; ছোট ছোট, একটু ঘুরান, একটু ফুলান, একটু হাসি হাসি; সে ওষ্ঠাধারে যদি একবার হাসি দেখিতে হবে তবে যোগী হও, মুনি হও, যুবা হও, বৃদ্ধ হও, আর ভুলিতে পারিতে না। অথচ সে হাসিতে সরলতা ও বালিকাভাব ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।

তিলোত্তমার শরীর সুগঠন হইয়াও পূর্ণায়ত ছিল না; বয়সের নবীনতা প্রযুক্তই হউক বা শরীরের স্বাভাবিক গঠনের জন্যই হউক, এই সুন্দর দেহে ক্ষীণতা ব্যতীত স্থূলতাগুণ ছিল না। অথচ তন্বীর শরীর মধ্যে সকল স্থানই সুগোল আর সুললিত। সুগোল প্রকোষ্ঠে রত্নবলয়; সুগোল বাহুতে হীরকমণ্ডিত তাড়; সুগোল অঙ্গুলিতে অঙ্গুরীয়; সুগোল ঊরুতে মেখলা; সুগঠন অংসোপরে স্বর্ণহার, সুগঠন কণ্ঠে রত্নকণ্ঠী; সর্বত্রের গঠন সুন্দর।



অষ্টম পরিচ্ছেদ : বিমলার মন্ত্রণা

বিমলা অভিরাম স্বামীর কুটীরমধ্যে দণ্ডায়মান আছেন। অভিরাম স্বামী ভূমির উপর যোগাসনে বসিয়াছেন। জগৎসিংহের সহিত যে প্রকারে বিমলা ও তিলোত্তমার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, বিমলা তাহা আদ্যোপান্ত অভিরাম স্বামীর নিকট বর্ণন করিতেছিলেন; বর্ণনা সমাপ্ত করিয়া কহিলেন, “আজ চতুর্দশ দিবস; কাল পক্ষ পূর্ণ হইবেক |” অভিরাম স্বামী কহিলেন, “এক্ষণে কি স্থির করিয়াছ?”

বিমলা উত্তর করিলেন, “উচিত পরামর্শ জন্যই আপনার কাছে আসিয়াছি |”

স্বামী কহিলেন, “উত্তম, আমার পরামর্শ এই যে, এ বিষয় আর মনে স্থান দিও না |”

বিমলা অতি বিষণ্ণ বদনে নীরব হইয়া রহিলেন। অভিরাম স্বামী জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিষণ্ণ হইলে কেন?”

বিমলা কহিলেন, “তিলোত্তমার কি উপায় হইবে?”

অভিরাম স্বামী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন? তিলোত্তমার মনে কি অনুরাগ সঞ্চার হইয়াছে?”

বিমলা কিয়ৎকাল নীরবে থাকিয়া কহিলেন, “আপনাকে কত কহিব! আমি আজ চৌদ্দ দিন অহোরাত্র তিলোত্তমার ভাবগতিক বিলক্ষণ দেখিতেছি, আমার মনে এমন বোধ হইয়াছে যে, তিলোত্তমার মনোমধ্যে অতি প্রগাঢ় অনুরাগের সঞ্চার হইয়াছে |”

পরমহংস ঈষৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, “তোমরা স্ত্রীলোক; মনোমধ্যে অনুরাগের লক্ষণ দেখিলেই গাঢ় অনুরাগ বিবেচনা কর। বিমলে, তিলোত্তমার মনের সুখের জন্য চিন্তিত হইও না; বালিকা–স্বভাববশত:ই প্রথম দর্শনে মনশ্চাঞ্চল্য হইয়াছে; এ বিষয়ে কোন কথাবার্তা উত্থাপন না হইলেই শীঘ্র জগৎসিংহকে বিস্মৃত হইবে |”

বিমলা কহিল, “না, না, প্রভু, সে লক্ষণ নয়। পক্ষমধ্যে তিলোত্তমার স্বভাব পরিবর্তন হইয়াছে! তিলোত্তমা আমার সঙ্গে কি বয়স্যাদিগের সঙ্গে সেরূপ দিবারাত্রি হাসিয়া কথা কহে না; তিলোত্তমা আর প্রায় কথা কয় না; তিলোত্তমার পুস্তকসকল পালঙ্কের নীচে পড়িয়া পচিতেছে; তিলোত্তমার ফুলগাছসকল জলাভাবে শুষ্ক হইল; তিলোত্তমার পাখীগুলিতে আর সে যত্ন নাই; তিলোত্তমা নিজে আহার করে না; রাত্রে নিদ্রা যায় না; তিলোত্তমা বেশভূষা করে না; তিলোত্তমা কখন চিন্তা করে না, এক্ষণে দিবানিশি অন্যমনে থাকে। তিলোত্তমার মুখে কালিমা পড়িয়াছে |”

অভিরাম স্বামী শুনিয়া নিস্তব্ধ রহিলেন। ক্ষণেক পরে কহিলেন, “আমার বোধ ছিল যে, দর্শনমাত্র গাঢ় অনুরাগ জন্মিতে পারে না; তবে স্ত্রীচরিত্র, বিশেষত: বালিকাচরিত্র, ঈশ্বরই জানেন। কিন্তু কি করিবে? বীরেন্দ্র এ সম্বন্ধে সম্মত হইবে না|”

বিমলা কহিল, “আমি সেই আশঙ্কায় এ পর্যন্ত ইহার কোন উল্লেখ করি নাই, মন্দিরমধ্যেও জগৎসিংহকে পরিচয় দিই নাই। কিন্তু এক্ষণে যদি সিংহ মহাশয়”,–এই কথা বলিতে বিমলার মুখের কিঞ্চিৎ ভাবান্তর হইল–“এক্ষণে যদি সিংহ মহাশয় মানসিংহের সহিত মিত্রতা করিলেন, তবে জগৎসিংহকে জামাতা করিতে হানি কি?”

অ। মানসিংহই বা সম্মত হইবে কেন?

বি। না হয়, যুবরাজ স্বাধীন।

অ। জগৎসিংহই বা বীরেন্দ্রসিংহের কন্যাকে বিবাহ করিবে কেন?

বি। জাতিকুলের দোষ কোন পক্ষেই নাই, জয়ধরসিংহের পূর্বপুরুষেরাও যদুবংশীয়।

অ। যদুবংশীয় কন্যা মুসলমানের শ্যালকপুত্রের বধূ হইবে?

বিমলা উদাসীনের প্রতি স্থিরদৃষ্টি করিয়া কহিল, “না হইবেই বা কেন, যদুবংশের কোন্ কুল ঘৃণ্য?”

এই কথা কহিবামাত্র ক্রোধে পরমহংসের চক্ষু হইতে অগ্নি স্ফুরিত হইতে লাগিল; কঠোর স্বরে কহিলেন, “পাপীয়সি! নিজ হতভাগ্য বিস্মৃত হও নাই? দূর হও!”




নবম পরিচ্ছেদ : কুলতিলক

জগৎসিংহ পিতৃচরণ হইতে সসৈন্য বিদায় হইয়া যে যে কার্য করিলেন, তাহাতে পাঠান সৈন্যমধ্যে মহাভীতি প্রচার হইল। কুমার প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, পঞ্চ সহস্র সেনা লইয়া তিনি কতলু খাঁর পঞ্চাশৎ সহস্রকে সুবর্ণরেখা পার করিয়া দিবেন, যদিও এ পর্যন্ত তত দূর কৃতকার্য হইবার সম্ভাবনা দেখাইতে পারেন নাই, তথাপি তিনি শিবির হইতে আসিয়া দুই সপ্তাহে যে পর্যন্ত যোদ্ধৃপতিত্ব গুণের পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহা শ্রবণ করিয়া মানসিংহ কহিয়াছিলেন, “বুঝি আমার কুমার হইতে রাজপুত নামের পূর্বগৌরব পুনরুদ্দীপ্ত হইবে |”

জগৎসিংহ উত্তমরূপে জানিতেন, পঞ্চ সহস্র সেনা লইয়া পঞ্চাশৎ সহস্রকে সম্মুখসংগ্রামে বিমুখ করা কোন রূপেই সম্ভব নহে, বরং পরাজয় বা মৃত্যুই নিশ্চয়। অতএব সম্মুখসংগ্রামের চেষ্টায় না থাকিয়া, যাহাতে সম্মুখসংগ্রাম না হয়, এমন প্রকার রণপ্রণালী অবলম্বন করিলেন। তিনি নিজ সামান্যসংখ্যক সেনা সর্বদা অতি গোপনে লুক্কায়িত রাখিতেন, নিবিড় বনমধ্যে বা ঐ প্রদেশে সমুদ্র-তরঙ্গবৎ কোথাও নিম্ন, কোথাও উচ্চ যে সকল ভূমি আছে, তন্মধ্যে এমন স্থানে শিবির করিতেন যে, পার্শ্ববর্তী উচ্চ ভূমিখণ্ড সকলের অন্তরালে, অতি নিকট হইতেও কেহ তাঁহার সেনা দেখিতে পাইত না। এইরূপ গোপনভাবে থাকিয়া, যখন কোথাও স্বল্পসংখ্যক পাঠান সেনার সন্ধান পাইতেন, তরঙ্গপ্রপাতবৎ বেগে তদুপরি সসৈন্য পতিত হইয়া তাহা একেবারে নি:শেষ করিতেন। তাঁহার বহুসংখ্যক চর ছিল; তাহারা ফলমূলমৎস্যাদিবিক্রেতা বা ভিক্ষুক উদাসীন ব্রাহ্মণ বৈদ্যাদির বেশে নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া, পাঠান-সেনার গতিবিধির সন্ধান আনিয়া দিত। জগৎসিংহ সংবাদ পাইবামাত্র অতি সাবধানে অথচ দ্রুতগতি এমন স্থানে গিয়া সৈন্য সংস্থাপন করিতেন যে, যেন আগন্তুক পাঠান-সেনার উপরে সুকৌশলে এবং অপূর্বদৃষ্ট হইয়া আক্রমণ করিতে পারেন। যদি পাঠান-সেনা অধিকসংখ্যক হইত, তবে জগৎসিংহ তাহাদিগকে আক্রমণ করার কোন স্পষ্ট উদ্যম করিতেন না; কেন না, তিনি জানিতেন. তাঁহার বর্তমান অবস্থায় এক যুদ্ধে পরাজয় হইলে সকল নষ্ট হইবে। তখন কেবল পাঠান-সেনা চলিয়া গেলে সাবধানে তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ গিয়া তাহাদিগের আহারীয় দ্রব্য, অশ্ব, কামান ইত্যাদি অপহরণ করিয়া লইয়া আসিতেন। আর যদি পাঠান-সেনা প্রবল না হইয়া স্বল্পসংখ্যক হইত; তবে যতক্ষণে সেনা নিজ মনোমত স্থান পর্যন্ত না আসিত, সে পর্যন্ত স্থির হইয়া গোপনীয় স্থানে থাকিতেন; পরে সময় বুঝিয়া, ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় চীৎকার শব্দে ধাবমান হইয়া হতভাগ্য পাঠানদিগকে খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতেন। সে অবস্থায় পাঠানেরা শত্রুর নিকটস্থিতি অবগত থাকিত না; সুতরাং রণ জন্য প্রস্তুত থাকিত না। অকস্মাৎ শত্রুপ্রবাহমুখে পতিত হইয়া প্রায় বিনা যুদ্ধে প্রাণ হারাইত।



দশম পরিচ্ছেদ : মন্ত্রণার পর উদ্যোগ

মন্ত্রণার পর উদ্যোগযে দিবস অভিরাম স্বামী বিমলার প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাকে গৃহবহিষ্কৃত করিয়া দেন, তাহার পরদিন প্রদোষকালে বিমলা নিজ কক্ষে বসিয়া বেশভূষা করিতেছিলেন। পঞ্চত্রিংশৎ বর্ষীয়ার বেশভূষা? কেনই বা না করিবে? বয়সে কি যৌবন যায়? যৌবন যায় রূপে আর মনে; যার রূপ নাই, সে বিংশতি বয়সেও বৃদ্ধা; যার রূপ আছে, সে সকল বয়সেই যুবতী। যার মন রস নাই, সে চিরকাল প্রবীণ; যার রস আছে, সে চিরকাল নবীন। বিমলার আজও রূপে শরীর ঢলঢল করিতেছে, রসে মন টলটল করিতেছে। বয়সে আরও রসের পরিপাক; পাঠক মহাশয়ের যদি কিঞ্চিৎ বয়স হইয়া থাকে, তবে এ কথা অবশ্য স্বীকার করিবেন।

কে বিমলার সে তাম্বুলরাগরক্ত ওষ্ঠাধর দেখিয়া বলিবে, এ যুবতী নয়? তাহার কজ্জলনিবিড় প্রশস্ত লোচনের চকিত কটাক্ষ দেখিয়া কে বলিবে যে, এ চতুর্বিংশতির পরপারে পড়িয়াছে? কি চক্ষু! সুদীর্ঘ; চঞ্চল; আবেশময়। কোন কোন প্রগলভক-যৌবনা কামিনীর চক্ষু দেখিবামাত্র মনোমধ্যে বোধ হয় যে, এই রমণী দর্পিতা; এ রমণী সুখলালসাপূর্ণা। বিমলার চক্ষু সেইরূপ। আমি নিশ্চিত পাঠক মহাশয়কে বলিতেছি, বিমলা যুবতী, স্থিরযৌবনা বলিলেও বলা যায়। তাঁহার সে চম্পকবর্ণ ত্বকের কোমলতা দেখিলে কে বলিবে যে, ষোড়শী তাঁহার অপেক্ষা কোমলা? যে একটি অতি ক্ষুদ্র গুচ্ছ অলককেশ কুঞ্চিত হইয়া কর্ণমূল হইতে অসাবধানে কপোলদেশে পড়িয়াছে, কে দেখিয়া বলিবে যে, যুবতীর কপোলে যুবতীর কেশ পড়ে নাই? পাঠক! মনশ্চক্ষু উন্মীলন কর; যেখানে বসিয়া দর্পণ সম্মুখে বিমলা কেশবিন্যাস করিতেছে, তাহা দেখ; বিপুল কেশগুচ্ছ বাম করে লইয়া, সম্মুখে রাখিয়া যে প্রকারে তাহাতে চিরণী দিতেছে, দেখ; নিজ যৌবনভাব দেখিয়া টিপি টিপি যে হাসিতেছে, তাহা দেখ; মধ্যে মধ্যে বীণানিন্দিত মধুর স্বরে যে মৃদু স্বরে যে মৃদু মৃদু সঙ্গীত করিতেছে, তাহা শ্রবণ কর; দেখিয়া শুনিয়া বল, বিমলা অপেক্ষা কোন্ নবীনা তোমার মনোমোহিনী?

বিমলা কেশ বিন্যস্ত করিয়া কবরী বন্ধন করিলেন না; পৃষ্ঠদেশে বেণী লম্বিত করিলেন। গন্ধবারিসিক্ত রুমালে মুখ পরিষ্কার করিলেন; গোলাপপূগকর্পূরপূর্ণ তাম্বুলে পুনর্বার ওষ্ঠাধর রঞ্জন করিলেন; মুক্তাভূষিত কাঁচলি লইয়া বক্ষে দিলেন; সর্বাঙ্গে কনকরত্নভূষা পরিধান করিলেন; আবার কি ভাবিয়া তাহার কিয়দংশ পরিত্যাগ করিলেন; বিচিত্র কারুকার্যখচিত বসন পড়িলেন; মুক্তা-শোভিত পাদুকা গ্রহণ করিলেন; এবং সুবিন্যস্ত চিকুরে যুবরাজদত্ত বহুমূল্য মুক্তাহার রোপিত করিলেন।

বিমলা বেশ করিয়া তিলোত্তমার কক্ষে গমন করিলেন। তিলোত্তমা দেখিবামাত্র বিস্ময়াপন্ন হইলেন; হাসিয়া কহিলেন, “এ কি বিমলা! এ বেশ কেন?”

বিমলা কহিলেন, “তোর সে কথায় কাজ কি?”

তি। সত্য বল না, কোথায় যাবে?

বি। আমি যে কোথায় যাব, তোমাকে কে বলিল?

তিলোত্তমা অপ্রতিভ হইলেন। বিমলা তাঁহার লজ্জা দেখিয়া সকরুণে ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “আমি অনেকদূর যাব |”

তিলোত্তমার মুখ প্রফুল্ল পদ্মের ন্যায় হর্ষবিকসিত হইল। মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় যাবে?”

বিমলা সেইরূপ মুখ টিপিয়া হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “আন্দাজ কর না?”

তিলোত্তমা তাঁহার মুখপানে চাহিয়া রহিলেন।

বিমলা তখন তাঁহার হস্তধারণ করিয়া, “শুন দেখি” বলিয়া গবাক্ষের নিকট লইয়া গেলেন। তথায় কাণে কাণে কহিলেন, “আমি শৈলেশ্বর-মন্দিরে যাব; তথায় কোন রাজপুত্রের সহিত সাক্ষাৎ হইবে |”



একাদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির দৌত্য

এদিকে বিমলার ইঙ্গিতমত আশমানি গৃহের বাহিরে আসিয়া প্রতীক্ষা করিতেছিল। বিমলা আসিয়া তাহাকে কহিলেন, “আশমানি, তোমার সঙ্গে কোন বিশেষ গোপনীয় কথা আছে |”

আশমানি কহিল, “বেশভূষা দেখিয়া আমিও ভাবিতেছিলাম, আজ কি একটা কাণ্ড |”

বিমলা কহিলেন, “আমি আজ কোন প্রয়োজনে অধিক দূরে যাইব। এ রাত্রে একাকিনী যাইতে পারিব না; তুমি ছাড়া আর কাহাকেও বিশ্বাস করিয়া সঙ্গে লইতে পারিব না; তোমাকে আমার সঙ্গে যাইতে হইবে |”

আশমানি জিজ্ঞাসা করিল, “কোথা যাবে?”

বিমলা কহিলেন, “আশমানি, তুমি ত সেকালে এত কথা জিজ্ঞেস করিতে না?”

আশমানি কিছু অপ্রতিভ হইয়া কহিল, “তবে তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি কতকগুলা কাজ সারিয়া আসি|”

বিমলা কহিলেন, “আর একটা কথা আছে; মনে কর, যদি তোমার সঙ্গে আজ সেকালের কোন লোকের দেখা হয়, তবে কি তোমাকে সে চিনিতে পারিবে?”

আশমানি বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি?”

বিমলা কহিলেন, “মনে কর, যদি কুমার জগৎসিংহের সহিত দেখা হয়?”

আশমানি অনেক্ষণ নীরব থাকিয়া গদগদ স্বরে কহিল, “এমন দিন কি হবে?”

বিমলাও কহিলেন, “হইতেও পারে |”

আশমানি কহিল, “কুমার চিনিতে পারিবেন বৈ কি |”

বিমলা কহিলেন, “তবে তোমার যাওয়া হইবে না, আর কাহাকে লইয়া যাই–একাও ত যাইতে পারি না |”

আশমানি কহিল, “কুমার দেখিব মনে বড়ই সাধ হইতেছে |”

বিমলা কহিলেন, “মনের সাধ মনে থাক; এখন আমি কি করি?”

বিমলা চিন্তা করিতে লাগিলেন। আশমানি অকস্মাৎ মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিল। বিমলা কহিলেন, “মর্! আপনা আপনি হেসে মরিস কেন?”

আশমানি কহিল, “মনে মনে ভাবিতেছিলাম, বলি আমার সোনার চাঁদ দিগ্গতজকে তোমার সঙ্গে পাঠাইলে কি হয়?”

বিমলা হাসিয়া উল্লাসে কহিলেন, “সেই কথাই ভাল; রসিকরাজকেই সঙ্গে লইব|”

আশমানি বিস্মিত হইয়া কহিল, “সে কি, আমি যে তামাসা করিতেছিলাম!”

বিমলা কহিলেন, “তামাসা না, বোকা বামুনকে আমার অবিশ্বাস নাই। অন্ধের দিন রাত্রি নাই, ও ত কিছুই বুঝিতে পারিবে না, সুতরাং ওকে অবিশ্বাস নাই। তবে বামুন যেতে চাবে না |”

আশমানি হাসিয়া কহিল, “সে ভার আমার; আমি তাহাকে সঙ্গে করিয়া নিয়া আসিতেছি, তুমি ফটকের সম্মুখে একটু অপেক্ষা করিও |”

এই বলিয়া আশমানি হাসিতে হাসিতে দুর্গমধ্যস্থ একটি ক্ষুদ্র কুটীরাভিমুখে চলিল।

অভিরাম স্বামীর শিষ্য গজপতি বিদ্যাদিগ্‌‌গজ ইতিপূর্বেই পাঠক মহাশয়ের নিকট একবার পরিচিত হইয়াছেন। যে হেতুতে বিমলা তাঁহার রসিকরাজ নাম রাখিয়াছিলেন, তাহাও পাঠক মহাশয় অবগত আছেন। সেই মহাপুরুষ এই কুটীরের অধিকারী। দিগ্‌গছজ মহাশয় দৈর্ঘ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ সাত হইবেন, প্রস্থে বড় জোর আধ হাত তিন আঙ্গুল। পা দুইখানি কাঁকাল হইতে মাটি পর্যন্ত মাপিলে চৌদ্দপুয়া চারি হাত হইবেক; প্রস্থে রলা কাষ্ঠের পরিমাণ। বর্ণ দোয়াতের কালি; বোধ হয়, অগ্নি কাষ্ঠভ্রমে পা দুখানি ভক্ষণ করিতে বসিয়াছিলেন, কিছুমাত্র রস না পাইয়া অর্ধেক অঙ্গার করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন। দিগ্‌‌গজ মহাশয় অধিক দৈর্ঘ্যবশত: একটু একটু কুঁজো, অবয়বের মধ্যে নাসিকা প্রবল, শরীরে মাংসাভাব সেইখানেই সংশোধন হইয়াছে। মাথাটি বেহায়া-কামান, কামান চুলগুলি যাহা আছে তাহা ছোট ছোট, আবার হাত দিলে সূচ ফুটে। আর্ক-ফলার ঘটাটা জাঁকাল রকম।



দ্বাদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির অভিসার

দিগ্‌‌গজ গজপতির মনোমোহিনী আশমানি কিরূপ রূপবতী, জানিতে পাঠক মহাশয়ের কৌতূহল জন্মিয়াছে সন্দেহ নাই। অতএব তাঁহার সাধ পুরাইব। কিন্তু স্ত্রীলোকের রূপবর্ণন-বিষয়ে গ্রন্থকারগণ যে পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া থাকেন, আমার সদৃশ অকিঞ্চন জনের তৎপদ্ধতি বহির্ভূত হওয়া অতি ধৃষ্টতার বিষয়। অতএব, প্রথমে মঙ্গলাচরণ করা কর্তব্য।

হে বাগ্‌দেবি! হে কমলাসনে! শরবিন্দুনিভাননে! অমলকমল-দলনিন্দিত-চরণ-ভক্তভজন-বৎসলে! আমাকে সেই চরণকমলের ছায়া দান কর; আমি আশমানির রূপ বর্ণন করিব। হে অরবিন্দানন-সুন্দরীকূল-গর্ব-খর্বকারিণি! হে বিশাল রসাল দীর্ঘ-সমাস-পটল-সৃষ্টিকারিণি! একবার পদনখের এক পার্শ্বে স্থান দাও, আমি রূপ বর্ণন করিব। সমাস-পটল, সন্ধি-বেগুন, উপমা-কাঁচাকলার চড়চড়ি রাঁধিয়া এই খিচুড়ি তোমায় ভোগ দিব। হে পণ্ডিতকুলেপ্সিত-পয়:প্রস্রবিণি! হে মূর্খজনপ্রতি ক্কচিৎ কৃপাকারিণি! হে অঙ্গুলি-কণ্ডূয়ন-বিষমবিকার সমুৎপাদিনি! হে বটতলা-বিদ্যাপ্রদীপ-তৈলপ্রদায়িনি! আমার বুদ্ধির প্রদীপ একবার উজ্জ্বল করিয়া দিয়া যাও। মা! তোমার দুই রূপ; যে রূপে তুমি কালিদাসকে বরপ্রদা হইয়াছিলে, যে প্রকৃতির প্রভাবে রঘুবংশ, কুমারসম্ভব, মেঘদূত, শকুন্তলা জন্মিয়াছিল, যে প্রকৃতির ধ্যান করিয়া বাল্মীকি রামায়ণ, ভবভূতি উত্তরচরিত, ভারবি কিরাতার্জুনীয় রচনা করিয়াছিলেন, সে রূপে আমার স্কন্ধে আরোহণ করিয়া পীড়া জন্মাইও না; যে মূর্তি ভাবিয়া শ্রীহর্ষ নৈষধ লিখিয়াছিলেন, যে প্রকৃতিপ্রসাদে ভারতচন্দ্র বিদ্যার অপূর্ব রূপবর্ণন করিয়া বঙ্গদেশের মনোমোহন করিয়াছেন, যাহার প্রসাদে দাসরথি রায়ের জন্ম, যে মূর্তিতে আজও বটতলা আলো করিতেছ, সেই মূর্তিতে একবার আমার স্কন্ধে আবির্ভূত হও, আমি আশমানির রূপ বর্ণন করি।

আশমানির বেণীর শোভা ফণিনীর ন্যায়; ফণিনী সেই তাপে মনে ভাবিল, যদি বেণীর কাছে পরাস্ত হইলাম, তবে আর এ দেহ লোকের কাছে লইয়া বেড়াইবার প্রয়োজনটা কি! আমি গর্তে যাই। এই ভাবিয়া সাপ গর্তের ভিতর গেলেন। ব্রহ্মা দেখিলেন প্রমাদ; সাপ গর্তে গেলেন, মানুষ দংশন করে কে? এই ভাবিয়া তিনি সাপকে ল্যাজ ধরিয়া টানিয়া বাহির করিলেন, সাপ বাহিরে আসিয়া, আবার মুখ দেখাইতে হইল, এই ক্ষোভে মাথা কুটিতে লাগিল, মাথা কুটিতে কুটিতে মাথা চেপ্টা হইয়া গেল, সেই অবধি সাপের ফণা হইয়াছে। আশমানির মুখচন্দ্র অধিক সুন্দর, সুতরাং চন্দ্রদেব উদিত হইতে না পারিয়া ব্রহ্মার নিকট নালিশ করিলেন। ব্রহ্মা কহিলেন, ভয় নাই, তুমি গিয়া উদিত হও, আজি হইতে স্ত্রীলোকদিগের মুখ আবৃত হইবে; সেই অবধি ঘোমটার সৃষ্টি। নয়ন দুটি যেন খঞ্জন, পাছে পাখী ডানা বাহির করিয়া উড়িয়া পলায়, এই জন্য বিধাতা পল্লবরূপ পিঁজরার কবাট করিয়া দিয়াছেন। নাসিকা গরুড়ের নাসার ন্যায় মহাবিশাল; দেখিয়া গরুড় আশঙ্কায় বৃক্ষারোহণ করিল; সেই অবধি পক্ষিকূল বৃক্ষের উপরেই থাকে। কারণান্তরে দাড়িম্ব বঙ্গদেশ ছাড়িয়া পাটনা অঞ্চলে পলাইয়া রহিলেন; আর হস্তী কুম্ভ লইয়া ব্রহ্মদেশে পলাইলেন; বাকি ছিলেন ধবলগিরি, তিনি দেখিলেন যে, আমার চূড়া কতই বা উচ্চ, আড়াই ক্রোশ বই ত নয়, এ চূড়া অন্যূন তিন ক্রোশ হইবেক; এই ভাবিতে ভাবিতে ধবলগিরির মাথা গরম হইয়া উঠিল, বরফ ঢালিতে লাগিলেন, তিনি সেই অবধি মাথায় বরফ দিয়া বসিয়া আছেন।

কপালের লিখন দোষে আশমানি বিধবা! আশমানি দিগ্গনজের কুটীরে আসিয়া দেখিল যে, কুটীরের দ্বার রুদ্ধ, ভিতরে প্রদীপ জ্বলিতেছে। ডাকিল, “ও ঠাকুর!”

কেউ উত্তর দিল না।



ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ : আশমানির প্রেম

দ্বার খুলিলে আশমানি গৃহে প্রবেশ করিবামাত্র দিগ্‌গজের হৃদ্বোধ হইল যে, প্রণয়িনী আসিয়াছেন, ইহার সরস অভ্যর্থনা করা চাই, অতএব হস্ত উত্তোলন করিয়া কহিলেন, “ওঁ আয়াহি বরদে দেবি!”

আশমানি কহিল, “এটি যে বড় সরস কবিতা, কোথা পাইলে?”

দি। তোমার জন্য এটি আজ রচনা করিয়া রাখিয়াছি।

আ। সাধ করিয়া কি তোমায় রসিকরাজ বলেছি?

দি। সুন্দরি! তুমি বইস; আমি হস্ত প্রক্ষালন করি।

আশমানি মনে মনে কহিল, “আলোপ্পেয়ে! তুমি যে হাত ধোবে? আমি তোমাকে ঐ এঁটো আবার খাওয়াব |”

প্রকাশ্যে কহিল, “সে কি, হাত ধোও যে, ভাত খাও না।”

গজপতি কহিলেন, “কি কথা, ভোজন করিয়া উঠিয়াছি, আবার ভাত খাব কিরূপে?”

আ। কেন, তোমার ভাত রহিয়াছে যে? উপবাস করিবে?

দিগ্‌গজ কিছু ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিলেন, “কি করি, তুমি তাড়াতাড়ি করিলে।” এই বলিয়া সতৃষ্ণনয়নে অন্নপানে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন।

আশমানি কহিল, “তবে আবার খাইতে হইবে |”

দি। রাধে মাধব! গণ্ডূষ করিয়াছি, গাত্রোত্থান করিয়াছি, আবার খাইব?

“হাঁ, খাইবে বই কি। আমারই উৎসৃষ্ট খাইবে।” এই বলিয়া আশমানি ভোজনপাত্র হইতে এক গ্রাস অন্ন লইয়া আপনি খাইল।

ব্রাহ্মণ অবাক হইয়া রহিলেন।

আশমানি উৎসৃষ্ট অন্ন ভোজনপাত্রে রাখিয়া কহিল, “খাও |”

ব্রাহ্মণের বাঙ্‌নিষ্পত্তি নাই।

আ। খাও, শোন, কাহাকে বলিব না যে, তুমি আমার উৎসৃষ্ট খাইয়াছ। কেহ না জানিতে পারিলে দোষ কি?

দি। তাও কি হয়?

কিন্তু দিগ্‌গজের উদরমধ্যে অগ্নিদেব প্রচণ্ড জ্বালায় জ্বলিতেছিলেন। দিগ্‌‌গজ মনে মনে করিতেছিলেন যে, আশমানি যেমন সুন্দর হউক না কেন, পৃথিবী ইহাকে গ্রাস করুন, আমি গোপনে ইহার উৎসৃষ্টাবশেষ ভোজন করিয়া দহ্যমান উদর শীতল করি।

আশমানি ভাব বুঝিয়া বলিল, “খাও – না খাও, একবার পাতের কাছে বসো |”

দি। কেন? তাতে কি হইবে?

আ। আমার সাধ। তুমি কি আমার একটা সাধ পুরাইতে পার না?

দিগ্‌‌গজ বলিলেন, “শুধু পাতের কাছে বসিতে কি? তাহাতে কোন দোষ নাই। তোমার কথা রাখিলাম |” এই বলিয়া দিগ্‌গজ পণ্ডিত আশমানির কথায় পাতের কাছে গিয়া বসিলেন। উদরে ক্ষুধা, কোলে অন্ন, অথচ খাইতে পারিতেছেন না – দিগ্‌গজের চক্ষে জল আসিল।

আশমানি বলিল, “শূদ্রের উৎসৃষ্ট ব্রাহ্মণে ছুঁলে কি হয়?”

পণ্ডিত বলিলেন, “নাইতে হয় |” আ। তুমি আমায় কেমন ভালবাস, আজ বুঝিয়া পড়িয়া তবে আমি যাব। তুমি আমার কথায় এই রাত্রে নাইতে পার?



চতুর্দশ পরিচ্ছেদ : দিগ্‌গজহরণ

এমন সময় বিমলা আসিয়া, বাহির হইতে দ্বার নাড়িল। বিমলা দ্বারপার্শ্ব হইতে অলক্ষ্যে সকল দেখিতেছিল। দ্বারের শব্দ শুনিয়া দিগ্‌গজের মুখ শুকাইল। আশমানি বলিল, “কি সর্বনাশ, বিমলা আসিতেছে – লুকোও লুকোও|”

দিগ্‌গজ ঠাকুর কাঁদিয়া কহিল, “কোথায় লুকাইব?”

আশমানি বলিল, “ঐ অন্ধকার কোণে একটা কেলে-হাঁড়ি মাথায় দিয়া বসো গিয়া – অন্ধকারে ঠাওর পাইবে না |” দিগ্গেজ তাহাই করিতে লাগিল – আশমানির বুদ্ধির তীক্ষ্ণতায় বিস্মিত হইল। দুর্ভাগ্যবশতঃ তাড়াতাড়িতে ব্রাহ্মণ একটা অড়হর ডালের হাঁড়ি পাড়িয়া মাথায় দিল - তাহাতে আধ হাঁড়ি রাঁধা অরহর ডাল ছিল - দিগ্‌গজ যেমন হাঁড়ি উলটাভইয়া মাথায় দিবেন, অমনি মস্তক হইতে অড়হর ডালের শতধারা বহিল – টিকি দিয়া অড়হর ডালের স্রোত নামিল – স্কন্ধ, বক্ষ, পৃষ্ঠ ও বাহু হইতে অড়হর ডালের ধারা, পর্বত হইতে ভূতলগামিনী নদীসকলের ন্যায় তরঙ্গে তরঙ্গে নামিতে লাগিল; উচ্চ নাসিকা অড়হরের প্রস্রবণবিশিষ্ট গিরিশৃঙ্গের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। এই সময়ে বিমলা গৃহে প্রবেশ করিয়া দিগ্গণজের শোভারাশি সন্দর্শন করিতে লাগিলেন। দিগ্‌গজ বিমলাকে দেখিয়া কাঁদিয়া উঠিল। দেখিয়া বিমলার দয়া হইল। বিমলা বলিলেন, “কাঁদিও না। তুমি যদি এই অবশিষ্ট ভাতগুলি খাও, তবে আমরা কাহারও সাক্ষাতে এ সকল কথা বলিব না |”

ব্রাহ্মণ তখন প্রফুল্ল হইল; প্রফুল্ল বদনে পুনশ্চ আহারে বসিল – ইচ্ছা, অঙ্গের অড়হর ডালটুকুও মুছিয়া লয়, কিন্তু তাহা পারিল না, কিংবা সাহস করিল না। আশমানির জন্য যে ভাত মাখিয়াছিল, তাহা খাইল। বিনষ্ট অড়হরের জন্য অনেক পরিতাপ করিল। আহার সমাপনান্তে আশমানি তাহাকে স্নান করাইল। পরে ব্রাহ্মণ স্থির হইলে বিমলা কহিলেন, “রসিক! একটা বড় ভারি কথা আছে |”

রসিক কহিলেন, “কি?”

বি। তুমি আমাদের ভালবাস?

দি। বাসি নে?

বি। দুই জনকেই?

দি। দুইজনকেই।

বি। যা বলি, তা পারিবে?

দি। পারিব না?

বি। এখনই?

দি। এখনই।

বি। এই দণ্ডে?

দি। এই দণ্ডে।

বি। আমরা দুজনে কেন এসেছি জান?

দি। না।

আশমানি কহিল, “আমরা তোমার সঙ্গে পলাইয়া যাইব |”

ব্রাহ্মণ অবাক হইয়া হাঁ করিয়া রহিলেন। বিমলা কষ্টে উচ্চ হাসি সম্বরণ করিলেন। কহিলেন, “কথা কও না যে?”




পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ : দিগ্‌গজের সাহস

বিমলা দ্রুতপাদবিক্ষেপে শীঘ্র মান্দারণ পশ্চাৎ করিলেন। নিশা অত্যন্ত অন্ধকার, নক্ষত্রালোকে সাবধানে চলিতে লাগিলেন। প্রান্তরপথে প্রবেশ করিয়া বিমলা কিঞ্চিৎ শঙ্কান্বিতা হইলেন; সমভিব্যাহারী নিঃশব্দে পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছেন, বাক্যব্যয়ও নাই। এমন সময়ে মনুষ্যের কণ্ঠস্বর শুনিলে কিছু সাহস হয়, শুনিতে ইচ্ছাও করে। এই জন্য বিমলা গজপতিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রসিকরতন! কি ভাবিতেছ?”

রসিকরতন বলিলেন, “বলি তৈজসপত্রগুলা!”

বিমলা উত্তর না দিয়া, মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে লাগিলেন।

ক্ষণেক কাল পরে, বিমলা আবার কথা কহিলেন, “দিগ্‌গজ, তুমি ভূতের ভয় কর?”

“রাম! রাম! রাম! রামনাম বল”, বলিয়া দিগ্‌গজ বিমলার পশ্চাতে দুই হাত সরিয়া আসিলেন।

একে পায়, আরে চায়। বিমলা কহিলেন, “এ পথে বড় ভূতের দৈরাত্ম্য।” দিগ্‌গজ আসিয়া বিমলার অঞ্চল ধরিলেন। বিমলা বলিতে লাগিলেন, “আমরা সেদিন শৈলেশ্বরের পূজা দিয়া আসিতেছিলাম, পথের মধ্যে বটতলায় দেখি যে, এক বিকটাকার মূর্তি!”

অঞ্চলের তাড়নায় বিমলা জানিতে পারিলেন যে, ব্রাহ্মণ থরহরি কাঁপিতেছে; বুঝিলেন যে, আর অধিক বাড়াবাড়ি করিলে ব্রাহ্মণের গতিশক্তি রহিত হইবে। অতএব ক্ষান্ত হইয়া কহিলেন, “রসিকরাজ! তুমি গাইতে জান?”

রসিক পুরুষ কে কোথায় সঙ্গীতে অপটু? দিগ্‌গজ বলিলেন, “জানি বৈ কি |”

বিমলা বলিলেন, “একটি গীত গাও দেখি।”

দিগ্‌গজ আরম্ভ করিলেন,

           “এ হুম্ – উ, হুম্ –

সই, কি ক্ষণে দেখিলাম শ্যামে কদম্বেরি ডালে |”

পথের ধারে একটা গাভী শয়ন করিয়া রোমন্থন করিতেছিল, অলৌকিক শব্দ শুনিয়া বেগে পলায়ন করিল। রসিকের গীত চলিতে লাগিল।

           “সেই দিন পুড়িল কপাল মোর –

               কালি দিলাম কুলে।

মাথায় চূড়া, হাতে বাঁশী      কথা কয় হাসি হাসি;

     বলে ও গোয়ালা মাসী–কলসী দিব ফেলে |”

দিগ্গ জের আর গান হইল না; হঠাৎ তাঁহার শ্রবণেন্দ্রিয় একেবারে মুগ্ধ হইয়া গেল; অমৃতময়, মানসোন্মাদকর, অপ্সরোহস্তস্থিত বীণাশব্দবৎ মধুর সঙ্গীতধ্বনি তাঁহার কর্ণকুহরে প্রবেশ করিল। বিমলা নিজে পূর্ণস্বরে সঙ্গীত আরম্ভ করিয়াছিলেন।

নিস্তব্ধ প্রান্তরমধ্যে নৈশ গগন ব্যাপিয়া সেই সপ্তস্বরপরিপূর্ণ ধ্বনি উঠিতে লাগিল। শীতল নৈদাঘ পবনে ধ্বনি আরোহণ করিয়া চলিল।

দিগ্গোজ নিশ্বাস রহিত করিয়া শুনিতে লাগিলেন। যখন বিমলা সমাপ্ত করিলেন, তখন গজপতি কহিলেন, “আবার |”

বি। আবার কি?




ষোড়শ পরিচ্ছেদ : শৈলেশ্বর সাক্ষাৎ

বিমলা মন্দিমধ্যে প্রবেশ করিয়া প্রথমে বসিয়া একটু স্থির হইলেন। পরে নতভাবে শৈলেশ্বরকে প্রণাম করিয়া যুবরাজকে প্রণাম করিলেন। কিয়ৎক্ষণ উভয়েই নীরব হইয়া রহিলেন, কে কি বলিয়া আপন মনোগত ভাব ব্যক্ত করিবেন? উভয়েরই সঙ্কট। কি বলিয়া প্রথমে কথা কহিবেন?

বিমলা এ বিষয়ের সন্ধিবিগ্রহে পণ্ডিতা, ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, “যুবরাজ! আজ শৈলেশ্বরের অনুগ্রহে আপনার দর্শন পাইলাম, একাকিনী এ রাত্রে প্রান্তরমধ্যে আসিতে ভীতা হইয়াছিলাম, এক্ষণে মন্দিরমধ্যে আপনার দর্শনে সাহস পাইলাম |”

যুবরাজ কহিলেন, “তোমাদিগের মঙ্গল ত!”

বিমলার অভিপ্রায়, প্রথমে জানেন - রাজকুমার যথার্থ তিলোত্তমাতে অনুরক্ত কি না, পশ্চাৎ অন্য কথা কহিবেন। এই ভাবিয়া বলিলেন, “যাহাতে মঙ্গল হয়, সেই প্রার্থনাতেই শৈলেশ্বরের পূজা করিতে আসিয়াছি। এক্ষণে বুঝিলাম, আপনার পূজাতেই শৈলেশ্বর পরিতৃপ্ত আছেন, আমার পূজা গ্রহণ করিবেন না, অনুমতি হয় ত প্রতিগমন করি |”

যুব। যাও। একাকিনী তোমার যাওয়া উচিত হয় না, আমি তোমাকে রাখিয়া আসি।

বিমলা দেখিলেন যে, রাজপুত্র যাবজ্জীবন কেবল অস্ত্র শিক্ষা করেন নাই। বিমলা উত্তর করিলেন, “একাকিনী যাওয়া অনুচিত কেন?”

যুব। পথে নানা ভীতি আছে।

বি। তবে আমি মহারাজ মানসিংহের নিকটে যাইব।

রাজপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “কেন?”

বি। কেন? তাঁহার কাছে নালিশ আছে। তিনি যে সেনাপতি নিযুক্ত করিয়াছেন, তাঁহা কর্তৃক আমাদিগের পথের ভয় দূর হয় না। তিনি শত্রুনিপাতে অক্ষম।

রাজপুত্র সহাস্যে উত্তর করিলেন “সেনাপতি উত্তর করিবেন যে, শত্রুনিপাত দেবের অসাধ্য, মনুষ্য কোন্ ছার! উদাহরণ, স্বয়ং মহাদেব তপোবনে মন্মথ শত্রুকে ভস্মরাশি করিয়াছিলেন; অদ্য পক্ষমাত্র হইল, সেই মন্মথ তাঁহার এই মন্দিরমধ্যেই বড় দৌরাত্ম্য করিয়াছে।”

বিমলা ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন, “এত দৌরাত্ম্য কাহার প্রতি হইয়াছে?”

যুবরাজ কহিলেন, “সেনাপতির প্রতিই হইয়াছে |”

বিমলা কহিলেন, “মহারাজ এমন অসম্ভব কথা বিশ্বাস করিবেন কেন?”

যুব। আমার সাক্ষী আছে।

বি। মহাশয়, এমন সাক্ষী কে?

যুব। সুচরিত্রে –

রাজপুত্রের বাক্য শেষ না হইতে হইতে বিমলা কহিলেন, “দাসী অতি কুচরিত্রা। আমাকে বিমলা বলিয়া ডাকিবেন |”

রাজপুত্র বলিলেন, “বিমলাই তাহার সাক্ষী |”

বি। বিমলা এমত সাক্ষ্য দিবে না।

যুব। সম্ভব বটে; যে ব্যক্তি পক্ষমধ্যে আত্মপ্রতিশ্রুতি বিস্মৃতা হয়, সে কি সত্য সাক্ষ্য দিয়া থাকে?



সপ্তদশ পরিচ্ছেদ : বীরপঞ্চমী

উভয়ে শৈলেশ্বর প্রণাম করিয়া, সশঙ্কচিত্তে গড় মান্দারণ অভিমুখে যাত্রা করিলেন। কিঞ্চিৎ নীরবে গেলেন। কিছু দূর গিয়া রাজকুমার প্রথমে কথা কহিলেন, “বিমলে, আমার এক বিষয়ে কৌতূহল আছে। তুমি শুনিয়া কি বলিবে বলিতে পারি না |”

বিমলা কহিলেন, “কি?”

জ। আমার মনে প্রতীতি জন্মিয়াছে, তুমি কদাপি পরিচারিকা নও।

বিমলা ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন, “এ সন্দেহ আপনার মনে কেন জন্মিল?”

জ। বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা যে অম্বরপতির পুত্রবধূ হইতে পারেন না, তাহার বিশেষ কারণ আছে। সে অতি গুহ্য বৃত্তান্ত; তুমি পরিচারিকা হইলে সে গুহ্য কাহিনী কি প্রকারে জানিবে ? বিমলা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলেন। কিঞ্চিৎ কাতরস্বরে কহিলেন, “আপনি যথার্থ অনুভব করিয়াছেন; আমি পরিচারিকা নহি। অদৃষ্টক্রমে পরিচারিকার ন্যায় আছি। অদৃষ্টকেই বা কেন দোষি? আমার অদৃষ্ট মন্দ নহে!”

রাজকুমার বুঝিলেন যে, এই কথায় বিমলার মনোমধ্যে পরিতাপ উদয় হইয়াছে; অতএব তৎসম্বন্ধে আর কিছু বলিলেন না। বিমলা স্বতঃ কহিলেন, “যুবরাজ, আপনার নিকট পরিচয় দিব; কিন্তু এক্ষণে নয়। ও কি শব্দ? পশ্চাৎ কেহ আসিতেছে?”

এই সময়ে পশ্চাৎ পশ্চাৎ মনুষ্যের পদধ্বনি শ্রুত হইল। এমন বোধ হইল, যেন দুইজন মনুষ্য কাণে কাণে কথা কহিতেছে। তখন মন্দির হইতে প্রায় অর্ধ ক্রোশ অতিক্রম হইয়াছিল। রাজপুত্র কহিলেন, “আমার অত্যন্ত সন্দেহ হইতেছে, আমি দেখিয়া আসি |”

এই বলিয়া রাজপুত্র কিছু পথ প্রত্যাবর্তন করিয়া দেখিলেন এবং পথের পার্শ্বেও অনুসন্ধান করিলেন; কোথাও মনুষ্য দেখিতে পাইলেন না। প্রত্যাগমন করিয়া বিমলাকে কহিলেন, “আমার সন্দেহ হইতেছে, কেহ আমাদের পশ্চাদ্বর্তী হইয়াছে। সাবধানে কথা কহা ভাল |”

এখন উভয়ে অতি মৃদুস্বরে কথা কহিতে কহিতে চলিলেন। ক্রমে গড় মান্দারণ গ্রামে প্রবেশ করিয়া দুর্গসম্মুখে উপস্থিত হইলেন। রাজপুত্র জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি এক্ষণে দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিবে কি প্রকারে? এত রাত্রে অবশ্য ফটক বন্ধ হইয়া থাকিবে |”

বিমলা কহিলেন, “চিন্তা করিবেন না, আমি তাহার উপায় স্থির করিয়াই বাটী হইতে যাত্রা করিয়াছিলাম |”

রাজপুত্র হাস্য করিয়া কহিলেন, “লুকান পথ আছে?”

বিমলাও হাস্য করিয়া উত্তর করিলেন, “যেখানে চোর, সেইখানেই সিঁধ।”

ক্ষণকাল পরে পুনর্বার রাজপুত্র কহিলেন, “বিমলা, এক্ষণে আর আমার যাইবার প্রয়োজন নাই। আমি দুর্গপার্শ্বস্থ এই আম্রকানন মধ্যে তোমার অপেক্ষা করিব, তুমি আমার হইয়া অকপটে তোমার সখীকে মিনতি করিও; পক্ষ পরে হয়, মাস পরে হয়, আর একবার আমি তাঁহাকে দেখিয়া চক্ষু জুড়াইব |”

বিমলা কহিলেন, “এ আম্রকাননও নির্জন স্থান নহে; আপনি আমার সঙ্গে আসুন |”

জ। কত দূর যাইব?

বি। দুর্গমধ্যে চলুন।

রাজকুমার কিঞ্চিৎ ভাবিয়া কহিলেন, “বিমলা, এ উচিত হয় না। দুর্গ-স্বামীর অনুমতি ব্যতীত আমি দুর্গমধ্যে যাইব না |”



অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ : চতুরে চতুরে

বিমলা আসিয়া নিজ কক্ষে পালঙ্কের উপর বসিলেন। বিমলার মুখ অতি হর্ষপ্রফুল্ল; তিনি গতিকে মনোরথ সিদ্ধ করিয়াছেন। কক্ষমধ্যে প্রদীপ জ্বলিতেছে; সম্মুখে মুকুর; বেশভূষা যেরূপ প্রদোষকালে ছিল, সেইরূপই রহিয়াছে; বিমলা দর্পণাভ্যন্তরে মুহূর্তজন্য নিজ প্রতিমূর্তি নিরীক্ষণ করিলেন। প্রদোষকালে যেরূপ কুটিল-কেশবিন্যাস করিয়াছিলেন, তাহা সেইরূপ কর্ণাভরণ পীবরাংসসংসক্ত হইয়া দুলিতেছে। বিমলা উপাধানে পৃষ্ঠ রাখিয়া অর্ধ শয়ন, অর্ধ উপবেশন করিয়া রহিয়াছেন; বিমলা মুকুরে নিজ-লাবণ্য দেখিয়া হাস্য করিলেন। বিমলা এই ভাবিয়া হাসিলেন যে, দিগ্গরজ পণ্ডিত নিতান্ত নিষ্কারণে গৃহত্যাগী হইতে চাহেন নাই।

বিমলা জগৎসিংহের পুনরাগমন প্রতীক্ষা করিয়া আছেন, এমত সময়ে আম্রকাননমধ্যে গম্ভীর তূর্যনিনাদ হইল। বিমলা চমকিয়া উঠিলেন এবং ভীতা হইলেন; সিংহদ্বার ব্যতীত আম্রকাননে কখনই তূর্যধ্বনি হইয়া থাকে না, এত রাত্রেই বা তূর্যধ্বনি কেন হয়? বিশেষ সেই রাত্রে মন্দিরে গমনকালে ও প্রত্যাগমনকালে যাহা যাহা দেখিয়াছেন, তৎসমুদয় স্মরণ হইল। বিমলার তৎক্ষণাৎ বিবেচনা হইল, এ তূর্যধ্বনি কোন অমঙ্গল ঘটনার পূর্বলক্ষণ। অতএব সশঙ্কচিত্তে তিনি বাতায়ন-সন্নিধানে গিয়া আম্রকানন প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। কাননমধ্যে বিশেষ কিছুই দেখিতে পাইলেন না। বিমলা ব্যস্তচিত্তে নিজ কক্ষ হইতে নির্গত হইলেন; যে শ্রেণীতে তাঁহার কক্ষ, তৎপরেই প্রাঙ্গণ; প্রাঙ্গণপরেই আর এক কক্ষশ্রেণী; সেই শ্রেণীতে প্রসাদোপরি উঠিবার সোপান আছে। বিমলা কক্ষত্যাগপূর্বক সে সোপানাবলী আরোহণ করিয়া ছাদের উপর উঠিলেন; ইতস্তত: নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন; তথাপি কাননের গভীর ছায়ান্ধকার জন্য কিছুই লক্ষ্য করিতে পারিলেন না। বিমলা দ্বিগুণ উদ্বিগ্নচিত্তে ছাদের আলিসার নিকটে গেলেন; তদুপরি বক্ষ স্থাপনপূর্বক মুখ নত করিয়া দুর্গমূল পর্যন্ত দেখিতে লাগিলেন; কিছুই দেখিতে পাইলেন না। শ্যামোজ্জ্বল শাখাপল্লব সকল স্নিগ্ধ চন্দ্রকরে প্লাবিত; কখন কখন সুমন্দ পবনান্দোলনে পিঙ্গলবর্ণ দেখাইতেছিল; কাননতলে ঘোরান্ধকার, কোথাও কোথাও শাখাপত্রাদির বিচ্ছেদে চন্দ্রালোক পতিত হইয়াছে; আমোদরের স্থিরাম্বু-মধ্যে নীলাম্বর, চন্দ্র ও তারা সহিত প্রতিবিম্বিত; দূরে, অপরপারস্থিত অট্টালিকাসকলের গগনস্পর্শী মূর্তি, কোথাও বা তৎপ্রাসাদস্থিত প্রহরীর অবয়ব। এতদ্ব্যতীত আর কিছুই লক্ষ্য করিতে পারিলেন না। বিমলা বিষণ্ণ মনে প্রত্যাবর্তন করিতে উদ্যত হইলেন, এমন সময়ে তাঁহার অকস্মাৎ বোধ হইল, যেন কেহ পশ্চাৎ হইতে তাঁহার পৃষ্ঠদেশ অঙ্গুলি দ্বারা স্পর্শ করিল। বিমলা চমকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিলেন, একজন সশস্ত্র অজ্ঞাত পুরুষ দণ্ডায়মান রহিয়াছে। বিমলা চিত্রার্পিত পুত্তলীবৎ নিষ্পন্দ হইলেন।

শস্ত্রধারী কহিল, “চীৎকার করিও না। সুন্দরীর মুখে চীৎকার ভাল শুনায় না |”

যে ব্যক্তি অকস্মাৎ এইরূপ বিমলাকে বিহ্বল করিল, তাহার পরিচ্ছদ পাঠানজাতীয় সৈনিক পুরুষদিগের ন্যায়। পরিচ্ছদের পারিপাট্য ও মহার্ঘ গুণ দেখিয়া অনায়াসে প্রতীতি হইতে পারিত, এ ব্যক্তি কোন মহৎপদাভিষিক্ত। অদ্যাপি তাহার বয়স ত্রিংশতের অধিক হয় নাই; কান্তি সাতিশয় শ্রীমান, তাঁহার প্রশস্ত ললাটোপরি যে উষ্ণীষ সংস্থাপিত ছিল, তাহাতে এক খণ্ড মহার্ঘ হীরক শোভিত ছিল। বিমলার যদি তৎক্ষণে মনের স্থিরতা থাকিত, তবে বুঝিতে পারিতেন যে স্বয়ং জগৎসিংহের সহিত তুলনায় এ ব্যক্তি নিতান্ত ন্যূন হইবেন না; জগৎসিংহের সদৃশ দীর্ঘায়ত বা বিশালোরস্ক নহেন, কিন্তু তৎসদৃশ বীরত্বব্যঞ্জক সুন্দরকান্তি; তদধিক সুকুমার দেহ। তাঁহার বহুমূল্য কটিবন্ধে প্রবালজড়িত কোষমধ্যে দামাস্ক ছুরিকা ছিল; হস্তে নিষ্কোষিত তরবার। অন্য প্রহরণ ছিল না।



ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ : প্রেমিকে প্রেমিকে

বিমলা যখন দেখিলেন যে, চতুর ওসমান অন্যত্র গেলেন, তখন তিনি ভরসা পাইলেন যে কৌশলে মুক্তি পাইতে পারিবেন। শীঘ্র তাহার উপায় চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

প্রহরী কিয়ৎক্ষণ দণ্ডায়মান থাকিলে বিমলা তাহার সহিত কথোপকথন আরম্ভ করিলেন। প্রহরী হউক, আর যমদূতই হউক, সুন্দরী রমণীর সহিত কে ইচ্ছাপূর্বক কথোপকথন না করে? বিমলা প্রথমে এ ও সে নানাপ্রকার সামান্য বিষয়ক কথাবার্তা কহিতে লাগিলেন। ক্রমে প্রহরীর নাম ধাম গৃহকর্ম সুখ দু:খ বিষয়ক নানা পরিচয় জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। প্রহরী নিজ সম্বন্ধে বিমলার এতদূর পর্যন্ত ঔৎসুক্য দেখিয়া বড়ই প্রীত হইল। বিমলাও সুযোগ দেখিয়া ক্রমে ক্রমে নিজ তূণ হইতে শাণিত অস্ত্র সকল বাহির করিতে লাগিলেন। একে বিমলার অমৃতময় রসালাপ, তাহাতে আবার তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিশাল চক্ষুর অব্যর্থ কটাক্ষসন্ধান, প্রহরী একেবারে গলিয়া গেল। যখন বিমলা প্রহরীর ভঙ্গীভাবে দেখিলেন যে, তাহার অধঃপাতে যাইবার সময় হইয়া আসিয়াছে, তখন মৃদু মৃদু স্বরে কহিলেন, “আমার কেমন ভয় করিতেছে, সেখজী, তুমি আমার কাছে বসো না |”

প্রহরী চরিতার্থ হইয়া বিমলার পার্শ্বে বসিল। ক্ষণকাল অন্য কথোপকথনের পর বিমলা দেখিলেন যে, ঔষধ ধরিয়াছে। প্রহরী নিকটে বসিয়া অবধি ঘন ঘন তাঁহার পানে দৃষ্টিপাত করিতেছে। তখন বলিলেন, “সেখজী, তুমি বড় ঘামিতেছ; একবার আমার বন্ধন খুলিয়া দাও যদি, তবে আমি তোমাকে বাতাস করি, পরে আবার বাঁধিয়া দিও |”

সেখজীর কপালে ঘর্মবিন্দুও ছিল না, কিন্তু বিমলা অবশ্য ঘর্ম না দেখিলে কেন বলিবে? আর এ হাতের বাতাস কার ভাগ্যে ঘটে? এই ভাবিয়া প্রহরী তখনই বন্ধন খুলিয়া দিল।

বিমলা কিয়ৎক্ষণ ওড়না দ্বারা প্রহরীকে বাতাস দিয়া স্বচ্ছন্দে ওড়না নিজ অঙ্গে পরিধান করিলেন। পুনর্বন্ধনের নামও করিতে প্রহরীর মুখ ফুটিল না। তাহার বিশেষ কারণও ছিল; ওড়নার বন্ধনরজ্জুত্ব দশা ঘুচিয়া যখন তা বিমলার অঙ্গে শোভিত হইল, তখন তাঁহার লাবণ্য আরও প্রদীপ্ত হইল; যে লাবণ্য মুকুরে দেখিয়া বিমলা আপনা আপনি হাসিয়াছিলেন, সেই লাবণ্য দেখিয়া প্রহরী নিস্তব্ধ হইয়া রহিল।

বিমলা কহিলেন, “সেখজী, তোমার স্ত্রী তোমাকে কি ভালবাসে না?”

সেখজী কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন?”

বিমলা কহিলেন, “ভালবাসিলে এ বসন্ত কালে (তখন ঘোর গ্রীষ্ম, বর্ষা আগত) কোন্ প্রাণে তোমা হেন স্বামীকে ছাড়িয়া আছে?”

সেখজী এক দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিল।

বিমলার তূণ হইতে অনর্গল অস্ত্র বাহির হইতে লাগিল। “সেখজী! বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু তুমি যদি আমার স্বামী হইতে, তবে আমি কখন তোমাকে যুদ্ধে আসিতে দিতাম না |”

প্রহরী আবার নিশ্বাস ছাড়িল। বিমলা কহিতে লাগিলেন, “আহা! তুমি যদি আমার স্বামী হতে!”

বিমলাও এই বলিয়া একটি ছোট রকম নিশ্বাস ছাড়িলেন, তাহার সঙ্গে সঙ্গে নিজ তীক্ষ্ণ-কুটিল কটাক্ষ বিসর্জন করিলেন; প্রহরীর মাথা ঘুরিয়া গেল। সে ক্রমে ক্রমে সরিয়া সরিয়া বিমলার আরও নিকটে আসিয়া বসিল, বিমলাও আর একটু তাহার দিকে সরিয়া বসিলেন।

বিমলা প্রহরীর করে কোমল কর-পল্লব স্থাপন করিলেন। প্রহরী হতবুদ্ধি হইয়া উঠিল।

বিমলা কহিতে লাগিলেন, “বলিতে লজ্জা করে, কিন্তু তুমি যদি রণজয় করিয়া যাও, তবে আমাকে কি তোমার মনে থাকিবে?”


বিংশ পরিচ্ছেদ : প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে

বিমুক্তি লাভ করিয়া বিমলার প্রথম কার্য বীরেন্দ্রসিংহকে সংবাদ দান। ঊর্ধ্বশ্বাসে বীরেন্দ্রের শয়নকক্ষাভিমুখে ধাবমানা হইলেন।

অর্ধপথ যাইতে না যাইতেই “আল্লা – ল্লা – হো” পাঠান সেনার চীৎকারধ্বনি তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল।

“এ কি পাঠান সেনার জয়ধ্বনি!” বলিয়া বিমলা ব্যাকুলিত হইলেন। ক্রমে অতিশয় কোলাহল শ্রবণ করতে পাইলেন; - বিমলা বুঝিলেন, দুর্গবাসীরা জাগরিত হইয়াছে।

ব্যস্ত হইয়া বীরেন্দ্রসিংহের শয়নকক্ষে গমন করিয়া দেখেন যে, কক্ষমধ্যেও অত্যন্ত কোলাহল; পাঠান সেনা দ্বার ভগ্ন করিয়া কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিয়াছে; বিমলা উঁকি মারিয়া দেখিলেন যে, বীরেন্দ্রসিংহের মুষ্টি দৃঢ়বদ্ধ, হস্তে নিষ্কোষিত অসি, অঙ্গে রুধিরধারা। তিনি উন্মত্তের ন্যায় অসি ঘূর্ণিত করিতেছেন। তাঁহার যুদ্ধোদ্যম বিফল হইল; একজন মহাবল পাঠানের দীর্ঘ তরবারির আঘাতে বীরেন্দ্রের অসি হস্তচ্যুত হইয়া দূরে নিক্ষিপ্ত হইল; বীরেন্দ্রসিংহ বন্দী হইলেন।

বিমলা দেখিয়া শুনিয়া হতাশ হইয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। এখনও তিলোত্তমাকে রক্ষা করিবার সময় আছে। বিমলা তাহার কাছে দৌড়িয়া গেলেন। পথিমধ্যে দেখিলেন, তিলোত্তমার কক্ষে প্রত্যাবর্তন করা দু:সাধ্য; সর্বত্র পাঠান সেনা ব্যাপিয়াছে। পাঠানদিগের যে দুর্গজয় হইয়াছে, তাহাতে আর সংশয় নাই।

বিমলা দেখিলেন, তিলোত্তমার ঘরে যাইতে পাঠান সেনার হস্তে পড়িতে হয়। তিনি তখন ফিরিলেন। কাতর হইয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, কি করিয়া জগৎসিংহ আর তিলোত্তমাকে এই বিপত্তিকালে সংবাদ দিবেন। বিমলা একটা কক্ষমধ্যে দাঁড়াইয়া চিন্তা করিতেছেন, এমত সময়ে কয়েকজন সৈনিক অন্য ঘর লুঠ করিয়া, সেই ঘর লুঠিতে আসিতেছে দেখিতে পাইলেন। বিমলা অত্যন্ত শঙ্কিত হইয়া ব্যস্তে কক্ষস্থ একটা সিন্দুকের পার্শ্বে লুকাইলেন। সৈনিকেরা আসিয়া ঐ কক্ষস্থ দ্রব্যজাত লুঠ করিতে লাগিলেন। বিমলা দেখিলেন, নিস্তার নাই, লুঠেরা সকল যখন ঐ সিন্দুক খুলিতে আসিবে, তখন তাঁহাকে অবশ্য ধৃত করিবে। বিমলা সাহসে নির্ভর করিয়া কিঞ্চিৎ কাল অপেক্ষা করিলেন, এবং সিন্দুক পার্শ্ব হইতে সাবধানে সেনাগণ কি করিতেছে দেখিতে লাগিলেন। বিমলার অতুল সাহস; বিপৎকালে সাহস বৃদ্ধি হইল। যখন দেখিলেন যে, সেনাগণ নিজ নিজ দস্যুবৃত্তিতে ব্যাপৃত হইয়াছে, তখন নি:শব্দপদবিক্ষেপে সিন্দুকপার্শ্ব হইতে নির্গত হইয়া পলায়ন করিলেন। সেনাগণ লুঠে ব্যস্ত, তাঁহাকে দেখিতে পাইল না। বিমলা প্রায় কক্ষদ্বার পশ্চাৎ করেন, এমন সময়ে একজন সৈনিক আসিয়া পশ্চাৎ হইতে তাঁহার হস্ত ধারণ করিল। বিমলা ফিরিয়া দেখিলেন, রহিম সেখ! সে বলিয়া উঠিল, “তবে পলাতকা? আর কোথায় পলাবে?”

দ্বিতীয়বার রহিমের করকবলিত হওয়াতে বিমলার মুখ শুকাইয়া গেল; কিন্তু সে ক্ষণকালমাত্র; তেজস্বিনী বুদ্ধির প্রভাবে তখনই মুখ আবার হর্ষোৎফুল্ল হইল। বিমলা মনে মনে কহিলেন, “ইহারই দ্বারা স্বকর্ম উদ্ধার করিব |” তাহার কথার প্রত্যুত্তরে কহিলেন, “চুপ কর, আস্তে, বাহিরে আইস |”

এই বলিয়া বিমলা রহিম সেখের হস্ত ধরিয়া বাহিরে টানিয়া আনিলেন; রহিমও ইচ্ছাপূর্বক আসিল। বিমলা তাহাকে নির্জনে পাইয়া বলিলেন, “ছি ছি ছি! তোমার এমন কর্ম! আমাকে রাখিয়া তুমি কোথায় গিয়েছিলে? আমি তোমাকে না তল্লাস করিয়াছি এমন স্থান নাই!” বিমলা আবার সেই কটাক্ষ সেখজীর প্রতি নিক্ষেপ করিলেন।

সেখজীর গোসা দূর হইল; বলিল, “আমি সেনাপতিকে জগৎসিংহকে সংবাদ দিবার জন্য তল্লাস করিয়া বেড়াইতেছিলাম, সেনাপতির নাগাল না পাইয়া তোমার তল্লাসে ফিরিয়া আসিলাম, তোমাকে ছাদে না দেখিয়া নানা স্থানে তল্লাস করিয়া বেড়াইতেছি |”



একবিংশ পরিচ্ছেদ : খড়্গে খড়্গে

বিমলাকে দেখিয়া জগৎসিংহ জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিসের কোলাহল?”

বিমলা কহিলেন, “পাঠানের জয়ধ্বনি। শীঘ্র উপায় করুন; শত্রু আর তিলার্ধ মাত্রে এ ঘরের মধ্যে আসিবে |”

জগৎসিংহ ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া কহিলেন, “বীরেন্দ্রসিংহ কি করিতেছেন?”

বিমলা কহিলেন, “তিনি শত্রুহস্তে বন্দী হইয়াছেন |”

তিলোত্তমার কণ্ঠ হইতে অস্ফুট চীৎকার নির্গত হইল; তিনি পালঙ্কে মূর্ছিতা হইয়া পড়িলেন।

জগৎসিংহ বিশুষ্কমুখ হইয়া বিমলাকে কহিলেন, “দেখ দেখ, তিলোত্তমাকে দেখ |”

বিমলা তৎক্ষণাৎ গোলাবপাশ হইতে গোলাব লইয়া তিলোত্তমার মুখে কণ্ঠে কপোলে সিঞ্চন করিলেন, এবং কাতর চিত্তে ব্যজন করিতে লাগিলেন।

শত্রু–কোলাহল আরও নিকট হইল; বিমলা প্রায় রোদন করিতে করিতে কহিলেন, “ঐ আসিতেছে!– রাজপুত্র! কি হইবে?”

জগৎসিংহের চক্ষু: হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতে লাগিল। কহিলেন, “একা কি করিতে পারি? তবে তোমার সখীর রক্ষার্থে প্রাণত্যাগ করিব |”

শত্রুর ভীমনাদ আরও নিকটবর্তী হইল। অস্ত্রের ঝঞ্জনাও শুনা যাইতে লাগিল। বিমলা চীৎকার করিয়া উঠিলেন, “তিলোত্তমা! এ সময়ে কেন তুমি অচেতন হইলে? তোমাকে কি প্রকারে রক্ষা করিব?”

তিলোত্তমা চক্ষুরুন্মীলন করিলেন। বিমলা কহিলেন, “তিলোত্তমার জ্ঞান হইতেছে; রাজকুমার! রাজকুমার! এখনও তিলোত্তমাকে বাঁচাও |”

রাজকুমার কহিলেন, “এ ঘরের মধ্যে থাকিলে কার সাধ্য রক্ষা করে! এখনও যদি ঘর হইতে বাহির হইতে পারিতে, তবে আমি তোমাদিগকে দুর্গের বাহিরে লইয়া যাইতে পারিলেও পারিতাম; কিন্তু তিলোত্তমার ত গতিশক্তি নাই। বিমলে! ঐ পাঠান সিঁড়িতে উঠিতেছে। আমি অগ্রে প্রাণ দিবই, কিন্তু পরিতাপ যে, প্রাণ দিয়াও তোমাদের বাঁচাইতে পারিলাম না |”

বিমলা পলকমধ্যে তিলোত্তমাকে ক্রোড়ে তুলিয়া কহিলেন, “তবে চলুন; আমি তিলোত্তমাকে লইয়া যাইতেছি।”

বিমলা আর জগৎসিংহ তিন লম্ফে কক্ষদ্বারে আসিলেন। চারি জন পাঠান সৈনিকও সেই সময়ে বেগে ধাবমান হইয়া কক্ষদ্বারে আসিয়া পড়িল। জগৎসিংহ কহিলেন, “বিমলা, আর হইল না, আমার পশ্চাতে আইস |”

পাঠানেরা শিকার সম্মুখে পাইয়া “আল্লা–ল্লা–হো” চীৎকার করিয়া, পিশাচের ন্যায় লাফাইতে লাগিল। কটিস্থিত অস্ত্রে ঝঞ্ঝনা বাজিয়া উঠিল। সেই চীৎকার শেষ হইতে না হইতেই জগৎসিংহের অসি একজন পাঠানের হৃদয়ে আমূল সমারোপিত হইল। ভীম চীৎকার করিতে করিতে পাঠান প্রাণত্যাগ করিল। পাঠানের বক্ষ হইতে অসি তুলিবার পূর্বেই আর একজন পাঠানের বর্শাফলক জগৎসিংহের গ্রীবাদেশে আসিয়া পড়িল; বর্শা পড়িতে না পড়িতেই বিদ্যুদ্বৎ হস্তচালনা দ্বারা কুমার সেই বর্শা বাম করে ধৃত করিলেন; এবং তৎক্ষণাৎ সেই বর্শারই প্রতিঘাতে বর্শানিক্ষেপীকে ভূমিশায়ী করিলেন। বাকি দুই জন পাঠান নিমেষমধ্যে এককালে জগৎসিংহের মস্তক লক্ষ্য করিয়া অসি প্রহার করিল; জগৎসিংহ পলক ফেলিতে অবকাশ না লইয়া দক্ষিণ হস্তস্থ অসির আঘাতে একজনের অসির আঘাতে একজনের অসি সহিত প্রকোষ্ঠচ্ছেদ করিয়া ভূতলে ফেলিলেন; দ্বিতীয়ের প্রহার নিবারণ করিতে পারিলেন না; অসি মস্তকে লাগিল না বটে, কিন্তু স্কন্ধদেশে দারুণ আঘাত পাইলেন। কুমার আঘাত পাইয়া যন্ত্রণায় ব্যাধশরস্পৃষ্ট ব্যাঘ্রের ন্যায় দ্বিগুণ প্রচণ্ড হইলেন; পাঠান অসি তুলিয়া পুনরাঘাতের উদ্যম করতে না করিতেই কুমার, দুই হস্তে দুঢ়তর মুষ্টিবদ্ধ করিয়া ভীষণ অসি ধারণপূর্বক লাফ দিয়া আঘাতকারী পাঠানের মস্তকে মারিলেন, উষ্ণীষ সহিত পাঠানের মস্তক দুই খণ্ড হইয়া পড়িল। কিন্তু এই অবসরে যে সৈনিকের হস্তচ্ছেদ হইয়াছিল, সে বাম হস্তে কটি হইতে তীক্ষ্ণ ছুরিকা নির্গত করিয়া রাজপুত্র-শরীর লক্ষ্য করিল, যেমন রাজপুত্রের উল্লম্ফোত্থিত শরীর ভূতলে অবতরণ করিতেছিল, অমনি সেই ছুরিকা রাজপুত্রের বিশাল বাহুমধ্যে গভীর বিঁধিয়া গেল। রাজপুত্র সে আঘাত সূচীবেধ মাত্র জ্ঞান করিয়া পাঠানের কটিদেশে পর্বতপাতবৎ পদাঘাত করিলেন, যবন দূরে নিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল। রাজপুত্র বেগে ধাবমান হইয়া তাহার শিরচ্ছেদ করিতে উদ্যোগ হইতেছিলেন, এমন সময়ে ভীমনাদে “আল্লা –ল্লা – হো” শব্দ করিয়া অগণিত পাঠানসেনাস্রোত কক্ষমধ্যে প্রবেশ করিল। রাজপুত্র দেখিলেন, যুদ্ধ করা কেবল মরণের কারণ।

------------------- প্রথম খণ্ড সমাপ্ত --------------------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন